জুলাই, ১৯৭১
১ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পাকিস্তান সফরকারী তথাকথিত পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের নেত্রী হিসেবে মিসেস জিল্ নাইটের যােগ্যতা সম্পর্কে খ্যাতনামা সাংবাদিক বার্নার্ড লেভিন সন্দেহ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফর করে নিরপেক্ষ মতামত দেয়া মিসেস নাইটের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য আর্থার বটলির নেতৃত্বে প্রেরিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্য টোবি জ্যাসেল কলকাতায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব বঙ্গে হিন্দু-অধ্যুষিত বহু গ্রাম নির্বিচারে ধ্বংস করেছে। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ১ জুলাই প্রকাশিত এই রিপাের্টে বলা হয়, গত দশ দিন যাবৎ মি. জ্যাসেল ও তার সঙ্গীরা পূর্ব বঙ্গের বহু এলাকা এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছেন। উল্লিখিত তারিখে দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, ঢাকা জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় ৪০ মাইল দূরবর্তী সিন্দুরী নামের একটি গ্রামের বাড়িঘর লুটপাট করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। গত পাঁচ দিনে এই এলাকায় আরও ৭টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু বলেই গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সৈন্যবাহিনী সিন্দুরী গ্রামের স্বর্ণকার রাধাবিনােদ কর্মকার এবং সাতজন পুরুষ ও একজন বৃদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। চারজন মহিলাকেও তারা ধর্ষণ করে। . মি. বটমূলির নেতৃত্বে প্রেরিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্য রেজ প্রেন্টিস দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনাকালে বলেন, কেবল রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ২ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই রিপাের্টে আরও বলা হয়, পূর্ব বঙ্গ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
মি, বটমূলি ভারতীয় পার্লমেন্ট সদস্য ও সাংবাদিকদের এক সভায় বক্তৃতাদানকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, পূর্ব বঙ্গে ‘আরাে একটি ভিয়েতনাম’ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। পূর্ব বঙ্গ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উদ্যোগী না হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার ফলাফলের জন্য। দায়ী থাকবেন বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ৩ জুলাই লন্ডনের কনওয়ে হলে সমগ্র গ্রেট ব্রিটেনের শাখা কমিটিগুলাের (অ্যাকশন কমিটি) প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী প্রতিনিধিবৃন্দকে একতা বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান এবং কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখার যুক্তি বিশ্লেষণ করেন। প্রতিনিধিবৃন্দ তার যুক্তি মেনে নিয়ে নির্বাচন স্থগিত রাখার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। উল্লিখিত সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে মােহাম্মদ শাজাহান ও আবদুল মান্নান মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী বাঙালিদের দেশপ্রেম ও কর্মতৎপরতার জন্য ধন্যবাদ জানান। জেনারেল ফরমান আলী খান ব্রিটিশ সাংবাদিক মিস্ ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারকালে স্বীকার করেন, গত সপ্তাহে (জুন মাসের শেষ সপ্তাহে) পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী টাঙ্গাইল জেলার ছ’টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। ৩ জুলাই ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই গ্রামগুলাে ধ্বংস করা হয়েছে। ৩ জুলাই পাকিস্তান সরকার লন্ডনস্থ হাই কমিশনার সালমান আলীকে “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটি’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিচারপতি চৌধুরীকে বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করার জন্য সােসাইটির আমন্ত্রণ প্রত্যাহার না করার ফলে এই নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ব বাংলা ও ভারত সফরের পর লন্ডনে ফিরে এসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শিশুরাও তা থেকে রেহাই পায় নি। পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের বক্তব্য রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর মিসেস জিল নাইট ৫ জুলাই ইয়াহিয়া খানের কাছে লিখিত এক পত্রে তার উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি হত্যা ও নির্যাতনের অভিযােগ সম্পর্কে তদন্ত করে অপরাধী সৈন্যদের শাস্তিদানের পরামর্শ দেন। ৬ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।
স্কটল্যান্ডের এবারডিনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে ইউনিয়নের কার্যকর কমিটি পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই প্রস্তাবে রাজনৈতিক বন্দিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। প্রস্তাবটি সমর্থন করে ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি লরেন্স ড্যালি বলেন, পূর্ব বঙ্গের শতকরা ৯৯জনের সমর্থনপুষ্ট আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যই পাকিস্তান সরকার সামরিক অভিযান শুরু করে। ৫ জুলাই তারিখের অধিবেশনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে ৭ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে সামরিক অত্যাচার ও নির্যাতনের গ্রহণযােগ্য ভবিষ্যৎ নেই।… কেবল শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। এই কঠোর বাস্তবতাকে পাকিস্তান অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। তাকে মুক্তি দিয়ে পূর্ব বঙ্গের নেতৃত্বে পুনপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। এছাড়া অন্য কোনাে পথ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মােহর আলীর যুক্তভাবে স্বাক্ষরিত একটি দীর্ঘ চিঠি ৭ জুলাই ‘দি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনের রয়াল গার্ডেন হােটেল থেকে লিখিত এই চিঠির মাধ্যমে তারা উভয়েই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের সামরিক চক্রের সমর্থনের নির্জলা মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলীর ব্যয়বহুল সফরের ব্যবস্থা করে। উল্লিখিত চিঠিতে তারা বলেন, গ্রেট ব্রিটেনের বহু লােক মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বহুসংখ্যক বাঙালিকে মার্চ মাসের ২৫/২৬ তারিখে এবং পরবর্তকিালে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে একথা জানতে পেরে তারা (সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলী) বিস্মিত হয়েছেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের বেপরােয়াভাবে হত্যা করা হয় নি। ২৫ মার্চ। কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে অধ্যাপককে হত্যা করা হয় নি। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক। হল) ও জগন্নাথ হলের আশপাশে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে নয়জন অধ্যাপক মারা। গিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই ছাত্রাবাসগুলােকে ঘাটি। করে সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ না করলে এই প্রাণহানি এড়ানাে যেতাে। তাদের ব্যক্তিগত বন্ধু’ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা গুলির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে তিন দিন পর মারা যাওয়ার আগে তার বন্ধুদের কাছে নাকি।
বলেছেন, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁর বাড়িতে না ঢুকলে তিনি সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ এড়াতে পারতেন। তারা দাবি করেন, ২৫ মার্চ ঢাকা ও রাজশাহীর ছাত্রাবাসে খুব অল্পসংখ্যক ছাত্র ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী ৩ মার্চ থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার ফলে অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রাবাস ত্যাগ করে। এই সুযােগে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলকে অস্ত্রাগারে পরিণত করে। মার্চ মাসে সামরিক আক্রমণের আগে পূর্ণ অরাজকতা বিরাজ করছিল বলে তারা মনে করেন। তখন নাকি জনসাধারণের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাদের মতভেদ ছিল তাদের জীবনের কোনাে নিরাপত্তা ছিল না। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং ১৩ এপ্রিল সৈন্যবাহিনীর রাজশাহী দখল করার আগে, আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি আস্থাহীন অধ্যাপকদের হত্যা করার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয় বলে তারা দাবি করেন। অবাঙালি অধ্যাপকদের তখন ঘরবন্দি করে রাখা হয়। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী এই অরাকজতা দমন না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অবাঙালি অধ্যাপকের মৃত্যু অবধারিত ছিল বলে তারা বিশ্বাস করেন।২ | ১০ জুলাই বাঙালিদের উদ্যোগে বেডফোর্ড শহরের একটি পাবলিক হলে বিচারপতি চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। স্থানীয় পাকিস্তানিরা হলটি চারদিক থেকে ঘিরে রেখে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। প্রত্যেকটি গেটের সামনে তাদের লােক দাড়িয়ে ছিল। পাকিস্তানিদের প্রতি দ্রুক্ষেপ না করে বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় মনােভাব নিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যান। তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তানিদের হীন মনােভাবের নিন্দা করেন। পাকিস্তানিদের এই হঠকারিতায় বাংলাদেশ আন্দোলন লাভবান হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। অধ্যাপক কবীরউদ্দিন আহমদ ও শেখ আবদুল মান্নান এই সভায় বক্তৃতা করেন।
১১ জুলাই ‘দি সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি গােপন রিপাের্টের কথা উল্লেখ করা হয়। জুন মাসে পূর্ব বঙ্গ সফরের পর বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রেরিত একটি মিশনের নেতা পিটার কারগিল উল্লিখিত রিপাের্ট পেশ করেন। এই রিপাের্টে যশাের, খুলনা, মংলা, ফুলতলা ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি ধ্বংসলীলার চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানকারী দেশগুলাের এক ঘরােয়া বৈঠকে উল্লিখিত রিপাের্টের সারমর্ম পেশ করা হয়। এর ফলে ২১ জুন অনুষ্ঠিত এক সভায় পাকিস্তানকে সাহায্যদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাহায্যদানকারী দেশগুলাের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৬ জুলাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা রিপাের্টটি প্রত্যাহার করে ব্যাঙ্কের নথিপত্র থেকে বেমালুম গায়েব করার নির্দেশ দেন। রিপাের্টের নকল সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের হস্তগত হয়েছে বলে টের পাওয়ার পর ৯ জুলাই তিনি তার নির্দেশ প্রত্যাহার করেন। ১৩ জুলাই ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। ১৮ জুলাই (রােববার) স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসের সামনে একটি বিক্ষোভ এবং দূতাবাস থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত মিছিলের আয়ােজন করা হয়। বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগদান করার জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালি কোচযােগে লন্ডনে আসেন। জগলুল পাশার নেতৃত্বে বিরাট একটি দল বার্মিংহাম থেকে এসে বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগ দেয়। তােজাম্মেল (টনি) হকও কয়েকটি কোচ-ভর্তি বাঙালিদের নিয়ে এদের সঙ্গে যােগ দেন। বিক্ষোভ শেষে দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপিতে বলা হয়, চীনের মহান নেতা মাও জে-ডুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের প্রতি বাঙালিদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধাবােধ রয়েছে। পাকিস্তান তাদের বন্ধু-রাষ্ট্র-এই অজুহাতে তারা যদি পাকিস্তানকে সমর্থন করেন, তা হলে ইতিহাসের চোখে তারা দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন। | জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট লন্ডনে আসেন। তাদের সম্মানার্থে কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটিজ অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার হিউ প্রিঙ্গার একটি ভােজসভার আয়ােজন করেন। ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরও এই ভােজসভায় যােগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলােচনার সুযােগ দেয়ার উদ্দেশ্যে স্যার হিউ বিচারপতি চৌধুরীকে ভােজসভায় যােগদানের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানান। বলা বাহুল্য, বিচারপতি চৌধুরী এই। সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন।
১৯ জুলাই ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শিগগিরই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচার অনুষ্ঠিত হবে। ইসলামাবাদে ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারকালে ইয়াহিয়া খান এই তথ্য প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোেগ আনা হবে তার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অভিযােগ রয়েছে। তার পক্ষ সমর্থন করার জন্য পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়ােগ করা হবে। বিদেশী আইনজীবী নিয়ােগের অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। মি. ম্যাক্সওয়েল বলেন, ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতাদের মধ্যে কেউ কেউ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ড দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে তিনি বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছেন। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকান বার অ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যােগদানকারী প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন একটি *খােলা চিঠি’ ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এই খােলা চিঠি’-তে বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের লক্ষ্য করে বলা হয়, আইনজীবী হিসেবে আইন ভঙ্গ করা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আমেরিকান নাগরিক হিসেবে তারা বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতনের খবর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করে এই অমানিশার অবসান ঘটাতে পারেন।
পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বহির্বিশ্ব গণহত্যা শব্দটির কথা ভুলে গিয়েছে বলে মনে হয়। আইনজীবী হিসেবে বার এ্যাসােসিয়েশনের সদস্যরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, পাকিস্তান জাতিসংঘের ‘জেনােসাইড কনভেনশন’-এর দ্বিতীয় ধারার ক, খ এবং গ উপধারা ভঙ্গ করেছে। উপসংহারে বলা হয়, বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যরা নিম্নে বর্ণিত দাবিগুলাের প্রতি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে বাঙালি ছাত্রছাত্রী ও তাদের সমর্থকরা আশা করেন :১. পাকিস্তানকে আমেরিকার সামরিক সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; ২. বাংলাদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ রাখতে হবে; ৩. গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে; ৪. জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে; ৫. পাকিস্তান জেনােসাইড কনভেনশন ভঙ্গ করে বিশ্ব শান্তি বিপন্ন করার জন্য সমগ্র ব্যাপারটি সিকিউরিটি কাউন্সিলে আলােচনার জন্য উত্থাপন করতে হবে। বিজ্ঞাপনটির অর্ধেক জায়গা জুড়ে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপানাে হয়। ২৫ জুলাই ‘দি অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম বঙ্গের মাও-সমর্থক নক্সালপন্থীরা পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর বর্বর অত্যাচার সমর্থন করে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। কলকাতা থেকে পত্রিকাটির সংবাদদাতা সুনন্দ দত্ত রায় এই সংবাদ প্রেরণ করেন। ২৬ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী লন্ডনে এক সভায় মিলিত হয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করেন। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের স্বাধীনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমর্থক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থকদের কর্মপ্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন কমিটির প্রধান লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়। সদস্যদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন এয়ার কমােডর এম কে জানজুয়া কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ৮৫ ২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সের হারকোট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট সংবলিত একটি “সেট’ এবং ‘ফাস্ট ডে কভার’ প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং দেশ-বিদেশের প্রায় চল্লিশজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকেটগুলাে ও “ফাস্ট ডে কভার’ প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া) এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালি নেতৃবৃন্দও এই অনুষ্ঠানে যােগদান করেন।
ডাকটিকেটগুলােতে বাংলাদেশের মানচিত্র, পতাকা, শিকল ভাঙার ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাত ইত্যাদি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো সংবলিত পাঁচ টাকা মূল্যের টিকেটে সােনালি-সদৃশ, কমলা, গাঢ় বাদামি ও হাফ-টোন কালাে রঙ ব্যবহার করা হয়। প্রতি ‘সেট’ ডাকটিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২১ টাকা ৮০ পয়সা (তল্কালীন পাউন্ডের মূল্য ২০ টাকা হিসেবে ব্রিটিশ মুদ্রায় ডাকটিকেটগুলাের মূল্য ছিল ১ পাউন্ড ৯ পেনি)। মুজিবনগর সরকারের সম্মতিক্রমে শ্রমিকদলীয় প্রাক্তন ডাক ও টেলিযােগাযােগ মন্ত্রী জন স্টোনহাউসের উদ্যোগে ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার প্রকাশিত হয় । লন্ডন প্রবাসী বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকেটগুলাের নকশা তৈরি করেন। তিনি বলেন, ডাকটিকেটগুলােতে ব্যবহৃত প্রতিকৃতিগুলাের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ এবং প্রগতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাবার জন্য ভারত সরকার ডাকটিকেটগুলাে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে উদ্যোক্তারা প্রকাশ করেন। পরদিন (২৭ জুলাই) লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ডাকটিকেটগুলাের ‘ফ্যাক্সিমিলি’সহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৯ জুলাই (১৯৭১) বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার’ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, ভারত, যুক্তরাজ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইজরায়েল, ইউরােপ, অস্ট্রেলিয়া ও দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। মুজিবনগর সরকারও কলকাতায় ডাকটিকেট’ ও ‘ফার্স্ট ডে কভার’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ডাকটিকেট প্রদর্শন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, আগস্ট মাস শেষ হওয়ার আগেই ব্রিটেনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়াই বর্তমানে বাঙালিদের একমাত্র কর্তব্য।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক ঘােষণার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এই ঘােষণা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বাঙালি জাতি স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হবে। এই হীন উদ্যোগের বিরােধিতা করার জন্য তিনি বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ ও বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানান। পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগ করতে পারে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কমনওয়েলথের বাকি দেশগুলাে সানন্দে তা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে পারে। উল্লিখিত সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ ২৭ জুলাই ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আগস্ট মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের বার্নার্ড শেরিডান সলিসিটার্স-এর পক্ষ থেকে একজন অভিজ্ঞ সলিসিটারও তাঁর সঙ্গে যান।৭ ২৪ জুলাই (শনিবার) মি. ম্যাক্ৰাইড ইসলামাবাদে পৌঁছানাের পর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। ইয়াহিয়া খান নিজে দেখা করতে অস্বীকার করেন। কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি ইয়াহিয়ার আইন বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি (কর্নেলিয়াস) বলেন, কোনাে বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা তার পক্ষ সমর্থন করতে দেয়া হবে না। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং তার পক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়ােগ করা হবে। | ২৭ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবের সঙ্গে এই প্রথমবার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে দেখা করার চেষ্টা করা হয়। গ্রেফতারের পর থেকে তাঁকে নির্জন কারাকক্ষে বন্দি করে রাখা হয়।
কয়েক দিন পর লন্ডনে ফিরে এসে মি, ম্যাব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার সুযােগ না পাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। | ২৬ জুলাই পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার। আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করার জন্য এইড পাকিস্তান কনসরসিয়াম’কে রাজি করানাের ব্যাপারে ব্রিটেনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ২৭ জুলাই রাত্রিবেলা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে স্যার আলেকের সঙ্গে সালমান আলীর সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, আরও বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করার আগে পূর্ব বাংলায় একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৮ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, কূটনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে শরণার্থীদের পূর্ব বঙ্গে ফেরত পাঠানাে কিংবা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা পরিহার করা যাবে না। কিন্তু কয়েকটি নাটকীয় পদক্ষেপ সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে। প্রথমত, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সিকিউরিটি কাউন্সিলের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, পাঞ্জাবি সৈন্যদের পাঞ্জাবে ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত নৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে বিরক্তিজনক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে বলে পরিষ্কার ভাষায় সাবধান করে দিতে হবে। উল্লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে শরণার্থীদের তদারকের জন্য জাতিসংঘ নিয়ােজিত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খানকে গোঁড়া মুসলমান এবং ইয়াহিয়ার প্রতি তার মনােভাব দ্ব্যর্থব্যঞ্জক বলে উল্লেখ করা হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদল পূর্ব বঙ্গ সফরকালে অত্যাচার ও নির্যাতন সম্পর্কে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সে তুলনায়। তিনি বেশি কিছু দেখেছেন বলে মনে হয় না। শরণার্থীদের কাছে তিনি রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন বলে আশা করা বৃথা। আগামী ১ আগস্ট (রােববার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে যে গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় ২৯ জুলাই অগ্রিম সংবাদ প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত সংবাদে বলা হয়, ‘বিটস্ গ্রুপের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে বাংলাদেশ’ নামের যে নতুন রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে তা বেলা দুইটার সময় ট্রাফালগার স্কোয়ারের গণসমাবেশে বাজিয়ে শােনানাে হবে। ঠিক তখন নিউইয়র্কের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে রেকর্ডটির উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে। রেকর্ড বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ শরণার্থী সাহায্য তহবিলে দান করা হবে। এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী রােববার (১ আগস্ট) ব্রিটেনের সর্বত্র বাঙালি রেস্তোরাগুলাে বন্ধ রেখে মালিক ও কর্মচারীরা দলে দলে ট্রেন ও কোচযােগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে এসে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাবেন। গণসমাবেশের আয়ােজনকারী অ্যাকশন বাংলাদেশের জনৈক মুখপাত্র ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকার প্রতিনিধিকে বলেন, বার্মিংহাম থেকে ৭০টি কোচভর্তি বাঙালি গণসমাবেশে যােগ দেয়ার জন্য লন্ডনে আসবেন। পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন ৩০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় পরিত্যক্ত তিনজন তরুণের মৃতদেহের একটি ছবির নিচে লেখা রয়েছে : “এই ছবিটি আপনার ছেলে-মেয়েদের দেখান এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে জনসমাবেশে যােগ দিন। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ আগস্ট (রােববার) ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যাকশান বাংলাদেশ আহূত এক সমাবেশে যােগদানের জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানানাে হয়। পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে এই গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়।
অ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে বিচারপতি চৌধুরীসহ বিভিন্ন বক্তার নাম এবং বার্মিংহাম, ব্র্যাডফোর্ড, কেমব্রিজ, কার্ডিফ, কভেন্ট্রি, গ্লাসগাে, লিড়স, লিভারপুল, লুটন, ম্যাঞ্চেস্টার, পাের্টস্মাথ ও শেফিল্ড থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য বিভিন্ন টেলিফোন নাম্বার উল্লেখ করা হয়। যারা গণসমাবেশে যােগ দিতে অক্ষম, তাদের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়। ৩০ জুলাই ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সিনেটর ইউজিন ম্যাকার্থি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে সমর্থন করেন। ৩০ জুলাই অ্যাকশান বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনাকালে তিনি উল্লিখিত মন্তব্য করেন। ৩১ জুলাই অ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে লন্ডনের ডরচেস্টার হােটেলে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি. ম্যাককার্থি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বায়ার দাবি সমর্থন করেন। ভৌগােলিক কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি। অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে তিনি মনে করেন। জুলাই মাসের শেষদিকে ব্রিটেন পূর্ব বঙ্গে ব্যবহারের জন্য কয়েকটি মােটরবােট সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। মি. সাদারল্যান্ড সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মােটরববাটগুলাে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার না করার শর্ত আরােপ করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মােটরববাটগুলাে পাওয়ার পর পাকিস্তান। সৈন্যবাহিনী পূর্ব বাংলার নদীপথ দিয়ে অভ্যন্তরের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠনের জন্য নিশ্চয় ব্যবহার করবে। এই আশঙ্কার প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার। জন্য তিনি স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানান।
ইতােমধ্যে জন স্টোনহাউস, পিটার শাের ও আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য ব্রিটিশ সরকারের উপরােক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গেও এ ব্যাপারে তারা আলােচনা করেন। স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাকালে বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন, পূর্ব বঙ্গের পক্ষে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কোনাে মােটরবােট পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হবে না। জুলাই মাসের শেষদিকের আরও একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানের সামরিক সরকার কিছুসংখ্যক পাকিস্তান-ভক্ত বাঙালিকে সরকারি খরচে বিদেশে পাঠায়। নেজামে ইসলামের নেতা মৌলবী ফরিদ আহমেদ এদের অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফরকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে তিনি ইসলামি জেহাদ’ বলে দাবি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নাকি ভারতের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামি জেহাদকে সমর্থন করা মুসলিম দেশগুলাের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, ফরিদ আহমদের এই প্রচার অভিযান ফলপ্রসূ হয় নি। তাই তিনি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। করাচি ফিরে গিয়ে তিনি এক গাঁজাখুরি কাহিনী সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন রিডার রেহমান সােবহান এবং লন্ডন প্রবাসী কমিউনিস্টপন্থী’ পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী ভারত সরকারের উদ্যোগে গঠিত এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বৈরুতে পৌঁছান। বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ােজিত এক সভায় তাঁরা বক্তৃতাদানের চেষ্টা করেন। কর্তৃপক্ষ এই সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। ভারতীয় দূতাবাসগুলাের উদ্যোগে তাঁদের জন্য অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা আরব দেশগুলাের অনুমতির অভাবে পরিহার করা হয়। এই প্রতিনিধিদলের সব খরচ ভারত সরকার বহন করে এবং ভারতীয় অফিসারগণ সর্বদা তাদের সঙ্গে ছিলেন। পাকিস্তানি সংবাদপত্রে উপরােক্ত মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক কাহিনী ফলাও করে প্রকাশ করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন