বিলাতের পত্রপত্রিকার ভূমিকা আগস্ট ৭১
বিলাতে বহুল প্রচারিত পত্রিকা ‘দি সানডে টাইমস’ ১ আগস্ট মুরে সাইল (M, Syel) এর একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার কোন আপােষ সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করা হয়। পূর্ববঙ্গ” পরিধি সম্পর্কে পাকিস্তান যে পরিমাণ অবাস্তব ও মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে পাকিতা ভিয়েতনামের মতাে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে প্রবন্ধে আশংকা করা হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানী সেনাদের হতাহতের সংখ্যা যে দিন দিন বছি পাচ্ছে তার ইঙ্গিত হিসাবে পাকিস্তানী আহত সৈন্যদের বিমানযােগে ঢাকা থেকে করাচী। প্রেরণের বিবরণ উক্ত নিবন্ধে প্রকাশিত হয়। পূর্ব বঙ্গের সামরিক হাসপাতালগুলােতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আহত সৈন্যদের করাচী স্থানান্তর করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের ঢাকা গমনের ঘােষণা ও ঢাকায় সংঘটিত যুদ্ধের কিছু বিবরণ প্রকাশিত হয়। ২ আগস্ট ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত ইকনমিক কাউন্সিলর বাঙালি কর্মকর্তা এ. এম, মুহিতের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবর প্রকাশিত হয়। একই দিনে দি টাইমস্ সহ বিলাতের প্রায় সকল পত্রপত্রিকায় ১ আগস্টে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এ্যাকশন বাংলাদেশ কর্তৃক আয়ােজিত জনসভার খবর প্রকাশিত হয়। ট্রাফেলগার স্কোয়ারের জনসভায় ঘােষণার মাধ্যমে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব বাঙালি কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবরটি উক্ত পত্রিকায় প্রাধান্য পায়। ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পাকিস্তানে বন্দী ও বিচারাধীন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করে বৃটিশ পার্লামেন্টে এক প্রস্তাব পেশ করার খবর প্রকাশিত হয়। গত ১৫ জুন বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়। পিটার শাের, এডওয়ার্ড ডুকান, আর্নেষ্ট মারপল্স, জন ষ্টোনহাউজ এবং মাইকেল স্টুয়ার্ট উপরােক্ত উদ্যোগের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
৫ আগষ্ট “দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশের প্রাত সহানুভূতিপূর্ণ একটি প্রস্তাব গ্রহণের খবর প্রকাশ করে সংবাদে বলা হয় যে, বাংলাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং শরণার্থীরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে আমেরিকার সাহায্য দান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত হয়। ৬ আগস্ট ‘দি টাইমস এবং এবং দি গার্ডিয়ান পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। উক্ত শ্বেতপত্রে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলীর অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা বিবরণ দিয়ে সকল ঘটনার জন্য য়ামী লীগকে এবং ভারতকে দায়ী করা হয়। ৭ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পিটার হেজেলহার্সট এক সংবাদ সমীক্ষায় এ পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনার ইঙ্গিত প্রদান করেন। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি সােভিয়েত মন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকোর অপ্রত্যাশিত দিল্লী সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য মিস ক্লেয়ার হােলিংয়ার্থ প্রেরিত সংবাদ, মন্তব্য করা হয়। ৭ আগস্ট “দি ভারত ও পাকিস্তানের মতে গৃহীত কয়েকটি রাজনৈ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ঘােমিয়ে করেন। – আগস্ট ‘দি সানডে টাইমস্’ পত্রিকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার ছাপানাে হয়। সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বৃটেনের বিরুদ্ধে ভারত প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রধান সমালােচক হিসাবে অভিযােগ করে পাকিস্তানের কমনওয়েলথ ত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বৃটিশ সাংবাদিকদেরও কঠোর সমালােচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপরােক্ত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বটেনের পত্রপত্রিকা বৃটিশ জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থকে পরিণত করতে কি পরিমাণ ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল।
‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ৯ আগস্টে এক সম্পাদকীয় মন্তব্য সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানী দূতাবাস ও মিশনে কর্মরত ১৫ জন কূটনৈতিক কর্মকর্তার একযােগে পদত্যাগের ঘটনাকে ইয়াহিয়া খানের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়। সম্পাদকীয় তে এক পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, Nothing is likely to persuade him yet if anything still can, it ought to be the dignified resignations of East Pakistani diplomats. The group that had resigned in Washington and New York is only the most dramatic group to have gone. Others have gone singly. More will undoubtedly go. Theirs is a powerful witness. Diplomats are normally among the last people to resign. When it happens it commands attention.” | ১০ আগস্ট লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রায় সকল পত্রিকায় পাকিস্তানে গঠিত একটি সামরিক পলিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার শুরু হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এই *তে ১০ আগষ্ট “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় যে, এই শমূলক বিচার অনুষ্ঠানের ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের যে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল তারও অপমৃত্যু হলাে। এই বিচার অনষ্ঠা ইয়াহিয়া খানের একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করে সম্পাদকীয়তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী বলে আশংকা করা হয় । সম্পাদকীয়তে মত করা হয় যে, “So also does Yahya Khan’s incredible decision to star the secret military trial of Sheikh Mujibur Rahman this we India and Pakistan are running out of all options but Open conflict fast.” | ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ১২ আগস্টে মিস, ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ পরিবেশিত খবরে ঢাকার কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পরিচালিত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের বিবরণ দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে এই আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে ‘দি টাইমস পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য সকল সংশ্লিষ্ট মহলকে জোরালাে পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানান। সম্পাদকীয়তে এই প্রহসনমূলক গােপন বিচারের তীব্র নিন্দা জানানাে হয় এবং পাকিস্তানের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জাকর বলে অভিহিত করা হয়।
১৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় শ্রমিকদলীয় এম, পি, টমাস উইলিয়াস এর একটি। পত্র গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। পত্রে টমাস উইলয়াস বলেন, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আনীত অভিযােগগুলাে যােগ করার খবরে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাছাড়া এই গােপন বিচারে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানী আইনজীবী ছাড়া অন্য কাউকে সুযােগ না দেয়ার সিদ্ধান্তে এটা পরিষ্কার যে শেখ মুজিব ন্যায় বিচার পাবেন না বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, টমাস উইলিয়ামস্ ১৯৬৯ সনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। একই দিন (১৩ আগস্ট) “দি ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকার জাতিসংঘ সংবাদদাতা প্রেরিত এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবের সামরিক আদালতে গােপন বিচার এবং নিরাপত্তার বিষয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট পর্দার অন্তরালে পাকিস্তান সামরিক শাসকদের সাথে যােগাযােগ রাখছেন এবং সক্রিয় আছেন। ১৫ আগস্ট ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল ভােটাধিক্যে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতার প্রতি ইয়াহিয়া খানের এ হেন আচরণে তিক্ততা আরাে বৃদ্ধি হবে এবং করুণ পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবিত হবে। ১৫ আগস্ট ‘দি অবজারভার পত্রিকায় একই বিষয় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় যে, বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রসে মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানী নির্যাতন নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পাদকীয়তে ইয়াহিয়া খানকে হুশিয়ারি করে বলা হয় যে, তার এই ভুল পদক্ষেপের ফলে এক সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় সবে এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিবে। গস্ট লন্ডনের রবিবারের পত্রিকা “সানডে টেলিগ্রাফ” এ প্রকাশিত এক খবরে না যায় যে, জনৈক ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ সামরিক আদালত | শহরে একটি সার্কিট হাউজে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করেছে।
গােপনে বিচারকার্য পরিচালনা করার কারণে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ। সমূহের বিবরণ জানা যায়নি বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আরাে ৬৮টি সংগ্রাম পরিষদের সমর্থন পুষ্ট হয়ে ১৬ আগস্ট দি ঢাইমস পত্রিকায় একটি অপৃষ্ঠা ব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। বিজ্ঞাপনে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়। ২১ আগস্ট “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানের আইনজীবী এ, কে, ব্রোহী রাজী হয়েছেন বলে খবর পরিবেশিত হয় । ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ক্যানাডার টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী ২২ আগস্ট প্রকাশ লাভ করে। উল্লেখিত সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই উপমহাদেশে সৃষ্ট সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান হবে বলে মত প্রকাশ করা হয়। ২৮ আগস্ট ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ সহ অন্যান্য পত্রিকায় লন্ডনের বেইজ ওয়াটার এলাকায় ২৪ নং পেমৃব্রিজ গার্ডেনে বাংলাদেশ মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের খবর পরিবেশন করা হয় । ৩০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় “Washington and Bangladesh” শিরােনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করে মানবাধিকার লংঘনের অভিযােগ এনে এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনের করণীয় সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়। গত ডিসেম্বরে যে অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে সেখানে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ, হত্যা, ধর্ষণ ও দুর্ভিক্ষের মতাে এক ভয়াবহ অবস্থা চলছে। এ হেন পরিস্থিতিতে বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার এ্যালেক ডগলাস হিউমকে ওয়াশিংটন সফর করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা এবং বৃটেনের মনােভাবের কথা অবহিত করার জন্য সম্পাদকীয়তে পরামর্শ দেয়া হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন