১৯৭১ সালে লন্ডন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিরা ‘মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত সংগ্রামকে নিঃসঙ্কোচে পূর্ণ সমর্থন জানায়। এই সংগ্রামের কাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবজনক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা অনুধাবন করতে হলে উনিশ শ’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে রাখা প্রয়ােজন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। সরকার পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েও তারা নিজ দেশে পরাধীনতার জীবন বরণ। করতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ১৯৪৯ সালের জুন মাসে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে। পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের মধ্যে ছিলেন হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। উনিশ শ’ পঞ্চাশের দশকে তারা যখন লন্ডনে আসেন তখন প্রবাসী বাঙালিরা তাদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দাবিদাওয়া সম্পর্কে আলােচনা করেন। এই প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া), মিনহাজ উদ্দিন, হরমুজ আলী ও আইয়ুব আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রয়ােজনমতাে তারা বাঙালি নেতাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়েছেন। লন্ডন সফরকালে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য বাঙালি নেতারা আর্লস কোর্ট এলাকায় ২৭৫ নম্বর ব্রমটন রােডে অবস্থিত আবদুল মান্নানের রেস্তরা ‘গ্রিন মাস্ক’ এবং কেনসিংটন এলাকায় ২৯ নম্বর সেন্ট মেরী এ্যাবটস্ টেরাসে (বর্তমানে অন্য নামে পরিচিত) তার নিজস্ব বাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। উনিশ শ’ পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে লন্ডনে বাঙালি ছাত্রদের সংখ্যা নগণ্য ছিল। উল্লিখিত দশকের শেষ ভাগ থেকে ষাটের দশকের প্রথমদিকে বহু বাঙালি ছাত্র লন্ডনে আসতে সমর্থ হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হওয়া বাঙালিদের পক্ষে সম্ভব হয়। মাহমুদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, শরফুল ইসলাম খান, সুবিদ আলী টিপু, একরামুল হক প্রমুখ বাঙালি ছাত্ররা পর্যায়ক্রমে ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করতে সমর্থ হন। রাজনীতি-সচেতন বাঙালি ছাত্ররা পূর্ব বাংলার দাবিদাওয়ার ব্যাপারে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে যােগ দেন। ইতােমধ্যে লন্ডন-প্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশন দখল করে বাঙালিদের দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে শরিক হন। ১৯৬৪ সালে উত্তর লন্ডনের ৯১ নম্বর হাইবারি হিলে পূর্ব পাকিস্তান ভবন (East Pakistan House) প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পূর্ব বঙ্গের জনগণকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার সপক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে সহায়তা করাই ছিল প্রতিষ্ঠাতাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মিনহাজউদ্দিন, আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া) ও হাফেজ মজির উদ্দিন। তেরচৌদ্দটি রুমবিশিষ্ট দোতলা বাড়িটির মূল্য ছিল দশ হাজার পাউন্ড। এর মধ্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড অগ্রিম জমা দিতে হয়। এর একটা অংশ মিনহাজউদ্দিন নিজ পকেট থেকে এবং বাকি অংশ ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে জমা দেন। পূর্ব বাংলার দাবিদাওয়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এশিয়ান টাইড’, (Asian Tide) শীর্ষক একটি ইংরেজি পত্রিকা এবং পূর্ব বাংলা শীর্ষক একটি বাংলা। পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইংরেজি পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ফজলে আলী ও নিজামউদ্দিন ইউসুফ। বাংলা পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন আলমগীর কবীর ও মেসবাহ উদ্দিন।
কয়েক মাস পর আমীর আলী পত্রিকা দুটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে ‘আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান (Unihappy East Pakistan) শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়। কবীর উদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে ডক্টর এবং ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার) সম্পাদিত পুস্তিকাটি রচনার ব্যাপারে জাকারিয়া খান চৌধুরী সহায়তা করেন। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যে জেনারেল আঁ$’র রাষ্ট্রীয় সফরকালে ‘আইয়ুব এক্সপােজড় শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকাও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রচারিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রবাসী বাঙালিরা ঐতিহাসিক ছ’দফাকে তাদের মুক্তি-সনদ হিসেবে গণ্য করেন। পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সুলতান মােহাম্মদ শরীফ এবং ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা যুক্তভাবে ছ’দফা সম্পর্কিত দলিল ছাপিয়ে সমগ্র যুক্তরাজ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি সুবিদ আলী টিপু ও পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের প্রাক্তন। প্রেসিডেন্ট আফতাবউদ্দিন শাহ্ সহযােগিতা করেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালিরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। মামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে প্রধানত বাঙালি ছাত্ররা লাউড স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশন দখল করেন। বিক্ষোভকারী ছাত্ররা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ঘােষণা করেন এবং অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানান। প্রবাসী বাঙালিরা পিছিয়ে থাকেন নি। যুব ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়ােজিত একটি প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দিয়ে ৭/৮ হাজার বাঙালি হাইড পার্ক থেকে পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দেয়া ও হাই কমিশন দখল করার ব্যাপারে অংশগ্রহণের জন্য আনিস আহমদকে জুলাই মাসের প্রথমদিকে (সম্ভবত ৮ জুলাই) পাকিস্তান হাই কমিশনের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তখন পর্যন্ত এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ মিছিল। এরপর আরাে কয়েকটি মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন এম এ রকীব, হাফিজ মজিরউদ্দিন, শামসুর রহমান, মতিউর রহমান, মিম্বর আলী ও সুলতান মাহমুদ শরীফ। একটি মিছিলের পর সুলতান শরীফ হাই কমিশন থেকে পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে ফেলে কালাে পতাকা উত্তোলন করেন।
এই কালাে পতাকার ফটো ও প্রতিবাদ মিছিলের সংবাদ ১৯৬৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দি টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। ছাত্র ও বাঙালি জনসাধারণের প্রতিবাদ মিছিলের পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আলােচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করার জন্য পরপর দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে হাফিজ মজিরউদ্দিনের দোকানে প্রথম সভা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনে আবদুল মান্নানের ‘গ্রিন মাস্ক’ রেস্তোরায় দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিস্তারিত আলােচনার পর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মামলা পরিচালনার ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য একটি ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হয়। মিনহাজ উদ্দিন কমিটির কনভেনার মনােনীত হন। শেখ মুজিবের পক্ষ । সমর্থন করার জন্য কমিটি ব্রিটেন থেকে একজন কৌসুলি পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ‘তাজমহল’ রেস্তোরাঁর মালিক আইয়ুব আলীর সৌজন্যে কেনসিংটন হাই। স্ট্রিট এলাকায় ১ নম্বর এডিংটন রােডে ডিফেন্স কমিটির অফিস স্থাপন করা হয় । সুলতান মাহমুদ শরীফ এই অফিস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ডিফেন্স কমিটির পক্ষ থেকে লন্ডনের সংবাদপত্র এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। প্রবাসী বাঙালিরা ডিফেন্স কমিটির তহবিলে মুক্তহস্তে দান করেন। যথাসময়ে কুইন্স কাউন্সেল ও শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামসকে মামলা পরিচালনার জন্য পাঠানাে হয়। মিনহাজ উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন : “এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর মাধ্যমে আমরা ব্যারিস্টার নিযুক্ত করলাম। (এজন্য) অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বারাে শ’ পাউন্ড যােগাড় করলাম। মিসেস মুজিব জায়গাজমি বিক্রি করে সেই সময় বিশ হাজার টাকা যােগাড় করলেন এবং সেই টাকা আমার কথামতাে চিটাগাং-এর একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা দেয়া হলাে। সেই রিসিট আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। আগরতলা কেসে আমার নিজের পকেট থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড খরচ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব সে টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
ইতােমধ্যে লন্ডনে এক রেস্তোরায় ছােটখাটো একটা প্রেস কনফারেন্স করা হলাে। আগরতলা কেস সম্পর্কে এবং আমরা যে শেখ মুজিবকে ডিফেন্ড করার জন্য ব্যারিস্টার পাঠিয়েছি লন্ডন থেকে তাও বলা হলাে। পরের দিনই খবরের কাগজে আমাদের ছবিসহ খবর প্রকাশিত হয়। | আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার পর শেখ মুজিবুর রহমান জেল। থেকে মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। এই উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তত্ত্বালীন সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। সমবেত জনসাধারণ বিপুল করতালিসহকারে তােফায়েল আহমদের প্রস্তাব সমর্থন করেন। যুক্তরাজ্যে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানানাের উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন সফরে আসেন। তাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য প্রবাসী বাঙালিরা। একটি কমিটি গঠন করেন। গাউস খান এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাসাদুক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য জেরার্ড স্ট্রিটে তার রেস্তোরায় (“দি গ্যাঞ্জেস’) যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সাক্ষাতের পর তাসাঙ্গুক আহমদ তার সহকর্মী আব্দুল মতিনকে বলেন, পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের কথা চিন্তা করছেন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্পষ্ট অভিমত-রক্তাক্ত সংগ্রাম এড়ানাে যাবে না। এই সংগ্রামে কার সাহায্য পাওয়া যাবে জিগ্যেস করা হলে তিনি তাসাদুক আহমদকে বলেন : “যে কেউ সাহায্য করবে তারই সাহায্য নেব।’ ৬ নভেম্বর (১৯৬৯) বঙ্গবন্ধু লন্ডন ত্যাগ করেন। তার কিছুকাল পর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। গাউস খান এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মনােনীত হন। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের কুলাউড়া রেস্তোরার মালিক বি এইচ তালুকদার সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ােজিত হন। পরবর্তীকালে লন্ডন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মিনহাজউদ্দিন ও সুলতান মাহমুদ শরীফ এই শাখার যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৭০ সালের আগস্ট (কিংবা সেপ্টেম্বর) মাসে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আমেরিকা যাওয়ার পথে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হােটেলে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লন্ডন আওয়ামী লীগ হােটেলের সামনে এক বিক্ষোভের আয়ােজন করে। হােটেলের নিকটবর্তী রাস্তার কোণে পুলিশ-বেষ্টনীর বাইরে কালাে পতাকাধারী প্রবাসী-বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের সপক্ষে শ্লোগান দেয়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে স্বয়ং ইয়াহিয়া খান রাস্তা পার হয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আসেন। তাদের সঙ্গে কথাকাটাকাটির সময় সুলতান মাহমুদ শরীফ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি জিগ্যেস করেন, আসন্ন নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যদি পার্লামেন্টে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদা লাভ করেন, তা হলে তাকে সরকার গঠনের সুযােগ দেয়া হবে কি না? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ইয়াহিয়া খান কিছুটা অসংলগ্নভাবে বলেন : “আমি যে-কোনাে মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করবাে। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার সুযােগ আমি কাউকে দেবাে না। পাকিস্তানের জন্য আমি প্রাণ দিতে রাজি আছি।’ ১৯৮৯ সালে লন্ডনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে আহমদ হােসেন জোয়ারদার (এ এইচ জোয়ারদার) বলেন, তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা ইয়াহিয়া খানবিরােধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। আসন্ন নির্বাচনে (১৯৭০) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা অর্জন করলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেন : “এটা প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে মি. জোয়ারদার বলেন : ‘তখন আমাদের কাছে পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তাধারা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দিনের মতাে পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা ধরে নিয়েছিলেন, বাঙালিরা তাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেই ; আর যদি ঘটনাক্রমে তেমন কিছু ঘটেই যায়, তবুও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। এটা তারা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিল।১০
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ ডিসেম্বর। সর্বগ্রাসী। ঝড়ের জন্য কিছুসংখ্যক আসনে নির্বাচন ১০ জানুয়ারি (১৯৭১) পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। মােট ২২টি দলও উপদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আওয়ামী লীগ দখল করে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারি দলের মর্যাদা লাভ করে। নির্বাচনের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার জন্য ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের বাঙালি ছাত্র ও যুবকরা নাইটসব্রিজ এলাকার চেশাম প্লেসে অবস্থিত ছাত্রাবাসে মিলিত হন। প্রস্তাবিত গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ দেবে না বলে সভায় অংশগ্রহণকারীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের আরাে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থকরা এসব সভায় অংশগহণ করেন। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে একমত না হওয়ায় তখনও পর্যন্ত ‘অ্যাকশন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় নি। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর। জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য ১২ জানুয়ারি (১৯৭১) ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় কোনাে অগ্রগতি না হওয়ায় ইয়াহিয়া খান ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৭ জানুয়ারি তিনি সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় ভুট্টোর বাড়িতে এক গােপন বৈঠকে সলাপরামর্শ। করেন। মি. ভুট্টো গণপরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন বয়কট’ করবেন বলে ঘােষণা করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় লন্ডন আওয়ামী লীগ মি. ভুট্টোর সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে ঘােষণা করে। মিনহাজউদ্দিন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে সুলতান মাহমুদ শরীফ বলেন, পার্লামেন্টের প্রস্তাবিত অধিবেশন স্থগিত রাখার সম্ভাবনা আঁচ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পার্লামেন্টের অধিবেশন নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানের দাবিতে লন্ডনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশ অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে এক প্রচণ্ড বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন হাজার প্রবাসী-বাঙালি এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভকারীরা। পার্লামেন্টের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা ও রেডিও মারফত গণপিরষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সংবা পাওয়ায় প্রকালীবাঙালিরা বেশন স্থগিত রাখার সংরঃ ‘বা গত অবিলম্বে মশাল মিছিল ও পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ২৪-ঘণ্টাব্যাপী ‘ভিজিল’ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এই ‘ভিজিল’ ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২ মার্চ বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভুইয়ার নেতৃত্বে একদল বাঙালি রাজনৈতিক-কর্মী লন্ডনে এসে ‘ভিজিল’-এ অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যােগ দেন। ৩ মার্চ বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘােষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযােগ করেন। বাঙালি রেস্তোরার মালিকরা। বিক্ষোভকারীদের জন্য খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫ মার্চের পর বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে থেকে সরে গিয়ে নিকটবর্তী হাইড পার্কে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহায্যের আবেদন জানান। ৩ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ইসলাম ও ভূগােলের মধ্যে বিরােধের ফলে সৃষ্ট বিপরীতমুখী শক্তি পাকিস্তানকে দু’ভাগে ভেঙে ফেলবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই নিবন্ধে পাকিস্তানকে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট মুসলিম রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লিখিত তারিখে (৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার) শেখ মুজিব বলেন, পরবর্তী রােববার তিনি ছ’দফার ভিত্তিতে রচিত পাকিস্তানের সংবিধান ঘােষণা করবেন। পরদিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত স্বায়ত্তশাসন কায়েম হবে। ৫ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ৩০০ জন নিহত হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করে শেখ মুজিব পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী দখলকারী-শক্তির মতাে ব্যবহার করছে বলে অভিযােগ করেন। সৈন্যবাহিনী নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে অসহায় জনসাধারণকে হত্যা করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
৫ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে পল মার্টিন শেখ মুজিবকে কার্যত । বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার শাসক বলে উল্লেখ করেন। পরদিন ‘দি টাইমস’-এ এই। সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৬ মার্চ ‘দি টাইমস’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, প্রতিবাদমুখর পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তীব্রতর হচ্ছে।… শেখ মুজিব নিশ্চয় পাকিস্তানকে দু’ভাগ করতে চান না। কিন্তু ভুট্টো তাকে সেদিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। ৬ মার্চ করাচি থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের সামনে দুটি পথ খেলা রয়েছে : তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারেন অথবা গণপরিষদের অধিবেশন ডেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। ৭ মার্চ ‘দি সানডে টাইমস-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবকরা চেশাম প্লেসে অবস্থিত পাকিস্তানি ছাত্রাবাসের দেয়াল থেকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি নামিয়ে পায়ের তলায় ফেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। ছাত্রাবাসে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে অবস্থিত লাইভ স্কোয়ারে অবিরাম বিক্ষোভ প্রদর্শন করার জন্য বহু ছাত্র ও যুবক জমায়েত হন। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের যুক্তরাজ্য শাখার সদস্যরা এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকরা এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। শেখ আবদুল মান্নান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সদস্যদের নেতৃত্বদান করেন। একই তারিখে (৭ মার্চ) বাঙালি ছাত্রদের সর্বদলীয় এক সভায় বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন (বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) গঠিত হয়। সেদিন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়ােজিত এক প্রতিবাদ মিছিলেও ছাত্ররা যােগ দেন। উল্লিখিত তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ছাত্র ও যুবকদের উদ্যোগে বিক্ষোভ অনুষ্ঠানকালে ঘােষণাটি ইংরেজি ও বাংলা প্রচারপত্র হিসেবে বিলি করা হয়।১৩
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে (পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে বলেন : ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘােষণার খবর পরদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় নি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা তার ভাষণের বিবরণ জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৮ মার্চ ঢাকা থেকে মার্টিন এ্যাডিনি প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, নতুন । সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াকুব খান সম্ভবত পদচ্যুত হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস বি এ সিদ্দিকী নতুন গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেছেন। পরদিন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ৯ মার্চ (মঙ্গলবার) ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত অপর এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবের অগ্নিগর্ভ বক্তৃতার পরদিন (সােমবার) ঢাকার জীবনযাত্রা মােটামুটিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে এটা পরিষ্কার বােঝা যায়, তার (শেখ মুজিব) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তার অনুমতি ছাড়া কোনাে সরকারি কার্য পরিচালিত হবে না। গত রােববার (৭ মার্চ) তাঁর বক্তৃতা ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে সরাসরিভাবে প্রচারিত হওয়ার ফলে বেতার কর্মচারীরা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন। পরদিন (৮ মার্চ) বক্তৃতাটি প্রচারিত হওয়ার পর রেডিও স্টেশনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ধর্মঘট পালনের জন্য শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস, উচ্চ ও নিম্ন আদালত, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে বন্ধ থাকবে। তাছাড়া ট্যাক্স ও খাজনা দেয়া হবে না, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাঙ্কে পশ্চিম পাকিস্তানের একাউন্টগুলাে পরবর্তী নির্দেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ বলে গণ্য করা হবে। | ৯ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গণসমাবেশে বক্তৃতাদানকালে চীনপন্থী মওলানা ভাসানী বলেন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সগ্রামকে তিনি সমর্থন করেন।
এর ফলে শেখ মুজিবের নীতির প্রতি বামপন্থীদের প্রকাশ্য সমর্থন সূচিত হয় বলে ‘দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতা পল্ মার্টিন মন্তব্য করেন। ১০ মার্চ ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার সারমর্ম উল্লেখ করা হয়। ১২ মার্চ ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। ইতােমধ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (বর্তমান ১০ নম্বর) রাস্তায় অবস্থিত তার বাড়িকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনুকরণে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাঙ্কার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লােকজন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শুধু মিলিটারি ব্যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের ওপর। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে এই সংবাদে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন দেশের সরকার কিংবা তাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করে পূর্ব বঙ্গের আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের অনুরােধ জানানাের জন্য বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে) সুলতান মাহমুদ শরীফ, মিনহাজউদ্দিন ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু লন্ডনে নিয়ােজিত ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার এ ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশন প্রবাসী বাঙালিদের সর্বপ্রকার সাহায্য দান করবে বলে বিদেশে ভারতের প্রত্যেকটি দূতাবাসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৪ মার্চ (রােববার) লন্ডনে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মফস্বলের বহু শহর থেকে দশ হাজারের বেশি বাঙালি হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে যােগদান করেন। হাইড পার্ক থেকে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের নেতৃত্বে লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এর আগে লন্ডনে বাঙালিদের এত বড় সমাবেশ আর দেখা যায় নি।১৪ এই সমাবেশের পর ব্রিটেনে বাঙালিদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫টি শহরে অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। এই শহরগুলাের মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, লিড়স, ব্র্যাফোর্ড ও ম্যাঞ্চেস্টার।
১৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছাবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চার হাজারেরও বেশি ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৬ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই রিপাের্টে বলা হয়, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে আসন্ন আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে কোনাে কোনাে মহল আশাবাদী ছিল। কিন্তু ছাত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে কথা শুনতে রাজি নয়।। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিদেশি সামরিক ও বেসামরিক বিমান ভারতের ওপর দিয়ে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করা হয়। ১৭ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ। মুজিবের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে ডক-শ্রমিকরা জাহাজ থেকে চীনা অস্ত্রশস্ত্র নামাতে অস্বীকার করেছে। এ সংবাদে আরও বলা হয়, গত সপ্তাহে দু’হাজারেরও বেশি। পাকিস্তানি সৈন্য গােপনে চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকে । নেমেছে বলে শেখ মুজিব ঘােষণা করেছেন। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, পাশব-শক্তি প্রয়ােগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে দমনের জন্য সামরিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পিছিয়ে দেন বলে দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর স্টাফ রিপাের্টার মন্তব্য করেন। ইতঃপূর্বে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বজায় রাখার জন্য প্রয়ােজন হলে বল প্রয়ােগ করা হবে বলে ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে হুঙ্কার দেন। ১৯ মার্চ ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে দু’দিনব্যাপী আলােচনার পর পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর। সাম্প্রতিক গুলিচালনার ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত ১৭ মার্চের প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘােষণা থেকেই বােঝা যায়, কমিশন গঠনের প্রস্তাব অর্থহীন। জনগণকে প্রতারণা করাই এর উদ্দেশ্য। এই কমিশনের সঙ্গে কেউই সহযােগিতা করবে না বলে তিনি ঘােষণা করেন। ২০ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে ‘দি অবজারভার -এর সংবাদদাতা বলেন, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলােচনার ফলে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে একটা কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ মুজিব সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােজিত হবেন।
ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা আগমন রাজনৈতিক মহলে, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে আশার সঞ্চার করে। কিন্তু বিদ্রোহী বাঙালিরা অমঙ্গল আশঙ্কা করে মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২২ মার্চ শেখ মুজিব ও মি, ভুট্টো এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক চলাকালে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, গণপরিষদের প্রারম্ভিক অধিবেশনের তারিখ ২৫ মার্চ থেকে পিছিয়ে দেয়া হবে। | যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি’ ও তাদের সমর্থকরা ২৩ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে বাংলার জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘােষণা করে। ( ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে। প্রতিরােধ দিবস পালন করে। ঢাকার সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ এবং শেখ মুজিবের বাড়িসহ শত শত বাড়ির ওপর সবুজ পটভূমিতে বাংলাদেশের সােনালি মানচিত্রখচিত নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সম্পর্কে ২৪ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিব তাঁর বাড়ির সামনে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগ কর্মীর এক সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ২২ দিন আগে তার নেতৃত্বে যে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। রক্তপাত ছাড়া যিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেন তিনিই সবচেয়ে বড় সেনাপতি’ বলে শেখ মুজিব মন্তব্য করেন।
মওলানা ভাসানী ও তাঁর সহকর্মীরা প্রতিরােধ দিবসের পরিবর্তে ২৩ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করেন। এই উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) স্বীকার করেন, তার প্রতিপক্ষ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পূর্ণ আস্থা অর্জন করেছে। তিনি আরও বলেন : “জনগণ সামরিক বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে। এবং তারা সেনাবাহিনীর নির্দেশ উপেক্ষা করেছে।১৬ | ২৫ মার্চ সন্ধ্যার আগে করাচি থেকে প্রেরিত ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতাদের খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলােচনা ব্যর্থ। হয়েছে। শেখ মুজিব এক ঘােষণা জারি করে বিদেশি কোম্পানিদের মাল রপ্তানি সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেন পূর্ব বাংলার দুটি ব্যাঙ্কের মারফত করার নির্দেশ দেন। করাচির পরিবর্তে ম্যানিলা ও লন্ডনের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের টেলি-যােগাযােগ রক্ষার জন্য তিনি বিদেশি ডাক ও টেলিগ্রাফ কোম্পানিদের অনুরােধ জানান। | প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার এক খবরে প্রকাশ, পূর্ব বঙ্গের ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের অসহযােগিতার ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ বাহিনীকে অস্ত্র পরিত্যাগে বাধ্য করতে পারে নি। তা ছাড়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, অস্ত্রধারী রিজার্ভ পুলিশ ও বেসামরিক পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা একযােগে শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২৬ মার্চ লন্ডনের সংবাদপত্রে এসব খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ লন্ডনের প্রভাতকালীন সংবাদপত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশিত হয় নি। সেদিন সান্ধ্য-পত্রিকাগুলােতে (‘ইভিনিং নিউজ’ ও ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড) পূর্ব বাংলার বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী খবরে প্রকাশ, ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রির পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্ত-পিপাসু বর্বর সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের অসহায় পুরুষমহিলা-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে রক্তবন্যার সূচনা করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি – যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন