You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.24 | ভাসানী মুজিবের সহিত ভুট্টোর সাক্ষাৎকার | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
ভাসানী মুজিবের সহিত ভুট্টোর সাক্ষাৎকার
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

গতকাল (রবিবার) পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জেড এ ভুট্টো ঢাকা আগমনের পর মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবর রহমানের সহিত একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। এই তিন নেতার মধ্যকার বিভিন্ন বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হইতেছে। এই সকল বৈঠকে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, রাজশাহী প্রভৃতি স্থানে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণজনিত পরিস্থিতি আলোচিত হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ।
মওলানা ভাসানীর সহিত তাঁহার আলোচনা সন্তোষজনক বলিয়া জনাব ভুট্টো প্রকাশ করেন।
অবশ্য তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে গুলীবর্ষণ অব্যাহত থাকায় বিশেষ করিয়া এই দিনে ঢাকায় নতুন করিয়া গুলিবর্ষণের ফলে সমস্যাকে আরও জটিল করিয়া তুলিয়াছে; ফলে প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠকে তিনি যোগদান করিবেন কিনা উহা বলা এই মূহুর্ত তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইতেছে না। পিপিপি প্রধান বলেন যে, সরকার একদিকে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছেন অপর পক্ষে নির্যাতন ও দমননীতি সমানে চালাইয়া যাইতেছেন। প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব কর্তৃক অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্তের ফলে তাঁহার মতামত জিজ্ঞাসা করা হইলে জনাব ভুট্টো বলেনঃ ইহা শেখ মুজিবের বিবেচনার বিষয়।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, তিনি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মধ্যকার বিরোধ সীমিত করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাইতেছেন। তিনি বলেন যে, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও তাঁহার দলের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি এখনও বলবৎ রহিয়াছে।
জনাব ভুট্টো পরে রাত্রে শেখ মুজিবের সহিত দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। এই সভা শেষে তিনি মওলানা ভাসানীর সহিত পুনরায় মিলিত হইবেন।
জনাব জেড, এ, ভুট্টো পূর্বাহ্নে ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতীয় সমস্যার সমাধানে গোলটেবিল বৈঠক একমাত্র মোক্ষম বিষয় হইতে পারে না। আমাদিগকে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অবশ্যই খোলা মন লইয়া বিষয়টি বিবেচনা করিতে হাইবে। তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবর সহ সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দানের ফলে প্রস্তাবিত সম্মেলনের পথে প্রধান অন্তরায় সমূহ দূরীভূত হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু সম্মেলনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার আরও কতিপয় অসুবিধা বিদ্যমান রহিয়াছে। আর স্বৈরতন্ত্রের এজেন্টরা ইহাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতে পারে। তিনি বলেন যে, অত্যাচারের প্রতীক গভর্ণর মোনায়েম খান এখনও গদীনসীন রহিয়াছেন।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, সরকার এখন নির্বিচারে গুলী চালনা করিয়া পরিবেশকে জটিল করিয়া রাখিয়াছেন। প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের প্রশ্নে তাঁহার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনা করিবেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি সরাসরি উক্ত আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন নাই।
তিনি বলেন যে, ঢাকায় মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সহিত আলোচনা শেষে এ ব্যাপারে তিনি মতামত প্রকাশ করিতে সক্ষম হইবেন। তিনি আরও বলেন, একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিন বাসী হইয়া গিয়াছে। অথচ বিগত ১১ বছর যাবত উহাই ছিল যুগের ধারা। জনাব ভুট্টো বলেন যে, সরকার বিরোধীদলসমূহের মধ্যকার ঐক্যকে দুর্বল করার জন্য সদা সচেষ্ট রহিয়াছে। তিনি বলেন, নীতির ভিত্তিতে বিরোধীদলসমূহের মধ্যে ঐক্য দৃঢ়তর হইতে পারে। তিনি বলেনঃ তিনি বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের নিকট তারবার্তা প্রেরণ করিয়া জাতীয় সমস্যা সমাধানে তাঁহার পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দান করেন।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে যদি পূর্ব পাকিস্তান হইতে সর্বসম্মত প্রার্থী দেওয়া হয় তাহা হইলে তিনি উহার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবেন না।
তিনি ছাত্রদের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, ছাত্র নেতারাই আজকের দিনের সত্যিকার নেতা। তাহারাই আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করিয়াছে। এবং এই বিজয় গৌরব পাকিস্তানের যুব সমাজেরই প্রাপ্য।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা কর্মসূচী সম্পর্কে মন্তব্য করিতে বলা হইলে তিনি বলেন যে, জনগণের নিকট হইতে উত্থিত সকল দাবী অত্যন্ত সতর্কতার সহিত পরীক্ষা ও বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, আমাদের সংগ্রাম শেষ হইয়াছে উহা ধরিয়া লওয়া ঠিক হইবে না। সমগ্র দেশের জনগণ, কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রগণ বিরাট ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। তাহারা স্বৈরাচারী শক্তির মোকাবিলায় মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে এবং প্রমাণ করিয়াছে যে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন পাশব শক্তিই অধিকতর ক্ষমতাশালী নহে। তিনি বলেন, সরকার তার শক্তি প্রয়োগ করিয়াছে আর উহার ফলে জনগণ এই ‘ডাঞ্জ’ ভঙ্গ করিয়াছে। দেশরক্ষা বিধিবলে আটকাবস্থা হইতে মুক্তিলাভের পর জনাব ভুট্টোর ইহাই প্রথম ঢাকা সফর। তিনি ঢাকায় আগমনের পর শহীদ মিনার পরিদর্শন ও উহাতে পুষ্পস্তবক দান করেন। তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত বর্তমান সরকারের গুলীর শিকার সংগ্রামী বীরদের সহিত সাক্ষাৎ করেন। তিনি আজিমপুর গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত শহীদদের মাজার পরিদর্শন ও ফাতেহা পাঠ করেন।
ইহাছাড়া শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীনের মাজারও পরিদর্শন এবং ফাতেহা পাঠ করেন।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯