You dont have javascript enabled! Please enable it! সেপ্টেম্বর মাসের তৎপরতা- স্টিয়ারিং কমিটিই কেন্দ্রীয় কমিটির পদমর্যাদায় কাজ চালিয়ে যায় - সংগ্রামের নোটবুক

সেপ্টেম্বর মাসের তৎপরতা

সেপ্টেম্বর মাসে বিলাতে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির গঠন, তার কাঠামাে ও প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে ষ্টিয়ারিং কমিটি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কভেন্ট্রিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। কিন্তু কমিটির গঠনতন্ত্র, পরিচালনা কমিটি এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় অবশেষে উক্ত কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। স্টিয়ারিং কমিটিই কেন্দ্রীয় কমিটির পদমর্যাদায় কাজ চালিয়ে যায়। এ মাসের উল্লেখযােগ্য অংশ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা হয়। ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের স্পীকারদের নেতৃত্বে প্রায় সাত শত জন সংসদ সদস্য সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা এবং শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা ইত্যাদির বিষয়ে অবগত করার সুযােগ গ্রহণ করার জন্য যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্যারিসে প্রেরণ করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা প্যারিসে অবস্থানরত বাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে সম্মেলনের যােগদানকারীদের কাছে বিচারপতি চৌধুরী একটি পত্র, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের লিখিত একটি বুকলেট, বিশ্বব্যাংকের রিপাের্ট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র বিলি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা বিভিন্নদেশের সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা দেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রেখে ২ সেপ্টেম্বর ওয়েলসের কার্ডিফ শহরে বাংলাদেশ আন্দোলনের ইংরেজ সমর্থকদেম সমন্বয়ে সলিডারিটি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।

এই সংগঠনে বৃটেনের শ্রম। দল, ওয়েলস জাতীয়তাবাদী দল, কমিউনিষ্ট পার্টি, ইয়ং কনজারভেটিভ ও ক্রিশ্চিয়ান এই প্রতিনিধিবৃন্দ সম্পৃক্ত ছিলেন। সলিডারিটি’ প্রতিষ্ঠার দিনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাগে ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ, শেখ মুজিবের মুক্তি ও গণহত্যা বকে জানানাে হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ওল্ডহাম বাংলাদেশ সমিতির উদ্যোগে স্থানীয় কো-অপারাে গণহত্যা বন্ধের দাবি এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করা হয়। মকসুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায়  প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত এম, পি, তারুজ্জামান চৌধুরী। সভায় বক্তব্য রাখেন আজিজুল হক ভূইয়া, অধ্যাপক কবীর হােসেন, আবদুল মতিন ও ডাঃ জামান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। প্রধান অতিথির ভাষণে আকতারুজ্জামান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভাকে অবহিত করে দেশ মুক্ত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় মনােবলের কথা ব্যক্ত করেন। একই দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সীমান্তে পেত্রাপােল চেকপােষ্ট দিয়ে ‘অপারেশন ওমেগা’ এর ৪ জন সদস্য দুর্গতদের জন্য সাহায্য সামগ্রি নিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেন। পাকিস্তানের সৈন্যরা তাদেরকে গ্রেফতার করে যশাের জেলে প্রেরণ করে। তাদের অন্য তিন সদস্য অন্যপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তাদেরকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। যশাের কারাগারে বন্দি ক্রিশ্চিয়ান গ্রান্ট, চেন ক্রো, জয়েস কোলওয়েল এবং ড্যান দু এর মুক্তির দাবিতে লন্ডনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ডেনিসাে পাইল ৯ দিন যাবৎ অনশন ধর্মঘট পালন করে। ঢাকায় অবস্থিত বৃটিশ হাইকমিশনের হস্তক্ষেপে ‘ওপারেশন ওমেগা’ এর চার স্বেচ্ছাসেবক কে যশাের জেল থেকে মুক্ত করে লন্ডন ফেরত পাঠানাে ১০ সেপ্টেম্বর বৃটেনের গােয়েন্দা প্রতিষ্ঠান “স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড” এর কর্মকর্তা পিটার লাংলী স্টিয়ারিং কমিটির কার্যালয়ে এসে কর্মকর্তাদের সাথে অফিসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আলােচনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, এর কয়েকদিন পূর্বে পাকিস্তানী কোন একটি মহল ১১নং গােরিং স্ট্রীটের অফিসের নিচতলায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটায় যার ফলে অফিসের দরজা-জানালার ক্ষতি হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তার নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক আলােচনার করে গােরিং স্ট্রীটে পুলিশ টহল বৃদ্ধিসহ অন্যান্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আর কখনাে ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিসে আর কোন অঘটন ঘটে নাই।

১১ সেপ্টেম্বর ইয়র্কশায়ার আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের এম. পি. এ. আকতারুজ্জামান চৌধুরী মনােয়ার হােসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন “শগুল হক চৌধুরী, জগলুল পাশা, তৈয়বুর রহমান, মােকাদ্দার বখত, নূরুল ইসলাম, * ডান ও মকসুদ আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় প্রধান অতিথি বাংলাদেশে কাদের বীরত্ব ও দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে স্বাধীনতা লাভের নিশ্চয়তার আশ্বাস দিয়ে সভায় উপস্থিত সবাইকে উজ্জীবিত করেন। ‘তে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এত স্বল্প সময়ে শেষ হবে। মশা ছিল না। তাই দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এমনি একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বাংলাদেশ পিপলস ইন গ্রেট বৃটেন” নামে একটি সংগঠন। প্রবাসী বাঙালীরা চাদা প্রদানের মাধ্যমে তহবিলে অর্থ জোগান দেয়া ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে চ্যারিটি শাে ও প্রদর্শনী আ মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায়। ১২ সেপ্টেম্বর উক্ত সংগঠনের উদ্যোগে টটেনহাম কোর্ট রােডস্থ “লা-কন্টিনেন্টাল সিনেমা হলে বাংলাদেশ ফাণ্ডের সাহায্যার্থে  চ্যারিটি শাে অনুষ্ঠিত হয়। চ্যারিটি শাে-এর সংগৃহাত অথ বাংলাদেশ ফাণ্ডে জমা দেয়া হয় বলে উদ্যোক্তরা ঘােষণা দেন।   ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সন্নিকটে “সেন্ট মার্টিনস ইন দি ফিল্ড” নামক গীর্জায় কমিটি ফর ক্রিশ্চিয়ান এ্যাকশন’ এর চেয়ারম্যান ক্যানন কলিন্স এর উদ্যোগে বাংলাদেশের সংগ্রামের স্বপক্ষে একটি প্রদর্শনী ও ৪টি আলােচনা সভার আয়ােজন করা হয়। চার দিনের আলােচনা সভায় প্রত্যেক দিন একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং অন্যান্যরা আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বরে আলােচনা সভার উদ্যোক্তা ক্যানন কলিন্স, ১৪ সেপ্টেম্বরে জন গ্রিগ, ১৫ সেপ্টেম্বরে বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্টিন এ্যাডনী এবং ১৬ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পাকিস্তানের নাগরিক ফরিদ জাফরী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে “মিচামে” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। উক্ত জনসভায় আমন্ত্রণক্রমে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। ১৬ সেপ্টেম্বর বৃটেনের লিবারেল পার্টির সম্মেলন ইংল্যান্ডের স্কারবারা শহরে অনুষ্ঠিত হয়।

লিবারেল পার্টি ইতােমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষ সমর্থনকারী দল হিসাবে পরিচিতি ছিল। বৃটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এম, পি, দের সাথে লিবারেল পার্টির এম, পি, রা বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখে আসছে। সম্মেলনের প্রথম দিনে লিবারেল পার্টির এম. পি. জন পারডাে তার উত্থাপিত এক প্রস্তাবে ‘পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার ও অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। এই দাবি আ” পাকিস্তান সরকার মেনে না নিলে বৃটিশ সরকারকে একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন অ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানাের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে তিনি প্রস্তাব পেশ কম” ১৮ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে পার্টি প্রধান জেরেমি থর্প তার বক্তব্যে বাংলা” আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং আন্দোলনকারীদের সার্বিক সহণে আশ্বাস প্রদান করেন। বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা ? সরকারকে ভূমিকা গ্রহণের জন্যও তিনি আহ্বান জানান। আমাদের সার্বিক সহযােগিতার ১৮ সেপ্টেম্বর ইপসুইজে বৃটিশ স্থানীয় নাগরিক ও প্রবাসী বাঙালীদের এক যৌথ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় স্থানীয় বৃটিশ সমাজকর্মী ও সিনিয়র নাগরিকরা বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। স্থানীয় নেতবৃন্দ ছাড়াও বাঙালীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ড. কবির চৌধুরী ও আবদুল হক। সভার শেষে সমবেত জনতা এক মিছিল সহকারে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এভাবে বিলাতের বিভিন্ন শহরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা বৃটিশ জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং সমর্থন আদায় করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিদেশীদের কাছে মনে হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব ও তার যথার্থতা বৃটিশ জনগণকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর (শনি ও রবিবার) লন্ডনের কনওয়ে হলে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নৃত্যনাট্য ও গীতি বিচিত্রার আয়ােজন করে। বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে উপরােক্ত সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও নৃত্যনাট্যের আয়ােজন করা হয়।

উক্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সম্মেলন গণসংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সদ্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাগত বৃটিশ এম পি পিটার শাের বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন। বাঙালি নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সিংহলের (বর্তমান শ্রীলংকা) বিরােধী দলীয় নেতা নওরতনও উক্ত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। উভয় দিনেই গণসংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের রচিত মুক্তযুদ্ধ ভিত্তিক নৃত্যনাট্য অস্ত্র হাতে তুলে নাও” মঞ্চস্থ হয়। উক্ত নৃত্যনাট্যের মূল ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেন মিসেস মঞ্জু হাফিজ ও আবদুল রউফ প্রমুখ নৃত্য শিল্পীবৃন্দ।  ২৩ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৬ সদস্য প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক গমন করেন। প্রতিনিধিদলের মধ্যে জাতীয় সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ, মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী (এম. আর. সিদ্দিকী), সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. মফিজ উদ্দিন, সেরাজুল হক, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডাঃ আসাবুল। হক, ফনি ভূষন মজুমদার, ফকির শাহাবুদ্দিন; ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ; আম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিক; অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান। “শ কূটনীতিবিদ রাষ্ট্রদূত এ, এফ, এম, আবুল ফাত্তাহ, রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী, সৈয়দ মারুল করিম, এ, এম. এ. মুহিত এবং এ. এইচ, মাহমুদ আলী অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বদলের সদস্যগণ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করে নিউইয়র্ক গমন করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূতি দিবস যথাযােগ্য গুরুত্বের সাথে বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদসমূহ পালন করে। এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সহযােগিতায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৬ সেপ্টেম্বরে লন্ডনের হাইড wers স্পীকার্স কর্ণারে এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জাত সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে অপর আহ্বায়ক মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। সভায় বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সদ্য বাংলাদেশ থেকে আগত বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি সিলেট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ, সংসদ সদস্য। সিরাজুল হক এবং সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, উক্ত সংসদ সদস্যরা জাতিসংঘে লবিং করার জন্য নিউইয়র্ক গমনের পথে তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে ইতােপূর্বে নিউইয়র্ক গমন করায় ছয় মাস পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। উক্ত সমীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাসের সাফল্য উল্লেখ করে মুক্তি অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয় যে, “While the agonies and indignities of the people of Bangladesh may have already exceded those of vietnam, the war in Bangladesh may not last as long as the current phase of vietnam war. The patriotic and partisans of Bangladesh must therefore view the immediate future with considerable hope” এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পূর্তি উপলক্ষে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা। সাপ্তাহিক ও মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র “সাপ্তাহিক জনমত” বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।  ২৭ সেপ্টেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত ‘কনওয়ে হলে ‘ যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ মােজাফফর) এর উদ্যোগে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদকে সম্বর্ধনা প্রদানের জন্য এক সভার আয়ােজন করা হয়। অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সরকারে প্রতিনিধিদলের। সদস্য হিসাবে যােগদানের জন্য নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। খায়রুল হুদার সভাপতিত্বে এই সভায় বক্তব্য রাখেন ডাঃ নুরুল আলম, মাহমুদ এ. রউফ, ডাঃ মনজুর আহম্মদ ও কায়সারুল ইসলাম প্রমুখ ন্যাপ নেতৃবৃন্দ। অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ সভা বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নেতৃবৃন্দের মধ্যে কোন মত বিরােধ বা বিভেদ নাহ। তিনি বিভিন্ন অপপ্রচারকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো যেথভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে। মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী বা বিশেষ কোন দলে সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না বলে যে অপপ্রচার করা হচ্ছে তাও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন।  ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়েলস্ এর কার্ডিফ শহরে ‘টেম্পল অফ পীস’ এ ইংরেজ সমর্থকদের একটি প্রতিষ্ঠান “এইড টু বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান বক্তা আলফ্রেড ইভানুস এম, পি, তার বক্তব্যে শীঘ্র বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য ইয়াহিয়া খানের বিচার দাবি করে বৃটিশ পার্লামেন্টে তিনি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন বলে উপস্থিত সবাইকে আশ্বাস প্রদান করেন। সভায় কনজারভেটিভ পাটির এম, পি, মাইকেল রবার্ট বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ানাের জন্য ওয়েল্‌স বাসীকে আহ্বান জানান। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ দূতাবাসের মহিউদ্দিন জায়গীরদার, এবং ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’ এর সম্পাদক ফরিদ জাফরী। সভায় লেবার পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টি, ওয়েল্স ন্যাশনালিষ্ট পার্টি, ওয়েল্‌স ইয়ং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও কর্মীবৃন্দ যােগদান করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন