মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশন উপলক্ষে জেনেভায় ছিলেন।১৭ সেদিন সকালবেলা বি বি সি’র খবর শুনে তিনি অনুমান করলেন, বাংলাদেশে গুরুতর একটা কিছু ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা তার মনে পড়লাে। তিনি অত্যন্ত অস্বস্তি বােধ করলেন। সেদিনের অধিবেশনে গিয়ে তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান মি. এগুইলার অনুমতি নিয়ে বি বি সি’র খবরের কথা উল্লেখ করে সেদিনই লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। লন্ডন বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীর বড় ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী । (কায়সার) ও হাবিবুর রহমান তাকে অভ্যর্থনা জানান। হাবিবুর রহমান তখন পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করার তিন সপ্তাহ পরে তিনি চাকরিচ্যুত হন। দক্ষিণ লন্ডনের বাসায় পৌঁছাবার কিছুক্ষণ পর সুলতান মাহমুদ শরীফ কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীসহ বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা সবাই ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ করতে না পেরে বিচারপতি চৌধুরীর মতাে শঙ্কিত বােধ করেন। তিনি তখনই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ-এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। সন্ধ্যার পর তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব হয়। পরদিন (শনিবার) ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি সকাল ১১টার সময় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হন। তার (বিচারপতি। চৌধুরী) অনুরােধক্রমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মি. ব্যারিংটনও পরদিন পররাষ্ট্র দপ্তরে আসতে রাজি হন। ২৬ মার্চ সকালবেলা থেকে বাঙালি ছাত্র শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও । আফরােজ আফগান ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিকটবতী হােয়াইটহলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারকালে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ‘মর্মান্তিক কিছু একটা হতে যাচ্ছে আশঙ্কা করে ২৫ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অনশন পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে অনশনকারীদের আশপাশে ‘হ্যাঙ্গ ইয়াহিয়া’, ‘রেকগনাইজ বাংলাদেশ’, ‘স্টপ। জেনােসাইড’ ইত্যাদি শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ও পােস্টার রাখা হয়।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাতের বেলাও ৫০ থেকে ১০০ জন বাঙালি পর্যায়ক্রমে অনশনকারীদের সঙ্গে ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের সঙ্গে সহযােগিতা করে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে অনশনকারীদের রক্ষা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলে অনুমান করা হয়। পুলিশের ডাক্তার প্রতিদিন অনশনকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তৃতীয় দিন তারা বলেন, অনশনকারীদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। অবিলম্বে অনশন ত্যাগ না করা হলে তাদের জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা অনশন অব্যাহত রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইতােমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিতর্ক শুরু হয়েছিল এবং প্রতিদিনই এম পি-দের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অবশেষে শ্রমিকদলীয় এম পি পিটার শােরের অনুরােধক্রমে ২৮ মার্চ। বিকেল ৩/৪ টার দিকে তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ব্রিটিশ টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় অনশনকারীদের ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা গাউস খানের উদ্যোগে লন্ডনের বেরিক স্ট্রিটে অবস্থিত তার এলাহাবাদ’ রেস্তোরার উপরের তলার অফিসে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার পর পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে অবিলম্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।১৯ সেদিন সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে প্রায় ৩০০ বাঙালি ছাত্র ও জনসাধারণ তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা হাই কমিশন দখলের চেষ্টা করেন। রাত প্রায় নয়টার দিকে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবক এবং পুলিশের মধ্যে এক সংঘর্ষের ফলে মােহাম্মদ ইসহাক, শফিকুল হকসহ মােট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। মােহাম্মদ ইসহাক তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উৎসাহী সদস্য ছিলেন। পরদিন তিনজনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। ১ জুন মাল্বারা স্ট্রিট কোর্টে উত্থাপিত মামলায় মােহাম্মদ ইসহাককে দু’সপ্তাহের কারাদণ্ড দেয়া। হয়। গাউস খান এই মামলার ব্যয়ভার বহন করেন। লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজউদ্দিনও উল্লিখিত বিক্ষোভে যােগ দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান হাই কমিশনার বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
মেনে না নেয়া পর্যন্ত তিনি হাই কমিশনের বাইরে অবস্থান করবেন। ২৭ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের পার্টি আওয়ামী লীগ এই বিক্ষোভের আয়ােজন করে। প্রায় একশ’জন ছাত্র ও জনসাধারণ সারা রাত হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা শেখ আবদুল মান্নান এবং ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। পুলিশ কর্তৃপক্ষ হাই কমিশনকে পাহারা দেয়ার জন্য প্রায় ৫০ জন পুলিশ অফিসার নিয়ােগ করেন। পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের খবর পাওয়ার পর আহমদ হােসেন জোয়ারদার তার সহকর্মীদের সহায়তায় ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হস্টেলে এক জরুরি সভার আয়ােজন করেন। এই সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছাত্র ও যুবকরা যােগদান করেন। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, আজ বাংলাদেশের জন্মদিন এবং এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান বলে কিছু নেই। তকালীন পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশনের বাঙালি সভাপতি ইকরামুল হক এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপত্তি জানান। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস হাউসের প্রেসিডেন্ট আনিস রহমান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি ছাত্র পাকিস্তান স্টুডেন্টস হস্টেলের সভায় যোেগ দেন। শামসুল আবেদীন, আনিস রহমান, মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু এবং আরাে কয়েকজন সভায়। বক্তৃতা করেন। শামসুল আবেদিন পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি এক সঙ্গে থাকার জন্য, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার-অবিচারের ফলে আর এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আনিস রহমান বলেন : ‘পাকিস্তান ইজ ডেড। কাজেই এখন। আমাদের সেইভাবে তৈরি হতে হবে।
লন্ডনে বিভিন্ন এলাকায় অ্যাকশন কমিটি গঠনের একটি প্রস্তাবও উল্লিখিত সভায় গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব অনুযায়ী মি. জোয়ারদার ও তাঁর ১৫/২০ জন সহকর্মী সেই রাতেই দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের স্ট্রেথাম এলাকায় কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরার উপরতলায় সমবেত হয়ে একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন বি এইচ তালুকদার (সভাপতি), আহমদ। হােসেন জোয়ারদার (সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট) এবং সােহেল ইবনে আজিজ (জেনারেল সেক্রেটারি)। মি. জোয়ারদার সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে এই কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ( ২৭ মার্চ ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তিন-কলাম শিরােনাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘােষণার সংবাদ এবং এ সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ‘দি টাইমস’-এর সংবাদে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র গঠন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণার পর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে বেআইনি প্রতিষ্ঠান এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে ঘােষণা করে শাস্তিদানের সঞ্চয় প্রকাশ করেন। ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী এবং শেখ মুজিবের সমর্থক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ঘােরতর সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। ‘পাকিস্তানের আকাশে যুদ্ধের মেঘ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় মন্তব্য উপলক্ষে ‘দি টাইমস্-এ বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধের ডাক দিয়ে এবং স্বাধীনতা ঘােষণা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বজনস্বীকৃত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালি রেজিমেন্টের সৈন্যরা শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে নেবে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে।২২. ট্র্যাজেডি ইন পাকিস্তান’ শিরােনাম দিয়ে ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, যে-কোনাে মূল্যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের একগুয়ে মনােভাব শেখ মুজিবকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাধ্য করে।… বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অখণ্ড পাকিস্তানের চিন্তাধারা অযৌক্তিক বলে আবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানিয়ে বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাকশন। কমিটি ২৭ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ একটি বিজ্ঞাপন দেয়। বাংলাদেশ আক্রমণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের অপসারণের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে আবেদন জানানাে হয়। | ২৭ মার্চ হাবিবুর রহমান বিচারপতি চৌধুরীকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যান। তিনি মি, সাদারল্যান্ডের রুমে পৌছানাের পর মি. ব্যারিংটন এসে তাদের সঙ্গে যােগ দেন। কিছুক্ষণ পর মি. সাদারল্যান্ডের সেক্রেটারি ঢাকা থেকে টেলেক্সযােগে সংবাদ আসছে বলে খবর দিলেন।
টেলেক্সের লম্বা সংবাদ পড়ার মাঝখানেই বেদনা ও সহানুভূতিভরা মুখ তুলে মি, সাদারল্যান্ড বিচারপতি চৌধুরীর দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে তিনি বললেন : ‘খবর খুব খারাপ। বহু লােক প্রাণ হারিয়েছে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী হতাহত হয়েছে।’ এই কথা বলে তিনি আবার পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ হলে তিনি বললেন : ‘পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রে ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার একটি ভয়াবহ রাত যাপন করেন। পরের দিনই তিনি গুলশান থেকে শহরের দিকে আসার চেষ্টা করে রাস্তায় অনেক মৃতদেহ দেখে ফিরে যান। সান্ধ্য-আইন শিথিল করার পর জনৈক ফার্স্ট সেক্রেটারি অল্পক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেন, | ইকবাল হল-এর (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সিড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তিনি জানতে পারেন, জগন্নাথ হলের সামনে গণকবর খুঁড়ে সেখানে নিহত ছাত্র ও শিক্ষকদের মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলা হয়। আর যেসব ছাত্রকে গুলির ভয় দেখিয়ে মৃতদেহগুলাে গণকবরের সামনে আনতে বাধ্য করা হয়, তাদেরও পরে গুলি করে সেই কবরেই ফেলা হয়। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার ফ্রাঙ্ক সার্জেন্ট আরাে লিখেছেন, পাকিস্তান রেডিও শেখ মুজিবকে বন্দি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে। এ দাবির সত্যতা সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। মি. সাদারল্যান্ড আরও বলেন, পাকিস্তান সরকার বিদেশি দূতাবাসের টেলেক্স ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে। এর ফলে ঢাকা থেকে আরও সংবাদ পাঠানাে যাবে না বলে তাকে জানানাে হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী মি. সাদারল্যান্ডকে বলেন : “এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোনাে সম্পর্ক রইলাে না। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাবাে, আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা কথা বিশ্ববাসীকে জানাবাে। তারা আমার ছেলে-মেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই।” বিদায় নেয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাসহিউমের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য মি. সাদারল্যান্ডকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক (পরবর্তীকালে লর্ড হিউম) তখন স্কটল্যান্ডে ছিলেন। লন্ডনে ফিরে আসার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে তিনি কথা দেন। তা ছাড়া বৈদেশিক সাহায্য দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উডের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা। করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগে সংবাদপত্রে কোনাে বিবৃতি না দেয়ার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ করেন। কারণ, সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়ার পর তাঁকে বিদ্রোহী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে। এর ফলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে প্রটোকল’ ভঙ্গের অভিযােগ উঠতে পারে।
বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলনের কয়েকজন উৎসাহী সমর্থক নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলােচনার পর ২৭ মার্চ (শনিবার) একটি ইংরেজি ‘নিউজলেটার প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ মার্চ (মঙ্গলবার) নিউজলেটার’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যায় ব্রিটিশ সােশ্যালিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে একটি। ‘খােলা চিঠি’ এবং মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত। অ্যাকশন কমিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। ‘খােলা চিঠি’-তে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আসল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে অবিলম্বে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তিদান, আওয়ামী লীগের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবি এবং হত্যা ও অমানুষিক নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের দাবি সমর্থন করার জন্য আকুল আবেদন জানানাে হয়। ২৭ মার্চ বিকেলবেলা শিল্পী আবদুর রউফ ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুসহ। কয়েকজন ছাত্র ও যুবনেতা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাছাড়া। ব্রিটেনস্থ বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, ড, মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার এবং আবদুল হাকিমও তার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের সবাইকে তিনি সংঘবদ্ধ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় । কমিটি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের। পক্ষে কাজ করে যাবেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্যের সঙ্গে দেখা করে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করবেন উত্তর লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তান ভবনে সেদিন (২৭ মার্চ) বিকেলবেলা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে ২৯ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, প্রায় আটশ’ লােক এই সভায় যােগদান করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, লন্ডন আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মস্কো ও চীনপন্থী গ্রুপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা সভায় হাজির ছিলেন। ছাত্রদের প্রস্তাবিত কর্মপন্থার প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা তাদের সঙ্গে একযােগে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকেন। পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য পৃথক সভার আয়ােজন করেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান ভবনের বক্তব্য পেশ করার জন্য পাঁচ-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাে হয়। শেখ আবদুল মান্নান এই প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত সভার শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পূর্ব লন্ডনের সভায় যােগদানের জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। পূর্ব পাকিস্তান ভবন থেকে সরাসরি পূর্ব লন্ডনে গিয়ে শেখ আবদুল মান্নান, আমীর আলী, মােহাম্মদ আইয়ুব, সাখাওয়াত হােসেন এবং আরাে কয়েকজন এই সভায় যােগদান করেন। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কাউন্সিল। ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনার পর এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরবর্তী সভায় গ্রহণের প্রস্তাব। অনুযায়ী ২৯ মার্চ (সসামবার) পর্যন্ত সভার কাজ স্থগিত রাখা হয়। শনিবার (২৭ মার্চ) বিকেলবেলা পূর্ব লন্ডনের ফুরনিয়ার স্ট্রিটে অবস্থিত পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশনের অফিসে অনুষ্ঠিত অপর এক সভায় কয়েকশ’ বাঙালি যােগদান করেন। এদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের উদ্দেশ্যে নিজেদের নাম-ঠিকানা তালিকাভুক্ত করান। পরবর্তীকালে মিনহাজউদ্দিন এক সাক্ষাঙ্কার উপলক্ষে মজনু-নুল হককে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যুবকদের ৩/৪ শ পাসপাের্ট তার। কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। ২৯ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৮ মার্চ (রােববার) প্রায় সাত হাজার পতাকা ও প্ল্যাকার্ডধারী বাঙালি বার্মিংহামের স্মল হিথ পার্কে সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের ব্যানারে ‘পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলাে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল। ২৮ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারেও একটি বিশাল প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকরাও এই সভায় যােগদান করেন। বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার, কভেন্ট্রি, লুটন ও অন্যান্য শহর থেকে কোম্ ও ট্রেনযােগে কয়েক হাজার বাঙালি এই সভায় যােগদানের জন্য আসেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলাের প্রতি আহ্বান জানান। গাউস খান ট্রাফালগার স্কোয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় না থাকলে এশিয়ার এই অশান্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে। কিন্তু সামরিক-বল প্রয়ােগ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা । রক্ষা করা যাবে না। এই পন্থা অবলম্বন করলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘােষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া তার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন।
২৮ মার্চ কার্ডিফ থেকে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি ফর ওয়েলস্-এর। নেতৃস্থানীয় সদস্যরা লন্ডনে এসে বেঙ্গল স্টুডেন্টস্ অ্যাকশান কমিটির সদস্যদের। সঙ্গে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা ও সােভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানান। ২৭ মার্চ তারিখে গঠিত ওয়েলস্ কমিটির সদস্যরা। কার্ডিফের এ্যাঞ্জেল হােটেলের সামনে জমায়েত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচারপত্র বিলি করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথ তখন এ্যাঞ্জেল হােটেলে অবস্থান করছিলেন। ( ২৯ মার্চ প্রকাশিত এক সংবাদে ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সংবাদদাতা সাইমন। ড্রিংগ বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুক্রবার) পাকিস্তান সেন্যবাহিনী বিনা প্ররােচনায় ঢাকায় তিন ঘণ্টা যাবৎ অবিরাম গােলাগুলি চালায়। ২৮ মার্চ (রােববার) তাকে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কলকাতা থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে বল প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য সামরিক বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন : ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। ২৫ /২৯ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা চলে না। ২৯ মার্চ (সােমবার) লন্ডনের পােল্যান্ড স্ট্রিটে অবস্থিত ‘মহাঋষি’ রেস্তোরায় গাউস খানের সভাপতিত্বে পূর্ব লন্ডনের অসমাপ্ত কাজ শুরু হয়। সভায় বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার পর কাউন্সিল ফর দি পিপল্স্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’ নামের প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটিগুলােকে অনুমােদন-দানের দায়িত্ব কাউন্সিলকে দেয়া হয়। কার্যনির্বাহি পরিষদ হিসেবে ১১জন নির্বাচিত সদস্য এবং ব্রাডফোর্ড, শেফিল্ড, গ্লাসগাে, বার্মিংহাম প্রভৃতি শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটির ১০ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। গাউস খান, শেখ আবদুল মান্নান, আতাউর রহমান ও কোহিনুর রেস্তোরার মালিক আবদুল হামিদ যথাক্রমে কমিটির প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি, সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে গাউস খান বলেন, নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তার নেতৃত্বে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে চার-দফা পরিকল্পনা পেশ করে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতিদান, অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘকে ব্রিটেনের অনুরােধ জ্ঞাপন, ব্রিটেনে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানে চালান নিষিদ্ধকরণ এবং অসহায় ও নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার নীতি পরিহার করার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের পরিকল্পনা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেয় বলে মি. খান প্রকাশ করেন। মি. খান আরও বলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অর্থ, খাদ্য-সামগ্রী এবং প্রয়ােজনমতাে অস্ত্র সরবরাহের পন্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতােমধ্যে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী-বাঙালি দেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করার ব্যাপারে সাহায্যের অনুরােধ জানিয়ে তাকে টেলিফোন করেছে। ৩০ মার্চ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ৩০ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৯ মার্চ ভারতের। প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে ভারতীয় পার্লামেন্টের সংহতি ঘােষণার জন্য বিরােধী দলগুলাের দাবি মেনে নেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও বাংলাদেশের কথা উত্থাপন করা হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য পিটার শাের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বর্বরােচিত অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনসাধারণের তীব্র ঘৃণার কথা পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্-হিউমকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক পূর্ব পাকিস্তানে প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে মন্তব্য করা তাঁর পক্ষে উচিত হবে না। ৩০ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর ‘লিড স্টোরি’তে ঢাকায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রথম বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা সাইমন ড্রিংগ প্রেরিত সংবাদে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাত্রে তিনি অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীকালে শেরাটন হােটেল) ছিলেন। বিদেশী সাংবাদিকদের যখন বহিষ্কার করা হয় তখন তিনি হােটেলের ছাদে লুকিয়ে। ছিলেন। পরে সুযােগমতাে হােটেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা শহর ঘুরে তিনি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। ২৭ মার্চ তাকে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সেখান থেকে ২৯ মার্চ ব্যাঙ্কক পৌছেই তিনি উক্ত তারবার্তা পাঠান। দু’বার মালপত্র ও দেহ তল্লাশি সত্ত্বেও তিনি তাঁর নােটগুলাে বাঁচাতে সক্ষম হন। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর তিন কলামব্যাপী সংবাদে বলা হয়, আল্লাহ ও অখণ্ড পাকিস্তানের নামে ঢাকাকে একটি বিধ্বস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত নগরীতে পরিণত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর চব্বিশ-ঘণ্টাব্যাপী নিষ্ঠুর ও নির্মম গােলাগুলি বর্ষণের ফলে অন্তত সাত হাজার লােক নিহত এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ধূলিসাৎ হয়েছে। ‘দেশের অবস্থা শান্ত’ বলে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের দাবি সত্ত্বেও হাজার হাজার লােক শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ রিপাের্টে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, পুরনাে শহরের বিভিন্ন এলাকা এবং নারায়ণগঞ্জে গণহত্যার বিস্তারিত ও হৃদয়বিদারক বিবরণ দেয়া হয়। সাইমন ড্রিংগ আরও বলেন, শেখ মুজিবকে টেলিফোনে সতর্ক করে আসন্ন। বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। জনৈক আস্থাভাজন ব্যক্তিকে তিনি বলেন : ‘আমি যদি পালিয়ে থাকি, তা হলে তারা (পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী) আমাকে খুঁজে বের করার জন্য সমগ্র ঢাকা শহরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। জনৈক পাঞ্জাবি অফিসার সাইমন ড্রিংগকে বলেন : ‘আমরা আল্লাহ ও অখণ্ড । পাকিস্তানের নামে যুদ্ধ করছি।’ সাইমন ড্রিংগ-এর এই রিপাের্ট প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা এই রিপাের্টটি অমূল্য দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন। বিচারপতি চৌধুরী এই রিপাের্টের ‘ক্লিপিং’ তাঁর ব্রিফকেসে রাখেন এবং যখনই কোনাে বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। তাকে একটি ফটোকপি দিয়ে এসেছেন। “ইনার টেম্পল’-এ অধ্যয়নরত আইনের ছাত্র শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ৩০ মার্চ লন্ডনে পৌছান। তিনি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে তার এক বন্ধুর বাড়িতে তিনি। লুকিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারের বিবরণ ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড ও ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৩০ মার্চ বিচারপতি চৌধুরী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর এবং সেন্ট ক্যাথরিন কলেজের অধ্যক্ষ লর্ড এ্যালেন বুলকের সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাহত শিক্ষক ও ছাত্রদের কথা জানান। তার পরামর্শ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটিজ অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারিজেনারেল স্যার হিউ প্রিন্সারের সঙ্গে দেখা করেন। স্যার হিউ ইতােমধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরােধ অনুযায়ী তিনি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এক তারবার্তা পাঠান। অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে শান্তি স্থাপন করার জন্য তিনি ইয়াহিয়া খানকে অনুরােধ জানান। ৩১ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক পত্রে তারিক আলী, হামজা আলাভী, মােহাম্মদ আখতার ও নাসিম বাজওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সােশ্যালিস্টদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অভিনন্দন জানান। সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের শতকরা ৯৮ ভাগ ভােটপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করে পূর্ব বাংলার ৭ কোটি অধিবাসীকে দেশদ্রোহিতার অপবাদ দেয়ার জন্য তারা ইয়াহিয়া খানকে নিন্দা করেন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুরু করা ছাড়া বাঙালি জনসাধারণের আর কোন উপায় ছিল না বলে পত্ৰলেখকরা মনে করেন। তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য মি. ভুট্টোকে দায়ী করেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত আরও একটি পত্রে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমােডর মােহাম্মদ খান জানজুয়া (এম কে জানজুয়া), কর্নেল ইনায়েত হােসেন ও ফরিদ এস্ জাফরী পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী। নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার মেনে নেয়ার দাবি জানান। শতকরা ৯৮ ভাগ ভােটপ্রাপ্ত পার্টি ও তার নেতার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোেগ চূড়ান্ত । অবমাননাকর বলে তারা মনে করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন