You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.16 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | পাঁচটি আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার আহ্বান | আর বাড়াবাড়ি নয়— | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৬ই মার্চ, শনিবার, ১৯৭৪, ২রা চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পাঁচটি আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার আহ্বান

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি এখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের এগারোটি তেল উৎপাদক দেশের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তেলের দাম বাড়ানোর জন্য নতুন সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। একদিকে তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা স্বীকৃত হয়েছে, অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে রোধ করার জন্য বিশ্বের পাঁচটি প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা অবিলম্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্যদানের আহ্বান জানিয়েছে। তেল রপ্তানীকারক দেশগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার এই আহ্বান যথাসময়ই জানানো হয়েছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধির যখন অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং সবাই একমত হয়েছেন, তখন কেবল মাত্র সৌদী আরবের বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত ধোপে না টেকাটাই স্বাভাবিক। ওপেক তেলমন্ত্রী সম্মেলনের ফলাফল কি হবে আর কি হবে না তা জানি না। তবে তেলের মূল্য, আর্থিক পরিবর্তন, বিকল্প জ্বালানী শক্তির ব্যয়, শিল্পায়িত দেশগুলো থেকে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য, মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ও সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত তথ্যাবলীর উপরও নাকি সমীক্ষা চালানো হবে। এই সমীক্ষার মাধ্যমে তেলের দীর্ঘমেয়াদী মূল্য ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে প্রধানতম উদ্দেশ্য। কোনো কোনো দেশ অবশ্য আশংকা করছেন, বর্তমান মূল্যের ক্ষেত্রে নাকি কোনো রকম বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে না। সৌদী আরব তো সাফ জানিয়েই দিয়েছে যে, তারা তেলের মূল্য বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তবুও যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে বোঝা যায়, তেলের মূল্য বাড়বে। তাই তেল রপ্তানীকারক দেশগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অবিলম্বে সাহায্য দানের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানী পরিস্থিতি বর্তমানে এক মহাসমস্যার আকার নিয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আন্তঃ মার্কিন উন্নয়ন ব্যাংক এবং আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তারা বৈঠকে মিলিত হয়ে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে মনোযোগী হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার কর্মকর্তারা আশংকা করছেন, তেলের মূল্য বাড়ানো হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি স্বল্পমেয়াদী কিংবা দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক সাহায্য পায়, তাহলে অর্থনৈতিক চাপ সামলাবার একটা পথ অন্ততঃ থাকবে। কারণ তেলের মূল্য বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে অতিরিক্ত ছয় থেকে সাত কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ফলে ‍উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির উপরই চাপ পড়বে তা নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমুদয় উন্নয়ন কর্মসূচীর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হবে, এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনাও হবে বিপদাপন্ন। কাজেই উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন তেলের বাড়তি মূল্যের জন্যে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভঙ্গ হয়ে অথর্ব না হয় সেদিকে তেল রপ্তানীকারক দেশগুলোর দৃষ্টি দেয়া দরকার। সম্ভবতঃ এজন্যেই পাঁচটি প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সুবিধাজনক শর্তে অতিরিক্ত বৈদেশিক সাহায্য যোগানোর আহ্বান জানিয়েছে। তেল রপ্তানীকারক দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি সদয় হয়ে অতিরিক্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রদানের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তেল রপ্তানীকারক দেশগুলো সাহায্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করে, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। পাঁচটি প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার এ আহ্বান তাই খুবই সময়োপযোগী। এ আহ্বানের প্রতি তেল রপ্তানীকারক দেশগুলো পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে বরং পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসবে বলেই আমরা মনে করি। নইলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সত্যি সত্যিই চরম অগ্নিপরীক্ষা ও মোকাবেলা করতে হবে।

আর বাড়াবাড়ি নয়—

কয়েকদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক তরুণ কবির একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে দেশের কোথাও কোথাও কিছু কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে—হচ্ছে। কবিতাটিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিকে পীড়িত করতে পারে এমন কয়েকটা শব্দ রয়েছে। কবিতাটি ছাপা হবার পর সঙ্গত কারণেই ঐ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সরকার কবিকে গ্রেফতার করেছেন এবং সর্বোপরি কবি নিজেই এর জন্যে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে অনুতপ্ত হয়েছেন-ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এবং বিষয়টির সেখানেই সুরাহা হবার কথা—নিষ্পত্তি হবার কথা। কিন্তু যা স্বাভাবিক তা আর হোল না, তা হতে দেয়া হলো না। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের দুঃখ প্রকাশ, সরকারের ত্বড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অনুতপ্ত কবির ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও একদল লোক বিষয়টাকে নিয়ে অতি সুচতুরভাবে বাড়াবাড়ি করা শুরু করেছে—অব্যাহত রেখেছে। আসলে ওরা সুপরিকল্পিতভাবে এ কবিতাটিকে একটি অজুহাত হিসেবে খাড়া করে অস্বাভাবিক দ্রব্য মূল্য আর দৈনন্দিন জীবন-যাত্রা পরিচালনায় পর্যুদস্ত দেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিলের জন্যে এটাকে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে তৎপর হয়েছে। ওদের এই তৎপরতা নিন্দনীয়।
গত বৃহস্পতিবার ওদের এই নিন্দনীয় তৎপরতাকে তীব্রভাবে নিন্দা করে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদ একটি প্রস্তাব পাশ করেছেন এবং দেশের ১২৫ জন লেখক-শিল্পী তথা বুদ্ধিজীবী সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়েছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐ প্রস্তাবে এবং বুদ্ধিজীবীদের ঐ বিবৃতিতে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের প্রতি এ ব্যাপারটি কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রশ্রয় না দেবার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকরা তথা বুদ্ধিজীবীরা সমাজেরই অংশ এবং তাঁরা সব সময়ই দেশের বৃহত্তর জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আসছেন। এমতাবস্থায় একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে ধর্মান্ধ স্বার্থবাদী মহল জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় মত্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে ঐ তরুণ কবির অসম্মানজনক শব্দ চয়ন এবং স্বার্থবাদী চক্রের জনগণকে বিভ্রান্ত করার হীন প্রয়াস দু’টোই নিন্দনীয়। তাঁরা আশা করেন, এরপর দেশের মানুষ এ ব্যাপারে আর কোনো বাড়াবাড়িতে প্রশ্রয় দেবেন না—দেওয়াটা কোনো মতেই সঙ্গতও নয়।
এক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা দরকার ধর্ম, ধর্মই। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বে ধর্মের স্থান। কিন্তু তবুও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা এ ঘটনাকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার বা কোনো কোনো সংবাদপত্র এটাকে নিছক নিজের কাটতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেখে আমরা দুঃখ বোধ না করে পারি না। আমরা আশা করবো, দেশের জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নৈতিক দৃঢ়তার সামনে তাদেরও জ্ঞানচক্ষু উম্মিলিত হবে। নিজেদের হীন স্বার্থের কথা ভুলে সকলেই আমরা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ ও ঐক্যের পথে এগিয়ে যাবো।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন