You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.15 | পাকিস্তান সমর্থক ও মাওপন্থী বাঙালি - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তান সমর্থক ও মাওপন্থী বাঙালি

যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করেন। এদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিছুসংখ্যক বাঙালি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি বলে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। খুব অল্পসংখ্যক বাঙালি প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। এদের সংখ্যা দু’ডজনের বেশি হবে না বলে স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নান মনে করেন। বাঙালি হয়েও ব্যারিস্টার আব্বাস আলী, আজহার আলী, আফজল হামিদ, আবদুল হক, আবুল হায়াত এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সাথে পুরােপুরি সহায়তা এবং প্রকাশ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরােধিতা করেছেন। মাওপন্থী বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেন নি। তাঁরা বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী। কর্মপন্থা নির্ধারণ করে পৃথকভাবে আন্দোলন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন : “সেই দিন (১ মে, ১৯৭১) অপরাহে বামপন্থী বাঙালিদের একটি সভা কনওয়ে হলে অনুষ্ঠিত হয়। তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন নি। তবে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা। অর্জিত হলেও সর্বহারাদের কল্যাণ সাধিত হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। শেখ। আবদুল মান্নান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা অর্জন কর্তব্য বলে মন্তব্য করেন।  তৎকালীন বামপন্থী আন্দোলনের দুটি ধারার মধ্যে একটি মস্কোপন্থী এবং অন্যটি। চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল। মস্কোপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর ছ’দফার পক্ষে এবং চীনপন্থীরা  বিপক্ষে ছিলেন। ছ’ দফার সঙ্গে যারা একমত তাদের মধ্যে ছিলেন সাইদুর রহমান মিয়া, শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ, নিখিলেশ চক্রবর্তী, ডা. সাইদুর রহমান ও হাবীবুর রহমান। ছ’দফার। যারা বিরােধিতা করেন তাদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান। শাজাহান, জগলুল হােসেন এবং আরাে অনেকে।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে গঠিত হওয়ার পর ২২ নম্বর উইন্ডমিল স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক। সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লিখিত সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। একটি বামপন্থী পত্রিকার সংবাদদাতা জানতে চান, উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কমিউনিস্ট বা মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাস করেন কিনা। তখন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ হাত উচু করে বলেন, তিনি মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট এবং মাও সে-তুং-এর চিন্তাধারার প্রতি আস্থাশীল। এই উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে কীভাবে দেশের মুক্তি আসবে তা ব্যাখ্যা করে বলেন, সেই মুক্তি হবে আসল মুক্তি, অন্যের ওপর নির্ভরশীল মুক্তি নয় সম্প্রসারণবাদী’ ভারত এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ রাশিয়ার সেখানে কোনাে প্রভাব থাকবে না। আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত হবাে। ২৪ এপ্রিল স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ পরিচালিত একটি জনসভায় লন্ডন অ্যাকশন কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে সাখাওয়াত হােসেন এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান যােগদান করেন। জিয়াউদ্দিন তার বক্তৃতায় দাবি করেন, তিনি ঢাকা জেলে তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে একই সেলে বন্দি ছিলেন। তাজউদ্দিন সাহেবের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি চিত্রিত করেন একজন স্বামী ও সামন্ততান্ত্রিক মনােবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে তার নেতৃত্বের যােগ্যতা সম্পর্কেও জিয়াউদ্দিন প্রশ্ন করেন। জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুঙ্কর। রহমান শাজাহান এবং আরাে কয়েকজন বক্তৃতা করেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ। খােলাখুলিভাবেই নিজেদের নকশালপন্থী বলে দাবি করেন।১৬৯ বাঙালি হয়েও মুক্তিযুদ্ধকালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে আবুল হায়াতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার দেশের বাড়ি বৃহত্তর সিলেট জেলায় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের অধিকাংশ এই অঞ্চলে থেকে এসেছেন তাদের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা চালান পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী প্রচারণা চালাবার জন্য আবুল হায়াতের সম্পাদনায় মুক্তি নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করে। 

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের অজুহাতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-বিরােধী এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হায়াত। ১৬ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, দু’সপ্তাহ আগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশ সমর্থক। বাঙালিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের জবাব হিসেবে ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট এই সমাবেশের আয়ােজন করে। এপ্রিল মাসে আবুল হায়াতের নেতৃত্বে বার্মিংহামে প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে। পূর্ববঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের অভিযােগ অস্বীকার করে পাকিস্তান হাই কমিশন প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র এই সমাবেশে বিলি করা হয়। ১৯ আগস্ট “দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের – অধ্যাপক জি কিয়ারনান বলেন, বহুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি তাদের বর্বর সরকার এবং পূর্ববঙ্গে তাদের সামরিক বাহিনী সংঘটিত পাশবিক অত্যাচারের সমর্থনে ১৫ আগস্ট লন্ডনে যে সমাবেশের আয়ােজন করে, তার সংবাদ অবগত হয়ে তিনি অস্বস্তিবােধ করেন। এই সমাবেশ থেকে মনে হয়, অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দৃষ্টিহীনতা, গোঁড়ামি এবং নিন্দনীয় নেতৃত্বের মনােভাব সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এসব তাদের নিজের দেশে রেখে আসা উচিত ছিল। ২৩ আগস্ট উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদপত্রে আবুল হায়াত নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গের নাগরিক বলে দাবি করেন।

যুক্তরাজ্যে গোঁড়া পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ব্যারিস্টার আব্বাস আলী। তিনি ইংল্যান্ডে আইনের ছাত্র হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীর সমসাময়িক ছিলেন। ভারত-বিভাগের আগে বিচারপতি চৌধুরী যখন এ দেশে আসেন, তার আগেই আব্বাস আলী আসেন। লন্ডন অবস্থানকালে তাকে দেখাশােনা করার অনুরােধ জানিয়ে বিচারপতি চৌধুরীর পিতা আব্বাস আলীকে চিঠি লেখেন। লন্ডনের ছাত্রজীবনে তার সৌজন্যের কথা স্মরণ করে বিচারপতি চৌধুরী আব্বাস আলীর কাছে ঋণী বােধ করেন। আব্বাস আলীর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে আব্বাস আলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে দেখতে যান। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। আব্বাস আলী বিচারপতি চৌধুরীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং কথা বলতে রাজি হলেন না। বিচারপতি চৌধুরী আন্তরিক কণ্ঠে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, আমি তােমাকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে দেখা করতে এসেছি। তুমি অতীতে আমার সঙ্গে যে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছ তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছি; কিন্তু আব্বাস আলী কোনাে কথা বললেন না। মৃত্যুর আগে আব্বাস আলী নির্দেশ রেখে যান, তাকে যেন পাকিস্তানে কবর দেয়া হয়।

তার মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবরের পাশে যথারীতি মর্যাদার সঙ্গে তাকে কবর দেয়া হয়। জুলাই মাসের গােড়ার দিকে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভারের রিডার ড, মােহর আলী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাের জন্য লন্ডনে আসেন। ৭ জুলাই (১৯৭১) ‘দি টাইমস্ -এর চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত এক দীর্ঘ চিঠিতে তারা দাবি করেন, ২৫ মার্চ কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে শিক্ষককে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে নি। তাঁরা স্বীকার করেন, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলের। আশপাশে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে নয়জন শিক্ষক মারা যান। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক  বাহিনী হল দুটি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সামরিক আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না করলে এই ‘দুঃখজনক ঘটনা এড়ানাে যেতাে বলে তারা দাবি করেন। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা ইউরােপ, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলী পরিবেশিত নির্লজ্জ মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম হােসেন এবং বাংলার অধ্যাপক এম ইসলাম উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হুসাইন পাকিস্তানপ্রীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাজির করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালানাের জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেসরকারিভাবে যাদের বিদেশে পাঠায়, তাদের মধ্যে ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান। তিনি তার স্বামী, এস এ সােলায়মানের সঙ্গে ২০ জুলাই লন্ডনে এসে হাজির হন। তাঁর বক্তব্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানে যে যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তা গৃহযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ঢাকায় গণহত্যা সম্পর্কে ভারতীয় প্রচার ভিত্তিহীন। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংঘটিত গণহত্যাকে সমর্থন করে বেগম সােলায়মান জুন মাসে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, তাঁর পিতা বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করতেন। | লন্ডনে এসে বেগম সােলায়মান ও তার স্বামী প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তান সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যারিস্টার আব্বাস আলী, আজহার আলী, আফজাল হামিদ, আবদুল হক এবং আরাে কয়েকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। সাপ্তাহিক ‘মুক্তি পত্রিকার সম্পাদক আবুল হায়াত তাদের সঙ্গে ঘােরাফেরা করেন। কয়েকজন পাকিস্তান সমর্থক পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গেও তারা দেখা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিগ ডেভিডসন এবং মিসেস জিল নাইট (পরবর্তীকালে ডেইম নাইট)। তবে বাঙালি মহলে বেগম সােলায়মান সুবিধা করতে পারেন নি। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা তাকে _ আমল দেন নি। শিগগিরই বেগম সােলায়মান স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নানের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করেন। তিনি বলেন : “মান্নান ভাই, জেনােসাইড” (গণহত্যা) হয় নি, অফিসার হত্যা করা হয় নি, সব ভারতীয় প্রােপাগাণ্ডা। ‘বর্ডারে’ কিছুসংখ্যক রিফিউজি মরেছে; ওরা তাদের লাশ দেখিয়ে দিয়েছে। আর ইউনিভারসিটির ওখানে ওরা কয়েকজন ছাত্র মেরে তাদের ফটো বাইরের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে।’ শেখ মান্নান বলেন ‘আপনি তাে অনেক কিছুই জানেন; নিহত অধ্যাপকদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে; তারা কি তা হলে বেঁচে আছেন? আপনি কি তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তারা জীবিত কি মৃত—সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন? বেগম সােলায়মান বললেন : ‘আমি কি করে যাব?

শেখ মান্নান বলেন : আপনার জন্য তাে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে কোনাে বাধা নেই। গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন। খোঁজখবর না নিয়ে এখানে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করবেন না।’  শেখ মান্নানের মুখে বেগম সােলায়মানের বক্তব্য শােনার পর বিচারপতি চৌধুরী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদের সঙ্গে যােগাযােগের প্রস্তাব করেন। স্ট্রাটফোর্ড-আপনএ্যাভনে অবস্থিত কাশ্মীর রেস্তোরার মালিক আরব আলীর সঙ্গে রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর পরিচয় ছিল। রাশেদ তখন রয়াল সেক্সপিয়র থিয়েটার কোম্পানির সদস্য হিসেবে স্ট্রাটফোর্ডে থাকতেন। | অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আরব আলী নিজের গাড়িতে করে রাশেদ সােহরাওয়ার্দীকে স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে নিয়ে আসেন। বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শ অনুযায়ী রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বেগম সােলায়মানের বিবৃতির প্রতিবাদ জানাতে রাজি হন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের বক্তব্য যথাসময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ৭ অক্টোবর লিখিত পত্রে রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বলেন : ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের মুক্তি সংগ্রামের দৃঢ় সমর্থক। রাজনীতিতে জড়িত না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি দেয়ার প্রয়ােজন বােধ করি নি। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য (বেগম সােলায়মান) তার বিবৃতির মাধ্যমে আমার প্রিয় পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদরি ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন বলে বুঝতে পারার পর আমার বক্তব্য পেশ করা অবশ্যকর্তব্য বলে আমি মনে করি। ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বিজয় আমি কামনা করি। গত ২৪ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শােষণ করে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বাধীনে রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী গণহত্যা ও অন্যান্য জঘন্য অপরাধজনক কর্মকাণ্ড শুরু করার পর তারা (বাংলাদেশের জনগণ) অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে।  ‘মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা আক্রমণকারী সৈন্যদের উৎখাত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে, এ সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ। ‘আমি আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে গিয়ে দেখবাে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা শান্তি ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে জীবনযাপন করছে। ‘বাংলাদেশ সরকারকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সরকারের সদস্যবৃন্দের সবাই আমার পিতার সহকর্মী এবং স্নেহের পাত্র ছিলেন।

বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী প্রচারণা চালানাের জন্য পাকিস্তান সরকার যাঁদের বিদেশে পাঠায় তাদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার -এর (পরবর্তীকালে ‘বাংলাদেশ অবজারভার) মালিক হামিদুল হক চৌধুরী এবং তৎকালীন গণতন্ত্রী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মাহমুদ আলী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলফিকার আলী জুটো মাহমুদ আলীকে দালালির পুরস্কার হিসেবে মন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হামিদুল হক চৌধুরী ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পেীছান। ইতােমধ্যে মাহমুদ আলীও লন্ডনে পৌঁছান। তারা উভয়ে বেজওয়াটার এলাকার ব্যয়বহুল রয়াল ল্যাঙ্কাস্টার হােটেলে ওঠেন। পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করে। তাদের ভাতাদান সম্পর্কিত দলিলের ফ্যাক্সিমিলি’ লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার ৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মি, চৌধুরী ও মি, আলী লন্ডনে মাত্র কয়েক দিন অবস্থান করেন। কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরায় গিয়ে তারা ঘরােয়া আলাপ-আলােচনাকালে ভারতের তথাকথিত দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। তারা দাবি করেন, ১৯৪৭ সালে ভারত দেশ-বিভাগ মেনে নেয় নি। তাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। ব্যারিস্টার আব্বাস আলী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।  ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে মি, চৌধুরী এবং মি. আলীকে বলা হয়, জনসভায় বক্তৃতাদান করার চেষ্টা করা হলে তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। তার ফলে তারা জনসভায় বক্তৃতাদানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান। হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী পূর্ববঙ্গে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে ও সহায়তায় গঠিত শান্তি কমিটিতে সক্রিয় ছিলেন।১৭৯

লন্ডন, ৩০ মে, ২০০০

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য আবদুল মতিন