বীরশ্রেষ্ঠ’! গােলাম আজম
ভেবেছিলাম, আর যে-কোনাে বিষয়ের ওপরই লিখি, না কেন, অন্তত জামায়েতে। ইসলামের সদ্য-ঘােষিত প্রকাশ্য নেতা অধ্যাপক গােলাম আজম সম্পর্কে লিখব না। লেখা বা বুলা সর্বশেই যে নিরর্থক হয়, তা নয়। তবে ১৯৭১-এ যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়ে এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, সহস্র-লক্ষ . মানুষকে ধর্মের নামে ফাসি কায়দায় খুন করেছিল, এবং আজ পর্যন্ত যারা বহাল তবিয়তে তাদের সে রাজনীতি বজায় রেখেছে, এমনকি কিছুটা উন্নতিও করেছে, তাদের বিশেষ শক্সি কী? অনেকেই বলেন, অনেকাংশে নিজেও বুঝি, জামায়েতে ইসলামী আজ নাকি সময়ের বাস্তবতা। এও বুঝি, এ দলটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের একাধিক সাময়িক সময় কাটিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব অনুভব করার মতাে শক্তি অর্জন করেছে। বাস্তবতা আরও আছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরােধী মুসলিম লীগ বা অন্যান্য ধর্মবাদী দলগুলাের রাজনৈতিক নেতারা অনেক আগেই যেখানে ফসিলে পরিণত হয়েছে, জামায়েতের নেতাদের ক্ষেত্রে তা হয় নি। বরং তাদের ওপরের পর্যায়ের সকল নেতাই, এমনকি নিম্ন পর্যায়েরও অনেকে, নিজেদের রাজনৈতিক ইমেজ অনেকাংশেই পুনরুদ্ধার করেছে। এবং পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য এবং আত্মসম্মানী জাতির কাছে যেখানে তাদেরকে গণহত্যা, জাতির স্বাধীনতার সশস্ত্র বিরুদ্ধাচারণ, লুণ্ঠন ইত্যাদি করার অপরাধে নাজি যুদ্ধ-অপরাধীর মতাে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত, সেখানে তাদের ক’জন আজ একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে জিতে স্বাধীন দেশের জাতীয় সংসদে এম.পি. পর্যন্ত হয়েছে। বাস্তবতা আরও আছে। দেশের স্বাধীনতাবিরােধী এই দলটির প্রধান নেতা অধ্যাপক গােলাম আজম, যে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, মাত্র সাত বছরের মাথায় বহাল তবিয়তে দেশে ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, যে-কোনাে পরিস্থিতিতেই হােক, যে-কোনাে শক্তির চাপের মুখেই হােক, সুদীর্ঘ বারাে-তের বছর এ দেশের সরকার, এ দেশের শতধাবিভক্ত স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক শক্তি, সবারই গােচরে সে এই খােদ ঢাকা শহরে বসবাস করছে এবং তার রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিতে পরিচালিত করছে! যে-কোনাে দেশের সরকার শুধুমাত্র নিজেদের রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে না, সেই সাথে জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল করে গড়ে তােলে, আইনের, নৈতিকতার-চরিত্রের ক্ষণাবেক্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ মানুষের রক্ত, বাঙালিদের অহঙ্কার ও লক্ষ বাঙালি নারীর ইজ্জত, লক্ষ মায়ের-বীর-প্রেমিকের প্রিয়জন হারানাের ফলে সৃষ্ট যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক বাহিনীর প্রতীক নেতা গােলাম আজম সম্পর্কে নীরব থেকেছে।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এও এক নির্মম বাস্তবতা। বাঙালি জাতির জাতীয়বাদী আন্দোলনের প্রধান পুরুষ, স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে অগণিত মানুষ হত্যাকারী, যুদ্ধ-অপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরােধীদের বিচারের ব্যবস্থা হয় নি! বঙ্গবন্ধু তাে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেছিলেন সাধারণ রাজাকারদের, কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযােগে কেন অভিযুক্ত করা হয় নি অগণিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী কুখ্যাত আল-বদরের প্রধান মৌলানা মতিয়র রহমান নিজামীসহ অন্যান্যকে ? এর উত্তর আজ কার কাছে খুঁজব? কার কাছে প্রশ্ন রাখব। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর, ‘৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, মুক্তিযােদ্ধা জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের দল এবং রাজনীতি করার সুযােগ দিয়েছে। সেই ঘৃণ্য হত্যাকারী স্বাধীনতাবিরােধী আর সাম্প্রদায়িক গণদুশমনদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে। মিথ্যে প্রমাণিত করার জো নেই, সে সময়েই গােলাম আজমের মতাে যুদ্ধ-অপরাধী বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং আজোবধি বহাল তবিয়তে থাকছে। তাকে নাকি নাগরিকত্ব দেওয়া হয় নি। কিন্তু কী করে থাকছে এই গােলাম আজম। কমপালসন’ বলে ইংরেজিতে একটি কথা আছে। অর্থাৎ বাধ্য হয়ে, বেগতিক হয়ে। ধরে কি নিতে হবে বিগত কুড়ি বছরে বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ পন্থী যতগুলাে সরকার এসেছে তারা সবাই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ সেই কমপালসন’-এর ফলেই গণহত্যাকারী, যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার করেন নি বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। এই যদি সত্যি হয়, কোথায় আমাদের জাত্যাভিমান, কোথায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, কীসের আমাদের স্বাধীন-সার্বভেীম জাতি হবার যােগ্যতা । সুস্পষ্টভাবেই বুঝি, অনেক বুদ্ধিমান এবং চালাক মানুষই আজকাল এ বিষয়গুলােকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রগতিশীল, দীর্ঘদিনের কট্টর বামপন্থী এবং এককালের ঘাের মুক্তিযুদ্ধপন্থী বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদেরও অনেকে আজকাল জামাত-শিবিরের সাথে গ্রুপ করেন, ইলেকশন করেন। এই সব কর্মকাণ্ড তারা করেন শুধুমাত্র পরিবর্তিত সময়ে সুবিধাবাদী স্ট্রাটেজী বা রাজনৈতিক সময় কৌশলে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজ জীবনে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে পরিস্থিতিতে নিজের মুক্তিযুদ্ধপন্থী মানবিক গৌরবের কান কেটেও আরেক মুক্তিযুদ্ধপন্থীর যাত্রাভঙ্গ করতে হচ্ছে আমাদের। এবং এই যখন পরিস্থিতি, তখন শুধুমাত্র ভাবাবেগনির্ভর হয়ে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণ করে বলেই একজন লেখকের জামায়াত বা গােলাম আজমের বিরুদ্ধে কলম ধরার সার্থকতা কী?
অতএব স্থির করেছিলাম, লিখব না। লিখে কিছু হবে না। হবে না, কারণ চলতি দলীয় বা গােষ্ঠী রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তিকে আজ একে অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। এমনকি একদল আরেক দলকে শায়েস্তা করতে বাড়তি শক্তি সঞ্চয়ের জোগান নিচ্ছে স্বাধীনতার ঘাতক দালালদের কাছ থেকে। এই স্বাধীন বাংলাদেশে যত স্বল্প সংখ্যক এম.পি.ই থাকুক না কেন, জামায়েতে ইসলামী, বর্তমান আমলে, সরকার গঠনে ভূমিকা পর্যন্ত রেখেছে। দু’জন মহিলা এম.পি, সরকারি দল থেকে ছাড় পেয়েছে। এবং কিছু রাজনৈতিক আর প্রায় গােটা সাংস্কৃতিক শক্তি যখন মুক্তিযুদ্ধের বিশ বছর পূর্তি উদযাপন করছে, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধঅপরাধী পাকিস্তানি নাগরিক গােলাম আজমকে জামায়াতের আমীর’ ঘােষণা দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে তৈরি সংবিধানের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে ওরা। সম্প্রতি কিছু বিরােধী দল গােলাম আজমের বহিষ্কার বিচার ইত্যাদি নিয়ে জাতীয় সংসদে হৈচৈ করেছে। মুক্তিযােদ্ধা সংগঠন, যুব-ছাত্র সমাজ আর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলাে বিবৃতি, সভা-সমিতি আর মিছিল করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, গােলাম আজমকে এখনাে বাতিলকৃত নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয় নি। বিদেশী নাগরিক হিসেবে কীভাবে এ-দেশের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচিত হলেন, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, ইত্যাদি। ব্যাস, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের মৌসুমিক বীর্যের পতন ঘটেছে এবং তার জায়গায় ঠিকই আছেন গােলাম আজম এবং আছেন বহাল তবিয়তে। ইতিমধ্যে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, তিনি দলের সভায় সভাপতিত্ব করছেন। হয়তাে কদিন পর আরও খবর বেরুবে গােলাম আজম খােদ ঢাকা শহরে মিছিল করছেন, সভাসমিতিতে ভাষণ দিচ্ছেন, ইত্যাদি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের খবর। দক্ষিণ কোরিয়ার সফরে যাবেন জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী মিয়াজাওয়া। দীর্ঘকালের গভীর বন্ধুসুলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক জাপান-কোরিয়ার। কিন্তু সফরের ঠিক আগে বাদ সাধলেন কোরীয় জনগণ এবং খােদ সরকার। তাঁরা একযােগে জানিয়ে দিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, অর্থাৎ ৫০ বছর আগে, জাপানি সেনাবাহিনী কোরীয় মেয়েদের জোড় করে ধরে যে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়ােগ করেছিল, সেই অপরাধের জন্যে জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে প্রথমে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে, তারপর হবে সফর।
পত্রিকা পাঠকমাত্রই জানেন, প্রধানমন্ত্রী মিয়াজাওয়া কোরীয় জনগণের কাছে প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তারপর সে দেশ ভ্রমণ করেছেন। না, বাংলাদেশের সরকার বা জনসাধারণের কাছে কোনাে পাকিস্তানি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ১৯৭১ সালের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ আর নারী নির্যাতনের জন্যে একটিবারও। ক্ষমা প্রার্থনা করে নি। আমরা কুড়ি বছরেও আমাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষার দাবি তুলতে পারি নি। পঞ্চাশ বছর আগের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হত্যাকারী যুদ্ধ-অপরাধীকে পইপই করে খুঁজে ইউরােপবাসী আজও যেখানে কাঠগড়ায় তুলছে, নাজী গোপাে বাহিনীর নেতাদের আজও যেখানে বিচার হচ্ছে, ভােটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধে, সেখানে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি যুদ্ধঅপরাধী সামাজিক সম্মান নিয়ে বেঁচে আছে। না, ওদের সম্মান শুধু সুপ্রতিষ্ঠিতই হয়। না, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনায় দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা একাত্তরের পরাজয়ের শােধ দিতে। আর আমরা, মুক্তিযােদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথিত সিপাহসালাররা, রণে মে যাওয়া কুকুরের মতাে এক দু’বার হুঙ্কার ছেড়ে পশ্চাদপসারণ করছি ক্রমাগত! বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ কালের ইতিহাসের প্রতিটি পাতা আয়ত্ত করার মতাে পাণ্ডিত্য আমার নেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রত্যক্ষদশী বলে এতটুকুন বুঝি, সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের কমতি না হলেও, আমাদের সমাজের ওপর তলার মানুষদের ত্যাগের তুলনায় প্রান্তি বেশি। বােধকরি, নিজেদের এই নগণ্য ত্যাগের কারণে জাতির বৃহত্তর ত্যাগকে এরা অস্বীকার করতে পারেন অনায়াসে। এই বাংলাদেশে, জনগণ যাকে বা যে দলকে ভােটে নির্বাচিত করবেন, তারাই চালাবেন দেশ-সরকার। একজন গণতান্ত্রিক মানুষ হিসেবে এই সভ্য ধারার শক্তিশালী বিকাশ দেখতে চাই আমি। গণরায়ে নন্দিত দলের আদর্শ ও কর্মসূচির সাথে আমার অমিল থাকতে পারে, কিন্তু গণরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা স্বৈরাচারী মানসিকতার সামিল। কিন্তু জাতীয় স্বাধীনতার ভিত্তি যে ইতিহাসে, তাকে অশ্রদ্ধা করে জাতির সম্মানকে ক্রমান্বয়ে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের রাজনীতি-স্বার্থকে ঘৃণা ছাড়া উপহার দেওয়ার মতাে আমার আর কিছু নেই। সেদিন শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলছিল, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যদি তার মতাে বাবা হারাত, তাহলে বুঝত, ঘাতকের হাতে প্রিয়জন হারানাের কী কষ্ট! সেই ছােট্ট শমী, যার স্বাধীনতাকামী লেখক-সাংবাদিক বাবা শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে গিয়ে আল-বদররা একাত্তরে খুন করেছিল, তার রােদনের কী মর্যাদা দিয়েছে এই সমাজ ?
না, গােলাম আজম গংদের প্রশ্নটি শুধু আইনগত নয়, নৈতিক। আমাদের এই সমাজ যদি নীতির, নৈতিকতার বা চরিত্রের প্রশ্নে আপােস না করে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক-দালালদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে একদিন না একদিন। আর তা যদি করা না যায়, তাহলে এ জাতির পরিচয় হবে ইতিহাসে কাপুরুষ, সভ্যতাহীন, বীর্যহীন। মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক-দালালদের ঘৃণা অথবা বিচারের প্রশ্নটি কোনাে রাজনীতি বা দলমতের প্রশ্ন নয়। আমরা কতটুকুন আত্মমর্যাদাশীল জাতি, এ প্রশ্ন তারই। গণতান্ত্রিক এ সমাজ ব্যবস্থায় যে কোনাে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে যে কেউ রাজনীতি চর্চা করতে পারেন। বৃহত্তর মানুষ যাকে বেছে নেবে, সে-ই সরকার। কিন্তু শুধু ব্যক্তিকে নয়, জাতির অপমানে অপমানিত হতে হবে সরকারকে, গােটা জাতিকে। আমরা যেন এমন কোনাে রাজনীতি না করি, যে রাজনীতি চর্চা জাতির আত্মসম্মানকেও ভুলিয়ে দেয়। স্বাধীনতায় যেমন প্রবল ভালােবাসা চাই, স্বাধীনতার বিরােধীদের প্রতিও তেমনি চাই প্রবল ঘৃণা। আজ আমরা যেন ক্রুদ্ধ হতেও ভুলে গেছি অপমানে! অনেকেই হয়তাে আমাকে বাস্তবতাবর্জিত এক হটকারী মানুষ বলবেন। বলবেন, যে দলটি জাতীয় সংসদের ১৮টি আসন জয় করেছে, সে দলের বিরুদ্ধে কথা বলে আপনি অগণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন। না, আমি শুধু এ দেশের মানুষ আর সকল ধর্মালম্বীর কাছে জামায়েতে ইসলামীর ঐতিহাসিক পাপের কথাই বলছি না, সেই সাথে ওদেরকে ওই পাপের স্বাভাবিক প্রায়শ্চিত্ত করানাে যায় নি বলে আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার কথাও বলছি। বার্লিনের স্পনডাউ কারাগারের সুবিশাল চত্বরে এই সেদিন। পর্যন্তও একটিমাত্র বন্দি ছিলাে আমৃত্যু। নাজি যুদ্ধ-অপরাধী রুডলফ হেস। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর প্রাক্তন সােভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ সেনাবাহিনী এই একমাত্র বন্দিকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল কয়েক যুগ। না, এ কোনাে প্রতিহিংসা নয়। মানবতার বিরুদ্ধে পাপ করার এ প্রায়শ্চিত্ত, যা নিশ্চিত না করলে সভ্যতা বিনির্মাণ করা যায় না। গােলাম আজম বা তার জামায়েতে ইসলামী কি বাংলাদেশের জনগনের সশস্ত্র বিরুদ্ধাচারণ, গণহত্যা আর ধর্ম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে নারী ধর্ষণের মতাে জঘন্য অপরাধের জন্যে কখনাে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। না, একটিবারের জন্যেও করে নি। তারা তাদের পুরনাে রাজনীতি বজায় রেখেছে। জাতীয় সংসদে আজ তাদের সব মিলিয়ে আসন সংখ্যা বিশ।
অর্থাৎ এই দলটি সময়ের মুখােশে তাদের নেতা গােলাম আজমের সেই বাণীই প্রমাণ করতে চায় যে, মুক্তিযােদ্ধারা ইসলামের দুশমন, আর স্বাধীনতার সমর্থকরা হচ্ছে কাফের। স্বাধীনতা, মানবতাবিরােধী এই গােলাম আযম বা তার সহযােগী ফ্যাসিস্ট যুদ্ধঅপরাধীদের পুনর্বাসনকে যদি প্রতিরােধ করা না যায়, তাহলে অবশ্যই আমাদের। জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসকে পাল্টাতে হবে। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ’-কে নাম বদলে। ডাকতে হবে ‘বেঈমানশ্রেষ্ঠ’। বীর উত্তম, বীর বিক্রম আর বীরপ্রতীক উপাধিগুলাে ছিনিয়ে নিতে হবে জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মােশাররফ, কাজী নূরুজ্জামান, সি, আর, দত্ত, আবু তাহের, কাদের সিদ্দিকী, এ. কে খন্দকার, জিয়াউদ্দিন, মেজর রফিক, হায়দার, মঈন, শাফায়াত জামিল থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পদকধারীদের কাছ থেকে। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি, জেনারেল ওসমানীকে ডাকতে হবে ‘বেঈমান বাহিনীর প্রধান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে নামবদলে ডাকতে হবে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের সরকার। আর বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রধান পুরুষ, শত্রু-মিত্রের কাছে যিনি আজও, এই বৈরী সময়েও বঙ্গবন্ধু’, তাকে আখ্যায়িত করতে হবে কি পদবিতে— তা না হয় জামায়াতের নেতারাই ভেবেচিন্তে স্থির করে দেবেন। এ কাজগুলাে করতে হবে, কারণ দেশীয় রাজনীতিতে শক্ৰমিত্র থাকলেও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শক্ৰমিত্র, একই দেশে, একই সমাজে সহাবস্থান করতে পারে না। এই মৌলিক প্রশ্নের যতদিন সুরাহা না হবে, ততদিন মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমতের প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। পারে না জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর প্রগতি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে। আমাদের জাতির অনেক ব্যর্থতা আছে, অনেক দুর্ভাগ্য আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিশ বছর পর পয়লা নম্বরের যুদ্ধ-অপরাধী গােলাম আযমকে নিয়ে বিতর্ক করার মধ্যে যে ঐতিহাসিক ব্যর্থতা, তার তুলনা নেই। জাতি এই বিশ বছরে বিন্দুমাত্র সামনে এগােয় নি, ব্যাক-গীয়ারে ঘুরে আবার যেন থমকে দাড়িয়েছে সেই ১৯৭১-এ গিয়ে। বিস্মৃত হবার কিছু নেই, ইতিহাসেরই অনিবার্যতায় হয়তােবা তুরানিত হচ্ছে বাঙালি জাতির সামনে আরেক ঐতিহাসিক যুদ্ধ। ঐক্যে এবং যােগ্যতার এ সংকট মােকাবেলা করতে না পারলে অবশ্যই নতুন ইতিহাস লিখতে হবে আমাদের। যে ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিটা দিতে হবে জাতীয় ধানতার ইতিহাসের কুখ্যাত অধ্যাপক গােলাম আজমকে। অবশ্য, ইকাে করলে, সে কাজটা এখনাে সমাধা করতে পারা যায়। কারণ, বিগত বিশ বছরে আজম সাহেব যে। যােগ্যতায় তার দল গড়ে তুলেছেন, ধর্মের কথা বলে যে কৌশলে তার অবস্থান দৃঢ় করেছেন, মুক্তিযােদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের একের পর এক যেভাবে পরাজিত করেছেন, তাতে পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের তঘমাটা তারই প্রাপ্য। আসলে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ জিতবে না ধ্বংস হবে, ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে না হবে না, তারই পরীক্ষা এখন।
জানুয়ারি, ১৯৯৩
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব