You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.09.07 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাস্তব কর্মসূচি প্রয়োজন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৭ই সেপ্টেম্বর, শনিবার, ২১শে ভাদ্র, ১৩৮১

বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাস্তব কর্মসূচি প্রয়োজন

বন্যা নিয়ন্ত্রণের মহা পরিকল্পনার কথা বেশ দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষ শুনে আসছে। গোটা জাতির কাছে এটা একটা মারাত্মক উদ্বেগজনক ব্যাপার। বন্যার ভয়াল আগ্রাসনী গতিকে যদি সার্থকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে এদেশের অর্থনীতি কোনদিনই পঙ্গু অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে না। এই সত্য দেশের সকল শ্রেণীর মানুষই আজ উপলব্ধি করে থাকে। কর্তৃপক্ষ এর বাস্তবতা অনুধাবন করে থাকেন। তবুও আর্থিক নানা প্রতিকূল কারণ এর দরুন এই মহাপরিকল্পনায় হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিকে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এড়িয়ে গেছেন আবার অনেক সময় এ প্রশ্নটি ওপর কিছু কিছু ভাবনা-চিন্তাও করা হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকেই পূর্বপ্রস্তুতির কথা স্মরণ করে ক্ষমতাসীন সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আসলেই এটা এমন একটি বিরাট সমস্যা যে, কোনো সহজ পদ্ধতিতে এর সমাধান হতে পারে না। একটি ব্যাপক পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার বাস্তব আশ্বাস ও প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যাদের সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
আমাদের শিল্পমন্ত্রীর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন। গত পরশুদিন তিনি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কোন আন্তর্জাতিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে রাশিয়া অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্য শিল্প মন্ত্রী যে সোভিয়েত আশ্বাস পেয়েছেন তার মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিও অন্যতম ছিল। বস্তুত আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই আশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তব সুদুরপ্রসারী। আমরা জানি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। এক বিরাট অঙ্কের আর্থিক সাহায্য ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে পারে না। এর জন্য দরকার তাই জাতিসংঘের সহানুভূতি, বিশ্বব্যাংক বা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক সহযোগিতা। যদি এ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য থেকে আমরা বঞ্চিত হই তাহলে কোন একটি বা দু’টি দেশের পক্ষে এই বিরাট কার্যক্রম এগিয়ে আসা সম্ভব হবে না। এ কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এগিয়ে আসার যে আন্তরিক বাসনার কথা উল্লেখ করেছেন তা অত্যন্ত বাস্তব ও ন্যায়ানুগ। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার সাহায্য লাভ করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। যদি আমরা সে সাহায্য লাভ করতে সক্ষম না হই তাহলে সহযোগিতার জন্য আগ্রহী বন্ধু দেশসমূহের আন্তরিকতার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে বাধ্য। অতএব কর্তৃপক্ষ এ দিকে লক্ষ্য রেখেই অগ্রসর হবেন বলে আমরা মনে করি।
বাঙালি জাতির ভবিষ্যত আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বন্যার স্বাভাবিকতা এবং ভয়াবহতা। বন্যার ভয়াবহ করাল মূর্তি এ জাতি বহুবার দেখেছে। ভারত বিভক্তির পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হয়েছে এবং তার কারণে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৫৪-৫৫ সালের বন্যার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির কথা ইতিপূর্বে আমরা জনশ্রুতির মত শুনেছি। কিন্তু এবারের বন্যা সেই অতীতকে ডিঙিয়ে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে জাতিকে নিমজ্জিত করেছে। বয়ে নিয়ে আসা পঙ্গু অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত করে দিয়ে গেছে। এই বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ তাই কর্তৃপক্ষের নতুন করে সবকিছু চিন্তা ভাবনা করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তব কর্মসূচি নিতে হবে। পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সে সকল কর্মসূচী ও জরিপ কাজ চালানো হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মিঃ জে, এ, ক্রুগ এর নেতৃত্বে গঠিত মিশন। এছাড়া হাইড্রলজি ওপর কিছু গবেষণামূলক কাজ ও নদনদীর গতি প্রকৃতি নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক থিসিস রিপোর্টও প্রণয়ন করা হয়েছিল। এশিয়া মহাদেশের এতদঞ্চলের অথবা হিমালয়ের পাদদেশে উপর দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বন্যার পানি প্রবাহিত হয়ে আসছে। বলা হয়ে থাকে খ্রিস্টপূর্ব দুহাজার বছর পূর্বেও নাকি পৃথিবীতে এ অঞ্চলে বর্ষা এবং বন্যা হতো। পৃথিবীর প্রকৃতি ও ভূমির বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এতদিনে। নদনদী প্রকৃতিতেও এসেছে নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। নদীর তলদেশে বহুকালের নানা প্রাকৃতিক কারণে স্ফীত হয়েছে, বন্যার পানি এখন তাই কুল ছাপিয়ে জনপদের ক্ষতিসাধন করার মতো ভরাটে পরিণত হয়েছে। অতীতের সেই গভীরতা নষ্ট হওয়ার কারণে নদীগুলোতে বর্ষা ও বন্যার পানি সংকুলান না হয়ে সমতল ভূমির ওপর গিয়ে আঘাত হানছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবন ও সম্পদ। এমনি সমস্যা বহুকাল ধরে চলে আসলেও বর্তমানে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বড় বড় নদীতেই প্রতিবছর বন্যা হচ্ছে। প্রত্যেকটি বড় বড় নদী তার পূর্বের ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনা ও যমুনা এই চারটি বৃহৎ নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে প্রবাহিত দেশসমূহের ওপর এর মারাত্মক একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই সকল নদীতে বন্যা হওয়ার না হওয়ার উপরে মূলত ভুক্তভোগী দেশগুলোর ক্ষতি-বৃদ্ধি নির্ভর করে। অতএব এদের গতি প্রকৃতি নিয়ে সার্বিক পর্যালোচনা আবশ্যক এবং এ সকল নদীর প্রবাহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এ পর্যন্ত যে সকল প্রস্তাব এসেছে তার মধ্যে নদীর গভীরতা বাড়ানো, প্রবাহ বৃদ্ধি এবং পরিসর উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ এবং রিজার্ভার তৈরি ইত্যাদি বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা হওয়া উচিত। পূর্বাহ্নেই আমরা উল্লেখ করেছি, এ দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই প্রতিবেশী দেশ যাদের সহযোগিতা ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। এবং তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বাড়াতে ও তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। এ কারণেই ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো দরকার। বর্তমানে যৌথ নদী কমিশনের যে গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে এ সকল প্রয়োজনীয় বাস্তব কর্মসূচি আলোচিত হবে বলে আমরা আশা করি। কর্তৃপক্ষ যথার্থই বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক এবং অত্যাবশ্যকীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে জাতির দুঃখ মোচনের পবিত্র দায়িত্ব পালন করুক এটাই সবার কামনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন