আমরা তােমার পাশে আছি
বাস্তব অভিজ্ঞতাই সব চেয়ে বড়াে… স্বাধীনতার পর দু’টি যুগের নানা… ভারতবর্ষ ও পূর্ব পাকিস্তান
থেকে… বাঙলাদেশের তেষট্টি কোটি মানুষ আজ মর্মে মর্মে বুঝেছেন… ও স্বাধীনতার শত্রু কে মিত্র কে। মধ্যিখানে পিকিং ছুঁয়ে ইসলামবাদ থেকে নিক্সনবাদ পর্যন্ত যে ষড়যন্ত্রের জাল এই উপমহাদেশের অস্তিত্বে দুঃস্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে, তারই প্রতিরােধের প্রহরায় সদাসতর্ক সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দৃঢ়সংকল্প আমাদের জনজীবন উপলব্ধি করেছে।
মাওবাদী চীনা নেতৃত্ব যখন নিক্সন-চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রসঙ্ েইয়াহিয়া খানের ছিদ্র কুন্তে জল রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখনই সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বস্তি পরিষদে তিন তিনবার ভেটো প্রয়ােগ করে সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক ভারতকে আগ্রাসী প্রমাণ করার চক্রান্তকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক ভেটো ভারত ও বাঙলাদেশের নিজেদের কর্মসূচি অনুযায়ী দৃঢ়পদে এগিয়ে যাওয়ার সুযােগ দিয়েছে।
ইয়ােরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রধান প্রধান সংবাদ-…ভারত ও বাঙলাদেশের উপর সার্বিক সমর্থন জানানাে হয়েছে। বিশেষ করে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বেতার ও সংবাদপত্রে ইয়াহিয়া খান ও পাক হানাদার ফৌজকে সরাসরি আক্রমণকারী বলে ঘােষণা করা হয়েছে। সেখানকার মুখ্য সরকারী দৈনিক ‘নিউয়ের জয়েটশল্যাণ্ড’ এর প্রথম পাতায় গত শনিবার শিরােনাম ছিল, “পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঘঘাষণা করেছে। পূর্ব জার্মানীর বেতারকেন্দ্র থেকে বলা হয়, “ভারত তার জাতীয় স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় ব্রতী হয়েছে।”
পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার দু’দিন পূর্বে পােল্যাণ্ডে ওয়ারিশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলির বৈদেশিক দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের যে সভা হয়, তাতে ইয়াহিয়া চক্রের জঙ্গী মনােভাব ও মার্কিন প্রশাসনের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার নব পর্যায় নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা হয়। আলােচকরা সকলেই বাঙলাদেশের অগণিত মানুষের মৃত্যু ও দুর্দশার পিছনে সামরিক ও নয়া-উপনিবেশবাদী চক্রান্তের কথা উল্লেখ করেন। পূর্ব জার্মানীর বৈদেশিক দপ্তরের মন্ত্রী অটো উইনজার বার্লিনে ফিরে এসে বলেন, “সভায় সর্বসম্মতক্রমে স্বীকৃত হয়েছে যে পূর্ববাংলার জনগণের ন্যায়্য দাবির ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।”
সংগ্রামী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবা বাঙলাদেশ প্রশ্নে রাষ্ট্রসঙ্রে ভেতর ও বাইরে সােভিয়েত নীতিকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানিয়ে আসছেন। রাষ্ট্রসঙ্গে কিউবার প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষ হাড়ে হাড়ে জানে, মার্কিনি পুঁজিবাদে ও সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র কতােখানি হঠকারি ও প্রতারক হতে পারে। পাক ভারত সংঘর্ষে তাদের ভূমিকা নেই একই চরিত্রকে প্রতিফলিত করেছে।” সাম্রাজ্যবাদে বিরােধী বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিলে কিউবার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রসঙ্,ে সংবাদপত্রেও বেতারে প্রায় একই বক্তব্য তুলে ধরেছে চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গারি, বুলগেরিয়া ও পােল্যাণ্ড। চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিনিধি রাষ্ট্রসঙ্ঘে বলেছেন, “পূর্ব বাঙলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ইচ্ছার সম্মান রক্ষিত হলেই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসা ও পাক ভারত সংঘর্ষের সমাধান হওয়া বাস্তবিক ভাবে সম্ভব।”
বাঙলাদেশ প্রশ্নে উত্তর ভিয়েতনামের প্রজাতান্ত্রিক সরকার দৃঢ়ভাবে মুক্তিসংগ্রামীদের সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।
সােভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম সম্পর্কে এখানে নতুন করে আলােচনা করার অবকাশ নেই। ভারত সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি থেকে শুরু করে বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি কার্যকরী সমর্থন জানানাে এবং মার্কিন-চীন-পাক সামরিক জুন্টার নােংরা আঁতাতের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে সােভিয়েতের ভূমিকা ভারত ও বাঙলাদেশের মতাে বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণের কাছেও আবার . নতুন করে… দুর্গ লাল সােভিয়েতকে পাশে না পেলে দুনিয়ার সগ্রামী জনতার অগ্রসর হওয়ার আজ আর কোনাে উপায়ই নেই।
পশ্চিমী দুনিয়ার কয়েকটি সংবাদপত্র থেকে
লণ্ডন টাইমস (১৩ ডিসেম্বর) এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছেন যে পাকিস্তান যদি বাঙলাদেশে ভরাডুবি থেকে বাঁচতে চায়, তাহলে তার উচিত এখনই শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তাকে সরকার গঠনের দায়িত্ব দেওয়া। এই সম্পাদকীয়তে আরও মন্তব্য করা হয়েছে যে এমনকি পাক জেনারেলরাও স্বীকার করেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান বলে আর কিছু থাকবে না এবং পাক সরকারের উচিত বাঙলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করা।
আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস-এর ১৪ ডিসেম্বরে রচিত সম্পাদকীয়তে বাঙলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকারের নীতির সমালােচনা করে বলেছেন যে পাক-ভারত যুদ্ধ থামানাের জন্য মার্কিন সরকার অতি সামান্যই চেষ্টা করেছে। ওয়াশিংটনের উচিত ছিল পাক-ভারত মহাদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য ইসলামাবাদকে আরও বাস্তব ও নমনীয় মনােভাব গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া।
সম্পাদকীয়টিতে একথাও বলা হয়, ইসলামাবাদ আত্মহননের যে অনমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে তার ফলে ‘সংযুক্ত পাকিস্তান আর কখনাে হতে পারে না। এই নীতির ফলে শুধু যুদ্ধের ব্যাপকতা বাড়তে পারে এবং প্রচুর সামরিক ও অসামরিক লােক প্রাণ হারাতে পারে।
লণ্ডন থেকে প্রকাশিত সানডে টেলিগ্রাম পত্রিকার ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংখ্যার সম্পাদকীয় রচনা থেকে কিছু অংশ নিচে উদ্ধার করছি। প্রবন্ধটির শিরােনাম ‘এক নতুন ভারত।
“সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত বিভাগ এখন বাতিল হয়ে গেছে, পরােক্ষভাবে অস্ত্রশক্তির চাপে উপমহাদেশে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।
..মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে সহবস্থান করতে পারবে না, এই অনুমানই ছিল দেশ বিভাগের ভিত্তি, কিন্তু তা ‘প্রকৃতির নিয়ম নয়।… আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম গেরিলারা ও হিন্দু প্রাধান্যযুক্ত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী একটি প্রধানত মুসলিম রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য সহযােগিতা করছে।
এবং ইজভেস্তিয়ার ভাষ্য
সােভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী সংবাদপত্র ইজতেস্তিয়ার রাজনৈতিক ভাষ্যকার ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন যে পাক-ভারত উপমহাদেশের সংকট নিরসনের জন্য বাঙলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান থেকে যুদ্ধাবসানের বিষয়টিকে আলাদা করে দেখা যায় না। কারণ এই দুটি বিষয় একই সমস্যার এ পিঠ ও পিঠ।
তিনি বলেন, “যারা দ্বিতীয় প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে প্রথম প্রশ্নটি সমাধানের জন্য পীড়াপাড়ি করছেন, তারা প্রত্যেকেই বর্তমান সংঘর্ষের মূল কারণগুলি জিইয়ে রাখছেন, যা অনতিবিলম্বে বা পরে আর একটি সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে।”
বাঙলাদেশের জনগণকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার জন্য পাকিস্তানকে সহায়তা করায় তিনি চীনের কঠোর নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানকে চীন সরকারে সাহায্য দানের অর্থ শুধু তাকে ভারত আক্রমণের দিকে ঠেলে দেওয়াই নয়, বাঙালী জনগণকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে সাহায্য করা।”
তিনি অভিযােগ করেন, “পশ্চিমী শক্তিবর্গ পূর্ব-বাঙলায় গণতন্ত্র রক্ষা এবং পূর্ব-বাঙলায় ব্যাপক গণহত্যা রােধ করার জন্য বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয় নি। এখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তাদের ব্যগ্রতা অশােভন ও দুরভিসন্ধিমূলক।”
সূত্র: কালান্তর, ১৬.১২.১৯৭১