You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.08.25 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রগতিশীল ছাত্র সমাজই অগ্রণী ভূমিকা নিক | পাকিস্তানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২৫শে আগস্ট, শনিবার, ১৯৭৩, ৮ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

প্রগতিশীল ছাত্র সমাজই অগ্রণী ভূমিকা নিক

স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করার মহতী ডাকে নীতিগতভাবে সকল দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন এবং ছাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হলেও আজ পর্যন্ত সেই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। স্বাধীনতাত্তোরকালে স্বাধীনতাসংগ্রামী প্রগতিশীল যুবকর্মীদের নিয়ে যে রাজনৈতিক যুব সংগঠন গড়ে তোলা হয় সেই আওয়ামী যুবলীগ বহু পূর্বেই এমন একটা প্রগতিশীল মোর্চা গড়ে তোলার জন্যে রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদ তার বিগত অধিবেশনে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের ঐক্যের উপর জোর দেন এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ গণমোর্চা গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি প্রগতিশীল মোর্চা গঠনের ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার। নীতিগতভাবে এই প্রগতিশীল মোর্চা গঠনের প্রয়োজনীয়তা মোটামুটি সংগঠন মেনে নেওয়া সত্ত্বেও কার্যকরীভাবে এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের প্রগতিবিরোধী কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামে-গঞ্জে, মহল্লায়-মহল্লায় আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কম্যুনিস্ট পার্টির ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সমাজবিরোধীদের মোকাবেলা করবার আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্রসমাজের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ একটা কর্মতৎপরতা বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গত কয়েকমাসে বেশ ক’টি সফল প্রগতিশীল কর্মতৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের পর ছাত্রসমাজ প্রগতিশীল মোর্চা গঠনের ব্যাপারে অধিকতর সক্রিয় এবং অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন সামনে আগামী ৩রা সেপ্টেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছাত্রসমাজ তাদের ভবিষ্যত ঐক্যবদ্ধ অগ্রাভিযানের ক্ষেত্রে অধিকতর শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি। ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এমনিতেই একটা অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে গেছে। সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কিছুসংখ্যক ছাত্রকে নিয়ে যে তথাকথিত কমিটি গঠন করেছেন তা ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনে অন্তরায় সৃষ্টি করুক এটা কোন সুস্থ চেতনাসম্পন্ন মানুষেরই কাম্য হতে পারে না। আমরা তাই আশা করবো বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অনতিবিলম্বে তারা তাদের এই ভেদনীতি পরিহার করবেন এবং সুষ্ঠু প্রগতিশীল কর্মধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করবেন। এর অন্যথা হলে প্রগতির স্রোতস্বিনী ধারায় একদিন তারা ভেসে যাবেন ; ইতিহাস কিন্তু তার অমোঘ নিয়মেই চলতে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ অতীতে প্রগতিশীল আন্দোলন সমূহে বরাবর অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছেন। সামনের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আগামী দিনে বিভিন্ন প্রগতিশীল এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মোর্চা গঠনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করবে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ, মহল্লায় অনতিবিলম্বে গড়ে উঠবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক-যুব সংগঠনের দুর্ভেদ্য দূর্গ। সেই প্রগতিশীল কর্মতৎপরতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে কারখানায়-কারখানায় ক্ষেতে-খামারে মেহনতি মানুষ তুলে ধরবে সমাজতন্ত্রের অজেয় পতাকা। আমরা সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় রয়েছি। প্রতিক্রিয়ার যে বিষ বীজাণুগুলো প্রগতিশীলদের অসতর্কতা এবং অসাবধানতার ফলে আমাদের সমাজদেহে সংক্রমিত হয়ে চলেছে তার আশু অবসান অপরিহার্য। সুস্থ চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি প্রগতিশীল দেশপ্রেমিককে আজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে হবে, সচেতন পরিকল্পনা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ভিত্তিভূমি গড়ে তুলতে হবে। এটা স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী ত্রিশ লক্ষ শহীদের অতৃপ্ত আশা। সে আশা পূরণে ব্যর্থ হলে ইতিহাস কোনদিন আমাদের ক্ষমা করবে না।

পাকিস্তানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

ভুট্টো সাহেব এবার তাঁর আসল মূর্তিতেই আবির্ভূত হয়েছেন। একাত্তর সালে ইয়াহিয়া খাঁর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিলেন—এক কোটি লোককে দেশ-ছাড়া করে ভারতে যেতে বাধ্য করেছিলেন। আর এখন নিজেই বেলুচিস্তানে গণহত্যা, লুন্ঠন, সন্ত্রাস ইত্যাদি চালিয়ে প্রায় দেড় হাজার বেলুচ ও পাঠানকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। ওরা পালিয়ে যাচ্ছেন কাবুল, আফগানিস্তানে। একাত্তরে যে জল্লাদের উপর ইয়াহিয়া-ভুট্টো ভর করে বাংলাদেশকে ছত্রখান করেছিলেন—আজ এই তিয়াত্তরেও সেই একই জল্লাদ টিক্কা খানের উপর ভর করে বেলুচিস্তানকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করা হচ্ছে। ইতিহাসের এমন পুনরাবৃত্তি সত্যি অবার হবার মতোই।
বেলুচিস্তানের বেলুচি আর সীমান্তের পাঠানদের স্বাধীনতাপ্রিয়তার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। মোগলরা তাদের দমাতে পারেননি—ইংরেজ শাসকরা হিমশিম খেয়েছেন সব সময় আর পাকিস্তানীরাতো কোনদিনই এদের সুনজরে দেখেননি। পাকিস্তানের শুরু থেকে পাঞ্জাবী কুচক্রীরা বাঙালীদের মতো পাঠান ও বেলুচদের হাতের মুঠোয় পুরে রাখতে বার বার ব্যর্থ কসরৎই করেছে। ঈদের জামাতে বোমা মেরেও ওদের কিন্তু শায়েস্তা করতে পারেনি। একাত্তর সালে বাঙালীরা সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে মুক্তি আর বিপ্লবের যে সাফল্য অর্জন করেছেন—তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বেলুচ আর পাঠান নর-নারীর হৃদয়ে। আর ঠিক তখনই পাঞ্জাবী চক্র ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সন্তান ভুট্টো-টিক্কা-কাইয়ুম জুটি মরিয়া হয়ে উঠেছে বেলুচ ও পাঠানদের দমন করার জন্যে।
বেলুচিস্তানের ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগভাবে গঠিত সরকারকে উচ্ছেদ করে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং সর্বোপরি বর্বর পাঞ্জাবী বাহিনীকে লেলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ আর নৃশংসতার এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ভুট্টো সরকার বেলুচিস্তানে আজ আজ যা করছেন—তা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকালীন ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ভুট্টো সরকার বেলুচ ও পাঠানদের প্রাণের দাবী পাখতুনিস্তান সংগ্রাম নস্যাৎ করার জন্যে আজ যা করছেন, ঠিক তাই ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা চক্র একাত্তর সালে করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করার জন্যেই। বেলুচি-পাঠানদের দমন করার জন্যে ভুট্টো সাহেব গোপনে আঁতাত করেছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী দালাল ইরানের শাহের সাথে। মার্কিনী মদদে আধুনিকতম সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইরানের শাহ এখন ভুট্টো চক্রের মুরুব্বী। ভুট্টো সাহেব একবার বেলুচিস্তানকে ইরানের হাতে তুলে দিতেও পাঁয়তারা করেছিলেন। কিন্তু বেলুচদের দৃঢ়তায় তা বাস্তবায়িত হয়নি।
বেলুচিস্তানের বেলুচিরা—সীমান্তের পাঠানরা তাই আজ ইতিহাসের অমোঘ বিধানেই মুক্ত পাখতুন ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছেন। বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ার মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ তাঁদের সামনে। বিশ্বের মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণ তাঁদের পেছনে। আফগানিস্তানের নতুন প্রজাতান্ত্রিক শক্তি ও সরকার তাঁদের মহান বন্ধু। বিপ্লব আর মুক্তি তাঁদের লক্ষ্য। সাফল্য তাদের অনিবার্য। এবং তাও ইতিহাসের অমোঘ বিধানেই। আর অন্যদিকে ইতিহাসের সেই বিধানেই ইয়াহিয়া খাঁ যেমন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত—ভুট্টো-টিক্কা-কাইয়ুম চক্রের ভাগ্যেও তাই ঘটবে এবং সেদিন বেশী দূরে নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন