মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ এবং একটি আবেগঘন দৃশ্য
মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান
তখন আরও একটি কাজ করা হয়েছিল, তা হলো বিডিআরের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতিস্তম্ভটির জন্য আমার পূর্বসূরি অধিনায়ক দত্ত সাহেবই প্রায় ৮০ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তিনি স্থপতিদের দিয়ে কয়েকটি নকশাও করিয়েছিলেন। তার একটি ছিল চার কলামবিশিষ্ট একটি কাঠামাে, সংবিধানে বর্ণিত চার মূলনীতির প্রতীক। দেখতেও সুন্দর। ওই কাঠামােটিই নির্মাণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলাে । কিন্তু তার জন্য ৮০ হাজার টাকা নিতান্তই অপ্রতুল ছিল। নানা খাতে খরচ সংকোচন করে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করে স্তম্ভটি প্যারেড গ্রাউন্ডের ঠিক সামনে নির্মাণ করা হলাে, যাতে বাৎসরিক প্যারেডের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি সমস্ত দর্শকের চোখে পড়ে। এর সঙ্গে আরও একটি কাজ করা হলাে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আট শ বিডিআর সদস্যের নাম মার্বেল পাথর বসিয়ে চার উপস্তম্ভের ওপর লিখে দেওয়া হলো। দেশবাসীর অনেকেই জানতেন না যে মুক্তিযুদ্ধে বিডিআরের (ইপিআর) শহীদ হয়েছিলেন প্রায় আট শ, যেখানে সেনাবাহিনীতে শহীদের সংখ্যা ছিল না শ খানেক ।
পাথরে শহীদদের নাম লেখানাে প্রসঙ্গে একটি ছােট দৃশ্য আমার চোখে এখনাে ভাসে এবং আমৃত্যু ভাসবে। এখনাে দৃশ্যটি স্মরণ করে আমার চোখ ভিজে ওঠে, আমৃত্যু ভিজে উঠবে।
তখন বিডিআরের বাৎসরিক পুনর্মিলনী । গাড়ি করে যাচ্ছিলাম শহীদ স্মৃতিস্তয়ের পাশ দিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা এবং শহীদদের মা ও স্ত্রী পুত্ররাও এসেছেন। তাঁদের অনেকেই স্তম্ভটির চারদিকে। অনেকে স্তম্ভটি ধরে আছেন। গাড়ি থামিয়ে নামলাম। ওখানকার অনেক দর্শনার্থীর চোখেই পানি।। একজন বৃদ্ধা পাশের মহিলা ও লােকদের বারবার অনবােধ করছেন, তার শহীদ ছেলেটির নাম কোথায় আছে দেখিয়ে দিতে। একজন বৃদ্ধাকে নিয়ে তার শহীদ ছেলের নামটি দেখিয়ে দিলেন। বৃদ্ধা পড়তে পারেন না। তাই সাহায্যকারীকে অনুরােধ করলেন যেন তার কলম-অঙ্গলিটি তার ছেলের নামের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়। বৃদ্ধা প্রথমে নামটির ওপর দু-তিনবার হাত বােলালেন। তারপর অঙ্গুলি একটু সরিয়ে চুমু খেতে আরম্ভ করলেন।
এর বেশি দেখার জন্য আর দাঁড়াতে পারিনি। তবে সে দিনটি ছিল বােধ হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম আত্মতৃপ্তির দিন। চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
Reference: কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫ মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান