নতুন রাষ্ট্রশক্তির জন্যে পুরনাে চ্যালেঞ্জ
রাষ্ট্রকে অবশ্যই জাতীয় ইতিহাসের রক্ষক হতে হয়, এবং সেই সব রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রককে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করা চলে, যারা জাতির গর্বিত ইতিহাসকে রক্ষা করে না, বরং অপমানিত করে, খণ্ডিত করে এবং নিজেদের প্রয়ােজনে নতুন প্রজন্মের মন থেকে তা মুছে দেয়ার চেষ্টা করে। ১৯৭৫ সালের বর্বরতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে উঠেছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের, এবং সেই সাথে জাতীয় ইতিহাসের, একনিষ্ঠ ঘাতক। এই সব ঘাতকেরা জাতির স্বাধীনতার পৃষ্ঠে যেভাবে ছুরিকাঘাত করেছে তার তুলনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। এরা আমাদের নতুন মানুষদের বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের সত্য ঘটনা জানতে দেয় নি। এরা মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের প্রয়োজনে সামরিকায়ন করেছে। পাঠ্য পুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলােকে এরা এমনভাবে ব্যবহার করেছে, যাতে নতুননবীনদের মগজে জাতির সঠিক ইতিহাসটি কখনােই না পৌছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকরা, যাদের প্রায় সবাই আবার সেনাছাউনি থেকে উঠে এসেছিলেন, এ ব্যাপারটি যথার্থই বুঝেছিলেন যে স্বাধীনতা-উত্তর নবীনদের মগজে যদি মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত বা মনগড়া ইতিহাস ঢুকিয়ে দেয়া না যায়, তাহলে নতুন রাজনৈতিক অভিলাষ মাঠে মারা যেতে বাধ্য। আর, সে-মিশনে সফলতাও লাভ করেছিল তারা যথেষ্ট। ইতিহাস উদাসীনতা কিম্বা ইতিহাস বিকৃতি আমাদের এক শ্রেণীর তরুণকে পুরােটাই গ্রাস করেছিল। এ অপরাধ কখনােই তারুণ্যের নয়, এ অপরাধ বিকৃত রাষ্ট্রশক্তির, যে-রাষ্ট্রশক্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই শুধু খণ্ডিত বা বিকৃত করে নি, সেই সাথে বাঙালির নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত সুকৌশলে পুরনাে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছে, ক্রমান্বয়ে তাদের ভাগ্যবাদী করেছে, এমনকি সাম্প্রদায়িক করতেও সচেষ্ট হয়েছে। আর এই কাজটি করেছে তারা ধর্মের নামে, যেভাবে পাকিস্তানিরা চেষ্টা করেছিল ধর্মকে ব্যবহার করতে। অথচ নতুনদের একটিবারের জন্যও তারা বুঝতে দেয় নি, এই ধর্মের নামে, এই ধর্মেরই অপব্যাখ্যায়– এক শ্রেণীর মােল্লাবাদী ভও রাজনীতিবিদ কত লক্ষ লােককে হত্যা করেছে এই দেশে, কত লক্ষ মেয়ের ইজ্জত লুটেছে এই দেশে। অন্যদিকে, নিজেদের চলতি রাজনীতির প্রয়ােজনে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সংগ্রাম বা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধকে যখন গৌরবান্বিত না করে পারা যায় নি, তখন ধরা তারা ধরেছিল অন্য ফিকির।
বােঝানাে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এমন এক যুদ্ধ– যা একটি বেতার কেন্দ্র থেকে একটিমাত্র ঘােষণা দিয়েই শুরু করা হয়েছিল। অথচ একটি জাতির মুক্তিসংগ্রাম বা জাতীয় স্বাধীনতার গণযুদ্ধ যে আবাহনী-মােহামেডানের কোনাে ফুটবল ম্যাচ নয়, যা এক রেফারির বাঁশির হুইসেলেই শুরু বা শেষ হয় এই সাধারণ ব্যাপারটিও এই জ্ঞানপাপীরা বুঝতে চায় নি। অতএব, সেনাছাউনি-চালিত সুদীর্ঘ রাজনীতির পৃষ্ঠপােষকতায় সমাজের নতুন মানুষদের এমন এক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যখন এদের বেশির ভাগের মগজে জাতির সত্যিকারের ইতিহাস-চিন্তা প্রবেশ করানােটাই ছিল দুঃসাধ্য। অবশ্য, আজ যখন এ লেখাটা লিখছি, তখন পরিস্থিতির বেশ খানিকটা উন্নতি ঘটেছে বলে ভাববার কারণ আছে। চলতি রাজনীতির টানাপােড়েনেও জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আগের মতাে এখন তেমন বড় সংকট নেই। ইতিহাসের অমােঘ নিয়েমেই ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিগুলাে এখন কমে আসছে। আমার বিশ্বাস, আরও কমবে। কারণ যে কোনাে জাতির রক্তাক্ত ইতিহাসের নিজস্ব একটি শক্তি আছে যা দিয়ে নিজেকে সে সব সংকটেও শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা দিতে পারে। স্বাধীনতার ২৬ বছর পূর্তির শুভক্ষণে দেশজুড়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী পালিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে শিখা চিরন্তন’-এর চিরঞ্জীব আগুন জ্বালানাে হয়েছে, এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দলের সরকার প্রতিষ্ঠিত করার কারণে জাতীয় গৌরবের ইতিহাস সযতনে সংরক্ষিত হবে, এটা আমরা স্বাভাবিকভাবেই আশা করতে পারি। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, অধিকন্তু তরুণদের অনেকেই আজ যে তাদের জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধকে যথার্থ আঙ্গিকে জানতে আগ্রহী তার একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে রজত জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় লক্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। একজন মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন লেখক হিসেবে আমাকেও এ সময়ে একাধিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় লক্ষ করেছি, তরুণদের বেশির ভাগ চায় আমরা যেন বেশি করে তাদের সেদিনের লড়াইয়ের কথা বলি, বেশি করে বলি মুক্তিযােদ্ধাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনী, বলি, আসলেই কী ঘটেছিল উনিশ শ’ একাত্তরে। কারা এর বন্ধু ছিল, কারা ছিল শক্র। জাতির ইতিহাস অনুধাবনে এ এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত বৈকি। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় হচ্ছে, যে-মানুষটি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের স্থপতি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এ মাটিতে, এবং নিষ্ঠুরতম এক পন্থায়।
অন্যদিকে আবার তারই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নব্য-পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি-ধারা, যে-ধারাকে উৎখাত করতে বাঙালিকে দুই যুগ ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত একটি সর্বাত্মক গণযুদ্ধ পর্যন্ত করতে হয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে সেই সংগ্রামের বা ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্পটি পর্যন্ত শােনাবার সুযােগ রাখা হয় নি, পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রকরা ছিলেন জাতির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহাের এমনই সচেতন বিরােধী। আসলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বা মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মান দেখার কথা বলে, একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে এই বাংলাদেশে যতােটা বিকৃত আর অপমানিত করা হয়েছে, এমনটা আর অন্য কোথাও ঘটেছে বলে শােনা যায় নি। কারণ বাঙালিদের মধ্যে দেশপ্রেমিকের সংখ্যা যতােই বেশি”হোক না কেন, দেশঘাতক বা বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যাও কম নেই। ইতিহাসই তার সাক্ষী। স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন সরকারের সমালােচনা বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযােগ অনেক ক্ষেত্রেই অমূলক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা শক্তও। আবার অনেক ক্ষেত্রেই তা স্বাধীনতার শত্রুদের সুপরিকল্পিত রটনা আর ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশও। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, মুজিবকে হত্যার পর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেভাবে সর্বশক্তি নিয়ােগ করা হলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমাজ-শক্তিকে ধ্বংস করতে, তা থেকেই বােঝা যায়, ওরা আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সেই কাজে কদূর তারা সমর্থ হতে পেরেছিল বা পারে নি, সে-বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকরা, যারা আবার বেশির ভাগই উঠে এসেছিল আমাদের সেদিনকার পাকিস্তান-প্রভাবিত সেনাছাউনি থেকে, মুক্তিযুদ্ধের সমাজ-শক্তিকে আর-সব শক্রর চেয়েও বেশি করে শত্রু বিবেচনা করেছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তিকে আড়াল করতে চেয়েছে। এরা বাঙালি। জাতীয়তাবাদের সমাজশক্তিকে ভয় করেছে, কারণ ওরা ভালাে করেই জানত, এ। শক্তিকে ধ্বংস করতে না পারলে তাদের নতুন কৌশলী ক্ষমতার মসনদ টিকবে না। আমার এ মন্তব্যটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। আমি সব মতবাদে সহনশীলতা চাই। গণতন্ত্রের মূলভিত্তিই তাই । অতএব বিতর্ক হলে হােক। তবে এটা ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধ। নিয়ে বিতর্ক তুলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগ্রহী মুক্তিযুদ্ধের ঘােরতর বিরােধীরাই। এরা ছলেবলে-কৌশলে কখনাে অতি-প্রগতিশীল হয়ে ওঠে, কখনাে আবার পাকিস্তান। ভেঙে ভারতই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে— এমন যুক্তি দেখাতেও পিছপা হয়। না। সে কারণে আমার বিশ্বাস, পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্রশক্তির হাতে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রকশক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদের এ-যাবৎকালের ক্ষতির সীমানা পর্যালােচনার দাবি রাখে।
আরও বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ তথাকথিত সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মাকে সর্বাংশে উৎখাতের পরিকল্পনাটা সুদূরপ্রসারী এক চিন্তা-চেতনারই ফসল। বাঙালি যেন আর বাড়তে না পারে, আর বেশি সংগঠিত বা বিকশিত হতে না পারে, তার বিরুদ্ধে কৌশল নির্মাণই ছিল এসবের বড় লক্ষ। ‘জয় বাংলা’, ‘জাগাে জাগাে বাঙালি জাগাে’ কিম্বা ‘তােমার আমার ঠিকানা— পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি উচ্চারণগুলাে, যা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সেদিন আবালবৃদ্ধবনিতার মুখের বুলি ছিল, হৃদয়ের ডাক ছিল, এবং এসব যে ছিল বাঙালি জাতীয়তা-উত্থানেরই বহিঃপ্রকাশ, তা এরা ভালাে করেই বুঝত। কিন্তু বাঙালি হয়েও এরা আত্মঘাতী হয়েছে, কারণ এদের বেশির ভাগই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে পুরনাে পাকিস্তানি রাজনীতি-ধারারই নব্য-প্রতিভূ। * হাতহাসের বিশাল স্তগুলােকে কালাে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিলেও চিরদিনের জন্যে সেগুলোকে আড়াল রাখা সম্ভব হয় না। ঐতিহাসিক সত্যের যে অন্তর্নিহিত শক্তি সাথে তার জোরেই সে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে কিংবা নিজের পুনরুত্থান ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের বেলাতেও সে সত্য প্রমাণিত হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি জাতীয় ঘটনাকে কোনাে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবার অবকাশ নেই; কিংবা মুক্তিযুদ্ধে মতাে একটি বিশাল-বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনাকে দলীয়করণ করারও বিন্দুমাত্র সুযােগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল। সমাজের সকল শ্রেণীর তারুণ্য, বিশেষ করে ছাত্র, তরুণ চাকরিজীবী, তরুণ কৃষক-মজুর, এমনকি মাঝ বয়সী সরকারি, আধাসরকারি আর বেসরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সেই সাথে আরও ছিল আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের দেশপ্রেমিক অংশ এবং সেদিনের ইপিআর ও পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং নেতৃত্বদানকারী গণসংগঠন ছিল আওয়ামী লীগ, যা সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। এ ছাড়াও ছিল অন্যান্য ছােট রাজনৈতিক দল আর গণসংগঠন— যদিও তাদের ভূমিকা তেমন উজ্জ্বল ছিল না। মূলত তাদের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণেই। এর পরও তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখবার সুযােগ নেই। যে কথা আগে বলছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সমাজ ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে যারা শত্রু বিবেচনা করে তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা বা তার অর্জনকে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল শাশ্বত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর দাঁড়ানাে, বাঙালির অসম্প্রদায়িক জাত-চেতনার ওপর নির্মিত হাজার বছরের আরাধনার ফসল। আর এই রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে যারা ধ্বংস করতে তৎপর, তাদের মন দেহ জুড়ে যে দুরভিসন্ধি তাকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তিতে এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের থিউরি’ দাঁড় করিয়ে ধর্মের নামে যে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামাে তৈরি করা।
হয়েছিল, সেই শশাষণনির্ভর রাষ্ট্রকাঠামােকে পরিত্যাগ করতে আমাদের দুই যুগ সময় লেগেছে। আমাদের আরও দুর্ভাগ্য হচ্ছে, নতুন-নবীনদের চোখ থেকে ধর্মের নামে পাকিস্তানি শোষণ আর বর্বরতার কাহিনীগুলােকে পর্যন্ত পঁচাত্তর-পরবর্তী এইসব রাষ্ট্রশক্তি আড়াল করে রেখেছিল তাদের পাকিস্তান-ঘনিষ্ঠ রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। তবে বাংলাদেশে আজ এক নতুন রাষ্ট্র পরিক্রমার শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল প্রায় দুই যুগ পর রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এসেছে। পঁচাত্তরের হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এই বিচার জরুরি । ধর্মীয় মৌলবাদী আর স্বাধীনতা বিরােধীদের বিরুদ্ধে আজ খােদ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে প্রতিরােধ আসছে, যা বিগত একুশ বছরে ছিল অভাবিত। আমার কাছে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ আবার জেগে উঠছে। পচাত্তরের পর যে দুর্ভাগ্যজনক এক রাষ্ট্র-পরিক্রমা শুরু হয়েছিল, রাজনীতির অনেক পর্যবেক্ষকই ধরে নেবেন, ইতিহাস-বিনাশী সেই পরিক্রমার শেষ হতে যাচ্ছে এখন। মুক্তিযুদ্ধের লাখাে শহীদের আত্মার সম্মানের জন্যে, বাঙালিকে তার অসাম্প্রদায়িক জাত-চেতনা ধারণ করে বিকশিত হবার জন্যে, নতুন এই পরিক্রমাকে আমি স্বাগত জানাব। সেই সাথে এ-ও আশা করব, মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক শক্তির এই পুনর্জাগরণের সম্ভাবনাটি যেন নিছক অসর্তকতায়, নির্বোধ আত্মতুষ্টিতে বা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় পুনর্বার বাধাগ্রস্ত না হয়। নতুন এই রাষ্ট্রশক্তির প্রবল সচেতনতার কারণ রয়েছে বৈকি। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী ধর্মীয় উগ্রপন্থী বা সংগােপন পাকিস্তানপন্থীরা ‘ধর্ম গেল’ আর ‘দেশ গেল’ বলে আজ আবার। মাঠে নেমেছে। এরা ঠিক ১৯৭১ সালের মতােই যেন দুই শিবিরে বিভক্ত করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশকে। যে-কোনাে সচেতন মানুষই বুঝবেন, এরা বাংলাদেশ নামের স্থিতিশীলতা মেনে নিতে অপারক। এরা চায় সেই দেশটির বিনাশ, যে-দেশ তারা। কোনােদিন চায় নি। এরা আর সব রাজনৈতিক নেতাকে ক্ষমা করতে পারে কিন্তু শেখ মুজিবকে নয়, কারণ কখনােই এরা ভুলতে পারে না এই শেখ মুজিবই তাদের সাধের পাকিস্তানকে টুকরাে করেছিল। একাত্তরের মতােই আজ আবারও এদের হাতে সেই ধর্ম নামের হাতিয়ার। অথচ এই ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শ্রেণীটির হাতে কোনােদিনও কোনাে ধর্মই রক্ষিত হয় নি। ধর্মের যতােটা বিকাশ তার সবটাই সাধারণ ধর্মপ্রাণদের হাতে, যারা একে আত্মিক আরাধনার সম্পদ ভেবেছে, কখনােই রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত করে নি।
মার্চ, ১৯৯৭
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত প্রবন্ধ – হারুন হাবীব