প্রচণ্ড কামান যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১১ ডিসেম্বর রাত কেটে গেলাে। পরদিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভােরের নিষ্প্রভ আলােতে খানিকটা যেনাে ইতঃস্তত ভাব নিয়েই সূর্যের উদয় হলাে। আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের সর্বত্র পাকিস্তানীদের বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণ তখনাে চলছে। তবে তার তীব্রতা অনেকটা কম ভারতীয় বাহিনীর গােলাবর্ষণও থেমে নেই। তাদের মাঝারী কামানগুলাের ভারী গােলা প্রচণ্ড শব্দে সারারাত ধরে প্রকম্পিত করেছে ভৈরব মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে ভারতীয়দের গােলাবর্ষণ এখনাে অব্যাহত রয়েছে। দূরে রায়পুরা-নরসিংদীর দিক থেকে গােলাগুলির শব্দ শােনা যাচ্ছে। গত রাতেও সেখানে গােলাগুলির শব্দ শােনা গেছে। এই অক্ষে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা এগিয়ে চলেছে। শেষ রাতের দিকে তালশহরে অবস্থান নেয়া ভারতীয় মাঝারী পাল্লার কামানগুলাে থেকে। সেদিক লক্ষ্য করে কয়েক দফা গােলাও বর্ষিত হয়েছে। দৌলতকান্দি ও মেথিকান্দা এলাকায়ও ভারতীয়রা গােলাবর্ষণ করেছে। সেদিক থেকেও রাতে গােলা ফাটার শব্দ এসেছে। সেখানে ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের একাংশ মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় দ্রুত বিচলন ঘটিয়ে ইতিমধ্যেই ভৈরবে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানীদের পশ্চাদ্ভাগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গত রাতটি ছিলাে হিম শীতের রাত। কনকনে হাওয়ায় শীতের প্রচণ্ডতা বেড়ে গিয়েছিলাে হঠাৎ করেই। মেঘনার পার ঘেষে আমাদের অবস্থান নেয়ার কারণে শীতের তীব্রতা আরও | বেশী অনুভূত হয়েছে। কামান যুদ্ধ ততােক্ষণে থেমে গেছে। এই ফাকে কোম্পানীর তদারকিতে বেরিয়ে পড়লাম। ক্লান্ত সৈনিকরা ট্রেঞ্জ থেকে মুখ বের করে উৎসূক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ওপারে ভৈরবের দিকে। হুদা তার অবস্থানে সেভ করছে। আমি কাছে আসতেই শুষ্ক হাসি দিয়ে অভিবাদন জানালাে। একটু কৌতূক করেই বললাে, বাড়ির কাছে পৌছে গেছি স্যার। তাই তৈরী হয়ে নিচ্ছি। অদূরে ট্রেঞ্জের পাশে উপবিষ্ট এক তরুণ সৈনিক আবেগভরে আমাকে অভিবাদন করে। বললাে, স্যার ওপারে ডান দিকে একেবারে উত্তরে ঘন গাছে ঘেরা ওই বাড়িটি আমার। তার এই বলার মধ্যে একটি অব্যক্ত বেদনা প্রকট হয়ে উঠলাে। সে তখনাে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে দূরের সেই নিস্তব্ধ গ্রামটির দিকে সম্ভবতঃ ওই ছােট্ট গ্রামটিকে ঘিরে বিগত ন’টি মাস ধরে তার অন্তরে লালিত হয়ছে একটি স্বপ্ন। স্নেহভারে মাথায় হাত রাখতেই অশ্রুসজল হয়ে উঠলাে তার দু’চোখ। পুঞ্জীভূত বেদনা কোনাে বাধাই আর মানলাে না।
ছােট্ট শিশুর মতাে ফুপিয়ে কেদে উঠলাে সে। আমি তাকে বললাম তুমি চাইলে এখনই চলে যেতে পারাে। তােমার ছুটি। যতােদিন ইচ্ছে থেকে আবার ফিরে এসাে। কিন্তু তার সৈনিক সত্তা আমার এ কথায় আবার জাগ্রত হয় উঠলাে। দু হাত দিয়ে চোখ মুছে সে বললাে, না স্যার, দেশ আগে স্বাধীন হােক। এক সাথেই যাবাে। এক সাথেই প্রিয়জনদের খুঁজবাে। আমি তার কথা শুনে হেসে উঠলাম। সেও হাসলাে। চোখের কোনে তখনাে তার দু ফোটা পানি টলটল করছে। কুয়াশা পুরােপুরি কেটে যেতেই দিনের প্রথম বিমান আক্রমণের সূচনা হলাে। এক ঝাক ভারতীয় এস ইউ ৭ বােমারু বিমান পূর্ব দিক থেকে সূর্যকে পেছনে রেখে ভৈরবে পাকিস্তানা লক্ষ্যবস্তুতে মুহুর্মুহু আঘাত হানলাে। সেখানে অবস্থান আগলে রাখা পাকিস্তানীরা তাদের দূরপাল্লার স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের নিক্ষিপ্ত হাজার হাজার গুলির শব্দ এবং সেই সাথে ভারতীয় বােমারু বিমানের বর্ষিত গােলার প্রচণ্ড আওয়াজে প্রলয়ংকারী এক অবস্থার সৃষ্টি হলাে ভৈরবে আশুগঞ্জে আমাদের অবস্থান থেকে মেঘনার অপর পারে সংঘটিত বিমান আক্রমণের পুরােটাই দৃষ্টিগােচর হলাে। বিমানগুলাে একের পর এক তাদের দায়িত্ব পালন শেষে আবার পূর্ব দিকে ফিরে গেলাে সেগুলাের প্রস্থানের পর পরই আরেক ঝাঁক বােমারু বিমান আবারও দেখা গেলাে ভৈরবের আকাশে। পাকিস্তানীরা এবারাে প্রতিরােধ গড়ে তােলার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা নিস্ফল প্রমাণিত হলাে। আক্রমণকারী বিমানগুলাে নির্বিঘ্নেই তাদের দায়িত্ব পালন করে চললাে। দু’টি বিমান ভৈরব রেলস্টেশন এলাকায় খুব নিচু দিয়ে উড়ে নাপাম বােমার আঘাত হানলাে। নাপামের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভৈরব-আশুগঞ্জ কেঁপে উঠলাে। মুহূর্তের মধ্যেই থেমে গেলাে পাকিস্তানীদের বিমান বিধ্বংসী তৎপরতা। সেখানে আহতদের তীব্র আর্তনাদ আমাদের অবস্থান থেকেও শােনা গেলাে। মাত্র ক’দিন আগেও এই পাকিস্তানীরাই তাদের স্যাবর জংগী বিমান দিয়ে শুধু মুক্তিবাহিনীই নয়, নিরস্ত্র বাঙালী জনগােষ্ঠীর ওপর যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছে তাদের বিধ্বংসী মারণাস্ত্রগুলাে। অসহায় সেই মানুষের মৃত্যু-যন্ত্রণার বিদীর্ণ চিকার আজকের তুলনায় সেদিন ছিলাে আরও করুণ, আরও ভয়াল। ভারতীয় বিমান বহর সেদিন উপর্যুপরি বেশ কয়েকবারই ভৈরবে পাকিস্তানী সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালালাে। সারাদিন ধরে কামান যুদ্ধও অব্যাহত থাকলাে। শেষ বিকেলের দিকে আমাকে জানালাে হলাে যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকজন লােক তাদের নিখোজ আত্মীয়স্বজনের সন্ধানে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের এলাকাসমূহে প্রবেশ করতে চাচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকবাহিনীর পশ্চাদপসরণের পর এই সমস্ত ব্যক্তির কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেহেতু পাকিস্তানীরা পরবর্তীতে আশুগঞ্জে এসেছে সেহেতু তাদের ধারণা এখানে কোথাও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আমার বুঝতে বাকি রইলাে না সাইলাের নিকটবর্তী ডােবাতে হাত-পা বাধা অবস্থায় নিহত যে হতভাগ্যদের আমি দেখে এসেছি তারা এদেরই আত্মীয়পরিজন। বিয়ােগান্ত এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হলাে সেখানে। গলিত মৃতদেহগুলাে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতাে বিলাপ করে কাঁদছিলাে এদের অনেকেই। সাত কি আট বছর বয়সের একটি ছেলে পরণের কাপড় দেখে তার বাবার মৃতদেহ সনাক্ত করে। হাত দুটি পেছনে বাধা ছিলাে তার। এই দৃশ্যে অঝােরে কাঁদছিলাে ছেলেটি। সযত্নে তার বাবার মুখ থেকে কাদামাটি পরিষ্কার করে মৃতদেহটি একাই ডােবার পাড়ে টেনে নিয়ে আসে সে। তারপর ছােট্ট দু’ হাতে প্রিয় পিতার স্পন্দনহীন দেহটি আঁকড়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। এই কান্নার যেনাে শেষ নেই। পিতৃহারা শােকাহত শিশুর সেই কান্নার শব্দ ব্যথিত করে তুললাে চারদিক। আমি খুব কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিস্পলক দেখলাম দৃশ্যটি। ওকে সান্ত্বনা দেয়ার মতাে মানসিক অবস্থা | অবশিষ্ট নেই আমার। গত ন’ মাসে এই রকম দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি। অসহায় মানুষের মৃত্যু আর সেই অনাকাক্ষিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আত্মীয় পরিজনের কান্না শুনতে শুনতেই যুদ্ধের এই পথ মাড়িয়ে আসতে হয়েছে আমাকে। এই সব দেখে দেখে সব কিছুই এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
রংপুর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অনেক মৃত্যুই তাে দেখলাম। প্রিয়জনও কম হারাইনি। এখন | মনে হয় সব মৃত্যুই মর্মান্তিক। কিন্তু কোনাে কোনাে মৃত্যু তারপরও যেনাে বড় বেশী হৃদয় বিদারক। বড় বেশী কষ্টের। সেই সব মৃত্যুর কান্না অবশিষ্ট প্রিয়জনের হৃদয়ে কোনােদিনই যেনাে আর থামতে চায় না। | রণাঙ্গনে মানুষের মৃত্যু আর আমাকে আগের মতাে ব্যথিত করে না। এই মৃত্যুকে এক বাকে মেনে নিয়েই তাে আমি নেমে এসেছি এই যুদ্ধে। নিষ্ঠুরতম পাকিস্তানীদের বেয়ােনেট আর বুলেটের ঘায়ে অসহায় নিরস্ত্র মানুষের যে মৃত্যু, সম্প্রতি সেখানেও আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা। এরপরও অন্য আরেক রকম মৃত্যু আছে যা আমি দেখেছি ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত শরণার্থী শিবিরগুলােতে। সেখানে মৃত্যুর ঘটনা ছিলাে প্রায় নৈমিত্তিক। সেখানকার মানুষগুলাের মুখাবয়বও ছিলাে নিয়ত বিষন্ন। প্রায়ই কোলাহলহীন থাকতাে শিবিরগুলাে, যদিও অসংখ্য মানুষের বসবাস সেখানে। সেই সব শরণার্থী শিবির থেকে প্রায়ই মধ্যরাতের নিস্তবতা ভেদ করে ভেসে আসতাে নিঃসহায় মানুষের কান্না এ কান্নার বার্তা আর কিছুই নয়। পরবাসে মানুষের অসহায় মৃত্যুর ঘােষণা। আমাদের সেনাশিবির থেকে স্বদেশীদের উদ্বাস্তু জীবনের এই কান্নার ধ্বনি শুনেছি বহু রাত জেগে। তাদের স্বজন হারানাের এই আহাজারির মধ্যে চরম অস্থিরতায় অসংখ্য বিনিদ্র রাত কাটাতে হয়েছে আমাকে। শরণার্থী শিবিরগুলােতে মৃত্যু পথযাত্রীর চারপাশে সমবেত শােকাহত স্বজনদের বিলাপ করার দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়তাে।
কোনাে শুশ্রুষা নেই। ডাক্তার ডাকার বিড়ম্বনা নেই। এবং এই সব করার মতাে সামথ কিংবা সুযােগও কারাে নেই সেখানে। অসমথ দৃষ্টি মেলে একান্ত কাছ থেকে মৃত্যু আর ভােগান্তিকে নির্বিকার অবলােকন করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই যেনাে করার নেই কারাে। সেখানে একজন পিতা তার সন্তানের সামনে কিংবা একজন সন্তান তার পিতামাতার চোখের সামনে নিঃশব্দে জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করে অবলিলায় পার হয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীর মায়া। এই সব হতভাগ্যের অনেকেরই অন্তিম মুহূর্তে এক ফোটা বিশুদ্ধ পানি পর্যন্ত মুখে পড়েনি। | সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার পর রক্ষাব্যুহের পরিদর্শন শেষ করে সেদিনের মতাে নিজের অবস্থানে ফিরছিলাম। পথে এক জায়গায় ভারতীয় সৈনিকদের জটলা দৃষ্টিগােচর হলাে। অবসন সােনকরা একটি দোতলা বাড়ির দেয়ালের পেছনে চুপচাপ গাদাগাদি করে বসােছলাে। পাকিস্তানা কামানের নিক্ষিপ্ত গােলা থেকে জায়গাটি নিরাপদ। সাধারণতঃ কোনাে আক্রমণে। যাবার আগে এই রকমভাবে সমবেত হতে দেখা যায় তাদের। আমি সেদিকে এগিয়ে গি৯ে জানতে চাইলাম যে রাতে তাদের কোথাও কোনাে আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা আ৭ কিনা। জবাবে তারা কিছুই বলতে পারলাে না। নির্বিকার তাকিয়ে রইলাে আমার মুখের। যেনাে কোনাে পরিকল্পনার সাথে তারা সম্পৃক্ত নয়। প্রয়ােজনও নেই। শুধু নিদেশ। হলাে। কখন কোথায় কি করতে হবে আগ মূহুর্তে জানতে পারলেই যথেষ্ট। তাদের আ কোথায় আছে জিজ্ঞেস করলে একজন সৈনিক নদীর ধারে ট্রেঞ্চে বসে থাকা জলে লেফনান্যের কাছে নিয়ে গেলাে আমাকে। লেফটেনন্ট ক্ষুদ্রাকার একটি ট্রানজিস্টারে – গান শুনছিলাে। আমাকে দেখা মাত্রই সে ট্রানজিস্টার বন্ধ করলাে এবং হাসি মুখে গানগ তার পাশে বসার অনুরােধ করলাে। ট্রানজিস্টারে যে গানটি বাজছিলাে তা শুনেছি বহুবার। কিন্তু এ গানের আবেদন যেনাে শেষ হবার নয়। গুণী শিল্পীদের কদর বােধ করি এ কারণেই চিরায়ত, অবিনশ্বর। ‘ অনেকদিন গান শুনিনি। আজ হঠাৎ করেই গান শােনার একটু সুযােগ পেলাম। এলােপাতাড়ি দুশ্চিন্তায় মনটাও ভালাে লাগছিলাে না। ভারতীয় অফিসারটিকে অনুরােধ করলাম, ভালােই তাে লাগছিলাে, ধরুন না গানটি। মনে হলাে এই অনুরােধে সে খুশিই হয়েছে।
| প্রােগ্রামটি ছিলাে যুদ্ধে নিয়ােজিত ভারতীয় সৈনিকদের জন্যে নিবেদিত। রিসেপশন দুর্বল থাকার কারণে আওয়াজ মাঝেমধ্যেই ক্ষীণ হয়ে আসছিলাে। ইথার তরঙ্গের ধারণকৃত এই সুরেলা শব্দের উত্থান-পতন শুনতেও মন্দ লাগছিলাে না। বানি ও সুরের চেয়ে এখানে শব্দের শ্রুতিই যেনাে মুখ্য। নিয়ত চড়াই-উত্রাইয়ের অনিশ্চিত এই জীবনের সাথে কোথায় কোথায় যেনাে ভারি মিলে যাচ্ছিলাে এই শব্দমালার ওঠানামা। এখানে সবকিছু বুঝে দেখার ততােটা তাড়না আজ নেই, যতােটা আছে উপলব্বির। মনে হচ্ছে যেনাে বহু দূর থেকে বহু কষ্ট করে আমাদের এই কষ্টময় জীবনের দিকে ভেসে আসছে এই সুরের আওয়াজ। কষ্টার্জিত সবকিছুই মূল্যবান একটু বেশী ভালােলাগার। তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম লতা মুকেশ আর কিশােরের কণ্ঠ। শাশ্বত প্রেম বিরহ আর জীবনবােধ—সেখানে সব যেনাে আজ একাকার। এই একাকারের মধ্যে থেমে থেমে বারবার আমি কোথায় যেনাে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। জীবনের আশীতে লুপ্ত হয়ে যাওয়া সব মধুর স্মৃতি কী এক অমিয় আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাে সর্বাঙ্গে। সেই আবেগে আমি আনমনে শিহরিত হয়ে উঠছিলাম বারবার। আজ এই মুহূর্তে কেনাে যেনাে অন্তরের সব কটা কবাট খুলে দিয়ে একাকী ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হলাে। পায়ে পায়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও বেঁচে থাকাটা যে কী আনন্দের তা এই মুহূর্তে আমার চেয়ে ভালাে আর কে জানে। ভারতীয় তরুণ অফিসারটিও লক্ষ্য করলাম আনমনে নিজের ভেতরই ভেসে বেড়াচ্ছে কোথায় কোন সুখকর কল্পনার রাজ্যে, তা সেই জানে। দৃষ্টি ছড়িয়ে আছে তার বহুদূরে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া দিগন্তের দিকে। হয়তাে সেখানে সেই অন্ধকারে সে খুঁজে ফিরছে পাঞ্জাবের অখ্যাত কোনাে পাড়াগাঁর স্মৃতি। সেই পাড়াগায়ে হয়তােবা তার পথ চেয়ে প্রতিরাত জেগে থাকে কোনাে উদ্ভিন্ন স্বপ্নের মানুষ। এই যুদ্ধে এ যাবত যতাে জনকেই দেখলাম তাদের প্রত্যেককেই মনে হয়েছে কোনাে না কোনাে স্বপ্নকে অবলম্বন করেই যুদ্ধের বন্ধুর পথ পাড় হয়ে যাচ্ছে। আবার লালিত স্বপ্নকে বুকে চেপে কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে পথের মাঝেই। যুদ্ধে তবু কারােই পথ চলা আর থামে না। এই পথের শেষ কোথায়, আর কতাে দূর সেই মুক্তির দিগন্ত, কে জানে।
জানি না কতােক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম। গােলা ফাটার শব্দে এবং একই সাথে আমিনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। পাকিস্তানীরা আশুগঞ্জে আবার গােলাবর্ষণ শুরু করেছে। মুহুর্মুহু গােলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবনগুলাের ওপর। ভারতীয় অফিসারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠতে হলাে। যতােক্ষণ দৃষ্টির বাইরে চলে গেলাম ততােক্ষণ হাত নেড়ে বিদায় জানালাে সে। ওই রাতেই ভারতীয় বাহিনীর এই দলটি আশুগঞ্জের অবস্থান ছেড়ে চলে যাবে। নরসিংদী-ডেমরার মাঝামাঝি অঞ্চলে অগ্রবর্তী দলের সাথে মিলিত হবে তারা ঢাকার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে। এরপর থেকে ভৈরবের পূর্বাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বর্তাবে ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের ওপর। ১৩ ডিসেম্বর ভােরে ভৈরবে আবারও বিমান আক্রমণের মধ্যদিয়ে দিনের সূচনা হলাে। সকল ১০টা নাগাদ মােট দুবার বিমান হামলা সঘটিত হলাে। এর মধ্যে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর একজন অফিসার এসে জানালে যে সেদিন দ্বিপ্রহর থেকে সীমিত আকারে তাদের কামানের সমর্থন পাওয়া যাবে। কেননা ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর সিংহভাগই তখন মেঘনার অপর পাড়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শত্রুবাহিনীর ভৈরব অবস্থানের দূরত্ব নিকটবর্তী হওয়ার কারণে ভারতীয় গােলন্দাজ অফিসার প্রয়ােজনে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। মর্টার ব্যবহারে আমাদের কোনাে আপত্তি ছিলাে না। সমস্যা ছিলো গােলার অপর্যাপ্ততা তবে এরই মধ্যে সেই অবস্থাটিরও উত্তরণ ঘটেছে। আশুগঞ্জে পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া অজস্র মর্টারের গােলা ইতিমধ্যে আমাদের হস্তগত হয়েছে তাদের পরিত্যাক্ত একটি ৮১ মিলিমিটার চীনা মর্টারও আমাদের হাতে এসেছে। এখন আমার দুটি এবং ভূঁইয়ার একটি মােট তিনটি মর্টার দিয়ে আমরা সকাল থেকে ভৈরবের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে গােলাবর্ষণ শুরু করে তা প্রায় দুপুর পর্যন্ত চালিয়ে যাই। পাকিস্তানীরাও অদের ১০৫ মিলিমিটার কামানের গােলাবর্ষণের মাধ্যমে এর জবাব দেয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবনগুলাের পাশেই আমাদের মর্টারের অবস্থান থাকাতে পাকিস্তানীদের পাল্টা গােলা নিক্ষেপ তেমন কার্যকরী হতাে না।
অব্যাহত এই গােলা বিনিময়ের মধ্যে দুটি ভ্যরতীয় ৫.৫ ইঞ্চি মাঝারি কামান মাঝে মধ্যে ভৈরবে ভারী গােলার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আশুগঞ্জে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যেতাে। সেদিন বিকেলের দিকে আমাদের সৈনিকরা দুজন বন্দীকে আমার কাছে নিয়ে এলাে। এদের একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিক। পেশায় ড্রাইভার এবং অপর জনের পরিচয় হচ্ছে সে রাজাকার। যৌথবাহিনীর চাপের মুখে আশুগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনী যখন মেঘনার অপর পারে ভৈরবের দিকে পশ্চাদপসরণ করে তখন ধৃত এই সৈনিকটি তার গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়েছিলাে। সে তার সহযােগীদের পশ্চাদপসরণ টেরই পায়নি। এরপর ঘুম থেকে জেগে উঠে চারদিকে মুক্তিবাহিনীর অবাধ চলাচল দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আমাদের সৈনিকরা তাকে গাড়ির মধ্যেই আবিস্কার করে। ধৃত এই পাঞ্জাবী সৈনিকটি তার মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনাে ভাষায় কথা বলতে পারে না। ধরা পড়ার পর আতংকে সে এতােটাই বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে তার পক্ষে কথা বলার জন্যে শব্দ উচ্চারণ করাও অসম্ভব হয় ওঠে। আটক রাজাকারটির বাড়ি ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়। তার পড়নে ছিলাে পাকিস্তানী মিলিশিয়া প্রভুদের পরিত্যাক্ত ধূসর রংয়ের সালােয়ার কামিজ। মুক্ত এলাকা আশুগঞ্জে তাকে একটি পিআরসি ৬ বেতারযন্ত্রসহ আটক করা হয় এবং আটক হবার সময় সে ভৈরবে পাকিস্তানীদের সাথে গােপন তথ্য আদান প্রদান করছিলাে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে রাজাকারটি জানালাে, সে গত রাতেই ডিঙ্গি নৌকায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে এপারে এসেছে। সে স্বীকার করলাে যে আশুগঞ্জে যৌথবাহিনীর অবস্থান এবং অন্যান্য গােপন তথ্যাবলী ওপারে পাচার করার দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানাে হয়েছে। আরও জানা গেলাে যে সে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু গােপন তথ্য ওপারে ভৈরবে পাঠিয়েছে। আটক অবস্থায় আমার সামনে নিয়ে আসার পরও রাজাকারটিকে অবিশ্বাস্য রকম নির্বিকার মনে হচ্ছিলাে। সে কী হয়েছে এবং এখনই তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হবে—এ ব্যাপারে তার মধ্যে সামান্য রকম ভয়ভীতি আছে বলে মনে হলাে না। তার কথাবার্তা এবং আচারণে এমন একটা ভাব যেনাে ভিত হবার মতাে কোনাে ঘটনাই ঘটেনি। ভাবখানা যেনাে প্রকৃত বিপদে পড়ার কোনাে সম্ভাবনা দেখা দিলে ওপার থেকে তার শক্তিধর প্রভুরা ঝটিকা অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদ হেফাজতে নিয়ে যাবে।
বন্দী দুজনকে খােলা জায়গায় দুটি খুটির সাথে আলাদা করে বেঁধে রাখা হলাে। তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনাে সিদ্ধান্ত তখনাে নেয়া হয়নি। সহসা ওপারে ভৈরবের অবস্থান থেকে পাকিস্তানীরা কামানের গােলাবর্ষণ শুরু করলাে। গােলা থেকে বাঁচার জন্যে ছুটোছুটি করে সবাই যে যার ট্রেঞ্চে গিয়ে আশ্রয় নিলাে। কিন্তু বন্দীরা তখনাে উন্মুক্ত স্থানে খুটিতে বাঁধা অবস্থাতেই থেকে যায়। এলােপাতাড়ি গােলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে চারদিকে। গােলাবর্ষণের কৌশলে বরাবরই পাকিস্তানী গােলন্দাজদের নিয়মের কোনাে ব্যতিক্রম নেই। ইতঃস্তত বিক্ষিপ্তভাবে এবং বিস্তৃত পরিসর জুড়ে বিকট শব্দে পাকিস্তানীদের গােলা বিস্ফোরিত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানীদের এবারের গােলা নিক্ষেপে একটু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেলাে। আগের তুলনায় এই গােলার লক্ষ্যস্থল ছিলাে অনেকটা সুনির্দিষ্ট। | স্পষ্টটতঃই বােঝা যাচ্ছিলাে যে, আমাদের হাতে ধৃত রাজাকারটির দেয়া তথ্য নিপুণভাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করছে পাকিস্তানীরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বন্দী দুজনকে যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে তার খুব কাছাকাছি স্থানে কয়েকটি গােলার বিস্ফোরণ ঘটলাে। এই বিস্ফোরণের মধ্যে বন্দীদের বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু বিস্ময়কর যে সেই সন্নিকটবর্তী কয়েক দফা গােলার বিস্ফোরণ সত্ত্বেও ওরা সম্পূর্ণ অক্ষতই বেঁচে রইলাে। কেনাে যেনাে পাকিস্তানীদের গােলা বিশ্বাসঘাতকতা করলাে না। স্বজাতিদেরকে ওরা চিনতে ভুল করেনি বােধ করি।। গােলাবর্ষণ বন্ধ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজর মতিন আমাদের অবস্থানে এলেন। মেজর। নাসিম আহত হবার পর মতিন ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মনােনিত হন। আমাদের অবস্থানে শত্রু বাহিনীর গুপ্তচর বন্দী রাজাকারটিকে দেখে স্বভাবসিদ্ধ আক্রোসে জ্বলে উঠলেন তিনি। বেঁধে রাখা রাজাকারটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, আমি সন্ধ্যায় এখানে ফিরে এসে এই মানুষটিকে যেনাে আর না দেখি। মতিন চলে যাবার পর সুবেদার তৈয়ব বন্দী দুজনের ব্যাপারে আমার নির্দেশ চাইলাে। জবাবে আমি তাকে বললাম, আপনি তাে কমাণ্ডিং অফিসারের নির্দেশ পেয়েছেন। এ ব্যাপারে আর আমার নির্দেশের প্রয়ােজন আছে কি? যদিও এ সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত একটিই দেয়া হয়ে থাকে, আর তা হচ্ছে মৃত্যু। ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক মতিনের নির্দেশ না থাকলেও এই অভিন্ন সিদ্ধান্তই কার্যকরী হতাে এখানে।
এরপর সুবেদার তৈয়বের নির্দেশে দুজন সৈনিক বন্দীদেরকে নিয়ে যাবার জন্যে উদ্যোগী। হলাে। মনে হলাে বন্দী রাজাকারটি যেনাে এতােক্ষণে তার চৈতন্য ফিরে পেলাে। পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝতে এখন তার মােটেও কষ্ট হলাে না। এবার সে ঠিকই বুঝে নিয়েছে যে তাকে উদ্ধারের জন্যে ওপারের ভৈরব থেকে কোনাে ঝটিকা অভিযান পরিচালিত হবে না এবং তার প্রভুরা তাকে বাঁচাবার কোনাে তাগিদ আদেী অনুভব করে না। তাদের নিজেদের জীবন। বাঁচানাের কসরতেই তারা এখন গলদঘর্ম। যাবার আগে রাজাকারটি আমার সাথে কথা বলতে চাইলাে এবং যথারীতি তাকে সেই অনুমতিও দেয়া হলাে। দুকদম এগিয়ে এসে সে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাে যে আমি মুক্তিবাহিনীর কোনাে অফিসার কি না। আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই সহসা ব্যাকুল হয়ে উঠলাে তার কণ্ঠস্বর। বললাে, আমারে মাফ কইরা দেওন যায় না স্যার? আমি মাথা নাড়ালাম, সম্ভব না। আমার যে দুইডা আবুইদ্যা আছিলাে সার। তাগােরে কে দেখবাে? তার কণ্ঠ ধরে এলাে এবার। বললাম, আজকের এই বাংলাদেশে তােমার আবুইদ্যাদের মতাে অসংখ্য আবুইদ্যা আছে যাদের বাবা-মা আত্মীয় পরিজন নেই। এই অসহায় এতিম আবুইদ্যারা তােমাদেরই গণহত্যার ফল স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের মতাে করেই বেঁচে থাকবে তােমার আবুইদ্যারাও। এদের ব্যাপারে চিন্তা করার এখন আর কোনাে সময় নেই তােমার খুব বিনয়ী হয়ে উঠলাে এবার রাজাকারটি। স্যার, আমার আবুইদ্যা দুইডারে আফনেই দেইবেন। সম্ভব হবে না। আমি সরাসরি তাকে জানিয়ে দিলাম। এরপর নিরেট নির্বোধের মতাে অর্থহীন দৃষ্টি মেলে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাে আমার। দিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হবার পরও নির্বিকার যে মানুষটি হাতের আঙ্গুলে তুড়ি মেরে অনর্গল কথা বলে গেছে সেই একই মানুষ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাবধানেই এখন নির্বাক, ভাষাহীন। রাইফেলের বাট দিয়ে ধাক্কিয়ে রাজাকারটিকে নিয়ে গেলাে দু’জন সৈনিক। এরপর আমাদের। অবস্থানের খানিকটা পেছনে পর পর দুবার গুলীর শব্দ হলাে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় মাকন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের নির্দেশ ১০ ডিসেম্বর। দেয়া হলেও রণাঙ্গনে সেই খবর আমাদের কাছে এসে পেীছে ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে। বময় এক তরুণ ভারতীয় সেনা অফিসার, যিনি আশুগঞ্জে গােলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, আমার কোম্পানী অবস্থানে এসে প্রসঙ্গক্রমে মার্কিন উদ্যোগের কথা জানালেন। এ সময় মেজর ভূইয়াও সেখানে ছিলেন এবং আমরা বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়েই আলােচনা করছিলাম। খবরটি শােনার পর ভূইয়ার স্বভাবসিদ্ধ হাসিখুশী ভরা মুখটিতে সহসাই উদ্বেগের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠলাে।
অস্বস্তিবােধ আমাকেও পেয়ে বসলাে। আগের বিষয়গুলাে নিয়ে আলাপ আর এগুলাে না! কিছুক্ষণ পরই মেজর মতিন দ্বিতীয়বারের মতাে আমাদের অবস্থানে এলেন। তিনি অবশ্য আগেভাগেই আমার অবস্থান পরিদর্শনে তার আগমনের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। মতিনকেও বেশ চিন্তিত মনে হলাে। অনুমান করলাম, সপ্তম নৌবহরের আগমনের খবরটি সবতঃ তিনিও পেয়েছেন। কিন্তু তার সাথে বিস্তারিত কোনাে কথা বলার সুযােগ পাওয়া গেলাে না। তার আগেই আমাদের অবস্থানের ওপর পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। আমরা তিন জন তড়িঘড়ি করে নিকটবর্তী দুটো ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিলাম। বিক্ষিপ্ত এই গােলাবর্ষণ প্রায় এক ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হলাে। সন্ধ্যা নেমে আসার পর পরই স্তমিত হয়ে আসে গােলার শব্দ। আশুগঞ্জে সম্ভবতঃ এই প্রথমবার ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণের প্রত্যুত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকলাে। এই নীরবতার অবশ্য একটি কারণও ছিলাে। আমাদেরকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিলাে যে সেদিন দুপুরের পর থেকে ভারতীয় গােলন্দাজ সমর্থন তেমন একটা পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র দু’টি মাঝারি ৫৫ ইঞ্চি কামান এপাড়ে তালশহরে রেখে। ভারতীয় ৫৭ ডিভিশন সেদিন দ্বিপ্রহরের মধ্যেই তাদের গােলন্দাজ ইউনিটসমূহ ঢাকার পথে মেঘনার পশ্চিম পাড়ে স্থানান্তর সমাপ্ত করেছে। সপ্তম নৌবহরের খবর পাবার পর সেই দুঃসময়ে কর্ণেল সফিউল্লাহর অনুপস্থিতিতে আমরা খুব অসহায় বােধ করছিলাম। সফিউল্লাহ তখন ২ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ঢাকার পথে সস্তবতঃ শীতলক্ষ্যার কাছাকাছি কোথাও গিয়ে পেীছেছেন। মার্কিন উদ্যোগের বিষয়টি মেজর মতিনই তুললেন। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বলয়ে এর সম্ভাব্য পরিণাম কি হতে পারে সে প্রসঙ্গে তার অভিমত ব্যক্ত করলেন। এ সময় আমাদের ধারণা হলাে পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে অবরুদ্ধ পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে। এই পরিস্থিতিতে ভৈরবে আটকে পড়া এবং এখনাে আংশিক অক্ষত পাকিস্তানের ২৭ পদাতিক বিগ্রেড অবরােধ ভেঙ্গে হয় ঢাকার সাথে সংযােগ স্থাপনে সচেষ্ট হবে, নয়তাে আবার মেঘনা অতিক্রম করে তাদের আগের অবস্থানে ফিরে আসার দুঃসাহস দেখাবে। মেঘনা অতিক্রম করলে তাদের সেই পদক্ষেপের সম্ভাব্য লক্ষ্য হবে পূর্ব পাড়ে ময়নামতি দুর্গের সঙ্গে পুনরায় সংযােগ স্থাপন, যার মাধ্যমে অন্ততঃ দুটি প্রবেশদ্বার অর্থাৎ দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। মতিন এরপর ভূইয়া এবং আমাকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যার পর পরই আমার কোম্পানীর প্রতিরক্ষা ব্যুহকে নতুন করে সাজানাের কাজ শুরু হলাে এর ফলে যে বাড়তি সুবিধার সৃষ্টি হলাে তা হচ্ছে উত্তরে মেঘনা তটরেখায় বিস্তীর্ণ। এলাকার ওপর আমার পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে উঠলাে এটা সুস্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হলাে যে পাকিস্তান বাহিনী কথিত সপ্তম নৌবহরের তাড়না নিয়ে মেঘনা অতিক্রম করে হারানাে অবস্থান পুনরুদ্ধারে অবতীর্ণ হলে তাদেরকে প্রথমে আমাদের অবরােধ ভাঙ্গতে হবে। আমাদের পর্যন্ত করে তবেই তাদের এগিয়ে যেতে হবে দক্ষিণে। এই অনুমান নির্ভর করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উত্তর দিকের নিরাপত্তা দেয়াল সংলগ্ন পাকিস্তানীদের পরিত্যাক্ত বাংকারগুলােকে আবার উপযােগী করে তােলা হলাে। সেগুলােতে বেশী সংখ্যায় কোম্পানীর ভারী ও হালকা মেশিনগান বসানাে হলাে। কিছু কিছু বাংকার ও ট্রেঞ্চ থেকে পাকিস্তানীদের মৃতদেহ সরিয়ে সেগুলােও সক্রিয় করে তােলার মধ্যদিয়ে এভাবেই ‘ডি’ কোম্পানীর দ্বিতীয় দফার পুনর্বিন্যাস সম্পন্ন হলাে। পাকিস্তানীদের নতুন আক্রমণের সম্ভাবনার দোদুল্যমানতার মাঝে মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক আগেই। গত রাতের মতােই উত্তরা হিমেল হাওয়া বইছে সর্বত্র। আর সে কারণেই হয়তাে তেমন একটা কুয়াশা নেই নিসর্গে। সমগ্র রণাঙ্গনে বিরাজ করছে:লিস্তবতা। হুদা কুড়িয়ে পাওয়া একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে অবস্থান পরিদর্শনে ব্যস্ত সুবেদার তেয়বকে উত্তরদিককার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মেশিনগানবাহী দল এখন তার নেতৃত্বে। ক্লান্ত সৈনিকদের। জাগিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় মাঝেমধ্যে তার খবরদারী চিৎকার অশনি সংকেতের মতাে ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র।
নিজের ট্রঞ্চে ফিরে এসে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। আমিন ট্রেঞ্চের মধ্যে কিছু খড় বিছিয়ে তা ইতিমধ্যেই বেশ আরামদায়ক করে তুলেছে। কিন্তু তারপরও এমন একটি গর্তের ভিতরে ঘুমানাে আমার জন্যে খুবই অস্বস্তিকর ঠেকলাে। ট্রেঞ্চের ভেতর কাঁচামাটির গন্ধ নাকে লাগে। যুদ্ধকালীন সময়ে সেখানে আশ্রয় নেয়া সহজ হলেও কেনাে যেনাে শবাধারের মতাে এই ট্রঞ্চে শুয়ে ঘুমানাে যায় না কৈশােরে একবার এক মৃত প্রতিবেশীকে কবর দেয়ার দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ট্রেঞ্চের মধ্যে ঘুমাতে গেলেই ওই দৃশ্যটি আমার মনে পড়ে যায়। মস্তিষ্ক থেকে এই অসার উপলব্ধিকে আমি কিছুতেই সরাতে পারি না। জেগে থেকে মৃত্যুর উপলব্ধি কেইবা ভালােবাসে। যদিও যুদ্ধ নিয়তঃ মৃত্যুরই একটি নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া। অযাচিতভাবে অন্যরকম এক অস্বস্তিবােধ আমাকে পেয়ে বসেছে। মৃত্যু নয়, এখন সপ্তম নৌবহরই যেনাে আমার এই অস্বস্তির কারণ। সেই নতুন আতংক বারবার ঘুরে ফিরে ভিড় জমাচ্ছে কল্পনাতে। স্বাধীনতা কি এখনাে বহুদূরে? স্বাধীনতার মূল্য বাঙালী জাতি কি এখনাে দেয়নি? আবারাে কি মার্কিনীরা ভিয়েতনামের ১৫ বছর চাপিয়ে দেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে? জীবনটা কি তাহলে যুদ্ধে যুদ্ধেই কেটে যাবে? নিজের কাছে এই রকম অজস্র প্রশ্ন। এখনাে সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত। তার ওপর আবার মার্কিন হস্তক্ষেপের আতংক আরও দীর্ঘায়িত করে তুলেছে এই অনিশ্চয়তাকে অনিশ্চয়তা শুধু আমাকে ঘিরেই নয়, অনিশ্চয়তার এই শখলে আবদ্ধ আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী। আজানের ধ্বনিতে চমকে উঠলাম অনেকদিন পর আজান শুনছি। যুদ্ধ স্তমিত হয়ে আসায় মােয়াজ্জিন ফিরে এসেছে মসজিদে। ভােরের আজানের সাথে কি রকম ভিন্ন প্রকৃতির এক আবেদন জড়িয়ে আছে যেননা। মনে হয় এ আজানের ধ্বনি বহুদূর থেকে আসা এক অজানা বার্তার আহ্বান শােনায়। সুবেদার তৈয়ব খুড়িয়ে খুড়িয়ে এসে রিপাের্ট দিয়ে গেলাে যে কোম্পানী ঠিকঠাক। অর্থাৎ সবকিছু বহাল তবিয়তেই আছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচলিত এই কথাটির ব্যবহার আমাদের মধ্যে এখনাে চলছে। সুবেদার তৈয়ব এতােক্ষণে সম্ববতঃ দাড়িয়ে পড়েছে নামাজে। আমিনের নামাজ পড়া হয়তাে এরই মধ্যে শেষ হয়েছে আমিন আবার নামাজের ব্যাপারে বেশ চটপটে। নামাজের সময় হলে যেখানে যে অবস্থায়ই সে থাকুক না কেনাে, সাথে সাথে নামাজ পড়ে ফেলা তার অভােস।
তার ধারণা যুদ্ধের সময় নামাজের জন্যে ওজুর প্রয়ােজন হয় না এবং নামাজের একাংশ ফরটুকু পড়ে ফেললেই যথেষ্ট। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাকে নামাজ পড়াবার জন্যে সে বেশ সচেষ্ট ছিলাে। কিন্তু চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর পর তার সেই প্রচেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে সে। আমিনের মধ্যে এমন একা বিশ্বাস রয়েছে যে নামাজ যুদ্ধাহত ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব করতে পারে। তার ধারণা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অনুকম্পা চাইলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে বান্দাকে রেহাই দেন এবং তার বর আজাবও মাফ হয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর। শীতের সকাল। কুয়াশা নেই একেবারেই। চারদিকে ঝলমলে রােদ। ভৈরবে এখনাে ভারতীয়দের ভােরের বিমান আক্রমণ শুরু হয়নি। এটা একটা ব্যতিক্রম। আমিন যে বিগলিতভাবে এক মগ গরম লাল চা নিয়ে হাজির। এমন একটি ভাব যেনাে অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে সে। তবে ঘটনাটি নিঃসন্দেহে চমক লাগাবার মতােই। | আমার শেষ চা খাওয়া হয়েছিলাে সেই ৫ ডিসেম্বর ভােরে অর্থাৎ ৯ দিন আগে। তারপর থেকে চায়ের মুখ আর দেখিনি। উপরন্তু এই জনমানবহীন রণাঙ্গনে চারের আয়ােজন করা কম। কষ্টের ব্যাপার নয়। | অনুমান করলাম এলাকার কোনাে পরিত্যাক্ত বাড়ীতে এই চা তৈরী পর্ব সমাধা হয়েছে। আমিনকে এ ব্যাপারে তিরস্কার করে লাভ নেই। এ নিয়ে কিছু বললে সে তার গতানুগতিক। যুক্তি খাড়া করবে, যুদ্ধে সবই জায়েজ স্যার। অর্থাৎ তার মতে যুদ্ধে ভালােমন্দ বলে কিছু নেই। প্রয়ােজনের তাগিদে সব কিছুই সেখানে বৈধ। আমিনের সাথে এ ব্যাপারে তর্ক করা বৃথা। সে তার যুক্তিতে সব সময়ই অনড়। তবে আমিন আমাকে আশ্বস্ত করে বললাে, যে। বাড়ীতে চা বানানাে হয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে একটি চিরকুট লিখে রাখা হয়েছে। কাজেই তার ভাষায় এ নিয়ে আর চিন্তার কোনাে কারণ নেই। সকাল ৮টার দিকে ৪টি এস ইউ ৭ বােমারু বিমান যেনাে কিছুটা ক্লান্ত ভাব নিয়ে ভৈরবের। আকাশে উদয় হলাে। খানিক সময় এলােমেলােভাবে উড়ে দু’টি বিমান বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে রকেট নিক্ষপ করলাে। বহরের অপর দুটি বিমান এরপর খুব নিচু দিয়ে উড়ে এসে রেলস্টেশন এলাকায় আবারাে নাপাম বােমার আঘাত হানলাে।
কিন্তু পাকিস্তানীদের বিমান বিধ্বংসী কোনাে তৎপরতা আজ দেখা গেলাে না। এর কিছুক্ষণ পর ভারতীয় একটি পরিবহণ বিমান দেখা গেলাে ভৈরবের আকাশে। খুব। উচুতে উড়ে সেটি লিফলেট ফেললাে ভৈরবে তারপর পূর্ব দিকে ফিরে গেলাে আবার। এই লিফলেটগুলাে পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য করে লেখা ভারতীয় সেনা প্রধান মানেকশ’র বার্তা। এতে অবিলম্বে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। বেশ কিছু লিফলেট বাতাসে ভাসতে ভাসতে নদীর এপারে আমাদের অবস্থানেও এসে পড়ে। | বেলা আনুমানিক ১০টা থেকে আমরা মর্টারের সাহায্যে ভৈরবে আবারও গােলবর্ষণ শুরু করলাম। ভারতীয় বিমান হামলার বিরুদ্ধে নিপ থাকলেও আমাদের গােলবর্ষণের জবাবে পাকিস্তানীরা ঠিকই তৎপর হয়ে উঠলাে। মুহুর্মুহু পাল্টা গােলাবর্ষণ করে তারা জানান দিলাে যে ওপারে তাদের শক্তি অটুট রয়েছে। ভারতীয় মাঝারী কামান দু’টিও আমাদের সমর্থনে এবার সচল হয়ে উঠলাে পেছন থেকে। আর সেই সাথে ভৈরব-আশুগঞ্জ রণাঙ্গন আবারাে সরব হয়ে উঠলাে গােলাগুলির শব্দে। এ সময় পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণ উপেক্ষা করে দুজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা আমাদের অবস্থানে এসে হাজির হলেন। এদের একজন ব্রিগেডিয়ার এবং অপরজন কর্ণেল। তারা দুজনই ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের স্টাফ অফিসার। এই কর্মকর্তারা আমার প্রতিরক্ষাব্যুহের খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন। কথাবার্তায় তাদের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠার ভাব লক্ষ্য করা গেলাে। তাদের দু’জনারই অনুমান যে আমরা মার্কিন নৌবহরের আগমন সম্বন্ধে অবহিত হয়েছি। কথা প্রসঙ্গে তারা আমাদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে বললেন, এই সেক্টরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ পরিচালনার বিন্দুমাত্র শক্তি বা অবস্থা আর অবশিষ্ট নেই। তবুও মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের প্রেক্ষিতে এবং পরিবর্তীত এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানীরা হয়তাে মেঘনার পূর্ব পারে নতুন আক্রমণে সচেষ্ট হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কি সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে গিয়ে তারা বললেন, সে অবস্থায় আপনাদেরকে বিচলনে ক্ষিপ্রতা এনে মেঘনার তটরেখা বরাবর তাদের প্রতিহত করতে হবে।
সম্ভাব্য এই যুদ্ধে আপনারা ভারতীয় সংরক্ষিত বাহিনীর সহায়তা পাবেন। ভৈরবে শত্রুবাহিনী সম্বন্ধে কর্মকর্তারা যে ধারণা দেন তাতে এটাই অনুমিত হয় যে সেখানে সবসাকুল্যে পাকিস্তানীদের নিয়মিত বাহিনীর এক ব্রিগেড পরিমাণ শক্তি তখনাে অবশিষ্ট রয়েছে। তবে সহায়ক সব শক্তি থেকেই তারা বঞ্চিত এই যা সান্ত্বনা। ভারতীয়দের বিমান আক্রমণের ফলে তাদের রসদের সিংহভাগ ইতিমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এমন কি তাদের গােলন্দাজ বহরও সমর্থন যােগাবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সব শেষে তারা দু’জনই এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে সপ্তম নৌবহর যুদ্ধ সীমানায় পৌছার আগেই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়ে যাবে এবং সেই অবস্থায় ভারতীয় ও বাংলাদেশের জনগণ প্রয়ােজনে যৌথভাবে উদ্ভুত চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায় এগিয়ে যাবে। ভারতীয় সেনা অফিসারদের কথাগুলাে ছিলাে সৈনিক সুলভ দৃঢ়তায় ভরপুর। বিশেষ করে তাদের বলার প্রত্যয়ি ভাবটি স্বভাবতঃই সাহস জোগায়। | আমি নিজে সাংঘাতিক রকম সাহসী কোনাে যােদ্ধা নই। কিন্তু তারপরও লাগাতার যুদ্ধের এই প্রক্রিয়া এখন আমাকে এমন এক স্থানে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে যেখানে পিছু হটার যেমন কোনাে সুযােগ নেই তেমনি নেই নিজের ভেতরে কোনাে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়ার অবকাশ। ফলে সাহসী হয়ে ওঠা ছাড়া এবং যে কোনাে পরিস্থিতি নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া ছাড়া এ অবস্থায় আমার সামনে আর কোনাে বিকল্প নেই। সে কারণে আমি এখন পরিস্থিতির যে কোনাে পরিবর্তন মেনে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। এই যুদ্ধ যতাে দীর্ঘায়িতই হােক, এমনকি মার্কিন হস্তক্ষেপের নিশ্চয়তার মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলেও আমাকে লড়তে হবে। প্রয়ােজনে ইন্দোচীনের মতাে দশকব্যাপী যুদ্ধ চালিয়ে যেতেও আমি তখন দৃঢ় সংকল্প।
আমার সাথে বাক্য বিনিময় শেষ হলে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা ব্যাটালিয়নের দক্ষিণ ভাগ। পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সেদিকে প্রস্থান করলেন। আমাদের মর্টারের গােলাবর্ষণ মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে তখনাে অব্যাহত রয়েছে। একই সাথে ভারতীয়দের কামানও সচল। এর মধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আরও দুটি দল এসে ভৈরবে বােমাবর্ষণ ও রকেট হামলা চালিয়ে গেলাে। এর বিপরীতে পাকিস্তানীদের গােলা নিক্ষেপও সমানে চলছে আমাদের লক্ষ্য করে। এ সময় পাকিস্তানী সৈনিকদের গলিত লাশের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। উত্তরা বাতাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে এবং সেই সাথে সুর্যের প্রখরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিপাবিক অবস্থা আমাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার প্রণে হুমকি হয়ে উঠেছে। লাগাতার অনাহারের ফলে এমনিতেই অবস্থা শােচনীয়। এ অবস্থায় গলিত মানুষের গন্ধ একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠলাে। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম বিশাল আকারের শিয়ালগুলাে যুদ্ধের গােলাগুলির মধ্যেও তাদের গর্ত ছেড়ে প্রকাশ্যে মৃত পাকিস্তানীদের নিথর শরীর নিয়ে টানা হেঁচড়ায় মেতে উঠেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে ফারনেস তেলের কয়েকটি ড্রাম স্তুপাকারে পড়েছিলাে। বাতাস থেকে লাশের গন্ধ তাড়াবার জন্যে সেগুলাে আমাদের ভাঙ্গতে হলাে। তারপর লাশগুলো কোনাে রকমে ঠেলেঠুলে একত্রিত করে তাতে ফারনেস তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হলাে। বুভুক্ষু শেয়ালেরা তাদের মুখের খাবার এভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখে ব্যাথ হচ্ছিলাে অদূরে দাড়িয়ে।
১৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরের আগেই ঢাকা অবরােধ কার্যকরী করার লক্ষ্যে ৬টি পূর্ণাঙ্গ এবং অপর ২টি আংশিক ভারতীয় ব্রিগেড চারদিক থেকে খানিকটা বৃত্তাকারে অগ্রসর হয়ে ক্রমান্বয়ে ঢাকার দিকে সংকুচিত হতে থাকে এ ছাড়াও সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দেড় ব্যাটালিয়ন পরিমাণ সৈন্যের একটি দলও পূর্ব দিকে ঢাকার উপকণ্ঠে পেীছে গেছে তখন। বিচ্ছিন্নভাবে আরও দু থেকে তিন হাজার গেরিলা মুক্তিযােদ্ধার কেন্দ্রীভবনও ঘটেছে ঢাকার চারপাশে। এর বিপরীতে যুদ্ধরত পাকিস্তানীদের ৫টি ডিভিশনের সবগুলােই হয় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে নয়তাে তাদের অস্তিত্বও এখন বিলুপ্তপ্রায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে ৯ পদাতিক ডিভিশনের একাংশ ৫৭ ব্রিগেড তাদের বিস্তীর্ণ এলাকা ছেড়ে দিয়ে উত্তরে পদ অতিক্রম করে গেছে। এই ডিভিশনের দ্বিতীয় অংশ ১০৭ ব্রিগেড খুলনা শহরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ওদিকে ডিভিশন অধিনায়ক আনসারী দু ব্যাটালিয়ন পরিমাণ সৈন্য নিয়ে মধুমতির পূর্ব পারে অবস্থান নিয়েছে। উত্তরে ১৬ পদাতিক ডিভিশন ত্রিধায় বিভক্ত হয়ে শহরকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর ২০৫ ব্রিগেড বগুড়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছে এবং অপর ২৩ ব্রিগেড় বিচ্ছিন্নভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনাজপুর, সৈয়দপুর ও রংপুরে ডিভিশনের শেষ ব্রিগেড ৩৪ পদাতিক নওগাঁ ও নাটোরের সম্মুখ অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সদ্য নিয়ােজিত ভারতীয় ১৬৫ ব্রিগেড প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করেছে সেখানে। ডিভিশন সদর দপ্তর নিয়ে অধিনায়ক নজর হুসেন শাহ ইতিমধ্যে নাটোর রাজবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন রাজবাড়ীর মনােরম পরিবেশে তখন তার সময় কাটছে ব্যক্তিগত আরাম আয়েশের ব্যস্ততার মধ্যেই। পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে ১৪ পদাতিকের অবস্থা আরও শােচনীয়। দু’ভাগ করে ফেলা হয়েছে এ ডিভিশনটিকে বহু আগেই। ডিভিশনের সদর দপ্তরসহ ২৭ ব্রিগেড ভৈরবে অবরুদ্ধ রয়েছে এবং অপর অংশ ৩১৩ ও ২০২ ব্রিগেড সিলেট শহরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন এই দু’অংশের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান ৩০০ কিলােমিটারেরও বেশী জেনারেল রহিম পরিচালিত ৩৯ এডহক ডিভিশন বস্তুতঃ ১০ ডিসেম্বর থেকেই অস্তিত্বহীন। সেদিনই রহিম চাদপুর ছেড়ে সদলবলে ঢাকায় পালিয়ে আসেন এর অধিনস্ত ৫৩ ব্রিগেডের একটি ক্ষুদ্র অংশ ময়নামতিতে ১১৭ ব্রিগেডের সাথে সংযুক্তি ঘটাতে সক্ষম হলেও ময়নামতি দুর্গও তখন অবরুদ্ধ ভারতীয় ৬১ ব্রিগেডের একাংশ ও ১৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড ময়নামতিকে কার্যকরভাবেই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ডিভিশনের অবশিষ্টাংশ চট্টগ্রামে নিয়ােজিত ৯১ ও ৯৭ ব্রিগেডের অবস্থাও তথৈবচ। ব্রিগেড দুটির অধিনস্ত সেনা ইউনিটগুলাে তাদের নেয়া বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থান একের পর এক ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে এসে জড়াে হয়েছে।
জেনারেল জামসেদ পরিচালিত ৩৬ এডহক ডিভিশনের একমাত্র নিয়মিত সেনা ফরমেশন ৯৩ ব্রিগেডও এখন ঢাকার পথে পিছু হটছে। উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকা ছেড়ে ১৩ ব্রিগেড সরে এসেছে কালিয়াকৈরে তুরাগ নদীর পাড় পর্যন্ত। সর্বত্রই যুদ্ধবিহীন এক দী পশ্চাদপসরণ। বিনাযুদ্ধে পিছু হটতে হটতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পাকিস্তানের তথাকথিত দুধষ সনারা। ১৪ ডিসেম্বর ভােরে কালিয়াকৈরে কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই ভারতীয়দের কাছে সালে ধরা পড়েন ব্রিগেড অধিনায়ক কাদের। তিনি যেখানে ধরা পড়েন তার মাত্র কয়েক ” গজ দূরেই ছিলাে ৩৩ পাঞ্জাবের সম্মুখ ভাগের প্রতিরক্ষাব্যুহ। দীর্ঘ পথ অতিক্রমণে। ব্রিগেডিয়ার কাদেরের দল এতােটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে অতঃপর আগ বাড়াবার কোনাে শক্তিই তাদের আর অবশিষ্ট ছিলাে না। তবে এই একটি মাত্র সেক্টরেই পাকিস্তানী সমর কর্মকর্তারা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্যে প্রয়ােজনীয় কিছু দক্ষ জনবল পেলাে। ময়মনসিংহ থেকে ৩৩ পাঞ্জাব মােটামুটি অক্ষতই ঢাকার প্রান্তসীমায় ফিরে এলাে। আংশিক অক্ষত ৩১ বালুচ এই প্রক্রিয়ায় ঢাকার দিকে ফিরে আসতে সক্ষম হলেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতাে কোনাে অবস্থাই তাদের আর থাকলাে না। এই অক্ষে ৩৩ পাঞ্জাব আগেভাগেই মির্জাপুরে একটি প্লাটুন আকারের হালকা বিলম্বিকরণ অবস্থান গড়ে তােলে দ্বিতীয় পর্যায়ে দু’টি কোম্পানী আয়তন বাহিনী দিয়ে কালিয়াকৈরে তুরাগ নদী বরাবর অপর একটি শক্ত প্রতিরােধ অবস্থান তৈরী করে তারা। এর সােজা পূর্বে জয়দেবপুর চৌরাস্তা বরাবর তারা তাদের মূল প্রতিরােধ ঘাটি গড়ে তােলে। সেখানে ৩৩ পাঞ্জাবের অবশিষ্ট দু’কোম্পানী সৈন্যের সাথে ৩১ বালুচের একটি কোম্পানী আকারের বাহিনীরও সমাবেশ ঘটানাে হয় এদের সমর্থনে দেয়া হয় গােটা চারেক সেফী ট্যাংক ও কয়েকটি কামান। একই সাথে আরও একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলা হয় টঙ্গীতে। অথচ দুর্বোধ্য কারণেই পশ্চিম থেকে ঢাকা প্রবেশের দ্বিতীয় সড়কটি অর্থাৎ কালিয়াকৈর-সাভারমিরপুর অক্ষকে এক অর্থে সম্পূর্ণ অরক্ষিতই রাখা হলাে। এই অক্ষ বরাবর আনুমানিক দু’কোম্পানী পরিমাণ রেঞ্জারস্-রাজাকার সংমিশ্রিত একটি দুর্বল বাহিনী একাধিক বিলম্বিকরণ অবস্থান গড়ে তােলে। তবে মিরপুর সেতুর ঢাকা অংশে একটি শক্ত প্রতিরােধ ব্যবস্থার সৃষ্টি করে পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর কিছু সেনা। ১০১ কমিউনিকেশন জোনের সম্মিলিত বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর ভােরেই কালিয়াকৈরে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
এর আগে মির্জাপুরে পাকিস্তানীদের প্রাদুন আকারের প্রতিরােধ অনায়াসেই উচ্ছেদ করা হয়। তুরাগ নদী অতিক্রমণে সচেষ্ট হবার সময় জেনারেল নাগরার বাহিনী দৈবাৎ কালিয়াকৈরের সাথে সাভারের সংযােগ সড়কটি আবিষ্কারে সমর্থ হয়। ফলে ঢাকা অভিযানের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার চুড়ান্ত পর্যায়ে এক নতুন মাত্রা ধু করলাে ভারতীয়দের জন্যে। নাগরা বিন্দুমাত্র সময় ক্ষেপণ না করে তখনই এফ জে ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিংকে একটি পদাতিক এবং অপর একটি কমাণ্ডে ব্যাটালিয়ন (২ প্যারা ব্যাটলিয়ন) সমভিব্যাহারে সাভার হয়ে মিরপুরের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। আতার দায়িত্ব হিসেবে পশ্চাদ্ভাগ সুরক্ষিত রাখার প্রয়ােজনে নয়ারহাটে একটি সড়ক প্রতিবন্ধকতা স্থাপনেরও নির্দেশ দেয়া হলাে সন্ত সিংকে। সস্থ সি তেমন কোনাে বিড়ম্বনা ছাড়াই ১৫/১৬ ডিসেম্বর রাত ২টায় মিরপুর সেতুতে পাকিস্তানী সমাবেশের সংস্পর্শে এসে যান। এখানে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ভারতারনা পাকিস্তানীদের সেতু উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত করে দেয়। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সে দখল নিশ্চিত করা ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব হলাে না। আর তার প্রয়োজনও সম্ভবতঃ তেমন” করা হয়ে ওঠেনি তখন। এখানেও মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে জোরালাে কোনাে প্রচেষ্টা চালানাে হলাে না। এটা ধরেই নেয়া হলাে যে ঢাকার পতনের পর সিলেট দুর্গ নিজ থেকে উদ্যোগী হয়েই আত্মসমর্পণ করবে। উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে বগুড়া দখলের মূল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ১৪ ডিসেম্বর ভাের থেকে। এর আগে ১২ এবং ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শহর থেকে নির্গমনের সকল সড়ক যােগাযােগের ওপর প্রতিবন্ধকতা গড়ে তােলেন অধিনায়ক লছমন সিং। বস্তুতঃ চারদিক থেকে বগুড়া শহরকে ঘিরে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই। | প্রচণ্ড গােলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় দুটি ব্রিগেডের সাহায্যে তিন দিক থেকে লছমন সিং তার আক্রমণের সূচনা করেন। ট্যাংকের সহায়তায় একটি গােখা ব্যাটালিয়ন উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যায়। একই সময় আরও দু’টি ব্যাটালিয়ন শহরের দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আঘাত হানে। এভাবে দুপুরের আগেই শহরের অর্ধেকেরও বেশী এলাকা ভারতীয়দের দখলে এসে যায়। লছমন সিং তার ৩৪০ ব্রিগেডের অধিনায়ক বকসির ওপর সেদিন সন্ধ্যার আগেই বগুড়ার পতন নিশ্চিত করার চাপ অব্যাহত রাখলেন। কেননা তিনি আশংকা করছিলেন যে কোনাে মুহুর্তে ৩৪০ ব্রিগেডের মূল অংশকে ঢাকা পাঠাবার চূড়ান্ত নির্দেশ এসে পৌছবে। সে অবস্থায় শহরকেন্দ্রিক যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে প্রয়ােজনীয় সেনাদলের ঘাটতি সৃষ্টি হবে। অবশ্য ইতিমধ্যেই ৩৪০ ব্রিগেডের একাংশ ফুলছড়ি হয়ে ঢাকার পথে এগিয়ে গেছে। এই অবস্থায় লছমন সিং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসরমান ১৬৫ ব্রিগেডকে বগুড়ার পার্থদেশে অধিকতর চাপ প্রয়ােগের নির্দেশ দিলেন। বগুড়ায় যুদ্ধ শহরময় হাতাহাতি যুদ্ধে পরিণত হলাে। ব্যাপক প্রতিরােধ সত্ত্বেও মিত্রবাহিনী। পাকিস্তানীদেরকে শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় সংকুচিত করে ফেলে। তাদের জোরালাে কোনাে প্রতিরােধই আর অবশিষ্ট থাকলাে না। বিকেল নাগাদ দলে দলে পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ শুরু করে ভারতীয়দের কাছে। বিক্ষিপ্ত ছােটোখাটো প্রতিরােধ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ বগুড়ার পতন নিশ্চিত হলাে বলা যায়। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর বগুড়ার অবশিষ্ট পাকিস্তানী প্রতিরােধও উচ্ছেদ করতে সমর্থ হলাে ভারতীয় বাহিনী।
বগুড়া পতনের প্রেক্ষাপটে লছমন সিং রংপুর অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই লক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর ভােরে আপাততঃ একটি ট্যাংক স্কোয়াড্রনের সহায়তা নিয়ে শর্মার ৬৬ ব্রিগেডকে মিঠাপুকুরের দিকে ধাবিত করলেন। দুপুর নাগাদ ছােটো ছােটো কয়েকটি সংঘর্ষের পর মিঠাপুকুরের পতন হলাে। লছমন সিং অবশ্য এর আগে রংপুর দখলের জন্যে দুই শলাকা বিশিষ্ট আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শর্মার ৬৬ ব্রিগেড এককভাবেই ১৬ ডিসেম্বর সকালে রংপুরের উপকণ্ঠে পৌছে যায়। | এর আগে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপ রংপুরের উত্তর ভাগের সকল যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ব্রিগেডটির দক্ষিণমুখি বিচলনের কারণে দিনাজপুর, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরের উত্তর ভাগ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ১ মাউন্টেন ব্রিগেড তিস্তার উপরিভাগ দখলে এনে দক্ষিণে রংপুরের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়ােগ করে। ফলে এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ২৩ পদাতিক ব্রিগেড যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকেই মােটামুটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই সেক্টরে এরপর বগুড়া ব্যতীত প্রতিটি শহুবেই পাকিস্তানীরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং অবরুদ্ধভাবে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এর বিপরীতে ৭টি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড নিয়েও ভারতীয়রা তখনাে উত্তরবঙ্গে তাদের পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হলাে না। সব দিক থেকে কোণঠাসা হয়েও পাকিস্তানীরা রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, নাটোর, নওগা প্রভৃতি শহরগুলােতে তাদের দুর্বল অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হলাে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে ডিভিশন অধিনায়ক আনসারী তার বাহিনী নিয়ে মধুমতির পূর্ব পারে গেড়ে বসেছে। ভারতীয় ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক বারার এ অবস্থায় আনসারীর অবস্থানে দু’শলাকা বিশিষ্ট আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬২ মাউন্টেন নদী পাড় হবে উত্তর দিক থেকে। আর ৭ মাউন্টেন দক্ষিণ দিক থেকে। তারপর দু’দিক থেকে সাড়াশি বিচলন ঘটিয়ে তিনি আনসারীকে নিস্ক্রিয় করে দিতে চাইলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর নির্ভুল পথ নির্দেশনায় ১৪/১৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয়রা তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যায় এবং ১৫ ডিসেম্বর ভােরেই আনসারীর চারদিকে অবরােধ কার্যকর করে। বারারের দু’টি ব্রিগেডের সংযােগ স্থাপিত হয় কামারখালী ও মধুখালীর মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের ওপর। অবরােধ আঁচ করতে পেরে আনসারী ফরিদপুরের দিকে সরে আসার চেষ্টা করেন এবং সড়ক অবরােধ ভাঙ্গার লক্ষ্যে একের পর এক আক্রমণ চালান। কিন্তু এই আক্রমণে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনাে সুবিধা আদায় করতে পারলেন না তিনি। এই প্রক্রিয়ায় এরপর নিজের পরিণতি বুঝে নেন আনসারী এবং শেষমেশ ১৬ ডিসেম্বর ভােরে ভারতীয়দের কাছে দলবলসহ নিজেকে সপে দেন। ১৪ ডিসেম্বর নাগাদ পাকিস্তানী কর্ণধারদের এটা সুস্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হলাে যে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে তাদের বাহিনীর সর্বাত্মক পরাজয় অত্যাসন্ন। আর একই সাথে এটাও সম্যক | উপলব্ধি হলাে যে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই বাংলাদেশে তাদের পরাজয় ঠেকাবার জন্যে এগিয়ে আসছে না। এই বাস্তব সত্যটি নিয়াজীর মতাে করে সম্ভবতঃ আর কেউ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়নি সেদিন।। | এদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলাে এই মর্মে একটি খবর দিলাে যে কলকাতা বিমান বন্দরে বহুসংখ্যক ভারতীয় সেনা ঢাকার যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে বিমানে আরােহনের অপেক্ষায় রয়েছে। আসল ঘটনাটি ছিলাে খানিকটা অন্য রকম। ওই সময় ভারতের সমর কর্মকর্তারা বাংলাদেশ রণাঙ্গন থেকে তাদের বেশ কিছু উদ্বৃত্ত সেনা ইউনিট পশ্চিমের রাণাঙ্গনে পাঠাবার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। এই খবরটিই নিয়াজীর কাছে এলাে ভিন্ন অর্থে। খবর শুনে তিনি ভাবলেন ঢাকা দখলের যুদ্ধে ভারত তার সর্বশক্তি নিয়ােগ করবে। ঘটনাটি তার স্নায়ুর চাপ আরও বাড়িয়ে তুললাে। এবার তিনি বাস্তবিকই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার গভর্নর হাউজের ওপর ভারতীয় বিমানের বােমাবর্ষণের পর গভর্ণর ডাঃ মালেক ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ এলাকা বলে কথিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে আশ্রয় নেন। এ অবস্থায় নিয়াজীর ইষ্টার্ণ কমাণ্ড সদর দফতর ছাড়া বাংলদেশে পাকিস্তানের আর কোনাে অস্তিত্বই অবশিষ্ট থাকলাে না।
জেনারেল নিয়াজী তার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তসূচক জবাব চাইলেন। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে প্রেসিডেন্টের জবাব নিয়াজীর হস্তগত হলাে। ইয়াহিয়া যুদ্ধ বন্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে নিয়াজীকে পরামর্শ দিলেন। অর্থাৎ প্রয়ােজনে তাকে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিতও দিলেন ইয়াহিয়া। এরপর নিয়াজী আর সময় ক্ষেপণ করলেন না। সেদিনই সন্ধ্যায় তিনি ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল হারবার্ট স্পিভ্যাককে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে অনুরােধ জানালেন। তার এই অনুরােধের এদিকে তখনাে দিল্লীতে চলছে অপর এক কূটনৈতিক সমঝােতা। এই সমঝোতার দুই পক্ষ হচ্ছে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন। সােভিয়েত উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী কানেতসভ এবং রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারতীয় পক্ষকে এই মর্মে বােঝাতে সক্ষম হলাে যে, বাংলাদেশের সামরিক বিজয় অর্জনের মধ্যেই নয়াদিল্লীর অভিপ্রায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তির ধ্বংস সাধন এ ক্ষেত্রে তেমন কোনাে গুরুত্ব বহন করে না। কেননা পাকিস্তান এ অঞ্চলে এখন আর কোনাে সামরিক শক্তিই নয়। সেদিনই ভারত পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনে তার কোনাে সামরিক অভিলাষ নেই কথাটি সােভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে জনিয়ে দেয়। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও এক ধরনের পরিতৃপ্তি বয়ে আনে এই কারণে যে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও এ যাত্রা কাশ্মীরসহ পাকিস্তানের অস্তিত্ব অটুট রয়ে গেলাে। আগের দিন ১৫ ডিসেম্বরের বিদায়ী সূর্য আমাদের পেছনে দূরের গ্রামগুলের ওপর দিয়ে ভাসমান দিগন্তে আবার উদিত হলাে। সেই একই সকাল ফিরে এলাে রণাঙ্গন জুড়ে। শীতল রৌদ্রের প্রলেপ ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে চারদিকে। আজ ১৬ ডিসেম্বর। ওপারে ঘাড় গুজে থাকা পাকিস্তানীদের নিঃশব্দ অবস্থানের দিকে আজও সকাল থেকেই আমাদের মর্টারের গােলাবর্ষণ আবার শুরু হলাে। কিন্তু এই গােলার জবাবে ভৈরবের দিক থেকে কোনাে সাড়া শব্দই পাওয়া গেলাে না। এক রহস্যজনক নীরবতার আড়ালে আজ চাপা পড়েছে পাকিস্তানী গােলন্দাজদের যুদ্ধোন্মাদনা। | এদিকে মাথার ওপর সূর্য আরও তেঁতে উঠেছে। বিরামহীন গােলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সকাল গড়িয়ে গেলাে। দুপুরের রৌদ্রের হলুদ উত্তাপ এখন চারদিকে। লাগাতার গােলাবর্ষণের কারণে মটারের ব্যারেলগুলাে উত্তাপে তেতে উঠেছে। আশুগঞ্জে আমাদের অবস্থানের পেছন থেকে ভারতীয় কামানগুলােও থেমে থেমে ভৈরবে গােলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। তবে তাদের আজকের এই গােলাবর্ষণে আগের সেই ধারা একেবারেই অনুপস্থিত। দুপুরের দিকে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মেঘনার ওপরে পাকিস্তানীদের অবস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অনেকগুলাে সাদা পতাকা উড়ছে। এই দৃশ্য কিছুক্ষণ প ণের পর বােঝা গেলাে পাকিস্তনীরা অত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তারপরও ভৈরবের ওপর আমাদের গােলার আঘাত বন্ধ হলাে না। সেদিকে মর্টারের গর্জন চলতে থাকলাে আগের মতােই। সহসা খেয়াল হলাে আমাদের পেছনের অবস্থানে ভারতীয়দের কামানগুলাে এরই মধ্যে নিরব হয়ে গেছে। ভৈরবের অকাশেও আর ভারতীয় বিমান দেখা গেলাে না সেদিন। মনে হলাে যেনাে পাকিস্তানীদের সাথে তাদের বিরােধে একটি বােঝাপড়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অনেক সময় অতিবাহিত হলাে। কিন্তু ভারতীয়দের কামান থেকে কিংবা তাদের বিমান থেকে ভৈরবে আর একটি গােলাও নিক্ষিপ্ত হলাে না।
এরপর পরিস্থিতি নাটকীয় পর্যায়ে পৌছলাে যখন রেডিওতে ভারতীয় প্রচার কেন্দ্র পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক নিয়াজির আত্মসমর্পণের কথা সরবে ঘােষণা করলাে। এই এদিকে তখনাে দিল্লীতে চলছে অপর এক কূটনৈতিক সমঝােতা। এই সমঝোতার দুই পক্ষ হচ্ছে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন। সােভিয়েত উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী কানেতসভ এবং রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারতীয় পক্ষকে এই মর্মে বােঝাতে সক্ষম হলাে যে, বাংলাদেশের সামরিক বিজয় অর্জনের মধ্যেই নয়াদিল্লীর অভিপ্রায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তির ধ্বংস সাধন এ ক্ষেত্রে তেমন কোনাে গুরুত্ব বহন করে না। কেননা পাকিস্তান এ অঞ্চলে এখন আর কোনাে সামরিক শক্তিই নয়। সেদিনই ভারত পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনে তার কোনাে সামরিক অভিলাষ নেই কথাটি সােভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে জনিয়ে দেয় বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও এক ধরনের পরিতৃপ্তি বয়ে আনে এই কারণে যে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও এ যাত্রা কাশ্মীরসহ পাকিস্তানের অস্তিত্ব অটুট রয়ে গেলাে। আগের দিন ১৫ ডিসেম্বরের বিদায়ী সূর্য আমাদের পেছনে দূরের গ্রামগুলের ওপর দিয়ে ভাসমান দিগন্তে আবার উদিত হলাে। সেই একই সকাল ফিরে এলাে রণাঙ্গন জুড়ে। শীতল রৌদ্রের প্রলেপ ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে চারদিকে। আজ ১৬ ডিসেম্বর। ওপারে ঘাড় গুজে থাকা পাকিস্তানীদের নিঃশব্দ অবস্থানের দিকে আজও সকাল থেকেই আমাদের মর্টারের গােলাবর্ষণ আবার শুরু হলাে। কিন্তু এই গােলার জবাবে ভৈরবের দিক থেকে কোনাে সাড়া শব্দই পাওয়া গেলাে না। এক রহস্যজনক নীরবতার আড়ালে আজ চাপা পড়েছে পাকিস্তানী গােলন্দাজদের যুদ্ধোন্মাদনা। এদিকে মাথার ওপর সূর্য আরও তেঁতে উঠেছে। বিরামহীন গােলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সকাল গড়িয়ে গেলাে। দুপুরের রৌদ্রের হলুদ উত্তাপ এখন চারদিকে। লাগাতার গােলাবর্ষণের কারণে মটারের ব্যারেলগুলাে উত্তাপে তেতে উঠেছে। আশুগঞ্জে আমাদের অবস্থানের পেছন থেকে ভারতীয় কামানগুলােও থেমে থেমে ভৈরবে গােলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। তবে তাদের আজকের এই গােলাবর্ষণে আগের সেই ধারা একেবারেই অনুপস্থিত।
দুপুরের দিকে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মেঘনার ওপরে পাকিস্তানীদের অবস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অনেকগুলাে সাদা পতাকা উড়ছে এই দৃশ্য কিছুক্ষণ প ণের পর বােঝা গেলাে পাকিস্তনীরা অত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তারপরও ভৈরবের ওপর আমাদের গােলার আঘাত বন্ধ হলাে না। সেদিকে মর্টারের গর্জন চলতে থাকলাে আগের মতােই। সহসা খেয়াল হলাে আমাদের পেছনের অবস্থানে ভারতীয়দের কামানগুলাে এরই মধ্যে নিরব হয়ে গেছে। ভৈরবের অকাশেও আর ভারতীয় বিমান দেখা গেলাে না সেদিন। মনে হলাে যেনাে পাকিস্তানীদের সাথে তাদের বিরােধে একটি বােঝাপড়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অনেক সময় অতিবাহিত হলাে। কিন্তু ভারতীয়দের কামান থেকে কিংবা তাদের বিমান থেকে ভৈরবে আর একটি গােলাও নিক্ষিপ্ত হলাে না। এরপর পরিস্থিতি নাটকীয় পর্যায়ে পৌছলাে যখন রেডিওতে ভারতীয় প্রচার কেন্দ্র পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক নিয়াজির আত্মসমর্পণের কথা সরবে ঘােষণা করলাে। এই ঘােষণায় বলা হলাে পাকিস্তানীরা নিঃশর্ত অস্ত্রসমর্পণে সম্মত হয়েছে এবং বিকেল থেকে। পুরােপুরি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। কিন্তু এই ঘােষণায় পাকিস্তানীরা কাদের কাছে। আত্মসমর্পণ করবে সে ব্যাপারে কিছুই বলা হলাে না। ওই দিনই বাংলাদেশব্যাপী রণাঙ্গনের সর্বত্র পাকিস্তানী অবস্থানগুলাের ওপর ভারতীয়দের সব ধরনের আক্রমণই বন্ধ হয়ে গেলাে। কিন্তু ভৈরব-আশুগঞ্জ আক্রমণ রেখায় আমাদের গােলাবর্ষণ তখনাে চলছে। রেডিওতে পাকিস্তানীদের অত্মসমর্পণের স্বীকারােক্তির কথা শােনার পর আমাদের মর্টার থেকে গােলা নিক্ষেপের পরিমাণ বরং আরও বেড়ে গেলাে। এই শেষ মুহূর্তে আমরা যেনাে হঠাৎ করেই মরিয়া হয়ে উঠলাম অতৃপ্ত আক্রোশে। অনেকটা যেনাে অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যদিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলাে। এই পরিসমাপ্তির মধ্যে উল্লাসের পাশাপাশি এক ধরনের সুপ্ত যন্ত্রণাবােধের উপস্থিতি টের পেলাম নিজের মধ্যে। এতােদিন যুদ্ধের প্রচণ্ডতার ভেতর যে রক্তপাত আর জীবনহানী দেখে শংকিত হয়েছি আজ সেই নৃশংসতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবার খবর শুনেও কম মর্মাহত হলাম না। যে কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরী হবার আলামত টের পাবার পরেও আমাদের মর্টারগুলাে শুরু হলাে না। অবশ্য এটা না হবার অন্য একটি কারণও ছিলাে। আর তা হলাে রণাঙ্গনে কোনাে যুদ্ধবিরতি পালনের ব্যাপারে তখনাে পর্যন্ত আমরা কারাে কাছ থেকেই আনুষ্ঠানিক কোনাে নির্দেশ পাইনি। কাজেই ভারতীয়রা যুদ্ধ বন্ধ করলেও তাদের। কর্তপক্ষের ঘােষণা অনুযায়ী আমাদের অস্ত্র সংবরণের কোনাে কারণ নেই। উপর। সেখানকার পরাজিত পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তাদের। ওপর আমাদের আক্রমণ বহাল রাখাই যুক্তিসঙ্গত। | কিন্তু বাস্তবে ঘটনা গড়ালাে অন্যভাবে। যে কারণে বেতার তরঙ্গে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির খবরটি ভেসে আসার পর আশুগঞ্জ রণাঙ্গনে আমাদের অবস্থানের সর্বত্র একটি হকচকিয়ে যাওয়া ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলাে সবার মধ্যেই। মনে হলাে আকস্মিক এই যুদ্ধবিরতি ঘােষণার ঘটনা কোনাে মুক্তিযােদ্ধাই যুদ্ধ বিজয়ের পরিতৃপ্তির সাথে মেনে নিতে পারছে না। অথচ তখনাে বারুদ আর পচা লাশের গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের উত্তাপ। রৌদ্রোজ্জ্বল শূন্যতায় নিমেঘ দূরের আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে উড়ছে মাংসেভুক শকুনেরা।
মানুষের অগণিত মরদেহ তখনাে ভাসছে মেঘনার জলে! রণাঙ্গনব্যাপী ব্যাংকারে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের শক্ত আঙ্গুল ট্রিগারে চেপে শক্র হননের উন্মাদনায় তখনাে কাতর। সবকিছুই ঠিকঠাক রয়েছে আগের মতােই। এর পাশাপাশি রেডিওতে কোনাে ভারতীয় ঘোষক অনবরত ঘােষণা দিচ্ছে। যুদ্ধবিরতির। এ অবস্থায় প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হলাে আরও বিকেলের দিকে অবশেষে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি প্রদত্ত অস্ত্র সংবরণের নির্দেশ পাওয়া গেলাে। এর পর পরই রণাঙ্গন জুড়ে এক অস্বাভাবিক নিরবতা নেমে এলাে। ভৈরবে তাক করে বসানাে আমাদের মর্টারগুলাে এখন থেকে অসাড় হয়ে গেলাে স্থায়ীভাবে। রণাঙ্গণের সর্বত্র বাংকারে অবস্থান নেয়া সৈনিকরা প্রায় প্রত্যেকেই মাথা উচু করে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওপারে ভৈরবের দিকে। সেখানে শান্তির সাদা পতাকাগুলাে বাতাসে উড়ছে স্বাধীনতার মতােই। মনে হলাে যেনাে অবিরাম যুদ্ধের একটি অক্লান্ত রণাঙ্গন আকস্মিক এক ভূমিধ্বসে মুহূর্তে হারিয়ে গেলাে অদৃশ্যে। যেনাে যুদ্ধের কোনাে পক্ষই এখন আর অবশিষ্ট নেই যুদ্ধক্ষেত্রের কোথাও পরিবর্তীতে এই হঠাৎ পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগলাে অল্পক্ষণের মধ্যেই অবসন্ন এবং অনাহারী শরীর টেনে টেনে ক্লান্ত সৈনিকরা একে একে উঠে আসতে লাগলাে বাংকার ছেড়ে। তাদের কেউ কেউ আবার গােছলের জন্যে মেঘনার পানির দিকে নেমে গেলাে। বহুদিন কারাে শরীর ধােয়া হয়নি। মনেও পড়েনি যে গােছল মানুষের। জন্যে খুব একটা প্রয়ােজনীয় কাজ। লক্ষ্য করলাম সৈনিকদের সবার মধ্যেই কি রকম একটা নির্জীব-নির্বিকার ভাব। কারাে মুখেই তেমন কোনাে কথা নেই। সুস্পষ্ট করে কোনাে জিজ্ঞাসাও নেই অথচ সবারই চোখের দিকে তাকালে একটি অন্তর্গত জিজ্ঞাসার ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বােধ করি তারাও ঠিক মতাে জানে না কি তাদের প্রশ্ন।
রণাঙ্গণে আর সবার মতাে আমিও সহসা নির্জীব হয়ে পড়লাম অস্ত্রবিরতির নির্দেশ পাবার পর। যুদ্ধময় গত জীবনের এই আকস্মিক ফলাফল আমাকে হতবাক করে দিলাে। মুক্তিযুদ্ধের এই রকম পরিসমাপ্তি যেনাে আমি চাইনি। যে আমি অনবরত এবং অনিশ্চিত যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে এতােদিন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির জন্যে ব্যাকুল হয়েছি, সেই আমি আজ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার ঘােষণা শুনে একই রকম ব্যাকুলতা উপলব্ধি করছি নিজের মধ্যে। বােধ করি যুদ্ধ বিজয়ের অতৃপ্তিই আমার মধ্যে এই অন্তর্গত দ্বকে তীব্রতর করে তুলছে। আজ আশুগঞ্জ রণাঙ্গনে প্রতিটি যুক্রান্ত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে যেনাে আমারই হুবহু দ্বমুখর মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। পরস্পর বিরােধী এই দ্বন্দ্ব শুধু আমার একার নয়, আজ প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধাকেই মনে হয় তা সমানভাবে আক্রান্ত করেছে। যুদ্ধের দীর্ঘ এক পথ অতিক্রম শেষে বিজয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে আজ মুক্তিযােদ্ধারা যেনাে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলাে। হঠাৎ করেই তাদের প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেছে মনে হলাে। যুদ্ধ বিজয়ের এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রায় ভারতীয় বাহিনীর নীরব বিচরণ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যুদ্ধজয় থেকে শুরু করে বিজয়ের প্রতিটি স্তরেই একক মালিকানার দাবিদার হয়ে উঠলাে তারা। তাদের মালিকানাসুলভ এই হঠাৎ দৃষ্টিগােচর আচার আচরণ দেখে এটা মনেই। হলাে না যে এই যুদ্ধজয়ের আর কোনাে অংশীদার আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অবাধ এবং একতরফা উপস্থিতির মধ্যে একরকম অস্পৃশ্যই হয়ে পড়লাে যেনাে। মুক্তিযােদ্ধাদের বিপুল অবদান। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জন্যে রণাঙ্গন যারা মসৃণ। করলাে এবং যাদের অন্তনিষ্ঠ সহযােগিতার কারণে এই ঐতিহাসিক বিজয় ত্বরান্বিত হলাে, যুদ্ধের পর আজ বাংলাদেশের কোথাও তারা তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ন্যূনতম প্রতিফলনটুকু পর্যন্ত ঘটাবার সুযােগ পেলাে না। অথচ রণাঙ্গনের মতাে এ বিজয়ের সর্বস্তরে যৌথবাহিনীর যৌথ কর্ম প্রয়াশই বাঞ্ছিত ছিলাে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি গড়িয়ে চললাে একলা এক পথ ধরে, যেখানে যৌথবাহিনীর অন্যতম অংশীদার মুক্তিযােদ্ধার সরব উপস্থিতি নেই কোথাও। অথচ এই মুক্তিযােদ্ধারাই নিতান্ত অসম জেনেও গত ন’মাস ধরে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী পাকিস্তান বাহিনীকে জলে স্থলে সর্বত্র প্রতিরােধ করেছে। আর এই প্রতিরােধ যুদ্ধ চালাতে গিয়ে অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে, বলি হয়েছে প্রতিশােধস্পৃহ পাকিস্তানীদের হাতে। স্বজন-সম্পদ হারিয়েছে এ দেশের আপামর জনগণ এবং দুঃসহ উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছে তারা পরবাসে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণমানুষের এই ত্যাগের দৃশ্যটি যারা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ পর্যন্ত করেনি, মাত্র তিন সপ্তাহের দ্ধের পর সেই মিত্রবাহিনীই আজ স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র তাদের বিচরণ প্রতিষ্ঠা করলাে এককভাবে। এমনকি লাখ লাখ মানুষের হত্যাকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়দায়িত্বটুকু পর্যন্ত তারা তাদেরই হেফাজতে রাখলাে। এর ফলে একজন মুক্তিযােদ্ধা, যে রণাঙ্গন থেকে তার বােন বা স্ত্রীর লাঞ্ছিত হবার কিংবা পিতা বা ভাইয়ের নিহত হবার খবর শুনেছে, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেই মুক্তিযােদ্ধা এই প্রশ্ন নিয়ে কোনাে বন্দী পাকিস্তানীর মুখােমুখি হবার সুযােগটি পর্যন্ত পেলাে না। | তাহলে প্রশ্ন আসে, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে এ যুদ্ধে বিজয়টা কিসের?
ন মাসের ত্যাগ তিতিক্ষিত যুদ্ধের পর একজন মুক্তিযােদ্ধা কোথায় এবং কিভাবে তার বিজয়ের যথার্থতা আবিস্কার করবে? এ অবস্থায় ওই মুক্তিযােদ্ধাকে তার যুদ্ধ জীবনের সমস্ত ত্যাগের ক্ষোভ কি ভুলে থাকতে হবে শুধুমাত্র একখণ্ড পতাকার দিকে তাকিয়ে ? | পাকিস্তানী বাহিনীর বেশুমার হত্যাযজ্ঞের মুখে মুক্তিযুদ্ধের দিশাহীন দুঃসময়ে ভারতীয় বাহিনী যেভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা অবিস্মরণীয় হলেও বিস্ময়কর নয়। বিস্ময়কর নয় এ জন্যেই যে এই ঘটনা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের স্বভাবসিদ্ধ ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের সাথেই সম্পৃক্ত। এর বিপরীতে বলা যায়, বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি নিকট প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক দেশের নীরব থাকার ঘটনাই বরং ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হতাে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সম্পৃক্ত হবার ঘটনা ইতিহাসের একটি অনিবার্য ধারা, যা আমাদের যুদ্ধজয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের সশস্ত্র প্রাক্রয়াকে যুগপৎ ত্বরান্বিত ও সহজতর করেছে। এই দিক থেকে বলা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক যুদ্ধজয় একই সাথে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী—উভয় বাহিনীর সমন্বিত শক্তিকেই বিজয় গৌরবে গৌরবান্বিত করেছে। এখানে বিজয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব নেয়ার অধিকার এককভাবে যেমন কারাে নেই, তেমনি খুব বােধগম্য কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয়দের এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে দুঃখজনক এক উপলব্ধিরই জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিজয়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে এ সত্য মেনে নিতেই হবে যে, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যে বিজয় অর্জিত হলাে তার কৃতিত্ব কারােই একার নয়। এটা বস্তুতঃ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলনে সৃষ্ট যৌথবাহিনীরই সমন্বিত কতিত্ব। ফলে যুদ্ধ বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে যৌথবাহিনীর শরিক ভারতীয় বাহিনী। একক ভাবে তার বিচরণ প্রাতিষ্ঠায় যে নজির স্থাপন করে তা শুধুমাত্র মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যেই নয়, এ দেশের ত্যাগী জনগণের মধ্যে তথা মুক্তবিশ্বে একটি নেতিবাচক হতাশারই ইতিহাস। সৃষ্টি করেছে। এই যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের অবদানকে এভাবে খাটো করে দিয়ে ভারতের মতাে একটি গণতান্ত্রিক দেশ তার জনগণ এবং নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনাকেই প্রকারান্তরে খাটো করেছে।
পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানের আগ পর্যন্ত এককভাবে মুক্তিযােদ্ধারাই বাংলাদেশের সর্বত্র একনাগাড়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এই যুদ্ধের নেপথ্যে ভারতীয়দের সাহায্য সহযােগিতার বিষয়টি অবশ্যই তাদের প্রতি আমাদের কৃত করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের মােট ন’ মাসের ব্যাপ্তির মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধে অংশগ্রহণের মেয়াদ মাত্র তিন সপ্তাহ। এই পটভূমি বিশ্লেষণে এটাই সত্যভাষণ যে, উপমহাদেশীয় ইতিহাসে এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং এখানে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ সামগ্রিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ মাত্র। অর্থাৎ উপমহাদেশীয় ইতিহাসে ৭১ সালের যুদ্ধ যতােটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসসিদ্ধ ততােটা পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে নয়। বাঙালীদের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার এই জাতীয় যুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ভারতের সম্পৃক্ত হবার বিষয়টি ইতিহাসের সেই অনিবার্য ঘটনা যা বিশ্বে যুগে যুগে বহুবারই ঘটেছে। ফলে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মালিকানা সর্বাগ্রে বঙালীদেরই প্রাপ্য ছিলাে এবং এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ভূমিকা হওয়া উচিৎ ছিলাে সহযােগিতার, যেমনটি হয়েছে রণাঙ্গনের সর্বত্র। | এপ্রিলের শেষ দিকে প্রতিরােধ যুদ্ধ সর্বাত্মক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হবার পর সর্বব্যাপী রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা এবং সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অগ্রগামী পাকিস্তানীদের ক্ষত-বিক্ষত করে তােলে। হামলার পর হামলা চালিয়ে তাদের সরবরাহ এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করে দেয়। মুক্তিবাহিনীর এই লাগাতার তৎপরতার ফলে এক পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের বিশাল রণাঙ্গনের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে বাধ্য। হয়। উপরন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা দমাবার জন্যে আড়াই হাজার কিলােমিটার দীর্ঘ। সীমান্তরেখায় তাদের সামগ্রিক সমর শক্তির একটি বড় অংশের বিচলন ঘটাতে হয়। এর ফলে পাকিস্তান বাহিনীতে প্রশাসনিক জটিলতা যেমন সৃষ্টি হয়েছে তেমনি তাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণ ক্ষমতাও হয়েছে খর্ব। রণাঙ্গন জুড়ে এ অচলাবস্থা চলতে থাকার কারণে পাকিস্তানীদের যুদ্ধ ক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। আর ঠিক এই রকম একটি পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনীর সর্বমুখি অভিযানের মুখে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয় পাকিস্তানীরা। বাংলাদেশের রণাঙ্গন জুড়ে মুক্তিবাহিনীর দীর্ঘ ন মাসের ঢালাও অভিযানের পরবর্তী মসৃণ পথ ধরেই এরপর এই রক্তাক্ত রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর প্রবেশ।
চুড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধ শুরু হবার আগ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা ভারতীয়দেরকে পাকিস্তান বাহিনী। সম্পর্কিত যে নির্ভরযােগ্য গােয়েন্দা তথ্যাবলি সরবরাহ করে ওই মুহূর্তে তা ছিলাে মিত্রবাহিনীর জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শত্রুবাহিনীর সঠিক অবস্থান, তাদের অস্ত্রশস্ত্রের বিবরণ এবং প্রতিরক্ষাব্যুহসমূহের যাবতীয় তথ্য মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় আগাম হাতে পাবার কারণে মুখ্যতঃ ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়েছে মাত্র ৮টি ডিভিশনের সাহায্যে পাকিস্তানের ৫টি পদাতিক ডিভিশনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। অথচ প্রচলিত যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী ৫ ডিভিশন শত্রু সৈন্যের বিপরীতে ভারতীয়দের যুদ্ধে মােতায়েন করার কথা অন্ততঃ। ১২ থেকে ১৫ ডিভিশন সৈন্য (আক্রমণের ক্ষেত্রে ১৪৩ প্রচলিত আনুপাতিক হার অনুযায়ী)। অধিকন্তু চূড়ান্ত যুদ্ধে ভারতীয়দের আক্রমণের যুৎসই রূপরেখা নির্ণয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবদান ছিলাে আরও গুরুত্ববহ। মুক্তিবাহিনী এই সংকট সময়ে ভারতীয়দেরকে অনায়াশে এবং নির্ভুলভাবে শত্রুর অবস্থানের ফাঁক দিয়ে সুবিধাজনক নিদিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দিয়েছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। রণনাঙ্গনের সর্বত্রই পথঘাটগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের জানা থাকার কারণে শত্রুর পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান গ্রহণে ভারতীয়রা তাদের সাহায্য নিয়েছে যুদ্ধের প্রতিটি স্তরে এবং এই অনুকূল অবস্থান থেকে শত্রুবাহিনীকে অব্যর্থ হামলার সাহায্যে ঘায়েল করা অনেক সহজ হয়েছে ভারতীয়দের জন্যে। সুতরাং বাংলাদেশে যুদ্ধজয়ে মুক্তিবাহিনীর অবদান খাটো করে দেখার আদৌ কোনাে সুযােগ নেই কোথাও। উপরন্তু গােটা রণাঙ্গনে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হবার পরও অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও মুক্তিবাহিনী সর্বত্র দ্বিগুণ উদ্দীপনায় যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। রণাঙ্গনের এই বাস্তবতা তাে ভারতীয়দের ভুলে যাবার কথা নয়। অথচ যুদ্ধের পর তারা তা। বেমালুম ভুলে গেলাে বিস্ময়করভাবে। রংপুর সেনাছাউনির নিশ্চিত মৃত্যুর গহ্বর থেকে পালিয়ে এসে আশুগঞ্জের এই রণাঙ্গনে যে কারণে এভাবে হঠাৎ করে এই যুদ্ধযাত্রা শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে যুদ্ধের এই শেষটা কেমন যেনাে হিসেবে মিলছে । মুক্তিযুদ্ধ যেনাে ঠিকমতাে শেষ হলাে না। একজন দুর্দান্ত অগ্রগামী সৈনিককে কেউ যেনাে পেছন থেকে সহসা থামিয়ে দিলাে ‘হলটু বলে। যেনাে কি এক অশরীরি শক্তির চাপে বাংলাদেশের গােটা রণাঙ্গন মুহূর্তে তলিয়ে গেলাে নৈঃশব্দে। মনে হলাে একটি দেশের স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের এই ন মাস কোনােক্রমেই যথেষ্ট সময় নয়।
স্বাধীনতার আস্বাদনের যাত্রাপথ কতাে কঠিন তা উপলব্ধির জন্যে এ যুদ্ধের মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত হওয়া খুব প্রয়ােজন ছিলাে। নিজের চৈতন্যের মধ্যে একটি অসম্পূর্ণতাবােধ দারুণ আক্রোশে মাথা কুটে মরছে। এতাে ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে ন’টি মাসের টানা যুদ্ধের পর বিজয়ের যে আস্বাদ তার বহুলাংশই যেনাে অমীমাংসিত থেকে গেলাে। এমন কি পরাজিত পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের গৌরবেও আমরা অভিষিক্ত হতে পারলাম না। বেতার তরঙ্গের ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনী অন্ত্ৰসমর্পণ করবে মিত্রবাহিনী। ভারতীয়দের কাছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ বিজয়ের পুরাে গৌরবটাই যেনাে ভারতীয়দের। যেনাে তাদের বিজয়ের গৌরবেই আমরা গৌরবান্বিত হবাে। রক্তস্রোতবাহী একটি প্রলম্বিত নদী পার হয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম তাও ঠিক আমাদের অর্জিত কোনাে পাওয়া নয়। এ যেনাে অন্য কারাে সােপর্দ করা পাওয়া। একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমার কাছে এই পাওয়ার আবেদন ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে লাগলাে। বুকের ভেতর ম্লান হয়ে আসলাে যুদ্ধ বিজয়ের সমূহ অহংকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতােই অপর এক বিরল ঘটনার জন্ম দিলাে এই যুদ্ধের প্রশ্নবােধক পরিসমাপ্তি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা হিসেবে এর শুরুটা যেমন ইতিবাচক শেষটাও যেনাে একইভাবে নেতিবাচক হয়ে উঠলাে। জাতীয় পর্যায়ের একটি সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ, যা দেশের সর্বস্তরের জনগণের মধ্য থেকে স্ফরিত হয়েছিলাে তার এই অপরিণত পরিসমাপ্তি এবং সেই সমাপ্তির আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের রহসাল অনুপস্থিতি চিরায়ত ইতিহাসে স্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহের ধারাকে বহুলাংশেই যেনাে কলুষত করলাে। তড়িঘড়ি করে একটি বিজয়কে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ভারতীয়দের সুপরিকল্পিত অভিযান এবং অনেকটা যেনাে তার চেয়েও দ্রুত সৃষ্ট প্রতিপক্ষ পাকিস্তানীদের পরাজয় ক্রমেই খুব নাটকীয় করে তুললাে পরিস্থিতিকে। বিষয়টি আমার কাছে খুবই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতার মধ্যে যা কিছুই ঘটছে তার কোনােটাই পরিকল্পনা বাহির্ভূত নয়। বরং সুপরিপক্ক মেধায় প্রণীত একটি অংকের ‘আশা-আকাক্ষা নিরপেক্ষ নিয়মের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশের সমূহ জটিলতার মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে।
আজ এই মুহূর্তে বদির কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আবসার, হাসেমকে। অন্তরাত্মা আর্তনাদ করে উঠছে বারবার। বদির জন্যে ভেতরটা কেবলই কাঁদে। এইতাে মাত্র সেদিন বিস্ময়ভরা চোখে বদি জানতে চেয়েছিলাে কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ ? বদির এই প্রশ্নের কোনাে জবাব তখন আমি দিতে পারিনি। কারণ আমি নিজেও কি জানতাম কবে হবে এই যুদ্ধের শেষ? কবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ মাতৃভূমির মাটিতে নির্ভয়ে বুকটান করে দাঁড়াতে পারবে স্বাধীনতার পতাকা হাতে। জীবিতাবস্থায় বদি তার প্রশ্নের জবাব পায়নি। পাহাড়ের মতাে ভারী এই অমােঘ প্রশ্নটি বুকে নিয়েই সে ছুটে বেড়িয়েছে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে। যুদ্ধের মধ্যদিয়েই বদি একটি যুদ্ধহীন স্বাধীন মাতৃভূমির অভ্যুদয় দেখতে চেয়েছে প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধার মতােই। যুদ্ধের নৃশংসতায় ব্যথিত মুখের বদি তার শাশ্বত সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য অদৃশ্যের মধ্যে। আজ আমি তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছি। এখন থেকে বাংলাদেশের কোথাও আর কোনাে যুদ্ধ নেই। যুদ্ধ আজ শেষ। কিন্তু অদৃশ্য বদিকে যুদ্ধ। শেষের এই কথাটি আমি কেমন করে জানাবাে ?
সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন