You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.18 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মাহে রমজান | জনসাধারণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৮ই সেপ্টেম্বর, বুধবার, ১লা আশ্বিন, ১৩৮১

মাহে রমজান

সংযম ও কৃচ্ছ তার প্রত্যয় নিয়ে এসেছে মাহে রমজান। তাবৎ দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য পবিত্রতম এই মাসকে অতীতের সকল গ্লানি পরিত্যাগ করে সকল কুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে নতুন করে শুদ্ধ হবার পালা। নতুন জীবনের অন্বেষায় আত্মস্থ এই মাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা খুঁজে পেতে চায় জীবন চেতনার মূল সুরকে। রমজান তাই শুধু সংযম ও কৃচ্ছ তার মাসই নয় বরং আত্মোপলব্ধি ও আত্মচেতনার মাসও বটে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। একটি মারা রমজানের সেই মূল শিক্ষাকে গ্রহণ করে সংযোম ও কৃচ্ছ সাধনার মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি আত্মচেতনা বিকাশের সাধনায় ব্রতী হবে।
আর দশটি বছরের মতো এবারের রমজান আসেনি তেমন আনুষ্ঠানিক রূপ নিয়ে। এ মাসটির যে একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রাত্যহিক অভাব দরিদ্রদের চাপে মানুষ ভুলতে বসেছে চাল-তেল-আটার বাজার আক্কারা । কদিন বাদে বাদেই ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেমাফিক দাম বাড়ছে আয়-উপার্জন আর ব্যায়সীমার মধ্যে সমন্বয় বিধান করা দুঃসাধ্য।
প্রতিবছরই দেখা যায় রমজানকে সামনে রেখে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। এবার এমনিতেই চারিদিকে দুর্ভিক্ষাবস্থা। অনাহারে মানুষ মরার খবর আসছে। কচু ঘেচু যা কিছু মিলছে তাই গলধঃকরণ করে মানুষ বেঁচে থাকার নির্মম সংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে রমজানের এক ফালি চাঁদ মানুষের নিত্য ব্যবহারী জিনিসের আর এক ধাপ মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কার বার্তা বহন করে আনছে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা তারা এই রমজানে কিছু ভালো মতো খেয়ে সিয়ামের সাধনায় ব্রতী হবার আকাঙ্খা রাখেন না। কিন্তু সেহেরী আর ইফতারিতে দুটো খাবার মুখে দেওয়ার মতো অবস্থাও যদি আর এক ধাপ মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে শেষ হয়ে যায় তবে তার জীবনে বিড়ম্বনাই ডেকে আনবে। রমজানের পবিত্র আহ্বান এক শ্রেণীর রক্তচোষার যূপকাষ্ঠে ম্লান অভিশাপ হয়ে নেমে আসবে।
আত্মোপলব্ধি আর আত্মচেতনা স্বাক্ষর বহনকারী রমজানের এই পবিত্র মাসের শুভারম্ভে আমরা আজ সকল মানুষের শুভ চিন্তা ও উদ্যোগের আহ্বান জানায়। কৃচ্ছতা তো বাধ্যবাধকতা। ঐশ্বর্যের কাছে এর অনেক মূল্য রয়েছে।
চারদিকে অভাব-অনটনের সকরুণ দৃশ্য অত্যাচার আর শোষণ অব্যাহত। ক্ষুদ্র দ্বীপ মালার মতো ঐশ্বর্য্য আর বিলাসের প্রাচুর্য কজন ভাগ্যবানের হাতে স্তূপীকৃত। রমজানের কৃচ্ছতা ও সংযম সাধনা তাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর চিন্তা চেতনার সাথে একাত্ম করুক। আত্মোপলব্ধি ঘটুক মানুষের। এই রমজানে আমরা লাখো ধর্মভীরু মুসলমানের কাছে সে আহ্বান জানাই।

জনসাধারণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ

দেশের দুঃখী জনগণ শত কষ্ট সত্বেও জাতির কল্যাণের জন্য বিনা দ্বিধায় স্বেচ্ছাশ্রম দিতে প্রস্তুত তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। গতকাল প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রে সরকারের পরিকল্পনা ছিল খুলনার কাছে জলাময় উপকূল ভাগ প্রকল্পের ২৮/২ নং পোল্ডারের কাজ তিন বছরে শেষ করতে হবে। কিন্তু ওই এলাকার গরিব জনসাধারণ সরকারি প্রকল্পের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই সম্মিলিতভাবে বাঁধ নির্মাণে অংশগ্রহণ করেন। নিজেদের বাড়িঘর নিজেরাই সরিয়ে নিয়ে বারো মাইল বাধ দিয়েছে, একটি নদীর ক্লোজার ও বারোটি স্নুইজ তারা নির্মাণ করেছে। এ কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে সরকারি পরিকল্পনার সময় ধরা হয়েছিল তিন বছর। সে ক্ষেত্রে জনসাধারণের সহযোগিতায় তা তিন মাসে সম্ভব হয়েছে। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত গত রোববার উক্ত উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের ২৮/২ নং পোল্ডারের উদ্বোধন করেছেন। তিনি উদ্বোধনী ভাষণে জনসাধারণের এ কাজে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা পেলে পরিকল্পিত সময়ের চেয়ে অনেক কম সময়ের মধ্যে বন্যা প্রতিরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। জনগণের সহযোগিতায় এই পোল্ডার নির্মাণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে মন্ত্রী আরো বলেছেন “এই পদ্ধতি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির ইঙ্গিতবাহী। আরো ক’টি কর্মসূচি আগামী বছর হাতে নেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। উল্লেখিত এই পোল্ডারের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ছয় হাজার চারশো একর এবং এতে দুই লাখ চব্বিশ হাজার মণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হবে। পূর্বে সমুদ্রের লোনা পানির প্লাবনে উক্ত জমিতে কোন ফসল উৎপাদিত হতো না। জনসাধারণ ছাড়াও স্থানীয় কৃষক লীগ সংগঠনের কর্মীরা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন বলে সংবাদে বলা হয়েছে। বাঁধ নির্মাণ বা নিজেদের বাড়িঘর এর ব্যাপারে জনগণ অগ্রিম কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করেনি বলেও মন্ত্রী জানিয়েছেন।
খুলনার জলাময় উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের এই ঘটনাটি গোটা জাতির সামনে যেমন একটি উদাহরণ তেমনি আমাদের সরকারের সামনেও এটা একটি উদাহরণ স্বরূপ। দেশের সাধারণ মানুষ জাতির কল্যাণের জন্য যে আজো যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত এ ঘটনাটি তার প্রমাণ। স্বাধীনতার পর এমনই একটি বাসনা জনসাধারণের মনে ছিল। তারা অত্যন্ত খোলা মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দেশের সরকার যদি তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করেন তাহলে যেকোনো সমস্যার মোকাবেলা জন্য তারা সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে আসবে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভ করার পর সাধারণ জনসাধারণকে এগিয়ে আসার ব্যাপারে শুধু বক্তৃতাই দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার অর্থে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।
ক্ষমতাসীন সংগঠন এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বস্তুত স্বাধীনতার পর প্রতিটি স্তরের নেতৃত্বে আপন আপন স্বার্থের সন্ধানে কাজ করেছেন। জনসাধারণকে নিয়ে কোনো সমস্যা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। স্থানীয়ভাবে যারা নেতৃত্ব দান করেন তাদের দায়িত্ব থাকে স্থানীয় জনগণকে কোন সংস্কারমূলক কাজের স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধ করে কোন কাজে আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু তারা তা করেননি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ভাবে কোনো কর্মসূচি ও কর্মীদের কাছে দেওয়া হয়নি। ফলে কোনো বিশেষ কাজে যদি জনসাধারণ এগিয়ে এসে থাকেন তাহলে তারা তাদের নিজ উদ্যোগেই এসেছেন। আমরা সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে মানুষের এই দেশাত্মবোধকে কাজে লাগাতে পারিনি। তবু জনসাধারণ যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন তাহলে তাদেরকে কতৃপক্ষ স্বাগত জানাবেন-এ আশা আমরা এখনও রাখি। খুলনার উপকূল অঞ্চলের একটি বাঁধ নির্মাণ করে স্থানীয় জনসাধারণ যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন-দেশের অন্য এলাকার মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ হবে। কর্তৃপক্ষ জনগণের এই স্বজাত্যবোধকে যথাযথ কাজে লাগাবার জন্য যতদিন ব্যবস্থা গ্রহণ না করবেন ততদিন গোটা জাতির মঙ্গল ত্বরান্বিত হতে পারেনা বলেই আমাদের বিশ্বাস।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন