এক বীরের প্রস্থান
১৯৭১ খুব সম্ভবত অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি কিংবা সেপ্টেম্বরের প্রথম। জুন কিংবা জুলাইয়ে মেজর আবু তাহের এসে পৌছাতে নবগঠিত ১১ নম্বর সেক্টরে নতুন এক প্রাণচাঞ্চল দেখা দিয়েছে। গেরিলা যােদ্ধাদের মধ্যে নতুন প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে। গােটা এলাকায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই চলছে। এতদিন ধরে আমাদের এলাকায় চলে আসছিল প্রচলিত যুদ্ধরীতি অর্থাৎ কনভেনশনাল ওয়ার’। জেড ফোর্সএর কর্নেল জিয়া হয়তাে সেটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। এই প্রচলিত লড়াইয়েও মুক্তিযােদ্ধারা রৌমারী-চিলমারী আর রাজীবপুর থেকে কামালপুর-মহেন্দ্রগঞ্জ, আর সেখান থেকে ডালু পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ইদানীং পুরনাে যুদ্ধ রীতির বদল হয়েছে। এর সবটুকু কৃতিত্ব মেজর আবু তাহেরের…যিনি মাত্র কিছুদিন আগে জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তান। থেকে পালিয়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন এবং নতুন ১১ নম্বর। সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছেন। এরই মধ্যে একদিন আমাদের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযােদ্ধা শিবিরে এসে উপস্থিত হলেন আবু ইউসুফ খান। শুনলাম সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের বড় ভাই তিনি। সৌদি আরব বিমান বাহিনীতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছিলেন। দুঃসাহসী নিঃসন্দেহে। এমন দুর্দিনেও সৌদি আরব থেকে পালিয়ে নানান দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত ভারতের মাটিতে প্রবেশ করেছেন। স্বাধীনতার আকাক্ষা তার এতই দুর্বার। তারপর সােজা চলে এসেছেন আমাদের সেক্টরে দেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান রাখতে। সেই ২৮ বছর আগের কথা। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে আমৃত্যু আবু ইউসুফ খান ছিলেন আমার একান্ত সুহৃদ। বারাে-তেরাে বছরের বয়ােকনিষ্ঠ ছিলাম বলেন ইউসুফ ভাই আমাকে বরাবর তার ছােট ভাইয়ের মতাে দেখতেন। তখন তাে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অবিবাহিত এবং ডানপিটে প্রায় অপ্রতিরােধ্য এক যুবক। পরবর্তীতে বয়স বেড়েছে, ঘরসংসার করেছি এবং ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছি।
কিন্তু ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ধানুয়া কামালপুরের ট্রেঞ্চে এবং বাঙ্কারে যে ইউসুফ ভাইকে আমি জানতাম, সেই একই ইউসুফ ভাইকে পেয়েছি গেল ২৮ বছর। প্রখর যুক্তিবাদী, সুবিশাল অন্তরের হৃদয়বান মানুষ ইউসুফ ভাই হয়তাে তার জীবনে বড় কোনাে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী হন নি, কিন্তু এই বাংলাদেশকে, এই বাংলাদেশের নিরন্ন, ভুখানাঙ্গা মানুষের কল্যাণে তাঁর উদ্যম আর আকুতির কোনাে শেষ ছিল না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রগতিশীল, যার হৃদয়ের সবটুকু অলবাসা, সবটুকু আকুতিকে তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণের জন্যে, সেই ইউসুফ ভাই আজ আমার এই লেখাটি পড়বেন না। যে ইউসুফ ভাই আমার প্রায় প্রতিটি লেখা পড়তেন, আলােচনা করতেন, এমনকি সমালােচনা করতেন, সেই ইউসুফ ভাই মাত্র কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে ইহজগৎ ত্যাগ করলেন। বেতার-টেলিভিশনে যৎসামান্য একটি খবর হলাে। পত্রপত্রিকায় ছােট একটি সংবাদ ছাপা হলাে। ব্যাস এইটুকুই। আমাদের প্রিয় ইউসুফ ভাই চোখের নিমিষে স্মৃতি হয়ে গেলেন। জীবজগতের মৃত্যু কিংবা মহাপ্রয়াণ আমার কাছে খুবই সহজবােধ্য। আমাদের যাদের বয়ােবৃদ্ধি ঘটছে, যারা বৃদ্ধ হচ্ছি, তাদের মৃত্যুর ঠিকানা ক্রমশই স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। সে অর্থে ৬৩ বছর বয়সে ইউসুফ ভাই চলে যাবেন। এতে আর বিস্মিত হবার কী আছে! কিন্তু আমি বিস্মিত এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে যে ইউসুফ ভাই ছিলেন একজন অপরাজিত বীর, এক দুঃসাহসী পুরুষ এবং যে ইউসুফ ভাইকে আমি জানতাম এক শক্ত মন আর শক্ত শরীরের অধিকারী বলে, সেই ইউসুফ ভাই এত অসমাপ্ত কাজ রেখে এত জলদি চলে যাবেন কেন। ১৯৭৫ সালের পর কেন, এক অর্থে তারও আগে থেকে ত্যাগী মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলে আসছিল। বাঙালির স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীদের দিক থেকে ব্যাপারটি ঠিকই ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের খারাপ আর কলঙ্কিত প্রমাণ করতে না পারলে তাে আর মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করা যায় না। আর মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত কিংবা বিকৃত করা। গেলেই আবারও আরেকটি পাকিস্তান বানানাে যায় স্বাধীন বাংলাদেশকে। না, সে চেষ্টার অন্ত ছিল না। শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীরা নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার লােভে মুক্তিযােদ্ধাদেরও কেউ কেউ সে ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছিলেন। ১৯৭৫-এর পর, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হত্যাকাণ্ডের পর, সে ষড়যন্ত্রই পরিণত হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। ৩ মাসের জন্য খন্দকার মােশতাক রাষ্ট্রক্ষমতা পেল। মােশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করলেও মূলত দেশ চালাত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা।
একের পর এক ঘটল হত্যাকাণ্ড, চলতে থাকল ষড়যন্ত্র, ক্ এবং পাল্টা ব্যু। এরই প্রক্রিয়ায় ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেন। আর জেনারেল জিয়া ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় মানুষদের ভাগ্যে ঘটতে থাকল একের পর এক অঘটন। কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ফাঁসিতে ঝুললেন। তার রাজনৈতিক অনুসারীরা প্রায় প্রত্যেকেই জেলে ঢুকলেন। বড় ভাই আবু ইউসুফ খান, বীরবিক্রম, বীর মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদ, আনােয়ার হােসেন এবং সর্বকনিষ্ঠ ওয়ারেছাত হােসেন বেলাল, বীরপ্রতীক। এরা। সবাই আটকে গেলেন ষড়যন্ত্র মামলায়। আমি কখনও সরাসরি কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হই নি। আমার মতাে একরােখা মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় নি। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বােধ যতই শক্তিশালী হােক না কেন, বিশেষ দলের সীমাবদ্ধতায় কখনও যদি নিজের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয় এমন একটি সন্দেহ বরাবরই আমার ছিল। এটি আমার নিজের, একান্ত নিজের মনের এক দ্বন্দ্ব যার সমাধান এখনও হয় নি। জানি, সংগঠন বা দল ছাড়া রাজনৈতিক আদর্শ বা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দল যখন আমার নিজের বােধ-বিশ্বাসের বাইরে যেতে চাইবে, যদি তার কৌশলের জন্য প্রয়ােজন হয়, তখন আমি কী করব? সে যাই হােক, মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রথম সারির সেনাপতি হয়েও জেনারেল জিয়ার শাসন আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তার চেতনার যতটা ক্ষতি হয়েছে তাকে আমি কখনও মেনে নিতে পারি নি। আমি মেনে নিতে পারি নি কর্নেল তাহেরের ফাসি। মেনে নিতে পারি নি দেশের ঘাতক-দালালদের, মুক্তিযুদ্ধের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের সমাজ আর রাজনীতিতে পুনর্বাসন। কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ ঠেকাতে হবে বলে লাখাে দেশপ্রেমিকের রক্তের কৃনে বাধা স্বাধীনতার মূল্যবােধ আর দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভূলুষ্ঠিত করতে হবে কোন যুক্তিতে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, জেনারেল জিয়া তাই করেছিলেন। জেনারেল জিয়ার আমলে ইউসুফ ভাই ছিলেন জেলখানাতে। সেই পঁচাত্তর-ছিয়াত্তরে এক-দু’বার দেখতেও গেছি তাকে, অনেকটাই লুকিয়ে, ভয়ে ভয়ে। যতবার গেছি, ততবারই একজন দৃঢ়প্রত্যয়ী মানুষের মতাে বলেছেন, দেখে নিও, এই দিন থাকবে না বাংলাদেশের। যে-বাংলাদেশের সৃষ্টির পেছনে লাখ লাখ মানুষের আত্মাহুতি আছে, লাখ লাখ মানুষের উৎসর্গ আর বিসর্জন আছে, সেই বাংলাদেশ অবশ্যই একদিন সেনানিবাসের চার দেয়ালের রাহুগ্রাস থেকে, কতিপয় জেনারেলের উচ্চাভিলাষের দেয়াল ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসবে। হ্যা, ইউসুফ ভাইয়ের কথাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। বিরােধী দলগুলাে তাদের পূর্ণ সরকার বিরােধিতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলাে এখন পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন।
অবশ্যই আমি বলব না, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলাের অসহিষ্ণুতা, নানান ভুলভ্রান্তি আর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও সেই চর্চা চলছে। সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব নিয়ম-শৃঙ্খলায় ফিরে গেছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের জবাবদিহিতা এবং এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। না, সবটা হয়েছে বলে যারা দাবি করেন, তাদের সাথে আমি একমত নই। কিন্তু অনেক ব্যর্থতার মধ্য দিয়েও একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এদ্দিন যা ছিল রুদ্ধ আজ সে দুয়ার খুলে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জুলাইয়ের ৩ তারিখে হঠাৎ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ইউসুফ ভাই। তিনি দেখে যেতে চেয়েছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে প্রতিটি মানুষ তার প্রতিটি অধিকারের নিশ্চয়তা লাভ করবে। শহর, গ্রামগঞ্জ কিংবা নগর-বন্দরের মানুষের জীবনযাত্রায় আকাশ-পাতাল ফারাক ঘুচে যাবে। বাংলাদেশ মাথা উচু করে দাঁড়াবে। একাত্তরের রণাঙ্গনে যে-তরুণরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়েছিল, সেই মুক্তিযােদ্ধারা এবং সেই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তি, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তাকে নেতৃত্ব দেবে। আমি এই জীবনে অসাধারণ কিছু শক্তিমান এবং আধুনিক মানুষ দেখেছি, অসাধারণ সাহসী মানুষও দেখেছি। কিন্তু যে ইউসুফ ভাইয়ের কথা বলছি, তার যেন তুলনা হয় না। বছর কয়েক আগে একদম একা চলে গেলেন তিনি কোলকাতার বিড়লা হাসপাতালে এবং যথারীতি ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’ সেরে সুস্থ হয়ে একাই ফিরে এলেন মােহাম্মদপুরের আজম রােডের ছােট্ট বাড়িটাতে। একই বাড়ির দোতলায় বসবাস করেন বীরউত্তম কর্নেল আবু তাহেরের সহধর্মিণী লুৎফা তাহের। পারিবারিক বন্ধুত্ব বলতে যা বােঝায় আমার এবং তাহের-ইউসুফের পরিবারের মধ্যে সেটিই বর্তমান। রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বিভিন্ন কার্যক্রমে হয়তাে-বা কখনও আমরা একে অপরের সমালােচনা করেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা বরাবর ছিলাম ঘনিষ্ঠ সহযােগী। তাহেরের ফাঁসির পর আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক মূলত ইউসুফ ভাইয়ের সাথেই ছিল, যাকে আমি গভীরভাবে ভালবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। সেই ইউসুফ ভাই যে এভাবে আকস্মিক চলে যাবেন, সে কি কখনও ভাবতে পারা যায়। গেল কয়েক বছর ধরে শরীরটা তার মােটেই ভালাে যাচ্ছিল না। ওপেন হার্ট সার্জারির পর থেকেই দেহটা দুর্বল হয়ে আসছিল।
কিন্তু এর পরও শারীরিক কিংবা মানসিক দুর্বলতার বিন্দুমাত্র লক্ষণ খুঁজে পাই নি তার মধ্যে একজন মুক্তিযােদ্ধার যতটা সঙ্গত গৌরব, একজন স্বাধীনচেতা প্রগতিশীল মানুষের জন্য যতটা উদারতা আর স্বাধীনতাবোেধ কাম্য, তার সবটুকুই ছিল এই মানুষটির মধ্যে। আপাদমস্তক উদার, আধুনিক মানুষ ছিলেন আবু ইউসুফ খান, যার কোনাে ক্ষোভ ছিল না জীবনে তেমন কিছু পান নি বলে। কিন্তু ইউসুফ ভাই, সত্যি কি আপনি জীবনে বড় কিছু পান নি ? আপনার জেনারেশনের সব চাইতে বড় অহঙ্কার যে-মুক্তিযুদ্ধ সেই মুক্তিযুদ্ধে আপনার অবদান আপনার সমবয়সীদের আর ক’জনই-বা পেয়েছে বলুন। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, জীবনের সাথে যুদ্ধ করা সঙ্গত, বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে যুদ্ধ করার যে-আনন্দ সেই আনন্দের সীমাপরিসীমা ক’জনেই-বা বােঝে । কিন্তু আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের আকস্মিক মৃত্যুতে, আমার মনে হয়েছে, হ্যা, জীবনের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারটা ঠিক আছে, কিন্তু মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করার হয়তাে একটা সীমা আছে। জীবন যতই শক্তিশালী হােক মৃত্যু একদিন না একদিন তাকে পরাভূত করেই। আমার ইউসুফ ভাই-ই তার প্রমাণ। সেদিন রাতে মােহাম্মদপুরের আযম রােডের ছােই বাড়িটার আঙ্গিনায় নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসহীন আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রমের লাশ রাখা হয়েছিল। পাশে নির্বাক বসেছিলাম আমি এবং আমার একাত্তরের সহযােদ্ধা আবু সাঈদ। ভাবি ফাতেমা ইউসুফকে ঘিরে ব্যস্ত আত্মীয়, বন্ধু এবং পরিবার-পরিজন। বাড়ির একমাত্র ছেলে শ্রাবণ। আনমনা হয়ে এদিক-সেদিক হাঁটছে। জীবনে কোনাে কিছু ধরে দাঁড়াবার আগেই সে পিতৃহারা। হঠাৎ শায়িতের কাপড় খোলা হলাে। ইউসুফ ভাইয়ের মুখটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। জীবন্ত একটি মানুষ শুয়ে আছে। মুখ, নাক, চুল, কপাল, কোথাও মৃত্যুর পরাজয় নেই। মাত্র তিন দিন আগেই তার সাথে আমার কথা। মনে হচ্ছিল, ইউসুফ ভাই, চোখ খুলে এক্ষুণি আমাকে ডেকে বলবেন, হারুণ হাবীব, এই কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছি। আজ আর কথা বলব না। তােমার তাে আবার অনেক ব্যস্ততা। পারলে আর একবার এসাে। অনেক কথা আছে বলার।
জুলাই, ১৯৯৯
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব