You dont have javascript enabled! Please enable it! একজন ব্যতিক্রমী সেক্টর কমান্ডার- ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের - সংগ্রামের নোটবুক

একজন ব্যতিক্রমী সেক্টর কমান্ডার

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের একাধিক ঘটনাপ্রবাহে এটা বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না যে, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের ঘটনাটিকে কেউ কেউ নিছক এক সামরিক কর্মকাণ্ড বলে পরিচিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি ব্যাপক বিস্তৃত ঘটনা কখনই কেবলমাত্র এক সামরিক কর্মকাও হয় না, হতে পারে না। একটি জাতির স্বাধীনতার আন্দোলন এবং সশস্ত্র জনযুদ্ধ সে জাতির রাজনৈতিক এবং একই সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিণতি। আমার বিশ্বাস, অবিভক্ত পাকিস্তানের অশুভ রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নির্লজ্জ অংশীদারিত্বে যাদের মনমানসিকতা গড়ে উঠেছিল, তারাই সুকৌশলে স্বাধীন বাংলাদেশেও নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি গৌরবময় ঘটনাকে বিকৃত অর্থে উপস্থাপনের চেষ্টা করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাঠে সেদিনের ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহেরকে যথেষ্ট কাছে থেকে জানবার সুযােগ আমার হয়েছিল। তাহের সবেমাত্র পাকিস্তানের এবােটাবাদ থেকে জীবন বাজি রেখে পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে ঢুকেছেন। আবু তাহের এবং তার সাথীদের সে ছিল এক ভয়ঙ্কর ঐতিহাসিক অভিযাত্রা। দেশপ্রেম মানুষকে কতটা দুঃসাহসী করতে পারে সে অভিযাত্রা ছিল তারই দৃষ্টান্ত। সীমান্ত পাড়ি দিয়েই তিনি পৌছেছেন কলকাতায়, সেখান থেকে প্রবাসী সরকারের অনুমতি নিয়ে এবং অধিনায়ক নিযুক্ত হয়ে এলেন পাহাড়ী মেঘালয়ের পাদদেশে এগারাে নম্বর সেক্টরের এলাকাতে। রংপুর আর উত্তর-ময়মনসিংহের এ অঞ্চলটিতে তখন মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স’ কাজ করে যাচ্ছিল। প্রবাসী সরকার এটিকে তখনও যুদ্ধ সেক্টরে ভাগ করে নি। তুখাের কমান্ডাে অফিসার আবু তাহের আসার পর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে সদ্য-গঠিত এগারাে নম্বর সেক্টরের যাত্রা শুরু হলাে। নিয়মিত বাহনীর সাথে তাহেরের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনীর বিকাশ ঘটতে থাকল। গণসম্পৃক্ততায় যুদ্ধের চেহারা বদলে যেতে লাগল। আজকের আলােচনাটি একান্তভাবেই তাহেরকে নিয়ে এবং তার হত্যাবার্ষিকীতে’।

সে কারণে অনন্যসাধারণ এই যুদ্ধ অধিনায়কের ‘হত্যাবার্ষিকীতে নিজের কিছু উপলব্ধির কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। আমি এখানে তাহেরের সাথে মুক্তিযুদ্ধের আর অন্য সেক্টর কমান্ডারদের কখনওই তুলনা করতে চাই। সে আরেক আলােচনা, যার প্রয়ােজন এখানে নেই। মুক্তিযুদ্ধের যে এগারােটি যুদ্ধ সৌর গড়ে তােলা হয়েছিল তার প্রতিটিই এক একজন অধিনায়কের গৌরবে গৌরবান্বিত। এদের প্রত্যেকেই তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ যােগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন রণাঙ্গন পরিচালনায় । এদের কে কতটা যােগ্য এবং কে কার চেয়ে কত আত্মত্যাগী– সে প্রশ্ন আমার কাছে অবান্তর।  যতটা বুঝেছি, তাহেরের নিজস্ব একটি রাজনীতিচিন্তা ছিল। সে চিন্তা সমাজ পরিবর্তনের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে এমন সমাজতান্ত্রিক চিন্তার আর ক’জন বাঙালি ছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে তাহের যে ছিলেন তা তার ঘনিষ্ঠজনদের জানা ছিল। আমারও কমবেশি জানবার সুযােগ হয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় সময় এই লােকটির সাথে আমাকে কাটাতে হয়েছে এবং তার অধিনায়কত্বে যুদ্ধে যেতে হয়েছে। তাহেরকে দেখে তাই আমার নিছক এক ভাগ্যপ্রত্যাশী গতানুগতিক সামরিক অফিসার মনে হয় নি। কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে নিয়েছিলাম এই ব্যক্তি মােটেও সাধারণ নন, একজন ‘ভিশনারি তিনি, যিনি গতানুগতিক সমাজের পরিবর্তন চান, এবং সে বিবর্তন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে চান। শেষ পর্যন্ত তিনি তা পারেন নি যা আরেক কথা। সে কারণেই কিনা জানি না, তাহের ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব লাভ করেই মুক্তিযুদ্ধের সমর কৌশল পাল্টাতে চাইলেন। বল্লেন, এটা হলে একটা পিপলস ওয়ার, কাজেই গতানুগতিক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি এখানে চলবে না। যুদ্ধ হবে জনযুদ্ধ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুটে, মজুর আর সেনাবাহিনী, পুলিশ-ইপিআর সকলকেই এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এখানে কমান্ড থাকবে কিন্তু বসিং থাকবে।

 এখানে বন্দুকের নলের জোরের চেয়ে আদর্শ আর দেশপ্রেমের জোর বেশি হবে। যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবে দেশপ্রেম, সৈন্য বা প্রথাগত সেনাবাহিনী নয়। জানতাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুযুিদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এমন অনেকেই তখন তাহেরের এসব চিন্তা চেতনায় ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এ আবার নতুন কি এক উট! কিন্তু সব সমালােচনাকে উপেক্ষা করে তাহের তাঁর গেরিলা যুদ্ধের নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিলেন এবং পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছিলেন। বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি যুদ্ধ যে কনসেশনাল’ পদ্ধতিতে হতে পারে না, তাহের তা জানতেন। আমার অভিজ্ঞতা, তাহেরের এ উপলব্ধি মুক্তিযুদ্ধের মাঠে যথেষ্টই কাজে দিয়েছিল। হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযােদ্ধার মনে অধিনায়কের সে বিশ্বাস অবিশ্বাস্যভাবে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। তারা আগের চাইতেও দুর্বার হয়ে উঠেছিল। সেনাবাহিনীর দক্ষ এবং জাদরেল কোনও অফিসার বা বস্ হিসেবে নয়, তাহের সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতাে। তাবুতে তাবুতে ঘুরে বেড়াতেন যখন তখন, যা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা একজন অফিসারের কাছ থেকে সে সময়ে প্রায় এক অসব আচরণ। তাহেরকে আমার সে কারণে যথেষ্ট আলাদা এক মানুষ মনে হয়েছিল। একজন প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমর অধিনায়ক। আর মনে হয়েছিল, দেশ ও জাতির সভ্যতা বিনির্মাণের জন্য যে সিভিল সমাজের প্রয়ােজন, সেনাবাহিনীর লােক হয়েও তাহের তা অনুধাবন করেন। মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের এক-দু বছরের মাথায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এক প্রােগ্রামে গেলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি তখন নতুন দেশের নতুন প্রজনের গর্বিত এক মানুষ, সদ্য মুক্তিযুদ্ধ থেকে উঠে আসা এক তরুণ, কেবলমাত্র সাংবাদিকতায় যােগ দিয়েছি। আমাদের হেলিকপ্টারটি নামল বেশ খানিকক্ষণ আগে। তারও পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নামল অন্যটি। দেখলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ আর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর সেখানে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে আগেভাগেই উপস্থিত। কি করে কতটা ভালবাসায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানাে যায়, তার জন্য তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

এদের একজন তখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার জেঠমী আর অন্যজন প্রতিমন্ত্রী। হেলিকপ্টার থেকে নামতেই মােশতাক আহম্মদ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আদরে-ভালবাসায় ঘনিষ্ঠ হয়ে একাধিকবার চুমাে দিলেন। মাথায় তার সেই বিশেষ টুপি। চোখেমুখে কি এক সীমাহীন ভালবাসা নেতাকে দেবার জন্য। ব্যাপারটা যথেষ্ট দৃষ্টিকটু লাগলেও কারােরই কিছু বলার ছিল না। আমার মতাে একজন নবীন সাংবাদিকের তাে নয়ই। একজন মন্ত্রীর জন্য একজন প্রধানমন্ত্রীকে কিংবা এ ধরনের একটি প্রকাশ্য জায়গায়, এ রকম একটি দৃশ্য না করলেই ভাল হত মাননীয় মীর জন্য। আমি এটাই ভাবছিলাম। আসলে এ ধরনের লােক দেখানাে ভালবাসার একেবারেই অর্থ হয় না। কিন্তু ঘটনাটি আমার সামনেই ঘটল। যে কথা বলছিলাম। সেবারেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম মিলিটারি একাডেমীর উধােধন করলেন কুমিলায়। তারপর অফিসার এবং জোয়ানদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। সে ভাষণের সবটা আর মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, বঙ্গবন্ধু তো পলার চোখের পানি ফেলে সদ্য-স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বনে, তােমরা জান না, আর আমার কত বড় আনন্দের দিন। আজকের এই দিনটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি দীর্ঘকাল। সেই দিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যে দিন নিজের চোখে দেখব আমার বাংলার ছেলেরা নিজের মাটিতে মিলিটারি একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। সব কিছুর পর চা-নাস্তা হচ্ছে। আমি সাংবাদিক, যতই তরুণ হই না কেন, আমার সেখানে যাওয়ার তাই তেমন অসুবিধা হয় নি। তাছাড়া আমার জন্য বাড়তি সুবিধাও ছিল কিছুটা। জিয়াউর রহমান, যাঁকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় বদলি করে আনা হচ্ছে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ করে, তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে আমাকে ভাল করে চেনেন, আর ঘনিষ্ঠভাবে জানেন আবু তাহের, যাঁকে ঢাকা থেকে জিয়ার পরিবর্তে কুমিল্লার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে সেদিনই। দু’জনেই সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বল্লেন, এই সেই ছেলে, ইত্যাদি। সেই প্রথম এবং সেই শেষ নিঃশব্দ পরিচয়। যে কথা বলতে এ প্রসঙ্গের অবতারণা। এখানে থাকতেও তাহের ঔপনিবেশিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাঠামােয় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকেও দেখতে চান নি। তার যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। আমাকে বেশ কয়েকবার কুমিল্লায় ঘুরতে যেতেও খবর পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু একবারও যাওয়া হয় নি।

পরবর্তীতে জেনেছিলাম, কুমিল্লায় থাকতেই তাহের সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষি আসারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে সচেতন করে দিয়েছিলেন। এখানে খাতেই তিনি সেনাবাহিনী থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে একবার পদত্যাগ পর্যন্ত চেয়েছিলেন, চিঠিও দিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের একজন বা কিছু সদস্যের যােগসাজশে সরকারকে উৎখাতের যে গােপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন তাঁর। লিখিত পদত্যাগপত্র। সবত বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার প্রয়ােজনে বিদেশে। সেনাপ্রধান ছিলেন তখন জে, সফিউল্লাহ। কিন্তু তাহেরের সেই সাবধান বাণী মােটেও কাজে দেয় নি। কেউ তার কথার গুরুত্ব বােঝে নি। আমার নিজের যা অভিজ্ঞতা, তাহের বিশ্বাস করতেন, মুক্তিযুদ্ধ একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রক্রিয়ার ফসল যা কখনও শুধুমাত্র একটি সামরিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অনেক কিছু হয়ত পছন্দ করতেন না, সে তার নিজস্ব চিন্তা চেতনার বিষয়। কিন্তু এও এখনও তিনি ভাবতে পারেন নি, লাখাে মানুষের আত্মদানে যে বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই বাংলাদেশে পুরনাে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আদলে আবারও সামরিক স্বৈরশাসকেরা জেঁকে বসবে। আমি রাজনীতিঘনিষ্ঠ নই। ছিলাম না কখনওই। তাহেরের নিজস্ব রাজনীতি চেতনা তার কৌশলের সাথে আমার অমিল যথেষ্ট। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্যসাধারণ সেনাপতি ‘ভিশনারি’-কে আমি ভালােবাসি। আর সে কারণেই দাবি করি, যে গােপন ট্রাইবুনাল করে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তার দলিল-দস্তাবেজ আজ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হােক। সে ট্রাইবুনালের ভালমন্দ সমাজের মানুষ জানতে পারুক। প্রয়ােজনে এই দেশপ্রেমিকের হত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা হােক। দেশে আজ গণত। অতীতের ভুল আর পাপগুলােকে যদি শুধরাতে পারা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতের পথে যেতে অধুনা সঠিক পদক্ষেপগুলাে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বৈকি!

জুলাই, ১৯৯৬

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ হারুন হাবীব