বাংলার বাণী
১৫ই আগস্ট, বুধবার, ১৯৭৩, ৩০শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সমতা এবং সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে শান্তি চাই
দু’টি দেশ বাংলাদেশ আর পাকিস্তান। দু’দেশের মানুষ। ষড়যন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে অনেক অনেক বৎসর। পাকিস্তানের উদ্ভব থেকেই সেখানকার সামন্তবাদী, নয়া পুঁজিবাদী শ্রেণী ষড়যন্ত্রের যে কুৎসিত থাবা বিস্তার করে তারই অমানবিক প্রভাবে দু’দেশের কোটি কোটি মানুষ দিনের পর দিন নিঃস্ব হয়েছে আর একই সঙ্গে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে গড়ে উঠেছে একটা প্রাসাদ চক্র। সামন্তবাদী আর পুঁজিবাদীদের সঙ্গে ক্ষমতায় ভাগ বসিয়েছে সুচতুর আমলা আর সামরিক বাহিনী। এদেরই যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিলো, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে তাদের স্বাধিকার থেকে রাখা হয়েছিলো বঞ্চিত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একদিন ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালো। স্তরানুক্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠত করে আর সে আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লাগে পাকিস্তানেরও নিঃস্ব নিঃসচ্ছল মানুষের মনে। বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের স্বাধিকারকামী মানুষ আজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে সেই পথে যে পথে প্রায় দু’বৎসর আগে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো।
বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জন করতে যে ত্যাগ ও রক্তক্ষয় স্বীকার করতে হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। এত কিছুর পরও কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান এবং সেখানকার দুঃখী মানুষের সুখ এবং সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। বলেছেন সে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। বস্তুতঃ দু’দেশেরই দুঃখী মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন একটা কোটারী স্বার্থবাদী চক্র দ্বারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা অত্যাচার, হত্যা, আর লুন্ঠনের নয়া নজির সৃষ্টি করেছিলো তারা আর যাই হোক পাকিস্তানেরও শান্তিকামী সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। আর করে না বলেই যখন সেই উন্মাদ সামরিক শক্তিকে বিচার করবার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তানের শান্তিকামী প্রগতিশীল মানুষ তার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়নি, যেমনটি হয়েছে সেই পুরোন প্রাসাদ চক্র। স্বার্থবাদীদের খেলার বিরাম নেই, নেই ছল ছুতো খুঁজে পাবার অভাব।
কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণার ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে আলোচনা আবার দ্বিতীয় দফা বসবে দিল্লীতে। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত যে যৌথ ঘোষণা দিয়েছে তাকে নানা টাল-বাহানায় এড়িয়ে যাবার কমতি নেই পিন্ডির শাসক সম্প্রদায়ের। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যখন বাংলাদেশের ভূমিকাকে অভিনন্দন জানিয়েছে তখন পাকিস্তান তার আন্তর্জাতিক বন্ধুদের পরামর্শে আলো থেকে অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।
কমনওয়েলথ সম্মেলন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনর্বার তাঁর ঘোষিত নীতিরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। বলেছেন সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমরা শান্তি চাই। আমরা সমৃদ্ধ একটা জাতি না হতে পারি, আর্থিক প্রাচুর্য আমাদের না থাকতে পারে তাই বলে কোন রাষ্ট্রের চাইতে আমরা ছোট নই। পারস্পরিক সমঝোতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের মতো উন্নতিশীল রাষ্ট্রসমূহকে সমৃদ্ধির সোপান অতিক্রম করতে হবে। আর সেজন্যেই আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির উপর আস্থাশীল। পাকিস্তান তার ইতিহাসে এই প্রথম একটি শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার গঠন করেছে। এখন পাকিস্তান তার নিজের স্বার্থেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে মুখ ফেরাবে বলে আমরা আশা করি। এমনিতেই অনর্থক বিলম্ব অনেক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। পাকিস্তানের নয়া সংসদীয় সরকার জনগণের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কতটুকু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন আমরা সেদিকেই আগ্রহে দৃষ্টি রাখছি।
সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পাকিস্তান
পাকিস্তানও শেষটায় সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে। কিছুদিন আগেও যে ভুট্টো সাহেব প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসনতন্ত্রের একমাত্র ধারক বাহক হয়ে নিজেই দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করে গণতন্ত্রের নামে একটি একনায়ক শাসন ব্যবস্থা পাকিস্তানী জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই ভুটো সাহেবকে শেষটায় নতি স্বীকার করতে হলো। আইয়ুব সৃষ্ট এই রাজনীতিক আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্র স্টাইলে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে মার্কিন শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অনুকরণে যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন, এবং প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির এই শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখার যে অপপ্রয়াস পেয়েছিলেন—তাঁর সেই অপচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। অথচ জনাব ভুট্টোকে এজন্যে কম কাঠখড়ও পোড়াতে হয়নি।
এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রশ্নে জনাব ভুট্টো কেবল পাকিস্তানী বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দেরই তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হননি—পরন্তু তাঁকে তাঁর স্বদলীয় পিপলস্ পার্টির অনেক প্রভাবশালী নেতারও তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে—খন্ডিতভাবে দ্বিখন্ডিত হয়েছে তাঁর দল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের পর পরই জনাব ভুট্টোর ভাগ্য খুলে যায়। সামরিক জুন্টার ক্রীড়নক ইয়াহিয়া খাঁকে অপসারণ করে ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। আর সাথে সাথে বনে যান সামরিক আইন প্রশাসক। দেশের বিরোধী দলীয় নেতাদের চাপে গত বছরের ১৪ই আগস্ট তিনি সামরিক আইন তুলে নেন এবং তাঁর দলের তদানীন্তন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইনমন্ত্রী মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরীকে পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ভার দেন। মিয়া কাসুরী সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক একটি খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। সেই শাসনতন্ত্র আবার ভুট্টো সাহেবের মনঃপুত হলোনা। তিনি কাসুরী সাহেবকে সেই শাসনতন্ত্র পাল্টাতে বললেন। বললেন, প্রেসিডেন্টের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ধরনের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে। কাসুরী সাহেব ভুট্টো সাহেবের সেই কথা রাখতে পারলেন না। দেখা দিলো শাসনতান্ত্রিক ও দলীয় সংকট। কাসুরী সাহেব নতি স্বীকার করলেন না—দলত্যাগ করলেন।
এরপর ভুট্টো সাহেব নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দিয়ে এক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রয়াস পান। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ সেই প্রয়াসও ব্যর্থ করে দেন। অতঃপর নিরুপায় ভুট্টো সাহেবকে সেই সংসদীয় গণতন্ত্রের বড়ি সেবন করতেই হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র গতকাল (১৪ই আগস্ট) থেকে পাকিস্তানে কার্যকর হতে শুরু করেছে। ভুট্টো সাহেব এই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাঁর দলেরই চৌধুরী ফজল এলাহী।
যাহোক, সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ বড় কঠিন পথ। পাকিস্তানী নেতারা কখনো সেই কঠিন পথ মাড়াতে রাজী ছিলেন না। এখন যখন সেই পথে তাঁরা পা বাড়িয়েছেন—তাঁর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে তাঁরা তৎপর হবেন বলে সবাই আশা করেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক