You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা (৪র্থ পর্ব) - মেজর নাসির উদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক

৮ নম্বর থিয়েটার রােড। উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সেকেলে ধরনের বিশাল একটি বাড়ি। এই বাড়িতেই স্থাপন করা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় এবং মুক্তিবাহিনীর। সর্বাধিনায়কের সদর দফতর। আর এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যায় জুড়ে আছে এই বাড়িটি। বাড়ির বাইরে এবং ভেতরে বিএসএফ এর সশস্ত্র সৈনিকরা। সার্বক্ষণিক প্রহরায় মােতায়েন রয়েছে। গােয়েন্দা সংস্থার লােকজনও সেখানে রয়েছে সমান তৎপর। এই দফতরে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে সহায়তার জন্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি জুদ্র দল ব্রিগেডিয়ার গুপ্তর নেতৃত্বে কাজ করছে। ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জাতে ভারতীয় বাঙালী। তিনি এই দফতরের প্রশাসনিক কাজকর্মে সহায়তা দেয়া ছাড়াও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সামরিক মর্যাদার দিক থেকে একজন [ব্রিগেডিয়ার একজন কর্নেলের তুলনায় অবশ্যই সিনিয়র। কিন্তু ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের বাড়িতে গুপ্ত বাবুর আচার-আচরণ দেখে তাকে কর্নেল ওসমানীর অর্ধেস্তন বলেই মনে হতাে আমাদের মাঝেমধ্যে মেজাজী কর্নেলের ধমকা-ধমকীর সামনে তিনি এতােটাই ন্যক্ত হয়ে যেতেন যে সে অবস্থা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার একজন সিনিয়র অফিসার পদে তাকে তুলে আনা খুবই দুরূহ হয়ে উঠতাে  কিন্তু সম্পর্কের এই বাহ্যিক আচরণের নেপথ্যে আসল ব্যাপারটি ছিলাে একটু অন্য  রকম সেখানে মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি জোরালাে বিষয় সক্রিয় থাকার কারণে  সামরিকসুলভ নিয়ম-অনিয়ম সব তালগােল পাকিয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত ছিলেন খুবই রসিক প্রকৃতির মানুষ পেশার স্বার্থে যা কিছুই করণীয় তার সবটা তিনি স্বাভাবিক নিয়মেই গ্রহণ করতেন সেখানে প্রয়ােজনে পদমর্যাদায় খাটো হতে হলেও তার আপত্তি নেই আসলে এটি তার পেশা ও দায়িত্বের প্রতি নিখাদ আন্তরিকতা বললেও বােধ করি ভুল হবে না। কার্যতঃ কর্নেল ওসমানীর প্রতি তার আনুগত্য ছিলাে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধরত একটি জাতির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে। সেখানে পদমর্যাদার ব্যাপারটিকে তিনি সঙ্গত কারণেই গৌণ করে দেখেছেন এ ব্যাপারে কখনাে সখনাে আমরা তাকে কৌতুকচ্ছলে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি খুব নিঃসংকোচে বলতেন, তােদের কর্নেল ওসমানী হলেন গিয়ে একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। আর কোথায় আমি একজন সাধারণ ব্রিগেডিয়ার। তাহলে এবার বুঝে দেখ, পার্থক্যটা কোথায়? আমাদের কর্নেল ওসমানীও নিশ্চয়ই বিষয়টিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করতেন। ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের এই ভবনটির একাংশ ডিফেন্স ব্লক হিসেবে নির্ধারিত ছিলাে। এই ব্লকে ছিলাে সর্বাধিনায়কের দফতর এবং বাসস্থান। তার প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্বে নিয়ােজিত সেনা অফিসারদের আবাসস্থলও ছিলাে এখানেই। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারসহ আট দশজন অফিসার থাকতেন এই ব্লকে। ভবনের বাকি অংশ ছিলাে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের জন্যে নির্ধারিত।

প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদসহ তার মন্ত্রিসভার অনেকেই এখানে থাকতেন। এই উভয় দফতরের সার্বক্ষণিক কর্মব্যস্ততায় সর্বদা গমগম করতাে গােটা ভবন। শুধুমাত্র ভারতীয় ও বাংলাদেশের মানুষই নয়, বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের কৌতূহল আর মনােযােগ নিবিষ্ট থাকতাে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের এই ভবনটিকে ঘিরে। এর প্রধান ফটকে এবং ফটকের সামনের প্রশস্ত রাস্তায় অসংখ্য মানুষের ভিড় দিনরাত লেগেই থাকতাে। বিদেশী সাংবাদিকদের ক্যামেরার সতর্ক লেন্সে এই বাড়িটি আটকা পড়ে থাকতাে প্রায় সব সময়ই। ওই দিনই বিকেলের দিকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার জানালেন যে পরদিন সকালে সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর সাথে আমাদের সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই আজ আর বিশেষ কোনাে কাজ নেই। তিনি আমাদের বিশ্রাম নিতে বললেন। ডিফেন্স ব্লকের একটি ব্যারাকে আরাে কয়েকজন অফিসারের সাথে আমাদের থাকা ব্যবস্থা হয়েছে। রাতে সেই ব্যারাকের মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় গড়িয়ে যেতে থাকলাে। দু’চোখে ঘুম নেই। কতােক্ষণে সকাল হবে সেই প্রতীক্ষা। মাথার মধ্যে সর্বাধিনায়কের সাথে অনুষ্ঠেয় সাক্ষাতকারের বিষয়টি নিয়ে অযথা নাড়াচাড়া শুরু করলাম। সার্বক্ষণিক ব্যস্ততম মানুষ কর্নেল ওসমানীর সাক্ষাত এতাে সহজে পেয়ে যাবাে ভাবিনি। সেদিন বিকেলেও দেখেছি দেশের প্রখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তার দেখা না পেয়ে মুখ কালাে করে ফিরে গেছে। ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের এই বাড়ি থেকে প্রতিদিনই এই রকম ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় অসংখ্য সাক্ষাত প্রত্যাশী মানুষ। আমাদের সাক্ষাতকারটিও বিলম্বিত হতে পারতাে সম্ভবতঃ সর্বাধিনায়ক বিষয়টিকে একটু আলাদাভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তার সাথে সাক্ষাতকারের এই সর্বশেষ ধাপটি অতিক্রম করার পরই মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্র। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ জুড়ে অবারিত এক রণাঙ্গন। সেই রণাঙ্গনে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে শুধুই প্রহর গুনছি। রণক্ষেত্রে আমাদের সেনা অফিসারদের কারা কোথায় আছে সর্বাধিনায়কের এডিসি ক্যাপ্টেন নূরের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই আমরা তা জেনে নিয়েছি। এখন শুধুমাত্র একটি নির্দেশের অপেক্ষা। এই নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের যে কোনাে রণাঙ্গন কিংবা সেক্টরে যুদ্ধে। ঝাপিয়ে পড়তে আমি প্রস্তুত। তবে বরিশাল-ফরিদপুর সেক্টরের প্রতি একটি সুপ্ত আকর্ষণ আমি অনুভব করছি। এ আকর্ষণ বােধ করি আমার শৈশব, কৈশাের ও তারুণ্যের জীবনের এই পুরাে সময়টাই আমার কেটেছে বৃহত্তর এই অঞ্চলের আলাে বাতাসে মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, সকালের সাক্ষাৎকারের সময় সর্বাধিনায়ক রণাঙ্গনের ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চাইলে আমি বৃহত্তর বরিশাল-ফরিদপুরের কথাই বলবাে। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, সে কারণে মানসিকভাবে সারারাত একটি উৎকণ্ঠার মধ্যে রইলাম।

এডিসি ক্যাপ্টেন নূরের রুমে বসে আছি কখন ডাক আসবে সেই অপেক্ষায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই কালাে স্টেনাে টেলিফোনে তলবী সংকেত পাওয়া গেলাে। পাশের রুম থেকে সর্বাধিনায়কের ডাক এসেছে। সাথে সাথে উঠে দাড়ালাম। ক্যাপ্টেন নূর আমাকে প্রথমে প্রবেশের অনুমতি দিলাে। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে মহান মুক্তিযুদ্ধের অমিয় বিক্রম কর্ণধার দাড়িয়ে আছেন। দু দিকে বাঁকানাে লম্বা ঘন ও শুভ্র গোফের আড়ালে এক অত্যুজ্জ্বল সৌম্য মুখাবয়ব চকচকে অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ চোখ। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার তাবৎ শ্রদ্ধাবােধ একত্রিত করে সামরিক কায়দায় তাকে অভিনন্দন জানালাম। হাতের ইশারায় আমাকে বসার নির্দেশ দিলেন সর্বাধিনায়ক টেবিলের ওপর থেকে আমার বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা এক প্রস্ত কাগজ তুলে নিলেন হাতে আনমনে চোখ বুলালেন তাতে। তারপর পুনরায় তাকালেন আমার দিকে। খুবই সংক্ষিপ্ত দু একটি প্রশ্ন করে তারপর বললেন, তুমি এখন এসাে। প্রয়ােজনে আবার ডাকবাে  হতাশই হলাম সর্বাধিনায়কের এই সংক্ষিপ্ত আচরণে। তার কাছে প্রত্যাশা ছিলাে অনেক বেশী। বােধ করি এ কারণেই হতাশাবােধের মাত্রাও বেড়ে গেলাে। আবার সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে আমাদের করণীয় কাজকর্মের ব্যাপারে আশানুরূপ কোনাে নির্দেশও পেলাম না। বিশেষ করে পােস্টিংয়ের ব্যাপারে এই সাক্ষাতকারেই একটি তাৎক্ষণিক আভাস পাবে বলে ধারণা। করেছিলাম। কিন্তু কিছুই হলাে না। একটি বিষণ মন নিয়ে সর্বাধিনায়কের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। 

এর কিছুক্ষণ পর গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের কাছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত পােস্টিংয়ের ব্যাপারে কোনাে সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম। কিন্তু তখনই তিনি আমাকে এ ধরনের কোনাে সিদ্ধান্তের কথা জানাতে পারলেন না। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে জানানাে হলাে যে সর্বাধিনায়ক তখনাে পর্যন্ত আমাদের ব্যাপারে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। তবে আগামী দিন কয়েকের মধ্যে বিষয়টির একটি ফয়সলা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হলাে। | ওই দিনই রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ক্যাপ্টেন নুর এসে খবর দিলেন যে সর্বাধিনায়ক আমাকে তলব করেছেন। বুকের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হলাে আবার। ভাবলাম হয়তাে এবার একটা হিল্লে হবে। মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে সর্বাধিনায়কের রুমে গিয়ে ঢুকলাম এবং যথারীতি অভিবাদন জানানাের পর কোনাে কথা না বলে নির্দেশের অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকলাম। লক্ষ্য করলাম, র্বাধিনায়কের মুখমণ্ডলে ইতিমধ্যেই কিছু উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন এসেছে। খুব চিন্তিত এবং গম্ভীর মনে হচ্ছে এখন তাকে। আশায় বুক বাধলাম। ভাবলাম, তিনি হয়তােবা আমাকে কোথায় পাঠানাে যায় সে ব্যাপারেই ভাবছেন। তিনি সম্ভবত খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই আমাকে দেবেন।  অধীর অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি। রক্তে টের পাচ্ছি অজানা শিহরণ। কি নির্দেশ দেবেন সর্বাধিনায়ক। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলাে। মুখ খুললেন চিন্তিত সর্বাধিনায়ক। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে ১৯৭০ সালের নবেম্বর মাসের একটি ঘটনার প্রতি তিনি আমার মনােযােগ আকর্ষণ করলেন। বললেন, পাকিস্তানী এক সেনা কর্মকর্তার আত্মীয় দুই মহিলাকে নিয়ে তুমিই তাে সিলেটে আমার বাড়িতে গিয়েছিলে, তাই না?

আচমকা আঁতকে উঠলাম আমি। নিমিষে ওলট-পালট হয়ে গেলাে সবকিছু। রক্তের মধ্যে উবে গেলাে সমস্ত শিহরণ। এখন আর মুক্তিযুদ্ধ নয়, এক অনাকাক্ষিত আতংক পেয়ে বসলাে আমাকে। খুব বিনীতভাবে জবাব দিলাম, হ্যা, আমিই গিয়েছিলাম। ৰ্বাধিনায়ক এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কেনাে গিয়েছিলে? তিনি ওই ঘটনার সবিস্তার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। এমন একটি পরিস্থিতির জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার জানা মতে এই ঘটনার আদৌ কোনাে গুরুত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষেই সেটি ছিলাে সিলেটে কর্নেল ওসমানীর বাসভবনে সাদেকা এবং তার মায়ের নিছক একটি সৌজন্যমূলক সাক্ষাতকার মাত্র। কনেল ওসমানী তখন তার নিজ বাড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন এবং সে সময় তিনি তেমন কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও নন। এ অবস্থায় তারই এক সময়কার উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার পত্নী এবং কন্যার এই সৌজন্য আতিথ্য গ্রহণের মধ্যে তিনি কি এমন গুরুত্ববাহী আলামত আজ এতােদিন পরে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন তা আমার বােধগম্য হলাে না। উপরন্তু এই আতিথ্য গ্রহণের আগে কর্নেল ওসমানীকে রীতিমতাে অতিথিদের পরিচিতি দেয়া হয়েছিলাে এবং সব শুনে তিনি নিজেই সম্মানিত অতিথিদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলেন।  আজ প্রায় আট মাস পরে এই অতি সাধারণ একটি ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে সর্বাধিনায়ক আমাকে রীতিমতাে এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলেন। কিন্তু জানতে যখন চেয়েছেন জবাব তাে একটি আমাকে দিতেই হবে। আমি আমার জানা মতাে ঘটনার সবিস্তার তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু দুঃখজনক যে আমার এই জবাব তার মনােপুত হলাে না। তিন প্র কুঞ্চিত করে একটু বিরক্তির সাথেই বলে উঠলেন, না না, ব্যাপারটি অতাে সাদামাটা ছিলাে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনাে মতলব ছিলাে। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমার মনে হয় তুমিও তা জানতে। এ কথায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সাংঘাতিক এক অসহায়ত্ববােধ আমাকে ক্রমেই যেনাে নির্জীব করে ফেলছে। এখন কি বলবাে বুঝে উঠতে পারছি না। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। কপালে। অপ্রীতিকর কিছু একটা ঘটে যাবার আশংকায় এই মুহূর্তে আমি রীতিমতাে আতংকিত হয়ে উঠছি। এরপর অনেক কষ্টে আমি নিজেকে সংযত করে বিনয়ের ভাব যতােদূর সম্ভব নমনীয় করে বললাম, ঘটনাটি খুবই সামান্য এবং এর সাথে অন্য কোনাে মতলব জড়িত ছিলাে বলে আমার কখনাে মনে হয়নি।

সর্বাধিনায়কের চিন্তিত মুখমণ্ডলে এ আশ্বাস কোনাে পরিবর্তনই আনতে পারলাে না। বরং তাকে আরাে বেশী চিন্তিত মনে হলাে। রুমের মধ্যে অনবরত পায়চারি করছিলেন। এখন কি বলবেন তিনি, কি নির্দেশ জারি হবে আমার জন্যে! ভাবতে গিয়ে সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা হয়ে আসছিলাে। কপালের ঘাম আর বিন্দুর মধ্যে নেই। তা ছড়িয়ে গেছে শরীরের সর্বত্র। এক রকম নেয়ে উঠেছি বলা যায়। পাকিস্তানী বন্দীশিবিরের হিম শীতল নির্জীবতায় আমি আবার অচল হয়ে পড়ছিলাম ক্রমান্বয়ে। | রুমের মধ্যে কোনাে শব্দ নেই। নাকি কোনাে শব্দ হয়েছিলাে আমি শুনতে পাইনি, কে জানে! পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে উঠার জন্যে নিজের মধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে আত্মস্থ হবার চেষ্টা করলাম। অনেক সময়ের নীরবতা ভঙ্গ করে এবার সর্বাধিনায়কের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, তুমি কি বুঝতে পারােনি যে ওরা স্পাইংয়ের জন্যে আমার বাসভবনে গিয়েছিলাে? আমি বললাম, হতে পারে স্যার, তবে আমার তা জানা নেই। সর্বাধিনায়ক তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এরপর বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও, পরে এ বিষয়ে আবার কথা হবে। | দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস নিয়ে খুব ধীর পায়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। আমি বিধ্বস্ত প্রায়। সামান্য সময়ের ব্যবধানে আমার অবস্থার এই রূপান্তর দেখে ক্যাপ্টেন নূর যেনাে আঁতকে উঠলে সে। সেব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলাে কি ব্যাপার।  তাকে জবাব দেয়ার মতাে মানসিক অবস্থা আমার ছিলাে না। নিঃশব্দে ক্যাপ্টেন নূরকে। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। তারপর সােজা গিয়ে ঢুকলাম ডিফেন্স ব্লকের ব্যারাকে সেখানে মেঝেয় পাতা আমার নির্দিষ্ট বিছানায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম। এ মুহূর্তে কোনাে কিছুই আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। না মুক্তিযুদ্ধ, না পােস্টিং। সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সর্বাধিনায়কের পরবর্তী তলবের অপেক্ষা করা ছাড়া বাকি সবকিছু এখন ঘাের অন্ধকারে নিমজ্জিত।  নিজের এই বিধ্বস্ত অবস্থার সাথে বদি আর আবুল হােসেনকে জড়াতে ইচ্ছে হলাে না। তাদের মধ্যে মুক্তির আনন্দ। এই আনন্দকে কোনাে বিষাদের আতংক দিয়ে নতুন করে আর অস্থিরতা বাড়াতে চাই না। আমার এই মনােকষ্টের কথা তাদের কাউকেই জানালাম না। কেবল গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে পুরাে ঘটনাটা বলে রাখলাম। ঘটনা শুনে তিনিও একটু শংকিত হলেন এবং বিষয়টি হালকা করার জন্যে এ ব্যাপারে সর্বাধিনায়কের সাথে কথা বলবেন বলেও আমাকে আশ্বাস দিলেন।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন এই আলাপ কখনাে করেছিলেন কিনা জানি না। তবে পরবর্তীতে যে কোনাে  কাবই হােক এই ঘটনার সাথে আর কোনাে নতুন অধ্যায় সংযােজিত হয়নি। কিন্তু ওই সময়। ঘটনাটির বিষক্রিয়া আমার মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিলাে যে তার রেশ বহুদিন পর্যন্ত আমাকে বিষন্ন করে রেখেছিলাে। এরপর আরাে প্রায় দুসপ্তাহর মতাে কেটে গেলাে থিয়েটার রােডে। পুরাে সময়টাই শুয়ে বসে আর খবরের কাগজ পড়ে কাটালাম। আমাদের ব্যাপারে তখনাে পর্যন্ত কোনাে সিদ্ধান্ত নেই। সর্বাধিনায়কের কমেও আর তলব আসেনি। খোজ খবর নিয়ে বেশ বুঝতে পারলাম যে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি খুব দ্রুত ঘটছে। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এর বিস্তৃতি এখন বিশ্ব জুড়ে সম্প্রসারিত। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে মুক্ত বিশ্বের সর্বত্রই মানুষ এ মুহূর্তে আগের যে কোনাে। সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন।  লােকে লােকারণ্য কলকাতা মহানগরী। বাংলাদেশের মানুষে সয়লাব। মহানগরীর নিজস্ব জনগােষ্ঠীকেও যেনাে ছাপিয়ে যাচ্ছে এই উদ্বাস্তুদের আধিক্য। এখানে সর্বত্র প্রায় সকল কর্মকাণ্ডই চলছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। কোথাও বাংলাদেশের গণহত্যাকে ধিক্কার দিয়ে সােচ্চার আওয়াজ উঠছে কোনাে গণসমাবেশ থেকে। আবার এর পালেই দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত গড়ে তােলার জন্যে স্বেচ্ছাসেবীরা আয়ােজন। করছে নতুন সমাবেশের। এই রকম ছােটোবড় অগুণতি সমাবেশ নিয়ত লেগেই আছে গড়ের মাঠ আর চৌরঙ্গী জুড়ে। কোথাও আবার চাদা তােলা হচ্ছে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্যে। শ্রেণী ও বর্ণ নির্বিশেষ সকল স্তরের মানুষ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী অকাতরে সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। সারা কলকাতা জুড়ে রাস্তায় রাস্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশাল প্রতিকৃতি টাঙ্গানাে। হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-বুজে হলুদ মানচিত্র মেশানাে পতাকাও চোখে পড়ছে যেখানে সেখানে, অসংখ্য। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ভারতবাসীদের এই আয়ােজনের মধ্যে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাটতে মনে হয় যেনাে খুব কাছ থেকেই শুনতে পাচ্ছি বুলেটে ঝাজরা বাংলাদেশের মানুষের আহাজারি।

প্রতিটি রণাঙ্গন থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দও যেনাে শােনা যাচ্ছে এই কলকাতার রাস্তায় দাড়িয়েই।  সেদিন বিকেলে আবার আমার ডাক এলাে সর্বাধিনায়কের দফতর থেকে। এই মানুষটির প্রতি এমনিতেই মনটা বিষিয়ে ছিলাে। সেদিনের ওই ঘটনার পর থেকে তাকে নিয়ে ভালােমন্দ আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। সেই সন্দেহপ্রবণ মানুষটির কক্ষে পুনরায় তলব পেয়ে এবার আর মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণের কোনাে তাগিদই অনুভব করলাম না। আগের মতাে আর কোনাে উত্তেজনা বা শিহরণ কোনােটাই টের পাচ্ছি না নিজের মধ্যে। বরং যা হবার হবে এই রকম একটি ভাবার আমাকে পেয়ে বসলাে এবং সেই মানসিকতা নিয়েই সর্বাধিনায়কের দফতরে যাবার জন্যে উঠে দাড়ালাম। বলতে কি, আমি তখন আমার ভবিষ্যতের প্রশ্নে এক রকম হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। ইঙ্গিতে ক্যাপ্টেন নূরের অনুমতি নিয়ে অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে ঢুকে পড়লাম সর্বাধিনায়কের ফুমে। পেছনে হাতে হাত বেঁধে সর্বাধিনায়ক আনমনে পায়চারি করছিলেন রুমের মধ্যে। দরজায় শব্দ পেয়ে তাকালেন আমার দিকে। তার সেই চোখের দৃষ্টিপাত আজ কিছুটা অন্য রকম মনে হলাে। মনে হলাে যেনাে নতুন কিছু বলবেন এবার তিনি আমাকে। আমি সে “” কিছু লােনার জন্যে তাকিয়ে আছি তার দিকে। সর্বাধিনায়ক মৃদু পায়ে দু কদম এ আমার দিকে। সস্নেহে হাত রাখলেন কাধে এবং হালকা টানে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, কেমন আছাে?  কী অদ্ভুত বিস্ময়কর এই বৈপরীত্য। সর্বাধিনায়কের সাথে শেষ সাক্ষাতের পর আমার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে একটি জমকালাে উইপােকা কাজ করছিলাে গত কয়েকদিন ধরে। খুব কষ্ট হচ্ছিলাে আমার। বােধ হলাে, সেই হতাশাব্যঞ্জক উইপােকাটি হঠাৎ পিঠের শিরদাড়া বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। এ অবস্থায় আমার মধ্যে সর্বাধিনায়কের সাথে এই অন্তরঙ্গে কথা বলার একটি ইচ্ছেশক্তি ফিরে আসবার কথা।

কি বলা যায়, মনে মনে তাই গােছাচ্ছিলাম। কিন্তু বিজ্ঞ সর্বাধিনায়ক আমাকে সিদ্ধান্তে পৌছার জন্যে বেশীক্ষণ সময় দিলেন না। কাধে স্নেহময় হাতের মৃদু ঝাকুনি দিয়ে বললেন, আজ মেজর ডালিমের বিয়ে। আমি ঠিক করেছি আমার হয়ে তুমি এই বিয়েতে যাবে। একটু থেমে আবার বললেন, আমার পক্ষ হয়ে দম্পতিকে তুমিই আর্শিবাদ জানাবে  আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম সর্বাধিনায়কের দফতর থেকে। কর্নেল ওসমানীর মতাে এমন একজন ব্যক্তিত্বের মধ্যে সামান্য কয়েক দিনের ব্যবধানে আচরণের এই রূপান্তর আমাকে খানিকটা অপ্রস্তুতই করেছিলাে সন্দেহ নেই। পাশের রুমে ক্যাপ্টেন নূর খুবই উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন আমাকে নিয়ে। না জানি আবার নতুন কি ঘটে। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই তিনি প্রশ্ন করলেন, সব ঠিক আছে তাে? | ওই দিন সন্ধ্যার দিকে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে পার্ক স্ট্রিটের একটি অভিজাত হােটেলে আমরা সদলবলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেজর ডালিমের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে এই হােটেলেই। আমাদের মধ্যে আছেন ক্যাপ্টেন নূর, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আলম, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং আরাে কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা।  প্রকাণ্ড ডাইনিং হলের একটি বিশেষ স্থান আমাদের জন্যে নিদিষ্ট করে রাখা হয়েছিলাে। ডাইনিং হলে যাবার আগে লাউঞ্জে পরিচিতি পর্ব শেষ হলাে। সেখানেই মেজর ডালিমকে প্রথম দেখলাম। হাতে ব্যাণ্ডেজ, যুদ্ধাহত। খুব বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার দিকে। মুক্তিযুদ্ধের আহত সৈনিক। এই ভাগ্যবান মানুষটিকে এ মুহূর্তে রূপকথার রাজপুত্রের মতােই মনে হচ্ছে। পাশে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী এখানে পরিচয় পর্বের এক পর্যায়ে নব দম্পতিকে। সর্বাধিনায়কের শুভাশিস জানিয়ে দিলাম। 

এরপর শুরু হলাে ভােজ পর্ব। আমাদের ডাইনিং টেবিলের এক কোণে একটি মঞ্চে এক তন্বী ষােড়শী গান গেয়ে শােনাচ্ছিলাে। বিচিত্র ভাষার সব গান। এর মধ্যে হিন্দীর প্রাধান্যই ছিলাে বেশী মাঝেমধ্যে আবার অভ্যাগতদের অনুরােধও রক্ষা করতে হচ্ছিলাে তাকে। ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে আনমনে গান শুনছিলাম। হঠাৎ শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক ভারতীয় ভদ্রলােক আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাে, বন্ধ করাে এই গান। এ গান আর চলবে না। দ্রলােক আবেগে উঠে দাড়ালাে চেয়ার থেকে। তার হাতে পানীয়র গ্লাস। কথা বলতে বলতে টলছিলাে সে। | আমাদের সকলের মধ্যেই একটা অপ্রস্তুত ভাব। এই রকম একটি অনুষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা হকচকিয়ে যাবার মতােই। কিন্তু তারপরও কেউই ভদ্রলােককে বাধা দিলাে না। সে তখন তার চেয়ার ছেড়ে ওই গায়িকা ষােড়শীর দিকে এগিয়ে গেছে আরাে কয়েক কদম। একহাত উচিয়ে চিৎকার করে বলছে, আজ আর কোনাে গানই আমরা শুনবাে না। এখানে এখন শুধু একটি গানই হতে পারে—আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি……। হাত সমেত  তার বিনয়ী মাথা এবার নুয়ে এলাে মেঝের দিকে। | এ কথায় ডাইনিং রুমে সবাই নতুন এক উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসলাে। গায়িকা গান ধরলাে, আমার সােনার বাংলা….. ভালােবাসি। মুহূর্তে সবাই প্রায় উঠে দাড়ালাে। কারাে মুখে কোনাে কথা নেই। সমস্ত হলঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে যােড়শীর কণ্ঠে বাজছে ………….আমি তােমায় ভালােবাসি।। পরিস্থিতির এই আকস্মিক পরিবর্তন এবং ষােড়শীর কণ্ঠে গানটি শুনতে শুনতে আমি একটু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। সহসা আত্মস্থ হয়ে লক্ষ্য করলাম ডাইনিং টেবিলে আমরা বাংলাদেশের কয়েকজন ছাড়া আর সবাই তখন দাড়িয়ে গেছে। দেশাত্ববােধ এতােক্ষণে আমাদেরকেও নাড়া দিলাে। খাবার রেখে সবাই উঠে দাড়ালাম এবং দাড়িয়ে থাকলাম যতােক্ষণ গান শেষ না হয়। ভারতীয় সেই উৎসাহী দ্রলােক তখন মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছে আবেগে উচ্ছাসে।। | থিয়েটার রােডে আমাদের সময় আর কাটছিলাে না। সর্বাধিনায়কের দফতর থেকে কোনাে সিদ্ধান্ত তখনাে পর্যন্ত পাইনি। শুধু প্রহর গােনার মধ্য দিয়ে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আরাে অনেক স্বপক্ষত্যাগী বাঙালী অফিসারের আগমন ঘটেছে কলকাতায়।

মেজর মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর আবু তাহের, ক্যাপ্টেন দেলােয়ার, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর প্রমুখ। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। তারাও ভারতীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের দীর্ঘ পথপরিক্রমণ শেষে কলকাতায় পৌঁছেছে। এদের সবার উপস্থিতিতে সর্বাধিনায়কের দফতর সরগরম। এ অবস্থায় একদিন ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত আমাদেরকে পরদিনের লাঞ্চ বেঙ্গল সাব এরিয়া অফিসার্স মেসে বাবার জন্যে অনুরােধ করলেন। হাতে আমাদের অফুরন্ত সময়। তাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন দুপুর ১২টা নাগাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর আমাদেরকে ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন বেঙ্গল সাব এরিয়া অফিসার্স মেসে নিয়ে গেলেন। | বৃটিশ আমলের তৈরি মেস। এর ডাইনিং হলটিও প্রকাণ্ড। সেখানে অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তার সাথে পরিচিত হবার সময় সাধারণ পােশাক পরিহিত ভারিক্কি চেহারার প্রবীণ এক ভদ্রলােকের সাথে আমাদের পরচিয় হলাে। পরিচয়ের সময় এই মৃদুভাষী ভদ্রলােক সরকার’ বলে নিজেকে পরিচয় দিলেন। কথাবার্তা শুনে মনে হলাে বেশ সদালাপী নিরহংকার ব্যক্তি তিনি। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রংপুরের ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের খুঁটিনাটি নিয়ে কৌতূহল দেখালেন। তার আচরণে তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনাে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেই আমার মনে হলাে। এই নতুন পরিচিত ব্যক্তির বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বদি যেনাে আজ একটু বেশি উৎসাহী হয়ে উঠলাে। চটপট জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাে সে। মিঃ সরকারের সাদামাটা আচরণের কারণে তাকে খুব উচ্চ স্থানীয় কোনাে সামরিক কর্মকর্তা বলে হয়তাে মনে করতে পারেনি সে। | আলাপচারিতা শেষ হবার পর আমরা সবাই খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। প্রায় জনা চল্লিশেক মানুষ। এর মধ্যে বদি, আবুল হােসেন আর আমি এই তিনজন বাংলাদেশের। বাদবাকি সবাই ভারতীয় কর্মকর্তা। আমি, বদি আর আবুল হােসেন টেবিলের মাঝখান বরাবর বসেছি। আমাদের উল্টো দিকে বসেছেন প্রবিণ ভদ্রলােক মিঃ সরকার। খেতে খেতে বদি হঠাৎ করেই তাকে প্রশ্ন করে বসলাে,  আপনি কি করেন? সরকার সাহেব যেনাে একটু চমকে গেলেন। কিন্তু তার এই অপ্রস্তুত অবস্থা কণ্ঠস্বর শুনে বােঝা গেলাে না। যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে তিনি বদির প্রশ্নে জবাব দিলেন।

বললেন, আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আপনার ব্যাংক জানতে পারি? মুরগীর এক টুকরাে মাংস চিবােতে চিবােতে বদি আবার প্রশ্ন করলাে।  ভদ্রলােক এবার খুবই বিব্রত হলেন বলে মনে হলাে। বদির প্রশ্নের ধরন দেখে আমিও অপ্রস্তুত হলাম। বদি যেনাে আজ খানিক বেশি চটপটে হয়ে উঠেছে। কথাবার্তাও বলছে। বেশি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাকে থামানাের চেষ্টাও দুরূহ কাজ। হঠাৎ আমার খেয়াল হলাে বদির শেষ প্রশ্নটি শােনার পর ডাইনিং টেবিলে সকলেই তাদের খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সকলেরই চোখ ছুটোছুটি করছে একবার বদির দিকে একবার মিঃ সরকারের দিকে। একটি নাটকীয় অবস্থা এখন ডাইনিং টেবিলে এবং নাটকের শেষ দৃশ্যটি দেখার জন্যে সবাই যেনাে উদগ্রীব। এদিকে বদিও ছাড়বার পাত্র নয়। সে তার প্রশ্নের জবাব সােনার জন্যে মিঃ সরকারের। দিকে তাকিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে মুরগী চিবােচ্ছে। সরকার সাহেব এবার আগের মতােই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আমি একজন কোর কমাণ্ডার, লেঃ জেনারেল। কথা শেষ করেই তিনি পূর্বাপর খাবারে মনােনিবেশ করলেন। বদি এখন অপ্রস্তুত। সরকারের পরিচিতি শুনে হঠাৎ করেই দমে গেলাে সে। খাবার টেবিলের চতুর্দিকে উপবিষ্ট সবার দৃষ্টি বদির এই অসহায়ত্ব উপভােগ করছে। আর বদিকে দেখে মনে হচ্ছে এই রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার অভিজ্ঞতা তার জীবনে সম্ভবতঃ এটাই প্রথম।  জেনারেল সরকার বদির অন্তর্গত এই অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। মৃদুহাস্যে বললেন, ঠিক আছে, এটা এমন কোনাে ব্যাপার নয়। খাবার শেষ করাে। বদি কিন্তু এরপর পুরােপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি। না পারারই কথা। কারণ সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের মুখােমুখি হবার ঘটনা তার চাকরি জীবনে এবারই প্রথম। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বদিউজ্জামান বা আমার মতাে জুনিয়র অফিসার কোনাে জেনারেলকে প্রশ্ন করা তাে দূরে থাক, মুখােমুখি বসার সুযােগ পাবার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাতে পারে না। ফলে জেনারেলের এই ঘাের কাটিয়ে আত্মস্থ হতে বদির সময় লাগলাে আরও অনেক। | ক্যাপ্টেন নূর দু দিনের ছুটিতে কল্যাণী গেছে। কল্যাণী সীমান্তবর্তী একটি ভারতীয় লােকালয়। সেখানে বাংলাদেশের বেশ কিছু উদ্বাস্তু পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে।

ক্যাপ্টেন নূর যে দু’দিন কল্যাণী থাকবে তার অনুপস্থিতিতে সেই সময়ের জন্যে ষ্টাফ দায়িত্ব আমাকে পালন করার অনুমতি দিয়েছেন সর্বাধিনায়ক। কাজকর্মহীন অফুরন্ত অবসরে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সুতরাং প্রস্তাবটি খারাপ লাগলাে না। সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। রংপুর থেকে পালিয়ে আসার পর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে এটা ছিলাে আমার প্রথম সরকারী দায়িত্ব। রােববার এবং সােমবার মাত্র দুটি দিনের জন্যে এই দায়িত্ব বর্তেছে আমার ওপর। রােববার সকালে ৮টা বাজার আগেই খুব উৎসাহ নিয়ে সর্বাধিনায়কের পাশের রুমে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে গিয়ে বসলাম। অন্যান্য দিনের তুলনায় কাজকর্মের চাপ আজ অনেকটা কম। লােকজনের ভিড়ও তেমন নেই। বেশ নির্বিঘ্ন ডিউটি। বসে আছি তাে আছিই সর্বাধিনায়কের রুম থেকেও কোনাে ডাকাডাকির ত্রস্ততা নেই। সামনের টেবিলে রাখা টেলিফোন সেটেও কোনাে সাড়াশব্দ নেই সেই সকাল থেকেই।  অনিধারিত চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর বেলা প্রায় ১০টার দিকে সহসা টেলিফোন বেজে উঠলাে। এই প্রথম টেলিফোন। খুব ব্যস্ত হয়ে সাথে সাথেই রিসিভার তুলে নিলাম। ওপাশ থেকে কার ভরাট কণ্ঠ শুনতে পেলাম, হ্যালাে, কে বলছেন। প্রশ্নকারী বােধ করি আমার ‘হ্যালাে’ শব্দটি শুনে ক্যাপ্টেন নূরের অনুপস্থিতি টের পেয়ে গেছেন। আমি আমার পরিচয় জানাতেই তিনি উল্লসিত হয়ে পড়লেন, তুমি নিশ্চয়ই রংপুরের ২৯ ক্যাভেলরী থেকে এসেছাে? জি, সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম। প্রশ্নকর্তা এবার এমনভাবে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন যে মনে হচ্ছিলাে আমরা দুজন বহুদিনের পরিচিত। তিনি প্রথমেই আমার কুশল জানতে চাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তােমার পােস্টিং কোথায় হয়েছে ? আমার কোনাে পােস্টিং তখনাে পর্যন্ত হয়নি শুনে প্রশ্নকর্তা যেনাে আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, বল কি? এখনাে হয়নি? কেনাে? টেলিফোনে কথা বলতে বলতে প্রশ্নকারীর প্রতি আমার কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছিলাে। এতােক্ষণ ধরে কথা বলছি অথচ তার পরিচয় জানা হয়নি। তবে কথাবার্তা এবং প্রশ্নের ধরন শুনে ইতিমধ্যেই অনুমান করে নিয়েছি যে তিনি আর যাই হােন খুব সাধারণ কেউ নন। তাছাড়া এই অচিন কোলকাতায় আমার খুব নিকটতম স্বজন কেউ আছে বলেও জানা নেই।

অথচ প্রশ্নকর্তা যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি আমার অনেক কিছুই জানেন। আমি কৌতুহল দমন করতে না পেরে এক ফাকে তার পরিচয় জানতে চাইলাম। ওপাশ থেকে এবার জবাব এলাে, আমি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার অরােরা। মুহূর্তে চমকে উঠলাম। পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়কের গুরুত্ব অনুধাবনে আমার কষ্ট হবার কথা নয়। যদিও অরােরা নামের সাথে আমি এর আগে কখনাে পরিচিত হবার সুযােগ পাইনি। টেলিফোনে কথা বলার সময় এটুকুই কেবল বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রশ্নকর্তা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ভারতীয়। কিন্তু তিনি যে স্বয়ং পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক অরােরা আমার অনুমান ঠিক ততােদূর গড়ায়নি। পরিচয় পাবার পর আমি যথারীতি তাকে অভিবাদন জানিয়ে খুব বিনয়ের সাথে তার পরবর্তী কথা শােনার অপেক্ষায় রইলাম। জেনারেল অরােরা এবার জানালেন যে তিনি আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে জরুরী কোনাে বিষয়ে আলাপ করতে চান কাজেই তক্ষুণি যেনাে টেলিফোনে তাকে সংযােগ দেয়া হয়। সাথে সাথে আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু টেলিফোনে কয়েক দফা সংকেত দিয়েও সর্বাধিনায়কের দিক থেকে কোনাে সাড়া শব্দ পাওয়া গেলাে না। অথচ জেনারেল অরােরা ওপাশের রিসিভারে। অপেক্ষা করে আছেন। কি করা যায় একটু ভেবে এবার আমি নিজেই উঠে গেলাম দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে দেখি সর্বাধিনায়ক টেবিল ল্যাম্পের স্বলােকে গভীর মনােযােগে কি লিখছেন। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, জেনারেল অরােরা লাইনে আছেন, তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান। সর্বাধিনায়ক মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। কয়েক মুহূর্ত কি যেনাে ভাবলেন। কিন্তু আমার বার্তাটি তাকে এ ব্যাপারে সামান্যতম উৎসাহিত করতে পেরেছে বলে মনে হলাে না। যেনাে এটা কোনাে ব্যাপারই নয় এমনভাবে তিনি বললেন, জেনারেল অরােরাকে বলে দাও আমি এখন ব্যস্ত। পরে অবসর মতাে তাকে রিং করবাে। বলেই তিনি আবার লেখায় মন দিলেন।

সর্বাধিনায়কের এই জবাব একটি অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিলাে আমাকে। আমার ধারণা হলাে তিনি হয়তাে আমার কথা বুঝতে পারেননি অথবা এমনাে হতে পারে যে টেলিফোনকারীর নাম তিনি ভুল শুনেছেন। ব্যাপারটি নিশ্চত হবার জন্যে আমি খুব। বিনীতভাবে সর্বাধিনায়ককে আবার বললাম, জেনারেল আরােরা টেলিফোনে অপেক্ষা। করছেন। খুবই জরুরী। সর্বাধিনায়ক এবার রীতিমত বিরক্ত হলেন। মুখ শক্ত করে রাগত স্বরে বললেন, আমি তােমার কথা ভালােভাবে শুনেছি এবং বুঝতে পেরেছি এবং এ ব্যাপারে তােমাকে যা বলেছি তুমি জেনারেলকে তাই জানিয়ে দাও, যাও। এ কথার পর সর্বাধিনায়কের রুমে আর দাড়িয়ে থাকার কোনাে যুক্তি থাকে না। আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু জেনারেল অরােরাকে কি বলি? সর্বাধিনায়ক রুমে থেকেও টেলিফোন ধরতে অস্বীকার করেছেন এ কথাটা তাকে কেমন করে বলবাে। উপায়ন্তর না দেখে বিষয়টি গ্রহণীয় করার জন্যে আমি জেনারেল অরােরাকে জানিয়ে দিলাম যে সর্বাধিনায়ক মন্ত্রীপরিষদ কক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। অবসর হওয়া মাত্রই তিনি নিজে আপনাকে টেলিফোন করবেন। | টেলিফোন ছাড়ার আগে জেনারেল অরােরা আমাকে আরেকবার বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিলেন। তিনি এও বললেন যে বিশেষ কাজে তাকে কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে এবং বাইরে। যাবার আগে সর্বাধিনায়কের সাথে তিনি জরুরী আলাপ সেরে যেতে চান। তারপরও প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেলাে। সর্বাধিনায়কের রুম থেকে কোনাে সাড়াই পাচ্ছি । সময় অতিক্রমের সাথে সাথে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। এমন সময় আবার টেলিফোন বেজে উঠলাে। সকালের সেই পরিচিত কণ্ঠ, জেনারেল অরােরা। টেলিফোনে এবার আর অন্য কোনাে আলাপ না করে সরাসরি জানতে চাইলেন সর্বাধিনায়ক অবসর কিনা এবং কোথায় আছেন। আমি তাকে লাইনে অপেক্ষা করার অনুরােধ জানিয়ে আবার গিয়ে ঢুকলাম পাশের রুমে। সর্বাধিনায়ক আগের মতােই নির্বিকার লিখে চলেছেন। আগমন টের পেয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি খুব ভয়ে ভয়ে তাকে জেনারেল অরােরার টেলিফোন করার কথা জানাতেই সহসা জ্বলে উঠলেন তিনি। দাত-মুখ খিচিয়ে কঠোরভাবে আমাকে বললেন, তুমি এই বার্তা নিয়ে আরেকবার যদি আমার রুমে প্রবেশ করাে তাহলে তােমাকে আমি আবার ফোর্ট উইলিয়ামে পাঠাবার ব্যবস্থা করবাে। এ অবস্থায় সর্বাধিনায়কের রুমে আর এক মুহূর্ত দাড়িয়ে থাকার অর্থই হচ্ছে ফোর্ট উইলিয়ামে যাবার পথ প্রশস্ত করা। কোনাে যুক্তি নেই। আরেক দফা ফোর্ট উইলিয়ামে যাবার। সুতরাং তক্ষুণি প্রস্থান। প্রস্থান সর্বাধিনায়কের রুম থেকে শুধু নয়, গােটা অফিস থেকেই। আমার সরকারী দায়িত্ব পালনের ইচ্ছে আপাততঃ এখানেই শেষ। সর্বাধিনায়কের রুম থেকে বেরিয়ে এসে টেবিলে নামিয়ে রাখা রিসিভারে শুধু বললাম, তিনি মন্ত্রীদের সাথে এখনাে বৈঠক করছেন। তারপর টেলিফোন ফেলে রেখে সােজা ডিফেন্স ব্লক। কিন্তু সেখানেও নিজেকে নিরাপদ মনে হলাে না। বদিকে বললাম, টাকা পয়সা কতাে আছে বলাে। এক্ষুণি নগর ভ্রমণে বেরুতে হবে।

 সর্বাধিনায়কের দফতরে জেনারেল অরােরার টেলিফোন সংকটটি শেষ পর্যন্ত কতােদূর। গড়িয়েছিলাে জানি না। জানতে চেষ্টাও করিনি। তবে ফোর্ট উইলিয়ামের আতংকের কথা মনে রেখে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে ঘটনাটি জানিয়ে বলেছিলাম, এই কঠিন দায়িত্ব পালন আমাকে দিয়ে একেবারেই অসম্ভব। কারণ আমি ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে পা বাড়াতে আর রাজি নই। এই ঘটনার ঠিক পরদিনই সর্বাধিনায়ক আবার তলব পাঠালেন। খুব ঘাবড়ে গেলাম আমি। আগের দিনের অসহায় অবস্থাটা তখনাে পর্যন্ত পুরােপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ভেতরে ভেতর একটা সন্ত্রস্ত ভাব কাজ করছিলো, কখন জানি আবার ডাক আসে। কিন্তু আশ্বস্ত হলাম যখন শুনলাম সর্বাধিনায়ক আমাকে একা নয়, আমাদের তিন জনকেই একসাথে। ডেকেছেন। আমি মােটামুটি নিশ্চত হলাম যে এবার আমাদেরকে পােস্টিং দেয়া হবে। কাপড়-চোপড় পড়ে বদি আর আবুল হােসেনকে সাথে নিয়ে সর্বাধিনায়কের দফতরে। গিয়ে দেখলাম সেখানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারও রয়েছেন। এবার আমার অনুমানের ব্যাপারে অারাে নিশ্চিত হলাম। পােস্টিংয়ের জন্যে মানসিকভাবে পুরােপুরি প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। সবাধিনায়ক তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন। আমরা তিনজন তার সামনে গিয়ে দাড়াতেই তিনি বললেন, আমি তােমাদের পােস্টিংয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তােমরা পূর্বাঞ্চলীয় ৩ নম্বর সেক্টরে কর্নেল শফিউল্লাহর অধিনে কাজ করবে। শফিউল্লাহ খুবই দক্ষ ও সাহসী অধিনায়ক। ৩ নম্বর সেক্টরে তার অধীনে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তােমরা যেহেতু নিয়মিত বাহিনীর অফিসার সে কারণে আমি ঠিক করেছি এই ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেই তােমরা যােগ দেবে। আবুল হােসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তােমার দায়িত্ব হবে ৩ নম্বর সেক্টরের যাবতীয় যান্ত্রিক রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি করা। এরপর তিনি গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে আমাদের আগরতলা যাবার বন্দোবস্ত করার নির্দেশ দিলেন। | মুহূর্তে সমস্ত শরীর হালকা হয়ে এলাে আমার। মনে হলাে বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘদিনের ভারী একটি পাথর যেনাে নিচে গড়িয়ে পড়লাে। প্রায় দেড় মাস আগে রংপুর সেনাছাউনি থেকে যে অনিশ্চিত যাত্রার শুরু বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সে যাত্রা পথের যেনাে শেষ হলাে আজ। | সর্বাধিনায়কের রুমে তারপর যে ছােট্ট ঘটনাটি ঘটলাে তা বিশেষ করে আমার জন্যে খুবই স্মরণযােগ্য। লক্ষ্য করলাম নিয়ােগপত্রে লিখিত আমার নামের দিকে তাকিয়ে তিনি কি যেনাে ভাবছেন। সহসা তিনি জানতে চাইলেন আমি আমার পুরাে নাম কি লিখি? এবার সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকালেন সর্বাধিনায়ক।

 আমি আমার নাম বলতেই তিনি – কুঞ্চিত করলেন। আমার উচ্চারিত নামটি একবার আওড়ালেন, নাসির উদ্দীন খান। তারপর বলে উঠলেন, নাহ, তােমার নামের শেষে কোনাে বানটান রাখা চলবে না। আমি তােমার নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি বাদ দিতে চাই। অবশ্য এতে যদি তােমার কোনাে আপত্তি না থাকে। বিষয়টি আমার কাছে খুব একটা গুরুত্ববহ মনে হয়নি। যে কারণে আমি জবাবে কিছু না ভেবেই জানালাম, আমার কোনাে আপত্তি নেই। সাথে সাথে তিনি আমার নামের শেষাংশ জুড়ে কলম চালিয়ে ‘খান’ শব্দটি কেটে দিলেন। স্মিত হাস্যে বললেন, এখন থেকে তােমার নাম নাসির উদ্দীন। ৰ্বাধিনায়ক আমার নিয়ােগপত্রে শেষ পর্যন্ত এই কর্তিত নামটিই নির্ধারণ করে দিলেন যা আর কোনােদিনই বদলানাে গেলাে না। | পরদিন আমাদের যার যার হাতে আগরতলাগামী বিমানের টিকেট ধরিয়ে দেয়া হলাে। টিকেটগুলাে কাটা হয়েছে ছদ্মনামে। একটি টিকেটে আমার ডাক নামের সাথে সেন যুক্ত করে বাদল সেন করা হয়েছে। সকাল ৭ টায় ফ্লাইট। মাঝখানে শিলিগুড়ি এবং শিলচরে অল সময়ের জন্যে যাত্রার বিরতি হবে। তারপর আগরতলা। তারপর? তারপর ৫৫ হাজার বমিইলের বিশাল এক রণাঙ্গন, আমার বাংলাদেশ।  সেই কখন থেকে একটানা উড়ছি। মেঘমুক্ত আকাশের অনন্ত নিলিমায় বিরামহীন উড়ে চলেছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এফ ২৭ বিমানটি। | লম্বা ফ্লাইট। কলকাতার দমদম বিমান বন্দর থেকে টেকঅফ করে সােজা উত্তরমুখি উড়ছে ধবল যান্ত্রিক বলাকা। শিলিগুড়ি পৌছে ডানে মােড় নিয়ে পূর্বমুখি হবে এটি।  শিলচরে খানিক যাত্রা বিরতি। তারপর আবার একটানা উড়ে চলা। তখন অবশ্য দিকের পরিবর্তন ঘটবে। এরপর দক্ষিণমুখি হয়ে সােজা আগরতলা। | দশ হাজার ফুট উচ্চতার এই যাত্রাপথের পুরােটাই অতিক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষে। বেশ খানিকটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অর্থাৎ বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমা পরিহার করে এই দীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দিচ্ছে বিমানটি। | বেশ কয়েকমাস থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের আকাশসীমা পরিহার করে চলেছে। ৭১’র ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানের লাহােরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান গংগা’র ধ্বংসকে কেন্দ্র করে এ বৈরীতার সূত্রপাত। তা না হলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কোলকাতা থেকে আগরতলায় যেতে সাকুল্যে এক ঘন্টার বেশী লাগার কথা না। কিন্তু ঘুর পথে এই দূরত্ব অতিক্রমে এখন সময় লাগে চার ঘণ্টারও বেশী। প্রতিদিনই কোলকাতা থেকে একটি ফ্লাইট পূর্বাংশের সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রাখছে। ফ্লাইটটি শিলিগুরি ও শিলচর হয়ে আগরতলা পেীছে অল্প বিরতি দিয়ে আবার ফিরে আসে। কোলকাতায়। ফ্লাইটটি যখন কোলকাতা ফিরে আসে, তখন সন্ধ্যা হয়ে যায়।

মহানগরী কোলকাতার ব্যস্ততা কমে আসে অনেকটাই। ভােরে দমদম বিমান বন্দরে আমরা যথাসময়ে পৌছে যাই। আগের দিন বিকেলেই আমাদের হাতে বিমানের টিকেট, পথ খরচের সামান্য টাকা, আর সেই সাথে পােস্টিং সংক্রান্ত একটি চিঠি ধরিয়ে দেয়া হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের নির্দেশে গাড়িও হাজির হয়েছে সময় মতাে। আমি অবশ্য খুব ভাের থাকতেই তৈরী হয়ে বসেছিলাম। গােছাবার তেমন কিছু নেই। প্যান্ট এবং সাটটি পড়ে ফেললে কেবলমাত্র লুঙ্গিই থাকবে বইনযােগ্য সম্বল। সে অবস্থায় রাজ্যের ভাবনা এসে ভর করেছে কল্পনায়। নাতিদীর্ঘ জীবনের বৈচিত্রময় ঘটনাগুলাে একের পর এক এসে হাজির হচ্ছিলাে কল্পনার পর্দায়। জীবন ব্যাপ্তিতে কুড়ি বছর খুব বেশী সময় নয়। সাধারণতঃ বয়সের এই স্তর থেকেই অভিজ্ঞতার নানা বৈচিত্রময় টানাপােড়েন শুরু হয়। আমার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারতাে। কিন্তু আমাদের টানাহেচড়ার পারিবারিক বলয় এবং পরবর্তীকালীন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমার কুড়ি বছরের জীবনটুকুকে সুখ-দুঃখের নানা বৈচিত্র্যে ভরে দিয়েছে অকালেই। অনেক কিছুই যেনাে দেখা হয়ে গেলাে এইটুকু সময়ের মধ্যে। অনেক কিছু না পাওয়া জীবনে হঠাৎ কিছু পাবার স্বপ্নে আশান্বিত হবার মুহূর্তেই যেনাে সবকিছু জড়িয়ে গেলাে অনাকাক্ষিত জটিলতায়। ধূলিসাৎ হয়ে গেল আগামী দিনের স্বপ্ন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের টানাটানিতে বেড়ে ওঠা এই আমি প্রায় সার্বক্ষণিক জীবন সংগ্রামের যাতাকলে পিষ্ট হতে দেখেছি আমার বাবাকে। আমার অসুস্থ মায়ের বেদনাক্লিষ্ট মুখ অনাগত সুখের অন্বেষায় আমাকে তাড়িয়ে ফিরেছে দীর্ঘদিন। যে কারণে তারুণ্যের দুর্দান্ত সব দিনগুলাে আমাকে ব্যয় করতে হয়েছে জিবীকার সন্ধানে। অসহনীয় অভাবী বলয় থেকে বেরিয়ে খানিক স্বচ্ছলতার জন্যে কি ব্যাকুলই না হয়েছি।

সেনাবাহিনীতে যােগ দেয়ার পরে একটা পর্যায়ে মনে হয়েছিলাে আমার সেই ব্যাকুলতার অবসান হয়তাে এবার সম্ভব হবে। সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার নিঝঝাট সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এবারও বিপত্তি। অনাহূত কি এক অনিশ্চিত জীবনের হাতছানি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এলাে চড়াই-উৎরাইয়ের এক অচেনা বন্ধুর পথে। জানিনা জীবনের এই অদৃশ্য হাতছানি এরপর আবার কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে। ২ আগষ্ট ১। দুপুর ১২টার দিকে আমাদের বহনকারী ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফোকার ২৭ বিমান আগরতলা বিমান বন্দরে অবতরণ করলাে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চারদিক ভেজা। টারম্যাকের এখানে ওখানে পানি জমে আছে। বেশ বৃষ্টি হয়েছে বােঝা গেলাে। এই সেই আগরতলা কৈশােরে যার কথা শুনে তখন থেকেই এই এলাকা সম্পর্কে মনে। মনে একটি চিত্র অংকন করে রেখেছিলাম। শৈশব এবং কৈশােরের অনেকটা সময়ই আমার কেটেছে কুমিল্লাতে। চাকরির সুবাদে বাবাকে মাঝেমধ্যে ট্যুরে যেতে হতাে এবং এই ট্যুরে আমি প্রায়ই তার সঙ্গী হতাম। ফলে সে বয়সেই অনেক অচেনা জনপদ আমার পরিচিত হয়ে ওঠে। বাতিশা, চৌদ্দগ্রাম, বিবির বাজার, কসবা, আখাউড়া-ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তসংলগ্ন এ সমস্ত জায়গাগুলাে কোনাে বিশেষ কারণ ছাড়াই সে সময় আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিলাে। আখাউড়া-আগরতলার অব্যবহৃত সড়কের বিভক্তিকরণ প্রতিবন্ধকতার সামনে পিয়ন শরাফত ভাই’র হাত ধরে দাড়িয়ে কতােদিন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি ওপাড়ের শহরতলীর দিকে। বাবা যে ক’বারই আখাউড়া এসেছেন একবারের জন্যেও তার পিছু ছাড়িনি। আগরতলা শহরকে ঘিরে এক ধরনের নেশায় পেয়ে বসেছিলাে আমাকে সেই কৈশাের কাল থেকেই। এতােগুলাে বছর পর কি এক ভিন্ন পরিবেশে এবং ভিন্ন মানসিকতায় আমার দেখার সৌভাগ্য হলাে সেই আকৈশাের লালিত নগরী আগরতলা। সংগত কারণেই রােমাঞ্চিত বােধ করছিলাম। মুক্তিবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চীফ অব স্টাফের দফতরের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা | আমাদের জন্যে বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। এখানে আমাদের আসার ব্যাপারে কলকাতা থেকে বােধ করি আগাম জানান দেয়া হয়েছিলাে।

আমাদের বহনকারী জীপ কয়েক মিনিটের মধ্যেই শহরে প্রবেশ করলাে। বিমান বন্দর আর শহরের মধ্যকার দূরত্ব খুবই কম। শ্রীহীন ছােট্ট একটি শহর। কোনাে পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মফঃস্বল শহরগুলাের সাথে এর তুলনা করা চলে। আগরতলাকে কেন্দ্র করে মনে মনে যে ধারণা কৈশাের থেকে লালন করেছি তা নিমিষেই উবে গেলাে। বয়ােসন্ধিক্ষণে প্রত্যক্ষে আগরতলাকে দেখে। | শহর ছােট্ট হলেও লােকে লােকারণ্য আগরতলা। বাংলাদেশের শরণার্থীতে গিজগিজ করছে চারদিক। তুলনায় স্থানীয় লােকজন কম। এখানেও স্থানীয় আর বাংলাদেশের মানুষের পাথক্য সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অবয়বে এখানেও একটি নির্লিপ্ত বিদ্রোহী ভাব সহজেই নজরে আসে। কলকাতায় এই ব্যবধানটি আমার প্রথম চোখে পড়ে। শহর অতিক্রম করে শালবন নামের সেনানিবাস এলাকায় প্রবেশ করলাে আমাদের জাপ। চারদিকে সবুজ পাহাড় আর ঘন কৃষ্ণচূড়ার আধিপত্য ছড়ানাে সাৱা প্রকৃতি জুড়ে। এখানেই পাহাড়ের কোল ঘেষে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় দফতর। | চীফ অব স্টাফ কর্নেল রব আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। চা পান পর্বে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রণাঙ্গনের অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে মােটামুটি অবহিত করলেন। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। মনে হলাে কেউ যেনাে রূপকথার গল্প শােনাচ্ছে। ঠিক তখনই দূরে গােলা ফাটার শব্দ শুনতে পেলাম। পর পর অনেকগুলাে। কেমন এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম ভেতরে। চোখের সামনে দিব্য দেখতে পেলাম জীবন আর মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে বহুদূর চলে গেছে রক্তে পিচ্ছিল অন্ধকারময় খুব চিকন একটি পথ—যার শেষ প্রান্তে প্রজ্বলিত মশালের আলােতে বাংলাদেশের বাতাসে উড়ছে একটি পতাকা। ওই পতাকা পর্যন্ত সামনের সারা পথ এখন যুদ্ধের এবং সেই যুদ্ধের জন্যে আমাকে নেমে যেতে হবে রণাঙ্গনে। জীবনকে উপেক্ষা করে হলেও পেীছে যেতে হবে ওই পতাকার কাছে, প্রিয় স্বাধীনতার কাছে।

গাড়ীর শব্দ শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। হাজারাে এলােমেলাে ভাবনায় মােহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ী থেকে কেউ নেমে আসছে মনে হলাে। বারান্দায় পায়ের শব্দ পেলাম। আমার পেছন দিক দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাে আগন্তুক। সাধারণ বাঙালী গােছের এক ভদ্রলােক। কর্নেল রব সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন তাকে। পরিচয় করিয়ে দিলেন, তােমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সফিউল্লাহ। | মলিন খানিক হাসি ছড়িয়ে গেলাে সেক্টর অধিনায়কের মুখে। হাত বাড়িয়ে দিলেন, তােমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। কর্নেল সফিউল্লাহকে এর আগে আমি প্রথম দেখেছি রংপুরে তিতুমীর সামরিক মহড়ার সময়। এক সময়কার কেতাদুরস্ত মেজর সফিউল্লাহ আর আজকের এই সফিউল্লাহর পার্থক্য অনেক। গাড়ীতে যেতে যেতে কর্নেল সফিউল্লাহ আমাদের কাকে কোথায় পােস্টিং দেয়া হয়েছে তা বুঝিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম আমার পােস্টিং হয়েছে ২ ইস্ট বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানীতে। আর বদিকে নিয়ােগ দেয়া হয়েছে একই ব্যাটেলিয়নের ‘বি’ কোম্পানীতে। আবুল হােসেনকে রাখা হলাে সেক্টর সদর দফতরে যান্ত্রিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে। স্বল্পভাষী অধিনায়ক এরপর খুব সংক্ষেপে সংশ্লিষ্ট কোম্পানী দুটির সামরিক তৎপরতার কথা বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে। | আমাদের গাড়ী আগরতলার উত্তরে মােহনপুরের দিকে এগুচ্ছে। মােহনপুর জায়গাটা আগরতলা শহর থেকে আনুমানিক ১৫ মাইল দূরে। সেদিকে পাকা প্রশস্ত সড়ক ধরে এগুচ্ছে। জীপ। এই সড়কটি বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা পশ্চিমে রেখে চলে গেছে সােজা উত্তরে। পুরাে এলাকাটি সারি সারি পাহাড় আর জঙ্গলে ছাওয়া। এখানে নিসর্গে শব্দের কোলাহল প্রায় নেই। এরপর মােহনপুরের কাছাকাছি এসে মূল সড়ক থেকে কাঁচা রাস্তায় এসে পড়লাে আমাদের জীপ। সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেছে এই রাস্তা। রাস্তাটি কর্দমাক্ত এবং খুবই পিচ্ছিল। সাবধানে গাড়ী চালাচ্ছেন কর্নেল সফিউল্লাহ। এভাবে পিচ্ছিল রাস্তা ধরে অ্যারাে মাইল তিনেক এগিয়ে। গােলাম আমরা। এখানে অবণ্য আরাে গভীর। সেই ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে কয়েক শ’ গজ যাবার পর দুই পাহাড়ের মধ্যিখানে একটি সামরিক শিবির আমাদের দৃষ্টিগােচর হলাে। ঘাড়ী। চালাতে চালাতে কর্নেল সফিউল্লাহ সেদিকে আমাদের মনােযােগ আকৃষ্ট করে বললেন, এটা। ‘ডি’ কোম্পানীর শিবির। একটু মােড় নিয়ে আমাদের গাড়ী গিয়ে থামলাে শিবিরের সামনে।

হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণ এগিয়ে এলাে আমাদের দিকে। জীপের কাছে এসে সে কর্নেল। সফিউল্লাহকে অভিবাদন জানালাে । আমাদের সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লাে তার দিকে। দেখেই মনে হলাে অত্যন্ত নির্ভরশীল এই ব্যক্তিত্ব। আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে আছে তার। চোখেমুখে। প্রথম দেখাতেই আমার ভালাে লেগে যায় তাকে। অধিনায়ক সফিউল্লাহ পরিচয় করিয়ে দিলেন, লেফটেনান্ট মােরশেদডি’ কোম্পানী কমাণ্ডার। ‘ডি’ কোম্পানীর শিবিরে খুব বেশী সময় দিলেন না সফিউল্লাহ্। মােরশেদের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষ করে বদি আর আবুল হােসেনকে সাথে নিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। যাবার সময় মােরশেদ এবং আমাকে পরদিন সেক্টর সদর দফতরে উপস্থিত থাকার জন্যে বলে গেলেন। রংপুর সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে আসার পর দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় এবারই প্রথম আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বদিকে ক্ষণিকের জন্যে একটু আনমনা মনে হলাে। বােধ করি তাকেও আমারই মতােন করে নাড়া দিয়েছিলাে বিষয়টি। কি এক সীমাহীন মমত্ববােধ। কিন্তু নিজেকে আমি ত্বরিত সামলে নিলাম। নিয়তঃ রণক্ষেত্রে ছুটে যাবার যে স্বপ্ন দেখেছি এতােদিন এখন তার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে গেছি। এখান থেকেই যুদ্ধের শুরু। সামনে নিজ বাসভূম জুড়ে বিশাল রণাঙ্গন। সেখানে একটি বিমুক্ত মানচিত্রের গান প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় মুছনায় মথিত করছে বাংলাদেশের বাতাস। আমি আমার ভেতরে এখন আর কোনাে আবেগকে ঠাই দিতে পারি না। এই উপলব্ধি নিয়েই কলকলিয়া সামরিক শিবির থেকে বিদায় জানালাম বদি আর আবুল হােসেনকে। জনমানবহীন কলকলিয়া নামক এই জায়গাটি পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা। এই পাহাড় অরণ্যের ঝােপঝাড় বৃক্ষরাজি কেটে স্থাপন করা হয়েছে ২ ইষ্ট বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানীর। সামরিক শিবির। চারদিকে প্রায় সব সময়ই শােনা যায় ঝিঝি পােকার ডাক। মাঝেমধ্যে এই ডাক স্তব্ধ হয়ে যায় গােলা ফাটার গগন বিদারী শব্দে। ঝিঝিরা তখন থমকে যায়। এরপর গােলার শব্দও একসময় থেমে যায়। কিন্তু কি ভেবে ঝিঝিদের ডাক শােনা যায় না আরাে অনেকক্ষণ। চারপাশের নিসর্গে তখন ভয়াল নিস্তব্ধতা। তারপর এক সময় আবার মেতে ওঠে। ঝিঝিরা—একটানা, যতােক্ষণ না আরাে একটি গােলার শব্দ প্রকৃতিকে চমকে দেয়। | ওপারে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আখাউড়া থেকে সােজা উত্তরে সিলেট পর্যন্ত একেবেঁকে চলে গেছে রেললাইন। সিলেটের দিকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত একাধিকবার ভারত সীমান্ত দুয়ে গেছে এই রেলপথ। আখাউড়া থেকে তেলিয়াপাড়া, মাঝখানে কতােগুলাে অখ্যাত ঘুমন্ত জনপদ আযমপুর, সিংগারবিল, রূপা, মুকুন্দপুর, হরষপুর, কাশিমনগর, মনতলা, প্রভৃতি। এই জনপদগুলাের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে উত্তরমুখি রেলপথটি।

গােটা এলাকাই কর্নেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ৩ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত যুদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। আখাউড়া থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত সব ঘুমন্ত জনপদগুলাে বাংলাদেশের আর সব এলাকার মতােই যুদ্ধের উষ্ণতায় তেতে উঠেছে। একদিন এখানে গ্রামীণ পাখিদের কলকাকাল আর মাঠের রাখালি বাশিতে আদিগন্ত তেপান্তর জুড়ে সুরের মুর্ঘনায় উড়ে বেড়াতাে ফুরফুরে বাতাস। আজ সেই বাতাসে উড়ছে বারুদের গন্ধ। ঝােপঝাড় কিংবা বনে বাদাড়ে ঘুধু বা শালিকের ডাক বিরলপ্রায়। সেখানে এখন পত্রবিহীন শিমূলের মগডালে ঝাক বেধে অপেক্ষায় আছে মানুষ খেকো শকুনীরা। এখানে ওখানে গুলীবিদ্ধ মানব খাবলে খায় শেয়ালের ঝাক। এপাড়ে কলকলিয়ায় পাহাড়ের মাঝখানে অরণের আড়ালে যেখানে আমাদের শিবর, তার ঠিক পেছনেই খানিকটা দূরে আগরতলা। বাংলাদেশের আযমপুর-মনতলার মতােই অখ্যাত জনপদ এখানকার নরসিশর, রাংগুটিয়া, বামুটিয়া, কৃষ্ণনগর, মােহনপুর, সিদাই, মনতলা, বাশবাড়ি, পঞ্চবটি, প্রভৃতি। ওপাড়ের জনপদগুলাের মতােই এ অঞ্চলেও যুদ্ধের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ওপাড়ে যে গােলাটি নিসর্গের নৈশব্দ গুড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়, তার কম্পনে এখানেও মাটি কাপে। ওপারের যুদ্ধের শব্দে এখানেও মানুষেরা জেগে ওঠে আতংকে-শিহরণে।  পাহাড়ে-অরণ্যে ঢাকা ত্রিপুরার এই জনপদগুলাের একটি কলকলিয়ার নিঝুম সমতল ভূমিতে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কলকলিয়ার আশপাশের জনপদগুলােতেও গড়ে উঠেছে মুক্তিযােদ্ধাদের অসংখ্য শিবির। সীমান্তবর্তী এই এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে আস্তানা পেতেছে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা। এই উদ্বাস্তুদের কোনাে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। হিমালয়ের ঢাল গড়িয়ে পড়া তুষার স্রোতের মতােই ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে বাংলাদেশের ভেতর থেকে তাড়া খেয়ে অপেক্ষাকৃত এই নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে আসছে তারা। ৩ নম্বর সেক্টরের প্রায় পুরাে ভিত্তিটাই বিন্যস্ত করা হয়েছে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের দিয়ে। পাকিস্তানী বাহিনীর তাড়া খাওয়া এই রেজিমেন্টের সৈনিকরা দীর্থ পথ অতিক্রম শেষে ভারতের এই অখ্যাত জনপথগুলােতে এসে জড়াে হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই বাঙালী অধ্যুষিত ব্যাটালিয়নটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধে শরিক হয় কার্যতঃ ১৯ মার্চ থেকেই। এদিন এই ইউনিটের বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য অস্ত্রসহ ব্যাটালিয়ন এলাকা জয়দেবপুর রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধু মুজিবের কাছে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ৩০ মার্চ ব্যাটালিয়নটি সমূলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করে। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই স্বপক্ষ ত্যাগের যে সাহসিক উৎপ্রেরণা অকথিত হলেও তার মূল শেকড় বােধ করি প্রােথিত রয়েছে ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে। ১৮৫৭ সালের সেই সেনা বিদ্রোহে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলাে ইংরেজ সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সৈন্যরা। কিন্তু দেশপ্রেমিক সৈনিকদের সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত একটি করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়। এই ঘটনার প্রায় সােয়া শতক পর একই দেশপ্রেমবােধের দ্বিতীয় ইতিহাস সৃষ্টি করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সৈনিকরা। জয়দেবপুরে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ এই ইতিহাসেরই একটি উল্লেখযােগ্য অধ্যায়। একইভাবে বিদ্রোহের গৌরবে অভিষিক্ত ১, ৩, ৪, ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্ট এবং ইপিআর সৈনিকরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী বিদ্রোহী বাহিনীগুলাের একটি অংশ ছিলাে এই ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)। এটি ছিলাে প্রধানতঃ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত একটি আধা সামরিক বাহিনী। কিন্তু শৃখলা এবং প্রশিক্ষণের গুণগত মানের দিক থেকে ইপিআর’র সৈনিকদের যােগ্যতা নিয়মিত বাহিনীর তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে ছিলাে।  বলা যায়, এই আধা-সামরিক বাহিনীটি গড়ে তােলা হয়েছিলাে নিয়মিত বাহিনীর একটি কাছাকাছি সেনা সংগঠন হিসেবে। এই দু’টি বাহিনীর মধ্যে যেটুকু ব্যবধান তা কার্যতঃ সীমাবদ্ধ ছিলাে সাধারণ সৈনিকদের ওপরের স্তরে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা (অফিসারদের ক্রমবিন্যাস) এবং সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের তুলনামূলক মানের মধ্যে। অর্থাৎ নিয়মিত বাহিনীর মতাে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্ৰ ইপিআরকে দেয়া হতাে না এবং এই বাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে অফিসারদের সংখ্যাও ছিলাে খুব নগন্য।

ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস হিসেবে ১৯২০ সালে এই বাহিনীর সৃষ্টি হলেও ১৯৪৭ সালে পরিবর্তীত অবস্থায় এই বাহিনী ইস্টার্ন পাকিস্তান রাইফেলস্ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং তৃতীয় দফায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ হিসেবে এর নামকরণ করা হয়। | মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে ইপিআর বাহিনীতে ২৫০০ শিক্ষানবিশসহ সর্বমােট সৈনিকের সংখ্যা ছিলাে আনুমানিক ২০ হাজার। এই ২০ হাজার সৈনিককে ৬টি সেক্টরের ১৭টি উয়িংর অধীনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে সীমান্তের চৌকিগুলােতে মােতায়েন করা হয়। এই চৌকিগুলােতে বাঙালী-অবাঙালী সমন্বিতভাবে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করতাে। উল্লেখ্য যে, ইপিআর’র মােট সৈনিকের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ছিলাে অবাঙালী এবং এই বাহিনীর নির্বাহী পদগুলাের। অধিকাংশই ছিলাে আবার তাদের অধিকারেই কুক্ষিগত। প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইপিআর বাহিনীর বাঙালী সৈনিকদের প্রদর্শীত সাহসিক ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবশ্যই একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত থাকবে। বলা যায় সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের উদ্বোধনই করেছে তারা। ইপিআরভুক্ত বাঙালী সৈনিকরা তাদের যার যার অবস্থানে থেকে অনেক ক্ষেত্রে নিয়মিত বাহিনীর বাঙালী সৈনিকদের আগেই। অত্যন্ত সময়ােচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্রোহের সূচনা করে। ফলে দলভূক্ত অবাঙালী। অংশের সৈনিকদের আক্রমণের মুখে তাদেরকে পরাজিত হতে হয়নি, যেমনটি ঘটেছিলাে নিয়মিত বাহিনীর ক্ষেত্রে। বাস্তবিক অর্থে ২৩ মার্চেই ইপিআর বাহিনী প্রকাশ্যে তাদের আনুগত্যের গতি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করে। এদিন পাকিস্তান দিবসে ইপিআর বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এই পতাকা উত্তোলন পর্বের অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতারও অনুসরণ করা হয়। যশাের সেক্টর সদর দফতরে সকাল বেলাতেই পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়া হয় এবং পরে ইপিআর সদস্যরা সমবেতভাবে অভিবাদন জানিয়ে পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন করে। একই সেক্টরের অধীন সাতক্ষীরা কোম্পানী সদর দফতরসহ যশােরের শ্যামপুর, বেনীপুর ও কুসুমপুর বিওপিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই দিন। চাপাই নওয়াবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার মাসুদপুর বিওপিতেও পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওঠানাে হয়। ইপিআর’র খুলনা ইউংয়েও একই ঘটনা ঘটে। 

দিনাজপুর সেক্টরের অধীন বিভিন্ন বিওপিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় একই দিন। চট্টগ্রামের বরকল বিওপিতেও স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকার পীলখানার প্যারেড গ্রাউণ্ডের নিকটস্থ বটবৃক্ষে ইপিআর’র কিছু নির্ভীক সৈনিক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের উষালগ্নে ইপিআর বাহিনীর এই সাহসীক উৎপ্রেরণা লিঃসন্দেহে মুক্তিপাগল বাঙালী জনগােষ্ঠীকে উদ্দেলিত করেছিলাে। ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর পরই পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকায় বাঙালী ইপিআর সৈনিকরা বিদ্রোহের মাধ্যমে চৌকিগুলােতে রাতারাতি তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিরােধ সংগ্রামের সূচনায় তাদের এই বিদ্রোহই সম্ভবতঃ প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ যা অচিরেই একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। ২০ হাজারের মধ্যে ১৫ হাজার সমপরিমাণ বাঙালী ইপিআর সৈনিকরা শুরুতেই সশস্ত্র। প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নিলেও এই যুদ্ধে তারা তাদের প্রাধান্য বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। এই না পারার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে প্রধানতঃ তিনটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন নেতৃত্বহীনতা, সংঘবদ্ধতার অভাব এবং অস্ত্রশস্ত্রের নিম্নমান। এর ফলে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা তাৎক্ষণিক সুবিধা অর্জনে সক্ষম হলেও এই অনুকূল অবস্থা তাদের। পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি। ইপিআরভুক্ত এই বাঙালী সৈনিকরা বিচ্ছিন্নভাবে সীমান্তের। বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত চৌকিগুলােতে সফল বিদ্রোহের সূচনা করছিলাে সন্দেহ নেই। কিন্তু। সংঘবদ্ধ হবার কোনাে সুযােগই তারে ছিলাে না। উপরন্তু ওপরের স্তরে অফিসার পর্যায়ে বাঙালী নেতৃত্ব ছিলাে একেবারেই অনুপস্থিত। সবশেষে এই প্রতিকূলতার সাথে যােগ হয়।

অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব। এ অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুত ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত * শক্তিশালী পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতায় প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করলেও অচিরেই তাদেরকে একে একে সীমান্ত চৌকিগুলাের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যেতে হয়। | এরপর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাে বিদ্রোহ করার ফলে পশ্চাদপসরণরত 2 ইপিআর সৈনিকরা তাদের হারানাে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। এই পর্যায়ে রণকৌশল ও ( নেতৃত্বের একটি দিক নির্দেশনাও তাদের সামনে উম্মোচিত হয় এবং তখন থেকেই কার্যতঃ। প্রতিরােধ যুদ্ধ একটি সংঘবদ্ধ অবস্থায় রূপ নেয়। প্রতিরােধ যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল-ইপিআর 2 সৈনিকদের সম্মিলনের এটি ছিলাে একটি অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া যা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে জনগণের 3 সামনে আশা-আকাঙ্খার নতুন দিগন্ত প্রসারিত করে।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তার অহিংস পর্ব থেকেই দেশব্যাপী আপামর জনগণের 5 গভীরতম চৈতন্যে জাগরণ তুলতে পেরেছিলাে। ফলে দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সাথে 5 প্রায় প্রতিটি মানুষেরই যােগসূত্র ওতপ্রােতভাবে একত্রিত হয়ে যায়। এই আন্দোলন পর্বেরই 2 একটি পর্যায়ে মুক্তিকামী জনগণ ব্যাপক হারে আত্মত্যাগী হয়ে ওঠে এবং কোনাে কোনাে * ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তসমূহ পেছনে ফেলে আরাে দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঠিক এই অবস্থাটির পাশাপাশি দেশের চলমান রাজনীতির উত্তাপ থেকে চুড়ান্ত আঘাতটি আসা পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলের সেনাছাউনিগুলােতে কিন্তু বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী সহাবস্থানের পূর্বাপর ধারা অব্যাহত থাকে। সেখানে বাঙালী সেনা ইউনিট কিংবা সেই ইউনিটের কোনাে সদস্যের পক্ষেই দেশে অগ্রসরমান রাজনৈতিক গতিধারার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া সহজতর ছিলাে না। ফলে বিক্ষুব্ধ জনগণের মুক্তিলাভের চিৎকার তাদের কানে গিয়ে পৌঁছতে সময় লেগে যায় অনেক। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তীব্রতা এ সময় এতােটাই সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে যে তা একদিন দুর্লংঘ সেনাছাউনিগুলাের নিচ্ছিদ্র প্রাচীরও অতিক্রম করে যায়। আর ঠিক তখন থেকেই বাঙালী সৈনিকদের মধ্যে নতুন উৎসাহ নিয়ে জেগে ওঠে দীর্ঘ দিনের ঘুমন্ত জাতীয়তাবােধ।

রাজনৈতিক অস্থিরতার এই কঠিন সন্ধিক্ষণে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক বিবেচনা থেকেই বাঙালী সৈনিকদের ব্যাপারে আনুগত্যের প্রশ্নে আশংকিত হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে তারা বাঙালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করার উপায় উদ্ভাবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অপর দিকে সেনাছাউনিগুলাের অভ্যন্তরে বাঙালীদের সামনে তখন পরস্পর বিরােধী দুটি বিষয় একত্রে কাজ কবেছে। একদিকে সেনাছাউনির বাইরে গােটা দেশ জুড়ে জনগণের ব্যাপক জাগরণ, অন্যদিকে বাঙালী সৈনিকদের ব্যাপারে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সন্দেহজনক তৎপরতা বৃদ্ধি। এভাবেই ১২৩ বছর পর ইতিহাসের সিপাহী বিদ্রোহ আরেক বিদ্রোহের অধ্যায় রচনা করে বাঙালী জাতির সশ্রামী ইতিহাসে। পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি বাঙালী সৈনিকদের এতােদিনকার আনুগত্য এবার আপনিই ধসে পড়ে। সেনাছাউনির ভেতরে বাঙালী অস্ত্রের নল সহসাই ঘুরে যায় পাকিস্তানের দিকে। সর্বকালের মুক্তির ইতিহাস বােধ করি যুগে যুগে এভাবেই তার প্রয়ােজন মেটায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালী অংশের বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের একটি বিস্ময় সৃষ্টিকারী ঘটনা। এই বিস্ময় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথে যােগ হবার কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সীমিত পরিসরে হলেও তার শুরু থেকেই একটি পরিপূর্ণতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। | জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কোনাে এক স্তরে বাঙালী সৈনিকরা স্বপক্ষ ত্যাগ করে এই আন্দোলনে যােগ দেবে—সংগ্রামী জনগণ এমনটি নিশ্চিত হিসেব কষে প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু করেনি। তবে পাকিস্তানী নীতি নির্ধারকরা এমন একটি ভাঙ্গনের শব্দ কিন্তু ঠিক সময় মতােই টের পেয়েছিলাে। ফলে আসন্ন সংকট সম্পর্কে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে তারা মােটেও বিলম্ব করেনি। বিশেষ করে সংঘবদ্ধ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পদাতিক ব্যাটালিয়নগুলাের শক্তি তাদেরকে ভাবিয়ে তােলে এবং এই শক্তির সম্ভাব্য ঝুকি প্রশমিত করার জন্যে। সময়ােপয়ােগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা। এই লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত ঝুকিহীন এলাকায় বিভাজন প্রক্রিয়া গ্রহণের মাধ্যমে বাঙালী সৈনিকদের সমন্বিত শক্তি খর্ব করার কৌশল অবলম্বন করা হয়। পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এ ধরনের বাঙালী অধ্যুষিত ইউনিটগুলাে বিভিন্ন অজুহাতে কয়েকটি খণ্ডে আগেভাগেই ভাগ। করে ফেলা হলাে। এই প্রক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারীর শেখ নাগাদ যশােরে অবস্থানরত ১ ইস্ট বেঙ্গল।

রেজিমেন্টের বড় একটি অংশ সামরিক মহড়ার নাম করে পাঠিয়ে দেয়া হয় সীমান্ত এলাকার চৌগাছায়। অনুরূপভাবে জয়দেবপুরের ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভাগ করে ফেলা হয় পাঁচ খণ্ডে। এর একটি ক্ষুদ্র অংশ জয়দেবপুরে রেখে বাদবাকি অংশগুলাে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে। সৈয়দপুরের ৩ ইস্ট বেঙ্গল চার ভাগে ভাগ। করে ঘােড়াঘাট, পলাশবাড়ি, দিনাজপুর ও পার্বতিপুর পাঠানাে হয়। কুমিল্লায় অবস্থিত ৪ ইস্ট বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং অপর একটি সিলেটের শমসেরনগরে মােতায়েন করা হয়। এই ধারায় ৮ ইস্ট বেঙ্গল হচ্ছে একমাত্র ব্যাটালিয়ান যা ভাগ করা হলাে না। তবে ব্যাটালিয়নটিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রাখা হলাে চট্টগ্রামে। | ৫ মার্চ জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে ২ ইস্ট বেঙ্গল প্রথমে টাঙ্গাইলে একত্রিত হয়। এরপর এই ব্যাটালিয়ন চলে আসে ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে নরসিংদি, ভৈরব ও আশুগঞ্জ হয়ে তারা মাধবপুর-তেলিয়াপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয়। এখান থেকে এই ল্যাটালিয়নের একটি কোম্পানী পরিমাণ দল সিলেটের প্রতিরোধ যুদ্ধে সহায়তা প্রদানের জন্যে। 

সেখানে পাঠানাে হয়। এই দলটি পরে সিলেট শহর ও তার শহরতলী এলাকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু সংখ্যায় অধিক পাকিস্তানী বাহিনীর জোরালাে চাপের মুখে তাদের এই অবস্থান সেখানে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। এদিকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতেই ভৈরব, আশুগঞ্জ, সরাইল, শাহবাজপুর ও মাধবপুর অক্ষাঞ্চল বরাবর অবস্থানরত ২ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মূল অংশ পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখােমুখি হয়। জল স্থল ও অন্তরীক্ষ তিন দিক থেকেই আক্রমণ আসতে থাকে তাদের ওপর। এই শক্তিশালী আক্রমণের মুখে বিশাল একটি এলাকা নিয়ে বেশী দিন টিকে থাকা তাদের জন্যে অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্রমবধি চাপের। মধ্যেও বাঙালী সৈনিকরা এই এলাকায় তাদের প্রতিরােধ যুদ্ধ অব্যাহত রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যায়। এখানে এক পর্যায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ এতােটাই তীব্রতর হয়ে ওঠে। যে বাঙালী সৈনিকদের জন্যে পিছু হটা ছাড়া আর কোনাে উপায়ই থাকে না। এ অবস্থায় একটির পর একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারা অনেকটাই হতােদ্যম হয়ে পড়ে এবং এক সময় পিছু হটতে হটতে তাদের পিঠ সীমান্ত পর্যন্ত এসে ঠেকে যায়। অনিদ্রা অর্ধাহার অনাহারের মধ্য দিয়ে একটানা যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের অনিশ্চয়তায় বিদ্রোহী সৈনিকরা হতাশ হয়ে পড়লেও এই যুদ্ধে জনগণের অংশিদারিত্ব তাদের মধ্যে নতুন এক সম্ভাবনার জন্ম দেয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিকদের প্রতিরােধ যুদ্ধ বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি নবতর দিগন্ত উন্মােচিত করে—এই উক্তি ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। বাস্তবতা পর্যবেক্ষনে এটা বলা যায় যে, প্রথমতঃ এই প্রতিরােধ দেশের ব্যাপক জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত করে এবং এক পর্যায়ে। সৈনিকদের সাথে এই ব্যাপক জনগণের অংশ গ্রহণের কারণে এই যুদ্ধ একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। দেশের মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের আন্দোলনে সশস্ত্র বাঙালী সৈনিকদের একীভূত হবার সাথে সাথেই কার্যতঃ এই সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত প্রতিরােধ বলতে জনগণ যেটুকু করতে সক্ষম হয়েছিলাে তা সীমিত ছিলাে। প্রধানতঃ যােগাযােগ ব্যবস্থা বিকল করে দেয়ার চেষ্টার মধ্যেই। খুব অনিবার্য কারণেই শক্তিশালী পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনগণ এই সময় ব্যাপক অর্থে কোনাে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে পারেনি, তা সম্ভবও ছিলাে না।

বিচ্ছিন্নভাবে এবং সীমাবদ্ধ পরিসরে হলেও বিদ্রোহী বাঙালী ইপিআর এবং ইবিআর ইউনিটগুলাে প্রথমতঃ এই সংঘবদ্ধ প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করে। এর পর পরই ক্রমবধিষ্ণু হারে জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হতে থাকে সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে এবং তখন থেকেই দ্রুত সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ। রূপান্তরিত হয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে।  যুদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন কিন্তু জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ কোথাও কোথাও খুব কাছে থেকে যুদ্ধ দেখতে দেখতেই কিংবা যুদ্ধের বার্তা শুনতে শুনতে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। এর ফলে দেখা গেলাে প্রত্যন্ত গ্রামের যে শান্তিপ্রিয় ভিতু মানুষটি একদিন সামান্য রক্তক্ষরণ দেখে মূৰ্ছা যেতাে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে সেই মানুষই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে শক্র হত্যার জন্যে নির্বিঘ্নে ছুটে যাচ্ছে রণাঙ্গনে। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বাঙালীই তখন তুখাের যােদ্ধা, অসম সাহসী সৈনিক। মেঘনার দুই পাড় ধরে বিদ্রোহী ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা তাদের প্রতিরােধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে এমন একটি উদ্দীপনার বীজই অংকুরিত করেছিলাে। সেদিন একইভাবে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিকদের অন্যান্য ইউনিটও এলাকাভিত্তিক জনতাকে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহসী করে তােলে। স্বাধীনতার জন্যে বাঙালীদের প্রস্তুতি এবার বেগবান হয়ে ওঠে তীব্রভাবে। এতাে কাছ থেকে এর আগে আর কখনাে বাঙালীরা এমন যুদ্ধ দেখেনি। যুদ্ধ এলাকায় রাতের পর রাত কেটেছে তাদের গােলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে। অস্থির যুদ্ধের ভীতি তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বসতবাড়ি থেকে। বেদখল এলাকায় পাকিস্তানী সৈনিকদের নৃশংস অত্যাচার সইতে হয়েছে দিনের পর দিন। চোখের সামনে দেখেছে প্রতিরােধ যুদ্ধরত সৈনিকদের সাহসিকতা ও দেশপ্রেম। সেই সাথে দুই মাসব্যাপী এই প্রতিরােধ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হতােদ্যম বাঙালী সৈনিকদের সীমান্তের দিকে পিছু হটে যাবার দৃশ্য ব্যথিত করেছে তাদের। বাঙালী রক্তে তখন অনিবার্য কারণেই ডাক এসেছে সহমর্মিতার। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কিংবা খণ্ডিত চিন্তার সুযােগ আর তারা পায়নি। সমস্ত পিছুটান জলাঞ্জলী দিয়ে এক বাক্যে তারা নেমে গেছে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে। দেশব্যাপী বাঙ্গালী জনগােষ্ঠী তখন যে কোনাে পরিস্থিতি মােকাবেলা করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে প্রস্তুত।  দ্বিতীয়তঃ প্রতিরােধ যুদ্ধে বাঙালী সৈনিকদের অংশ গ্রহণ শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়ই নয় আঞ্চলিক পরিমণ্ডলেও একটি ঐতিহাসিক সুফল বয়ে আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে ভারতের যে অবদান আমাদেরকে কৃতজ্ঞ করে তার নেপথ্যেও কিন্তু বাঙালী সৈনিকদের এই বিদ্রোহী ভূমিকা যথেষ্ট ইতিবাচক অর্থে কাজ করেছে। জাতীয় প্রতিরােধ যুদ্ধে বাঙালী সৈনিকদের এই সম্পৃক্ততা যুদ্ধের পরিসর শুরু থেকেই একটি পরিপূর্ণতায় উত্তীর্ণ করার মধ্য দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিতে যে অনুকূল ক্ষেত্রটি তেরী করে তা-ই পরবর্তীতে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রশ্নে ভারতীয়দের এগিয়ে আসার পথটি সহজতর করে দেয় অনেকখানি।

২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপড়া অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় যুদ্ধে লিপ্ত ঠিক সেই সময় মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বাধীন ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়ার দক্ষিণ থেকে কুমিল্লার পূর্বাঞ্চল বরাবর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রথম দিকে এই ব্যাটালিয়নটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-শমসেরনগর এলাকায় অবস্থান নেয়। কিন্তু এই এলাকার দিকে ২ ইস্ট বেঙ্গল এগিয়ে আসার পর খালেদ মােশাররফ তার বাহিনী নিয়ে দক্ষিণে সরে যায়। এই সময় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় বাঙালী সেনা নায়কদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের সেনা বৈঠক এটাই প্রথম। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, কর্নেল রব, কর্নেল রেজা, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হােসেন প্রমুখ। এই বৈঠকেই প্রথম সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সুশৃঙ্খলভাবে পিরচালনার জন্যে একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠন করা প্রয়ােজন। আর এই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তিটিকে অবশ্যই সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় হতে হবে এবং তাকে সর্বস্তরে হতে হবে গ্রহণযােগ্য। বৈঠকের দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি ছিলাে রাজনৈতিক। এতে বলা হয়,যে জাতায় মুক্তিযুদ্ধে দিক নির্দেশনার জন্যে অনতিবিলম্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করতে হবে এবং অচিরেই এই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে। বৈঠকের অপর সিদ্ধান্তটি ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের এলাকা ভিত্তিক বিভাজন এবং তার অধিনায়ক নির্বাচন সংক্রান্ত। এই সিদ্ধান্তের অধীনে গােটা পূর্বাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রকে মােট তিন ভাগে ভাগ করে এর প্রতিটি এলাকার জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার অধিনায়ক মনােনীত হন মেজর শফিউল্লাহ। কুমিল্লা-নােয়াখালির দায়িত্ব পড়ে মেজর খালেদ মােশাররফের ওপর এবং সব শেষে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিয়দংশের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর জিয়ার ওপর।

এই ঘটনার পর ১০ এপ্রিল আগরতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় এবং সেই সাথে কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। একই সময় রণাঙ্গনকে চারটি সেক্টরে ভাগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে চার জন অধিনায়কও নিয়ােগ করা হলাে। এই চার জন হচ্ছেন মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর জিয়া এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। | মুক্তিযুদ্ধের এই পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত অংশের কতিপয় কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে নেয়া হয়। এর ফলে চার জন সেক্টর কমাণ্ডারের মধ্যে তিন জনকেই মেজর থেকে লেঃ কর্নেল মর্যাদায় উন্নীত করা হলাে। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মেজর ওসমান যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতি পেলেও সে যাত্রা এ পদোন্নতির সুযােগ থেকে বঞ্চিত হন। এর মাত্র ক’দিন পর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পূর্ববর্তী সেক্টরগুলাের পুনর্বিভাজন করে আঞ্চলিক ভিত্তিতে গােটা রণাঙ্গনকে সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এই অঞ্চলগুলাের বর্ধিত নেতৃত্বে আগের চার জন সেক্টর অধিনায়ক ছাড়াও আরাে তিন জন অধিনায়ক নিয়ােগ করতে হলাে। নতুন এই আঞ্চলিক অধিনায়করা হচ্ছেন মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ এবং ক্যাপ্টেন নাজমুল হক। | এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে এবং তখন থেকেই প্রতিরােধ যুদ্ধ যুগপৎ সামরিক এবং রাজনৈতিক পরিপূর্ণতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত  পরবর্তীতে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে সামরিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে রণাঙ্গনকে আরেক দফায় পুনর্বিন্যাস করা হয়। সর্বশেষ এই পর্যায়ে সমগ্র রণাঙ্গনকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সামরিক সেক্টরে। এই সেক্টরগুলাের মধ্যে ৫ ও ১১ নম্বর সেক্টর—এ দুটি রণক্ষেত্রের কার্যকারিতা ও সক্রিয়তা ছিলাে তুলনামূলক কম। জুলাই পর্যন্ত এই দুটি সেক্টরের গঠন প্রক্রিয়ায় তেমন কোনাে লক্ষ্যনীয় কর্মতৎপরতা দৃষ্টিগােচর হয়নি।

যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক পরিসরে সেক্টর দুটিতে স্থায়ী ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট করে কোনাে অধিনকেও নিয়ােগ করা যায়নি। অধিকন্তু ১০ নম্বর সেক্টরেও কোনাে অধিনায়ক দেয়া হয়নি। এই সবটিৰ কাষতঃ কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখাও ছিলাে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ কিছু  সহ বাংলাদেশের সমস্ত নেী ও সমুদ্র বন্দর এবং অভ্যন্তরীণ জলভাগ ছিলাে এই সেক্টরের অভিযান পরিচালনা ক্ষেত্র। প্রধানতঃ মুক্তিযুদ্ধের নৌকমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা স্থল মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় এই সেক্টরে তাদের পর্যায়ক্রমিক’ অভিযান চালিয়ে শত্রু বাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। বস্তুতঃ ৭১র ১৫ আগস্ট থেকে ১০ নম্বর সেক্টরের কার্যকরিতা। শুরু হয়। সফিউল্লাহ ৩ নম্বর সেক্টরের আয়তন বিস্তৃত ছিলাে আখাউড়ার সিংগারবিল থেকে শুরু করে উত্তরে শ্রীমঙ্গলের চূড়ামণি পর্যন্ত। পূর্ব-পশ্চিমে আড়াআড়িভাবে ঢাকার উত্তর দিকের অংশসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের ব্যাপক এলাকাও ছিলাে এই সেক্টরের আওতাধীন। দক্ষিণে যেখানে ৩ নম্বর সেক্টরের সীমানা শেষ সেখান থেকেই শুরু হয় খালেদ মােশাররফের ২ নম্বর সাংগঠনিক সুবিধার্থে ৩ নম্বর সেক্টরটিকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দশ ভাগে ভাগ করে দশটি সাব সেক্টর গঠন করা হয়। এভাবে বিভাজনকৃত সাব সেক্টরগুলােতে মােতায়েন সংমিশ্রিত প্রতিটি পদাতিক কোম্পানীর নেতৃত্ব অর্পিত হয় নিয়মিত বাহিনীর একেকজন সেনা কর্মকর্তার ওপর। ক্ষেত্র বিশেষ কোনাে কোনাে সাব সেক্টরে, যেখানে শত্রু বাহিনীর তুলনামূলক আক্রমণের চাপ বেশি, সে সব এলাকায় বর্ধিত সৈনিক দিয়ে বাহিনীর আয়তন এবং সমর শক্তি উভয়ই বাড়ানাে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত অংশে বিভক্ত করে স্পর্শকাতর সাব সেক্টরগুলােতে সমাবেশ করা হয়। এর ফলে বিভক্ত কোম্পানীগুলােতে পেশাদার পদাতিক সৈনিকের যে ঘাটতি সৃষ্টি হয় তা পূরণ করাতে হলাে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোর ও ইপিআর সদস্যদের দিয়ে। অধিকন্তু সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেসামরিক সদস্যদেরকেও ব্যাপক সংখ্যায় এই নিয়মিত কোম্পানীগুলােতে অন্তর্ভুক্ত করা  সিংগারবিল থেকে চূড়ামণি-ভারত সীমান্ত ঘেষা বাকৃতির এই বিশাল এলাকার দশটি সাব সেক্টরে বিভক্ত সৈনিকরা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এই এলাকায় নিয়মিত বাঙালী সেনা অফিসার ও পেশাদার সৈনিকদের অধিকতর কেন্দ্রীভবন লক্ষ্য করে পাকিস্তানী বাহিনী এখানে তাদের সমর সমাবেশ এবং আক্রমণ উভয়ই জোরদার করে।

ফলে শত্রুবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে এই এলাকায় প্রতিটি সাব সেক্টরের সৈনিকদের লাগাতার যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয় মুক্তিযুদ্ধের পুরােটা সময় ধরে। সমগ্র সীমান্ত বেষ্টনী বরাবর মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত অংশের সমাবেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের এক ধরনের প্রবণতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রথম থেকে। অর্থাৎ তারা প্রতিরােধ প্রদানকারী বাহিনীর নিয়মিত অংশকে যথাসম্ভব নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার ব্যাপারটিকে তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের সামরিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। প্রতিরােধ যুদ্ধে লিপ্ত নিয়মিত বাহিনীর তখনাে অবশিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলােকে নির্মূল করতে পারলেই সম্ভাব্য সুসংবদ্ধ প্রতিরােধ বাহিনী সৃষ্টির দ্রুণ বিনষ্ট হবে—এমন একটি ধারণা সম্ভবতঃ তাদেরকে এই কৌশল গ্রহণে প্রলুব্ধ করে থাকবে। যে কারণে দেখা যায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাচটি ক্ষুদ্রাকার ইউনিটকে কোণঠাসা করার জন্যে পাকিস্তানীরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই গােলন্দাজ সজ্জিত একটি পদাতিক ব্রিগেডের সম আয়তন বাহিনীর সমাবেশ ঘটায়। একই সাথে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলােকে তারা কৌশলী প্ররােচনার মাধ্যমে ভূখণ্ড দখলের লড়াইয়ে প্রলুব্ধ করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখে। প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকে নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থান ধরে রাখার জন্যে যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হলেও শত্রুবাহিনীর সমন্বিত জোরালাে আক্রমণের মুখে নিয়মিত বাহিনীর প্রতিরােধ যােদ্ধারা তাদের আগলে রাখা এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিরােধ বাহিনীর জন্যে ভূমি দখলী যুদ্ধ অব্যাহত রাখা প্রধানতঃ দুটি কারণে অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রথমতঃ নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থান আগলে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিয়মিত বাহিনীর তখনাে অবশিষ্ট ক্ষুদ্রাংশের, জন্যে জীবনহানীর দিক থেকে ব্যয়বহুল প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয়তঃ স্বল্প পরিমাণ সমর শক্তি দিয়ে শত্রবাহিনীর তীব্রতর আক্রমণের বিপক্ষে কার্যকরী কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তােলাও সম্ভব হচ্ছিলাে না। এ অবস্থায় প্রতিরােধ যােদ্ধারা কৌশলগত কারণেই তাদের অবস্থান নিয়ন্ত্রণে রাখার যুদ্ধনীতি পরিহার করে। অন্যদিকে শত্রুবাহিনী এলাকা দখলী যুদ্ধে প্রলুব্ধ করার মাধ্যমে বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিকদের সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাে তা প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুটা সফল হলেও প্রতিরােধ বাহিনীর পরিবর্তীত রণনীতির কারণে অচিরেই তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

এ পর্যায়ে প্রতিরােধ বাহিনী তাদের পূর্বতন রণকৌশলের অর্থাৎ ভুমি দখলী যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে সড়ক ও রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকরণ, সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস এবং ব্যাপক আকারে চোরাগােপ্তা হামলা চালানাের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের ঘায়েল করার কৌশল অবলম্বন করে। পাকিস্তানীদের প্রলুব্ধকরণ সামরিক কৌশল পাশ কাটিয়ে নিয়মিত বাহিনীর প্রতিরােধ যােদ্ধারা এরপর বিস্তৃত সীমান্ত এলাকায় শক্র সমাবেশের ওপর তাদের পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ অব্যাহত রাখে। এই সব আক্রমণে এবার তারা গেরিলা অভিযানের পাশাপাশি প্রয়ােজনে প্রচলিত রণকৌশলও অবলম্বন করে। | রণাঙ্গনব্যাপী পুর্নগঠন প্রক্রিয়ায় সেক্টর বিভাজনের পর সেক্টর নেতৃত্বকে যে দায়িত্বগুলাে পালন করতে হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি সেক্টরের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক অবকাঠামাে তৈরি ও তার তদারকি। অধীনস্থ সাব সেক্টরগুলাের সাথে। সার্বক্ষণিক সংযােগ রক্ষা এবং একই সাথে কলকাতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দফতর, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় বিএসএফ ঘাটি, ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি রাজনীতিকদের সাথে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখা ছাড়াও গেরিলা যােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ডও সেক্টর সদর দফতরগুলােকেই সম্পাদন করতে হয়েছে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় সেক্টর নেতৃত্বকে বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশ্নে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকিও নিতে হয়। যার ফলশ্রুতি অনেক ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সুদূরপ্রসারী বলে গণ্য হয়েছে। সেক্টর বিন্যাস হবার পর প্রতিটি সেক্টরের অধীনস্থ সাব সেক্টরগুলাে একই ধারায় তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে সার্বক্ষণিক যােগাযোগ রেখে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ  ক্ষেত্রে বিভিন্নমুখি যুদ্ধ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার সাথে সাথে সাব সেক্টরগুলােকে তাদের নির্দিষ্ট এলাকার অভ্যন্তরে অবস্থিত গেরিলা অবস্থানগুলাে সুগঠিত করার কাজেও মনােনিবেশ করতে হয়। এ ছাড়াও নির্দেশিত গন্তব্যের দিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা বাহিনীর প্রবেশ পথসমূহ নিরাপদ রাখার ব্যাপারেও তাদের সতর্ক নজর রাখতে হয়েছে। উপরন্তু অধীনস্থ এলাকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং শত্রুবাহিনী সম্পর্কিত খোঁজখবরও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সাব সেক্টরের নেতৃত্বকেই আদান-প্রদান করতে হতাে। এই দায়দায়িত্বগুলাে পালন করার পরও তাদের যে কাজগুলাে নিয়মমাফিক করতে হয়েছে তা হলাে দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, বিশেষভাবে সশস্ত্র বামপন্থী গােষ্ঠির মােকাবেলায় নীতি ও কৌশল অবলম্বনের নির্দেশনা এবং অধিকৃত মুক্ত এলাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা।

মােট কথ্য সেক্টরের অধীন প্রতিটি সাব সেক্টরকেই চোরাগােপ্তা হামলা পরিচালনা কিংবা সম্মুখ সমরে শত্রুবাহিনীকে মােকাবেলা করা ছাড়াও তার অভ্যন্তরীণ প্রাসঙ্গিক সকল দায়িত্বই পালন করতে হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হ্বার পর এই যুদ্ধে প্রয়ােজনীয় সহায়তা দেয়ার উদ্দেশে ভারতীয় কর্তৃপক্ষও সমগ্র সীমান্ত রেখা বরাবর ভারতীয় ভূখণ্ডে ছয়টি প্রশাসনিক সেক্টর প্রতিষ্ঠা করে। এই সেক্টরগুলাের প্রতিটির নেতৃত্ব দেয়া হয় একেকজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ারের ওপর। | দক্ষিণের কলরেখা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বর্গাকৃতি সীমান্ত এলাকা জুড়ে ভারতীয় যে। সেক্টরগুলাে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজী বর্ণমালার আদ্যক্ষর দিয়ে সেগুলাের নামকরণ করা হয়। আলফা, ব্র্যাভাে, চার্লি, ডেল্টা, ইকো এবং ফক্সট্রট। একইভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধে নিয়ােজিত। নিয়মিত বাহিনীর কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামগ্রিক রণাঙ্গন জুড়ে সর্বশেষ যে ১১টি সেক্টর গঠন করা হয় সেগুলাের দায়িত্বে সে সময় সর্বোচ্চ মর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন একেকজন মেজর, ভারতীয় সেক্টরের নেতৃত্বে যেখানে ব্রিগেডিয়ার। প্রাথমিক পর্বে প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু হবার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের যােগাযােগ কার্যতঃ সীমাবদ্ধ ছিলাে ভারতের আধাসামরিক বাহিনী অর্থাৎ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। বিএসএফ পর্যন্ত। নিয়ন্ত্রণহীন প্রাথমিক পর্ব অতিক্রান্ত হবার পর মুক্তিযােদ্ধা তথা সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ততা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। ৩ নম্বর সেক্টরের ক্ষেত্রে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুযােগ্য নেতৃত্ব শুরু থেকেই তার অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পাদনের সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে জোরালাে ভুমিকা রাখে। এমনকি ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়াই প্রতিরােধ সংগ্রামের প্রারম্ভে তায় সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আগত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে ব্যাপকতর কার্যক্রম গ্রহণ। করে। পরবর্তীতে এই প্রশিক্ষণার্থীদের আগমণ দ্রুত বেড়ে যাবার প্রেক্ষিতে বর্ধিত সংখ্যায়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে। যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে এই প্রশিক্ষণের কাজে ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য-সহায়তা অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং ঠিক তখন থেকেই সীমিত আকারে তাদের সাহায্য নেয়া শুরু হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কাজে ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য নেয়ার নেপথ্যে যে প্রতিকূল অবস্থাটি সক্রিয় ছিলাে তা হচ্ছে যুদ্ধের সেই তীব্রতার মধ্যে এ কাজে রণাঙ্গন থেকে নিয়মিত বাহিনীর দক্ষ সৈনিকদের প্রত্যাহার করে আনা।

একেবারেই সম্ভব ছিলাে না। এটা যেমনি ছিলাে ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি নির্বুদ্ধিতাও। এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সাহায্যের কোনাে বিকল্প ছিলাে না। | প্রতিরােধ সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শুরু হয়েছিলাে। ওই সময় দেশপ্রেমিক বাঙালীরা, যারা বিভিন্ন স্থানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিংবা ইপিআর’র সংস্পর্শে আসে, মামুলি ধরনের খণ্ডকালীন প্রশিক্ষণ সম্বল করেই প্রতিরােধ যুদ্ধের মূল বাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধ শুরু করে। এর পাশাপাশি এই স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে বিভিন্ন স্থানে খণ্ড যুদ্ধেও লিপ্ত হতে থাকে। এরপর এপ্রিলের শেষ নাগাদ মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত সম্প্রসারিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলের দিকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়ােজনে মুক্তিযােদ্ধাদের যথাপােযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য লাভ করে। এই পর্যায়ে প্রশিক্ষণার্থী এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেরও পর্যাপ্ত সংখ্যায় বিস্তৃতি ঘটে। ফলে প্রয়ােজন দেখা দেয় প্রশাসনিক অবকাঠামাে সৃষ্টির এবং পরিকল্পিত কর্মসূচী গ্রহণের। কার্যতঃ তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সুচিন্তিত প্রশিক্ষণ পর্বের যাত্রা শুরু। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় তাদের যে সেনা অভিযান শুরু করে তার মূল লক্ষ্য ছিলাে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেনা ছাউনিগুলাের একক ও অবিচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। ইপিআর এবং পুলিশ ছাউনিগুলােও ছিলাে এই লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। ৩০ মার্চের মধ্যেই তারা সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র বাঙালী অংশকে তাদের ছাউনিগুলাে থেকে সমূলে উৎখাতে সমর্থ হয়। ইপিআর ও পুলিশ ছাউনিগুলােতেও একই পরিণতি নেমে আসে। একই সাথে পাকিস্তানী সেনারা ছাত্র-জনতার প্রতিরােধ কেন্দ্রগুলাে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মধ্যদিয়ে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে সেনা ছাউনিগুলাের অভ্যন্তরে আক্রান্ত বাঙালী সৈনিকদের পক্ষে ব্যাপক এই প্রতিকূলতার মধ্যে ছাউনি আগলে রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। একই সাথে পাকিস্তানী বাহিনী নিকটবর্তী বিমান অবতরণ ক্ষেত্রগুলাের কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্যে সেদিকেও ধাবিত হয়। এভাবে সেনাছাউনি ও বিমান অবতরণ ক্ষেত্রগুলাে দখলে আনার পর তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইস্ট বেঙ্গল ও ইপিআর’র বিদ্রোহী বাঙালী সেনাদের নির্মূল অভিযান শুরু করে। পাকিস্তানীদের এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বাঙালী। সৈনিকরা সহজেই পিছু হটে যায়। বাঙালী সৈনিকদের হটিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তারা সুপরিকল্পিতভাবে বেসামরিক বাঙালী নিধন অভিযান অব্যাহত রাখে। 

রক্তের নেশায় উন্মাতাল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পাকিস্তানী সৈনিকরা তাদের এই বিদ্রোহ নিধন, অভিযানে প্রয়ােজনীয় শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কার্পণ্য করেনি কখনােই। আক্রমণের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বিধ্বংসী শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে দ্বিধাহীনভাবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ক্ষেত্রগুলােতেও শক্তির এই চরম প্রয়ােগের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালী জনগােষ্ঠীকে এটাই বােঝাতে প্রয়াস পেয়েছে যে, যে কোনাে মূল্যে কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে পিণ্ডির নীতি নির্ধারকরা অবিচল। বিদ্রোহ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে তারা অপর যে উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ করতে চেয়েছিলাে তা হচ্ছে অস্থির বাংলাদেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা, যাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনাে দেশের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তিরােহিত হয়।  ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশ জুড়ে যে সশস্ত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে তা পাকিস্তানী। নীতি বিধারকদের কাছে মােটেও অপ্রত্যাশিত ছিলাে না। তবে রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহী আগুনের এমন দিগন্ত প্রসারী প্রজ্বলন অবশ্য তারা আশা করেনি। ২৫ মার্চের সেনা অভিযান পরবর্তী পরিস্থিতি তারা যেমনটি কল্পনা করেছিলাে বাস্তবে তা হয়নি । মার খাওয়া বাংলাদেশের সামগ্রিক দৃশ্যপট তাদের দৃষ্টির অনুকূলে মােটও পরিকল্পনা মাফিক আবির্ভূত হয়নি। ৪৮ ঘন্টার সময় চেয়ে বিদ্রোহী বাঙালীদের শায়েস্তা করার কাছে অবর্তীণ হলেও জেনারেল টিক্কা ৪৮ দিনেও এই বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হলেন না। তিনি ববং বিদ্রোহী বাঙালীদের নির্মূল করতে গিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং এক পর্যায়ে প্রতিবেশী বৈরী দেশ ভারতে তাড়িয়ে নিয়ে সেখানে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করলেন। এর যা ফলাফল দাঁড়ালাে তা কার্যতঃ পাকিস্তানী নীতি নির্ধারকদের জন্য বলাংশেই হিতে বিপরীত হলাে। অস্থির বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা তাে এলােই না বরং তা আরও অস্থির এবং যুগপৎ সশস্ত্র আকারে তীব্রতর হয়ে উঠলাে। আবার সংখ্যায় কম হলেও আক্রান্ত বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিকরা বিভিন্ন স্থানে আংশিক অক্ষতই থেকে গেলাে। আক্রমণের প্রাথমিক স্তরে দলছুট এবং ছত্রখান হয়ে পড়লেও চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য অচিরেই তারা পুনরায় নতুন উদ্যম এবং মনােবল নিয়ে একত্রিত হলাে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। এর সাথে বাড়তি মাত্রায় যােগ হলাে এসে যুদ্ধোচ্ছুক দেশপ্রেমিক জনগণ। এবার প্রতিরােধ রূপ নিলাে বিদ্রোহী বাঙ্গালী সৈনিক-জনতার সম্মিলিত শক্তিতে। বিদ্রোহের বীজ এখানে সশস্ত্র আকারে দ্রুত ছড়িয়ে গেলাে ব্যাপকতর জনগণের মধ্যে। 

পাকিস্তানী সেনা অভিযানের সর্বশেষ যে পরিণতি পিণ্ডির নীতি নির্ধারকদের জন্যে। উপহার হিসেবে এনে দিলাে তা হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলমান অস্থিরতায় একটি তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের অবারিত সুযােগ, যা তারা শুরু থেকেই ঠেকিয়ে রাখতে। চেয়েছিলাে। পাকিস্তানী সৈনিকদের তাড়া খাওয়া নিরস্ত্র বাঙালী জনগণ এবং পিছু হটা। সৈনিকরা ততােক্ষণে ভারতের মাটিতে আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ, উভয় শিবিরই অবাধে নির্মাণের। সম্ভাবনা সূচিত করেছে। অর্থাৎ ২৫ মার্চের পাকিস্তানী সেনা অভিযানের পুরাে পরিণতিটাই চলে যায় পিণ্ডির পরিকল্পনার বিপরীতে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে খুব বােধগম্য কারণেই অতিরিক্ত সেনা আমদানীর দাবি তুললেন। তথাকথিত ৪৮ ঘণ্টার নায়ক জেনারেল টিক্কা খান। বেগতিক অবস্থার মধ্যে এই দাবিতে তিনি ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন পণ্ডিকে। পিণ্ডির কর্মকর্তারা তাতে রাজি হলেন। ২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল অর্থাৎ ১২ দিনের মধ্যে এই পর্যায়ে দুটি পদাতিক ডিভিশন স্থানান্তর করা হলাে। ঢাকায়। এর একটি ১ পদাতিক পাঞ্জাবের খারিয়া থেকে এবং অপর ১৬ পদাতিক ডিভিশন কোয়েটা থেকে সঞ্চালন করা হলাে। এর সাথে অতিরিক্ত আরও তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও দুটি ভারী মর্টার ব্যাটারীর স্থানান্তর ঘটে মূল বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্যে। কি এতােকিছুর পরও বাংলাদেশে সামগ্রিক অবস্থার তেমন কোনাে উন্নতি পরিলক্ষিত হলাে না। ফলে অল্প ক’দিনের ব্যবধানে আরও ২৫ হাজার সংমিশ্রিত অনিয়ন্তি বাহিনীর আমন ঘটলাে এই অঞ্চলে। অত্যন্ত সীমিত সময়, মাত্র ১২ দিনের মধ্যে দূরবর্তী একটি অঞ্চলে বিমানে পুরাে সােয়ী দুই ডিভিশন সৈন্য সঞ্চালনের ঘটনাটি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর জন্যে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযােগ্য সাফল্য। এই আপাতঃ সাফল্যের মধ্য দিয়ে তারা পরােক্ষভাবে ভারতকে হাত করে এটাই প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলাে যে, দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে পাকিস্তান তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সামান্যতম ফাঁক রাখতেও রাজি নয়। কিন্তু সেনা সঞ্চালনের ব্যাপারে পাকিস্তানের এই সাফল্যে কোনাে দ্বিমত না থাকলেও পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের মূল প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা দুর্বল করে দিয়ে এক হাজার মাইল দূরত্বে বিচ্ছিন্ন দেশের পূর্বাংশে দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিভিশন ও একটি পদাতিক ব্রিগেড পরিমান বাহিনীর সঞ্চালনের এই ঘটনাটি ছিলাে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে হতবাক করে দেয়ার মতােই। বিশেষ করে পশ্চিম এলাকায় সুবিধাজনক সামরিক ভারসাম্যের প্রশ্নে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই নির্বুদ্ধিতা ভারতের জন্যে একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবেই মূল্যায়িত হলাে। 

পূর্ব বাংলার গণঅসন্তোষ এবং সেই অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সার্বিক এই অস্থির পরিস্থিতিকে টিক্কা খান তার সীমিত প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার কারণে খুবই সাধারণ ঘটনা হিসেবে মূল্যায়ন করেন। পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্ভবতঃ তিনি কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকদের অনুরূপ ধারণার প্রতি আসক্ত হন। অর্থাৎ এ ধরনের সমস্যা মােকাবেলায় তার বিবেচনায়ও সামরিক শক্তি প্রয়ােগই যথেষ্ট। যে কারণে তিনিও ভাবতে পেরেছিলেন যে এই সামরিক শক্তির বলে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধীন সত্তার বিস্ফোরণকে তিনি হয়তােবা পঞ্চাশ দশকের ক্ষুদ্র পাঠান বিদ্রোহের সাথে একীভূত করে দেখে থাকবেন। একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে টিক্কা খানের সৈনিক জীবনের শুরু। ফলে খুব সঙ্গত কারণেই একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার যে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকা প্রয়ােজন টিক্কার তা ছিলাে না। আর তা ছিলাে না বলেই সাড়ে সাত কোটি বিক্ষুব্ধ মানুষের এক বিশাল জনগােষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কথিত অখণ্ড পাকিস্তানের বাস্তবতা চিন্তা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। টিক্কা খানের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। শিক্ষা এবং প্রজ্ঞায় উপযুপরি ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও একজন সাধারণ সৈনিক থেকে তিনি জেনারেল পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ধর্মান্ধ এবং ঔপনিবেশিক ধাঁচে গড়ে ওঠা একটি দ্বিতীয় সারির সেনাবাহিনীতেই কেবল এমন ঘটনা সম্ভব। উগ্র পাঞ্জাবী মানসিকতা এবং সেই সাথে কট্টর বাঙালী বিদ্বেষ টিক্কা খানকে পাকিস্তানী সৌখিন নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রিয়ভাজন এবং বিশ্বস্ত করে তুলেছিলাে। যে কারণে বিদ্রোহী বাঙালীদের কঠোর হাতে শায়েস্তা করার দায়দায়িত্ব তারা নির্দ্বিধায় তার ওপর ছেড়ে দেন। বলা যায় এ কাজে প্রথম বিচারেই টিক্কাকে অবিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেনারেল টিক্কা বাঙালী শায়েস্তা করার রােমাঞ্চকর দায়িত্ব পাবার পর বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনে তার মধ্যযুগীয় মেধার পরিচয় দিতে শুরু করেন। প্রথমতঃ তিনি ধরে নিলেন পলিল মাটির বাঙালী জাতিকে শায়েস্তা করা তেমন কোনাে কঠিন কাজ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রোহের উৎসস্থল হিসেবে ধরে নিয়ে তিনি এই এলাকাটিকে ধ্বংসসহ কয়েক হাজার বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্যদিয়ে বিদ্রোহ দমনের উপায় স্থির করলেন, যা প্রকারান্তরে পাকিস্তানী অখণ্ডতার ধারণাটিকেই চরমভাবে খণ্ডিত করে ফেললাে। 

ঢাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে সেনা অভিযানের পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেডকে যমুনার পশ্চিম পারে বিস্তৃত উত্তরবঙ্গের দিকে ধাবিত করেন টিক্কা খান। ৮ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে এই ব্রিগেড যমুনা অতিক্রম করার পর পাবনা, বগুড়া ও রাজশাহীর অবরুদ্ধ সেনা ইউনিটগুলাে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে  একই সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য সঞ্চালিত ১৬ পদাতিক ডিভিশনকে আকাশ পথে। উত্তরবঙ্গে পাঠানাে হলাে। ১৬ পদাতিকের ইউনিটগুলাে বিমানে লালমনিরহাট হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষস্থলগুলাের দিকে এগিয়ে যায়। রংপুরে ১৬ পদাতিকের অগ্রবর্তী দলের আগমনের সাথে। সাথে ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের নেতৃত্বে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় যুগপৎ তিনটি অভিযান। পরিচালিত হয়। এর একটি ট্যাংকের সহায়তায় বগুড়া হয়ে রাজশাহী অভিমুখে যাত্রা করে। এবং এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে আগুয়ান ৫৭ ব্রিগেডের সাথে সংযােগ স্থাপনের পরিকল্পনা। নেয়। এই ত্রিমুখী অভিযানের দ্বিতীয় দলটিও পরিচালিত হয় ট্যাংকের সহায়তায়। এই অভিযানটির লক্ষ্যস্থল কুড়িগ্রামসহ তিস্তার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চল। অভিযানের তৃতীয়। শলাকা এগিয়ে যায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের দিকে। এদিকে যমুনা অতিক্রম করেই ৫৭ ব্রিগেড বাঙালী নিধনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মধ্যযুগীয়। লুটের সৈনিকদের মতােই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ আর অবিস্মরণীয় ধ্বংসলিলায় লিপ্ত হয় তারা। যাত্রাপথের দুপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেয় এই বাহিনী। জীবন। হত্যার ব্যাপারে শিশু থেকে বৃদ্ধ কাউকেই রেহাই দেয়া হলাে না। ইতিহাসে বিকৃত সেনানায়কদের মতােই মানব সভ্যতা ধ্বংসের উম্মত্ততায় মেতে উঠলেন বিশ শতকের পাকিস্তানী সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার আরবাব। যমুনা পাড় হয়ে তিনি যতােদূর গেছেন পথের দু ধারে টিকা খানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের নৃশংস স্বাক্ষর তিনি রেখে গেলেন যথাযথভাবেই। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতার পর বৃটিশ সেনাপতি নিল পরাভূত বিদ্রোহীদের প্রতি প্রতিশােধের যে লােমহর্ষক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তা একটি চরম ঘৃণিত অধ্যায় হিসেবে নিন্দিত হয়ে আছে।

এলাহাবাদ থেকে কানপুর পর্যন্ত সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথের দু ধারে তিনি অসংখ্য বিদ্রোহীকে হত্যা করে তাদের লাশ খুঁটিতে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। ইতিহাসের সেই ঘৃণিত চরিত্র নিলের অনুকরণে। ব্রিগেডিয়ার আরবাবও অনুরূপ একটি প্রতিহিংসার অধ্যায় সংযােজিত করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সশ্যামের ইতিহাসে। আরবাবের ‘আবাবিল’ নামধারী বাহিনী পাবনায় গিয়ে পৌঁছার আগেই সেখানে ২৫ পাঞ্জাবের অবরুদ্ধ কোম্পানীটি বাঙালী ইপিআর সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে ১৪ এপ্রিল রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাবের মূল বাহিনীকে উদ্ধারে তিনি সমর্থ হলেন। ততােদিনে অবশ্য ২৫ পাঞ্জাব তার কার্যোপযােগিতা বহুলাংশেই হারিয়ে ফেলেছে এবং পর্যাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির কারণে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ওদিকে যশােরে অবস্থিত ১০৭ পদাতিক ব্রিগেড খুলনায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেও ঝিনাইদা, ঈশ্বরদী, বেনাপােল ও কুষ্টিয়ায় প্রবল প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়। বালি। সৈনিকদের প্রবল প্রতিরােধের ফলে কুষ্টিয়ার যুদ্ধে ২৭ বালুচের একটি কোম্পানী পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঢাকা থেকে আকাশ পথে আরও এক ব্যাটালিয়ন অতিরিক্ত সৈন্য পাঠিয়ে যশাের ব্রিগেডের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরবঙ্গ থেকে জাহানজেব আরবাবের ৫৭ ব্রিগেডকে দক্ষিণে সঞ্চালণ ঘটিয়ে যশাের-কুষ্টিয়া। অঞ্চলে পাকিস্তানীদের অবস্থান দৃঢ়তর করা হয়। | তুলনামূলকভাবে কুমিল্লায় পাকিস্তান বাহিনীকে এই পর্যায়ে তেমন কোনাে প্রতিরােধের মােকাবেলা করতে হয়নি। ফলে এখানে অবস্থানরত ৫৩ ব্রিগেডের মূল বাহিনীকে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অভিমুখে চালিত করা সম্ভব হয়।

চট্টগ্রামের অবরুদ্ধ সেনাছাউনি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর দখলের গুরুত্ব অনুধাবন করেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এই সঞ্চালন ঘটানাে হয়। চট্টগ্রামে শক্তির তুলনামূলক ভারসাম্য প্রতিরােধ বাহিনীর ব্যাপক অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানী বাহিনীর ২০ বালুচ রেজিমেন্ট এবং অপর ৩১ পাঞ্জাবের দু’টি কোম্পানী কিছু ট্যাংকের সহায়তায় সেনাছাউনিতে তাদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে আগলে রাখে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির বাহিনী ৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে অবরুদ্ধ পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সংযােগ স্থাপনে সমর্থ হয় এবং সেখানে তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে চট্টগ্রামে ধাবিত হওয়ার প্রাক্কালে অবশ্য তিনি কুমিল্লা সেনাছাউনিতে বাঙালী নিধন পর্ব সাফল্যের সাথেই সম্পন্ন করেন। | সিলেটে অবরুদ্ধ ৩১ পাঞ্জাবের মূল বাহিনীকে উদ্ধারের জন্যে পাকিস্তানের খারিয়া থেকে সদ্য সঞ্চালিত ৯ পদাতিক ডিভিশনের ৩১৩ ব্রিগেডকে বিমানে দ্রুত সেখানে পাঠানাে হয়। সিলেটে ৩১ পাঞ্জাবের সাথে সংযুক্তি ঘটিয়ে এই ব্রিগেড সােজা দক্ষিণে নেমে যায়। ২৮ এপ্রিল মৌলভীবাজার দখলে এনে এই ব্রিগেডটি তেলিয়াপাড়া-মাধবপুর অক্ষাঞ্চলের উত্তরে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানে আঘাত হানে। একই সময় ৯ পদাতিক ডিভিশনের অধীনস্থ ২৭ ব্রিগেডের একাংশকে ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে ময়মনসিংহের দিকে ধাবিত করা হয়। এই ২৭ ব্রিগেডের অপর অংশ ভৈরবে অবস্থানরত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেখান থেকে তাড়া করে তেলিয়াপাড়া-মাধবপুর অঞ্চলে কোণঠাসা করে ফেলে। ৯ পদাতিক ডিভিশনের তৃতীয় ব্রিগেড অর্থাৎ ১১৭ ব্রিগেডকে কুমিল্লায় ৫৩ ব্রিগেডের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। | এদিকে ঢাকার উত্তরে ১ এপ্রিল গােলন্দাজ সহায়তা দিয়ে একটি ক্ষুদ্র সেনাদল টাঙ্গাইল অভিমুখে পাঠানাে হয়। এই বাহিনী ন্যূনতম প্রতিরােধ ছাড়াই টাঙ্গাইলে তাদের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই। এভাবে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ মােটামুটি প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। যদিও তাদের এই নিয়ন্ত্রণ ছিলাে শহরকেন্দ্রিক। প্রধানতঃ অধিকৃত শহরগুলােকে হাতে রেখেই তাদেরকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পরিতৃপ্তিবােধে মগ্ন থাকতে হয়।

এই শহরকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর দখলদার বাহিনীতে পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্গঠনের জরুরী প্রয়ােজন দেখা দেয়। এর ফলে নতুন করে সেনা ডিভিশনগুলােতে রূপান্তর ঘটে। এ অবস্থায় ৯ পদাতিকের অধীনে ন্যস্ত হয় খুলনা, যশাের, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও বরিশালের বিশাল এলাকা। মেঘনার পূর্বাঞ্চল অর্পণ করা হয় ১৪ পদাতিক ডিভিশনের ওপর। ১৬ পদাতিক থেকে যায় উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনার সামগ্রিক দায়িত্বে। একই সাথে পুনর্গঠনের আওতায় ১৬ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে দেয়া হলাে তিনটি ব্রিগেড – ২৩, ৩৪ ও ২০৫। ১৪ পদাতিকের অধীনে ন্যস্ত হয়২৭, ৫৩, ১১৭ ও ৩১৩ ব্রিগেড এবং ৫৭ ও ১০৭ ব্রিগেড দুটির নেতৃত্ব দেয়া হয় ৯ পদাতিককে। উপরন্তু অতিরিক্ত প্রায় আড়াই ব্যাটালিয়ন নিয়মিত সৈন্য এবং প্রায় দু’হাজার সংমিশ্ৰিত আধাসামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে ৯৭ ব্রিগেড নামে একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড তৈরী করা হয় চট্টগ্রামে। | পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও পাঁচ ব্যাটালিয়ন সৈন্যের আগমনের ফলে সার্বিক পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। আনুমানিক দুই ব্রিগেড সমান পাঁচ ব্যাটালিয়ন সৈন্যের এই স্থানান্তর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা প্রশ্নে প্রকারান্তরে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের নির্বুদ্ধিতাকে আরও একবার নগ্নভাবে  প্রমাণ করলাে। যাহােক এই পর্যায়ে পাকিস্তানীদের ঢেলে সাজানাের প্রক্রিয়ায় আবারাে পরিবর্তন আনা হলাে। বাংলাদেশে এবার মেঘনার পূর্ব এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৪ পদাতিকের বিশাল এলাকা খণ্ডিত করে এর একটি অংশের দায়িত্ব দেয়া হয় ৩৯ এডহক ডিভিশনের ওপর এবং ৫৩, ১১৭ ও বৃহত্তর চট্টগ্রামে নিয়ােজিত ৯৭ স্বতন্ত্র ব্রিগেডকে এই ডিভিশনের অধীনস্থ করা হয়। অর্থাৎ কুমিল্লা, নােয়াখালী এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ছাড়াও এই ডিভিশনের একাংশের ওপর প্রয়ােজনে ঢাকার দক্ষিণাংশের প্রতিরক্ষার দায়িত্বও অর্পিত হলাে। ১১ ব্রিগেড নামে অপর একটি সংমিশ্রিত বিগ্রেডেরও সৃষ্টি করা হয় এ সময়। এই ব্রিগেডটিকে ফেনী ও চট্টগ্রাম অক্ষাংশের প্রবেশমুখে মােতায়েন করে এই ৩১ ডিভিশনকে এর তদারকির ভার দেয়া হয়। ফলে ৩৯ এডহক ডিভিশন সর্বমােট ৪টি পদাতিক ব্রিগেডের কর্তৃত্ব। লাভ করলাে। | ঢাকায় সদর দফতর করে এবং ৩৬ এডহক ডিভিশন নাম দিয়ে আরও একটি ডিভিশন গড়ে তােলা হলাে। ঢাকার প্রতিরক্ষা ছাড়াও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তৃত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হলাে এই ডিভিশনকে এবং এর অধীনে দেয়া হয় ৯৩ ব্রিগেডসহ আধা সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত দুটি ব্যাটালিয়ন।

এডহক ফরমেশন গঠনের এই প্রক্রিয়া এরপরও অব্যাহত থাকে। শহরকেন্দ্রিক যুদ্ধ অর্থাৎ দুর্গকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা কৌশলের আওতায় গঠন করা হয় আরও তিনটি এডহক ব্রিগেড। তিনটি কৌশলগত শহরকে কেন্দ্র করে গঠিত এই তিনটি এডহক ব্রিগেডের ২০২ ব্রিগেড সিলেটে এবং অপর দু’টি মােতায়েন থাকে রাজশাহী ও খুলনায়। ফেব্রুয়ারী মাসের গােড়ার দিকেই ভারতীয় সমরবীদরা পাকিস্তানের পূর্বাংশে দ্রুত অবনতিশীল ঘটনাবলীর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে শুরু করে। কার্যতঃ এ সময় থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন ডাইরেক্টরেট, বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থা এবং সর্বোপরী কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণী সংস্থাসমূহ বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকায় বড় ধরনের একটি গােলযােগ আসন্ন—এ বিষয়টি তারা আগাম অনুমান করতে সক্ষম হলেও এখানে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ এই গােলযােগ মােকাবেলায় ঠিক কতােখানি আহাম্মকী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তার গভীরতা নিরূপণ করা তখনাে পর্যন্ত তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২৫ মার্চের সেনা অভিযানের পরও বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে কি ঘটছে ভারত তা সুস্পষ্ট করে জানতে পারেনি। এরপর বিভিন্ন সূত্র থেকে কিছু কিছু খবর ভারতের গােচরীভূত হতে থাকে। কিন্তু এই সব খবরের ভিত্তি এবং সত্যতাও সুস্পষ্ট কিংবা জোরালােভাবে নির্ভরশীল ছিলাে না। অর্থাৎ ২৫ মার্চের পরবর্তী বেশ কিছুদিন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপ্তি এবং বাঙালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাহণ অবস্থান, এমনকি তিনি জীবিত না মৃত—সে সম্পর্কেও পরিস্কার কোনাে তথ্য পায়ান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে পাকিস্তানীদের অভিযান তৎপরতার কিছু কিছু খবর ৩” সবেমাত্র সীমান্ত গড়িয়ে ভারতমুখি হতে শুরু করেছে। বলাই বাহুল্য এই খবরেরও বেশ ভাগ ছিলাে বিভ্রান্তিকর।

প্রধানতঃ ঢাকায় সেনা অভিযান শুরু হবার পর ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ দিক-বিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও তখনাে পর্যন্ত সীমান্তের দিকে আশ্রয়প্রাথী উদ্বাস্তুদের ঢল তেমন করে শুরু হয়নি। তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তাড়া খাওয়া কতিপয় ইপিআর সদস্য এরই মধ্যে সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। ২৬ মার্চ জনা ত্রিশেক ইপিআর সদস্যের একটি দল প্রথম বিলােনিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরা এলাকায় প্রবেশ করে। এই ঘটনার দু’এক দিনের মধ্যেই অনুপ্রবেশের অনুরূপ আরও একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে। এই অনুপ্রবেশকারীরা ছিলাে বিদেশী সাংবাদিক। দলে মােট সাংবাদিক ছিলেন প্রায় ৪০ জন। এরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সীমান্ত অতিক্রমে বাধ্য হয়। বলা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে বিতাড়িত এই বিদেশী সাংবাদিকরাই প্রধানতঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডের কিছু কিছু তথ্যনির্ভর বিবরণ ভারতে বয়ে নিয়ে যায় বিশ্ববাসীর জন্যে। এরপর ক্রমান্বয়ে ভারতমুখি বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। একই সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ভারত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারে। কিন্তু তখনাে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এমনকি খােদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কোনাে নিশ্চিত তথ্য হস্তগত করতে পারেননি। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলে মিসেস গান্ধী তাকে প্রথমেই যে প্রশ্নটি করেন তা হচ্ছে, তােমাদের নেতা শেখ মুজিব কোথায়?

এর আগে ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ভারতীয় লােকসভায় উত্তেজিত পার্লামেন্ট সদস্যদের আশ্বস্ত করতে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে সে ব্যাপারে ভারত যথাসময়ে যথাবিহিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মােটেও দ্বিধা করবে না। মিসেস গান্ধীর এই ঘােষণার ঠিক চার দিন পর ভারতীয় লােকসভার বৈঠকে বাংলাদেশে যুদ্ধরত জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সাহায্যের আশ্বাস সম্বলিত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর অস্পষ্টতা কেটে যাবার পর অর্থাৎ এই অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। পাবার পর ভারত এটা যথার্থই বুঝে নিলাে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যা করছে তার প্রভাব সীমান্ত পার হয়ে অচিরেই ভারতকেও আক্রান্ত করবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটাও বুঝে নিলাে যে এই ঘটনার পরিণতিতে উপমহাদেশে এক সময় বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের সম্ভাবনাও অনিবার্য হয়ে উঠবে—যাকে আর কোনাে বিকল্প দিয়েই উপেক্ষা করা যাবে  বাংলাদেশের ঘটনায় ভারতীয় সম্পৃক্ততার অপর একটি ক্ষেত্র ছিলাে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের দীর্ঘসূত্ৰী বৈরীতা। এই বৈরীতাও পাকিস্তানের স্বার্থের বিপরীতে যুদ্ধোন্মুখ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষাবলম্বনে যৌক্তিকভাবে উৎসাহী করে তােলে ভারতকে। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে ভারতের উৎফুল্ল হবার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে পাকিস্তানের এই বর্বরােচিত সামরিক পদক্ষেপে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রথমতঃ হতবাক হয়ে যায়। সবকিছু মিলিয়ে চির বৈরী পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার যে একটি মােক্ষম সুযােগ পাকিস্তান নিজেই সৃষ্টি করে দেয় তা হাত ছাড়া করতে ভারত রাজী হবে কেননা! ভারতের জন্যে এই সুযােগ কাজে লাগাবার অনুকূল ক্ষেত্র তৈরী হয়ে আসছিলাে চারদিক থেকে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারতে সাংবিধানিকভাবেই গণতন্ত্র চর্চা ও তা লালনের প্রতিশ্রুতি ছিলাে তার জনগণের কাছে এবং বিশ্বব্যাপী।

আবার সেই জনগণও সরকারের তুলনায়। ইতিমধ্যেই কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলাে গণতন্ত্রের মূল কথা স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধরত বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে। কিন্তু তারপরও এই সত্যটি পরিষ্কার যে ভারত পাকিস্তানের সাথে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার প্রশ্নে মােটেও প্রস্তুত ছিলাে না। বিশেষতঃ মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা এবং তারও দূরবর্তী অঞ্চল জুড়ে ভারতীয় সেনা বিন্যাসের প্রকৃত চিত্রটির দিকে তাকালে এই সত্যটি পরিষ্কার হয়ে যায়। আবার এর বিপরীতে সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের স্বেচ্ছাচারিতাকে একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে। ছেড়ে দিতেও তারা সম্মত ছিলাে না। এই টানাপােড়েনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী। গান্ধী যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে পরিস্থিতিকে আরও পর্যবেক্ষণের স্বার্থে সীমিত আকারে সামরিক তৎপরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। তার এই নির্দেশের আওতায় যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীকে ভারতের মাটিতে প্রবেশের অনুমতিসহ প্রশিক্ষণ এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া হলাে। এই পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব অর্পিত হলাে ভারতের আধা সামরিক সেনা সংগঠন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফর ওপর। | ভারতের প্রাথমিক পর্যায়ের এই সীমিত সহায়তা প্রদানের আশ্বাস নিয়েই বাংলাদেশের প্রতিরােধ যুদ্ধ নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটালাে চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথে। যুদ্ধ অসম জেনেও মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ জোরদার করে তুললাে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রতিরােধ যুদ্ধ ছড়িয়ে গেলাে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে—সর্বত্রই। | একদিকে পাকিস্তানীদের বেধড়ক হত্যাযজ্ঞ এবং অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ যুদ্ধ—এই টানাপােড়েনের মাঝখানে ভিটেমাটি ছাড়া হলাে শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষ। দেখতে। দেবতে অল্প ক’দিনের মধ্যেই বাস্তুত্যাগী এই অসহায় মানুষেরা সীমান্ত অতিক্রম করে | ভারতের দিকে ধাবিত হলাে আশ্রয়ের জন্যে। পাকিস্তানের নির্বোধ সমরবিদরা তাদের সব ব্যবস্থাকেই স্থায়ী এবং প্রতিঘাতহীন হিসেবে ধরে নিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করলাে। তাদের এই মানব বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের ভয়ংকর অশুভ প্রতিক্রিয়া অনুধাবনে তারা ব্যর্থ হলাে চরমভাবে। বেমালুম ভুলে গেলাে একান্ত পাশে অবস্থিত ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ভারতের অস্তিত্বের কথা—ভারতের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার কথা।

১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর সহসাই ভারত চীনা হামলার সম্মুখীন হয়। এর এক মাস পর ২১| নবেম্বর চীনা বাহিনী একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে। এই যুদ্ধে ভারতের পরাজয়কে ভারতীয় রাজনীতিক ও সমরবিদদের চৈতন্য লাভের একটি পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা এবং চীনের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় সর্বপরি ১৯৫৪ সালে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চশীলা নীতির আওতায় চান| ভারত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় তা ভারতকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা থেকে বিরতা রাখে। ফলে সামরিকভাবে অপ্রস্তুত ভারত শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয় ৬২র এই যুদ্ধে । পরাজয়ের কারণে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে নিপতিত হয় ভারতীয় জনগণ। ব্যাপক সাহায্য এবং সমর্থনও ভারতের এই বিব্রতকর অসহায়ত্ব ঘােচাতে সমর্থ হলাে না। যুদ্ধ শেষে সে দেশের জনগণ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কারণেই এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পেতে চেয়েছে এবং এই পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ভারতের সামরিকীকরণকেই তারা জোরালােভাবে সমর্থন দিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে যথাসম্ভব ত্যাগ স্বীকারেও তাদের মানসিক প্রস্তুতির কথা তারা ব্যক্ত করেছে জাতীয়ভাবে। আর তখন থেকেই কার্যতঃ ভারতের নিরবিচ্ছিন্ন সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যাপকতর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে ভারতকে ৬২’র সমপর্যায়ের সামরিক শক্তি বিবেচনা করে পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুতে তাকে যুদ্ধের জন্যে প্ররােচিত করে। তারা ভেবেছিলাে চীনের অনুরূপ বিজয় অর্জন তাদের পক্ষেও সম্ভব। ফলে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ। ১৭ দিনের এই যুদ্ধে ভারত ব্যাপক আকারের সাফল্য অর্জনে সমর্থ না হলেও পাকিস্তানের কাশ্মীর দখলের খায়েসকে অন্ততঃ তখনকার মতাে ধূলিস্যাৎ করে দেয়। ভারতের জন্যে এটাই ছিলাে তখনকার বিবেচ্য সামরিক বিজয়। পক্ষান্তরে পাকিস্তান ভিন্ন এক ভারতীয় বাহিনীর পরিচিতি লাভ করে এই যুদ্ধে—’৪৮ বা ৬২’র তুলনায় যাদের অবস্থানে ততােদিনে ব্যাপক গুণগত পার্থক্য সাধিত হয়েছে।

এর আগে ১৯৬৪ সালে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর আয়তন বৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের জন্যে যে পঞ্চসালা পরিকল্পনা গৃহীত হয় ৭০’র দশকে পদার্পণের আগেই তার সফল বাস্তবায়ন ঘটে। এই পঞ্চসালা পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিলাে প্রথমতঃ স্থল বাহিনীর আয়তন ৮ লক্ষ ২৫ হাজারে বৃদ্ধি এবং বিমান বাহিনীর স্ফীতি ঘটিয়ে জংগী বিমানের বহরকে ৪৫ টি। কার্যপযােগী স্কোয়াড্রনে উন্নীত করা। একইভাবে নৌবাহিনীর ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিকল্পিত পরিবর্তন সূচিত হয়। সেই সাথে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন ঘটে আধুনিকায়ন পরিকল্পনা। প্রতিরক্ষামূলক উৎপাদন বৃদ্ধি করে এই সময়ের মধ্যে বিদেশী নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনা হয় উল্লেখযােগ্য হারে। সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্তু প্রথম পঞ্চসালা পরিকল্পন! শেষ হবার আগেই ভারতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সামরিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভারত সাফল্যজনকভাবে ইলেকট্রনিক সাজসরঞ্জাম তৈরী ও তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীতে। অত্যাধুনিক জংগী বিমান, ট্যাংক, কামান, রাডার, নৌযান এসবের আমদানীর পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদনও নিশ্চিত করা হয়। ফলে পরিকল্পিতভাবেই প্রতিরক্ষা উৎপাদন সংক্রান্ত অবকাঠামাে সৃষ্টির পাশাপাশি স্বনির্ভর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি সুশৃঙ্খল সশস্ত্র বাহিনী তৈরীতে ভারত সফল হয় বললে অত্যুক্তি হবে না। এভাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যখন ৭০’র দশকে পদার্পণ করে তখন যে কোনাে মাপকাঠিতেই এই দেশটি একটি আধুনিক যুদ্ধোপযােগী সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী। হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে সামরিক ক্ষেত্রে ভারতের এই দ্রুতগতি সমৃদ্ধির প্রকৃত পরিসংখ্যান নিরূপণে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী চরমভাবে ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানের শাসকরা তখনাে ভারতকে ৬২ বা ৬৫’র অবস্থার একটি সামরিক শক্তি বিবেচনা করা অব্যাহত রাখে এবং কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবারও একটি যুদ্ধের জন্যে তাকে প্ররােচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বাংলাদেশে তাদের সামরিক আগ্রাসন ছিলাে এক অর্থে এই প্রচেষ্টারই অংশবিশেষ।

৭১’এ পদার্পণের প্রারম্ভে ভারতের ৮ লক্ষ ২৫ হাজার সদস্যের সুবিশাল স্থলবাহিনী ১৩টি  মাউন্টেন, ১০টি পদাতিক ও ১টি সাজোয়া ডিভিশনে বিভক্ত ছিলাে। এ ছাড়াও ছিলাে | একাধিক স্বতন্ত্র পদাতিক ও সাজোয়া বিগ্রেড এবং ২টি বিমানবাহী প্যারা ব্রিগেড। | ভারতের ট্যাংক বহর সজ্জিত ছিলাে আধুনিক সােভিয়েট নির্মিত এবং নিজস্ব উদ্যোগে উৎপাদিত বিজয়স্তা ট্যাংক দিয়ে।  ইতিমধ্যে ভারত তার স্থলবাহিনীতে ৬৫’র যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে অতিরিক্ত আরও ৭৫০টি ট্যাংকের সংযােজন ঘটাতে সমর্থ হয়েছে তার সাজোয়া বহরে। গােলন্দাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রচলিত যুদ্ধের জন্য উপযােগী গােলন্দাজের এক বিশাল বহরও ততােদিনে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে ভারত তার বাহিনীতে। | দেশ হিসেবে ভারতের আঞ্চলিক বিশালতা এবং কৌশলগত প্রয়ােজন বিবেচনা করে ভারত বিগত দিনগুলােতে তার সেনাবাহিনীকে চারটি কমাণ্ডে বিভক্ত করার মাধ্যমে পরিকল্পিত সমাবেশ ঘটায়। পশ্চিমাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধীনে ন্যস্ত করা হয় তিনটি কোরে বিভক্ত তেরটি পদাতিক ও একটি সঁজোয়া ডিভিশন। এ ছাড়াও অতিরিক্ত আরও কিছু সঁজোয়া ব্রিগেডকে এই কমাণ্ডের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। উত্তর-পূর্ব কাশ্মীরের লাদাখ ও সিমলা সেক্টরে নিয়ােজিত দুটি মাউন্টেন ডিভিশনকেও এই কমাণ্ডের আওতাধীন রাখা হয়। অনুরূপভাবে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধীনেও তিনটি কোরের বিন্যাস ঘটে। অবশিষ্ট সেনা ফরমেশনগুলােকে উত্তর ও মধ্য-দক্ষিনাঞ্চলীয় কমাণ্ডের মধ্যে বিভক্ত করে তাদের কৌশলগত সমাবেশ ঘটানাে হয়। মধ্য-দক্ষিণাঞ্চলীয় কমাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত অঞ্চলসমূহ ছিলাে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশসংলগ্ন রাজস্থান ও গুজরাটের গােটা সীমান্ত এলাকা জুড়ে সম্প্রসারিত। | বিমান বাহিনীর ক্ষেত্রেও ভারত আধুনিকীকরণ এবং সম্প্রসারণে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। এই সম্প্রসারণ স্কীমের আওতায় ৬২৫টি আধুনিক জঙ্গী বিমান ৪৫ টি স্কোয়াড্রনে বিভক্ত করে ৪টি সুনির্দিষ্ট কমাণ্ডের অধীনে বিভিন্ন ঘাটিতে মােতায়েন করা হয়।

নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে একটি বিমানবাহী জাহাজ, দুটি ক্রুজার, তিনটি ডেস্ট্রয়ার, দুটি ডেস্ট্রয়ার স্কর্ট, পাচটি সােভিয়েত নির্মিত পিটা শ্রেণীর ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত নৌযান এবং চারটি ‘এফ’ শ্রেণীর সাবমেরিন দুটি পৃথক নৌবহরে বিভক্ত করে পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে আরব সাগরে মােতায়েন রাখা হয়। ভারতের এই বিশাল সমর আয়ােজনের বিপরীতে ‘৭১ সাল নাগাদ পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীকে ১৩টি পদাতিক ও ২টি সঁজোয়া ডিভিশন এবং অতিরিক্ত ২টি গােলন্দাজ ও ২টি পদাতিক ব্রিগেড দিয়ে সজ্জিত করে। তিনটি বােমারু স্কোয়াড্রনসহ বিমান বাহিনাতে সর্বমােট স্কোয়াড্রনের সংখ্যা দাড়ায় ১৭। নৌবাহিনীতে উল্লেখযােগ্য সংযােজন ছিলাে একটি হালকা ক্রুজারসহ দুটি ডেস্ট্রয়ার, তিনটি ডেস্ট্রয়ার স্কর্ট, দুটি দ্রুতগতিসম্পন্ন ফ্রিগেট, চার টহল যান এবং চারটি সাবমেরিন। পাকিস্তানের মূল জনগােষ্ঠীর শতকরা ৫৬ জনের বাস পূর্বাংশে থাকলেও ৭১ পূর্ববতা সময় এই অঞ্চলে পাকিস্তানের সামরিক শক্তির খুবই ক্ষুদ্র একাংশের সমাবেশ ঘটানাে হয়। ১৩টি পদাতিক ডিভিশনের মধ্যে মাত্র একটির সঞ্চালন ঘটানাে হয়েছিলাে ঢাকায়। এই ডিভিশনের সমর্থনে ছিলাে ১২টি এফ ৮৬ স্যার জেট জঙ্গী বিমান নিয়ে গঠিত একটি মাত্র স্কোয়াড্রন এবং শুধুমাত্র নদীপথে চলাচলযােগ্য চারটি সেকেলে গানবােট। বস্তু পাকিস্তানের গােটা সামরিক শক্তির প্রায় পুরােটাই নিয়ােজিত থাকে পশ্চিমে স্থলবাহিনীর ১২টি পদাতিক ও দুটি সাজোয়া ডিভিশনকে ৩টি কোরে বিভক্ত করে উত্তর থেকে দক্ষিণে ভারত সীমান্ত বরাবর নিয়ােজিত রাখা হয়। এর মধ্যে দুটি পদাতিক ডিভিশনের সমাবেশ ঘটানাে হয় উত্তরে ভারতীয় কাশ্মীরের মুখােমুখি এবং একটি সঁজোয়া ব্রিগেডের সমন্বয়ে অপর একটি ডিভিশনের সঞ্চালন ঘটানাে হয় দক্ষিণে সিন্ধুসংলগ্ন সীমান্তে। সমর শক্তির বাদবাকি বৃহদাংশই নিয়ােজিত থাকে পাঞ্জাবের প্রতিরক্ষায়। বাংলাদেশে মার্চ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড থেকে যে দুটি পদাতিক ডিভিশনের সঞ্চালন ঘটে তার শূন্যস্থান পূরণে অবশ্য সেখানে নতুন দুটি ডিভিশন সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয় এপ্রিলের শেষ দিকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সমাপ্তির আগেই পাকিস্তানের সামরিক বিপর্যয় ঘটে যায় বাংলাদেশসহ পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনগুলােতে। একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয় মুখ্যতঃ রাজনৈতিক টানাপােড়েনেরই অবধারিত ফলশ্রুতিতে যে কারণে কোনাে যুদ্ধের সূচনা সাধারণতঃ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

কিন্তু সেই যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে তার বাস্তবায়নসহ বিজয় বা সাফল্য। অর্জনের মূল দায়িত্ব অর্পিত থাকে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর। অবশ্য এই বিজয়ের বিপরীতে পরাজয়ের গ্লানির দায়ভার বহন করতে হয় সশস্ত্র বাহিনীকে। যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর সেনানায়কদের ওপর অর্পিত থাকলেও বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করেই তাদেরকে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। এই পরিকল্পনার পরিধির মধ্যে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক ছাড়াও সমান গুরুত্বে প্রাধান্য প্রায় রাজনৈতিক বাস্তবতার নানান প্রসঙ্গ—যেমন, যুদ্ধের জন্যে ব্যাপক জনগণের মানসিক প্রস্তুতি কিংবা একাত্মতা, তাদের সামগ্রিক প্রত্যাশা বা আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। একজন কিংবা একাধিক বিচক্ষণ বা দক্ষ সেনাপতিই প্রধানতঃ যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নের মূল দায়িত্ব বহন করে থাকে। যে কারণে এই সেনাপতিদের মেধায় সামরিক দক্ষতার পাশাপাশি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ও সমরকৌশলগত বিচক্ষণতা কিংবা দূরদর্শিতার সমন্বয় থাকা একান্তই অপরিহার্য। ৭১’র মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হবার পর নির্বিচার গণহত্যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভীত-সন্ত্রস্ত নারী-পুরুষরা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে। বাস্তুত্যাগী এই শরণার্থীরা তাদের সাথে বয়ে নিয়ে যায় বেশুমার হত্যা, ধ্বংস, ধর্ষণ আর লুটপাটের সব লােমহর্ষক বিবরণ। তাদের পেছনে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে তখনাে কামান আর মেশিনগানের অনবরত শব্দের মুখে দিকছুট অসহায়। মানুষের আর্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাস মথিত হচ্ছে। কয়েক দিনের ব্যবধানেই ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালী শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় কোটিতে গিয়ে পৌছলাে। ভারতের মাটিতে আশ্রিত এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভিড় সে দেশের সমাজ জীবনের ভারসাম্যে বােধগম্য কারণেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। কিন্তু বিস্ময়কর যে সে দেশের জনগণ নিজেদের অসুবিধার কথা ভুলে গিয়ে এই বাড়তি মানুষের চাপকেও তখন নিদ্বিধায় মেনে নেয়। তারা সুহৃদয় প্রতিবেশীর মতােই স্বাগত জানায় শরণার্থীদের। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণ এই সুবাদে যেনাে সেই হারানাে ইতিহাসের পুনরাবির্ভাব তথা বৃহত্তর বাংলার সহজাত সহমর্মিতা খুঁজে পায় দীর্ঘকাল পর। ভারতীয় জনগণ খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা এবং দিনের পর দিন ক্রমবর্ধিষ্ণু এই দুঃখ-যন্ত্রণা ব্যথিত করে তােলে তাদের।

এ অবস্থায় তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈনিকদের নির্দয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্যে ভারত সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনায় সােচ্চার হয়ে ওঠে। | এদিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের অব্যাহত হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের বিপরীতে প্রতিরােধ যুদ্ধও ক্রমান্বয়ে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় উপমহাদেশীয় ইতিহাসে বাংলাদেশ’ নামক এক নতুন এবং স্বাধীন মানচিত্রের আবেদন ক্রমেই বিমূর্ত হতে থাকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভ্যন্তরে। ফলে আগ্রাসিত বাংলাদেশে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারটি একটি অনিবার্য রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এ ব্যাপারে উপর্যুপরি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে থাকে। ভারতীয় জনগণ, বিরােধী রাজনৈতিক দল এবং সর্বোপরি সে দেশের নীতি নির্ধারকরা বাংলাদেশ ইস্যুতে ইন্দিরা সরকারের আপাতঃ নির্লিপ্ততায় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। অনুরূপ অভিযােগ উত্থাপন করে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধেও সমালােচনার ঝড় ওঠে। বাংলাদেশ সম্পর্কে উদাসীনতা প্রদর্শনের কারণে কেউ কেউ এমনকি তার অপসারণও দাবি করে। এক পর্যায়ে দিল্লীতে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিসভার মধ্যেই বিষয়টি অনুরণন তােলে। সেখানে ক্রমেই পূর্ব বাংলায় ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তীব্রকণ্ঠীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে চূড়ান্তভাবে বােঝাপড়া সেরে ফেলার জন্যে মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে শক্তিশালী একটি লবীর নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এতাে সব চাপের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার স্বভাবজাত বিচক্ষণতা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পথ ধরে এগুচ্ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ ইস্যুতে বাহ্যিকভাবে তাকে নির্লিপ্ত মনে। হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি যথারীতি সজাগ এবং সক্রিয় ছিলেন এ ব্যাপারে কার্যতঃ তিনি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে এবং আটঘাট বেঁধেই পাকিস্তানের সাথে চূড়ান্ত বােঝাপড়ায় নামতে চেয়েছিলেন এবং তার এই বিচক্ষণতার স্বপক্ষে সামগ্রিকভাবে একটি উপযুক্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রও খুব দ্রুততার সাথে প্রস্তুত হচ্ছিলাে।

উত্তর দিকে হিমালয় সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের এক নম্বর প্রিয়ভাজন চীনা উপস্থিতির সম্ভাবনায় কিছুটা বিচলিত ছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সেনানায়করা। তারা সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধের প্রশ্নে দুর্বোধ্য চৈনিক নীতি নির্ধারকদের পুরােপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভূট্টো সিনাে-পাক বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ভারতকে অনবরত শাসিয়ে যাচ্ছিলেন এই বলে যে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে চীন নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে না। তারা নিশ্চিতভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেবে। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আভাস-ইঙ্গিতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং এটাই বােঝাতে প্রয়াসী হলেন যে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই তারা চৈনিক নেতাদের আশ্বাস পেয়ে গেছেন। চীনের পক্ষ থেকে অবশ্য পাকিস্তানের এই আস্ফালনের প্রসঙ্গে হ্যা বা না সুস্পষ্ট করে কোনাে বক্তব্যই পাওয়া যায়ান। যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার বাঙালী নিধনে প্রধানতঃ চৈনিক সমরাস্ত্রই বেশী কাজে লাগছিলাে। সবকিছুর মিলিত বিবেচনায় ভারত সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে পুরােপুরি উড়িয়ে দিতে পারেনি। এই ধারণার আলােকে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ও তার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ একই সাথে পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টিকে মােটেও যুক্তিযুক্ত মনে করতে পারলেন না। এ ক্ষেত্রে তারা একক শক্তি শুধুমাত্র পাকিস্তানকেই মােকাবেলা করার জন্যে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান সেনাপতিই নন, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তথা দূরদর্শিতাও ছিলাে প্রখর। আঞ্চলিক রাজনীতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলাে তিনি তার বিচক্ষণ মেধায় বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। এই মেধাবী সেনা প্রধান মানকেশ যে কারণে তার রাজনৈতিক এবং সামরিক আত্মবিশ্বাস থেকেই চেয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সাথে ভারতের একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রশ্নে তার সিদ্ধান্তকেই যেনাে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তার মতে বাংলাদেশ ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সুবিবেচিত সময় হচ্ছে নবেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বর মাসের যে কোনাে সময়। যুদ্ধোপযােগী আঞ্চলিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে জেনারেল মানেকশ যে ধারণা পােষণ করতেন তা হচ্ছে প্রথমতঃ মুক্তিবাহিনীকে একটি সুগঠিত যুদ্ধোপযােগী শক্তিতে রূপান্তরের জন্যে জোরালাে প্রশিক্ষণ প্রদান।

এরপর একটি নির্দিষ্ট মেয়াদী প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে চোরাগােপ্তা হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীকে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখবে এবং এই প্রক্রিয়াকে একটি পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর ফলে শত্রু বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা ক্রমধয়ে বেড়ে যাবে এবং একই সাথে বিপর্যস্ত হবে যােগাযােগ ব্যবস্থা। ঠিক এই অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনী বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে ধাওয়া করতে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে বাধ্য হবে অর্থাৎ পরবর্তীতে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্যে প্রয়ােজনীয় সংঘবদ্ধ প্রতিরােধ ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলবে এবং সেই অবস্থায় যুদ্ধে তাদেরকে পরাভূত করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলম্বে যুদ্ধে নামার স্বপক্ষে জেনারেল মানেকশ’র যুক্তি ছিলাে সম্ভাব্য সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রশ্নে চীনাদের সামনে একটা শক্ত প্রতিকূলতার সৃষ্টি করা। পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে পিকিং সরকারের কোনাে প্রত্যক্ষ মন্তব্য না থাকলেও মানেকশ চীনা আক্রমণের সম্ভাবনার কথা ধরে নিয়েই যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে মনােযােগী হন। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে তিনি যে সময়টি বেছে নেন ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার প্রশ্নে বিশেষ করে স্থল পথে এই সময়টি চীনাদের জন্যে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বছরের এ সময়টিতে ভারতের উত্তর সীমান্তে হিমালয় সংলগ্ন প্রবেশ পথসমূহ বরফে আচ্ছাদিত থাকে। ফলে চীনা বাহিনী পাক-ভারত যুদ্ধে জড়ালে তুখােড় ঠাণ্ডা এবং তুষার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ভারতের বিরুদ্ধে কোনাে জোরালাে আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে না। তৃতীয়তঃ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় আকারের একটি যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্যে সেনা বিন্যাস, সামরিক স্থাপনা নির্মাণ, সরবরাহ ব্যবস্থা ও বিমানক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও প্রচুর সময়ের প্রয়ােজন অনুমিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পূর্ব ফ্রন্টে তাদের প্রস্তুতির বিষয়টি ছিলাে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সব শেষে জেনারেল মানেকশ যা চেয়েছিলেন তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি গ্রহণযােগ্য যুক্তির প্রেক্ষিতে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক অর্থাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের এই যুদ্ধ যেনাে এমনভাবে পরিচালিত হয় যাতে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই যুদ্ধকে কোনােক্রমেই সে দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন কিংবা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার যুদ্ধ বলে অভিহিত করতে না পারে। বরং পাকিস্তানী আগ্রাসন প্রতিরােধে এই যুদ্ধ হতে হবে আত্মরক্ষামূলক এবং তা অবশ্যই পরিচালিত হবে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যের নামেই। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে সেনা প্রধান জেনারেল মানেকশার সাথে পুরােপুরি একমত পােষণ করেন। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ভারতে আশ্রিত এক কোটি শরণার্থীর চাপকে অসহনীয় বিবেচনা করলেন এবং বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলােতে বিশেষ করে আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতে জনবসতির ভারসাম্যহীনতার সম্ভাবনায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। উপরন্তু ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় গােলযােগপূর্ণ রাজ্যসমূহ যেমন নাগাল্যাণ্ড মিজোরাম মনিপুর প্রভৃতি এলাকায় বিরাজমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে নিয়ােজিত বামপন্থী গেরিলাদের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বদৌলতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া সহজলভ্য অস্ত্রশস্ত্র পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাতেও তিনি উপর্যুপরি বিচলিত ছিলেন। সামগ্রিক এই পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী তাড়াহুড়াে এড়িয়ে পাকিস্তানের সাথে খানিক বিলম্বিত বােঝাপড়ার প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টিকে যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। এই যুদ্ধে চৈনিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে মােকাবেলার জন্যে এরপর তিনি আন্তর্জাতিক বলয়ের কূটনৈতিক পর্যায়ে যে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হলেন তা সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে নিশ্চিতপ্রায় বিজয়ের প্রশ্নে ভারতকে এক লাফে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলাে। চৈনিক ভীতির বিপরীতে এ সময় তিনি পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করলেন। এই চুক্তির শর্তাবলীর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহায়তার বিষয়টি বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত হলাে। সেদিক থেকে বলা যায় ৭১’র ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে পরবর্তী পাক-ভারত যুদ্ধে নয়াদিল্লীর প্রথম সাফল্য। এই মৈত্রীচুক্তি প্রকারান্তরে ভারতের বিরুদ্ধে যে কোনাে চীনা আক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে চৈনিক নীতি নির্ধারকদের জন্যে একটি সতর্কতামূলক মাইল ফলক হয়ে থাকলাে।

প্রধানমন্ত্রী গান্ধী এরপর বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির কাজে তৎপর হলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ সােচ্চার হতে শুরু করেছিলাে। এবার ভারতীয় কূটনৈতিক তৎপরতার সুবাদে ক্রমেই তা সুতীব্র হয়ে উঠলাে। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী এবং তার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ দু জনেই চেয়েছিলেন বাংলাদেশের চলমান ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হােক যাতে ভারত নয় পাকিস্তানই আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আগেভাগে ভারত আক্রমণ করে বসে। যার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। করা সহজ হবে এবং ভারত এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করবে তা বহিবিশ্বে নিছক আত্মরক্ষামূলক প্রতিআক্রমণ হিসেবেই বিবেচিত হবে। বলাই বাহুল্য বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপারে সিনে-মার্কিন প্ররােচনা সক্রিয় থাকলেও বিশ্ববিবেক ভারতের পরিকল্পনার সমর্থনেই দ্রুত গড়ে উঠছিলাে। অন্যদিকে যুদ্ধমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটনা প্রবাহ যেভাবে এগুলাে তাতেও সে ওহ ভারত প্রণীত পরিকল্পনারই প্রতিফলন ঘটলাে। অথাৎ পাক-ভারত যুদ্ধের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে ভারত যা চেয়েছিলাে বাংলাদেশের প্রায় সমূহ ঘটনাই তার সমর্থনে ঘটে যেতে থাকলো। বাংলাদেশের বিস্তৃত রণাঙ্গন জুড়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে হামলার পর হামলা চাল ক্ষতবিক্ষত করে ফেললাে মুক্তিযােদ্ধারা। আবার একই সাথে মার খাওয়া পাকিস্তানী সৈন্যরা অদৃশ্য প্রায় মুক্তিবাহিনীকে ধাওয়া করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লাে বিশাল এলাকায়, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাে ভারত। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নির্ভুল এবং সবিস্তার ইতিহাস নিশ্চয় একদিন লিখা হবে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশাল ব্যাপ্তির এই বিষয়টির ওপর ব্যাপকতর আলােকপাত করা তাে সম্ভব নয়। তবে স্বল্প কথায় এটা বলা যায় যে, এ দেশের মানুষ তাদের শিরায় ঐতিহ্যের সেই রক্তস্রোত ধারণ করে যা যুগে যুগে চিরকাল বিদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধে উদ্দীপ্ত হয়েছে। বাঙালীর এই প্রতিরােধ যুদ্ধ বিশ্ব মানবতার মুক্তি সংগ্রামে সংযােজন করেছে অনুপ্রেরণার বিরল ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেই ইতিহাসেরই সর্বাধিক উজ্জ্বল এক স্বনালী অধ্যায়। 

ভারতীয় উপমহাদেশে বিদেশী আধিপত্যবাদের সূচনা লগ্ন থেকেই বাঙালী জনগােষ্ঠী তার জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় বারবার বিদ্রোহী হয়েছে। যে কারণে দেখা গেছে সামন্তবাদী মােঘল এবং ঔপনিবেশিক বটিশ শক্তি বিশাল এই উপমহাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য অনেক জাতিগােষ্ঠীকে পদানত করতে সক্ষম হলেও বাঙালী জাতিকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারেনি দীর্ঘকাল। চির বিদ্রোহ মিশে আছে বাঙালীর রক্তে। শােষণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যেনাে তার মজ্জাগত। এ অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে ইঙ্গে-মােঘল শক্তি তাদের বহু কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতা থেকে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে বহুবার। | মােঘল আমলে যেমন কেন্দ্রীয় রাজশক্তিকে বিনিদ্র রাত কাটাতে হয়েছে বিদ্রোহী বাঙালী জাতিকে শায়েস্তা করতে না পারার আক্ষেপে, তেমনি পরবর্তীতে বৃটিশ বিরােধী আন্দোলনের সময়ও দেখা গেছে সেই আন্দোলনের পুরােভাগে সােচ্চার ভূমিকায় অগ্রণী রয়েছে বাঙালীরাই। বাঙালী জাতির এই চির বিদ্রোহী ইতিহাস অনেকের জানা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাদের বিলাসী অভিজাতচক্র তা মানতে চায়নি কখনােই। তারা এ জাতিকে এমনকি একটি জাতি হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের রক্তের বিদ্রোহী ধারা যথাসময়ে ঠিকই অনুসরণ করেছে। ঐতিহ্যকে তারা ভােলেনি। পাকিস্তানীদের দুঃশাসিত ২৩ বছরের প্রতিটি সন্ধিক্ষণেই তারা জানান দিয়ে গেছে তাদের জাতীয় অস্তিত্বের বিদ্রোহী চিৎকার। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময়কাল থেকেই বস্তুতঃ এই সন্ধিক্ষণের ধারাক্রম শুরু। সবশেষে ৭১’এ এসে এই বাঙালী জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে যে সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা করে তা তাদের কয়েক শ’ বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতারই সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস। 

‘৪৭ থেকে ৭১-এই দীর্ঘ দুই যুগের কণ্টকিত রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় বাঙালী জাতি পাকিস্তানের সাথে একটি চূড়ান্ত বােঝাপড়ার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিলাে। এই বােঝাপড়া রাজনৈতিক না সামরিকভাবে হবে তার কোনাে সুচিন্তিত পরিকল্পনা তাদের মধ্যে জন্মালেও শেষ দিকে পাকিস্তানের সাথে তিক্ত সহাবস্থান মানতে তারা আর রাজি ছিলাে এই মানসিকতার পরিণত পর্যায়ে ২৫ মার্চের পর বাঙালী সৈনিকদের বিদ্রোহ তাৎক্ষণিকভাবেই তাদেরকে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আর ঠিক তখন থেকেই একটি বিয়ােগান্তক রক্তাক্ত পথ ধরে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের যাত্রা শুরু। আশার কথা, প্রতিরােধ যুদ্ধের পক্ষে একটি জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তােলার ব্যাপারে যেটুকু সময়ের প্রয়োজন বাঙালীদের জন্যে তার দরকার হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিক গুরুত্ববহ এই ইতিবাচক দিকটির সাথে বর্ধিত সুবিধা হিসেবে যােগ হয় সশস্ত্র দেশপ্রেমিক জনশক্তি। ২৫ মার্চের সুচনালগ্ন থেকেই এই সশস্ত্র জনশক্তি পাওয়া যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালী অংশ থেকে। এদের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের ধারায় খুব দ্রুততার সাথেই প্রতিরােধে অংশগ্রহনেচ্ছু ব্যাপক জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরিক হয় জাতীয় এই যুদ্ধে। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালীদের পক্ষে দু’দিক থেকেই অবস্থাটা ছিলাে সুবিধাজনক। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে প্রাপ্ত দেশপ্রেমিক জনশক্তির সাথে সশস্ত্র বাঙালী সৈনিকদের সম্মিলিত প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনাকাঙ্খিত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে থাকে প্রথম থেকেই। আর তখন থেকেই বাঙালীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অপ্রতিরােধ্য হয়ে ওঠে। | ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সদস্যদের বিদ্রোহের সাথে সাথেই প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত সর্বস্তরের জনগণের একটি বড় অংশ এসে মিলিত হয় বিদ্রোহী সশস্ত্র সৈনিকদের সাথে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত এই সম্মিলিত বাহিনী প্রতিরােধ যুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত। এই বাহিনীর একাংশ যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে এসেছে, তারা নিয়মিত বাহিনী এবং অপর বৃহদাংশ বেসামরিক গণবাহিনী হিসেবেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়। | প্রতিরােধ যুদ্ধের দ্রুত বিস্তৃতির সাথে সাথে সম্মিলিত বাহিনীর গণবাহিনী অংশে। বেসামরিক মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাও ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে।

কিংবা বলা যায়, সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে প্রতিরােধ যুদ্ধেরও বিস্তৃতি ঘটতে থাকে একই হারে। বেসামরিক স্তর থেকে আগত এই মুক্তিযােদ্ধাদেরকে প্রথমতঃ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সহায়তায় সীমিত মেয়াদে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর ফলে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রারম্ভিক অবস্থা থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছােটো ছােটো অসংখ্য প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে। অবশ্য এ ধরনের শিবিরে স্বল্প আয়ােজনে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাতে এমনকি বিশেষ কোনাে মানও অনুসরণ করা হতাে না। প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম এবং সেই সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা না থাকার কারণে সেখানে এর চেয়ে উন্নত কিছু করাও সম্ভব ছিলাে না। হালকা অস্ত্রশস্ত্র চালনা এবং সাধারণ চোরাগােপ্তা হামলা পরিচালনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাে প্রারম্ভিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলাের দায়দায়িত্ব। এরপর প্রতিরােধ যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক পরিণতিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের এই পর্যায় থেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রশ্নে সুপরিকম্পিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এ সময় ভারতের অভ্যন্তরে জরুরা ভিত্তিতে একাধিক প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে। এই শিবিরগুলাে মূলতঃ ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হতাে। এখানে ভারতীয় বাহিনীর চৌকস প্রশিক্ষকদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হতে থাকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। একই সময় যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে সেক্টর কর্তৃপক্ষও ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়। এই কর্মসূচীর বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিটি সেক্টরের অধীনেই এ ধরনের বেশ কিছু প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্থানে।

যুগপৎ প্রশিক্ষণ কর্মসুচীর অধীনে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রশিক্ষণ শিবিরের সংখ্যা একশ’র কোটা ছাড়িয়ে যায়। এর প্রতিটি শিবিরে আকার অনুযায়ী প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিলাে ২ শ থেকে ৫ শ’। প্রতিরােধ যুদ্ধের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত যতােদিন প্রশিক্ষণ শিবির চালু থেকেছে প্রশিক্ষণের জন্যে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীর অভাব সেখানে পরিলক্ষিত হয়নি কখনােই। অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ-যুবক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে ইয়ুথ ক্যাম্পগুলােতে ভিড় জমিয়েছিলাে। এ সব ইয়ুথ ক্যাম্প থেকেই মূলতঃ প্রশিক্ষণের জন্যে উপযুক্ত যােদ্ধা বাছাই করা হতাে। যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক এমন তরুণ-যুবার অধিকাংশই ছিলাে স্কুল-কলেজের ছাত্র যারা। স্বল্প মেয়াদে ও স্বল্প শ্রমে প্রশিক্ষণের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অপেক্ষাকৃত সহজেই আত্মস্থ করতে সক্ষম হলাে। মুক্তিবাহিনীর সর্বস্তরেই এই শিক্ষিত যােদ্ধাদের সমাবেশ ঘটে উল্লেখযােগ্য হারে। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষিত শ্রেণীর বিপুল হারে অংশ গ্রহণের এই রকম ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হিসেবে খুবই বিরল। মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের অভিযান আকারে কিংবা ধরনে তেমন সুপরিকল্পিত অথবা সুনির্দিষ্ট না হলেও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনে দেশের অভ্যন্তরে। চলমান মুক্তিযুদ্ধ বহুলাংশেই বেগবান হয়ে ওঠে। শিক্ষিত শ্রেণীর তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা এ সময় দু থেকে চার সপ্তাহের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ নিয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সর্বত্র আতংক সৃষ্টির পাশাপাশি যতােটা সম্ভব যােগাযােগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়ার কাজে। তারা সক্রিয় হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আশানুরূপ সফলতা পেলেও পাকিস্তানীদের পাল্টা হামলার মুখে তারা কোথাও বেশী সময় ধরে টিকে থাকতে পারেনি। ফলে এই হামলা পাল্টা হামলার মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময়ী মুক্তিযােদ্ধা এ সময় হারিয়ে যায় চিরকালের জন্যে।

এই অসহায় অবস্থার উত্তরণে খুব বেশী দিন অপেক্ষায় থাকতে হলাে না। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দলে দলে আগমন ঘটতে থাকে তুলনায়। অধিকতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের। প্রতি দেড় মাসে অনুমান ২০ হাজার করে। মুক্তিযােদ্ধা তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে রণাঙ্গনে হাজির হতে থাকে। আর তখন থেকেই শুরু হয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধ। যােগাযােগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংসসহ বড় ধরনের চোরাগােপ্তা হামলার পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধও এ সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় প্রতি মুহুর্তের ঘটনায় পরিণত হয়। এ পর্যায়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ৩১টি বড় আকারের সেতু উড়িয়ে দেয়া হয় এবং অস্তুতঃ ১২২টি স্থানে রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে কেনা  হয়। একই স্ময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ স্থাপনা ধ্বংস করা হয় ৯০টিরও বেশী। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা অভিযান অথাৎ চোরাগােপ্তা হামলা। মুক্তিযােদ্ধারা এতাে ব্যাপক আকারে যে এ ধরনের | বিধ্বংসী গেরিলা হামলা চালাতে পারবে পাকিস্তানীরা তা কখনােই ভাবতে পারেনি। এতে করে সীমিতভাবে হলেও বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাধ চলাচল বিঘ্নিত হয়, | যা প্রকারান্তরে বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা অনুধাবনে তাদেরকে বাধ্য করে। | এই পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর ধ্বংসাত্মক গেরিলা সাফল্যে খুবই আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের এতােদিনের শংকিত মানুষেরা। এমনকি রাজনৈতিক মহলের আশান্বিত অংশ সাময়িকভাবে অর্জিত মুক্তিযােদ্ধাদের এই সাফল্যকে চূড়ান্ত বিজয়ের ফলক হিসেবে বিবেচনা করে। এই সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিশেষ করে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলােতে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য নিয়ে কিছু কিছু অতিরঞ্জিত খবরও প্রকাশ হতে থাকে। প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কিত মূল তথ্যের এই বাড়তি প্রকাশনা কিংবা সম্প্রচারের একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে আশাহত জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উৎসাহিত করা এবং একই সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে আরও সাফল্যের প্রশ্নে নতুন উদ্যম সৃষ্টি করা। এর বিপরীতে পাকিস্তানীদের মনােভঙ্গের একটি সুক্ষু উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহিত থাকতে পারে। | যে কোনাে যুদ্ধেই সমর্থক গােষ্ঠীর মধ্যে স্বপক্ষে অতিরঞ্জনের একটি স্বভাবজাত প্রচলন গড়ে ওঠে খুব বােধগম্য কারণেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেলায়ও অনেক ক্ষেত্রে তাই হয়েছিলাে এবং এই অতি আশাবাদের প্রভাবে এক পর্যায়ে ভারতীয় নীতি নির্ধারকরাও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তারা এমনও ভাবতে শুরু করে যে, ভারতীয় প্রশিক্ষণ এবং সমর সাহায্য নিয়ে মুক্তিবাহিনী তার একক প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ পুরােপুরি শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা ছিলাে অনেকটাই অন্য রকম।

বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছিলাে বটে, তবে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে এমনকি ভারসাম্য সৃষ্টিতেও এই সাময়িক সাফল্য তেমন কোনাে স্থায়ী কার্যকারিতা সৃষ্টি করতে পারেনি তখনাে। এটা সম্ভবও ছিলাে না যৌক্তিক কারণেই। মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণে গড়ে ওঠা একটি নবজাত বাহিনী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে যাচ্ছে-ওই সময় এমন কিছু আশা করা একেবারেই বাস্তবসম্মত ছিলাে না। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবতা ছিলাে মুক্তিবাহিনী তার সামগ্রিক শক্তি নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাে, তা ছিলাে বহুলাংশেই একটি অসম যুদ্ধ। এ ধরনের একটি অসম যুদ্ধে এতাে অল্প সময়ে ভারসাম্যসূচক সামরিক বিজয় অর্জন কোনাে ক্রমেই সম্ভব ছিলো না। শুধু মনােবল আর বীরত্ব দিয়ে একটি জাতীয় যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একটি দক্ষ বাহিনীকে মােকাবেলা করার জন্যে উন্নত মনােবল আর বীরত্বের পাশাপাশি দরকার। প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ এবং উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র। অস্ত্রশস্ত্রে মুক্তিবাহিনী আর শক্র বাহিনীর মধ্যেকার ভারসাম্যহীনতার ব্যাপকতা ছিলাে এতােই বিশাল যে নির্ণয়কারী কোনাে সূত্রের মাধ্যমে এ ব্যাপারে একটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব ছিলাে না। উদাহরণস্বরূপ এখানে বালাদেশ রণাঙ্গনের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যায় ? 

পাকবাহিনী

১৮৩৭ ৯১২০৬ ৪৩ (২)

মুক্তিবাহিনী

২৫০ ১৪৬৩০১ (১)

সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার সৈনিক নিয়মিত ব্যাটালিয়ন গােলন্দাজ রেজিমেন্ট (আর্টিলারী) গােলন্দাজ ব্যাটারী। ভারী মর্টার ব্যাটারী (১২০ মিমি) ট্যাংক রেজিমেন্ট স্বতন্ত্র ট্যাংক স্কোয়াড্রন মােট ট্যাংকের সংখ্যা। মােট কামানের সংখ্যা ভারী মর্টারসহ জঙ্গী বিমান অতিরিক্ত বাহিনী

& w ৩ ৫ ০ ৪

১৯৮

৫০০০০ (৪)

১) এর মধ্যে নিয়মিত পদাতিক সৈনিকের সংখ্যা ৩০০০, অন্যান্য নিয়মিত ২০০০, ইপিআর

সৈনিক ১৫০০০। বাদবাকি বেসামরিক গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা।

২টি কমাণ্ডে ও ৩টি ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নসহ। ৩) ৬টি ১০৫ মিমি ও ৬টি ৩.৭ ইঞ্চি হাল্কা কামান দিয়ে দুটি ব্যাটারী সৃষ্টি করা হয়। এ দুটি

ব্যাটারী মুজিব ব্যাটারী নামে পরিচিত। ৪) রাজাকার বাহিনী।

ছেছল্লিশ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন যখন সশস্ত্র হয়ে ওঠে, সে সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদেরকে যুদ্ধের জন্যে শুধুমাত্র রাইফেল ও সাব মেশিনগান দেয়া হতাে। পরবর্তীতে পরিবর্তীত অগ্রগামী অবস্থায় তাদেরকে তুলনায়। অধিকতর উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীকে হালকা মেশিনগান, ব্যাপক বিধ্বংসী মাইন ও বিভিন্ন ক্যালিবারের মর্টার দেয়া হয়। এই বধীত অস্ত্রশস্ত্রের সুবাদে মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমান্বয়ে তাদের সাফল্যকে আরও অগ্রগামী করে তােলে। এ সময় বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যে সব খবরাদি আসছিলাে তাতে স্পষ্টতঃই বােঝা যাচ্ছিলাে যে, যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য দ্রুততর করার লক্ষ্যে তাদের জন্যে পরিমাণে আরও বেশী এবং তুলনায় ভারী। অস্ত্রশস্ত্র প্রয়ােজন। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীতে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্দের যে নিয়মিত বাহিনী যুক্ত ছিলাে, এক পর্যায়ে তারা আলাদাভাবে দলবদ্ধ হলাে প্রয়ােজনে ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্যে। এই প্রক্রিয়াটি ছিলাে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ যখন আশাতীত সাফল্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাব্য বিজয়ের দিকে সেই সময় বাড়তি সুবিধা নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনাও তীব্রতর হয়ে ওঠে। এর ফলে চুড়ান্ত যুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টি এবং সেই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক রকম নিশ্চিত হয়েই উঠেছিলাে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর নেতারা এটা বুঝতে পারছিলেন যে দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর সরকারী পর্যায়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হবে।

কেননা একটি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনী গঠনের বাস্তবতা অনস্বীকার্য। কার্যতঃ এ সময় থেকেই অনিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অভ্যন্তরে ভবিষ্যত স্বাধীন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে যােগ দেয়ার মতাে একটি সৈনিক মনােবৃত্তি তৈরী হতে থাকে অনেকের মধ্যেই। পরবর্তীতে হয়েছেও তাই। স্বাধীন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে অনেক নতুন মুখের অভ্যুদয় ঘটেছে—গত নয় মাসের যুদ্ধ এবং যুদ্ধপূর্ব প্রশিক্ষণই যাদের যােগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা। কাজেই এটা বলা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অংকুর সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় যুদ্ধের নয় মাসে। একাত্তরে মুক্তিবাহিনী শুধুমাত্র পদাতিক সৈনিকদের দিয়েই গঠিত হয়নি। এই বাহিনীতে পাকিস্তান নৌ ও বিমান বাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালী অংশও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাে। ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলাে তারা প্রথম থেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়। কিন্তু পাকিস্তানে যারা আটকা পড়ে যায় তাদের মধ্যে কেবল চেতনাদিপ্ত কয়েকজনই যুদ্ধ শুরু হবার পর বিভিন্ন গুপ্ত পথে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে আসে এবং যুদ্ধে অংশ নেয়। এই পর্বের একটি খুব উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে ওই সময় পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান নৌবাহিনীর আট জন উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাবমেরিনারের মুক্তিযুদ্ধে যােগদান। এই সাবমেরিনাররা সুদূর ট্রাম্পের তুলন নৌঘাটি থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়। এরপর পশ্চিম বাংলার পলাশীতে সর্বোচ্চ তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে গঠন করা হয় নেভাল কমাণ্ডো বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যদের সংক্ষেপে বলা হতাে নৌ কমাণ্ডো। নিয়মিত অনিয়মিত গেরিলা—সব মিলিয়ে সংগঠিত মুক্তিবাহিনীতে এই নৌ কমাণ্ডো বাহিনী নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযােগ্য সংযােজন। |

আগস্টের ঠিক মধ্যভাগ থেকে নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জলভাগে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ কমাণ্ডোরা লিমপেট মাইন নিয়ে তাদের আক্রমণাত্মক অভিযানের সূচনা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অভিযান সফল হয় এবং বন্দরগুলােতে নােঙ্গর করা অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ হয় ডুবে যায়, নয়তাে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে এই বিধ্বস্ত জাহাজগুলাে মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়ে আর কাজে লাগানাে যায়নি। | মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমাণ্ডো বাহিনী আগস্টের মধ্যভাগ থেকে স্থল মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় যে অভিযান শুরু করে তা অব্যাহত থাকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিন পর্যন্ত। সার্বিক মুক্তিযুদ্ধে নেী কমাণ্ডা অভিযানের যে তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া গেলাে তা হচ্ছে, এই অভিযান শুরু হবার পর বাংলাদেশের জলপথে পাকিস্তানী সৈনিকদের অবাধ চলাচল আর নিরুদ্বিগ্ন থাকলাে না। নদী ও সমুদ্র বন্দরগুলােতে এরপর থেকে জাহাজ চলাচল এমনকি নােঙ্গর করে রাখা জাহাজের সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীদেরকে বঙ্গোপসাগরের বহির্নোঙ্গর পর্যন্ত জাহাজ সরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু সেখানেও নৌ কমাণ্ডোরা অভিযান চালায়। সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক ভিত্তি ছিলাে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ হাজার নিয়মিত ও ১ হাজার বিভিন্ন পেশার মিশ্রিত সেনা। এর সাথে ছিলাে আনুমানিক ১৫ হাজার ইপিআর সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রাথমিক ভিত্তির সাথে যুক্ত হয় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য স্তর থেকে আগত বেসামরিক তরুণ-যুবকদের ব্যাপক অংশ। মুক্তিবাহিনীর অনিয়মিত অংশে এক সময় এই সংখ্যা উন্নীত হয় আনুমানিক সােয়া লাখে। এর সাথে নিয়মিত বাহিনী যুক্ত হয়ে সামগ্রিক মুক্তিবাহিনীতে মােট মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা দাড়ায় প্রায় দেড় লাখ। এতাে অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত এমন একটি বিশাল যােদ্ধা বাহিনীর সংগঠন বিশ্বের ইতিহাসে অবশ্যই একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী যখন একটি বিশাল বাহিনী হিসেবে সংগঠিত এবং সে কারণে  জাতীয় মুক্তিযুদ্ধও সমানভাবে বেগবান ঠিক সেই সময় মুক্তিযুদ্ধে একটি নেতিবাচক বিকল্প | বাহিনী সৃষ্টির আলামত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময় বিশেষতঃ মুক্তিবাহিনীর অনিয়মিত অংশ থেকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু কিছু বাছাই করা মেধাবী তরুণ-যুবার আকস্মিক অন্তর্ধান ঘটতে থাকে। দুলছুট এই তরুণ যুবাদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে যােগদানেচ্ছুদের সংখ্যাও ছিলাে প্রচুর। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী এই প্রক্রিয়াটি হঠাৎ করে শুরু হলেও এর ভিত যে অনেক গভীরে প্রােথিত তা অচিরেই বােঝা গেলাে। জানা গেলাে একটি বিশেষ নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে এই দলছুট তরুণ-যুবকেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া শুরু হবার অল্প কিছু দিনের ব্যবধানেই নতুন সৃষ্ট এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের অজ্ঞাত নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। এমনকি সেক্টর কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানতে দেয়া হলাে না। এই পর্যায়ে খুব যৌক্তিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্তর থেকে জোরালাে প্রতিবাদ উঠলাে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই বিশেষ মহল তাদের এই বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়া পূর্বাপর অব্যাহত রাখলাে। ফলে যা হবার হলােও তাই। মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত মুক্তিসেনাদের মধ্যে শুরু হলাে দুঃখজনক ভুল বুঝাবুঝির। অনাকাক্ষিতভাবে দেখা দিলাে মতপার্থক্য এবং এই প্রথমবারের মতাে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ধ্বনিত হলাে অনৈক্যের সুর। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া ছিলাে আসলেই একটি হতবাক করে দেয়ার মতােই ঘটনা। | ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে সে দেশের সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেনারেল ওবান ‘মুজিব বাহিনী নাম দিয়ে মুক্তিবাহিনীর মধ্য থেকে এই বিশেষ বাহিনী গঠনে তৎপর হন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের আগে ভারতের দেরাদুনে ও উত্তর প্রদেশের শহরামপুরে এই বাহিনীকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

প্রশিক্ষণউত্তর মুজিব বাহিনীকে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হলেও বাংলাদেশের বিশাল রণাঙ্গনে এদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হবার পুরাে অধ্যায়টিই ছিলাে বহুল বিতর্কিত। সব মিলিয়ে এটা মনে হয়েছে যে, সামরিক নয় মূলতঃ স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিপক্ষ শক্তিকে ঘায়েল করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই বাহিনীর জন্ম দেয়া হয়েছিলাে মুক্তিবাহিনীর ঔরসে। আবার এই মুজিব বাহিনীর আপাতঃ দুর্বোধ্য তৎপরতার ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে সুস্পষ্ট করে বিশদ কিছু জানতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই বাহিনী কোনাে সেক্টর প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট আওতায় কিংবা অধীনে থাকেনি। ফলে মুজিব বাহিনীর এই হঠাৎ জন্ম একটি বড় আকারের প্রশ্নবােধক চিহ্ন হয়েই বিরাজমান থাকে মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়ে-যে প্রশ্নের সুস্পষ্ট সুরাহা স্বাধীনতার দুই দশক পর আজও আনুপার্বিক মেলেনি এ জাতির কাছে। প্রক্রিয়া ও জন্ম রহস্যে ভিন্নতা থাকলেও বিচ্ছিন্ন মুজিব বাহিনীর মতাে আরও কয়েকটি  স্ব বাহিনীর সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। স্থানীয় পর্যায়ে এই বাহিনীগুলাে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের অভান্তরেই। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ সব বাহিনীও কোনাে সেক্টরের কমাণ্ড অনুসরণ না করেই অথবা কোনাে সেক্টরের প্রশাসনিক গণ্ডির আওতায় না থেকেই নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত। টাঙ্গাইলে এ ধরনের একটি বাহিনী গড়ে ওঠে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে। হেমায়েত বাহিনী নামে অনুরূপ একটি বাহিনী সৃষ্টি হয় ফরিদপুর অঞ্চলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা বাতেন বাহিনী এবং আফসার বাহিনীর নামও শােনা গেছে। | টাঙ্গাইল এলাকায় কাদের সিদ্দিকী একটি বড় আয়তনের বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও যুদ্ধজয়ের কোনাে বিশাল সাফল্যের কথা তাদের শােনা যায়নি। অবশ্য এই এলাকায় যুদ্ধের ন মাস নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে কাদের বাহিনীর কৃতিত্বের কথা স্বীকার করে উপায় নেই। তবে সেখানে বিভিন্ন সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার দাবি যারা করেন তাদের সেই দাবি কতােখানি বাস্তবসিদ্ধ তা ঐতিহাসিকভাবেই লিপিধ্বদ্ধ হওয়া উচিত। কেননা, বৃহত্তর টাঙ্গাইল এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর সৈন্য মােতায়েনের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা সেখানে তাদের বড় আকারের কোনাে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে না।

একই কারণে পাকিস্তান বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্রে কাদের বাহিনী টাঙ্গাইলে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, এমন ধারণাও প্রশ্নাতীত নয়। আসলে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই বাহিনীগুলাের তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিলাে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই, যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা তার সাফল্যের মধ্যে নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অনেকটা নামডাক সর্বস্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই বাহিনীগুলাের ইতিহাস বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় অভিন্ন। | মুক্তিযুদ্ধের স্বল্প পরিসর প্রক্রিয়ায় এ সব এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বাহিনীর অধিকাংশের গড়ে ওঠার নেপথ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য সহায়তা ছিলাে অকৃত্রিম। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের রহস্যময় আনুকূল্যে এই বাহিনীগুলাের অধিকাংশই যার যার এলাকায় তাদের। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল মেরুতে বিকল্প মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ঘটনা আকস্মিক হলেও এর ভিত যেমন প্রােথিত ছিলাে নেপথ্যচারী রাজনীতির গভীরে তেমনি এর লক্ষ্যও ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের সীমানা ছাড়িয়েও বহুদূরপ্রসারী। নাম শুনে এই বাহিনীর চরিত্রে সামরিক লেবাসের আভাস পাওয়া গেলেও এবং এর মৌলিক কাজকর্মের সীমানা মাঠ পর্যায়ে রণাঙ্গন হলেও এই বাহিনীর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিলাে প্রধানতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির মধ্যেই। আরও বিস্ময়কর যে এই ঝহিনীটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী আপামর জনগােষ্ঠীর মুক্তির চৈতন্য থেকে জন্ম নেয়নি, যেমনটি নিয়েছিলাে মুক্তিবাহিনী। যে কারণে শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেশ স্বাধীন করাও এর দায়দায়িত্বের মধ্যে পড়েনি। এই বাহিনীটি বস্তুতঃ সৃষ্টি হয়েছিলাে ভারতীয় রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় সে দেশের গােয়েন্দা ও সামরিক চক্র এবং বাংলাদেশের কট্টর ডানপন্থী যুব নেতাদের সম্মিলিত শলাপরামর্শ থেকেই । মুজিবের নামে একান্ত মুজিব অনুসারীদের নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হলেও শেখ মুজিব তাে নয়ই, এমনকি মুজিবের অস্থায়ী সরকার পর্যন্ত মুজিব বাহিনী গঠনের আলামত টের পায়নি।

২১ মে ২ ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাড়াশি আক্রমণের চাপে পড়ে পশ্চাদপসরণ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের সর্বশেষ অবস্থান। তেলিয়াপাড়া-মাধবপুর এলাকা থেকে বিতাড়নের পর তারা ভারতের অভ্যন্তরে নিজেদের মধ্যে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে। এরপর অল্প ক’দিনের ব্যবধানে এই পুনর্গঠিত ২ ইস্ট বেঙ্গল নতুন উদ্যমে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হয় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। তাদের এই নতুন উদ্যমের সাথে এবার যে বাড়তি সুবিধা যােগ হলাে তা হচ্ছে অপেক্ষাকৃত একটি নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা। এ ছাড়া ব্যাপকহারে রসদ সরবরাহের সুবিধাটিও এর সাথে যােগ হলাে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ দুটি ব্যাপারেই তারা নিশ্চয়তার আশ্বাস ইতিমধ্যেই পেয়েছে। ওদিকে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিতাড়িত করার পর পাকিস্তানীরা তাদের দখলিকৃত এলাকার উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দুটি পদাতিক ও একটি মিলিশিয়া-রেঞ্জার্স মিলিত ইউনিট এবং এদের সমর্থনে প্রয়ােজনীয় গােলন্দাজ রেখে প্রতিরােধ যুদ্ধের সমর্থকদের খোঁজে চারদিকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। আখাউড়া থেকে উত্তরে ইটাখােলা পর্যন্ত একটি এবং আরও উত্তরে অপর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সমাবেশ এ সময় ঘটানাে হয়। উপরন্তু অনিয়মিত বাহিনীর মিশ্রিত ব্যাটালিয়নটিকে ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত করে মােতায়েন করা হয়। একেবারে অগ্রবর্তী এলাকাসমূহে। মনতলা ও শাহবাজপুরে গােলন্দাজ বাহিনীর কামান এবং ভারী মর্টারের অবস্থান এবং সেগুলাের সুকৌশলী ব্যবহারিক সুবিধা এলাকার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন করে তােলে পাকিস্তানীদের। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একাংশের নতুন আবাসস্থল কলকলিয়ার শিবিরে আমার জন্যে একটি বিশালায়তন নিষ্ফলা আম গাছের নিচে তাবু ফেলা হয়েছে। এই তাঁবুতেই আমার বসবাস। তাঁবুর ভেতরে বাঁশের ফালি করা চটি দিয়ে একটি চৌকির মতাে তৈরী করা হয়েছে। এই চৌকির ওপর একটি কম্বল লম্বা করে বিছানাে। অপর কম্বলটি কয়েক ভাঁজ করে বালিশ বানিয়ে রাখা হয়েছে মাথার দিকে। মােটামুটি এটিই হচ্ছে আমার ঘুমােবার ব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থা সম্পন্ন করার যাবতীয় কাজই করেছে আমার সদ্য নিয়ােজিত ব্যাটম্যান আমিন। দীর্ঘদেহী কোম্পানী সুবেদার আব্দুল মান্নান এই আমিনকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দিয়ে আমার ব্যাটম্যান হিসেবে মনােনীত করেছে। প্রথম সাক্ষাতের সময় এক দঙ্গল ঝাকড়া চুল মাথায় আমিন সটান সামরিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলাে। সাপ্লাই কোরের সৈনিক আমিনের বাড়ি নােয়াখালি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে জড়িয়ে আছে। পরিচয়ের এক পর্যায়ে বাড়ির খবর জানতে চাইলে আমিন প্রথমতঃ নিপ নির্বিকার একদিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে মাথা নাড়িয়ে যা বললাে তার অর্থ হচ্ছে, বাড়ির কোনাে খবর তার কাছে নেই অনেকদিন। খবর নেয়ার কোনাে চেষ্টাও সে করেনি। সেদিন বিকেলে কলকলিয়ার শিবিরে অপর একটি ঘটনা আমাকে বিস্মিত করলাে। এই বিস্ময় আমার জন্যে আনন্দেরও। ডাইরির পাতায় দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষ দিনকার ঘটনাগুলাে লিখছিলাম। হঠাৎ নজর পড়লাে আমার দিকে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসছে দুজন সৈনিক। অরা কাছে এসে আমাকে স্যালুট করে দাঁড়ালাে। প্রথম দেখাতে তাদেরকে আমি সনাক্ত  করতে পারলাম না। দু’চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আগন্তুক দু’জনের মধ্যে একজন। কথা বললাে, স্যার আমার নাম নূরুল ইসলাম—২৯ ক্যাভেলরীতে আপনার টুপের কামান্দাজ। এরপর সে পাশের অপর জনকে পরিচয় করিয়ে দিলাে, আর এ হচ্ছে আবুল, ট্যাংক ড্রাইভার একই স্কোয়াড্রনের। আমার বিস্ময়ের ঘাের আরও বেড়ে গেলাে। মুহূর্তে সচকিত হয়ে দাড়িয়ে পড়লাম এবং ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কলকলিয়ার গহিন অরণ্যে এই পরিবেশে আমারই ২৯ ক্যাভেলরীর সৈনিকদের সাথে আবার মিলিত হবাে কখনাে কল্পনা করিনি। নূরুল ইসলাম আর আবুলের চোখ একই আবেগে অশ্রু প্লবিত হলাে। একই বিস্ময় নিয়ে ওরাও আমাকে দেখছিলাে। স্যার, আপনি এখনাে বেঁচে আছেন? আমরা তাে শুনেছি রংপুরে আপনাদের। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। নূরুল ইসলাম ও আবুল—এরা দুজনই বার্ষিক ছুটিতে গ্রামের বাড়ি এসেছিলাে। এ সময়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানের চাকরিতে আর ফিরে না গিয়ে ওরা দেশের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দেয়। প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনা লগ্নে ২ ইস্ট বেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলে এই দুই সৈনিক তাদের সাথে যােগ দিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নেমে যায়। তারপর বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ শেষে সীমান্ত পার হয়ে আসে এই আরণ্যিক কলকলিয়াতে। কলকলিয়ার শিবিরে নূরুল ইসলাম এবং আবুলের সাক্ষাত পাবার ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক শিহরণের ভালাে লাগার একটি বাড়তি মাত্রা হিসেবে যােগ হলাে আমার জন্যে। মােরশেদের কাছে ‘ডি’ কোম্পানীর কর্মকাণ্ড বুঝে নিতে কয়েকদিন চলে গেলাে। এর মধ্যে একদিন সে আমাকে বামুটিয়া সংলগ্ন লতিফপুরে নিয়ে গেলাে তার নিয়ন্ত্রণে তখনাে ধরে রাখা এক চিলতে বাংলাদেশ দেখাতে। এটুকু বাংলাদেশ তখনাে স্বাধীন। মাত্র কয়েক শ’ গজ আয়তনের এই এক ফালি স্বাধীন বাংলাদেশ মােরশেদের নেতৃত্বের অধীন একটি প্লাটুন সযত্নে আগলে রেখেছে। এরই মধ্যে নিকটবর্তী ভারতীয় বিএসএফ শিবিরেও যাওয়া হয়েছে দু’ একবার। সে ওই মােরশেদের সাথেই। নিছক পরিচিত হবার কারণেই সেখানে যাওয়া। প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই লক্ষ্য করেছি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে মােরশেদের নিষ্ঠার তুলনা নেই। অর্পিত দায়িত্বের সবটাই সে পালন করছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।

কর্তব্য পালনের কোথাও কোনাে শৈথিল্য নেই। প্রতিরাতেই সে দলবল নিয়ে টহলে বেরুচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং চলমান মুক্তিযুদ্ধের আতংক ছড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানী হানাদারদের মধ্যে। তার এই তৎপরতার সাথে হলে সে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে আমাকে। | সেদিন সকালে হঠাৎ করেই খুব ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম শিবিরের সর্বত্র। গত কয়েক দিনের স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে এ ধরনের তৎপরতা অবশ্যই ব্যতিক্রম। মােরশেদকেও দেখলাম একটু যেনাে বেশী তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যে আমি সবকিছু বুঝে উঠবার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় আমার ডাক পড়লাে। আমি যেনাে এই ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলাম। দ্রুত এগিয়ে গেলাম কি ঘটতে যাচ্ছে জানার জন্যে। শুনলাম শিবিরে খবর এসেছে হরষপুর রেলস্টেশনের অল্প দক্ষিণে একটি বিরত রেলসেতু মেরামত করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। হরষপুরের ওই এলাকাটি ‘ডি’ কোম্পানার আওতাভুক্ত থাকার কারণে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব মােরশেদে ওপরই বর্তায়। মােরশেদ পুরাে ব্যাপারটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাে এই  অপারেশনের নেতৃত্ব গ্রহণে আমি আগ্রহী কি না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এমনই একটি সুযােগের জন্যে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছি সে কতােদিন থেকে। রংপুর সেনানিবাস ছেড়ে যেদিন বাইরের মাটিতে পা রাখার সুযােগ পেয়েছিলাম কার্যতঃ সেদিন থেকেই আমার এ অপেক্ষার শুরু তারপর লম্বা এক যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে মানুষের মুখে নিছক রূপকথার মতােই শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের কথা। কিন্তু এতােদিনেও নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করতে পারিনি সেই যুদ্ধের সাথে। জিজ্ঞাসু মােরশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে এবং মুহুৰ্তমাত্র বিলম্ব করে আমি আমার সম্মতির কথা তাকে জানিয়ে দিলাম। টের পেলাম এই প্রথম শরীরের রক্তের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শিহরণ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। শরীরের প্রতিটি জীবকোষ যেনাে মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে উঠলাে। মুক্তিযুদ্ধে এ আমার প্রথম অভিযান।  অভিজ্ঞ কমাণ্ডার মােরশেদের পরামর্শ মতােই একটি প্লাটুন আকারের সেনাদল সাথে ভারী। মেশিনগান এবং ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। দলে বাড়তি সুবিধা হিসেবে পাওয়া গেলাে সুবেদার মান্নানকে। যেহেতু এই অপারেশনটি আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সামরিক মিশন সে কারণে যুদ্ধে অভিজ্ঞ সুবেদার মান্নান স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়েই আমার সফরসঙ্গী হলাে। আমিও কিছুটা আশ্বস্ত হলাম মান্নানের মতাে সাহসী যােদ্ধাকে দলে পেয়ে।

অকুস্থল সম্পর্কে পুরােপুরি ওয়াকেবহাল এমন একজন গাইডও সাথে নেয়া হলাে সংক্ষিপ্ত সময় এবং সীমিত আকারে প্রস্তুতি মােটামুটি এভাবেই শেষ হলাে। তারপর যাত্রা শুরু গন্তব্যের দিকে।  মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনের জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব বুকে নিয়ে পা বাড়ালাম। গাইড সাথেই ছিলাে। তার পথ নির্দেশনায় গন্তব্যে পৌছুতে ঘণ্টা খানেকের বেশী সময় লাগলাে না। একটি ছােট পাহাড়ী টিলা অতিক্রম করতেই চোখে পড়লাে শত্রুদের। দেখলাম ধ্বংসপ্রায় রেলসেতুটির ওপর ইতস্ততঃ দাড়িয়ে আছে কয়েকজন সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈনিক সাথে আরও কিছু লােক। সম্ভবতঃ ওরা রেলকর্মী। বিধ্বস্ত সেতুর মেরামত কাজে ব্যস্ত সবাই। নিমিষে রক্তে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠলাে। উত্তেজনা আর শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাে শরীর। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিজেকে সংযত করলাম। মনে হলাে যেনাে আপন চৈতন্যের মধ্যে এবার অসম সাহস নিয়ে জেগে উঠছি আমি। | আমাদের অবস্থান থেকে সেতুর দূরত্ব তখনাে অন্ততঃ এক হাজার গজ। চারদিকে তাকিয়ে এলাকাটি ভালাে করে একবার দেখে নিলাম। তারপর সন্তর্পণে হাটু ভাঁজ করে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম আরও পাঁচ শ গজ। এখানে জায়গাটা বেশ জঙ্গলাকীর্ণ। শত্রু – ঘায়েলের জন্যে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক। তারপরই সমতল জলাভূমির শেষ প্রান্তে। রেলসেতু। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে অবস্থান নিয়ে ফেললাম। ভাবলেশহীন নির্বিকার সুবেদার। মান্নান আমার একান্ত পাশেই তার স্থান ঠিক করে অবস্থান নিলাে। লক্ষ্য করলাম সে খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সেতুর ওপর বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়ানাে শত্রুদের পর্যবেক্ষণ করছে। তারপরই সে আমার দিকে ঘুরে তাকালাে এবং আমার নির্দেশ কি জানতে চাইলো। সুবেদার মান্নানের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম আমার ভেতর নেতৃত্বের এক অপরিমেয় অনুভূতি জেগে উঠলাে। এতােদিন নেতৃত্বের যে অহমিকা লালন করেছি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মেকি আবরণের মধ্যে আজ তা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হলাে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে। চাইনিজ ভারী মেশিনগানটি যেনাে নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলাে। চোখের ইশারা পাবার সাথে সাথে তা গগন বিদারী শব্দ করে গর্জে উঠলাে এবং অঝােরে গুলি বৃষ্টির ধারা বর্ষিত হতে। 

লাগলাে নিদিষ্ট লক্ষ্যে। একই সাথে সেতুর দিক থেকে শােনা গেলাে সম্মিলিত আর্তচিৎকার। কয়েক মুহুর্তের জন্যে প্রকম্পিত হতে থাকলাে চারপাশের নিঃসর্গ। অপারেশনের এক পর্ব। শেষ হলাে কোনােরূপ গুলি বিনিময় ছাড়াই, প্রায় একতরফা। তাৎক্ষণিকভাবে এতে কোনাে হতাহতের সংখ্যা পাওয়া গেলাে না। | এরপর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। কোনাে শব্দ নেই কোথাও। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই শুরু হলাে ঘটনার দ্বিতীয় পর্ব। এবার হামলা আসলাে উল্টো দিক থেকে। মুহুর্মুহু কামানের গােলা এসে পড়তে লাগলাে আমাদের অবস্থানের কাছাকাছি জায়গায়। ১০৫ মিলিমিটারে ব্যাসের এই কামানের গােলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলাে পাকিস্তানীদের মনতলার অবস্থান থেকে। প্রচণ্ড শব্দে সেই গােলা বিস্ফোরিত হলাে চারদিক কম্পিত করে। যার যার অস্ত্র হাতে আমরা চুপচাপ পড়ে রইলাম মাটিতে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই দূরবর্তী সেই গােলা ক্রমেই কাছাকাছি হয়ে আসতে লাগলাে। এরপর বিপত্তি চরম আকার নিলাে। এবার পাকিস্তানীদের নিক্ষিপ্ত গােলা সরাসরি এসে আঘাত করতে লাগলাে আমাদের অবস্থানের ওপর। এ অবস্থায় মৃত্যু একটি মুহূর্তের ঘটনা মাত্র। যুদ্ধের প্রথম অভিজ্ঞতা। আতংকে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হলাে যেনাে প্রতিটি গােলার বিস্ফোরণের সাথে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠছে পৃথিবী। সংকুচিত হয়ে এলাে ভেতরটা। একটা অজানা ভয়ে ক্রমেই চুপসে যাচ্ছিলাম নিজের ভেতর। মনের ঠিক এই অবস্থায় হঠাৎ অনভিজ্ঞ সিদ্ধান্তটি নিতে গিয়েই অঘটন ঘটিয়ে বসলাম। গােলা বৃষ্টির মধ্যেই কি ভেবে আমি সহসা লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালাম। আজ এতােদিন পরে স্মৃতি হাতড়িয়ে ঠিক মনে করতে পারছি না সেদিন কি ভেবে এই আহস্পকী কাজটি আমি করতে পেরেছিলাম। যতােদূর আন্দাজ করতে পারি জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত সেই সন্ধিক্ষণে আমি একটি নিরাপদ। দূরত্বের আকাক্ষাতেই অমন কাজটি করতে পেরেছিলাম। আসলে জীবনের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বেশুমার গােলার মধ্যে আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু আমাকে কোনাে দিকেই ছুটতে হলাে না। পাশে অবস্থানরত সুবেদার মান্নান এক ঝটকায় আমার হাত চেপে ধরলাে। তার শীতল হাতের শক্ত টানে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমার আগের অবস্থানেই। মাটিতে নুয়ে থাকা অবস্থাতেই তারপর সে অত্যন্ত বিরক্তি ভরে তাকালাে আমার দিকে। ধমকের সুরে বললাে, কি বােকামিটাই না করতে যাচ্ছিলেন। আরেকটু হলেই নির্ঘাত মারা পড়তেন। চুপ করে মাটিতে পড়ে থাকুন, কিছু হবে না। অভিভাবকের কণ্ঠস্বর সুবেদার মান্নানের। এর বিপরীতে এই অপারেশনের কমাণ্ডার আমি লজ্জা আর ধিক্কারে যেনাে বিন্দুর মতােই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলাম নিজের ভেতরে পরবর্তীতে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধের ভয়ংকর দিনগুলােতে বৃষ্টির মতাে গােলাগুলির মধ্যদিয়ে লাগাতার অভিযানে এগিয়ে যেতে যেতে বহুদিন আমার মনে পড়েছে সেই প্রথম যুদ্ধের অপরিণামদর্শী লজ্জার কথা। অপারেশন শেষে শিবিরে ফিরে আসার সময়ও আমি আমার অন্তর্গত বিমর্ষতা ক\েড়য়ে উঠতে পারলাম না। অপার অনুশােচনা বুকের মধ্যে নিয়ত দংশন করেই যাচ্ছিলাে। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার এই তাৎক্ষণিক মতিভ্রমের দুর্বোধ্যতা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারছিলাম না। তেতম ভেতরে আমার সমূহ অনুভূতি তখনো চরম বােঝাপড়ার মুখােমুখি। বারবার নিজেকে এম করছি, এটা কেনাে হলাে, কেমন করে হলাে? সেকি মৃত্যুভয়? কিন্তু মৃত্যুর ভয়তাে আম মধ্যে থাকবার কথা নয়। ২৫ মার্চের পর রংপুর সেনানিবাসের নির্জন কক্ষে প্রতি মুহুর্তেই তাে। আমি অত্যন্ত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি। সেই বন্দী জীবনে মৃত্যু ছিলাে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কতাে রাত জেগে জেগে পাকিস্তানীদের বুলেটে বিদ্ধ বাঙালীদের মৃত্যু চিৎকার শুনেছি কাছ থেকে। সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে একদিন আবসার আর হাসেমের মৃত্যু সংবাদও শুনলাম। এ খবর শােনার পর থেকে তাে আমি নিজেও মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কেবল অপেক্ষা করছিলাম এক বিকেলের পােস্টিং নামক প্রতারণার আড়ালে মহাপ্রস্থানের ডাকের জন্যে বন্দী জীবনে একাকী নির্জন কক্ষে কতােদিন আনমনে শেষ মুহূর্তের দৃশ্যগুলাে এঁকেছি কল্পনায় দেখেছি, একটি চলমান জীপ হঠাৎ পথিমধ্যে কার অদৃশ্য নির্দেশে থেমে গেলাে। তারপর টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামানাে হলাে আমাকে। দু’হাত শক্ত করে বাঁধা হলাে পেছনে। রাস্তার কোনাে ঢালে আমাকে দাঁড় করিয়ে বুকতাক রাইফেলগুলাে তৈরি হলাে।

কী নির্বিকার দৃষ্টিতে অসহায় আমি তাকিয়ে আছি ঘাতকদের দিকে। সহসা বিকট গর্জন। সমস্ত শরীর ছেদিয়ে আমার কোথায় কি যেনাে ঘটে গেলাে। আমি ঢলে পড়লাম রাস্তার ঢালে। হয়তাে গড়িয়ে গেলাম আরও নিচে কোনাে জলাভূমিতে। তারপর! তারপর চোখের সামনে নিরেট অন্ধকারে তলিয়ে গেলাে সমস্ত পৃথিবী। আবার সেই আমি হরষপুরের একটি ছােট্ট যুদ্ধে মৃত্যুভয়ে পালাতে চাইলাম কেমন করে? নিজেকে ভারি অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগলাে নিজের কাছেই দেখতে দেখতে কেটে গেলাে আরও কয়েক সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে কলকলিয়ার অনেক জায়গাই আমার জানা হয়ে গেছে। কোলাহলহীন এই জনপদের প্রায় সর্বত্র আমাকে বিভিন্ন কাজে ছুটোছুটি করতে হয়েছে এই কয়েক সপ্তাহে। বাদল বাবুর চা বাগান আর নির্জন অরণ্যের সাথে কি এক সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার এ ক’দিনেই। এই এলাকায় এখন রাত্রের ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আমি শুধুমাত্র আন্দাজের ওপর নির্ভর করে অনায়াসে পথ চলতে পারি। এমবুশ কিংবা প্যাট্রোলিংয়ে বেরুলে সাধারণতঃ এভাবেই আমাকে পথ চলতে হয়। | আমাদের শিবির ছাড়িয়ে কিছুদূর পর্যন্ত কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। এই জংলাভূমি পার হলেই বাদল বাবুর চা বাগান। চারদিকে ছােটো ছােটো অসংখ্য পাহাড়। মাঝখানে চা বাগানের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্ত, সমতল ভূমি। এখানে একটি উঁচু পাহাড়ের ওপর আমাদের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের এক কোণে এক চিলতে শান বাঁধানাে জায়গা। কি কারণে কবে কে এই জাগয়াটুক এমন করে বাঁধিয়ে রেখেছিলাে তা আমার জানা নেই। তবে কখনাে সখনাে অবসরে একান্তে কিছু সময় কাটাবার জন্যে এই ছােট্ট জায়গাটুকু ইতিমধ্যেই আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন যখনই কোথাও অপারেশনে বেরিয়েছি এখানে কিছু সময়ের জন্যে হলেও বিশ্রাম নিতে ভুলিনি। বাংলাদেশের দিকে মুখ করে এখানে বসে দেশের কথা ভাবতে ভারী ভালাে লাগে। “ডি’ কোম্পানীর সৈনিকরা এরই মধ্যে এই বিশেষ জায়গাটির প্রতি আমার দুর্বলতার কথা জেনে ফেলেছে। যে কারণে অনেক দিন লক্ষ্য করেছি এখানে আসা মাত্রই তারা ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দেয়।

সীমান্তের দিকে পাকিস্তানী সৈনিকদের সমাবেশ আরও অগ্রবর্তী হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে। সেই সাথে তীব্রতর হয়েছে তাদের এলােপাতাড়ি গােলাবর্ষণ। কখনাে কখনাে এই নিক্ষিপ্ত গােলা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অনেকটা ভেতরে এসে পড়ে। এরই মধ্যে পাকিস্তানী গুপ্তচররা ভারতের অভ্যন্তরে এই এলাকায় কয়েক দফা নাশকতামূলক হামলা চালিয়ে গেছে এবং তাতে প্রাণহানিও ঘটেছে প্রচুর।  একই সাথে অপর একটি বাড়তি সংযােজন লক্ষ্য করা গেলাে ভারতের এদিকটায়। বিস্তৃত সীমান্ত এলাকা বরাবর ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর চলাচল এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। বড় ধরনের কোনাে সেনা সমাবেশ না ঘটলেও তাদের অব্যাহত তৎপরতা বেশ চোখে পড়ছে। এবং এটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগরতলার শহরতলিতে এক সময় ব্যাপক আকারে অস্থায়ী ভিত্তিতে সেনাশিবিরও গড়ে উঠলাে। স্থান সংকুলান না হবার কারণে অনেক সেনা ইউনিট তাবুতে আশ্রয় নিয়েছে। সেই সাথে সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন সড়ক পথের পর্যাপ্ত সংস্কার কাজেও হাত দেয়া হলাে। ধর্মনগর থেকে আগরতলা গামী একমাত্র সড়ক পথটিও মেরামত করা হয়েছে। এই পথে প্রতিদিন এরপর আগরতলার দিকে অসংখ্য সামরিক যানের চলাচল লক্ষণীয় হয়ে উঠলাে। বস্তুতঃ এ সময়ই প্রথম বারের মতাে আমাদের বিভিন্ন অবস্থান কেন্দ্রগুলােতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের উপস্থিতি দেখতে পেলাম। এ প্রসঙ্গে দুজন অফিসারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এদের মধ্যে একজন ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ এবং অপরজন ১৮ রাজপুত রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল ভর্মা। আমাদের সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এ দু’জন অফিসারের ঘন ঘন যােগাযােগ গােটা বিষয়টিকে অর্থবহ করে তুললাে। এ সবই ঘটছিলাে এমনই একটি সময়ে যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ঠিক এই পটভূমিতে পরিণত মুক্তিযুদ্ধের সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠলাে। এদিকে কলকলিয়ায় আমাদের বিভিন্ন অবস্থান কেন্দ্রগুলােতেও আগের যে কোনাে সময়ের তুলনায় তৎপরতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। ব্যাপক টহলের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত এলাকা বরাবর আমাদের জোরালাে কর্মকাণ্ড নিয়ত তটস্থ করে রাখছে। পাকিস্তানীদের। বাংলাদেশের ভেতরে এমবুশের ঘটনা তখন নিত্যনৈমিত্তিক।

আমাদের ভাণ্ডারে সরবরাহকৃত গােলাবারুদের পরিমাণও আগের তুলনায় পর্যাপ্ত। ফলে প্রতিদিনই পাকিস্তানী অবস্থানগুলাের ওপর মর্টারের প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। পক্ষান্তরে বিপরীত অবস্থান থেকেও পাকিস্তানীরা তার জবাব অব্যাহত রেখেছে তাদের ১০৫ মিলিমিটার কামানের গােলা নিক্ষেপের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের আক্রমণের পাল্লা অপেক্ষাকৃত প্রচণ্ড হবার কারণে সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানীরা অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানেই তাদের এতােদিনের অবাধ চলাচল অনেকটা সংকুচিত করে ফেলেছে। শামুকের মতাে গুটিয়ে গেছে তারা তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানের চৌহদ্দিতে। রাতে তাে নয়ই, এমনাক দিনের আলােতেও তখন তাদেরকে আর আগের মতাে দেখা যায় না যত্রতত্র। এ অবস্থায় কার্যতঃ বাংলাদেশের ভেতরে সীমান্তবর্তী পুরাে এলাকার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই এসে যায় কলকলিয়ায় ‘ডি’ কোম্পানীর শিবিরে এরই মধ্যে মােরশেদের সাথে আমার সম্পর্ক বে” আন্তরিক হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত দায়িত্ব সচেতন এবং কর্মিষ্ঠ লােক সে হাজারাে প্রতিকূলতার মধ্যেও নিয়ত প্রাণবন্ত। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে আর যাই হােক পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে আমাদের সম্পর্ক তখন পরস্পর ভালাে লাগার, অপরিমেয় আস্থার এ শ্রদ্ধাবােধেরও। নানান কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকার কারণে দিনের বেলা মােরশেদের সাথে আমায় আলাপচারিতার তেমন একটা সুযােগ হতাে না। আমাদের দু’জনেরই দিনের পুরাে সময়টাই ব্যয় হতাে প্রশিক্ষণ আর সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের কাজে। আমাদের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সময় হতাে কেবল রাতে, কোনাে মিশনের ফাঁকে বিশ্রামের অবসরে। ঠিক এই রকম কোনাে সময় জীবনের গুঢ় কোনাে রহস্য উদঘাটন নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু কথা হতাে মােরশেদ ও আমার মধ্যে। চারদিকে ওৎ পেতে থাকা নিষ্ঠুর মৃত্যুর ফাঁদ। মধ্যিখানে আমি আর মােরশেদ কখনাে সখনাে হারিয়ে যেতাম কোথায়, অনেক পেছনে ফেলে আসা দূর কোনাে অন্ধকারে। সেই অদৃশ্য অতীত থেকে মাঝেমধ্যে মােরশেদ জীবনের কি সব সুখ-দুঃখের কথা শােনাতাে আমাকে।  সেদিন রাতে টহলে বেরিয়ে হরষপুর রেলস্টেশনে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। মােরশেদ এই অবস্থানটির ওপর একটি ছােটোখাটো আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করছিলাে কিছুদিন থেকে। যদিও পাকিস্তানীদের এই অবস্থানটি কৌশলগত দিক থেকে তেমন গুরুত্ব বহন করে না, তবুও পাকিস্তানীরা হরষপুরে যে একটি বড় ধরনের সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিলাে তা গুড়িয়ে দেয়া প্রয়ােজন।

কেননা কাছাকাছি অবস্থানে শত্রু পক্ষের এমন একটি জোরালাে সমাবেশ আমাদের জন্যে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিলাে।  হরষপুরে আক্রমণ চালানাের প্রশ্নে প্রয়ােজনীয় নিরীক্ষণ শেষ করে শিবিরের পথে ফিরছিলাম। সাথে পথ প্রদর্শক সৈয়দ। সৈয়দের বাড়িও এই হরষপুরে। তখন ? ত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সীমান্তের কাছাকাছি পর্যন্ত এসে বড় একটি দীঘির পারে খানিক বিশ্রামের জন্যে বসলাম। পাশেই মসজিদ এবং মসজিদের সামনে ঘাট। আস্ত একটি মস্তকবিহীন খেজুর গাছ ফেলে এই ঘাট তৈরী করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে এ সময় কারাে কারাে খুব পানির তেষ্টা পেলাে। মসজিদের সামনে একটি চাপকল। কিন্তু মােরশেদ এই চাপকলের পানি খেতে সবাইকে নিষেধ করলাে। আমাদের জন্যে পানিতে বিষ মিশিয়ে রাখা বিচিত্র কিছু নয়। বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যার জন্যে কোনাে কোনাে পাকিস্তান প্রেমিক বাঙালী তাে এখনাে পর্যন্ত অবশিষ্ট রয়েছে। শেষমেশ আমাদেরকে বাধ্য হয়েই দীঘির পানিতে তৃষ্ণা মেটাতে হলাে।  শেষ রাতের নিসর্গে সাংঘাতিক নিস্তব্ধতা। তার ওপর ঝাপটা মেরে আসছে থেকে থেকে দমকা বাতাস। বিশ্রামের এই দুর্লভ সময়টুকু বৈশ ভালােই লাগছিলাে। চৈনিক এসএমজি’র বাটে মাথা রেখে ঘন দুয়ি গা বিছিয়ে দিয়ে পড়েছিলাে মােরশেদ। ওইভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এক পর্যায়ে কথা বলে উঠলাে সে। এ কথা কোনাে যুদ্ধের কথা নয়, এ কথার অর্থ অন্য কিছু। মনে হলাে দূর অতীত থেকে এই দমকা বাতাস কার শরীরের গন্ধ যেনাে ভাসিয়ে এনে বার বার ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাকে। মােরশেদ বললাে, তােমার জন্যে কোথাও কি কেউ অপেক্ষা করে আছে? | আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এ ধরনের কোনাে প্রশ্ন শােনার জন্যে। তবুও সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম, না কেউ না। কেনাে? আমার পাল্টা প্রশ্ন। মােরশেদ সরাসরি কোনাে জবাব দিলাে না। নিঃশব্দ কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলাে। তারপর সে তার নিজের কথা বললাে, আমি তিতলীকে ভালােবাসি। তিতলী । হ্যা, তিতলী, শেষের কবিতার লাবন্য সেএরপর আবার আগের নিস্তরতায় ডুব দিলাে মারশেদ।

কথা বললাে অনেকক্ষণ পর  জানাে, তিতলীর ছােটো একটি বােন আছে, নাম বাবনা। একটু হেসে তারপর বললাে, তুমি তাকে দেখলেই ভালােবেসে ফেলবে। মুহূর্তে কল্পনায় এক অদৃশ্য বাবনা ভেসে এলাে। কলকলিয়ার এক দঙ্গল জঙ্গলের মতােই ঝাকড়া চুলের সেই মেয়েটি ভেতরে কোথায় যেনাে সঁতরে বেড়ালাে খানিক। নিয়ন্ত্রণহীন কল্পনার রাজ্যে এরপর সহসাই হারিয়ে ফেললাম মােরশেদের বাবনাকে। তারপরই কঠিন বাস্তবতা। সেখানে মােরশেদের কথার জবাব দেয়ার ভাষা আমার নেই। মােরশেদের হাতে মৃদু। চাপ দিয়ে এর জবাবে একটু হাসলাম কেবল। আমি নিজেও বুঝলাম এ হাসি নিরেট অর্থহীন। অন্ধকারের মধ্যেও হালকা দেখতে পেলাম আনমনা মােরশেদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে, নক্ষত্রের দিকে। সেখানে হয়তােবা কোনাে নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে দীপ্তির মধ্যে সে খুঁজে ফিরছে তার অপেক্ষায় থাকা তিতলীর আভা। | সহসা সৈয়দের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। চারদিকে তাকিয়ে মনে হলাে রাত শেষ হয়ে এসেছে। নিসর্গে রাত্রির অন্ধকার থাকতে থাকতেই ফিরে যেতে হবে শিবিরে। আলসী ভেঙ্গে উঠে দাড়ালাম। একই সাথে মােরশেদও উঠলাে। অতীতের ভেতর নিঃসঙ্গ তিতলীকে ফেলে আসতে বােধ করি তার খুব কষ্ট হচ্ছিলাে। এরপর আমরা ঢালু পথে পা বাড়ালাম শিবিরের দিকে। পাহাড় আর অরণ্যের ওপর দিয়ে পূর্বের আকাশে তখন ফর্শা ভােরের মুখ সবে উকি দিচ্ছে। ভারতীয় বাহিনীর সেনা সঞ্চালন গত কয়েকদিনে আরও বেড়েছে। পূর্ব সীমান্তে তাদের সমাবেশ ঘনীভূত হয়েছে সব থেকে বেশী। আগরতলাকেন্দ্রিক এই প্রকাশ্য সেনা সঞ্চালনের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।

অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে ভারতীয় বাহিনীর সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি প্রায় সুস্পষ্ট। সেই সাথে এটাও পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিলাে যে এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে ভারতের একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ কেবলমাত্র অনিবার্যই নয়, অত্যাসন্নও। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই একদিন শত্রু বাহিনীর ধর্মগড় অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা করলেন কর্নেল সফিউল্লাহ। এই আক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে এবার প্রথমবারের মতাে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী সম্পৃক্ত হবে। অবশ্য কর্নেল সফিউল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে সম্পৃক্ত হবে পরােক্ষভাবে অর্থাৎ তারা পেছন থেকে অগ্রবর্তী মুক্তিবাহিনীকে গােলন্দাজ সহায়তা দেবে, সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ নয়। সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধারা পরপনা বাস্তবায়নে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া এবং লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান ‘বি’ কোম্পানী নিয়ে ধর্মগড় অবস্থানের ওপর মূল আক্রমণ চালাবে। এই আক্রমণের সমর্থনে ‘ডি’ কোম্পানীর একাংশ নিয়ে একটি সাপাের্ট কোম্পানী তৈরী করা হলাে এবং এই সমর্থক কোম্পানীর শেখ আপত হলাে আমার ওপর প্রয়ােজনে শক্ত অবস্থানের ওপর আমাকেও আক্রমণ চালাতে  হবে। এই আক্রমণে গােলন্দাজ সহায়তা পাওয়া যাবে পেছনের অবস্থান থেকে ভারতীয় বাহিনীর। একটি মাউন্টেন ব্যাটারী অর্থাৎ ছয়টি হালকা কামান এ জন্যে তৈরী রাখা হবে। এই প্রথমবারের মতাে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভারতীয় বাহিনীর সহায়তার আশ্বাস পেয়ে যুদ্ধে  আমাদের উৎসাহ আর মনােবল দ্বিগুণ বেড়ে গেলাে। মুক্তিযুদ্ধের একটি উজ্জ্বল পরিণতির সম্ভাবনা কার্যতঃ এভাবেই এবং তখন থেকেই শুরু হলাে। ওদিকে, শক্রর ধর্মগড় ঘাটিটিও বেশ সুরক্ষিত ছিলাে। এটি তাদের কৌশলগত একটি সেনা অবস্থান ফলে এর রক্ষা ব্যবস্থাও জোরালাে হবে এটাই স্বাভাবিক ধর্মগড় ঘাটির প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিলাে নিয়মিত বাহিনীর একটি আস্ত প্লাটুনসহ রেঞ্জার্সমিলিশিয়া মিলিয়ে পুরাে একটি কোম্পানী। এই মজবুত রক্ষাব্যুহের সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করেই আমাদের আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণীত হলাে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বর শেষ রাতে ৩টার দিকে আক্রমণ শুরু করা হবে। এর আগে উত্তর দিকের যােগাযােগ ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টির জন্যে প্রতিবন্ধকতা দল তৈরী করা হলাে যৌথভাবে ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনস্থ বাহিনী দিয়ে। দক্ষিণভাগের যােগাযােগ ব্যবস্থায়ও প্রতিবন্ধকতা তৈরীর ব্যবস্থা করা হলাে। এই দায়িত্ব দেয়া হলাে মােরশেদের ওপর। মােরশেদ ‘ডি’ কোম্পানীর অপর অংশ নিয়ে এ দায়িত্ব পালন করবে।

আক্রমণের দু’তিন দিন আগে থেকেই ধর্মগড় অভিযানকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান তৎপরতা শুরু করা হলাে। অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলাে ব্যাপক অনুসন্ধান তৎপরতায় অংশ নেয়। আগস্টের ৩০ তারিখ এ ধরনের সর্বশেষ অনুসন্ধানী টহল সম্পন্ন হলাে আমার নেতৃত্বে। এরপর থেকে এই তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হলাে যাতে শত্রুবাহিনী সতর্ক হয়ে উঠতে না পারে। | কিন্তু পরিকল্পনা এবং এর সাথে সংযুক্ত অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মােক্ষম সময়টিতেই বিরূপ হয়ে উঠলাে প্রকৃতি। ২ সেপ্টেম্বর দুপুরের পর থেকেই এই আলামত লক্ষ্য করা গেলাে আবহাওয়ায়। বিকেলে বৃষ্টি নামলাে অঝাের ধারায়। এই বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর সৈনিকরা তাদের নির্ধারিত স্থানে যথারীতি পৌছে গেলাে কামান নিয়ে। মধ্যরাতের কিছু পর আমরাও অবস্থান নিলাম যার যার জায়গায়। আমার অবস্থানটি ছিলাে বাংলাদেশের সীমান্তের অনেকটা ভেতরে বৈষ্ণবপুরের অগ্রবর্তী স্থানে। | অবস্থান নেয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে এলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের অধীনেই এই অভিযানে আমাকে কাজ করতে হবে। একটানা বৃষ্টি তখনাে ঝরছে। আমরা সবাই ভিজে জবজবে। শেষ রাতের দিকে এই অনাহুত বৃষ্টির সাথে আরও এক মাত্রা বৈরীতা যােগ করলাে ঠাণ্ডা বাতাস। সব মিলিয়ে এমন একটি প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হলাে অভিযান চালানাের পক্ষে যা একেবারেই অনভিপ্রেত। কিন্তু তারপরও পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ধর্মগড় আক্রমণের পরিকল্পনা পুরােপুরি অক্ষুন্ন থাকলাে। প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমরা প্রকাণ্ড একটি বট গাছের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। প্রকৃতির এই বৈপরীত্য দেখে এ সময় ব্রিগেডিয়ার স্বরূপকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হলাে।

আমার সাপাের্ট কোম্পানীর আপাতঃ নেয়া অবস্থান থেকে ধর্মগড়ের শত্রুঘাটির দূরত্ব প্রায় এক হাজার গজ। পাহাড়ী এলাকা এক বুক জঙ্গল চারদিকে। একটু সামনে গিয়েই শেষ হয়েছে এই জঙ্গলের সীমা। তারপর সমতলভূমী। সেখানের লােকালয়টিই ধর্মগড়।  ক্যাপ্টেন জুইয়া খানিকটা উত্তর দিক থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। তার প্রবেশ পথের পুরােটাই আগেভাগে বেকি করা। সুতরাং সেখানে বিভ্রান্তি ঘটার সুযােগ নেই। তাছাড়া বি কোম্পানী বেশ কয়েক দফাই আক্রমণের নকল মহড়া সম্পন্ন করেছে। বড় ধরনের কোনাে বিপত্তি না ঘটলে সবকিছু যথারীতি চলবে বলেই ক্যাপ্টেন ভূইয়াসহ সকলের ধারণা। এর মধ্যেই রাত আড়াইটার দিকে বেতারযন্ত্রে কর্নেল সফিউল্লাহর কণ্ঠস্বর ভেসে এলাে। ক্যাপ্টেন ভুইয়ার সর্বশেষ অবস্থান জানার জন্যে তিনি বেতারে তার খোঁজ করছিলেন। মুল আক্রমণের নিদিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হতে চলেছে। অথচ তখনাে এই আক্রমণে সম্মুখ সারির একজন অধিনায়ক ভূঁইয়ার সাথে যােগাযােগ করা যাচ্ছে না। বিষয়টি জানতে পেরে আমরাও খানিকটা হতাশ হলাম। উপরন্তু অগ্রবর্তী ‘বি’ কোম্পানীর তৃতীয় একটি প্লাটুনের সঠিক অবস্থান তখনাে পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। একই দশা পরিলক্ষিত হলাে লেফটেনান্ট বদিউজ্জামানের প্লাটুনটিরও। সেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই চরম সন্ধিক্ষণে সবকিছু কেমন তালগােল পাকিয়ে যাচ্ছিলাে। আর এ কারণে অপেক্ষমান ভারতীয় কামানগুলােও তাদের গেলবর্ষণ শুরু করতে পারছে না।

এই এলােপাতাড়ি অবস্থার মধ্যে এক সময় বেতারযন্ত্রে’ ধরা পড়লাে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কণ্ঠস্বর। সে জানালাে যে বৃষ্টির কারণে তার বেতারযন্ত্রটি ঠিক মতাে কাজ করছিলাে না।  বদির প্লাটুনসহ তৃতীয় প্লাটুনটিরও বােজ পাওয়া গেলাে একটু পরেই। এই প্লাটুন দু’টি প্রবল বৃষ্টির কারণে অদূরে কিছু ঠিকঠাক মতাে দেখতে না পেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাে। | কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার ক্ষীণ হয়ে এলাে। ভাের হতে তখন আর বেশী বাকি নেই। ঠিক এই সময় ভূঁইয়া জানালেন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া প্লাটুন দুটির সাথে তার যােগাযােগ সম্ভব হয়েছে এবং তারা তখন লক্ষ্যস্থলের নিকটবর্তী নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু একই সাথে ভূঁইয়া একটি দুঃসংবাদ দিয়ে বললেন যে তাদের অবস্থানে এক বুক পানির স্রোত পাহাড়ী ঢল সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে এটা হয়েছে। তিনি আরও জানালেন, তার বাহিনীর সৈন্যরা এ অবস্থার মধ্যে ঝড়বৃষ্টিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ পুরাে অবস্থাটি যা দাড়িয়েছে তাতে জোরালাে একটি সামরিক অভিযান চালানাের পক্ষে এটা একেবারেই উপযােগী নয়। এ অবস্থায় পুরাে অভিযানটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলাে। কিন্তু সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহ্ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। তিনি ভূঁইয়ার বেতার বার্তার কোনাে আমলই দিলেন না। দৃঢ়চেতা সৈনিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে গিয়ে এ অবস্থার মধ্যেই তিনি আক্রমণ চালাবার নির্দেশ দিলেন ভূঁইয়াকে। প্রয়ােজনীয় সংকেত পেয়ে ভারতীয় কামানগুলাে গর্জে উঠলাে এক সাথে। কিন্তু সেখানেও প্রকৃতির বৈরীতা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করলাে। প্রবল বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে পড়ায় গােলাবর্ষণের সাথে সাথে কামানগুলাে দেবে যাচ্ছিলাে বারবার। ক্যমান পুনৱায় ঠিক মতাে বসিয়ে পরবতা গােলা নিক্ষেপ করতে সময় লেগে যায় অনেক। যে কারণে এই অভিযানে পেছন থেকে ভারতীয় গােলন্দাজদের গােলাবর্ষণের কার্যকারিতা মােটামুটি ব্যর্থ হলাে। যেখানে একনাগারে অন্তত ৫শ গােলা নিক্ষেপ প্রয়ােজন, সেখানে দেখা গেলো গােলন্দাজরা থেমেথেমে গুহ সময়ের মধ্যে মাত্র শ’খানেকের মতাে গােলাবর্ষণে সমর্থ হয়েছে।

ক্যাপশনে ভুয়া এ অবস্থায় আরও গোলন্দাজ সহায়তার আবেদন জানালেন। কিন্তু সফিউল্লাহ তার এই আবেদন উপেক্ষা করে মূল আক্রমণে যাবার নির্দেশ দিলেন তাকে। এই নিদেশের সাথে সাথে এক বুক পানির প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে ‘বি’ কোম্পানীর সৈনিকরা এগিয়ে গেলাে ধর্মগড় অবস্থানের দিকে। ধর্মগড় ঘাটিতে পাকিস্তানীরাও ততােক্ষণে প্রস্তুত হয়েছে যুদ্ধের জন্যে। তারাও জেনে গেছে যে তাদের অবস্থানে একটি আক্রমণ অত্যাসন্ন। তাদের পাল্টা হামলার মুখে অল্পক্ষণের মধ্যেই রুদ্ধ হয়ে এলাে ‘বি’ কোম্পানীর অগ্রযাত্রা। এ অবস্থায় পাকিস্তানী গােলন্দাজরা অনবরত গােলা নিক্ষেপ চালিয়ে গেলাে থমকে যাওয়া ‘বি’ কোম্পানীর ওপর এবং এভাবেই দুঃখজনক একটি পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলাে ধর্মগড় অভিযান। এবার পশ্চাৎপসরণের পালা।। এই অনিবার্য প্রায় পাল্টা হামলার মধ্যে প্রকৃতির বৈরীতার শিকার ‘বি’ কোম্পানীর সৈন্যদের অধিকাংশই আটকা পড়ে গেলাে। পাকিস্তানীরা ইতিমধ্যেই তাদের মূল অবস্থান ছেড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ‘বি’ কোম্পানীকে। অপেক্ষাকৃত উচু ভূমিতে অবস্থানগত সুবিধা থাকার কারণে এই পর্যায়ে পাকিস্তানীরা তাদের সাফল্যে আশাবাদী হয়ে ওঠে। আমাদের সাপাের্ট কোম্পানীর অবস্থানও ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। পাকিস্তানীদের এই জানার বিষয়টি আমাদের কাছে অবাক করে দেয়ার মতাে ছিলাে। গােলা এসে আমাদের ওপর পড়তে শুরু করলাে। যেহেতু আমাদের অবস্থান নেয়া এই জায়গাটি ছিলাে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট, সেহেতু ট্রেঞ্চ খোড়া হয়নি। অগত্যা উন্মুক্ত অবস্থাতেই পাকিস্তানীদের গােলার আঘাত সয়ে নিতে হলাে। মুহুর্মুহু কামানের এই বিপর্যয়ের মধ্যে সফিউল্লাহ্ বেতারযন্ত্রে আমার সাথে যােগাযােগ করলেন। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন অগ্রসরমান পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এই মুহুর্তে আক্রমণ চালাতে আমি প্রস্তুত কি না। এর জবাবে আমি আমার সম্মতির কথা জানাতেই তিনি কোনাে রকম আগপাছ চিন্তা না করে আমাকে সরাসরি ধর্মগড় আক্রমনের নির্দেশ দিলেন। ধূসর দিবালােকে প্রস্তুত পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তখন আক্রমণ চালানাের মানেই হচ্ছে জেনেশুনে অযথা জীবন হারানাের ঝুঁকি নেয়া। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি এই সব ভেবে দেখার সময় পেলাম না। তড়িঘরি প্রস্তুতি নিলাম আক্রমণের জন্যে। এগিয়ে গিয়ে সমতল ভূমীর এক বুক পানিতে নেমে পড়লাম স্বসৈন্যে। কিন্তু বেঁকে বসলেন ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ।

তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে সাথে সাথে কর্নেল সফিউল্লাহকে বেতারযন্ত্রে এই অভিযানের বিপদ সম্পর্কে বােঝালেন। এরপর সফিউল্লাহ তার মত পাল্টালেন। এই পর্যায়ে অবরুদ্ধপ্রায় ‘বি’ কোম্পানীর ওপর থেকে শত্রু বাহিনীর চাপ হ্রাস করার লক্ষ্যে ধর্মগড়ের সামান্য দক্ষিণে একটি হাল্কা নকল আক্রমণ শানানাের জন্যে ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ আমাকে নির্দেশ দিলেন। এই আক্রমণটি কার্যতঃ মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে শত্রু বাহিনীর মধ্যে যথাসম্ভব বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যেই চালানাে হবে, যাতে পাকিস্তানীরা ধরে নেয় যে আক্রমণ বহুদিক থেকে শুরু করা হয়েছে। মােরশেদও একই ধরনের আক্রমণের মহড়া চালানাের জন্যে একটি প্লাটুন নিয়ে তার অবস্থান থেকে আরও কিছুটা দক্ষিণে সােজাসুজি হরষপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। কৃষ্ণনগর বিওপি’র বিএসএফ বাহিনীও পাকিস্তানীদের ওপর তৃতীয় একটি আক্রমণের চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ততােক্ষণে ভারতীয় কামানগুলােও আগের তুলনায় অনেক বেশী সচল হয়ে উঠেছে। এই কামান শক্ত মাটিতে স্থানান্তরিত করতে পারার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ অবস্থায় শক্র বাহিনীও একটি বহুমুখী আক্রমণের মধ্যে পড়ে যায়। আর সেই ফাক দিয়েই ‘বি’ কোম্পানীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় সকাল ৯টার দিকে।

 

সূত্র : যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নাসির উদ্দিন