দিনভর ৩ নম্বর সেক্টরসলে বিস্তৃত সীমান্ত অশান্ত হয়ে থাকে। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানীদের। মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে রণাঙ্গনের প্রায় সর্বত্রই। দিনভর কামান আর মর্টারের গােলা বিনিময়ও হয় বিক্ষিপ্তভাবে। পাকিস্তানী কামানগুলাে কলকলিয়া ও কৃষ্ণনগর এলাকার বিভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করে এলােপাতাড়ি গোলাবর্ষণ দুপুর অবধি অব্যাহত রাখে। এর কয়েকটি গােলা এসে পড়ে সীমান্তঘেষা শরণার্থী শিবিরগুলাের ওপর। বেশ কিছু প্রাণহানিও ঘটে যায় সেখানে। শিশুসমেত ৪ থেকে ৫ জনের মতাে নিহত হয়। আহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশী। বিকেলের দিকে শক্র ও মুক্তিবাহিনী উভয়ই সম্ভবতঃ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেই সুবাদে ধীরে ধীরে শাস্তুর্ভাব নেমে আসে রণাঙ্গন জুড়ে। ইতিমধ্যে আকাশও স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার পর মেঘ কেটে যাওয়া পরিষ্কার আকাশে চাদ ওঠে। পূর্ণিমার বােধহয় বেশী দেরী নেই। বদি আমার। বস্থানেই থেকে যায় সেদিন আগরতলা আসার পর আমাদের দু’জনের মধ্যে দেখাসাক্ষাত হয় না খুব একটা। সেক্টর সদর দফতরে অবশ্য দু একবার মুখােমুখি হয়েছি। কিন্তু কথাবার্তা বলার সুযােগ বড় একটা। পাইনি কেউই। সেক্টর দফতরে সাধারণতঃ কার্যোপলক্ষেই যাওয়া হয়ে থাকে। সেখানে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সময় কোথায়। স্মিত হাসি কিংবা দু’ একটা সৌজন্য কথাবার্তার মধ্যেই পরস্পর পাশ কাটিয়ে গেছি। রাতে দুটি জঙ্গী টহল দল পাঠানাে হলাে বাংলাদেশের ভেতরে। সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়েছে সীমান্ত বরাবর যদিও তুলনামূলক শান্তই এখন বিস্তৃত রণাঙ্গন। কিন্তু অশান্ত হতে কতােক্ষণ। যে কোনাে মুহূর্তেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে আবার। আমার তাবুতে টিমটিমে হারিকেনের আলােতে ট্রানজিস্টারে কিছু একটা শােনার চেষ্টা করছিলাম, পাশে আমার চৌকিতে বদি আধাে শােয়া অবস্থায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে, সেই কনি থেকে। কোনাে নড়াচড়া নেই। কেনাে যেনাে আজ তাকে একটু বেশী বিষন্ন মনে হচ্ছে। যে কারণে আমিও তাকে ঘাটাতে চাইলাম না। অনেকক্ষণ এভাবে পড়ে থেকে এক সময় কি ভেবে সহসা নড়ে উঠলাে সে। চলুন স্যার, একটু হেটে আসি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বদির কথায় রাজি হয়ে গেলাম। এএমজি কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। কতােক্ষণে আবার শিবিরে ফিরবাে তার তাে কোনাে ঠিক নেই। যে কারণে পাস। ওয়ার্ড’ জেনে নিলাম। পাস ওয়ার্ডের বিশেষ সাংকেতিক শব্দ জানা না থাকলে রাতে শিবিরে ফেরা সমূহ বিপজ্জনক। প্রতিদিনই এই পাস ওয়ার্ড পরিবর্তন হচ্ছে। সীমান্তঘেষা সেই শন বাধানাে উচু জায়গাটিতে গিয়ে বসলাম বদি আর আমি। আমাদের সামনে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের আয়তন জুড়ে এক ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাংলাদেশ। মাথার ওপর শুক্লপক্ষের চাদ। ফুটফুটে জোছনা চারদিকে।
এক পােচ সাদা মেঘও নেই এতাে বড় একটা আকাশের কোথায়ও। নিখুঁত আকাশের নিচে শুন্যে ভাসছে কেবল শীতল বাতাস। এর সাথে যােগ হয়েছে চারপাশের ঝোপঝাড় থেকে আসা বিমানহীন ঝিঝি পােকাদের ডাক। সবকিছু মধ্যে কি এক অমিয় মহুয়া মাদকতা নিয়ে জেগে উঠছে ভেজা মাটির গন্ধ। এখানে এই শানে ওপর জীবনের সব বন্ধ দরজাগুলো যেনাে এক সাথে খুলে গেলাে নিমিষে। পৃথিবীর এই মু ইচ্ছে করলেও বাবার দেখা যায় না। চারদিকে তখন যা কিছুই দেখছি তার সবটাই ভারি সুখকর মনে হচ্ছে। এই সুখানিভূতি মানুষের জীবনে এতাে ক্ষণস্থানীয় হয় কেনাে। বহুদূরে একটি গােলার বিস্ফোরণ শুনতে পেলাম। নিসর্গের ভেতর সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে গেলাে অল্পক্ষণেই যেভাবে মানুষের জীবনে অতীত সুখের অনুভূতি হারিয়ে যায়। বদিও ওই শব্দটি শুনলাে কি না বুঝা গেলাে না। সে বললাে, স্যার জীবনানন্দের একটা কবিতা শােনান। ‘রূপসী বাংলা’ বদির খুব প্রিয়। এই কাব্যের শুরু থেকে শেষ অবধি সে চোখ বন্ধ করে অবাধে দৌড়াতে পারে। সুযােগ পেলেই বদি আমাকে ‘রূপসী বাংলা শােনায়। আমি তাকে পাল্টা চাপ দিলাম, তুমিই বরং শােনাও। আজ মনটা ভালাে নেই স্যার। ফর এ চেঞ্জ, আপনিই শােনান। আবদারের মতাে শােনালাে বদির কণ্ঠ। ক্ষীণ স্বরে এরপর আমি একটি কবিতা ধরলাম। অনেকক্ষণ ধরে বিষন্ন বদি এবার পুরােপুরি যেনাে ডুবে গেলাে বিষন্নতায়। আমি বুঝতে পারলাম বদির মনমানসিকতা আজ একেবারেই ভালাে নেই। আমি তার কারণ জানতে চাইলে সে মুখ খুললাে। বললাে, স্যার ভালাে করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিষ্ঠুরতায় ভরা এই পৃথিবীর এতােকিছু দেখে ফেললাম যে এখন জীবনের কোনাে কিছুর মধ্যেই আগের মতাে আর উৎসাহ খুঁজে পাই না। রংপুরে পাকিস্তানীদের বর্বরতা দেখে হতবাক হয়েছি। এমন একটি অবস্থার মধ্যদিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম যেখানে বেচেঁ থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যেকার ব্যবধানটুকু পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারিনি। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে জীবন খুব অসহ্য হয়ে উঠেছিলাে। বদি তারপরও থামলাে না। মনে হলাে যেনাে আজ সে আর কোনাে কথাই বলা বাকি রাখবে না। গত দিনগুলাের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্ন যা ভারী পাথর হয়ে চেপেছিলাে তার বুকে, আজ তা সব বলে কয়ে সে হাল্কা হবে। বদি এবার মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ফিরে এলাে। বললাে, স্যার, উদ্দেশ্য যাই হােক নৃশংসতায় ভরা এই যুদ্ধ।
এরপর সে একটি ঘটনার উদ্ধৃতি দিলাে। বললাে, আজ সকালে ক্যাপ্টেন ভূইয়ার নিদের্শ। পেয়ে যখন প্লাটুনের সৈনিকদেরকে যুদ্ধের জন্যে এক বুক পানি ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে বললাম—দেখলাম সৈনিকদের একজন অবুঝের মতাে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেনাে সে বুঝতে পারছে সামনে নির্ঘাত মৃত্যু। তার মধ্যে প্রশ্ন, এই নিদের্শ আমি কেমন করে দিতে পারছি ? তখন আমাকে বাধ্য হয়েই এসএমজি’র বাট দিয়ে আঘাত করতে হয়েছে তাকে সামনে এগােবার জন্যে। তারপর যখন গােলাগুলি শুরু হলাে তখন দেখলাম ওই সৈনিকটি আমার নিদের্শ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। ভাবটা এই রকম যে মৃত্যুর নির্দেশ যখন তাকে দেয়া হয়েছে সে মরবেই। আমি পেছন থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেও তাকে আর থামাতে পারছিলাম না। | বদি এরপর সহসা ঝুঁকে পড়লাে আমার মুখের কাছে। শিশুর মতাে প্রশ্ন করে বসলাে সে, স্যার, কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ, বলতে পারেন? উত্তরের অপেক্ষায় নিঃশব্দে বদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু তার এই প্রশ্নের জবাব তাে আমার জানা নেই। আমি বদির চোখের দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি মেলে ধরলাম দূরে যতােদূর চোখ যায় ওই পাহাড় আর অরণ্যের ওপর অদৃশ্য শূন্যতার দিকে। সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়া সত্ত্বেও বদির মধ্যে একটি বালকসুলভ অসহায় ভাব শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যকার বড় ধরনের ফারাক সে মেনে নিতে না পারার কারণেই বােধ করি তার মধ্যে এই অবস্থাটি ঘনীভূত হয়। কিন্তু সেই চেনা বদিকে যেনাে আরেক দফায় নতুন করে আবিস্কার করতে হলাে আমাকে। এতােদিন নিছক অগ্রজের দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিবেচনা করেছি তাকে। তার বিষন্নতায় সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দু’ একটা ইংরেজী শব্দ প্রয়ােগকেই যথেষ্ট মনে করেছি। অতি উচ্ছাস কিংবা চপলতার কারণে তাকে ধমকও দিয়েছি কখনাে সখনাে। কিন্তু তার অন্তর্গত দ্বন্দ্বকে বােঝার চেষ্টা করিনি একবারও। আসলে সামরিক বাহিনীতে কঠোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে একই রক্তমাংসে গড়া মানুষগুলাে অন্তর্ভেদী হয়ে উঠতে পারে না কখনােই। আর তা পারে না বলেই তারা নিদের্শ মতাে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করে মরে এবং এই যুদ্ধ আর মৃত্যুর মধ্যেই জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পায়।
জীবনসন্ধানী বদি ভেতরে ভেতরে সেনাবাহিনীর নিয়ম কানুনের সীমাবদ্ধতা কখনােই মেনে নিতে পারেনি। সেনাবাহিনীর প্রায় সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই একটি জিজ্ঞাসু ভাব ফুটে উঠতাে তার চোখেমুখে ঠিক একইভাবে। যে কারণে জীবনবিনাশী যুদ্ধও তার কাছে মনে। হয়েছে অসহনীয়। মুক্তিযুদ্ধের সমূহ চেতনার সাথে একাত্ম হয়েও এই নিয়ত গােলাগুলির মধ্যে ক্রমেই মৃয়মান হয়ে পড়েছিলাে বদি। যে কারণে তার প্রশ্ন, এই যুদ্ধের শেষ কবে। | নাহারকে ভালােবাসতাে বদি। এই নাহার নামের মেয়েটির কথা সে প্রায়ই বলতাে আমাকে। রংপুরের বন্দী জীবনে অনেক রাতই কেটেছে আমার নাহারের গল্প শুনে। নাহারকে নিয়ে একই কথা বহুবার বলতে শুনেছি বদিকে। কিন্তু তারপরও আমি ছিলাম তার নিঃশব্দ শ্রোতা। মাঝেমধ্যে একই গল্পের পুনরাবৃত্তি শুনে তাকে নতুন কিছু বলার জন্যে বলতাম । বদির জবাব, ভালােবাসার কথা সব সময়ই নতুন। সে কথা কখনাে পুরনাে হয় না। কেবল শুনতে হয় একটু ভিন্ন করে—এই যা! বদির কাছে প্রতিনিয়ত নাহারের গল্প শুনে শুনে কল্পনার ইজেলে এক অদৃশ্য নাহারকে আমি এঁকে ফেলেছিলাম। অবসরে মাঝে মধ্যে আমরা নাহার প্রসঙ্গে ‘ফিল ইন দ্য গ্যাপ’ খেলাটি খেলতাম। নাহারের আকৃতি, তার স্বভাব কিংবা তার ভালােলাগা না লাগার। বিষয়গুলাে নিছক অনুমানের ওপর নির্ভর করে আমি বলে যেতাম। আমার বর্ণনায় যতােটুকু নির্ভুল হতাে বদি তার ওপর নম্বর দিতাে। এভাবে প্রাপ্ত নম্বরগুলাে যােগ করে মােট যে অংকটি দাড়াতাে তাতে মনে হতাে বহু দূরতম অদৃশ্য নাহারের অনেকখানিই আমি চিনে। ফেলেছি। যেনাে অনেক মেয়ে মানুষের ভীড়ে আমি অনায়াশেই নাহার নামের বদিপ্রিয়। মেয়েটিকে আবিষ্কার করে ফেলতে পারবাে। যদিও এই রকম করে তাকে আবিষ্কার করার সুযােগ কিংবা প্রয়ােজন আমার কোনদিনই হয়নি। আসলে মানুষের জীবনে যখন দুঃসময় এসে ভর করে, তখন সম্ভবতঃ জীবনের সব ভালােলাগার কাকতালীয় ব্যাপারগুলাে এমনি। কবেই সমন্বিত হয়। সুখানুভূতীর নিছক স্পর্শটুকু এ সময়ে জীবন্ত করে রাখে দুঃসময়ে নিপতিত মানুষগুলােকে। পাহাড় আর অরণ্যসংকুল ত্রিপুরার আগরতলা শহরটি আয়তনে খুব একটা বড় নয়। চারদিকটায় ভালাে করে তাকালে বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলাের সাথে এর একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তখন মনে হয় আমি আমার নিজের দেশের মাটিতেই দাড়িয়ে আছি।
এই উপলব্ধি কখনো কখনাে আমাকে আমার দেশের কোনাে এক মফস্বলী অতীত জীবনের মায়ায় টেনে নিয়ে যায়। লম্বালম্বি একটি সড়কের দুপাশ ধরে কিছু দোকানপাট, দুটি সিনেমা হল, ত্রিপুরার। মহারাজার বাড়ি, কয়েকটি ব্যাংকের শাখা অফিস আর কংগ্রেস ভবন—এই নিয়ে আগরতলা। বাংলাদেশের রারজনৈতিক ইতিহাসের সব থেকে উল্লেখযােগ্য দুটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে এই ক্ষুদ্র শহরটির নাম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহে আগরতলা অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় একাত্তরে। এই শহরেরই এক প্রান্তে অবস্থিত কংগ্রেস ভবন। কলকাতার থিয়েটার রােডের পরেই মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এই কংগ্রেস ভবনের নাম আসে। শত্রু কবলিত বাংলাদেশের অসংখ্য বিতাড়িত মানুষের আনাগােনা সর্বক্ষণ লেগেই থাকে এখানে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরিচালিত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় তৎপরতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে এই আগরতলা, বিশেষকরে আগরতলার এই কংগ্রেস ভবন। | ত্রিপুরা সরকার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে এই বিশাল ভবনটিকে ব্যবহার করার জন্যে বরাদ্দ দেয়। এখানে বাংলাদেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ভারতীয় রাজনীতিকদের আসা যাওয়া নিত্যদিনকার ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। | আগরতলা শহরের মূল অংশ সমতল ভূমি হলেও এর চারপাশ জুড়ে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের বেষ্টনী আর অসমতল অরণ্যভূমি। সেখানে কৃষ্ণচূড়ার আধিক্য দৃষ্টি ধাধিয়ে দেয়। শহর ছাড়িয়ে যেদিকেই যাই পাহাড়ী বণভূমির অপার সবুজ সমুদ্রের যেন আর শেষ নেই। ভয়াবহ যুদ্ধের দিনগুলােতেও এই অনিন্দ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আমি যতােবার আগরতলা গিয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। কলকলিয়ার শিবিরে আসার পর নানা কারণে বিশেষত শিবিরের জন্যে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বহুবার আমাকে যেতে হয়েছে আগরতলা। কলকলিয়া থেকে আগরতলার দূরত্ব মাইল পনেরাে হবে। রাস্তা আংশিক কাচা এবং বাকী পাহাড়ী পথটুকু উচুনিচু হবার কারণে জীপে প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগে যায়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ওষুধ, ক্যানভাসের জুতা আরও কি কি সব কেনার জন্যে আগরতলা যাই আমরা তিন জন। আমি, মাের্শেদ ও আবুল হােসেন।
ওই দিন আমার কেনাকাটা একটু আগেই শেষ হয়ে যায়। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম মাের্শেদ ও আবুল হােসেনের জন্যে। সহসা লক্ষ্য করলাম কথা বলতে বলতে আমারই সমবয়সী তিন যুবক পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় তাদের মধ্যে একজন গভীর বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালাে। সে আরাে দুপা এগিয়ে এলাে, কে বাদল না ? আমার চোখেমুখেও অনুরূপ বিস্ময়, আরে হাবিবুল ! আমাদের বিয়ের পালা শেষ হবার আগেই হাবিবুল আমাকে জড়িয়ে ধরলাে। হ্যা, হাবিবুলই তাে। কতােদিন পরে দেখাে। বছর ছয়েক তাে হবেই। এতােদিন পরে আগরতলায় কৈশাের তারুণ্যের প্রিয়মুখ হাবিবুলকে এভাবে দেখতে পাবাে ভাবিনি। ইতিমধ্যে হাবিবুলের সাথের অপর দুই বিস্মিত যুবকও এগিয়ে এসেছে। প্রায় একই প্রিয়মুখ। একজন চুন্ন অপরজন মিলন। আমরা এই চারজনই এক সময় স্বদেশের একটি মফস্বল শহরে সহপাঠি। ছিলাম। অনেকদিন কাটিয়েছি এক সাথে। আজ বহু দিন পরে এই প্রিয়মুখগুলােকে কাছে পেয়ে আমি নিজের মধ্যে সহসা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। কৈশাের তারুণ্যের মফস্বল শহর মাদারীপুরের আরও বহু ঘনিষ্ঠজনের ছায়াশরীর ভেসে ওঠে চেতনায়। মনে পড়ছে ফেলে আসা উজ্জ্বল দিনগুলাের কথা। কম সময়তাে নয়। দীর্ঘ ছয় বছর কাটিয়েছি ওই মফস্বল । অনেকের কথাই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলাে হাবিবুলকে। কিন্তু হাবিবুল জানালাে অন্য কথা। ওরা তিনজনই নৌ কমান্ডাে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলােতে সদ্য শেষ করে আসা কমান্ডাে অভিযানের বর্ণনা দিলাে সে। আগস্টের মধ্যভাগে চট্টগ্রাম নৌবন্দরে পরিচালিত কমান্ডাে অপারেশনে ওরা অংশ নিয়েছে। সে জানালাে আগরতলার কাছাকাছি কোথাও একটি ক্যাম্পে ভারতীয় নৌ বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে হয় ওদের। হাবিবুলের মুখে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত সফল অপারেশনের বিবরণ শুনে আমি শিহরিত হলাম : বলতে কি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৌ অপারেশনের কথা হাবিবুলদের মুখেই আমি প্রথম জানতে পাই।
ওদের সবাইকে কলকলিয়ায় আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেদিনের মতাে বিদায় | নিলাম। কোনাে আগাম জানান না দিয়েই ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল গণজালভেস কলকলিয়ায় এসে উপস্থিত হলেন। মােরশেদ সেদিন শিবিরে ছিলাে । তার দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হলাে। জেনারেল আমাদের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শন করতে চাইলেন। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটেই তিনি ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন। অসংখ্য প্রশ্ন তার বিষয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকার কারণে আমারও উত্তর দিতে কোনাে ক্লান্তিবােধ হচ্ছিলাে না। জেনারেল গণজালভেসের আপাতঃ মাথা ব্যথার মূল কারণ যে শক্রর ধর্মগড় ঘটিকথাবার্তার মধ্যদিয়ে এটা বুঝতে আমার অসুবিধা হলাে না। দিন দুয়েকের মধ্যে কর্নেল ভর্মাও একদিন এসে উপস্থিত হলেন আমাদের শিবিরে। তার সাথে দুজন কোম্পানী কমাণ্ডার। এদের একজন মেজর টি এল শর্মা এবং অপরজন মেজর টেটা সিং। এলাকার খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান তৎপরতা চালালেন তারাও। সীমান্তের এ পারে ভারতীয় বাহিনীর এই তৎপরতার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঞ্চালনও আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। বিভিন্ন অবস্থানে বধীত সেনাদলের উপস্থিতির খবরও আসতে লাগলাে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থায় দফায় দফায় গােলাবর্ষণ ছাড়া সীমান্ত এলাকা বরাবর পাকিস্তানীদের অন্য কোনাে আগ্রাসী তৎপরতা পরিলক্ষিত হলাে না। সম্ভবতঃ সেনা সঞ্চালন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তাদের তৎপরতায়। এই সাময়িক ভাটা পড়ে। কিন্তু আমাদের দিক থেকে সামরিক কর্মকাণ্ডে কোনাে শৈথিল্য। আনা হলাে না। বরং তা আরও তীব্রতর করা হলাে।
এরই মধ্যে আমাদের তৈরী এমবুশে সীমান্তের ওপারে রাজাকারের একটি দল নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আহত অবস্থায় ধরা পড়েছে একজন। এই আহত রাজাকারের কাছ থেকে জানা গেলাে যে মনতলার পাকিস্তানী অবস্থানে কামানের দায়িত্বে নিয়ােজিত রয়েছে হাকিম নামে একজন বাঙালী ক্যাপ্টেন। পাকিস্তানীদের সেবায় নিবেদিত এই হাকিমের গােলার আঘাতে ইতিমধ্যেই অনেক শরনার্থী ও মুক্তিযােদ্ধার প্রাণাবসান হয়েছে। | পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাকিম তার স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় শুরু থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালী হত্যায় সে অনেক পাকিস্তানীকেও হার মানায়। | দেখতে দেখতেই সেপ্টেম্বরে এসে গেলাে। আর এই সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকেই ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় হঠাৎ করে পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণের তীব্রতা বেড়ে যায়। মাত্র দিন কতক আগেই আমাদের কলকলিয়া শিবির লক্ষ্য করে প্রচণ্ড হামলা চালায় মনতলার পাকিস্তানী গেলান্দাজ বাহিনী। তাদের নিক্ষিপ্ত সব থেকে নিকটবর্তী গােলাটি শিবিরের ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে। এই গােলাবর্ষণের পর পরই বাদল বাবুরা চা বাগান ছেড়ে চলে যায়। এ পর্যায়ে পাকিস্তানীরা এ পারের ভারতীয় লােকালয় মােহনপুর বাজারেও গােলন্দাজ আক্রমণ চালায়। সেখানে নিহত হয় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ভারতীয় নাগরিক। | ধর্মগড়ে আমাদের আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর কর্নেল সফিউল্লাহ্ সঙ্গত কারণেই কিছুটা মনক্ষুন্ন হন। এই ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবে সেক্টরের শ্রেণী নির্বিশেষ সকলকেই মানসিকভাবে আহত করে। এরপর সফিউল্লাহ মগড়ের ওপর দ্বিতীয় একটি আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তবে তার আগে তাৎক্ষণিকভাবে সীমিত আকারের কিছু আক্রমণাত্বক কার্যক্রম গ্রহণের জন্যে তিনি তৎপর হন। এই লক্ষ্যে ‘ডি’ কোম্পানীকে মুকুন্দপুর এলাকায় পাকিস্তানীদের সৈন্য ও রসদ বহনকারী ট্রেন ধ্বংসের নির্দেশ দেয়া হলাে। | প্রতি সপ্তাহে একবার দুপুরের দিকে আখাউড়া থেকে সৈন্য ও রসদ বহনকারী একটি ট্রেন মুকুন্দপুর অবধি এসে আবার আখাউড়া ফিরে যেতাে। মুকুন্দপুর পর্যন্ত ট্রেনটি আসার মূল উদ্দেশ্য সপ্তাহান্তে প্রতিটি অগ্রবর্তী ঘাটিতে রসদ পৌছে দেয়ার পাশাপাশি বদলী সেনাদের স্থানান্তর করা। নির্দিষ্ট এই রুটে ট্রেনটির চলাচলের খবর আমরা অনেক আগেই পেয়েছিলাম। কিন্তু সেক্টর কমাণ্ডারের অনুমতি না পাওয়ার কারণে এটি ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
পরিবর্তীত অবস্থায় এই ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়ার জন্যে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহে ভারতীয়দের সাহায্য চাওয়া হলাে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন বিশেষজ্ঞ রিমােট কন্ট্রোলের সাহায্যে ট্রেনটি ধ্বংস করে দেয়ার পক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করলাে। এরপর ভারতীয়দের দিক থেকে রিমােট কন্ট্রোল সরবরাহে কোনাে বিলম্ব হলাে না। | অপারেশন চালাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার পর এ ব্যাপারে কর্নেল সফিউল্লাহর প্রয়ােজনীয় অনুমতিও পাওয়া গেলাে। সেদিনই আমি ও মাের্শেদ একটি হালকা সেনাদল নিয়ে দুপুরের দিকে এক অনুসন্ধানী টহলে বেরিয়ে পড়লাম। খুব সন্তর্পণে মুকুন্দপুর হয়ে রূপা পর্যন্ত রেললাইনসংলগ্ন পুরাে এলাকাটির পর্যবেক্ষণ শেষ করে বিস্ফোরক বসাবার একটি স্থান নির্ধারণ করা হলাে। নির্ধারিত এই স্থানটি মুকুন্দপুর আর রুপার মাঝামাঝি জায়গায়। কাছেই একটি সরু খরস্রোতা খাল পূর্বদিকে রেললাইনের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। নির্ধারিত স্থানে বিস্ফোরক লাগানাের কাজে খালটির সুবিধাজনক অবস্থানকে ব্যবহার করা যেতে পারে। খালের উজান বেয়ে ওপরে রেললাইন পর্যন্ত নিরাপদেই পৌছানাে যাবে বলে মনে হলাে। বিপত্তি ঘটলাে ফেরার পথে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিলাে। এবার আমরা বনবাদাড় না মাড়িয়ে অনেকদিনের অব্যবহৃত একটি কাঁচা রাস্তা ধরে এগুলাম। কিছুদূর যাবার পর একটি বাকের কাছে পৌছে মনে হলাে মাটিতে ছােটো কৌটোর মতাে কি যেনাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। খেয়াল হলাে আমি আর মাের্শেদ ইতিমধ্যে এই রকম বেশ কিছু কৌটো অতিক্রম করে এসেছি। আরও অনেকগুলাে কৌটো লক্ষ্য করা গেলাে। সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই প্লাটুন কমান্ডার বারকিও আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের পুতে রাখা এই মানব বিধ্বংসী মাইনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। নিমিষেই রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে এলাে। কোনাে কিছু যেনাে আর ভাবতে পারছি না। তারপরও নিজেকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালাম। আমরা দুজনেই সমস্বরে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বললাম। বিষয়টি বুঝে ওঠার সাথে সাথেই মাইনে আটকে পরা আমরা তিনজন ছাড়া বাদবাকি সবাই মাটিতে শুয়ে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের মাইন ফিড দূরপাল্লার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওতার মধ্যে থাকার কথা। এ অবস্থায় মাইন বিস্ফোরণে না মরলেও পাকিস্তানীদের গুলিতে ঝাজরা হয়ে যাবার সম্ভাবনায় আমরা আতংকিত হলাম। কয়েক মুহূর্তে কেটে গেলাে। কোনাে অঘটন ঘটলাে না। এভাবেই অনুমান করলাম কাছাকাছি শক্রর কোনাে অবস্থান নেই। তা যদি থাকতাে, তাহলে তিন তিনটি জলজ্যান্ত শিকার এভাবে এতােক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারতাে না। | এখন সমস্যা মাইন ফিলড থেকে বের হই কেমন করে। আস্তে আস্তে খুঁচিয়ে একদিকের মাইন তুলে ফেলার পর যে ফাকের সৃষ্টি হবে, সেই ফাক দিয়ে বের হওয়া ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ভাবা গেলাে না। কাজটি দুরুহ এবং প্রচণ্ড ঝুকিপূর্ণ। মাটি খুঁড়তে হবে আস্তে ধীরস্থিরভাবে। একটি একটি করে মাইন তুলে নিয়ে দূরে কোথাও রাখতে হবে। তাড়াহুরাের কোনাে অবকাশ নেই এই কাজে।
আমাদের চেয়ে সৈনিকদের উৎকণ্ঠা অনেক বেশী। ওরা সবাই পাগলের মতাে বিলাপ করছিলাে। পারে তাে ওদের জীবনের বিনিময়ে আমাদেরকে উদ্ধার করে নেয়। মাইনক্ষেত্রের মধ্যে কিংকর্তব্যবিমূর দাড়িয়ে থেকে আমরা এই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে, পুতে রাখা দুএকটা মাইনের ওপর আমাদের পা পড়া অস্বাভাবিক ছিলাে না। সে ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ না ঘটার কারণ কি? হতে পারে কোনাে মাইনের ওপর আমাদের পা আদো পড়েনি। আর তা যদি হয়ে থাকে, ঘটনাটি দৈব সন্দেহ নেই। এও হতে পারে যে মাইনগুলাে অনভিজ্ঞ লােক দিয়ে বসানাে হয়েছে যারা মাইনগুলাে বসাবার আগে তা ‘প্রাইম’ করতে পারেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কারণে জীবন-মরন এই সংকটের সঙ্গে অপর একটি বারতি মাত্রা এসে যুক্ত হলাে। কিন্তু করার কিছু নেই। ইতিমধ্যে দুজন সৈনিক আস্তে আস্তে বেয়ােনটের মাথা দিয়ে মাটি সরিয়ে মাইন তােলার করার কাজ শুরু করেছে। বাকি সবাই ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে সতর্ক দৃষ্টি ধরে আছে চারদিকে। আধ ঘন্টারও ওপর ধরে দাড়িয়ে আছি এক জায়গায় একইভাবে। তারপরও ধৈর্যহারা। হলাম না। খানিক পরেই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার পেলাম সবাই। শিবিরে যখন ফিরে এলাম, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে কলকলিয়ার অরণ্যে।
১৩ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে আমাদের একটি প্লটুন আকারের সেনাদল মােরশেদের নেতৃত্বে মুকুন্দপুর রেলসেতুর নিকটবর্তী রেললাইনের পাথরের নিচে বিস্ফোরকের সাথে ৩টি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে দেয়। তারপর তারের সাহায্যে পুতে রাখা বিস্ফোরক রিমােট কন্ট্রোলে যুক্ত করে নিয়ে আসা হয় নিরাপদ দূরত্বে। রেললাইনের পূর্ব পাশের ঘন হয়ে বেড়ে ওঠা পেয়ারা বাগানের মধ্যে এরপর রিমােট কন্ট্রোলটি বসানাে হয়। অপারেশনের প্রথম পর্ব এভাবে নির্বিঘ্নেই শেষ হলাে। পরদিন সকালেই পৌছে গেলাম রেললাইনের কাছাকাছি পেয়ারা বাগানে। সেখানে রাত থেকেই পাহারায় নিয়ােজিত রয়েছে আমাদের সৈনিকরা। তাদের সাথে কথা বলে তখন অবধি সেখানে বিরুপ কিছু ঘটেনি জেনে আশ্বস্ত হলাম। | আগেই সুবেদার মান্নানকে ৪০ জনের এক প্লাটুন যােদ্ধাকে ট্রেন ধ্বংসের অপারেশনে যাবার জন্যে মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। সাথে ভারী ধরনের অস্ত্র রেখে তার পরিবর্তে সর্বোচ্চ সংখ্যক হালকা মেশিনগান নেয়ার কথাও সুবেদার মান্নানকে একইসঙ্গে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। দুপুরের খাবার একটু আগেভাগেই শেষ করা হলাে। খানিক বিশ্রামের পর গন্তব্যে রওয়ানা হলাম মুক্তিযুদ্ধের এক দুরুহ অপারেশনে। ২টা বেজে গেছে তখন। উত্তেজনায় হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে বুকের মধ্যে। কিন্তু ট্রেনের কোনাে সাড়াশব্দ নেই। আতংকিত হলাম ভেতরে ভেতরে। তাহলে কি গুপ্তচরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়। শত্রুরা কি জেনে ফেলেছে ট্রেন ধ্বংসে আমাদের উদ্যোগের কথা। আমার শংকার ব্যাপারটি নিয়ে মােরশেদের সাথে আলাপ করলাম। মােরশেদও আতংকিত একই কারণে। আমরা বিলম্ব না করে আমাদের সাথের প্লাটুনটিকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নিদের্শ দিলাম। বলা যায় না এখন হয়তাে আমরাই পাকিস্তানীদের পাতা এমবুশে বসে আছি। সামগ্রিক পরিস্থিতি যখন এ রকম ঠিক তখনই দক্ষিণ দিক থেকে ট্রেনের শব্দ পাওয়া গেলাে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অগ্রসরমান ট্রেন দৃষ্টিগােচর হলাে। প্রথমে দুটো লাল রঙের পণ্যবাহী বগী, তারপর ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের পর চারটি যাত্রীবাহী কামরা এবং শেষের দিকে আরও দুটি লাল বগি। বেশ মন্থর গতিতেই ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। উত্তেজনা আমাদের সবার তখন চরমে। ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছি। দৃষ্টি নিবদ্ধ সবার ধীর গতিতে আগুয়ান ট্রেনের দিকে। প্রতিটি জানালায় খান সেনাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটি কামরার দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম একজন সেনা অফিসারকে।
ট্রেনের ইঞ্জিন বিস্ফোরক পুঁতে রাখা স্থান অতিক্রম করার সাথে সাথেই রিমােট কন্ট্রোলের প্লঞ্জারে চাপ পড়লাে। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে পুরাে ট্রেনটি দু ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রথমে শূন্য উঠে এলাে। তারপর বিভক্ত দু ভাগ রেললাইনের দু পাশে প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে পড়লাে। বিস্ফোরনের প্রচণ্ডতায় ঘাবড়ে গেলাম। এ যেনাে অবিবাস্য ভয়াবহতা। একশাে গজ দূর থেকে উড়ে আসা রেললাইনের স্লিপারসহ অন্যান্য লােহাড় টুকরাে আমাদের নিরাপত্তাও অনিশ্চিত করে তুললাে। গাছ-গাছালি না থাকলে আমাদের লােকজনও যে। হতাহত হতাে, তাতে সন্দেহ নেই। আতংক কেটে যেতেই গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয়া হলাে। মাত্র একশাে গজ দূরত্ব থেকে স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের কয়েক হাজার গুলি বর্ষিত হলাে আমাদের দিকে পড়ে থাকা ট্রেনটির বিধ্বস্ত অংশের ওপর। এরপর সবকিছু নিথর। জীবনের চিহ্ন নেই কোথাও। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে খান সেনাদের লাশ যত্রতত্র। একমাত্র যে বস্তুটি অক্ষত থেকে গেলাে তা হলাে ট্রেনটির ইঞ্জিন। রেললাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢালুতে বেশ খানিকটা নিচে পড়ে আছে। কেনাে যেনাে ইঞ্জিনটিকে ধ্বংস করতে আর মন চাইলো না। মুকুন্দপুরের সাফল্যে কর্নেল সফিউল্লাহ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠলেন। তারপর পাকিস্তানীদের। সর্বশেষ তথ্য অবহিত হওয়ার পর তিনি ২ ইস্ট বেঙ্গলের পুরাে শক্তি নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ধর্মগড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই মধ্যে একদিন তিনি কলকলিয়ায় এসে জানালেন যে পাকিস্তানীরা বিধ্বস্ত ট্রেনটির। ইঞ্জিন সরিয়ে নেয়ার জন্যে ক্রেন নিয়ে মুদপুরে অবস্থান করছে। অবশ্য সেদিন সকালে আমরাও একই ধরনের খবর পেয়েছিলাম। যাইহােক কর্নেল সফিউল্লাহ ক্রেনটিকে অকেজো করে দেয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করলেন। | এরপর সিদ্ধান্ত হলাে যে এই দুরুহ কাজটি আমার তত্বাবধানেই সম্পন্ন হবে এবং তা করতে হবে কোনাে প্রকার কালক্ষেপন না করেই। ভারতীয়দের কাছ থেকে মাত্র চারটি রকেটসমেত ৭৩ মিলিমিটারের একটি পুরনাে রকেট লঞ্চার পাওয়া গেলাে। সম্ভবতঃ বিএসএফ বাহিনীর কাছ থেকে এটিকে আনা হয়েছে। লঞ্চারের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্যে এর মধ্যে আবার একটি রকেট খরচ হয়ে গেলাে। বাকি তিনটি রকেট নিয়েই ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে হাবিলদার বারকির প্লাটুন সাথে নিয়ে সতর্কতার মধ্য দিয়ে বিধ্বস্ত ট্রেনের কাছাকাছি পৌছে গেলাম। কিন্তু কোনাে ক্রেন দেখতে পেলাম না। সেখানে। শুধুমাত্র ইঞ্জিনটিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম রেললাইনের ওপর। সম্ভবতঃ ইঞ্জিনটি তােলার পর ক্রেন তার গন্তব্যে চলে গেছে। যাহােক এবার ইঞ্জিনটিকে এভাবে আর ফেলে যাওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না বিধায় সেটিকেই ধবংস করার সিদ্ধান্ত নিলাম। লঞ্চারের নিক্ষিপ্ত রকেটের দূরত্ব অতিক্রমন ক্ষমতা অনুর্ধ্ব ৫০ গজ থাকার কারণে হাবিলদার বারকি ও আরও দুজন সৈনিককে সাথে নিয়ে আমি জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাটির শেষ প্রান্তে এসেও দূরত্ব ঘােচাতে ব্যর্থ হলাম। উপায়ান্তর না দেখে বারকিকে লঞ্চারে একটি রকেট ভরে দিতে বললাম। রকেট লােড হওয়ার সংকেত পেয়ে আমি একাই নেমে গেলাম রেললাইনের ২৫ গজ দূরত্বে। রেললাইনের পাশের জলায় নেমেই ইঞ্জিনের কাছাকাছি পাকিস্তানী সেনাদের ঘােরাফেরা করতে দেখলাম। তাবু ফেলে সেখানে একটি ক্যাম্পের মতাে করা হয়েছে।
রেললাইনের পাশের গাছগুলােতে গােটা দশেক লাশ ঝুলে থাকতে দেখা গেলাে। বিভৎস্য সেই দৃশ্য। সেগুলাে হতভাগ্য বাঙালীদের লাশ। সম্ভবতঃ ট্রেন ধ্বংসের প্রতিশােধ নিয়েছে তারা এই নিরীহ বাঙালীদের ওপর। অন্য সময় হলে এই দৃশ্য দেখে আতকে উঠতাম। কিন্তু চুড়ান্ত উত্তেজনার এই মুহুর্তে কোনাে আতংকই আমাকে স্পর্শ করলাে না। | আমি মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম যে রকেট নিক্ষেপের পর হয়তাে আর জীবিতাবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। অভিন্ন পাকিস্তানী সেনাদের ২৫ গজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারাটা খুবই অসম্ভব কাজ । তারপরও এগিয়ে গেলাম। কিন্তু রকেট লঞ্চার তাক করে ট্রিগার চাপার পরও রকেট বিস্ফোরিত হলাে না। কয়েকবার চেষ্টা করার পর আস্তে করে। পেছনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনাে আমি দৃষ্টিগােচর হইনি কারাে। প্রথম লােড করা রকেটটি আমি নিজেই বের করে পানিতে ফেলে দিলাম। বারকিকে আরেকটি রকেট লােড করার জন্যে বললাম। কিন্তু বারকি জোরালাে আপত্তি তুললাে। আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে সে বিচলিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তখন তাে আর ফেরার পথ নেই। আমাকে যে যেতেই হবে। আমার মাথায় জেদ চেপে গেছে তখন।
সতর্কতার সাথে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে এলাম। দূরত্ব ২৫ গজের বেশী নয়। বরঞ্চ কম হলেও হতে পারে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর প্রতি তাক নির্ভুল করতে এবার আমি আমার সামরিক জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞান কাজে লাগালাম। প্রচণ্ড শব্দে রকেট বিধ্বস্ত হলাে ইঞ্জিনের ঠিক মাঝখান বরাবর। কেঁপে উঠলাে ইঞ্জিন। তারপর কালাে ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলাে গােটা এলাকা। আর সেই সাথে বৃষ্টির মতাে আমার চারদিকে অঝােরে ঝরতে লাগলাে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের ৮১ মিলিমিটার চীনা মর্টার থেকে গােলাবর্ষণও শুরু হয়ে গেছে আমাদের ওপর। বারকি চিৎকার করে আমাকে ডাকছে। আমার সাথের যােদ্ধারাও তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে গুলিবর্ষণ করছে পাকিস্তানীদের ওপর। এই ফাকে বারকি টেনে হিচড়ে আমাকে তুলে ফেললাে জলা থেকে। আমি অক্ষত। কোথাও রক্ত লেগে নেই। পুরাে ঠিকঠাক ফিরে এলাম কলকলিয়ার শিবিরে। মােরশেদ অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাে আমাদের জন্যে। ধর্মগড়ের দ্বিতীয় অভিযানে ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণে যাবার প্রস্তাব করে। এটা ছিলাে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার একটি প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানীদের সাথে একটা চূড়ান্ত বােঝাপড়া অত্যাসন্ন—এটা যে তারই সুস্পষ্ট আলামত বুঝতে অসুবিধা হলাে না।। কর্নেল সফিউল্লাহ চেয়েছিলেন দ্বিতীয় দফায় ধর্মগড়ের ওপর একটি ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের আক্রমণ চালাতে। অর্থাৎ আনুমানিক এক হাজার যােদ্ধার সঞ্চালন ঘটিয়ে তিনি এই আক্রমণ শানানাের জন্যে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্থানীয় কুশলীরা এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পােষণ করলেন। তারা গােলন্দাজের সহায়তায় ১৮ রাজপুতের দুটি কোম্পানী দিয়ে ধর্মগড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এই অভিযানে ২ ইস্ট বেঙ্গলের যে ব্যাপক সহায়তা প্রয়ােজন তারা তা জানালেন। পকিল্পনা অনুযায়ী ২ ইস্ট বেঙ্গলের তিনটি কোম্পানী আগেভাগে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে ধর্মগড়কে বিচ্ছিন্ন করবে। এরপর ১৮ রাজপুতের আক্রমণের সাথে সাথে ক্যাপ্টেন ভুইয়া ‘বি’ কোম্পানী নিয়ে ধর্মগড়ের কিছুটা দক্ষিণে বিজয়নগর এলাকায় একটি কৃত্রিম আক্রমণ রচনা করবে।
এবারের অভিযানে গােলন্দাজের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটলাে তা শুধু কামানের সংখ্যায়। অথাৎ এবার সহায়তা দেয়ার জন্যে ১২টি কামান পাওয়া গেলাে আগের ৬ টির পরিবর্তে ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের কিছু পর ২ ইস্ট বেঙ্গলের ৩টি কোম্পানী পরিকল্পনা অনুযায়ী ধাড়ের দুদিক থেকে সফল অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হলাে। এর আগে কয়েকদিন আমরা এ ধরনের বেশ কয়েকটি মহড়ার আয়ােজন করেছিলাম এবং এর ফলে আমাদের সৈনিকদের ভেতর তাদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কোনাে অস্পষ্টতা ছিলাে না। অধিকন্তু ধর্ষাড়ের আসন্ন এই যুদ্ধের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আগরতলার সেনানিবাসে কর্মকর্ত পর্যয়ে দুদফায় আলােচনাও হয়েছে। অর্থk নিখুত প্রস্তুতির প্রশ্নে কোথাও কোনাে শৈথিল্যের প্রশ্রয় দেয়া হলাে না। কলকলিয়ায় হালকা উপস্থিতি রেখে ‘ডি’ কোম্পানীর মূল অংশ নিয়েই মােরশেদ এবং আমি শিবির এলাকা ত্যাগ করলাম। দুজন স্থানীয় গাইডের সাহায্যে এগিয়ে চললাম ধর্মগড় ডানে রেখে। এই গাইড দুজনকে আগেভাগেই তৈরী রাখা হয়েছিলাে। আমরা আমাদের পূর্ব নির্ধারিত স্থানে পৌছে প্রথমেই সংযােগ স্থাপন করবাে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানীর অগ্রবর্তী অংশের সঙ্গে। ক্যাপ্টেন নাসিমের ‘এ’ কোম্পানীও আমাদের | অনুরূপ পাকিস্তানী অবস্থানকে বিচ্ছিন্নকরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে বিপরীত দিক থেকে। ‘এ’ এবং ‘ডি’ কোম্পানীর সংযােগ স্থাপিত হলে ধরে নেয়া হবে যে ধর্মগড়ের পাকিস্তানী | অবস্থান বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এরপর সংকেত পেলে ভারতীয় রাজপুত বাহিনী কলকলিয়া হয়ে | ‘ডি’ কোম্পানীর সহায়তায় ধর্মগড়ের দিকে এগিয়ে যাবে এবং ভাের চারটায় সূচনা করবে তাদের আক্রমণ। রাজপুতদের এই আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াও ‘বি’ কোম্পানী নিয়ে বিজয়নগর এলাকায় অপর একটি কৃত্রিম আক্রমণের সূচনা করবে। এই কৃত্রিম আক্রমণের উদ্দেশ্য হবে মূল আক্রমণ প্রশ্নে শত্রুর মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা। অধিকন্তু টেলিফোন লাইনসহ অন্যান্য যােগাযােগ ব্যবস্থাও বিকল করে দিতে হবে আক্রমণ শুরু করার আগেই। তারপর প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে মূল ভূখণ্ড থেকে অবরােধ ভাঙ্গার লক্ষ্যে পরিচালিত যে কোনাে পাল্টা হামলা প্রতিহত করতে। সবকিছু ঘটে গেলাে পরিকল্পনা মাফিক।
রাত ২টায় রাজপুত বাটালিয়নের দুটি কোম্পানী মেজর টেটা সিং ও মেজর টি এল শর্মার নেতৃত্বে ধর্মগড়ের দিকে এগিয়ে গেছে নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই। আমাদের দেয়া গাইডের সহযােগিতায় নির্ভুলভাবেই তারা লক্ষ্যে পৌছে যায়। | ভাের ৪টায় মূল আক্রমণ শুরুর আগে ভারতীয়দের কামানগুলাে সচল হয়ে উঠলাে। মূহুর্মুহু গােলাবর্ষণের শব্দে কেঁপে উঠলাে ধর্মগড়ের জনপদ। নিকটবর্তী মনতলার অবস্থান থেকেও পাকিস্তানীদের কামান প্রত্যুত্তরে বিক্ষিপ্তভাবে গােলাবর্ষন শুরু করেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু সেগুলাে এখনও তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে উঠতে পারেনি। যে কারণে তাদের গােলাবর্ষনে এই বিক্ষিপ্ত আচরণ। দুর্ভাগ্যবশতঃ রাজপুতদের আক্রমণের সূচনা ঘটে এমন একটি স্থান থেকে যেখানে আগেভাগেই পাকিস্তানীরা তাদের মেশিনগানগুলাের শক্ত অবস্থান ঘটিয়ে রেখেছিলাে। এই মেশিনগানের সাহায্যে সেখানে তারা জোরালাে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। লাগাতার আক্রমণ চালিয়েও ভারতীয়রা তেমন কোনাে সুবিধা অর্জন করতে পারলাে না। এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানীদের একটি সহায়ক সেনাদল এগিয়ে আসার চেষ্টা চালায় সকাল ৭টার দিকে। অগ্রসরমান এই দলটির আচরণের কারণে এটিকে একা “ফাইটিং পেট্রোল’ বলে মনে হলাে। সেখানে একটি প্রাটন নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমি। চমৎকারভাবে সংযত থেকে আমাদের সৈনিকরা শত্রু বাহিনীর আগুয়ান দলটিকে অবস্থানের ৫০ গজের মধ্যে আসার সুযােগ করে দেয়। নুরুল ইসলাম অব্যর্থভাবে তার মেশিনগান ব্যবহার করে এবার। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় পাচ জন। এরপর এগিয়ে আসার আর কোনাে চেষ্টাই করেনি তারা। অনুরূপ আরেকটি দলকে ক্যাপ্টেন নাসিমও বাধা দেয় ধর্মগড়ের উত্তরে। সেখানেও তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। | বেলা ১০টার দিকে ভারতীয়রা তাদের আক্রমণ পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদেরকে তাদের নিরাপদ প্রত্যাহারে সহায়তা করতে বলা হলাে। অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে তারা ভারতের মাটিতে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব অর্পিত হলাে আমাদের ওপর। রাজপুতরা তাদের দু’জন সহযােদ্ধার মৃতদেহ সাথে করেই নিয়ে এলাে। আহত অবস্থায় দেখলাম অনেককেই। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে হতাহত না হলেও ১৪০ জনের মতাে বেসামরিক লােক নিহত হলাে এই যুদ্ধে! এরা সবাই ক্রশ ফায়ারের শিকার। রাজাকারসহ বেশ | কিছু বেসামরিক লােক ধর্মগড়ের মূল লােকালয়ের কাছাকাছি একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলাে। কামানের গােলা ভুলবশতঃ সেখানে পড়লে প্রায় সবাই মারা পড়ে। এভাবেই শেষ হলাে ধর্মগড়ের দ্বিতীয় যুদ্ধ।
ধর্মগড়ের এই যুদ্ধ সামরিক দিক থেকে তেমন উল্লেখযােগ্য না হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কেননা এটাই | ছিলাে পূর্ব রণাঙ্গনে সম্ভবতঃ বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর প্রথম সম্মিলিত অভিযান। সেদিন হ্যাজামারায় সেক্টর সদর দফতরে যাচ্ছিলাম। জীপের স্টিয়ারিং ছিলাে মােরশেদের হাতে। ড্রাইভিংয়ের প্রতি তার আগ্রহ প্রচণ্ড। কোথাও যেতে গাড়ির প্রয়ােজন হলে এ কাজটি তারই করা চাই। যদিও ড্রাইভিংয়ে তার হাত খুব পরিপক্ক ছিলাে না। কিন্তু এ কথা তাকে বলবে কে? তিনি তাে আমার সিনিয়র। সেনাবাহিনীতে সিনিয়রদের এই রকম অনেক কিছুই নিরবে হজম করতে হয়। এটাই নিয়ম। আগরতলা-মােহনপুর মহাসড়কের সাথে কলকলিয়ার সংযােগ সড়কটি বৃষ্টির কারণে চলাচলের জন্যে একেবারেই অযােগ্য হয়ে পড়েছিলাে। সেখানে গাড়ি চালানাে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সড়কে পুরু কাদার স্তর জমে থাকার কারণে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যায় না ঠিকমতাে। ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। এই কাঁচা সড়কটি যেখানে মহাসড়কের সাথে মিলেছে, তার পাশে এক চিলতে জায়গায় স্থান পাচেক টিনের ঘর। বাংলাদেশের কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার স্থান নিয়েছে এই ঘরগুলােতে। পিচ্ছিল কাঁচা সড়ক থেকে মহাসড়কে উঠতে গিয়ে মােরশেদ জীপটিকে অনেক কসরতের মধ্য দিয়ে সহসাই উল্টে ফেলতে সক্ষম হলাে। সে এক অনাহুত কাণ্ড ভাগ্যিস আশপাশে লােকজন তেমন ছিলাে না। আবার লােকজন কাছাকাছি না থাকার কারণে আরেক বিপত্তি। দেখা দিলাে। আকাশের দিকে চিৎ হয়ে থাকা জীপের তলদেশ থেকে আমরা দুজন কোনাে রকমে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসতে পারলেও গাড়িটি এখন সঠিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে কেমন করে সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম। মােরশেদের ওপর আমার বিরক্তি চরমে উঠলেও আপাতঃ এ নিয়ে আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হলাে না। দুজনে মিলে উল্টানাে জীপ সােজা করার কাজে লেগে গেলাম।
সহসা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম পাঁচ-ছয় বছরের একটি বালকও আমাদের সাথে জীপ । বাহ।ছলেটি কখন এসে জুটলাে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ পেছন থেকে কার কর্কশ কণ্ঠ শােনা গেলাে। তাকিয়ে দেখলাম কাচা পাকা দাড়ির এক প্রৌঢ় ভদ্রলােক পথ পার্থের একটি ঘঝে রক্ষায় দাড়িয়ে ছেলেটিকে ধমকের সুরে ডাকছে। তার ডাক শুনে সে অদৃশ্য হয়ে গেলাে মুহুর্তে মধ্যে। এখানে ঘরের বারান্দায় ওই প্রৌঢ় ভদ্রলােককে প্রায়ই বসে থাকতে দেখি আনমনে। এ পথে চলাচলের সময় মাঝেমধ্যেই চোখে পড়েছে এই দৃশ্য। কিন্তু কখনাে যেচে গিয়ে তার সাথে জ্বালা করার সুযােগ হয়নি, আর সে প্রয়ােজন বােধ করিনি। | জীপ ঠিকঠাক করে উঠতে যাবাে এমন সময় দেখলাম দ্রলােক আমাদের কাছে এসে নাড়িয়েছেন। ছেলেটিকে দিয়ে গাড়ি ধাক্কাবার কাজ করাচ্ছিলাম কেনাে—এই নিয়ে তিনি বাগাড়ম্বর শুরু করলেন। তার এই আচরণে বিস্মিত হলেও লােকটির কথায় আমরা কোনাে আমল দিলাম না। তাকে পাশ কাটিয়ে জীপে গিয়ে উঠলাম। বােধ করি আমাদের এই তাচ্ছিল্যে ভদ্রলােক আরও ক্ষেপে উঠলেন। পেছন থেকে কর্কশ ঝাঁঝালাে গলা শােনা গেলাে তার। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, যুদ্ধ নেই, বিগ্রহ নেই, দেশ স্বাধীনের নাম নেই, খালি ঘােরাফেরা। আমােদ-ফুর্তি আর কি! | মােরশেদ এবং আমি দু’জনই প্রেীটের এ কথায় ঘুরে তার দিকে বিরক্তিভরে একবার। তাকালাম। সে তখনাে কটমট করে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। তার এই আচরণে আমাদের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিলাে। অনেক কষ্ট করে নিজেদের সংযত করলাম। মােরশেদ গাড়িতে স্টার্ট দিলাে। সে দিনের মতাে ঘটনার এখানেই সমাপ্তি।
এ ঘটনার দু’এক দিনের মধ্যেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ক’দিন থেকে গায়ে বেশ জ্বর।। সেই সাথে ব্লড ডিসেন্ট্রি। ভালাে চিকিৎসা দরকার। চেক আপের জন্যে যেতে হবে। আগরতলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাসপাতালে। আমাদের ডাক্তার আবুল হােসেনকে সাথে নিয়ে একদিন আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দীপ চলেছে হ্যাজামারার দিকে। সেক্টর সদর দফতর থেকে চিঠি নিয়ে আগরতলা যেতে হবে। সেই টিনের শেড দেয়া বাড়িগুলাের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মহাসড়কের সংযােগ স্থলে হাত উচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিটুল—সেদিনের সেই ছেলেটি, আমাদের উল্টানাে জীপে ধাক্কা দেয়ার কারণে যাকে বকা শুনতে হয়েছিলাে। জীপ তার পাশ। কেটে যেতেই সে পিছু নিলাে এবং চিৎকার করে আমাদের থামতে বললাে। ব্যাপার কি জানার জন্যে গাড়ী থামাতে হলাে। হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে বিটুল জানালাে তার বুবু আমাকে ডাকছে। বিটুলের বুবু বলে কাউকে আমি চিনি না। তাছাড়া বিটুলের বয়সও খুব কম। ওর কথায় নতর করে কারাে সাথে দেখা করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছিলাম। তাও আবার মেয়েমানুষ। কিন্তু বিটুল নাছােড়বান্দা। সে আমার হাত ধরে রীতিমতাে টানাটানি শুরু করে সিলো। আসুন, নেমে আসুন, বুবু ডাকছে তাে। জানেন, আমি রােজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকি। আপনাদের জন্যে। গাড়ীর শব্দ শুনলেই বুবু আমাকে রাস্তায় পাঠিয়ে দেয়। খুব বিপদে পড়ে গেলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিটুলের বুবুর সাথে দেখা করতে যেতে হলাে। বাড়ির ছোকাছি এসে খােলা বারান্দার দিকে একবার তাকালাম। না, সেখানে আজ আর সেই প্রােঢ় প্রলােক নেই। ইতঃস্তত করে বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। খােলা দরজা দিয়ে বা দিকের একটি রুমে দেখলাম এক ভদ্রলােক খােলা জানালায় নিবিষ্ট হয়ে আছেন চা বাগানের সবুজে। পায়ের শব্দ শুনে তাকালেন বারান্দার দিকে। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, কাকে চাই? সেদিনের সেই কর্কশ কণ্ঠ। বুঝতে আর কষ্ট হলাে না তিনি কে?
অপ্রীতিকর কিছু একটা ঘটার আশংকায় আমি ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে পড়লাম। আর ঠিক তখনই আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারে পাশের একটি রুম থেকে বেরিয়ে এলাে বিটুলের বুবু। সে তাকে বললাে, বাবা, আমিই ওনাকে আসতে বলেছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, ‘আপনাকে এ পর্যন্ত ডেকে আনার জন্যে আমি দুঃখিত’ বলে অনুতাপ করলাে। বললাে, আপনারা খুব ব্যস্ত মানুষ। দেশের জন্যে যুদ্ধ করছেন। আপনাদের তাে কাজের অন্ত নেই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বিটুলের বুবুর দিকে। কলকলিয়ার এই পরবাসে এমন দৃশ্য আমি যেনাে আশাই করিনি। খুব সুন্দর মেয়ে বিটুলের বুবু। কলকলিয়া কেনাে তাহলে প্রাণহীন ছিলাে এতােদিন, আমার ভাবতে ইচ্ছে হলাে। | সেদিন বাবা আপনাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। এজন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আশা করি। তার এই আচরণ মনে রাখবেন না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে আমার দু’ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। এই নিয়ে বাবা খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। এর ওপর আবার এখানকার এই দুর্বিষহ উদ্বাস্তু জীবন। নানান অসুবিধা। সব মিলিয়ে বাবার মন কখনােই ভালাে থাকে না। বিটুলদের পরিবারের দুঃখ বেদনার অনেকখানি আমার জানা হয়ে গেলাে এই অল্প। কথায়। কর্কশ মেজাজের ওই প্রৌঢ় ব্যক্তিটি যে ওদের বাবা তাও জানা হলাে। বিটুলের বুবুকে তারপরও আমি কোনাে জবাব দিতে পারলাম না কেনাে যেনাে। বিটুলের বাবার দুর্ব্যবহারও এখন সহনীয় হয়ে এলাে অনেকটা। এরপর আমি নিঃশব্দে নেমে এলাম বারান্দা থেকে। দেখলাম অদূরে জীপে আবুল হােসেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জুলাই মাসের প্রথম ভাগেই ভারত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে তিন সপ্তাহ মেয়াদী যুদ্ধ। পরিকল্পনা তৈরী করে ফেলে। তবে এই পরিকল্পনা শুধুমাত্র বাংলাদেশ রণাঙ্গনকে কেন্দ্র করেই প্রণীত হয়নি, সম্ভাব্য পশ্চিমের রণাঙ্গনেও তার বিস্তৃতি ঘটে। ভারত এ সময় এটা নিশ্চতভাবেই উপলব্ধি করে যে, বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তানের সাথে তার যুদ্ধ পশ্চিমেও ছড়িয়ে পড়বে অনিবার্য কারণেই এবং সেই রণাঙ্গনে পাকিস্তান সর্বময় শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে বাংলাদেশে তার সম্ভাব্য পরাজয়ের ঘাটতি পূরণে সচেষ্ট হবে। ভারতের যুদ্ধ পরিকল্পনা যে কারণে দু’দিকের দুই রণাঙ্গনকে হিসেবে রেখেই প্রণীত হলাে। এই যুদ্ধ পরিকল্পনায় চীনের দিক থেকে আসতে পারে এমন একটি হুমকির মােকাবেলার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রাখা হলাে। সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের ঝুঁকির প্রশ্নে উত্তর ভাগের প্রতিরক্ষার ব্যাপারেও সতর্ক মনােযােগী হতে হয় ভারতকে। অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত মেয়াদে তিনটি ফ্রন্টে একাধারে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার একটি বিশাল পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভারত।
পূর্ব রণাঙ্গনে অবস্থানরত পাকিস্তানের ৫ ডিভিশন পরিমান বাহিনী পরাস্ত করে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে আনুমানিক ৭ থেকে ৮ ডিভিশন সৈন্যের প্রয়ােজন-পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে ভারতীয় যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রধানতঃ এই নিরিখেই প্রণীত হয়। যদিও প্রচলিত যুদ্ধনীতিতে এই হিসেবটা অন্য রকম। সে যাই হােক, ভারতের এই অনুমিত সমর শক্তির অধিকাংশই তাকে সঞ্চালন করতে হবে উত্তরে হিমালয় এবং আংশিকভাবে পূর্বের নাগাল্যাণ্ড ও মিজোরামের সেনা অবস্থান থেকে। কিন্তু এই সমূহ সঞ্চালন পরিকল্পনায় ভারতের পশ্চিম দিককার অবস্থান থেকে কোনাে প্রকার সেনা স্থানান্তর বিবেচনায় আনা হলাে না। সেখানে পাকিস্তানের সমাবেশকৃত সর্বমােট ১৪টি ডিভিশনের বিপরীতে ভারত তার সম পরিমাণ শক্তির উপস্থিতিতে আপাতঃ নিশ্চিন্ত থাকলাে। কিন্তু ট্যাংক বহরের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটি প্রাধান্য থেকেই গেলাে। সম্ভাব্য বাংলাদেশ যুদ্ধের নিরিখে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের প্রতিরক্ষা কেন্দ্রিক পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডকে একই সাথে বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলাে। প্রথমতঃ পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের আওতায় বাংলাদেশ রণাঙ্গনের দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে লেঃ জেনারেল টি এন রায়নার নেতৃত্বে একটি নতুন সেনা কোর সৃষ্টি করা হলাে। ২ কোর নামে পরিচিত এই ফরমেশনের অধীনে এরপর ন্যস্ত হলাে ৪ মাউন্টেন ও ৯ পদাতিক ডিভিশন। পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অপর সেনা ফরমেশন শিলিগুড়িতে অবস্থানরত লেঃ জেনারেল থাপানের ৩৩ কোরের অধীনে ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে নিয়ে আসা হলাে হিলি কমপ্লেক্সের বিপরীতে। এই ডিভিশনটিকে তুলে আনা হয় উত্তরে হিমালয় সংলগ্ন তিব্বত সীমান্ত থেকে। উপরন্তু উত্তরে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের দিকে সঞ্চালনের জন্যে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপ এবং তিস্তা বরাবর ৯ মাউন্টেন ব্রিগেডকে দায়িত্ব দিয়ে সরাসরি এই কোরের অধীনস্থ করা। হলাে। অর্থাৎ ৩৩ কোরের অধীনে থেকে যুদ্ধ করার জন্যে নির্বাচিত হলাে একটি পূর্ণাঙ্গ মাউন্টেন ডিভিশন, একটি ব্রিগেড গ্রুপ এবং অপর একটি স্বতন্ত্র উন্টেন ব্রিগেড। | শিলিগুড়ি করিডাের অঞ্চলের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্যে সৃষ্ট ১০১ কমিউনিকেশন। জোনকে যুদ্ধোপযােগী করে এর অধীনে আপাততঃ একটি ব্রিগেড ৯৫ মাউন্টেনের বিন্যাস ঘটানো হলাে ঢাকার উত্তরে ময়মনসিংহ ও টাংগাইলের যুদ্ধের জন্যে। উত্তর-পূর্ব হিমালয় এবং এর নিম্নাঞ্চলে নিয়ােজিত ৪ কোরকে দেয়া হলাে বাংলাদেশের। পূর্ব রণাঙ্গনের দায়িত্ব। লেঃ জেনারেল সাগত সিং তেজপুর থেকে এই সেনা কোরের কার্যক্রম। পরিচালনা করতেন। আগস্টের শুরুতেই ৪ কোরকে দ্বিখণ্ডিত করে চীনের সম্ভাব্য হামলা। প্রতিহত করার জন্যে এর একাংশের হালকা সমাবেশ উত্তরে রেখে মূল বাহিনীকে বালাদেশের যুদ্ধের জন্যে ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ অবধি মােতায়েন করা হলাে। এই কোরের অধীনে ন্যস্ত করা হয় ৮, ২৩ ও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন।
এর মধ্যে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনটি তুলে আনা হয় হিমালয় থেকে। অপর দিকে ৮ ও ৫৭ ডিভিশন দুটিকে মিজোরাম ও নাগাল্যাণ্ডের বামপন্থী বিদ্রোহী নির্মল আভিযান থেকে অব্যাহতি দিয়ে আগরতলার মধ্যাঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। | এরপরও শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আক্রমণাত্বক যুদ্ধের জন্যে ভারতীয়দের অবস্থান কিছুটা অসম থেকে গেলাে। যে কারণে পশ্চিমের রাজস্থান থেকে অপর একটি ব্রিগেড ৩৪০ মাউন্টেনকে তুলে আনা হয় পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের আওতায় এবং বিমানবাহী ৫০ প্যারা ব্রিগেডকেও বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্যে মােতায়েন রাখা হলাে এই কমাণ্ডের অধীনেই। উপরন্তু হিমালয়ের ৬ মাউন্টেন ডিভিশনকেও বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত রাখা হলাে। প্রয়ােজনে এই ডিভিশনটিরও সঞ্চালন ঘটানাে হবে বাংলাদেশে। ভারতের প্রণীত যুদ্ধ পরিকল্পনার উল্লেখযােগ্য দিক হলাে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে ট্যাংকের উপস্থিতির আধিক্য। বাংলাদেশ মুক্ত করার যুদ্ধে ভারত অধিক সংখ্যক ট্যাংকের উপস্থিতিকে ব্যাপক প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিমে ট্যাংকের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রণাঙ্গনে ভারত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে পশ্চিম থেকে কিছু ট্যাংকবহর পূর্ব ফ্রন্টে সরিয়ে আনে। ভারতীয় সমর পরিকল্পকরা যথার্থই ধরে নেয় যে, পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধে ট্যাংকের জোরালাে উপস্থিতি মূলতঃ ভারসাম্যের পাল্লা ভারতের অনুকূলেই রাখবে। এই মূল্যায়নের প্রেক্ষাপটে তিনটি পূর্ণাঙ্গ ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং দুটি স্বতন্ত্র ট্যাংক স্কোয়াড্রন পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের তিনটি সেনা কোরের মধ্যে প্রয়ােজন। অনুপাতে ভাগ করে দেয়া হলাে। সবশেষে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য কিছুটা অসমই রয়ে গেলাে এবং এটা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হলাে হিমালয়ের চীন সীমান্ত থেকে চারটি ডিভিশন প্রত্যাহারের কারণে। এ ক্ষেত্রে ভারতকে একটি সুচিন্তিত ঝুঁকিরই আশ্রয় নিতে হলাে। অবশ্য যুদ্ধ পরিকল্পনাটি এমনভাবে তৈরি করা হলাে যাতে প্রয়ােজনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলাদেশ রণাঙ্গন থেকে অন্ততঃ দুটি ডিভিশন সরিয়ে নেয়া যায় চীনের মােকাবেলায়। | ভারত ইতিমধ্যেই পূর্বাঞ্চলে তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে শুরু করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধে রণাঙ্গনের গভীরদেশ পর্যন্ত বিমান আক্রমণ চালানাে সহজসাধ্য হবে বলে ধরে নেয়া হয়। যদিও বঙ্গোপসাগরের জলভাগে যুদ্ধের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম তথাপি প্রয়ােজনে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে একটি কার্যকরী নেী অবরােধ সৃষ্টির জন্যে পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহরকেও সক্রিয় করে তােলার পদক্ষেপ নেয়া হলাে।
এক সাথে তিন দিকে সতর্ক মনােযােগ রেখে ভারত এভাবেই একটি বিশাল যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পন্ন করে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের উপযােগী সরবরাহ ভাণ্ডার তৈরী এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার বিষয়টিও নিখুঁতভাবে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং সেই সাথে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্নমুখি সেনা সঞ্চালন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়। আর এই প্রক্রিয়া নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারতীয় সমর কুশলীরা। এরপর তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনার বাইরে এই যুদ্ধে চীনের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। কেননা তাদের মধ্যে তখনাে প্রশ্ন, চীন আসলেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না? এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের মনােভাব সংক্রান্ত একটি আভাস প্রথম পাওয়া গেলাে সে দেশের একজন উধর্বতন নেতার বক্তব্য থেকে। ১৩ এপ্রিল চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুবাই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদকে সবত্নিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মুষ্টিমেয় কিছু লােকের গণ্ডগােল বলে অভিহিত করলেন। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই’র এই আশ্বাসের সূত্র ধরে পাকিস্তানের চীন পন্থা। রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো ৩০ এপ্রিল ঘােষণা করলেন যে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র কয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে চীন নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবে। তার এই ঘেণর অর্থন ধ্বনিত হলাে একই সাথে পিকিং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মধ্যেও। এরপর ১৯ জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট খােদ ইয়াহিয়া খান এক সাক্ষাতকারে বললেন, ভারত যদি পাকিস্তানের ওপর কোনাে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাহলে সেই যুদ্ধে পাকিস্তান একা থাকবে না। ফলে স্বভাবতঃই এই সব ঘােষণা বক্তব্য থেকে তখনকার মতাে এটা অনুমান করা গেলাে যে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি খুবই প্রণিধানযােগ্য। | তবে এ সময় ভারতের সমর ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য পাকিস্তান এবং চীনের দৃষ্টিভঙ্গীতে কিছু ভিন্নতা আবিষ্কারে সমর্থ হলেন। অর্থাৎ চীন মুখে যা কিছুই বলুক এবং সেই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান যেভাবেই বাগাড়ম্বর করুক, কার্যতঃ পাকিস্তানের প্রতি টানা সাহায্য-সমর্থন শেষ পর্যন্ত বৈষয়িক এবং কূটনৈতিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে—এমন একটি ধারণাকে তারা একেবারে উড়িয়ে দিলেন না। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী আন্তজাতিক পরিমণ্ডলে চীন তার জন্য গুরুত্ববহ একটি পূর্বকাল অতিক্রম করছিলাে। উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীন আন্তজাতিক বলয়ে তখন তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়ও ব্যতিব্যস্ত। সেটি আবার এমন একটি সময় যখন সে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার দাবিকৃত অন্তর্ভুক্তি পেতে যাচ্ছে। সেদিক থেকে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে ৬২’র চীনের সাথে ‘৭১ সালের চীনের পার্থক্য অনেক। আবার ঠিক এই সময়ের মধ্যে আদর্শিক চিন্তা-চেতনায় তার অন্যতম এবং একক প্রতিদ্বন্দ্বী সােভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট জুড়ে এগিয়ে গেছে অনেক দূর।
ঠিক এমন একটি অবস্থায় বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে একটি নিষ্ঠুর প্রকৃতির সামরিক জান্তার পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নেমে যাবে চীন—এই ধারণাকে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে গ্রহণ করতে পারলেন না। উপরন্তু এরই মধ্যে চীন বাংলাদেশের আপামর গণমানুষের দাবির বিরােধিতা করে আন্তর্জাতিক বলয়ে তাে বটেই, এমনকি কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তার আদর্শিক মিত্রদের মধ্যেও বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় চীন্য নেতারা। বালাদেশকে কেন্দ্র করে খুব বেশীদূর এগুবে না বলেই ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনুমান। হলাে। তাছাড়া হিমালয় সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় চীনের তেমন কোনাে সামরিক প্রস্তুতিও লক্ষ্যণীয় নয়। সামগ্রিক এই বিবেচনা থেকেই ভারত এরপর বাংলাদেশের যুদ্ধে উত্তরে চান সীমান্ত থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করার ঝুঁকি গ্রহণে কার্যতঃ উৎসাহী হয়ে ওঠে। | কি? তারপরও চীনা নুমকিকে পুরােপুরি উড়িয়ে দেয়া সম্ভব হলাে না। তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনার মধ্যে যে কারণে তারা চীনা হুমকি মােকাবেলার জন্যে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েই রাখলাে। এই প্রস্তুতিকে আরও শক্ত করার জন্যে প্রতিবেশী পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে একটি সামরিক গাটছড়া বেঁধে রাখা হলাে যথাসময়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে খুব সঙ্গত কারণেই এদেশের জনগণ চীনের সহমর্মিতা পাব। পারে একটি সুনিশ্চিত আবাস ভেতরে ভেতরে লালন করছিলো। অচিরেই তারা এ চীনা নীতির বৈপরিত্য দেখে নিদারুণভাবে আশাহত হয়ে পড়ে। নির্যাতিত বিশ্বের জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সাহায্য-সমর্থন যার বৈপ্লবিক রাষ্টীয় নীতির পর্যায়ৰ্ভুক্ত সেই চীনা নেতৃত্ব বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অকস্মাৎ মুখ ঘুরিয়ে নেবে—এমনটি প্রথমতঃ ভাবাই যায়নি। বিশেষতঃ চীনা নেতৃত্বের কর্ণধার যখন কমরেড মাও সেতুং স্বয়ং এবং চৌ এন লাইয়ের মতাে নেতা তার প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাে, দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে তাদের পাশে চীনা মহিরুহ’র ছায়াটি পর্যন্ত নেই। উপরন্তু ২৫ মার্চের ভয়াল রাত থেকে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের আপামর জনগণের ওপর তাদের নৃশংসতম প্রতিশােধ গ্রহণে যে অস্ত্রপাতি ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে তার প্রধান সরবরাহকই হচ্ছে চীন। এরপর ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞের মুখে বাংলাদেশের অসহায় জনগণ যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয় তখনাে চীনা নেতৃত্ব স্বতঃস্ফূর্ত জনতার এই মুক্তি সংগ্রামকে নিছক মুষ্টিমেয় মানুষের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিশৃঙ্খলা বলে উড়িয়ে দিলাে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার আক্রমণে দিশেহারা এ দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ যখন এই প্রতিরােধ যুদ্ধে শরিক, চীন তখনাে এই গণউত্থানকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে যায় একে ‘মুষ্টিমেয় মানুষের গণ্ডগােল’ বলে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্বিচার বুলেটের মুখে বাংলাদেশের মানুষের আর্তচিৎকার চীনা নেতাদের এমন কি মহান নেতা মাও সে তুংয়ের ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি সুদীর্ঘ ১ মাসে। জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের জনগণের কাছে চীনের এই নেতিবাচক ভূমিকা প্রকারান্তরে এক ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা বলেই বিবেচিত হলাে। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট বােধগম্য কারণেই তাদের ঔপনিবেশিক সেবাদাস পাকিস্তানের সামরিক স্বেচ্ছাচারকে সমর্থন দিয়েছে। এখানে উপর্যুপরি বিস্ময়কর ব্যাপার যে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকারী জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক যন্ত্রে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন স্বার্থ এবং সমাজবাদী চীনা স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে। অথচ এই চীনই আবার একটি ঐতিহাসিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী শ্লোগান তুলে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং নিযাতিত জনগণের সেই চীনে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে একটি অনুকরণীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। বিশ্বের অপর সমাজতান্ত্রিক দেশ সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়েছে বলে কিংবা ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে তাদের প্রয়ােজন রয়েছে বলে চীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে—এ যুক্তি কখনােই গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। চীনের রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাদের ভাষ্যমতে তথাকথিত সম্প্রসারণবাদী। সােভিয়েত ইউনিয়নের চেয়েও সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্টই তার প্রধান শত্রু বিবেচ্য হওয়া উচিৎ এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে তা হয়নি। শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেলায়ই নয়, এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর চীনা নীতি অবাক করেছে বিশ্ববাসীকে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, সমাজতন্ত্রী চীনের। সাথে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মূল বিরােধটা কিসের ? সেকি আদর্শের না কি নিছক স্বার্থ রক্ষারই কৌশলমাত্র ? সম্ভবতঃ এ প্রশ্নের জবাব চীনা নেতৃত্বের কাছেও নেই।
বাংলাদেশের গণযুদ্ধে চীনের প্রকাশ্য বিরােধিতার নীতি এ দেশের যুদ্ধরত গণমানুষকেই শুধু নয় এই দুর্বোধ্য নীতি অনাকাক্ষিতভাবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এ দেশের মাওবাদী রাজনীতি-আশ্রিত মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশের মধ্যেও। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণনিধন অভিযানের মুখে একই সাথে দ্বিমুখী রণকৌশল অবলম্বন করে। যার ফলে খুব সীমিত পর্যায়ে হলেও দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পর পর অন্তর্ঘাতী আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। এর ফলে, উভয় দিকে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক। মুক্তিযােদ্ধাকেই। বস্তুতঃ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে চীনা নীতির জটিলতাই এর জন্যে। পুরােপুরি দায়ী। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম পর্যায়ে চৈনিক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের। সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে চীনা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিবৃত সেই ব্যাখ্যায়। বাংলাদেশের গণযুদ্ধের বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে বলা হয় যে, এটা সামান্য কিছু লােকের উচ্ছংখলতা এবং অখণ্ড পাকিস্তানের ঐক্যবিনাশী একটি কর্মকাণ্ড। ব্যাখ্যায় পূর্ব পাকিস্তানে। ঘটমান সমস্যাবলীকে নিতান্তই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ চীনা নেতৃত্বের মতে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে, তা নিছক একটি গণ্ডগােল মাত্র। এবং প্রতিবেশী ভারত এই গণ্ডগােলের সুযােগ নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। কাজেই মিঃ চৌ এন লাইর চিঠিতে এমন আশ্বাসও দেয়া হলাে যে, প্রয়ােজনে চীন ভারতের বিরুদ্ধে যে কোনাে যুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম পাকিস্তানের পাশে থাকবে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে চীনা নীতির কূটকৌশলের এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় যখন নিশ্চিতপ্রায়, যখন ভারতের সাথে পাকিস্তান একটি ভয়াবহ যুদ্ধে সর্বত্র বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং পাকিস্তানের ঐক্য, অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে যাচ্ছে, ঠিক এই দুঃসময়ে দেখা গেলাে চীন আদৌ পাকিস্তানের পাশে নেই। ইয়াহিয়া খানকে প্রদত্ত চৌ এন লাইর আশ্বাস নিরবে নিঃশব্দে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে পিকিং। ভারতের সেনা সঞ্চালন প্রক্রিয়া সমাপ্তির অনেক আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিমাঞ্চলে। তাদের শান্তিকালীন অবস্থান ছেড়ে উত্তর-দক্ষিণে সমগ্র ভারত সীমান্ত বরাবর জড়াে হতে শুরু করে এবং অক্টোবর নাগাদই তাদের এই সেনা সমাবেশ সম্পন্ন হয়ে যায়। মূলতঃ কাশ্মীরের জম্মু সেক্টর ও পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চলের সমতলভূমিতে পাকিস্তানী সমাবেশের তুলনামূলক প্রাধান্য অনুভূত হয় বেশী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১২ ও ২৩ পদাতিক। ডিভিশন দুটির সমাবেশ সীমাবদ্ধ থাকে এককভাবে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে। ৮, ১৫ ও ১৭ পদাতিক এবং ৬ আর্মার্ড ডিভিশন এই চারটি ডিভিশনকে নিয়ােজিত করা হয়। শিয়ালকোট সেক্টরে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে সঞ্চালনের উদ্যেশ্যে। পাঞ্জাবের মধ্যাঞ্চল বরাবর সমাবেশ করা হয় ১০ ও ১১ পদাতিক ডিভিশন ও একটি স্বতন্ত্র আমাজ। ব্রিগেড। পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান নেয় ৭ ও ৩৩ পদাতিক এবং ১ আমডি ডিভিশন। এছাড়া আরও একটি অতিরিক্ত পদাতিক ব্রিগেডকে এই সমাবেশের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
আর একেবারে দক্ষিণে অর্থাৎ সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ সংলগ্ন সীমান্তে ১৮ পদাতিক ডিভিশন ও একটি স্বতন্ত্র আমর্ড ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটে। | পাকিস্তানী সেনা সমাবেশের ধরন দেখে এটা স্পষ্টতই বােঝা গেলাে যে পশ্চিমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল আক্রমণ সূচিত হবে প্রথমতঃ শিয়ালকোট সেক্টরে, কাশ্মীরে ভারতীয় সমাবেশ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে। ৬টি ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ শক্তির সমাবেশই ঘটানাে হয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এটাও অনুমেয় যে পাকিস্তানী সমাবেশের পরবর্তী লক্ষ্য ভারতীয় পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চল। এখানেই মােতায়েন রাখা হয়েছে পাকিস্তানের শক্তিশালী ১ আর্মার্ড ডিভিশন। পাকিস্তানের এই সমাবেশের বিরুদ্ধে ভারত তার পশ্চিমাঞ্চলীয় কমাণ্ডের তিনটি সেনা কোরে বিভক্ত ১১টি ডিভিশনের পুরাে শক্তির সমাবেশ ঘটায় পশ্চিমে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় কমাণ্ডের দুটি ডিভিশনের সঞ্চালনও ঘটানাে হয় রাজস্থান ও গুজরাট সংলগ্ন পাক সীমান্তে। অধিকন্তু কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত বাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হলাে পশ্চিমাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধীনে প্রয়ােজনে তার সঞ্চালন ঘটাবার জন্যে। | এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার প্রেক্ষিতে | যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত অংশের পুনর্গঠনের কাজও ত্বরিৎ হাতে নেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার একাংশে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে আরও একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন তৈরীর নির্দেশ পাওয়া গেলাে। এই নির্দেশের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আংশিক অক্ষত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিভক্ত করে তার একটি অংশ নিয়ে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের কাজ শুরু হলাে। ২ এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে গঠিত হলাে ‘এস ফোর্স ব্রিগেড। কর্নেল সফিউল্লাহ ৩ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে এই এস ফোর্স ব্রিগেডের কমাণ্ডার নিযুক্ত হলেন এবং তার স্থলে ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান হলেন সেক্টর কমাণ্ডার। নুরুজ্জামান এই পর্যায়ে তার সেক্টরে। ১০টি সংমিশ্রিত কোম্পানীর একটি বাহিনী পেলেন।
একইভাবে ২ ইস্ট বেঙ্গলের অফিসারদের মধ্যেও বিভাজন আনা হলাে। মেজর মঈন | নিযুক্ত হলেন এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন নাসিমকে দেয়া হলাে ১১ ইস্ট বেঙ্গলের নেতৃত্ব। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট মােরশেদ, লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম ও লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান থেকে গেলাে ২ ইস্ট বেঙ্গলে। | ১১ ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানী কমাণ্ডার হিসেবে এলেন ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া। একাধারে | এডজুটেন্ট ৭ কোম্পানী কমাণ্ডার হিসেবে আমিও নিযুক্তি পেলাম এই রেজিমেন্টে। একই সময় ১১ ইস্ট বেঙ্গল ছাড়াও ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে আরও দুটি নতুন ব্যাটালিয়ন তৈরী। করা হলাে ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল নামে। | এস ফোর্স ব্রিগেডের পাশাপাশি আরও দু’টি ব্রিগেড তৈরী করা হলাে একই প্রক্রিয়ায়। এর মধ্যে ‘জেড ফোর্সের আত্মপ্রকাশ ঘটে সবার আগে জুলাই মাসের মাঝামাঝি এবং এর অধিনায়কত্ব দেয়া হয় কর্নেল জিয়াকে। কে ফোর্স’ ব্রিগেডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন কর্নেল খালেদ মােশাররফ। পুনর্গঠনের এই নবতর পর্যায়ে যুদ্ধরত এবং নতুন সৃষ্ট সকল নিয়মিত ব্যাটালিয়নই এই তিনটি ব্রিগেডের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ২ ইস্ট বেঙ্গল বিভক্ত করার ফলে এর দু’টি কোম্পানী চলে আসে ১১ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে। রেজিমেন্টের বাদবাকি দুই কোম্পানী পরিমান সৈন্য সংগ্রহের জন্য আমাদের যেতে হলাে ইয়ুথ ক্যাম্পগুলােতে। টানা সাত দিন অক্লান্ত চেষ্টার পর আনুমানিক ৫ শ’ শিক্ষিত তরুণ প্রশিক্ষণার্থী সহ করা সম্ভব হলাে সেখান থেকে। অক্টোবরের প্রথম থেকেই এদেরকে নিয়ে শুরু হলাে ৬ সপ্তাহ মেয়াদী সামরিক প্রশিক্ষণ।
এদিকে ১১ ইস্ট বেঙ্গলের জন্যে এক বিশাল সেনা শিবির গড়ে তােলা হলাে ফটিকছড়া নামক স্থানে। অরণ্যবেষ্টিত এই স্থানটি বিটুলদের বাসস্থানের খুব কাছাকাছি। ২ ইস্ট বেঙ্গলও তাদের অগ্রবর্তী স্থানসমূহ সেক্টর সেনাদের বুঝিয়ে দিয়ে আগরতলার নিকটবর্তী ভিন্ন একটি শিবিরে চলে যায়। | এই বিভাজন প্রক্রিয়ার সুবাদে আমি কলকলিয়া ছেড়ে এলেও কলকলিয়ার আরণ্যিক নির্জনতাকে বিসর্জন দিতে পারিনি। কলকলিয়ার সম্প্রসারিত অরণ্যের ঘের ফটিকছড়াকেও ছেয়ে আছে। বাদল বাবুর চা বাগান এখানে না থাকলেও ফটিকছড়া চা বাগানের সবুজ আস্তরণ আমাদের নতুন এই শিবির থেকে খুব বেশি একটা দূরে নয়। আর এই ফটিকছড়া চা বাগানের কোল ঘেঁষে থাকে বিটুলরা। | ফটিকছড়ার ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শিবির এখন লােকে লােকারণ্য। প্রায় হাজার খানেক মুক্তিযােদ্ধার সমাবেশ ঘটেছে এখানে। ফলে শিবির এলাকায় আগের নৈসর্গিক নিস্তবতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ উত্তর যুদ্ধ মহড়ার কোলাহল অনেক বৈপরীত্য এনে দিয়েছে এখানকার পারিপার্শ্বিকতায়। | দিনভর প্রশিক্ষণের পর রাতে শুরু হয় শত্রু নিধনের মহড়া। কোনাে কোনাে রাতে এই মহড়ার আয়ােজন নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর অবস্থানের প্রায় কাছাকাছি জায়গায়। এটি এমন এক ধরনের মহড়া যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযােদ্ধা অনেক বেশী যুদ্ধ কৌশলী হয়ে উঠতে পারে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। | ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের চালানের সরবরাহ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে। রসদও এসে পৌঁছেছে যথেষ্ট পরিমাণে। মাঝেমধ্যে দুর্গম গিরিপথ বেয়ে ট্রাক চালিয়ে আমাকেও এই রসদ আনার জন্যে যেতে হয় পশ্চাদ্ভুমির কোনাে সরবরাহ ঘাটিতে। সেখানে পাহাড় কেটে গড়ে তােলা হয়েছে বিশাল সরবরাহ ভাণ্ডার। শুধুমাত্র ত্রিপুরা রাজ্যেই এ ধরনের দুটি ভাণ্ডার ক্ষেত্র তৈরী করা হয়েছে পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যে।
এরই মধ্যে এক ধাপ পদোন্নতি দেয়া হলাে নিয়মিত বাহিনীর কোনাে কোনাে অফিসারকে। সেই সুবাদে নাসিম, ভূঁইয়া, মতিন এবং মতিউর সবাই ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হয়েছেন। মােরশেদও লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছে। একই সময় নতুন কমিশনপ্রাপ্ত চারজন তরুণ অফিসার ফটিকছড়ায় এসেছে ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে যুদ্ধে যােগ দিতে। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। ভারতের মূর্তিতে অবস্থিত প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ শেষে এদের কমিশন দেয়া হয়েছে। | ফটিকছড়ার ১১ ইষ্ট বেঙ্গল শিবিরে বাংলাদেশ সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গেরও আগমন শুরু হয়েছে কয়েকদিন থেকে। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ ইতিমধ্যে আমাদের শিবির পরিদর্শন করে গেছেন। এ সময় সৈনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে কর্নেল সফিউল্লাহ তার বক্তব্যে দু’জনের নাম ও পদবীতে ওলট-পালট করে ফেললেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় একটি হালকা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলাে। প্রধানমন্ত্রী খানিকটা অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলেই মনে হলাে। অস্থায় রাষ্ট্রপতির মধ্যে অবশ্য কোনাে ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলাে না। উপস্থিত অন্যরা এটাকে নিছক একটি রসাত্মক ঘটনা হিসেবেই উপভােগ করলাে।
সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীও একদিন শিবির পরিদর্শনে এলেন ফটিকছড়ায়। তিনি চলে যাবার পর পরই শিবিরে এসে হাজির হলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদ। তিনি একটি রাত আমাদের সাথে থেকেও গেলেন ফটিকছড়ার শিবিরে। সেদিন অনেকদিন পর হঠাৎ হাবিবুল ফটিকছড়ায় এলাে। গত কয়েকদিনে আমাদের বেশ ধকল গেছে। একের পর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আগমনের কারণে আমাদের কারাে কোনাে অবসরই মেলেনি। তাছাড়া প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ব্যপক বিস্তৃতির ফলে সবকিছু থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। | মাস দেড়েকের ওপর হলাে আগরতলায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অনেকদিন ভেবেছি আগরতলায় গেলে হাবিবুলদের ওখানে যাবাে। ওরা আছে কি নাই, না কোনাে অপারেশনে গেছে, সে খবরটিও নেয়া হয়নি এই দেড় মাসে। সঙ্গত কারণে হাবিবুলকে দেখে বেশ খুশি। হয়ে উঠলাম। সাথে চুনু আর মিলনকে না দেখতে পেয়ে ওদের কথা জিজ্ঞেস করলাম। আমার এই প্রশ্নে হাবিবুলের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিলাে। আমি শংকিত হয়ে উঠলাম। হাবিবুলই বললাে, কয়েকদিন হলাে ওদের দুজনের কোনাে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আগরতলার সম্ভাব্য সব জায়গায় তল্লাশি শেষে এখন খোঁজাখুজি থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মূহুর্তে আমার করনীয় তেমন একটা কিছু ছিলাে না। আর তা সম্ভবও নয়। চারদিকে এখন যুদ্ধ। এই অবস্থায় কোথায় তাদেরকে খুঁজবাে। ফটিকছড়ায় আমাদের ভীষণ ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন বিটুলদের কথা হঠাৎ মনে পড়লাে। সেই কাদা আর পীচঢালা সড়কের মােহনায় যাওয়া হয়নি অনেকদিন। ওদের দেখতে যাওয়া দরকার। কিছু চ-চিনি আর গুড়াে দুধ নিয়ে একদিন এক অবসরে রওনা হলাম। প্রয়ােজনীয় এই সামগ্রীগুলাে তখন এখানে খুবই দুষ্প্রাপ্য। সাথে আরও একটি দুষ্প্রাপ্য বস্তু নিতে ভুল করলাম না, আর তা হচ্ছে আমার মাসিক বেতনের ৪শ’ ভারতীয় রুপী। বিটুলদের কাছে শেষের এই বস্তুটির দুষ্প্রাপ্যতাই বােধ করি সব থেকে বেশী। ফটিকছড়ার এই শিবিরে মেজর ভূঁইয়া ছাড়া আর কারােরই তেমন নগদ অর্থের প্রয়ােজন হয় না। আমাদের মধ্যে একমাত্র মেজর ভুইয়া বিবাহিত এবং তার স্ত্রী আগরতলাতেই থাকেন। তাছাড়া এখানে বাংলাদেশের তেমন কেউ অর্থের জন্যে আমাদের উপর নির্ভরশীলও ছিলাে না। সে কারণে। ন্যূনতম হাত খরচ ছাড়া আমাদের অর্থের কোনাে প্রয়ােজন হতাে না। | নিজেই জীপ চালিয়ে বিকেলে গিয়ে পৌছলাম বিটুলদের বাসায়। কিন্তু নির্দিষ্ট চৌচালাটির মধ্যে কোনাে জনমুনিষ্যি আছে বলে মনে হলাে না। বারান্দায় উঠে দরজায় তালা ঝােলানাে দেখে সহসা চমকে উঠলাম। তাহলে কি বিটুলরা এখানে নেই? নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হলাে। অনেকদিন বিটুলদের খোজ-খবর নেয়া হয়নি। কি জানি হয়তাে ওরা চলে গেছে অন্য কোথাও। আবার কোনাে দুর্ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয়। এই সব চিন্তাভাবনার মধ্যে নিঃশব্দে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম আরও কিছুক্ষণ। অনুশােচনায় নিজের বিরুদ্ধেই মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাে। | তবুও যাহােক একটা খবর নিয়ে যাওয়া প্রয়ােজন।
কি ভেবে পাশের একটি ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন এক বয়স্ক মহিলা। তিনি বিটুলদের খবর দিয়ে বললেন, ওরা সবাই আজ সকালেই কি কাজে আগরতলা গেছে। ফিরতে রাতও হতে পারে। | যাক, তবুও একটা খবর তাে পাওয়া গেলাে। কিন্তু বিটুলদের জন্যে রাত অবধি অপেক্ষায়। থাকা সম্ভব নয়। হাতের চ-চিনির পােটলাগুলাে বিটুলদের দেয়ার জন্যে ওই মহিলার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সেদিনকার মতাে ফিরে এলাম শিবিরে। শিবিরের অদূরে নিচে সমতল ভূমিতে ঘন সবুজ চা বাগানের ওপর দিয়ে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে শুরু করেছে অলক্ষ্যে, নিঃশব্দে। স্বাট সেদিন খুব ভােরে মেজ ভূইয়ার হাকডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলাে। তাবু থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিনি গত রাতে ডিউটিরত সেট্রিদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে উত্তেজিতভাবে হাত পা নেড়ে কি যেনাে বলছেন। প্রথমতঃ ভেবেছিলাম শিবিরে কোন গুরুত্বপূর্ণ অঘটন ঘটেছে। কিন্তু কাছে গিয়ে জানলাম যা ঘটেছে তা অঘটন সন্দেহ নেই, বিশেষ করে মেজর ভূঁইয়ার দৃষ্টিতে। তবে এই অঘটন আদৌ কোন গুরুত্ব বহন করে না। বিষয়টি এই রকম ? আমাদের শিবিরে টয়লেটে যাবার পথে কাঁঠাল গাছে একটি রিষ্টপুষ্ট কাঁঠালের প্রতি সহসা একদিন চোখ পড়ে মেজর ভূঁইয়ার। এরপর থেকে তিনি প্রায় প্রতিদিনই ওই বাড়ন্ত কাঠালটির তদারকী করতেন। শিবিরের অনেককেই ডেকে এই কাঠালটি বারকয় দেখিয়েছেন তিনি। পরিস্থিতির কারণে কাঠালের প্রতি আদৌ কোনাে আগ্রহ না থাকলেও মেজর ভূঁইয়ার কাঁঠাল সমাচার আমাদেরকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে হয়েছে অনেক দিনই। কিন্তু আজ ভােরে টয়লেটে যাবার পথে ওই অমূল্য বস্তু পরিদর্শনে মেজাজ বিগড়ে যায় ভূঁইয়ার। তিনি এ সময় দেখতে পান যে তার প্রিয় কাঁঠালটি আর আগের মতাে অক্ষত অবস্থায় নেই। তার নিচের দিকের অর্ধেকটা বিলুপ্ত হয়েছে অদৃশ্য কারণে। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ক্ষীপ্ত মেজর ভূঁইয়ার হাঁকডাক।
টয়লেটে যাবার পথে আমি নিজেও একবার দেখলাম দৃশ্যটি। পাছে তখনাে ঝুলে থাকা অর্ধাংশ কাঠাল দেখে এর খাদককে আমারও খুব বেরসিক মনে হলাে। ভােজনপ্রীতি ছিলাে মেজর ভূঁইয়ার চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। তার প্রাত্যহিক কথাবার্তায় এই ভােজন বিলাশের প্রাধান্য ছিলাে লক্ষ্যণীয়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তার বাস্তবায়ন সব সময় সম্ভব হয়ে উঠতাে না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মেজর ভূঁইয়া সস্ত্রীক চলে আসেন ভারতে। স্ত্রীকে তিনি একটি ভাড়া বাসায় রেখে দেন আগরতলায়। তিনি সন্তানসম্ভবা। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও এই সংক সময়ে মেজর ভুইয়া স্ত্রীকে সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য দিতে পারছেন না। যে কারণে সদ্য বিবাহিতা তরুণী স্ত্রী তার জীবন থেকে উইয়াকে এক রকম বাদ দিয়েই রেখেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নিবেদিত প্রাণ মের ভূঁইয়াকে এই নিয়ে অবশ্য কখনাে বিষণ হতে দেখিনি। ওই দিন রাতেই সেন্ট্রির ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলাে। রাতের মহড়া শেষ করে কেবল ঘুমিয়েছি। মাথার কাছেই রাখা ছিলাে এসএমজি। আকস্মিক ঝাকুনিতে লাফিয়ে উঠে প্রথমেই প্রিয় অস্ত্রটি কা করে নিলাম। এ সময় কানের কাছে মুখ এনে সেন্ট্রি ফিসফিস করে যা বললাে তাতে প্রথমতঃ মেজাজই বিগড়ে গেলাে। কিন্তু তারপরেও একটি কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসলাে। সেন্ট্রি জানালাে রাতের অন্ধকারে কে একজন লাফিয়ে লাফিয়ে মেজর ভূঁইয়ার কাঁঠালটি গলাধঃকরণ করছে। কাঁঠালের মালিক মেজর ভূঁইয়াকে বিষয়টি জানানাে হলাে ঘুম থেকে জাগিয়ে। তারপর আমরা এক সাথে ধির পায়ে এগিয়ে গেলাম কাঁঠাল গাছের দিকে। এ চোর কে তা জানতেই হবে। গাছের কাছাকাছি একটি অবস্থান পর্যন্ত এগিয়ে হঠাৎ টর্চের আলাে ফেলা হলাে অকুস্থলে। এরপর স্বচ্ছ আলােয় যে দৃশ্য দৃষ্টিগােচর হলাে তাতে আমাদের সবার চোখই। বিস্ময়ে চড়কগাছ। উজ্জ্বল হয়ে ছড়ানাে টর্চের আলােতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম মাঝারি আকারের একটি ভাল্লুক লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁঠালের বাকি অংশটুকুও পেটে চালান করার চেষ্টা করছে। টর্চের আকস্মিক আলােতে পড়ে সে খানিকটা বিরক্তই হলাে যেনাে। একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাে আমাদের দিকে। বিপুল বিতৃষ্ণা তার চোখেমুখে। অতঃপর শেষ বারের মতাে এটো কাঁঠালটির দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত হতাশ ভঙ্গিমায় এগিয়ে গেলাে নিকটস্থ অরণ্যের দিকে। যেনাে খাদ্যাহারের সময় এমন একটি অভদ্র আচরণ সে আশাই করেনি।
একষট্টি ১৯ নবেম্বর খুব ভােরে প্রচণ্ড কামানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলাে। মুকুন্দপুরে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভারতীয় ১৮ রাজপুত সেখানে পাকিস্তানী অবস্থান ঘিরে ফেলে মধ্যরাত থেকেই। খুব ভােরে ভারতীয় গােলন্দাজের সহায়তায় ২ ইস্ট বেঙ্গলের সদ্যাগত অফিসার সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট সাইদ একটি কোম্পানীর সাহায্যে শক্রর অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েছে। ১১ ইস্ট বেঙ্গলকে সতর্ক অবস্থায় আনা হলাে সকাল থেকেই। সেদিন ছিলাে ঈদ। সকালে প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দের মধ্যেই ১১ ইষ্ট বেঙ্গল শিবিরে অনুষ্ঠিত হলাে ঈদের জামাত। সৈনিক এবং অফিসারদের অনেকেই বিষন্ন মন নিয়ে যােগ দিলাে নামাজে। | মােনাজাতের সময় ইমাম অঝােরে কাঁদছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্যে সৃষ্টিকর্তার অনুকম্পা চাইলেন। ঢাকার পাকিস্তানী রেডিওতে বলা হলাে যে সেখানে নাকি দেশপ্রেমিক বাঙালী মুসলমানেরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা এবং তাদের ভাষায় সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ থেকে দেশ মুক্ত করার জন্যে আল্লাহর অনুকম্পা চেয়ে মােনাজাত করেছে। ঈদের নামাজের পরপরই কর্নেল সফিউল্লাহর জরুরী তলব পেয়ে মেজর নাসিম এবং আমাকে ছুটে যেতে হলাে মুকুন্দপুরের দিকে। যুদ্ধ তখনাে চলছে। পাকিস্তানীরা এখানে শক্তিশালী প্রতিরােধ ব্যুহ রক্ষা করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে কর্নেল সফিউল্লাহ জরুরী ভিত্তিতে ৮১ মিলিমিটার মর্টারের গােলা পাঠাবার নির্দেশ দিলেন। দুপুরের মধ্যেই এ ধরনের শ’ দুয়েক গােলা পৌছে দেয়া হলাে মুকুন্দপুরে। নিকটবর্তী অবস্থানগুলাে থেকে এ সময় পাকিস্তানী বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল মুকুন্দপুরে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অবস্থানের সাথে পুণঃসংযােগের চেষ্টা চালায়। কিন্তু রাজপুত ও ২ ইস্ট বেঙ্গলের অবরােধের কারণে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। বিকেলের আগেই ৩১ জন পাকিস্তানী সৈনিক সাঈদের কাছে অস্ত্র সমপণ করে।
পরদিন সকালে গােলন্দাজের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীদের একটি ভারী সেনাদল কোনাে বাধা ছাড়াই মুকুন্দপুরে প্রবেশ করলাে। বাধা না থাকারই কথা সেখানে। কেননা এর আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ রাজপুত ও ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধারা মুকন্দপুর ছেড়ে চলে যায় । তুমী দখলের জন্যে যেহেতু এই অভিযানটি পরিচালিত হয়নি, সেহেতু পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়েই মুকুন্দপুর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র সপ্তাহখানেক আগে মুকুন্দপুর থেকে সেনা প্রত্যাহারের ভারতীয় সিদ্ধান্তটি কৌশলগত প্রশ্নে ছিলাে বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন। মুকুন্দপুরে দখলি ভূমী ধরে রাখার মধ্যদিয়ে ভারতীয়রা সেখানে একটি আক্রমণ শলাকার উপস্থিতি ধরে রাখতে পারতাে যা কিনা মুকুন্দপুর ও শাহবাজপুর অঞ্চলে একটি সম্ভাব্য অক্ষ হিসেবেই পাকিস্তানী সমরবিদদের কাছে প্রতিমান হতাে। ফলে অবধারিতভাবেই ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ আখাউড়া বা কসবার বিস্তৃত অঞ্চলের প্রতিরক্ষা হালকা করে এই অক্ষের প্রতিরক্ষা খানিকটা হলেও ভারী করে তুলতেন। এ ক্ষেত্রে ২৭ ব্রিগেডের অধীন তিনটি সম্ভাব্য অক্ষকেই সাদুল্লাহ আগলে রাখতে বাধ্য হতেন সমান গুরুত্ব দিয়ে। এর ফলে ২৭ ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটতাে একটি বিশাল এলাকাজুড়ে যা সাদুল্লাহ বা তার ব্রিগেডের পক্ষে সামাল দেয়া দুঃসাধ্য হতাে। এভাবে মুকুন্দপুর থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিপরীতে সেখানকার দখলীকৃত ভূমী ধরে রাখার সিদ্ধান্ত যে পরিণতি বয়ে আনতাে, তা এই অঞ্চলে কৌশলগত প্রশ্নে ভারতের অনুকূলে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে দিতে পারতাে।
ওই বিকেলে এক ফাঁকে বিটুলদের দেখতে গেলাম। ঘরের বারান্দায় উঠতেই প্রথম মুখােমুখি হলাম তার বাবার সাথে। ভদ্রলােক আজ লুঙ্গির উপর একটি পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবী। পরেছেন। ঈদের দিনের জন্যেই সম্ভবতঃ এই ভিন্নতা। পায়ের শব্দ পেয়ে একবার তাকালেন। আমার দিকে। তারপর কোনাে কথা না বলে পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন যথাস্থানে। বিটুলের বুলু সামান্য মলিন হাসি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালাে। তার সাথে বিটুলকেও দেখলাম। কেমন আছেন? অনেক দিন পরে এলেন। ভালাে। সময় পাই না। তাই আসা হয়ে ওঠে না। আপনি এসেছিলেন শুনেছি। আপনার দেয়া চা চিনি দুধ সবই পেয়েছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। যদিও এতাে কিছুর দরকার ছিলাে না। এর জবাবে আমার কোনাে কথা নেই। কিংবা থাকলেও ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়লাে না। যে কারণে বােকার মতােই তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ বিটুলের বুবুর দিকে। বসুন, আপনার দুধ-চিনি দিয়েই আপনাকে চা করে দেই। লিটুলের সাথে কথা বললাম এটা সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ। এরপর চা এলাে। চা খেয়ে শিবিরে ফিতে সেদিনও প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলাে। ফেরার পথে সারাক্ষণই মনে হচ্ছিলাে বিটুলের নুনু আসলেই খুব সুন্দর মেয়ে। বাষটি রণাঙ্গনব্যাপী যৌথবাহিনীর সমাবেশ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে সমন্বিতভাবে এখন পাকিস্তানী বাহিনীর মুখােমুখি দাঁড়ানাের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়ার উত্তর ভাগ সামনে রেখে সিঙ্গারবিল এলাকায় তাদের অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করেছে। মেজর মতিনের নেতৃত্বে দুটি মিশ্রিত কোম্পানীও একই স্থানে নিয়ােজিত রয়েছে।
অপরদিকে আগরতলার উত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কোনাে পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে ১১ ইস্ট বেঙ্গলকেও প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়া হলাে। এই নির্দেশের আওতায় ১১ ইস্ট বেঙ্গল হরষপুর-মনতলা অক্ষ বরাবর প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণের আয়ােজন সম্পন্ন করবে। এই এলাকায় অবস্থান গ্রহণের প্রশ্নে ভারতীয়দের এমন একটি আশংকা কাজ করছিলাে যে, পাকিস্তানীরা হয়তাে হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার অঞ্চলে নিয়ােজিত তাদের ৩১৩ ব্রিগেড দিয়ে আগরতলার পশ্চাদ্ভাগে একটি ঝুঁকিপূর্ণ হামলা চালাতে পারে। এই হামলার সম্ভাবনার ব্যাপারে তেমন কোনাে যুক্তি না থাকলেও ভারতীয়রা বিষয়টিকে পুরােপুরি উড়িয়ে দিতে পারলাে না। ২৫ নবেম্বর থেকে ১১ ইস্ট বেঙ্গল ফটিকছড়া শিবির ছেড়ে সীমান্তে অবস্থান নেয়া শুরু করে। ‘ডি’ কোম্পানী নিয়ে আমি আমার বহু পরিচিত কলকলিয়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাই এবং হরষপুর সামনে রেখে বাদল বাবুর পরিত্যক্ত চা বাগানের উত্তর দিক বরাবর অবস্থান নেই। আমার বাঁয়ে নজরুলের ‘সি’ কোম্পানী এবং ডানে ভূইয়ার ‘বি’ কোম্পানী। ‘এ’ কোম্পানীর অবস্থান ছিলাে খানিকটা পেছনে। আরও পেছনে অবস্থান নিয়েছে ৩.৭ ইঞ্চি হালকা কামানে সজ্জিত নিয়মিত বাহিনীর ‘মুজিব ব্যাটারী। | ‘এস’ ফোর্সের অধীনস্থ ২ এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট—এই দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। ৫৭ ডিভিশন আখাউড়াকে সামনে রেখে সমাবেশ ঘটিয়েছে আগরতলা শহরের পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে। | পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনীর ৪ কোরের লক্ষ্য হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মেঘনার পূর্বাঞ্চলে পুরােপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ প্রচণ্ড আঘাতে মেঘনার পূর্ব তীর বরাবর শত্রু বাহিনীকে ধ্বংস করে সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহের মাথায় সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালি ও চট্টগ্রাম দখল করে নেয়া। এই সেক্টরের মধ্যাঞ্চল বিশেষ করে আশুগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘনা তটরেখা কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্ব বহন করে। কেননা ভারতীয় বাহিনীর এ অঞ্চল দখল প্রথমতঃ ঢাকাকে লাইফ লাইন চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। দ্বিতীয়তঃ এই দখলী নিয়ন্ত্রণ ঢাকার সাথে সংযােগকারী মেঘনার তীর বরাবর আড়াআড়িভাবে অবস্থিত আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর—এই তিনটি প্রবেশদ্বারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযােগ এনে দেবে। এর ফলে খােদ ঢাকায় আঘাত হানার বিষয়টিও তখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়াবে মাত্র, যদিও ঢাকা দখল ৪ কোরের যুদ্ধ পরিকল্পনায় তখনাে পর্যন্ত স্থান পায়নি। | সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুমিল্লা ও শমসেরনগর বিমান বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। আগরতলা ও কুম্বিগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম তেমন কোনাে বিমানবন্দর ভারতের ছিলাে না। মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই আগরতলা বিমান বন্দর তার কার্যকারিতা অনেকটা হারিয়ে ফেলে। নিকটবর্তী আখাউড়ার যে।
কোনাে সীমান্ত চৌকি থেকে হালকা অস্ত্রের সাহায্যেই এই বিমান বন্দরটি পুরােপুরি অকেজো করে ফেলা সম্ভব। এ অবস্থায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণাত্মক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে কুমিল্লা ও শমসেরনগর বিমান বন্দরের কর্তৃত্ব লাভ এবং সেই সাথে আগরতলা বিমান বন্দরকে কার্যক্ষম করে তােলার জন্যে আখাউড়ার দখল ৪ কোরের জন্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। | পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ কোরের অধীনস্থ ৮ মাউন্টেন ডিভিশনকে সিলেটে যুদ্ধের জন্যে মনােনীত করা হয়। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয় আখাউড়া- ব্রাহ্মণবাড়িয়া অক্ষ বরাবর অবস্থিত সিলেটের দক্ষিণ ও কুমিল্লার উত্তর এলাকা দখলের। স্বল্পতম সময়ে আখাউড়ার দখল নিশ্চিতকরণের বিষয়টি প্রাধান্য পেলাে ৫৭ ডিভিশনের মূল আক্রমণ পরিকল্পনায়। ৬১ মাউনটেন ব্রিগেডকে সরাসরি ৪ কোরের নিয়ন্ত্রণাধীনে ময়নামতি ও তার | পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের যুদ্ধের জন্যে রাখা হলাে। ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জন্যে নির্ধারণ করে দেয়া হলাে কুমিল্লা ও কুমিল্লার দক্ষিণ এলাকা এবং নােয়াখালি ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। অর্থাৎ ২৩ মাউন্টেন আঘাত হানবে মূলতঃ লাকসাম, চাঁদপুর ও ফেনীর বিস্তৃত অঞ্চলে এবং সেই সাথে এই বাহিনীর অপর একটি শলাকা আক্রমণ চালাবে চট্টগ্রামে। তিনটি সেনা ডিভিশনকেই দুই। থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের নির্দেশ দেয়া হলাে। | বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গণে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর আটটি নিয়মিত ব্যাটালিয়নকে ৪ কোরের অধীন উপরােক্ত তিনটি ডিভিশনের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়। অর্থাৎ এই রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্যাটালিয়নগুলাে চূড়ান্ত যুদ্ধে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর সাথে আক্রমণে অংশ নেবে। যৌথ কমাণ্ড গঠনের এই প্রক্রিয়ায় ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল চলে যায় ৫৭ ডিভিশনের নিয়ন্ত্রণে। একইভাবে ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল ভারতীয় ৮ মাউন্টেন এবং ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল ভারতীয় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে অর্পিত হয়। অপরদিকে উত্তর রণাঙ্গনে ৩৩ কোরের অধীন ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে শিলিগুড়ি করিডাের ও বালুরঘাট উচ্চভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও দিনাজপুরসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জনপদ দখলে আনার দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধ শুরুর অনূর্ধ্ব এক সপ্তাহর মধ্যেই এই জনপদগুলাে দখলে আনার নির্দেশ প্রদান করা হলাে। এই নির্দেশের আওতায় ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে একই সময়ে অপর একটি অক্ষ রেখা ধরে হিলি দখল করে অগ্রসর হতে হবে গাইবান্ধার দিকে। এখানে তাদের আঘাতের লক্ষ্যস্থল হবে উত্তরাঞ্চলের ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থিত সেনা অবস্থানসমূহ। এই অঞ্চলে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখি পাকিস্তানীদের যােগাযােগ রেখা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার নিশ্চয়তা নির্ভর করবে এই আঘাতের সফলতার ওপরই। এরপর পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ডিভিশনটির মূল আক্রমণ শলাকা অগ্রসর হবে আরও উত্তরে রংপুর কিংবা সরাসরি দক্ষিণে বগুড়ার দিকে। | রাজস্থান থেকে নিয়ে আসা ৩৪০ ব্রিগেডকে অতিরিক্ত ব্রিগেড হিসেবে ২০ মাউটেনের অধীনে হিলি কমপ্লেক্সের যুদ্ধের জন্যে মনােনীত করা হলাে। ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপকে নির্দেশ দেয়া হলাে উত্তরে আত্রাই নদীর দু’কূল বরাবর পঞ্চগড়-ঠাকুরগ। অক্ষে অগ্রসর হয়ে আত্রাই সেতুর কাছাকাছি সৈয়দপুর সড়কে অগ্রসরমান ২০ মাউন্টেনের উত্তরমুখি শলাকার সাথে সংযােগ স্থাপনের। এই মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপটিকে ক’দিন আগে তুলে আনা হয়েছে নাগাল্যাণ্ড থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ব্রিগেডটি যুদ্ধ করবে ৩৩ কোরের অধানে।
শিলিগুড়ি করিডােরে মােতায়েন ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের অপর একটি ব্রিগেডকেও নিয়ে আসা হয় রংপুরের উত্তরে। ৯ মাউন্টেন নামে পরিচিত এই ব্রিগেডটিকে মােতায়েন করা হলাে | তিস্তার উত্তরাংশে তিস্তা পকেট দখলের জন্যে। | স্বতন্ত্র ফরমেশন ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধীনে আপাততঃ একটি নয়মিত ভারতীয় ব্রিগেড এবং ভারতীয়দের সংমিশ্রনে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটাবার পরিকল্পনা নেয়া হয়। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে মােতায়েন পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে | আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে তাদের ধ্বংস করার দায়িত্ব দেয়া হয় এই বাহিনীর ওপর। | দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত যশাের এবং তদসংলগ্ন দক্ষিণ অঞ্চল মুক্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হয় ৯ পদাতিক ডিভিশনের ওপর। একই সাথে যশাের সেক্টরের মুখ অঞ্চল | যেমন ঝিনাইদা, মাগুরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর প্রভৃতি মুক্ত করার নির্দেশ | দেয়া হলাে ৪ মাউন্টেন ডিভিশনকে। এই দুটি ডিভিশনই ২ কোরের অধীনে থেকে সঞ্চালিত হবে নির্দেশিত অবস্থানগুলাের দিকে। | সাঁজোয়া বহরের ক্ষেত্রে ৪ কোরকে দেয়া হয় সােভিয়েত নির্মিত দুটি পিটি-৭৬ উভচর। | ট্যাংক স্কোয়াড্রন। ৩৩ কোরকে দেয়া হলাে একটি পূর্ণাঙ্গ পিটি-৭৬ ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং অপর দুটি টি-৫৫ মাঝারি ট্যাংক সজ্জিত স্কোয়াড্রন। একটি পিটি-৭৬ ট্যাংক রেজিমেন্ট | এবং অপর একটি টি-৫৫ ট্যাংক স্কোয়াড্রনের সঞ্চালন ঘটে ২ কোরের অধীনে। | ভারতীয়দের সামগ্রিক যুদ্ধ পরিকল্পনায় আক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিটি ডিভিশনের জন্যে একটি মুখ্য আক্রমণ শলাকা রচনার ওপর গুরুত্বারােপ করা হয়। অর্থাৎ সেনা ডিভিশনগুলাের মধ্যে ব্রিগেডের বিভাজন ঘটলেও ভারসাম্য সৃষ্টিতে সহায়ক শক্তিশালী আক্রমণক্ষম শলাকার। | জোরদার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি রণাঙ্গনে। | ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণের এই পটভূমিতে মুক্তিবাহিনীর আনুমানিক এক লাখ যােদ্ধা তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু আরও অন্তত ৪৫ হাজার মুক্তিযােদ্ধা বাংলাদেশের বিস্তৃত সীমান্ত বরাবর অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ততােদিনে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মুক্তিকামী মানুষও তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার জন্যে দেশের মধ্যে পুরােপুরি প্রস্তুত হয়ে আছে।
বাংলাদেশ রণাঙ্গনে শুকনাে মওসুমের শুরুতেই অর্থাৎ অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজিয়ে ফেলতে শুরু করে সম্ভাব্য যুদ্ধের মােকাবেলায়। এ পর্যায়ে পাকিস্তানীরা ভারত সংলগ্ন সীমান্তে ৭০ হাজার সদস্যের পাচটি পদাতিক ডিভিশন মােতায়েনের কাজ সম্পন্ন করে। এর সাথে অতিরিক্ত ৩০ হাজার। সদস্যের আধাসামরিক বাহিনীর এক বিশাল সমাবেশও ঘটানাে হয় মূল বাহিনীকে সহায়তা। প্রদানের লক্ষ্যে। অধিকন্তু আরও ৫০ হাজার রাজাকার, আল-বদর, আলসামস সদস্য | অনুরূপ সহায়তা প্রদানের জন্য সমবেত করা হয় বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। কৌশলগতভাবে পাকিস্তানীরা তাদের নিয়মিত বাহিনীর সমস্ত শক্তি নিয়ােজিত করে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর। এই সমাবেশ অবশ্য প্রথম অবস্থায় ছিলাে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। মুক্তিবাহিনীকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছিলাে বিস্তৃত সীমান্তে। পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে সেই অবস্থা থেকে কোনাে পর্যায়েই তাদেরকে আর প্রত্যাহার করে আনা কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সংকুচিত করার সুযােগ ঘটেনি। কৌশলের প্রশ্নে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সেনাপতি নিয়াজী শুরুতে তার বাহিনীর পুরাে অংশের সীমান্তে সঞ্চালন ঘটানাের বিষয়টিকে একটি স্থায়ী সমাধান হিসেবে গ্রহণ করেন। সীমান্তব্যাপী এই সঞ্চালনের ফলশ্রুতিতে মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে—এমন একটি ধারণা সম্ভবতঃ তার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিস্তৃত সীমান্তব্যাপী মাত্র পাচ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করলেই অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে—আসলে এ ধরনের ভাবনা। ছিলাে একেবারেই বাস্তবতা বর্জিত।
সময় যতােই অতিক্রান্ত হতে লাগলাে ততােই বিষয়টি স্পষ্ট হলাে যে অধিক সংখ্যায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের সীমান্ত বেষ্টনী ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে। সে অবস্থায় সীমিত পর্যায়ে তাদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হলাে। এই পরিবর্তনে মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রশ্নকে আর প্রাধান্য দেয়া হলাে না। কেননা নিয়াজী ততােদিনে এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, সীমান্তে সেনা মােতায়েন করে মুক্তিদের অনুপ্রবেশ ঠেকানাে সম্ভব নয়। ফলে তাদের কাছে তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ালাে ভারতীয় বাহিনী। এ অবস্থায় বাংলাদেশ রণাঙ্গনের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার ভারতীয় বাহিনীর জন্যে দুর্ভেদ্য করে তােলার কাজে সচেষ্ট হলেন নিয়াজী। তবে তার সামগ্রিক এই পরিকল্পনায় গােটা রণাঙ্গনে সেনা সঞ্চালনে তেমন কোনাে পরিবর্তন আনা হলাে না। ফলে বাংলাদেশের সমগ্র সীমান্তব্যাপী তাদের একটি মাত্র প্রতিরক্ষা ব্যুহই থেকে গেলাে পূর্বাপর। মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের এই নবতর সন্ধিক্ষণে চারদিককার দৃষ্টিগােচর আলামতে এটা সুস্পষ্ট। হয়ে উঠলাে যে মুক্তিযুদ্ধ তার শেষ পর্বে এসে উপনীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে আলােচিত বিষয় এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের সকল সংবাদের শিরােণাম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিবেক জোড়ালাে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধানতা সংগ্রামের প্রতি। | বাংলাদেশের পুরােটাই এখন একটি রক্তাক্ত রণাঙ্গন। অসম জেনেও মুক্তিবাহিনী সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে ভেতরে ও বাইরে লড়ে চলেছে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৯০ ভাগ যােগাযােগ ব্যবস্থাই এ সময়ের মধ্যে কার্যতঃ অচল হয়ে পড়েছে। জাহাজ ডুবিয়ে অচল করে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর। বিদ্যুৎ আর পানি সরবরাহ বন্ধ করে। দেয়া হয়েছে অধিকাংশ স্থানেই। একই সাথে চলছে উপযুপরি সামরিক অভিযান। প্রতিদিনকার এই আঘাতের ফলে শত্রুবাহিনী এখন ক্ষতবিক্ষত। এই পর্যায়ে বিলম্বে হলেও পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর বােধােদয় ঘটে। এবার তারা বুঝে নিলাে যে বাংলাদেশে তাদের আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে এসেছে এবং অচিরেই বাঙালাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ভারত জড়িয়ে পড়বে, যার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে স্পষ্টতঃই দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। পরিণামে অবশ্যম্ভাবী রূপেই সূচিত হবে আরও একটি পাক-ভারত যুদ্ধের এবং দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানের অভ্যুদয়ও ঘটতে পারে এখান থেকেই। | পশ্চিম থেকে বর্ধিত সৈন্য আমদানী করেও পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করা যাবে না, বরক তা করতে গেলে পশ্চিমকেই দুর্বল করে ফেলা হবে—এই উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক কর্তা ব্যক্তিরা তিনটি বিকল্প উদ্ভাবন করে এবং সেই অনুসারে অগ্রস হওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করে। এই বিকল্পগুলাের প্রথমটি হচ্ছে, তাদের দখলীকৃত পূর্বাংশ।
মুক্তিবাহিনীকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছিলাে বিস্তৃত সীমান্তে। পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে সেই অবস্থা থেকে কোনাে পর্যায়েই তাদেরকে আর প্রত্যাহার করে আনা কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সংকুচিত করার সুযােগ ঘটেনি। | কৌশলের প্রশ্নে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সেনাপতি নিয়াজী শুরুতে তার বাহিনীর পুরাে অংশের সীমান্তে সঞ্চালন ঘটানাের বিষয়টিকে একটি স্থায়ী সমাধান হিসেবে গ্রহণ করেন। সীমান্তব্যাপী এই সঞ্চালনের ফলশ্রুতিতে মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে—এমন একটি ধারণা সম্ভবতঃ তার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিস্তৃত সীমান্তব্যাপী মাত্র পাচ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করলেই অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে—আসলে এ ধরনের ভাবনা ছিলাে একেবারেই বাস্তবতা বর্জিত। সময় যতােই অতিক্রান্ত হতে লাগলাে ততােই বিষয়টি স্পষ্ট হলাে যে অধিক সংখ্যায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের সীমান্ত বেষ্টনী ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে। সে অবস্থায় সীমিত পর্যায়ে তাদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হলাে। এই পরিবর্তনে মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রশ্নকে আর প্রাধান্য দেয়া হলাে না। কেননা নিয়াজী ততােদিনে এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, সীমান্তে সেনা মােতায়েন করে মুক্তিদের অনুপ্রবেশ ঠেকানাে সম্ভব নয়। ফলে তাদের কাছে তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ালাে ভারতীয় বাহিনী। এ অবস্থায় বাংলাদেশ রণাঙ্গনের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার ভারতীয় বাহিনীর জন্যে দুর্ভেদ্য করে তােলার কাজে সচেষ্ট হলেন নিয়াজী। তবে তার সামগ্রিক এই পরিকল্পনায় গােটা রণাঙ্গনে সেনা সঞ্চালনে তেমন কোনাে পরিবর্তন আনা হলাে না। ফলে বাংলাদেশের সমগ্র সীমান্তব্যাপী তাদের একটি মাত্র প্রতিরক্ষা ব্যুহই থেকে গেলাে পূর্বাপর।।
মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের এই নবতর সন্ধিক্ষণে চারদিককার দৃষ্টিগােচর আলামতে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠলাে যে মুক্তিযুদ্ধ তার শেষ পর্বে এসে উপনীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে আলােচিত বিষয় এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের সকল সংবাদের শিরােণাম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিবেক জোড়ালাে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি। বাংলাদেশের পুরােটাই এখন একটি রক্তাক্ত রণাঙ্গন। অসম জেনেও মুক্তিবাহিনী সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে ভেতরে ও বাইরে লড়ে চলেছে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ ভাগ যােগাযােগ ব্যবস্থাই এ সময়ের মধ্যে কার্যতঃ অচল হয়ে পড়েছে। জাহাজ ডুবিয়ে অচল করে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর। বিদ্যুৎ আর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অধিকাংশ স্থানেই। একই সাথে চলছে উপযুপরি সামরিক অভিযান। প্রতিদিনকার এই আঘাতের ফলে শত্রুবাহিনী এখন ক্ষতবিক্ষত। | এই পর্যায়ে বিলম্বে হলেও পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর বােধােদয় ঘটে। এবার তারা বুঝে নিলাে যে বাংলাদেশে তাদের আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে এসেছে এবং অচিরেই বাঙালাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ভারত জড়িয়ে পড়বে, যার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে স্পষ্টতঃই দৃষ্টিগােচর হতে শুরু করেছে। পরিণামে অবশ্যম্ভাবী রূপেই সূচিত হবে আরও একটি পাক-ভারত যুদ্ধের এবং দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানের অভ্যুদয়ও ঘটতে পারে এখান থেকেই।
পশ্চিম থেকে বর্ধিত সৈন্য আমদানী করেও পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করা যাবে না, বরঞ্চ তা করতে গেলে পশ্চিমকেই দুর্বল করে ফেলা হবে—এই উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক কর্তা ব্যক্তিরা তিনটি বিকল্প উদ্ভাবন করে এবং সেই অনুসারে অগ্রসর কেহ যমুনায় মনে করে। এই বিকল্পগুলাের প্রথমটি হচ্ছে, তাদের দখলীকৃত পূর্বাংশে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করা এবং পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের ভাষায় আক্রমণকারী বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে একটি পর্যায় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা, যাতে করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে ভারতের সাথে গ্রহণযােগ্য একটি নিস্পত্তি অর্জন করা যায়। দ্বিতীয়তঃ এই অঞ্চলের সামরিক পরাজয়ের ঘাটতি পূরণে পশ্চিমে ভারতের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বিজয় অর্জন করা, যাতে করে এই বিজয় থেকে দখলীকৃত ভারতীয় ভূখণ্ডের বিনিময়ে পূর্বাংশে বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে একটি অনুকূল রাজনৈতিক মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায়। তৃতীয় ও শেষ বিকল্পটি হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশের নেতাদের সংগে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযােগ্য একটি সমঝােতায় পৌছানাের উদ্যোগ নেয়া। | কলকাতার মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগের শক্তিশালী একাংশের সাথে ইতিমধ্যেই সংলাপের একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। ওয়াশিংটন এবং ইসলামাবাদ উভয়ই এই সংলাপ প্রক্রিয়ার শুরুতে উৎসাহ প্রদর্শন করে। কিন্তু ভারত সরকার এক পর্যায়ে ঘটনাটি জানার পর সংগত কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং এই উদ্যোগের বিপক্ষে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ফলে সংলাপ প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে যায়। যে কারণে পাকিস্তানের তিনটি বিকল্প ব্যবস্থার শেষটির মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার কোনাে সম্ভাবনাই আর থাকলাে না। এ অবস্থায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্প দুটিকে অবলম্বন হিসেবে তাদেরকে বেছে নিতে হলাে। আর এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানী সমরবিদরা বাংলাদেশ রণাঙ্গনের বিস্তৃত সীমান্ত রেখায় তাদের প্রাপ্ত সমর শক্তির পুরােটাই নিয়ােজিত করার মাধ্যমে একটি মাত্র প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে, যাতে প্রয়ােজনে এই প্রতিরক্ষা ব্যুহকে সংকুচিত করে ক্রমান্বয়ে মধ্যাঞ্চলের দিকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। পরিশেষে ঢাকাকে কেন্দ্র করে তারা বৃত্তাকার প্রতিরক্ষা ব্যুহ সৃষ্টির মধ্যদিয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের কাংক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। বলাই বাহুল্য পশ্চিম রণাঙ্গনে তাদের বিজয়ের ব্যাপারটি এই পরিকল্পনায় সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় অগ্রাধিকারের প্রশ্নে। |
সামগ্রিক এই পরিকল্পনার পাশাপাশি আসন্ন যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে জেনারেল নিয়াজী শহরকেন্দ্রিক যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নে সচেষ্ট হলেন। তিনি যশাের, ঝিনাইদা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ভৈরব, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামকে প্রতিরক্ষা দুর্গে পরিণত করার নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ এ সমস্ত শহরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলাই এই নির্দেশের মূল কথা, যাতে এই শহরগুলােতে অগ্রসরমান বাহিনী বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। এইসব দুর্গশহরের সবকটিই সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ রেখা বরাবর অবস্থিত। এর প্রতিটি ঘাটিতে ৬০ দিনের রসদ ছাড়াও ন্যূনতম ৪৫ দিনের রেশন জমা করা হলাে। | কৌশলের প্রশ্নে জেনারেল নিয়াজী ডিভিশন কমাণ্ডারের অনুমতি ব্যতিরেকে সীমান্তে নিয়ােজিত বাহিনীর যে কোনাে ধরনের পশ্চাদপসরণ নিষিদ্ধ করলেন। ক্ষেত্র বিশেষ কৌশলগত পশ্চাদপসরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে সেই প্রক্রিয়াকে যতােটা সম্ভব বিলম্বিত করার জন্যে বলা হলাে। অর্থাৎ অবস্থানে টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়লে কেবল সে ক্ষেত্রেই পিছু হটা যাবে এবং এই রকম পরিস্থিতিতে পশ্চাদপসরণরত বাহিনীকে নিকটবর্তী দুর্গ শহরে এসে আশ্রয় নিতে হবে। পিণ্ডির সেনা সদরের কর্তা ব্যক্তিরা নিয়াজীর গৃহীত এই পরিকল্পনা হুবহু অনুমােদন করলেন। তবে সেই সাথে তারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষার বিষয়টি অনুধাবনের প্রতি গুরুত্বারােপ করলেন সর্বাধিক। চৌষটি নবেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতেই বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গনে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায়। এবং পরিস্থিতি চুড়ান্ত যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। যশোরের চৌগাছা সীমান্তে ব্যাপক সংঘর্ষের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের এই পূর্ণাঙ্গতা আসে। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের। স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধ।
২১ নবেম্বর চৌগাছায় পাকিস্তানী বাহিনী প্রথম বারের মতাে শক্তি পরীক্ষায় নামার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে ২০ নবেম্বর ভারতীয় বাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী ১৪টি পিটি-৭৬ ট্যাংকের ছত্রছায়ায় বয়রা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের কিছুটা অন্তরে মুক্ত এলাকায় ঢুকে পড়ে। এই সঞ্চালনের উদ্দেশ্য ছিলাে। সম্ভবতঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রৱােচিত করা। পাকিস্তানীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সম্ভবতঃ তার শাস্তি প্রদানের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলাে সীমিত আকারের এই যুদ্ধে ভয়াবহ প্রত্যাঘাত করার মাধ্যমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ সীমিত থাকেনি বয়রাচৌগাছার সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে । পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে এক স্কোয়াড্রন পরিমাণ এম-২৪ সেফী ট্যাংক এবং গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় কুয়াশাচ্ছঃ -বে মিত্রবাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। দুটা স্থায়ী এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলাে। তাদের ১১ টি ট্যাংক ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি অফিসারসহ সৈনিক হতাহতের সংখ্যা দাড়ালাে ৩ শায়। পরদিন ২৯ নবেম্বর একই স্থানে পাকিস্তানীরা বিমান বাহিনীর সাহায্যে মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনীর ওপর আবারও আক্রমণের সূচনা করে। সেদিন চারটি এফ-৮৬ সেবর জেট বয়রা ও চৌগাছা অঞ্চলের বিভিন্ন অবস্থানে বােমাবর্ষণ শুরু করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীও তৎপর হয়ে ওঠে এই চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায়। দুপক্ষের মধ্যে পাচ মিনিট স্থায়ী বিমান যুদ্ধে ভারতীয় জংগী বিমান পাকিস্তানের তিনটি সেবর জেটকে ভূপাতিত করে। আর এভাবেই পাকিস্তানীদের গুণগত শ্রেষ্ঠত্বের কাল্পনিক ধারণা ভুলুণ্ঠিত হয় যুদ্ধের প্রথম পর্বেই।
এই সীমিত বিজয়ের পর পরই মিত্রবাহিনী যশাের অভিমুখে অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই অভিযানে তারা প্রচলিত গমন পথগুলো পুরােপুরি পরিহার করে চললাে। প্রকৃতিগতভাবে কণ্টকিত এবং একই কারণে কষ্টকর ও অপ্রত্যাশিত একটি অক্ষ রেবা ধরে ভাৰতীয়বা অগ্রসর হলাে যশােরের দিকে। ভারতীয় অগ্রাভিযানের এই অনাকাক্ষিত কৌশল সম্পর্কে আগাম ধারনা পােষণে ব্যর্থতার কারনে তেমন কোনাে প্রতিরােধের সুযােগই পেলাে না সেখানকার প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানের ১০৭ ব্রিগেড। পাবনাহীন পথ ধরে এক ধাক্কাতেই যশােরের কাছাকাছি লােকালয় আড়পাড়া, আফর, বুদি, মােহাম্মদপুর ও দুর্গাবরকাঠিতে পৌছে যায় ভারতীয় বাহিনী। অপরদিকে চৌগাছায় পাক ৫ : পাকিস্তানীরাও আরা-ঝিকরগাছা উত্তর-দক্ষিণ সমান্তরাল রেখায় এসে অবস্থান নেয়। এই সমান্তরাল রেখায় অবস্থিত লােকালয়গুলােকে কেন্দ্র করে ৬, ১২, ” পাঞ্জাবি ও ২২ Fটয়াৰ সোর্স রেজিমে তাৎক্ষণিক প্রতিরােধ : হলতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এই অবস্থান গ্রহণ দীগামী হল না। এখানে পাকিস্থানী সমর নায়কদের সিদ্ধান্তহীনতা চর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে তাদের বাহিনীর মধ্যে। চৌগাছায় যুদ্ধ শুরু হবার পর পরই যশাের থেকে ডিভিশন সদর দফতর মাগুড়ায় সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ডিভিশন অধিনায়ক আনসারী। এ শ্ৰবস্থায় যশােৰ দুগ। রক্ষার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় একই সাথে দুর্গ প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তান বাহিনী। এবং অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে। এই দোদুল্যমান অবস্থাটি প্রকারাস্তরে আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদেরকে।
এদিকে একই সময়ে খানিকটা উত্তরে দর্শনার কাছে জীবননগরে অপর একটি ভারতীয় আক্রমণ রেখার ক্রমাগত বিস্তৃতি দর্শনার নিরাপত্তাকেও বিপত্ন করে তােলে। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে ভারতীয় ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের একটি আক্রমণ শলাকা ক্রমেই জোরালাে হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় দর্শনার নিরাপত্তা বিপন্ন হলে চুয়াডাঙ্গাও হুমকির মুখে পড়বে। এর ফলে একই সাথে ঝিনাইদা, কুষ্টিয়া এবং মাগুড়া অভিমুখে প্রবেশ পথ খুলে যাবে ভারতীয়দের জন্যে। | বাস্তবে হলােও তাই। যুদ্ধ শুরুর প্রথম ঝাপটাতেই দর্শনার পতন ঘটলাে। ব্রিগেডিয়ার আরবাব চুয়াডাঙ্গায় গুটিয়ে নিলেন তার ৫৭ ব্রিগেড। তিনি ধারণা করেছিলেন দর্শনার পর। চুয়াডাঙ্গা আক্রান্ত হবে। কিন্তু তা হলাে না। তাদের প্রত্যাশা মতাে কোনাে অক্ষেই এগুলাে না ভারতীয় বাহিনী। তারা এর পরিবর্তে পাকিস্তানীদের হতবাক করে দিয়ে একটি সড়ক অবরােধের সৃষ্টি করলাে ঝিনাইদা-চুয়াডাঙ্গা সড়কের সাধুহাটিতে। এর ফলে ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে আরও পিছু হটতে হলাে। এবার তিনি তার মুখস্থ গােটা অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে নিলেন কুষ্টিয়ার দিকে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এই বিস্তৃত রণাঙ্গনে প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়টিই মূখ্য বিবেচ্য এবং এটা ভারত পাকিস্তান উভয় পক্ষের জন্যেই সমানভাবে প্রযােজ্য। বলা যায় এই রণাঙ্গন জুড়ে যুদ্ধ যা হয়েছে তা সশব্দ অন্ত্রের নয় বরং নিঃশব্দ মেধা আর কৌশলের। ফলে উভয় পক্ষেই রক্তপাতের ঘটনা এখানে ততােটা তীব্র হয়নি যতােটা। হয়েছে রণকৌশলের প্রতিযােগিতা। বলাই বাহুল্য রণপরিকল্পনার নিপুণ এই মারপ্যাচে এখানে পাকিস্তানীরা প্রাথমিক পর্যায়েই ভারতীয়দের কাছে নাস্তানাবুদ হয়। এখানে ভারতীয়রা প্রতিপক্ষ পাকিস্তানী সমর নায়কদের কোনাে প্রত্যাশাই পূরণ করেনি। পাকিস্তানীদের পরিকল্পনা বহির্ভূত অপ্রত্যাশিত পথে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীগুলাের পেচালাে পরিবেষ্টনে কোনাে রকমে কেবল পিছু হটার পথ অনুসন্ধানের মধ্যেই নিয়ত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে পাকিস্তানী ব্রিগেডগুলােকে। পক্ষান্তরে এই সুপরিকল্পিত পেচালাে অভিযানের নিঃশব্দ অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল রায়না ক্লান্ত হয়েছেন রণাঙ্গন জুড়ে শত্রু খুঁজে বেড়ানাের কাজে। | এই ফ্রন্টে পাকিস্তানীদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিলাে একান্তই গতানুগতিক। তাদের এই পরিকল্পনার আগাম হিসেব ভারতীয়রা যথার্থই বুঝে নিয়েছিলাে। ফলে অভিযানের প্রশ্নে তারা এমন কিছু অপ্রচলিত পথঘাট বেছে নেয় পাকিস্তানীদের কাছে যা ছিলাে অকল্পনীয় এবং হতবাক করে দেয়ার মতােই।
শরু থেকেই পাকিস্তানীরা তিনটি নির্দিষ্ট অক্ষ ধরে ভারতীয়দের আক্রমণ প্রত্যাশা করে এবং সেই অনুযায়ী এই অঞ্চলে তাদের সেনা বিন্যাস ঘটনাে হয়। তারা কলকাতা বেনাপােল যশাের অক্ষাঞ্চলকেই ভারতীয়দের মুখ্য আক্রমণ রেখা হিসেবে ধরে নেয়। তাদের ধারণায় এ ধরনের সম্ভাব্য দ্বিতীয় আক্রমণ রেখাটি হচ্ছে কৃষ্ণগড়–দশন-ঝিনাইদা এবং অনা; মুর্শিদাবাদ-রাজাপুর-কুষ্টিয়া। এই হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের ৯ পদাতিক ডিভিশন তার ১০৭ ব্রিগেডের পুরাে শক্তিরই সমাবেশ ঘটায় বেনাপােল অক্ষের উত্তর-দক্ষিণ সমান্তরাল রেখায়। একই ধারণা থেকে ডিভিশনের অপর ৫৭ ব্রিগেড পদার দক্ষিণ তীরবর্তী রাজাপুর থেকে দর্শনা অবধি দুটি প্রত্যান্ত আক্রমণ রেখা বরাবর তার সমাবেশ ঘটায়। পাকিস্তানীরা এই অঞ্চলে তাদের সামগ্রিক যুদ্ধ পরিকল্পনায় বেনাপােল, দর্শন ও রাজপুরের উত্তর-দক্ষিণ সমান্তরাল রক্ষাব্যুহ আগলে রাখার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে ১০৭ ব্রিগেড যশােরে এবং ৫৭ ব্রিগেডকে ঝিনাইদায় কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করে দুর্গশহর রক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত হতে বলা হয়। পরিকল্পনায় এরপর মধুমতির উত্তর-দক্ষিণ রেখাকে সর্বশেষ প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। | কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীদের এই যুদ্ধ পরিকল্পনার সার তাদের মগজেই থেকে যায়। বাস্তবে তা কোনাে কাজেই আসলাে না। ভারতীয়রা তাদের প্রত্যাশিত কোনাে অঙ্কেই। আক্রমণ চালালাে না। অথচ তারা তাদের অগ্রাভিযান ঠিকই অব্যাহত রাখলাে অশ্বগতিতে। সবশেষে রণকৌশলের এই প্রতিযােগিতার যা সার কথা দাঁড়ালাে তা হচ্ছে প্রতিরােধ ব্যতীত পাকিস্তানীরা ক্রমান্বয়ে পিছু হটলাে এবং একই গতিতে যুদ্ধ ব্যতীত ভারতীয়রা তাদের অভিযান অব্যাহত রাবলাে। এই দৃষ্টিকোন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানীদের জন্যে হতবাক করে দেয়ার মতাে রণকৌশল প্রণয়নের পরিচয় দিয়েছে ভারতীয় সমর পরিকরা-সন্দেহ নেই।
পয়ষট্টি এদিকে নবেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ শেষ হবার আগেই পূর্ব রণাঙ্গনের আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অক্ষাঞ্চলে দুই শলাকা বিশিষ্ট আক্রমণ রচনার জন্যে ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন তার প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে। অপেক্ষা শুধু নির্দেশের। এই ডিভিশনের ৩১১ বিগ্রেড গ্রুপকে আখাউড়া এবং ৭৩ ব্রিগেডকে গঙ্গাসাগর অভিমুখে সঞ্চালন ঘটাবার সিদ্ধান্ত নেন ৫৭ ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল গনজালভেস। এই ডিভিশনের তৃতীয় অংশ মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্স বিগ্রেডকে নিয়ােজিত করা হয় আখাউড়ার উত্তরাঞ্চলে শাহবাজপুর-সরাইল-আশুগঞ্জ অক্ষ বরাবর অগ্রসর হতে। | যৌথবাহিনীর অবশ্যম্বাবী আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ২৭ পদাতিক ব্রিগেউও শ্রাবাউড়ায় তার প্রস্তুতি পর্ব ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে। ২৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সুদক্ষ অফিসার হিসেবে চিহ্নিত, তার অধীনস্থ এলাকায় তিনটি ব্ৰক্ষ বরাবর মিত্রবাহিনীর আক্রমণ প্রত্যাশা করলেন এবং এই ধারণার ওপর। ভিত্তি করেই তিনি তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার বিন্যাস ঘটালেন। | আখাউড়া রণাঙ্গনে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহর উপস্থিতির বিষয়টি অনেকের মতাে আমার কাছে ঃ অর্থবহ মনে হয়েছে শুরু থেকেই। সাদুল্লাহকে লেঃ কর্নেল হিসেবে আমি পাকিস্তান। মিলিটারী একাডেমী কাকুলে দেখেছি বছর তিনেক আগে। সে সময় তিনি আমার প্রশিক্ষক ছিলেন। একাডেমীতে ক্যাডেটদের সমর কৌশল শেখানো ছিলাে তার প্রশিক্ষণ বিষয়। আর এ কারণেই একজন দক্ষ সমরবিদ হিসেবে তিনি শুধু আমার কাছেই নন, অনেকের কাছেই সুপরিচিত। এ জন্যেই আখাউড়াতে সাদুল্লাহর উপস্থিতি যুদ্ধকে যে তীব্র এবং ভয়াবহ করে তুলবে সে বিষয়ে আমার কোনাে সন্দেহ ছিলাে না। সাদুল্লাহর অধীনে ছিলাে দু’টি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং অতিরিক্ত দুটি কোম্পানী। এছাড়াও ছিলাে চারটি ট্যাকে, ১০টি ১০৫ মিলিমিটার কামান, চারটি ভারী মর্টার এবং আরও দুই ব্যাটালিয়নের সম পরিমাণ মিলিশিয়া ও রেঞ্জারস্ বাহিনী। রাজাকারদের একটি বিশাল বাহিনীও সামগ্রিক এই সমর শক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। | ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ আগরতলা-আখাউড়ব্রাহ্মণবাড়িয়া অক্ষকেই জোরালাে আক্রমণ। রেখা হিসেবে চিহ্নিত করেন। সে কারণে তিনি তার অধীনস্থ অভিজ্ঞ সেনা ইউনিট ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে আখাউড়া অক্ষ বরাবর অর্থাৎ আখাউড়ার উত্তর থেকে দক্ষিণে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত মােতায়েন করেন। দ্বিতীয় আক্রমণ রেখা হিসেবে বিশালগড় কসবাব্রাহ্মণবাড়িয়াকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সাদুল্লাহর কাছে। যে কারণে ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টকে তিনি কসবা-সালদানদী-শাহপুর-সায়দাবাদ এলাকায় মােতায়েন করেন। আখাউড়ার উত্তর অঞ্চল বরাবর অর্থাৎ আগতরলা-শাহবাজপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অক্ষে তিনি ১২ আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানীর সঙ্গে আরও একটি অনিয়মিত ব্যাটালিয়নের সমাবেশ ঘটালেন। গােলন্দাজ সহায়তার জন্যে এদেরকে দিলেন চারটি ভারী মর্টার।
১৯ নবেম্বর মুকুন্দপুরের যুদ্ধ সাদুল্লাহকে চিন্তিত করে তােলে। তিনি এই ছােটো আকারের যুদ্ধটিকে ইঙ্গিতবহ মনে করলেন এবং এক পর্যায়ে আগরতলা-শাহবাজপুর অক্ষকেই মূল আক্রমণ রেখা ভাবতে শুরু করেন। এই শাহবাজপুর অক্ষ তার শিরঃপীড়ার বিষয় হয়ে দাড়ায় আরও একটি কারণে। এই অক্ষের দক্ষিণে তার ২৭ এবং উত্তরে ৩১৩ ব্রিগেডের অবস্থান। অর্থাৎ শাহবাজপুর অক্ষের অবস্থিতি ঘটেছে দুটো ব্রিগেডের মধ্যবর্তী স্থানে। এই রকম অবস্থানগত জটিলতায় আক্রমণ বা অনুপ্রবেশ প্রতিরােধের প্রশ্নে দায়দায়িত্ব একে অন্যের ওপর বর্তানাের সুযােগ থেকে যায়, যা বড় ধরনের কোনাে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে সে ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সুযােগ সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যে কারণে তিনি শাহবাজপুর অক্ষে সেনা বিচলনে খানিকটা পুনর্বিন্যাস ঘটালেন। শাহবাজপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্ধে প্রয়ােজনে অতিরিক্ত সৈন্য সঞ্চালনের একটি ছােটখাটো পরিকল্পনাও তৈরী করলেন। তা সত্ত্বেও শাহবাজপুর অক্ষ অরক্ষিতই থেকে গেলাে পূর্বাপর ।। দুর্ভাগ্যবশতঃ আগরতলা-শাহবাজপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অক্ষরেখা পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা মিত্রবাহিনীর কারাে কাছেই তেমন জোরালাে আক্রমণ রেখা হিসেবে প্রতিয়মান হয়নি। অথচ এই অক্ষটি ছিলাে মিত্রবাহিনীর জন্যে একটি নিরাপদ আক্রমণ রেখা। এ ক্ষেত্রে মিত্রবাহিনী অনায়াসে তার একটি আক্রমণ শলাকার সাহায্যে শাহবাজপুর-সরাইল হয়ে নুন্যতম সময়ে আশুগঞ্জ প্রবেশদ্বারে আঘাত হানতে সক্ষম হতাে। এতে করে পাকিস্তানের ২৭ পদাতিক ব্রিগেডের মূল বাহিনী এবং একই সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতর সহজেই বিচ্ছিন্ন করে দেয়া সম্ভব ছিলাে। | অনাদিকে সাদুল্লাহ শাহবাজপুর অক্ষাঞ্চল অরক্ষিত রেখে মারাত্বক কৌশলগত ঝুঁকি নেন। ৫৭ মাউনটেনের দুটি ব্রিগেডের একটির সঞ্চালন এখানে ঘটলে পশ্চারণের প্রয়ােজনীয় সময়ও তিনি সম্ভবতঃ পেতেন না।
সাদুল্লাহর প্রত্যাশা অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনী ৩০ নবেম্বর সন্ধ্যায় আখাউড়া বরাবর তাদের প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। প্রথম প্রচেষ্টাতেই ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড আখাউড়ার তিন মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ৭২টি কামান বিরামহীনভাবে প্রকম্পিত করে তােলে আগরতলা-আখাউড়ার জনপদ। সাদুল্লাহর কামানগুলােও বিস্তৃত রণাঙ্গনব্যাপী বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণ করে চলে। কিন্তু তাদের সেই গােলাবর্ষণের তেমন কোনাে কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হলাে না। ভারতীয় গােলাবর্ষণের তীব্রতার মুখে তাদের কামানগুলাে মাঝেমধ্যেই নিন্দুপ হয়ে যাচ্ছিলাে। মধ্যরাতের আগেই গােলন্দাজ আক্রমণের ছত্রচ্ছায়ায় ভারতীয় বাহিনীর দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন আখাউড়ার। উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে প্রবেশ করে রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানী সমাবেশের পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে আখাউড়ায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর সাথে পশ্চাতের যােগাযােগের জন্যে শুধুমাত্র রেলপথটুকুই খােলা থাকে তখন। তারপরও সাদুল্লাহ্ কি ভেবে আখাউড়ার অবস্থানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। | ৩০ নবেম্বর মধ্যরাতের পর পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ ইস্ট বেঙ্গলও আখাউড়ার উত্তরে সিংগারবিল ও আযমপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। ভাের বার আগেই আযমপুর রেলস্টেশনসহ সিংগারবিলের অধিকাংশ এলাকা ২ ইস্ট বেঙ্গলের দখলে এসে যায়। মেজর মতিনও তার অধীনস্থ দুটি মিশ্রিত কোম্পানী নিয়ে আযমপুরের উত্তরভাগে একটি সাহসী আক্রমণ চালায়। এই দুটি আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী জোরালাে সমর্থন প্রদান করে তাদের। আমরা আমাদের ১১ ইষ্ট বেঙ্গল অবস্থানে পূর্ণ সতর্কাবস্থায় থেকেছি রাতভর। আখাউড়া যুদ্ধের প্রকম্পন আমাদের অবস্থান থেকে ভালভাবেই টের পেলাম সে রাতে। | ভােরে আরও কিছুটা দক্ষিণে গংগাসাগরে ব্রিগেডিয়ার তুলির ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড ট্যাংকের ছত্রচ্ছায়ায় আরও একটি আক্রমণের সূচনা করে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলাে সম্ভবতঃ কসবা এলাকায় নিয়ােজিত ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টকে ২৭ ব্রিগেডের মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। দ্বিপ্রহরের আগেই গংগাসাগর এলাকার সম্মুখ ভাগ মিত্রবাহিনীর দখলে এসে যায়।
রাতের তুলনায় সকালের দিকে আখাউড়া অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকলেও গংগাসাগর এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দুপুর নাগাদ। সেখানে ৩৩ বালুচ পিছিয়ে গিয়ে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এদিকে আখাউড়াতে যৌথবাহিনীর সাফল্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের ১২ ফ্রন্টিয়ার। ফোর্স রেজিমেট ছােটো ছােটো অংশে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের অধিকাংশ অবস্থানে অংশতঃ অক্ষত থেকে যায়। এখানে রেললাইন বরাবর সুরক্ষিত বাংকারে তাদের অবস্থানগুলাে ছিলাে দুর্ভেদ্য। এই শক্তিশালী বাংকারগুলাের অবস্থিতি ছিলাে সীমাস্তুঘেঁষা উত্তর-দক্ষিণ সমান্তরালভাবে চলে যাওয়া রেললাইনের ওপর। এখানে তারা তাদের ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্যাকে বিধ্বংসী কামানের সুনিপুণ সমাবেশ ঘটায়। মিত্রবাহিনী এবং ২ ইস্ট বেঙ্গলের জন্যে এই বাংকারগুলাে বিশেষ পীড়ার কারণ হয়ে দাড়ালাে। ব্যাপক গােলাবর্ষণের পরেও এগুলাে পুরােপুরি অক্ষতই থেকে গেলো। দুপুরের দিকে আখাউড়াতে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেখানে ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের একটি অতিরিক্ত ব্যাটালিয়ন ট্যাংক স্কোয়াড্রনের সহায়তায় নতুন আক্রমণের সূচনা করে। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের কামানগুলাে তখন বিরামহীনভাবে গােলাবর্ষণ করে চলে আখাউড়ার অবস্থানগুলাে লক্ষ্য করে।
সকাল থেকে পুরাে রণাঙ্গন জুড়ে বেশ কয়েক দফায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আক্রমণ ঘটে। দুপুরের দিকে তিনটি সেবর জেট আখাউড়ার কিছুটা দক্ষিণে সম্ভবতঃ গংগাসাগর এলাকায় আক্রমণ চালায়। তাদের প্রতিটি আক্রমণই ভারতীয় বিমান বিধ্বংসী কামানের প্রতিরােধের মুখে পড়ে। এ সময় অবিরাম বিস্ফোরিত গােলার ধোঁয়া অসংখ্য ছাতার মতাে ভাসতে দেখা যায় আকাশে। এদিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলের ডিমাপুরে জড়াে করা হয় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কয়েকজন বাঙালী জঙ্গী বিমান চালককে। বেশ কিছু বেসামরিক বিমান চালককেও সেখানে এদের সাথে একত্রিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে এরা সবাই পক্ষ ত্যাগ করে ভারতে চলে আসে এবং যুদ্ধের শুরু থেকেই বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সিদ্ধান্তের আওতায় এই ডিমাপুরেই প্রথম সৃষ্টি করা হলাে বাংলাদেশের জন্যে একটি ক্ষুদে বিমান বাহিনী। এই বিমান বাহিনীর বহরে দেয়া হলাে ৩টি বিমান। একটি ডিসি ৩ পরিবহন বিমান এবং অপর দুটির একটি এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট হালকা ‘টুইন অটার’ ও দ্বিতীয়টি এলুয়েট ৩ হেলিকপ্টার।। এই টুইন অটার বিমানটিকে একটি বােমারু বিমানে পরিণত করে ফেললাে বাংলাদেশের বৈমানিকরা। হাতের সাহায্যে ধাক্কা দিয়ে বােমা ফেলার একটি ব্যবস্থার সসাংযােজন করা হলাে বিমানটিতে। হেলিকপ্টারটিকেও একইভাবে রকেট ও মেশিনগানে সজ্জিত করা হলাে। এরপর এই বিমান বহরকে প্রস্তুত রাখা হলাে বাংলাদেশে আঘাত আনার জন্যে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই হলাে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মােটামুটি আকার ও শক্তি।।
সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর এই ক্ষুদে বিমান বাহিনী বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সিলেট, শমসেরনগর ও নরসিংদীর বেশ কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে উপুর্যপরী অভিযান চালায়। ২ ডিসেম্বর ভােরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও শমসেরনগরে সর্বপ্রথম যে বিমান আক্রমণ পরিচালিত হয়, তা ছিলাে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীরই পরিচালিত আক্রমণ। বাংলাদেশের বৈমানিকদের গুনগত মান বা দক্ষতার ওপর ভারতীয় সমর কুশলীদের যে একটি ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিলাে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম আক্রমণ চালাবার দুর্লভ সুযােগ প্রদানের মধ্যদিয়ে প্রকারান্তরে তারই প্রতিফলন ঘটে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের বিমান বাহিনী তাদের যােগ্যতা বা সমর্থতার প্রশ্নে ভারতীয়দের কোনােভাবেই আশাহত করেনি। | খুব নিচু দিয়ে উড়ে বিমান বাহিনীর এই দু’টি মান্ধাতা আমলের বিমান প্রতিবারই শত্রুর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে সফল আঘাত হেনে চলে।
যুদ্ধের প্রথম কদিন সেই সুদূর ডিমাপুর থেকে উড়ে এসে টুইন অটার ও অপর এলুয়েট। হেলিকপ্টারটি হামলা চালাতাে। দুএকদিনের মাথাতেই শমসেরনগর বিমান বন্দর থেকে পাকিস্তানীরা বিতারিত হলে ওই বিমান ক্ষেত্রটির ব্যবহার শুরু করে বাংলাদেশের বিমান বাহিনী। আখাউড়া শত্রুমুক্ত হলে পাশ্ববর্তী আগরতলা বিমান বন্দরকে সচল করে তােলা হয়। এরপর বিস্তৃত রণাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আক্রমণ এই আগরতলা বিমান বন্দর থেকেই পরিচালিত হতাে। দুপুরের দিকে মেজর নাসিম হঠাৎ করেই অন্ততঃ একটি ১০৬ মিলিমিটার ট্যাংক বিধ্বংসী। কামান আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বরাবর বসাবার প্রয়ােজন অনুভব করলেন। এই। মারণাস্ত্রটি ব্যাপক বিধ্বংসী। এ ধরনের গােটা তিনেক অত্র আমাদের আছে। তিনি তার একটি নিয়ে আসার জন্যে আমাকে বললেন। আমরা এখানে আসার প্রাক্কালে আমাদের ভারী। অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় সবটাই ফটিকছড়ার ব্যাটালিয়ান ভাণ্ডারে রেখে এসেছি। আক্রমণাত্মক যুদ্ধে এগুলাের খুব একটা প্রয়ােজন পড়ে না বিধায় মেজর নাসিম এগুলােকে আমাদের অগ্রবর্তী স্থানে নিয়ে যেতে চাননি। সুবেদার তৈয়বকে অবস্থানে রেখে আমাকেই ফটিকছড়া যেতে হলাে। বিকেলের আগেই ট্রাকটরে করে গােলা সমেত কামানটি পাঠিয়ে দিলাম। একটু পরে আমিও ফেরার উদ্যোগ | নিলাম। বিটুলদের বাড়ীর সামনে আসতেই ওদেরকে একবার দেখে যেতে খুব ইচ্ছে হলাে।। হাতে সময় কম। ঝটপট জীপ থেকে নেমেই বারান্দায় ওঠে এলাম। বিটুলের বাবাকে দেখলাম তার নির্দিষ্ট রুমে বসে আছেন। আমার উপস্থিতি টের পেতে বিটুলের সময় লাগলাে। না। আমার হাতের এসএমজিটি একবার হাতে নেয়ার তার খুব ইচ্ছে। এটিকে এ পর্যন্ত তাকে কখনাে দেয়া হয়নি। ভাবছি আজ একবার দেবাে। বিটুলের বুবু নিঃশব্দে এসে দাড়ালাে সামনে। তাকে আজ ভিন্ন মনে হচ্ছে। খুবই মলিন। আরও মলিন এক প্রস্থ হাসি দিয়ে সে | অভ্যর্থনা জানালাে আমাকে। ম্যাগজিন খুলে রেখে আমার এসএমজিটি বিটুলের হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে মহাখুশি। ভারী এই বস্তুটি নিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলাে না। | আমরা দুজনেই তাকিয়েছিলাম ওদিকে। এবার আমি চোখ ফেরালাম বিটুলের বুবুর দিকে। বললাম, মনে হয় যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে এবার। জানি না আপনাদের সাথে দেখা করার | জন্যে আর এখানে আসার সুযােগ পাবাে কি না। নিজের কাছেই আজ আমার কণ্ঠ খুব অস্ফুট। শােনালাে।
বিটুলের বুবু, যার নাম কোনােদিন আমার জানা হয়নি, লক্ষ্য করলাম সহসা খুব আনমনা| হয়ে পড়লাে যেনাে। তারপর বােবা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাে আমার দিকে। । আমার হাতে একদম সময় ছিলাে না। চারদিকেই তখন যুদ্ধের কোলাহল। চৈতন্যের মধ্যে রণাঙ্গনে যাবার জোরালাে তাড়া অনুভব করলাম। আর দেরী করা যায় না। উঠে পড়লাম, চাল| এবার। | বিটুলের বুবু তার অপলক নিঃশব্দ দৃষ্টি তখনাে পর্যন্ত ধরে আছে আমার মুখের দিকে। ঘুরে। দরজার কাছে আসতেই সে এগিয়ে এসে আমার একটি হাত চেপে ধরলাে। কয়েকটি মূহুত। এভাবেই কেটে গেলো। তারপর খুবই ক্ষীণকণ্ঠে বললাে, বিজয়ী হয়ে যেনাে ফিরে আসেন। শুধু এটুকুই প্রার্থনা করি। | বিদুলের বুবুর ক্লান্ত চোখ আজ আর কোনাে বাধাই মানলাে না। অপলক তাকিয়ে থাকা চোখ দুটি ভিজে এলাে পানিতে এয়েক ফোটা সাদা জ্বলজ্বলে পানি গড়িয়ে পড়লাে কােলা বেয়ে। বিটুলের এই বুবুর সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আমার কখনােই। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমি তার সাথে পরিচয়ের গভীর সূত্রিতার সংযােগও ঘটাতে চাই না। সামলে দেশজুড়ে এক বিশাল রণাঙ্গন আমার অপেক্ষায়। সেখানে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ অহর্নিশ। রক্তক্ষরণের যন্ত্রনায়-আর্তনাদে বিদীর্ণ করে চলেছে বাংলাদেশ। সেই সাথে আমার জীবনেও এক অনিশ্চিত পথযাত্রার চূড়ান্ত পর্যায়ের শুরু এখান থেকেই। এখানে এখন আর অন্য কিছুই। শুরুর অবকাশ নেই। আমার নাতিদীর্ঘ জীবনের অভিধানে এই একান্ত মুহূর্তটি প্রচণ্ড সুখানুভূতি হিসেবেই শুধু থেকে যাক। একমাত্র গংগাসাগর এলাকার পতন ছাড়া এবং আখাউড়ার দখলীকৃত এলাকায় নিজেদের । অবস্থান সুদৃঢ় করা ছাড়া ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ যৌথবাহিনীর আর তেমন কোনাে সাফল্য অর্জিত হলাে না। সন্ধ্যার পর সমগ্র ফ্রন্টেই আবার প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলাে। এ সময় আখাউড়ার অবরােধকে আরও কার্যকরী করার একটি জোরালাে প্রচেষ্টা চালায় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে আখাউড়ার পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান নিয়া ৪ গার্ড ব্যাটালিয়নটিকে। তিতাস নদীর ওপরে আখাউড়া রেলসেতুর কাছাকাছি পৌছানাের একটি প্রচেষ্টা চালানাে হয়। সেতু এলাকার আশেপাশে পাকিস্তানী অবস্থানগুলাের ওপর ভারতীয় গােলন্দাজের গােলাবর্ষণ। তুলনামূলক বেশী তীব্র ছিলাে এ কারণেই। এই রেলসেতুটিই ২৭ ব্রিগেডের পশ্চাত এলাকার সাথে সংযােগের একমাত্র খােলা পথ হিসেবে তখনাে উন্মুক্ত ছিলাে। আর এটাকেই আঁকড়ে রাখার জন্যে সাদুল্লাহ প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এই রণাঙ্গনে গত ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধে পাকিস্তানী ২৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক সাদুল্লাহর জন্য যে। অবস্থা দাড়ালাে, তা হচ্ছে : ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড ও বাংলাদেশের ‘এস ফোর্স ব্রিগেডের চাপের ফলে আখাউড়ার সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সন্দেহাতীতভাবেই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে ২৭ ব্রিগেডের পেছন দিকে ভারতীয় ৩১১ ব্রিগেডের অব্যাহত উপস্থিতি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং একই সাথে আখাউড়ার গােলন্দাজ অবস্থান তাদের মূল বাহিনী থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। পশ্চাদ্ভাগের সাথে ২৭ ব্রিগেডের যােগাযােগের জন্যে এ পর্যায়ে শুধুমাত্র রেলপথটুকুই খােলা থাকলাে। সেখানেও সেতুর কাছাকাছি এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর ৪ গার্ড ব্যাটালিয়নের উপস্থিতির কারণে এই একমাত্র উন্মুক্ত পথটুকুর নিরাপত্তাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়তঃ দক্ষিণে গংগাসাগর-কসবায় নিয়ােজিত ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টকে ২৭ ব্রিগেডের মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়েছে ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড। এর ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধোক্ষম ব্রিগেড হিসেবে সাদুল্লাহ’র ২৭ ব্রিগেড বাস্তবিক অর্থেই এখন অকার্যকর।
এখন তার সম্ভাব্য যা করণীয় তা হলাে আখাউড়া ও আখাউড়ার সম্মুখভাগ থেকে কোনােরকমে তার সেনা প্রত্যাহার করে আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যবর্তী কোনাে এক স্থানে অপর একটি প্রতিরক্ষা লাইন বা ব্যুহের সৃষ্টি করা। এই প্রেক্ষাপটে সাদুল্লাহ অবরােধ ভাংগার লক্ষ্যে ২ ডিসেম্বর ভােরে একটি পাল্টা। আক্রমণের উদ্যোগ নেন আখাউড়া রণাঙ্গনে। ভাের রাত থেকেই যুদ্ধ প্রচণ্ড আকার ধারণ। করলাে। কামান যুদ্ধের আঁচ আমরা আমাদের কলকলিয়ার অবস্থান থেকে স্পষ্ট অনুভব করলাম। সাদুল্লাহর বাহিনী ২ ইস্ট বেঙ্গলকে আযমপুর রেলস্টেশন এলাকার কিয়দংশ থেকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ হলাে। এর পশ্চিমে অর্থাৎ রেলস্টেশনের পেছনে আখাউড়া সেতুর কাছে অবস্থান নেয়া ৪ গার্ডকেও আংশিক পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে তারা। তবে দক্ষিণে ৩৩ বালুচের অবস্থানে কোনাে পরিবর্তন ঘটলাে না। বরঞ্চ এই ইউনিটের একটি কোম্পানী এ সময় কসবা সড়ক ধরে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের দিকে পিছিয়ে যায়। এই পাল্টা আক্রমণের পরেও সামগ্রিকভাবে ২৭ ব্রিগেডের সামনে একটি নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠলাে ক্রমান্বয়েই এবং সমরবিদ সাদুল্লাহও সেটা বুঝতে সক্ষম হলেন যথাসময়। | আখাউড়ার ব্যাপক রণাঙ্গন তখন এক লণ্ডভণ্ড কুরুক্ষেত্র। পােড়া বারুদ আর মানুষের স্থূপীকৃত গলিত মৃতদেহ আখাউড়া রণাঙ্গন জুড়ে যেনাে নরকের বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে। | দুপুরের দিকে মেজর নাসিম ও আমি সিংগারবিলে কর্নেল সফিউল্লাহর যুদ্ধকালীন দফতরে গেলাম তলব পেয়ে। ২ ইস্ট বেঙ্গলের অগ্রবর্তী এলাকার খানিকটা পেছনে সফিউল্লাহর এই অবস্থান। পাকিস্তানীদের বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণের মধ্যদিয়েই আমাদেরকে পথ করে নিতে হলাে। জায়গাটি আগরতলার শহরতলী। পাকিস্তানীদের গােলার আঘাতে এখানে বাড়ীঘর ভেংগে সব একাকার। ৭০’র ঘূর্ণিঝড়ের পর একই রকম দৃশ্য দেখেছিলাম বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে। | মাটির নিচে বাংকার করে সফিউল্লাহ তার দফতর তৈরী করেছেন। সেখানে তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখলাম। সফিউল্লাহ সে সময় ফিলড টেলিফোনে বদির সাথে কথা বলছিলেন। বদি তখন আযমপুর রেলস্টেশনসংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানীদের একেবারে মুখােমুখি। সেখানে হামলা পাল্টা হামলা চলছে। আমাদের উপস্থিতির সাথে সাথেই পাকিস্তানীদের বিমান আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তিনটি সেবর জংগী বিমান গংগাসাগর এলাকায় বােমাবর্ষণ করলাে। ভারতীয় বিমান বিধ্বংসী কামানগুলােও তখন সক্রিয়। এর খানিকক্ষণ পরেই কর্নেল সফিউল্লাহর প্রয়ােজনীয় নির্দেশ নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের অবস্থানে।
৩ ডিসেম্বর সমস্ত দিন ধরেই খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলে আখাউড়ার উত্তর থেকে দক্ষিণের সকল রণাঙ্গনে। ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড পর্যায়ক্রমে তার অবরােধ কার্যক্রম জোরদার করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। দিনের যুদ্ধ মূলতঃ গােলন্দাজকেন্দ্রিক। আখাউড়ার পশ্চাদ্ভাগের রেলপথটুকু তখনাে সচল রেখেছে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ। সকালের দিকে ২ ইস্ট বেঙ্গল আরও একটি আক্রমণ চালালাে সিংগারবিল-আযমপুর এলাকায়। এই আক্রমণের আগে এবং পরে জোরালাে ভারতীয় গােলন্দাজ সহায়তা দেয়া হলাে তাদের। তবে সেখানে পাকিস্তানীদের গােলাবর্ষণও ছিলাে প্রচণ্ড। এই আক্রমণের ফলে ১ ইস্ট বেঙ্গল আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাে এবং পুনরুদ্ধারে সমর্থ হলাে গতদিনের কিছু হারানাে এলাকা। সেদিনই বিকেল পৌনে ছটায় পাকিস্তান ভারতের ওপর বিমান আক্রমণের মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করে। পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পশ্চিমের শ্রীনগর, অভীপুর, পাঠানকোট, উবলাই, যােধপুর, আম্বালা ও আগ্রায় বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণের সূচনা করে। প্রায় একই সময় পূর্বাংশে আগরতলা বিমান বন্দরও আক্রান্ত হয়। কামার ও পাঞ্জাবের একাধিক ফ্রন্টে স্থলবাহিনীর আক্রমণও সংঘটিত হলাে একই সাথে। রাতেও আর এক দফা বিমান আক্রমণ চালালাে পাকিস্তান। কিন্তু ইসরাইলী বিমান বাহিনীর অনুকরণে পরিচালিত এই আক্রমণ নিল প্রমাণিত হলাে। এবং এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানই আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হলাে ভারতের প্রত্যাশা অনুযায়ী। | ভারতীয় বিমান বাহিনীর অপেক্ষার অবসান হলাে। সেদিন সারারাত ধরে মুহুর্মুহু। আক্রমণ চললাে পাকিস্তানের বিভিন্ন অবস্থানে এবং একদিনেই ভারতীয় বিমান বাহিনী। পাকিস্তানী ভূখণ্ডে ৫শ’ বার হামলা চালালাে। এভাবে ৪ ডিসেম্বর দিনের শেষে ভারত। বাংলাদেশসহ পাকিস্তানের আকাশে তার পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হলাে। | স্থলযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানীদের আক্রমণ শুধু প্রতিহতই করলাে না বরং বিভিন্ন। ফ্রন্টে পাল্টা আক্রমণ চালালাে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে। একমাত্র কাশ্মীরের ছাম্ব সেক্টরেই। সীমিত সাফল্য অর্জনে সমর্থ হলাে পাকিস্তান। উনসত্তর। ৪ ডিসেম্বর ভােরে আখাউড়া রণাঙ্গনের সর্বত্র ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ১২ আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের একাংশ আরও একটি জোরালাে পাল্টা আক্রমণের সূচনা করলাে। এটাই ছিলাে এই রণাঙ্গনে ২৭ ব্রিগেডের শেষ আক্রমণ প্রচেষ্টা। সম্ভবতঃ পশ্চাদ্পসরণের লক্ষ্যে সম্মুখ ভাগ থেকে বিচ্ছেদকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এই আক্রমণ চালানাে হয়। কিন্তু এই আক্রমণের পরেও সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কোনাে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলাে না তারা। | অপরদিকে ভারতীয় ৩১১ ও ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড আখাউড়ার উত্তর এবং দক্ষিণের দুই ফ্রন্ট বরারব তাদের সম্মিলিত চাপ অব্যাহত রাখলাে আগের মতােই। তবে এ পর্যায়ে আখাউড়া দখলের দীর্ঘসূত্রিতায় ভারতীয় সমর কর্মকতারা কিছুটা অধৈর্য হয়ে ওঠেন। দিনের শেষে অবশ্য গংগাসাগর-কসবা এলাকা থেকে কিছু সাফল্যের খবর আসে। এই খবরে ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্বেগ কিছুটা হলেও লাঘব হয়। | সেদিনই দুপুরের খানিকটা আগে কর্নেল সফিউল্লাহ খুব তড়িঘড়ি করেই ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের অগ্রবর্তী এলাকায় এলেন। তার এই আসার উদ্দেশ্য আক্রমণ শুরু করার জন্যে আমাদেরকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়া। আমরাও তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছি। এই অক্ষে পাকিস্তানীদের পাল্টা আক্রমণের কোনাে সম্ভাবনা আর নেই। আমাদের জন্যে এখন সময় শুধু আঘাত হানার।
সুতরাং পার্শ্বদেশ থেকে আখাউড়ার ওপর আরও চাপ প্রয়ােগ এবং সেই সাথে সিলেট থেকে পশ্চাদ্ল্পসরণরত পাকিস্তানী বাহিনী যাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে যুক্ত হতে না পারে সেই লক্ষ্যে ১১ ইষ্ট বেঙ্গলকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হলাে। পকিল্পনা অনুযায়ী আমাদেরকে পরদিন অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পর মুকুন্দপুর হরষপুর-ধর্মগড় অক্ষাঞ্চল দখলে এনে রাতের মধ্যেই সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক বরাবর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী এরপর এগিয়ে যেতে হবে শাহবাজপুর অক্ষ ধরে। সেখান থেকে প্রয়ােজনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অথবা সরাইল হয়ে আশুগঞ্জ-ভৈরব। সফিউল্লাহকে আজ কিছুটা বিমর্ষ মনে হলাে। তার চরিত্রে এটা ছিলাে একটা ব্যতিক্রম। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে আমি কখনােই বিমর্ষ হতে দেখিনি। এমন কি প্রতিকূল অবস্থাতেও না। দুঃসময়ের মধ্যেও এই স্বল্পভাষী মানুষটিকে বরাবর সৌম্যশান্ত রূপেই দেখেছি আমি। যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে একটু মলিন হাসলেন অধিনায়ক সফিউল্লাহ। কি ভেবে কাছে ডাকলেন। কাধে হাত রেখে ছােট্ট করে বললেন, তােমাকে আজ একটি দুঃসংবাদ | দেবাে। একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, বদি আর বেঁচে নেই। আজ সকালে আযমপুরের যুদ্ধে সে মারা গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অধিনায়ক সফিউল্লাহ’র মুখের দিকে। আমি তখন পুরােপুরি | বাকশূন্য। একবার মনে হলাে চিৎকার করে বলে উঠি, এ কথা সত্য নয়। এ সত্য হতে পারে। না। কিন্তু এই দুঃসংবাদ যে মিথ্যেও নয়, তা এই মুহূর্তে আমার চেয়ে আর ভালাে করে কে | জানে। একটি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কর্নেল সফিউল্লাহ তাে আর প্রহসন করতে পারেন না।
বদির মুখখানি বারবার মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে হলাে বহুদিন ওকে দেখি না। স্মৃতি থেকেও যেনো আজ হারিয়ে গেছে বদি। আমার দু’চোখ মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে এলাে। বহু দূর থেকে সহসা বদির করুণ মুখখানি এক ঝলক ভেসে উঠে নিমেষেই আবার মিলিয়ে গেলাে শূন্যতায়। কলকলিয়ার পাহাড়ের টিলায় আমার হাতে বদির শীতল হাতের স্পর্শ টের পাচ্ছি। যেনাে! কানের কাছে মুখ এনে বদি বলছে, স্যার, এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে ? | এক স্থূপ ধুলাে উড়িয়ে কর্নেল সফিউল্লাহর জীপ অদৃশ্য হয়ে গেলাে। অভিবাদন জানাতেও ভুলে গেলাম আষ্ট অধিনায়ককে। আমার সমস্ত শরীর ক্রমেই যেনাে অবশ হয়ে। আসছে। | আযমপুরে সমাহিত করা হয়েছে বদিকে। স্বভাবতঃই কোনাে আনুষ্ঠানিকতা ছিলাে না তার শেষকৃত্যে। পরে শুনেছি বদির দেহটি নাকি পাকিস্তানীদের কামানের নিক্ষিপ্ত গােলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। মৃত্যু যন্ত্রণায় খুব একটা ছটফট করে নি বদি। নিমিষেই মৃত্যু হয়েছে তার। কর্নেল সফিউল্লাহ নিজের তত্ত্বাবধানে বদির সংক্ষিপ্ত সমাহন পর্ব শেষ করেন। পরণের রক্তাক্ত কাপড়েই তাকে কবরস্থ করা হয়েছে আযমপুরে। জানি না বাংলাদেশের কোন অঞ্চল থেকে বদির জীবন শুরু হয়েছিলাে, তবে সেই অসম্পূর্ণ জীবন তার শেষ হলাে আখাউড়ার আযমপুরে। আমি সেই ঘটনার হতভাগ্য এক সাক্ষী হয়ে রইলাম। | বদির মৃত্যু আমার দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটালাে। রণাঙ্গনের এই জীবন আমার ভালােই কেটে যাচ্ছিলাে। এর সব কিছুকেই ভালােবেসে ফেলেছিলাম। এই শেষ মুহূর্তে এসে বদির শূন্যতা যেনাে সেই ভালােলাগায় ছন্দ-পতন ঘটালাে। দুপুর থেকে কেমন এক ধরনের অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে আমাকে। কোনাে কিছুই আর আগের মতাে করে ভালাে লাগছে না। বদির জন্যে প্রাণ খুলে একটু কাঁদতেও পারছি না। আমার সীমাবদ্ধতা অনেক। আমি কোম্পানী কমাণ্ডার। আমার নির্দেশে প্রয়ােজনে মৃত্যু মুখােমুখি হতে প্রস্তুত আমার অধিনস্ত দুশ সৈনিক। তারা সবাই প্রহর গুণছে যুদ্ধেরআন নির্দেশের। এখন আমার অশ্রুসজল চোখ কোনােভাবেই কারাে কাম্য নয়। এখানে আর দ* সাধারণ মানুষের মতো আচরণ আমার কাছ থেকে ওরা কেউ আশা করে না এবং তা আ” করা উচিতও নয়।
৫ ডিসেম্বর দুপুর নাগাদ আখাউড়ার দখল প্রশ্নে ৪ কোর কমাণ্ডার সাগত সিংয়ের যখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম, তখনই সফলতার বার্তা নিয়ে আসেন ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মিশ্র। ট্যাংকের সহায়তায় ৩১১ মাউন্টেন আখাউড়ার দখল নিশ্চিত করে এগিয়ে গেছে তিতাস নদীর রেলসেতু অবধি এবং সেতুটি তারা অক্ষতই নিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানীদের কাছ থেকে। মিত্রবাহিনীর সেদিনের এই আক্রমণ ছিলাে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের সবথেকে প্রচণ্ডতম আক্রমণ। গােলন্দাজের হাজার হাজার গােলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় তারা তাদের এই আক্রমণের সূচনা করে। তবে সেতু বরাবর ভারতীয়দের অগ্রাভিযান আবার থেমে পড়ে। এখানে তিতাস নদীকে সামনে রেখে সাদুল্লাহ তার শেষ শক্তি প্রয়ােগ করেন আরেক দফা। অন্য দিকে ৭৩ মাউন্টেন ৩৩ বালুচকে ধাওয়া করে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবড়িয়া মহাসড়কে এসে অবস্থান নিয়েছে। ফলে কুমিল্লাও বিচ্ছিন্ন হলাে উত্তরভাগ থেকে। এখন অবশ্য ভারতীয়দের তেমন একটা তাড়া নেই। রি-গ্রুপিংয়ের পরই কেবল নতুন আক্রমণ ধারার সূচনা হবে। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতর ব্রাহ্মণবাড়িয়াই ভারতীয় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের পরবর্তী আক্রমণস্থল। এ অবস্থায় জেনারেল গনজালভেসকে তার তৃতীয় শলাকা ২ এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে শাহবাজপুর অক্ষ বরাবর। এই কার্যক্রমের ফলে প্রথমতঃ সিলেট অঞ্চল থেকে পশ্চাদপসরণরত পাকিস্তানী বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ বা ভৈরবে তাদের মূল বাহিনীর সাথে যুক্ত হবার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়তঃ এই সঞ্চালণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন্দ্রীভূত ২৭ পদাতিক ব্রিগেড ও ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতর তিন দিক থকে ঘিরে ফেলে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার মধ্যদিয়ে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করবে যেখানে স্বল্পতম সময়ে আখাউড়ার ভরাডুবির পুনরাবৃত্তি ঘটাও বিচিত্র নয়। সন্ধ্যা হতে তখনাে বাকি। প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সমাপ্ত। সন্ধ্যার পর ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের সঞ্চালন ঘটবে হরষপুর-মনতলা ফ্রন্টে। এরপর মধ্যরাতে সংঘটিত হবে আক্রমণ—হরষপুর, ধর্মগড় ও মনতলার শক্ত অবস্থানে। তারপর রাতের মধ্যেই এগিয়ে যেতে হবে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের দিকে এবং ভােরের আগেই ওই এলাকা দখল করে নিতে হবে। এ ছাড়াও ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান ও তার অধীনস্থ সেক্টর বাহিনী তেলিয়াপাড়া দখল করবে একই সময়ের মধ্যে। আমাদের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রার জন্যে তেলিয়াপাড়ার দখলও অপরিহার্য। আখাউড়ার যুদ্ধ এখন স্ত্রীমিত। তবে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছাকাছি এলাকায়। ভারতীয় ৭৩ ও ৩১১ ব্রিগেড পূর্বের দুই অক্ষ ধরে দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
অন্যান্য সবার মতাে আমিও তখন যাবার জন্যে তৈরী। প্রথমে হরষপুর। হরষপুরের দখল নিশ্চিত করেই এগিয়ে যেতে হবে পাইকপাড়ার দিকে। নজরুলের সঞ্চালন ঘটবে আমার বা দিকে, মুকুন্দপুর হয়ে। ভূইয়া থাকবে ডানে। তার সঞ্চালন হতে হবে আমাদের চেয়ে দ্রুত। ভূহয়াকে চারার উত্তরে মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করতে হবে ভাের হওয়ার আগেই। এই অবরােধের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করবে ১১ ইস্ট বেঙ্গলের অগ্রযাত্রা। আমার ট্রেঞ্চসংলগ্ন এলএমজি পােস্টে চাঁনমিয়া তার এলএমজি পরিস্কার করছে। এলএমজি’র ওপর তার হাতের প্রতিটি স্পর্শ পরম যত্নের ছাপ রেখে যাচ্ছে। বরাবরের মতােই সে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে চলেছে ? কে তােমার আর যাবে সাথে কোথায় রবে ভাই-বন্ধুগণ পরবি যেদিন কালের হাতে কে তােমার আর যাবে সাথে। মারফতি গান চাঁনমিয়ার খুব প্রিয়। আর এ ধরনের অনেক মারফতি গানই তার মুখস্থ। সব সময়ই মুখে লেগে আছে তার মারফতী গানের দু একটা কলি। ধর্মগড়ের দ্বিতীয় যুদ্ধে প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যেও আমি চাঁনমিয়াকে নির্বিকারভাবে গান গাইতে দেখেছি। | চাঁনমিয়া আমাদের বেসামরিক সহযােদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ২ ইস্ট বেঙ্গলে এসে যােগ দেয়। বীরত্বের সাথে লড়েছে অনেক যুদ্ধে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই আহত হয়েছে। বীরত্ব চাঁনমিয়ার অহংকার সাহস তার মজ্জাগত।। চেষ্টা করেও বেশী একটা জানতে পারিনি চাঁনমিয়াকে। যখন তখন গান গাওয়া ছাড়াও চাঁনমিয়া খুব সগদোক্তি প্রিয়। নিজের সাথে সে নিজেই কথা বলে। এটাও তার একটি প্রায় সার্বক্ষণিক অভ্যাস। এলএমজি চাঁনমিয়ার প্রিয় মারণাস্ত্র। লক্ষ্য অব্যর্থ তার। সে একাই একশাে। যে কোনাে অপারেশনে চাঁনমিয়ার উপস্থিতি সরব করে তােলে তার সহযােদ্ধাদের।
নুরুল ইসলামও বসে নেই। সেও তার চাইনিজ ভারী মেশিনগানটি শেষবারের মতাে দেখে নিচ্ছে। সুবেদার তৈয়ব কোরান শরীফ পড়ছে জংলা পেয়ারা গাছের আড়ালে বসে। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। কোনাে আক্রমণ বা অভিযানের আগে অজু করে তার কোরান শরীফ পড়া চাই। এরই মধ্যে ব্যাটম্যান আমিন দুটো তাজা গ্রেনেড ঢুকিয়ে দিয়ে গেলাে আমার বুকের দু পাশের নির্দিষ্ট জায়গাতে। তারপর নিষ্ঠার সাথে আমার চাইনিজ এসএমজি’র পাঁচটি ম্যাগজিনেই ৭শু৬২ মিলিমিটারের ২৮টি করে গুলি ভরলাে এবং যত্নের সাথে একটি ম্যাগজিন। এসএমজি’তে ঢুকিয়ে বাকিগুলাে রেখে দিলাে ম্যাগজিন বহনকারী খাপে। স্যার, আল্লার নাম নিয়া এইবার ওড়েন। সময় হইয়া আইছে। | আমিনের সবটাতেই একটা নিষ্ঠার ভাব। খারাপ কোনাে কাজের জন্যে যেনাে ওর জন্ম হয়নি। আনুগত্য তার মাত্রার চেয়েও অনেক বেশী। যুদ্ধক্ষেত্রে আঠার মতাে তাকে লেগে থাকতে হবে আমার সাথে। ধাক্কা দিয়েও সরানাে যাবে না। ধমক দিয়েও নিস্তার নেই। ধমক দিলে বলে উঠবে, আমি আমিন মইরলে একশােডা আমিন পাওয়া যাইবাে। কোম্পানী কমাণ্ডার মইরলে মাটি খুইড়লেও একটা পাওয়া যাইবাে না। আপনি আমারে মাইরলেও আগে থাইকম। গুলি আগে আমারে মাইরবাে, তারফরে আফনারে। শীতের শেষ বিকেল। দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। একটু বাদেই অন্ধকার নেমে আসবে। সুবেদার তৈয়ব এলাে বলে। স্যালুট করে দাড়িয়েই বলবে, স্যার, কোম্পানী রেঙ। তারপর এক সময় শুরু হবে গন্তব্যের পথে যাত্রা। আগে গাইড এবং সেই সাহ অবধারিতভাবেই সৈয়দ। তার পরে একটি প্লটুন এবং প্রাটনের শেষে আমি। আমার সেই এলএমজি নিয়ে চানমিয়া। সেই সাথে মেশিনগানবাহী দল। তার পেছনে বাকি দুই প্লাটুন এবং সবশেষে সুবেদার তৈয়ব। আর আমিন? তাকে তাে আমার সাথে থাকতেই হবে। তা না ) আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা গুলি কে ঠেকাবে। তারপর এক সময় হঠাৎ হাটা থেমে ) সৈয়দ এসে ফিসফিস করে বলবে, স্যার, আইসা গেছি। ঐ যে হরষপুর রেলইস্টিশন যায়। মাত্র দুইশাে গজ স্যার।
মুহূর্তেই অবশ হয়ে আসতে চাইবে শরীরের প্রতিটি স্নায়ু। একটা ভয়াল নিস্তব্ধতা নেমে আসবে সবার মুখে। বুকের ধুকধুকানিটাও তখন নিজের কানেই শােনা যাবে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসতে চাইবে—যেনাে কতাে যুগ পানি খাওয়া হয়নি। এটা কি মৃত্যু ভয়, না। শিহরণ, না উত্তেজনা—তা আজও বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর শক্রর অবস্থান এবং দূরত্ব নিশ্চিত হয়েই বলবাে, ওকে এক লাইন। কমপ্লিট ফায়ার কন্ট্রোল। অনর্থক একটি গুলিও না। আমি যতােক্ষণ গুলি না চালাবে, তার আগে কোনাে ফায়ার হবে না। ঠিক আছে ? সবাই। ফিসফিস করেই উত্তর দেবে, ঠিক আছে স্যার। সেই সাথে চাপা একটি গুঞ্জরণ—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মােহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এরপর আমি, চান মিয়া আর আমিন চলে আসবাে কোম্পানীর মাঝখানটাতে—শক্রর অবস্থান সােজা। আর তারপরই বলবাে, চলাে, জয়বাংলা। শক্র তার সুদঢ় অবস্থান থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে পাল্টা আঘাত হানবে। যেনাে চরে বসে থাকা বুনােহাঁস মারছে। আর আমরা নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও ছুটে যাবে তাদের অবস্থানের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম। সুবেদার তৈয়ব এখনাে আসেনি। হয়তাে তার মােনাজাত শেষ হয়নি। নিজের অজান্তেই তাকালাম বা দিকে। বহুদূরের পেয়ারা বাগানগুলাের দিকে। মুকুন্দপুর, রূপা, রাজাপুর, তারপর আমপুর। সেখানে ঘুমিয়ে আছে বদি চিরনিদ্রায়। বার বার আমার সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে আসছিলাে বদির বিষন্ন মুখখানি। আর তার প্রিয় কবিতাটি ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তােমাদের নক্ষত্রের রাতে, তখনাে যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তাে বা আমার তরুণ দিন তখনাে হয়নি শেষ সেই ভালে-ঘুম আসে বাংলার তৃণ আমার বুকের নীচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে কচি পােকা ঘুমায়েছে-আমিও ঘুমায়ে রবাে তাহাদের সাথে, ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে—এই ঘাসে আখাউড়ার দখল নিয়ে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে, ঠিক সেই সময় ৮ মাউন্টেন ডিভিশন সিলেট অঞ্চলে দুটি ভিন্ন অক্ষে দুটি আলাদা ব্রিগেডের সাহায্যে আক্রমণের সূচনা করে।
ডিভিশন অধিনায়ক মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রাও ২ ডিসেম্বর দুপুরে ব্রিগেডিয়ার আপতির ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেডকে কৈলাশহর-শমসেরনগর-মৌলভীবাজার অক্ষের দিকে ধাবিত করেন। অপর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেডকে ব্রিগেডিয়ার কুইনের নেতৃত্বে একই দিন ধাবিত করা হয় ধর্মনগর কুলাউড়া-ফেঞ্চুগঞ্জ অক্ষ বরাবর। সিলেটের দিকে উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে মুক্তিবাহিনীরও তিনটি নিয়মিত ব্যাটালিয়নের সঞ্চালন ঘটানাে হয় একই সাথে। এগুলাে হলাে ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। উপরন্তু ভারতীয় বাহিনীর আরও একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ৫/৫ গুখ্য রাইফেলস খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ডাউকি থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর ১ ও ৩ ইস্ট বেঙ্গল এবং ভারতের ৫/৫ মুখ রাঈফেলস্ ও ৮৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন মূলতঃ এই ৪টি পদাতিক ইউনিট ব্রিগেডিয়ার ওয়াদকির নেতৃত্বে ই ফোস নামের ফরমেশনের অধীনে থেকে সিলেটের এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশ্য ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড এই বাহিনীর সর্বময় নেতৃত্বে থেকে যায় আগাগােড়া। এ পর্যায়ে বৃহত্তর সিলেট রণাঙ্গনের সামগ্রিক চিত্রপট এমন দাঁড়ালাে যে চারদিক থেকে অনেকগুলাে আক্রমণ শলাকা তখন একই সাথে সিলেটকে ঘিরে অগ্রসরমান। | এই ব্যাপক আক্রমণের মধ্যে আবদ্ধ সিলেটের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল রক্ষায় নিয়ােজিত পাকিস্তানের ৩১৩ ব্রিগেডকে যুদ্ধের শুরুতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ অক্ষ বরাবর চলে আসতে নির্দেশ দেয়া হলেও অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার রানা এই নির্দেশ কার্যকর করতে তার অসমর্থতার কথা জানালেন। তবে ২৭ ব্রিগেডসংলগ্ন ইটাখােলার বিস্তৃত অঞ্চলে নিয়ােজিত ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে দক্ষিণে সরিয়ে আনার প্রশ্নে তার আপত্তি ছিলাে না। | বিপর্যয়ের মুখােমুখি থেকেও ব্রিগেডিয়ার রানার সৈনিকরা মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অক্ষে ভারতীয় ৮১ মাউন্টেনের অগ্রাভিযানের বিপরীতে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ফলে ভারতীয় এই ব্রিগেডটির বিচলনে সাময়িক স্থবিরতা এসে যায় যুদ্ধের শুরুতেই। অপর দিকে আটগ্রাম-জকিগঞ্জ-চরকাই অক্ষে প্রতিরােধের দায়িত্বে নিয়ােজিত ২০২ ব্রিগেড তেমন কোনাে যুদ্ধে জড়িত না হয়েই পশ্চাদপসরণের মাধ্যমে পশ্চিমে সরে আসে এবং সিলেট শহরসংলগ্ন চরকাইতে তাদের নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে।
পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের দক্ষিণে কুমিল্লা-নােয়াখালী অঞ্চলের যুদ্ধে শুরু থেকেই ভারতীয় রণকৌশলে পদ্ধতিগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এখানে ৪ কোর অধিনায়ক সাগত সিং আখাউড়ার অনুরূপ গোয়ার্তুমি পরিহারের সিদ্ধান্ত নিলেন। আর এ কারণেই পাকিস্তানীদের সুরক্ষিত ময়নামতি দুর্গকে তিনি ঘাটাতে চাইলেন না। বরং একে পাশ কাটিয়ে মেঘনার দুটি প্রবেশদ্বারে পৌঁছতে চাইলেন কোনাে রকম সময় ক্ষেপণ না করেই। এই দুটি প্রবেশদ্বারের একটি উত্তরের দাউদকান্দি এবং অপরটি কিছুটা দক্ষিণে চাদপুর। | এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার দুটি পদাতিক ব্রিগেডের সমাবেশ ঘটায়। এর একটি ১১৭ ব্রিগেড ময়নামতিলালমাই রক্ষাব্যুহের প্রহরায় এবং অপর ৫৩ ব্রিগেড লাকসামের সাধারণ এলাকা, ফেণীর কিছু অংশ ও চাদপুর অঞ্চলে মােতায়েন করা হয়। পুর্নগঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ দুটি ব্রিগেডকে আগেভাগেই পাকিস্তানের সদ্য সৃষ্ট ৩৯ এডহক ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছিলাে। সমরবিদ হিসেবে সাদুল্লাহ’র মতােই খ্যাত জেনারেল রহিম চাদপুর থেকে এই ডিভিশনটির তদারকি করছিলেন। | জেনারেল সাগত সিং তার ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই সমাবেশের বিরুদ্ধে সঞ্চালন ঘটাবার সিদ্ধান্ত নেন। এই ডিভিশনটির পরিচালনায় ছিলেন। মেজর জেনারেল হীরা। উপরন্তু, ব্রিগেডিয়ার টম পাণ্ডের অধিনায়কত্বে ৬১ মাউন্টেন হিসেবে। পরিচিত অপর একটি অতিরিক্ত ব্রিগেডেরও বিচলন ঘটাবার পরিকল্পনা নেয়া হয় একই অঞ্চলের দাউদকান্দি অভিমুখে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ ডিসেম্বর থেকে এই অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের সূচনা হয়। প্রথমেই টম পাণ্ডের ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড কিছু ট্যাংক সাথে নিয়ে গােমতি অতিক্রম করে। এরপর এই ব্রিগেডটি চান্দিনা হয়ে সরাসরি দাউদকান্দির দিকে এগিয়ে যায়। পথে চম পাণ্ডে তার ব্রিগেডের একটি অংশ রেখে যান ময়নামতির উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমে। ফলে যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই ময়নামতি সেনাছাউনি ঢাকার সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের ৩০১ ও ১৮১ ব্রিগেড দুটির সঞ্চালন ঘটানাে হলাে লাকসাম, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর ও মুদাফফরগঞ্জের বিস্তৃত অঞ্চলে। ৩০১ ব্রিগেডের মূল অংশ লাকসাম ও লালমাই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে অনুপ্রবেশ করে পাকিস্তানের ১১৭ ও ৫৩ ব্রিগেড দুটিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ব্রিগেডটির অপর অংশ মুদাফফরগঞ্জ ও হাজিগঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে একটি সড়ক অবরােধও সৃষ্টি করে। এই অবরােধ ভাংগার জন্যে ৫৩ ব্রিগেড প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়। কিন্তু এখানে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনাে সফলতা আসেনি। এ পর্যায়ে জেনারেল হীরা তার অপর ১৮১ ব্রিগেডের সাহায্যে। একটির পর একটি আঘাত হেনে চললেন ৫৩ ব্রিগেডের বিভিন্ন সমাবেশের ওপর। | আরও দক্ষিণে ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের নেতৃত্বে কিলাে নামের একটি ব্রিগেডকে চট্টগ্রাম দখলের জন্যে ধাবিত করা হয় ফেনীর মধ্যাঞ্চল হয়ে। এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হলাে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি ব্যাটালিয়ন, একটি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন, একটি গােলন্দাজ রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর মুজিব ব্যাটারী নামের একটি ক্ষুদে গােলন্দাজ ইউনিট। খানিক বিলম্বে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেডও এসে যুক্ত হয় এই বাহিনীর সাথে চট্টগ্রাম মুক্ত করার যুদ্ধে। | উত্তরে মেঘালয় বরাবর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল। গুরবকস সিং প্রথমতঃ একটি অক্ষেই তার মূল আক্রমণ ধারা সূচনার সিদ্ধান্ত নেন। এই লক্ষ্যে তিনি প্রথমেই ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপকে সীমান্তসংলগ্ন লােকালয় কামালপুর নকশী বারােবাড়ির পাকিস্তানী প্রতিরােধ ভেঙে জামালপুর দখলে আনতে চাইলেন এবং সেখান থেকে সরাসরি টাঙ্গাইল। সেই সাথে একই অঞ্চলের অপর দুটি ভিন্ন অক্ষে তিনি। জোরালাে চাপের সৃষ্টি করতে চাইলেন। এর মাধ্যমে তিনি সেখানকার পাকিস্তানী অবস্থানগলােকে এই মর্মে বােঝাতে সচেষ্ট হবেন যে, মূল আক্রমণ বা সমপর্যায়ের শক্তিশালী। আক্রমণ বিস্তৃত সেক্টরের তিনটি স্থানে একই সাথে সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ দুটি আক্রমণের উদ্দেশ্য হবে নিতান্তই প্রতারণামূলক এবং এর মাধ্যমে গুরবকস সিং চেয়েছিলেন পাকিস্তানীদের একাংশকে এখানে ব্যতিব্যস্ত রাখতে, যাতে পশ্চাদপসরণের মাধ্যমে তারা ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের মুল অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হালকা ধরণের এই নকল আক্রমণ দুটোর একটি সংঘটিত হবে হালুয়াঘাট-ফুলবাড়িময়মনসিংহ অক্ষে এবং অপরটি বাগমারা-দুর্গাপুর-জারিয়াঝাঞ্জাইল অক্ষে। আর এই দুটি আক্রমণই পরিচালিত হবে ভারতীয় মিশ্রিত সেনাদল এবং মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে। এ ছাড়াও এক পর্যায়ে ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণরত পাকিস্তানী বাহিনীর গতিরােধে বিমানবাহী সেনাদের সাহায্যে টাংগাইল বরাবর অবরােধ সৃষ্টির পরিকল্পনাও নেয়া হলাে। | ময়মনসিংহের এই বিস্তৃত অঞ্চলে পাকিস্তান তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অজ্ঞাত কারণে দুর্বল অবস্থায় ফেলে রাখে সমূহ বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও। সম্ভবতঃ ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা এ অঞ্চলে তেমনভাবে পরিলক্ষিত না হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটে। থাকবে। তাছাড়া ব্ৰহ্মপুত্র জলাধার এবং মধুপুর বনাঞ্চলের মতাে দুটো প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে খােদ ঢাকার নিরাপত্তা কেউ বিঘ্নিত করতে পারে সে রকম না ভাবাটাই যৌক্তিক।
বিশাল এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি ভারী মর্টার বাটারীসহ তার একটি মাত্র পদাতিক ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটায় ব্যাপক আয়তনের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি ভিন্ন অক্ষে। এটা ধরে নেয়া হয় যে, ৩১ বালুচ এবং ৩৩ পাঞ্জাব এই দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ৯৩ পদাতিক ব্রিগেড মূলতঃ আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার যুদ্ধে লিপ্ত হবে। স্পষ্টতঃই দৃষ্টিগােচর দুটি অক্ষের মধ্যে একটি অর্থাৎ হালুয়াঘাট-ফুলবাড়ী-ময়মনসিংহে ৩৩ পাঞ্জাব ও কামালপুর-শেরপুর-জামালপুর অক্ষে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সমাবেশ ঘটালেন ব্রিগেড অধিনায়ক কাদের। তিনি কার্যতঃ হালুয়াঘাট-ফুলবাড়ি-ময়মনসিংহ অক্ষকেই ভারতীয় এবং মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ রেখা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত সুবিধার কারনে তিনি ময়মনসিংহেই তার ব্রিগেড সদর দফতর স্থাপন করেন। | এই সেক্টরে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই পাকিস্তানী সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে এবং এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর নিয়মিত অংশও এর সাথে জড়িয়ে পড়ে। ২২ অক্টোবর ভারতীয় বাহিনীর একাংশ এবং মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে সীমান্তের কামালপুর চৌকি আক্রমণ করে। এরপর একই অবস্থানে দ্বিতীয় জোরালাে আক্রমণের সূচনা ঘটে ১৪ নবেম্বর। ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে দ্বিতীয় দফার এই আক্রমণ পরিচালনা করে। উপরন্তু এই অক্ষের পশ্চাদ্ভাগে বকশিগঞ্জের কিছুটা উত্তরে জোরালাে একটি সড়ক অবরােধেরও সৃষ্টি করা হয় যাতে কামালপুর চৌকিতে পাকিস্তানীদের কোনাে প্রকার সহায়তা পৌছানাে সম্ভব না হয়। অবরােধের কারণে কামালপুর চৌকি বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও এখানে এমবুশে আটকা পড়ে পাকিস্তানীদের ভারী মর্টার ব্যাটারীর সিংহভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের সূচনা ঘটে ২৭/২৮ নবেম্বর রাতে। কামালপুরে অবরুদ্ধ ৩১ বালুচের কোম্পানী অবস্থানে ভারতীয় ৯৫ ব্রিগেডের একাংশ এবং মুক্তিবাহিনী একযােগে এই ধারার তৃতীয় আক্রমণ পরিচালনা করে। অন্যদিকে ব্রিগেডের মূল বাহিনী নিয়ে ব্রিগেড অধিনায়ক ক্লেয়ার বকশিগঞ্জের দিকে ধাবিত হন। গােলন্দাজের ছত্রচ্ছায়ায় একের পর এক স্থল আক্রমণ এবং শেষে উপযুপরি বিমান আক্রমণেও কামালপুরের পাকিস্তানী ঘাটি অক্ষত থেকে যায়। শেষমেশ ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অব্যাহত ২১ দিনের প্রতিরােধ শেষে আত্মসর্পণের মধ্য দিয়ে কামালপুর ঘাটির পতন ঘটে।
কামালপুর পতনের সাথে সাথে পরবর্তী অবস্থান বকশীগঞ্জে একই ধরনের অবরােধ গড়ে তােলে ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনী। কিন্তু ৪/৫ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর অবরােধ ভেঙে পাকিস্তানী বাহিনী সরে পড়ে সেখান থেকে। যাইহােক পলায়নপর পাকিস্তানীদের আটকাতে না পারলেও শেরপর দখলের সুযােগ সৃষ্টি হয়ে যায় এরপর। এদিকে ৪/৫ ডিসেম্বর রাতে হালয়াঘাট এলাকায় ঢুকে পড়ে মুক্তিবাহিনীর চার কোম্পানী সেন্যের সাথে একটি ভারতীয় ব্যাটালিয়ন ৬ বিহার রেজিমেন্ট। এই যৌথ সেনাদলটি ব্রিগেডিয়ার সস্ত সিংয়ের অধীন এফ জে সেক্টর’ নামে পরিচিত ব্রিগেডের অংশে পরিণত হয়। হালুয়াঘাটে সীমান্ত অতিক্রম করার পর পরই এরা পাকিস্তানের ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অগ্রবর্তী দলের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আরও একটি ক্ষুদ্র আক্রমণ রেখার সূচনা ঘটে বাগমারা-দুর্গাপুর-জারিয়াঝাঞ্জাইল অক্ষে। এই বাহিনীর সংমিশ্রণে থাকে একটি বিএসএফ ব্যাটালিয়ান এবং মুক্তিবাহিনী। এই সেনাদলটও এফ জে ব্রিগেডের অধীনে পরিচালিত হয় এবং তারা এই সেক্টরের আড়াআড়ি পাচমে ভারতীয় ১৫ ব্রিগেডের আক্রমণ রেখার সাথে সমান্তরালভাবে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে। অপরদিকে একেবারে উত্তরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরকে কেন্দ্র করে ভারতীয় ৩৩ কোরের যুদ্ধ পরিকল্পনা অক্টোবরেই চূড়ান্ত হয়ে যায়। পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। নির্ধারিত হয় প্রথমত হিলি-গাইবান্ধা রেখার উত্তর ও দক্ষিণ ভাগের সমাবেশকৃত পাকিস্তানী বাহিনীর ধ্বংসসাধন এবং একই সাথে শিলিগুড়ি করিডােরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যে। কার্যতঃ গােটা উত্তরবঙ্গ এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার লক্ষ্যেই প্রণীত হলাে ৩৩ কোরের মূল পরিকল্পনা। পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে মূল আক্রমণ রেখার নির্ধারণ নিয়ে ৩৩ কোর অধিনায়ক থাপান এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক অরােরার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। অরােরা হিলি-ঘােড়াঘাট অক্ষ বরাবর থাপানের মূল আঘাত হানাকে যুক্তিযুক্ত মনে করালেন। তার কাছে একটি ব্রিগেড আয়তন সেনাদলকেই উপরােক্ত কাজের জন্যে যথেষ্ট বলে মনে হলাে। তারপর তিনি হিলি আক্রমণের জন্যে নির্ধারিত ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের বাকি ব্রিগেডগুলােকে সেক্টরের বিভিন্ন শহরগুলাের দিকে ধাবিত করতে চাইলেন সেগুলাে দখলের জন্যে। থাপান প্রথমতঃ হিলি-ঘােড়াঘাট মূল আক্রমণ রেখার প্রশ্নে দ্বিমত পােষণ করেন। হিলির সুরক্ষিত অবস্থানকে এড়িয়ে খানিকটা ঘুরপথে গাইবান্ধার দিকে ধাবিত হওয়াকেই থাপান অধিক যুক্তিসঙ্গত বলে ধরে নিলেন এবং এজন্যে একটির পরিবর্তে দুটি ব্রিগেডের একত্রিত শক্তি ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।
শেষমেষ উত্তর বঙ্গের যুদ্ধের জন্যে যে আক্রমণ পরিকল্পনা গৃহীত হয় তা হলাে ঃ
এক, একটি ব্রিগেড গ্রুপ পরিমাণ সেনাদল পঞ্চগড়-ঠাকুরগা হয়ে দক্ষিণে দিনাজপুরের দিকে আত্রাই বরাবর অগ্রসর হবে এবং কান্তানগর সেতুর কাছে এসে অবস্থান নেবে। এই কার্যক্রমের জন্যে ব্রিগেডিয়ার কাথাপালিয়ার নেতৃত্বে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপকে নির্বাচিত করা হলাে। তবে ব্রিগেডটির কার্যক্রম পরিচালিত হবে সরাসরি ৩৩ কোরের অধীনে থেকে। | দুই ২০ মাউনটেনের একটি ব্রিগেড দক্ষিণ দিক থেকে দিনাজপুর দখলে এনে উত্তরে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের সাথে সংযােগ স্থাপন করবে। এই আক্রমণ রেখা রচনায় ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেডকে নিযুক্ত করা হলো। | তিন, অপর একটি ব্রিগেড ফুলবাড়ী-চরকাই অক্ষে ধাবিত হয়ে পলাশবাড়ী দখলে এগিয়ে যাবে। এই অক্ষের দায়িত্ব অর্পিত হয় ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেডের ওপর। চার, হিলি দখল এবং একই আক্রমণ রেখা বরাবর সােজা পূর্বে ধাবিত হওয়ার জন্যে ২০২ ব্রিগেডকে মনােনীত করা হলাে। এই ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটবে ৬৬ ব্রিগেডের পাশাপাশি প্রয়ােজনে একত্রিত শক্তির সুসম ব্যবহারের জন্যে।
পাঁচ, বালুরঘাট উচ্চভূমির প্রতিরক্ষার জন্যে একটি ব্রিগেডকে সংরক্ষিত রাখা হবে। প্রয়ােজনে হিলির বিরুদ্ধেও ব্রিগেডটির সঞ্চালন ঘটানাে যেতে পারে। এই দায়িত্ব দেয়া হলাে ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেডকে। ছয়, রাজশাহীর বিপরীতে নওয়াবগঞ্জ রাজশাহী অক্ষের জন্যে ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংয়ের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড আকারের সেনাদলকেও নিয়ােগ করা হবে। এই পাচটি ব্রিগেড ছাড়াও ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের সাথে আরও দুটি ব্রিগেডের সংযােজন ঘটিয়ে এটিকে প্রচণ্ড শক্তিধর করে তােলা হলাে। এই দুটি ব্রিগেডের একটি ৩ আর্মার্ড এবং অপরটি ৪৭১ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড। এই সেক্টরের ভারতীয় সমাবেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পদ্মার উত্তর ভাগের বিস্তৃত অঞ্চলে আগেভাগেই একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ডিভিশনের সমাবেশ ঘটায়। এর অধীনস্ত ২০৫ ব্রিগেডের সঞ্চালন ঘটানাে হয় মূলতঃ হিলি অক্ষে। ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত হয় রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুরসহ উত্তর ভাগের প্রবেশদ্বার রক্ষার দায়িত্ব। ৩৪ পদাতিক ব্রিগেডকে নিয়ােজিত করা হয় জয়পুরহাট, নওগা ও নাটোরের প্রতিরক্ষায়। রাজশাহীর প্রতিরক্ষার জন্যে রাজশাহী এডহক ব্রিগেড সৃষ্টি করে সেটিকে এর জন্যে নিয়ােগ করা হলাে। একমাত্র ট্যাংক রেজিমেন্ট ২৯ ক্যাভেলরীকে ভাগ করে একটি করে স্কোয়াড্রন দেয়া হলাে ২৩, ৩৪ ও ২০৫ ব্রিগেডকে। ২৩ ব্রিগেড তার অধীনস্থ ট্যাংকের সমাবেশ ঘটায় বােদাঠাকুরগা অক্ষে। অন্যদিকে ২০৫ ব্রিগেড তার অধীনস্থ স্কোয়াড্রনটির সমাবেশ প্রথমে নওগা এলাকায় ঘটালেও পরে তা হিলির পশ্চাদ্ভাগে নিয়ে আসে। শেষােক্ত স্কোয়াড্রনটি অবস্থান নেয় হার্ডিঞ্জ সেতুসংলগ্ন কৌশলগত অবস্থানে। | যুদ্ধের উত্তাপ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে শিলিগুড়ি করিডােরের নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পঞ্চগড়-ঠাকুরগা অক্ষের পাকিস্তানী সেনা সমাবেশের ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড ২৮/২৯ নবেম্বর রাতে তাদের আক্রমণের সূচনা করে এবং পরবর্তী দুই দিনে তারা সম্মিলিতভাবে ঠাকুরগার শহরতলিতে পৌঁছে যায়। ৪ ডিসেম্বর পঞ্চগড়-বােদা দখলে এনে ৭১ মাউন্টেন দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে তার নির্দেশিত লক্ষ্যের দিকে এবং ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বীরগঞ্জ দখল করে নেয়। এর ফলে পাকিস্তানীদের জন্যে উত্তর দিক থেকে দিনাজপুর এবং | সৈয়দপুর উভয়ই হুমকির মুখােমুখি হয়ে পড়ে।
স্থাি পকেটের ভুরুঙ্গামারী এলাকা যুদ্ধ শুরুর আগেই মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে যায়। এরপর ৯ মাউন্টেন ব্রিগেড তেমন কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দখল করে নেয়। অর্থাৎ তিস্তার উত্তর ভাগ ৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই পাকবাহিনীর | দখলমুক্ত হয়ে যায়। এরপরও ১ মাউন্টেন তার দক্ষিণমুখি চাপ অব্যাহত রাখে এবং এর ফলে পাকিস্তানীদের রংপুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। ৯ মাউনটেনের এই | কৌশলী আচরণ রংপুর এলাকায় ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের সেনা সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে সহসাই আটকে দেয়। অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে ধাবিত ভারতীয় ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডকে ঠেকাবার জন্যে রংপুর থেকে অতিরিক্ত সৈন্য সঞ্চালনের সুযােগ পেলাে না ২৩ পদাতিক ব্রিগেড। ফলে ব্রিগেডিয়ার কাথাপালিয়ার ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের দক্ষিণমুখি শলাকা কোনাে জোরালাে প্রতিরােধ ছাড়াই তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হলাে। শিলিগুড়ি করিডােরের অনুরূপ হিলি অক্ষের বিপরীতে বালুরঘাট উচ্চভূমির নিরাপত্তার ব্যাপারেও ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সেখানকার ভারতীয় ভূখণ্ড পাকিস্তানীদের অব্যাহত গােলাবর্ষণ এবং সেই সাথে বালুরঘাটে তাদের আক্রমণের আলামত সুস্পষ্ট হবার কারণে ভারতীয় বাহিনী হিলিতে পাকিস্তানের সেনা অবস্থানগুলাে আগেভাগেই নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২ নবেম্বর ২০ মাউন্টটেন ডিভিশনের ২০২ ব্রিগেড হিলির উত্তরে নােয়াপাড়া, মােরাপাড়া ও বাসুদেবপুরে আক্রমণ চালায়। সেখানে পাকিস্তানী পদাতিক ব্যাটালিয়ন ৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থেকে জোরদার প্রতিরােধ গড়ে তােলে। এই প্রতিরােধ গুড়িয়ে দিয়ে ২৭ নবেম্বরের মধ্যেই এলাকাগুলাে ভারতীয় বাহিনীর পুরোপুরি নয়ণে এসে যায়। কিন্তু এই অখ্যাত জনপদে পাকিস্তানের দুটি পদাতিক কোম্পানীর বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেডের ব্যবহার এবং টানা পাঁচ দিনের যুদ্ধের পর ৩২
এলাকাসমূহ দখলের ঘটনা কার্যতঃ সামরিক বিচারে কোনাে তাৎপর্য বহন করে না। অথচ এই তাৎপর্যহীন যুদ্ধে ভারতীয় পক্ষে জীবনহানি ঘটে প্রায় দেড় শ। এর মধ্যে ছয় জনই অফিসার। আহত হয় আরও অন্ততঃ দুশ। পাকিস্তানীদের এ ধরনের সুরক্ষিত এলাকায় নিছক গোয়ার্তুমির আশ্রয়ে পরিচালিত এমন একটি আক্রমণ ও তার সাফল্যে ভারতীয় সমর কুশলীরা পরিতৃপ্ত বােধ করতে পারেন—সন্দেহ নেই। তবে এতে রণকৌশলগত কোনাে সার্থকতা ছিলাে বলে কোনাে সমরবিদই মনে করেন না। ইচ্ছে করলে ভারতীয় বাহিনী হিলিতে পাকিস্তানীদের এই দুর্ভেদ্য অবস্থান এড়িয়ে অনায়াসেই মূল লক্ষ্যে পেীছে যেতে পারতাে। কিন্তু তারা তা করেনি। ফলে প্রায় অকারণেই জীবন হারাতে হলাে বহু প্রতিশ্রুতিশীল সৈনিক এবং অফিসারকে। অথচ এতাে রক্ত ত্যাগের পর পুরাে এলাকা যখন নিয়ন্ত্রণে এলাে তখন দেখা গেলাে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পশ্চাদপসরণরত পাকিস্তানী বাহিনীর পেছনে তাদের সেনা সঞ্চালন করে যেতে আর আগ্রহী নয়। এর ফলে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের পুরাে ঘটনাটাই একেবারে নিরর্থক হয়ে দাঁড়ালাে। অথচ এই অভিযানের মধ্যদিয়ে সে সময় পুরাে হিলি এলাকাই দখল করে নেয়া যেতাে। | পরবর্তী এক সপ্তাহের ব্যবধানে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবার পর হিলি রণাঙ্গন আবারাে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এখানে ভারতীয় ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে ৩ ডিসেম্বর নির্দেশিত অক্ষে আক্রমণ চালাতে বলা হলাে। তবে হিলিতে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ রেখা এবার ঘুরে গেলাে। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা আগের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার আলােকে এই অক্ষে বিকল্প পথে ধাবিত করতে চাইলেন তাদের বাহিনী। ফলে সামগ্রিক পরিকল্পনায় আবারাে পরিবর্তন এলাে। এই পর্যায়ে ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড ট্যাংকের সহায়তায় বেজাই হয়ে ফুলবাড়িতে আক্রমণ চালায় এবং ৪ ডিসেম্বর সকালের মধ্যেই ফুলবাড়ি তাদের দখলে এসে যায়। এই যুদ্ধে লেঃ কর্নেল নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন আয়তনের | বাহিনীও ভিন্ন পথে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় একই সময় ফুলবাড়িতে প্রবেশ করে।
অপরদিকে ২০২ ব্রিগেড হিলির উত্তর দিক থেকে চরকাইর দিকে তাদের নতুন আক্রমণ রেখায় অভিযান চালায়। ২০ মাউন্টেনের অধিনায়ক লছমন সিং চরকাই এলাকায় ৬৬ এবং ২০২ ব্রিগেডের সাথে সম্মিলনের একটি আগাম পরিকল্পনা করেন যাতে পরবর্তীতে তার ডিভিশনের মূল আক্রমণ শলাকা হিসেবে এই দুটি ব্রিগেডকে পীরগঞ্জ ও ঘােড়াঘাট অক্ষে ধাবিত করা যায়। কিন্তু হিলি এলাকা অতিক্রম করেই ব্রিগেডিয়ার ভাট্টির ২০২ ব্রিগেড চরকাইর পথে দাঙ্গাপাড়ায় পাকিস্তানীদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে আবারাে আটকে পড়ে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয় এবারও। এ অবস্থায় লছমন সিং হিলি এলাকার মূল প্রতিরক্ষায় ব্রিগেডিয়ার পানুর নেতৃত্বে ১৬৫ ব্রিগেড রেখে আরও উত্তর থেকে চরকাইর দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন বিপর্যস্ত ২০২ ব্রিগেডকে। | ইতিমধ্যে অগ্রসরমাণ ৬৬ ব্রিগেডের সাথে সংযুক্ত ট্যাংক স্কোয়াড্রনটি চরকাইতে আক্রমণের সূচনা করে। এই এলাকায় ভারতীয় ট্যাংকের উপস্থিতি পাকিস্তানীদেরকে বেশ হতবাক করে দেয়। কেননা চরকাই এলাকায় ট্যাংকের চলাচল অসাধ্য বলেই পাকিস্তানীরা আগাম অনুমান করেছিলাে। ফলে অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণের মুখে তারা চরকাই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলাে। ৫ ডিসেম্বর ভােরে চরকাই এবং একই অক্ষে অবস্থিত নওয়াবগঞ্জ ভারতীয়দের হস্তগত হয়। এরপর ভারতীয়দের পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে দাড়ালাে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পীরগঞ্জের দখল নিশ্চিত করা। লছমন সিং শক্তিশালী একটি ডিভিশন শলাকা সৃষ্টির জন্য ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেডকেও ৬৬ ও ২০২ ব্রিগেডের সাথে যুক্ত করলেন। অর্থাৎ এখান থেকে তিনটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড একত্রিত হয়ে একটি ভারসাম্যসূচক অবস্থায় এগিয়ে যাবে উত্তর বঙ্গের নির্ধারিত যে কোনাে শত্রু অবস্থানের দিকে।
সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন