বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা (মে ‘৭১)
বিলাত সফরে আগত পাকিস্তানী ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ স্টুডেন্ট একশন কমিটিসহ প্রবাসী বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটিসমূহের বিক্ষোভের কর্মসূচী গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ১ মে তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে আশংকা করা হয় যে, প্রবাসীদের বিক্ষোভের কারণে যদি ক্রিকেট খেলায় বিঘ্ন ঘটে তাহলে বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ ক্রীড়ামােদী জনগােষ্ঠীর সহানুভূতি ও সমর্থন হারাতে পারে। তবে নিবন্ধে একথাও স্বীকার করা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রামকে পদদলিত করার জন্য পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বৃটেন ও আমেরিকাসহ বিশ্ববাসী যদি নিচুপ থাকেন তাহলে প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। ১ মে দি টাইমস’ পত্রিকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বরাত দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশংকা প্রকাশ করে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদে আরাে জানা যায় যে, মিঃ ভুট্টো উক্ত সম্ভাব্য যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন। বৃটেনের বামপন্থী পত্রিকা “মর্নিং সান” ৪ এপ্রিলে প্রকাশিত খবরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থনের কথা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পাটি বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক দেশ সমূহের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থনের আবেদন জানিয়েছেন বলে উক্ত খবরে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের ছয়টি প্রভাবশালী ট্রেড ইউনিয়ন সমবায়ে গঠিত বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নও বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন বলেও উক্ত সংবাদে জানা যায়। এর ফলে বৃটেনে প্রবাসী প্রগতিশীল কর্মীদের মধ্যে ইতোপূর্বে প্রকাশিত | খবরে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান হয়। বার্মিংহামের কাছে এজবাষ্টন ক্রিকেট মাঠে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তান ক্রিকেট | টিমের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের খবর ‘মর্নিং সান’ পত্রিকায় ৬ মে ফলাওভাবে প্রকাশিত হয়। ৬ মে তারিখে “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স সাভিসের ডি, জি, মেজর জেনারেল মােহাম্মদ আকবর খানের বরাত দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক “The Evening standard” পত্রিকায় ৬ মে “Time শিরােনামের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয় যে, “This is not a it is virtually a war between two nations, clumsily unite 1947 and now quite clearly imcompatible.”
৭ মে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় “The world’s latest refugees” শিরােনামে এক প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শরণার্থী সমস্যার কথা বিশ্ববিবেকের কা ধরা হয়। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বর্বরতার ফলে যে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে এই প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয় । ‘দি অবজারভার পত্রিকা ৯ মে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে এক নিবন্ধে এ পর্যন্ত যে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে ভারত যে ব্রিতকর অবস্থায় পড়েছে তার আলােচনা করা হয়। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শরণার্থীদের সংখ্যা ৫০ লক্ষে দাঁড়াবে বলে নিবন্ধে আশংকা প্রকাশ করা হয় এবং এ ব্যাপারে আঞ্চলিক শান্তি ভঙ্গের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়। ১৩ মে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা “The silent conscience” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। অবশেষে পরের দিন (১৪ মে) বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা হবে এই প্রেক্ষাপটে উক্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বৃটিশ পার্লামেন্টের এম, পি, দের কাছ থেকে বৃটিশ জনগণ ও বিশ্ব বিবেক কি প্রত্যাশা করে তা বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। নিবন্ধে এক অংশে বলা হয় যে How many died. Millions, says the Bangla propagandists. Perhaps 15000 say Yahya’s spokesmen. But crucially even fifteen thousand corpses is an absurd price to pay for keeping the two distant giants of Pakistan in miserable liaison.” নিবন্ধে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের ধারণার অপমৃত্যু হয়েছে-বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার। ক্ষয়ক্ষতি ও হত্যাকাণ্ড এড়ানাের উদ্দেশ্যে সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সেনা শাসনকে বৃটেন যত দ্রুত বাধ্য করতে পারবে ততই মঙ্গল হবে।
নিবন্ধে এক পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, “How should a Government which belives in freedon act in these circumstances? It should not hide behind the diplomatic niceties of “internal matter”. It should have an open view.” এ পর্যায়ে বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের এবং সরকারের কি কি করণীয় রয়েছে তাও বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। বাংলাদেশ সংক্রান্ত পালামেন্ট ডিবেটকে সামনে রেখে ১৩ মে ‘দি টাইমসূ’ পত্রিকায়। নাটনের ২০৬ জন বৃদ্ধিজীবী, পালামেন্ট সদস্য ও অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত নষ্ঠ ব্যাপি একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর যাযজ্ঞের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশ থেকে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য বৃটিশ সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। ১৫ মে “দি টাইমস পত্রিকায় বনগা থেকে পিটার হেজেলহার্সটস (Peter Hazelhurst) কর্তৃক প্রেরিত একটি সংবাদ “Unbelivable misery” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভারতে প্রবেশের খবর প্রাধান্য পায়। খবরে বলা হয় যে ইতােমধ্যে প্রায় ২০ লাখ শরণার্থী বনগা এলাকায় রয়েছে। শরণার্থীদের। মাথা গুজবার মত কোন স্থান নেই বলে উল্লেখ করে তাদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা। বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন