You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.23 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ভুতেরই পা হয় পিছন দিকে! | ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রসঙ্গে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩শে সেপ্টেম্বর, সোমবার, ৬ই আশ্বিন, ১৩৮১

ভুতেরই পা হয় পিছন দিকে!

উৎপাদন বাড়াতে হবে কিন্তু কেমন করে, কীভাবে বা কোন পদ্ধতিতে তার কোনো সুস্পষ্ট দিক নির্দেশক ইঙ্গিত অনেক ক্ষেত্রেই নেই। অতএব আবার এক সময় কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়তি উৎপাদনের বোঝায় পথ রোধ হয়ে যাবার দরুন পিছু হটতে হয়। উৎপাদন কমানোর নির্দেশ দিতে হয় কারখানা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। ‘বাংলার বাণী’ বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট পড়ে থাকার দরুন কতৃপক্ষ সিমেন্টের উৎপাদন শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রতিবেদন সূত্র আরও জানাচ্ছে, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও চট্টগ্রাম ক্লিংকারস ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত প্রায় ১৫ হাজার টন সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দু’টির প্রাঙ্গণেই পড়ে আছে। ছাতক ও চট্টগ্রামের উৎপাদিত সিমেন্ট বিতরণ ও সরবরাহের জন্য এলোকেশন কমিটি এবং সেই কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত ডিলারও রয়েছে। তবে বর্তমানে এই ব্যবস্থা শুধু চট্টগ্রাম সিমেন্ট ক্লিংকারস এর ক্ষেত্রে কার্যকরী ও সরবরাহ করার ভার নিয়েছে টিসিবি।
প্রতিবেদনের মাধ্যমে অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, টিসিবি এবং ডিলাররা ঢিলেমি করে মাল ঠিকমতো উঠাচ্ছেনা। ফলে উৎপাদিত সিমেন্টের স্তুপ পড়ে থাকছে এবং গুদামে স্থানাভাবের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে হচ্ছে উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে। অপরপক্ষে যদিও চট্টগ্রাম সিমেন্ট ক্লিংকারস ফ্যাক্টরির মাল বিতরণ ও সরবরাহের জন্য এলোকেশন কমিটি ও তাদের ডিলার আছে, তবুও চট্টগ্রামে প্রায় ৩ হাজার টনের মতো উৎপাদিত ক্লিংকারস বাইরে পড়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছেন মাল রাখার সময় ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে।
একথা সবাই স্বীকার করেন যে, প্রত্যেক কর্মের একটা অজুহাত থাকেই। চোর-ডাকাত দুর্নীতিবাজ, অপগুণ্ড, অধম সবারই ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই ছাতক ও চট্টগ্রাম সিমেন্ট কারখানায় স্তুপীকৃত হয়ে থাকা এবং তার জন্য উৎপাদনের নির্দেশ দেওয়া অবশ্যই কৈফিয়ৎ থাকবে-এ আর নতুন কথা কি! কিন্তু শুধু কৈফিয়তে যখন পেট ভরে না, মুশকিল বেঁধে যায় তখনই।
আমরা জানি বর্তমানে দেশে গৃহ নির্মাণ উপকরণের মধ্যে শুধুমাত্র সিমেন্টের অভাবেই বহু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। অসংখ্য নির্মায়মাণ ভবন শেষ হচ্ছে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অজস্র বিধ্বস্ত দালান কোঠা পর্যন্ত সিমেন্টের অভাবে সংস্কারহীন অবস্থায় যেন ভেংচি কাটছে সকলকে। সামর্থ থাকা সত্বেও ব্যক্তিগত বাতি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিতে সাহস করছে না কেউ। ফলে নতুন বাড়ি ঘর নির্মাণের কাজ প্রায় স্থগিত রয়েছে আর অপরদিকে রাজধানীতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বাঁড়ার দরুন বসতবাড়ির সংকট তীব্রতাকেও গেছে ছাড়িয়ে। এমনকি সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহু তলাবিশিষ্ট ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণ বা অল্প ব্যয়ের ভোড়াবাড়ি নির্মাণের কাজও আশানুরূপ গতিতে অগ্রসর হতে পারছে না ওই সিমেন্টের অভাবে।
আবার কোন কোন প্রকল্পের সিমেন্টের অভাবে দালানকোঠা সম্প্রসারণের কাজ বিশ্রীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ক’দিন আগেই পত্রিকান্তরে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এর উন্নয়ন কাজ মাত্র ৫০০ বস্তা সিমেন্টের জন্য পুরোপুরি বন্ধ আছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা পায় (অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে)। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে যে রোগীদের খাবার তৈরীর জন্য পাক ঘর বা হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্সদের কোয়াটার অথবা রোগীদের জন্য বিছানা সহ ঘর বাড়ানোর কাজ করা হবে তার উপায় নেই। সিমেন্ট পাওয়া যায় না। টিসিবি ঢাকা জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বত্র দৌড়াদৌড়ি করে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সিমেন্ট জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এই চূড়ান্ত তাগাদার সময় সিমেন্ট নিয়ে এত অবহেলা প্রায় অসহ্য। অনেকের ধারণা এই সিমেন্টলীলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উৎপাদন কমে গেলে বাজারের সিমেন্ট সঙ্কট আরো বাড়বে এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য তা হবে আশীর্বাদ এবং এসব অর্ধেক ভাগ নাকি যথাস্থানে স্থানান্তরেও পৌঁছায়। তবে এসব খবরের সত্যতা যাচাই করা আমাদের কাজ নয়, আমরা তা করতেও চাই না। আমরা শুধু বুঝতে চাই যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ও জাতীয় জীবনের সার্বিক সমস্যার ক্রান্তির তাগিদে যেকোনো মূল্যে উৎপাদন বাড়ানোর ডাক আসছে, সেখানে উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত কি করে নেয়া সম্ভব হয়? তাই সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে আমাদের আবেদন যে, এর পেছনে উদ্দেশ্য বা লাভজনক দূরভিসন্ধিই থাকুক তাকে যেন নির্মমভাবে নির্মূল করা হয়। নইলে ভূতের মত পেছনের পায়ে হাঁটা হবে। সম্মুখ গতি হবে রুদ্ধ।

ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রসঙ্গে

ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা পরিচালিত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ন্যায্য মূল্যের দোকান অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চাকুরিচ্যুত হয়েছেন এই সকল দোকানের সাথে জড়িত প্রায় পনেরো হাজার কর্মচারী। এখন থানা সদর এবং শহরগুলোর মধ্যে ন্যায্য মূল্যের দোকান সীমাবদ্ধ থাকবে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে যে সকল প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রতিষ্ঠা ছিল সেগুলোর অন্যতম এর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে যত শীঘ্র গিয়ে পৌঁছাতে পারতো অন্য কোনো পদক্ষেপই তেমন দ্রুত ফল দানে সক্ষম ছিল না। ফলে একটি নতুন রাষ্ট্রে নতুন সিস্টেম হিসেবে বন্টন ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এর যেমন অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল তেমনি ছিল রাজনৈতিক গুরুত্ব।
অথচ সুষ্ঠু পরিচালনার অভাব এবং প্রশাসনিক গাফিলতির জন্য এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মহতী উদ্যোগ থেকেও সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। গোড়া থেকেই এমন একটা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সর্তকতা এবং বাস্তব অবস্থা হিসেবে রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছিল। কিন্তু সে আবেদন সুপারিশের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ইচ্ছামত ইউনিয়নে ইউনিয়নে একটা ঘরের ওপর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আর গুটিকতক লোককে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট দিয়েই তারা তাদের দায়িত্ব সেরেছেন। মালপত্র যোগান দেয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধার দিক বিবেচনা করা অথবা সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মী নিয়োগ কোনটির প্রতিই তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাই ফল ফলেছে উল্টোটি।
ন্যায্য মূল্যের দোকান জনসাধারণের কাছে চিহ্নিত হয়েছে মূল্যবৃদ্ধি তথা কালোবাজারি একটা আস্তানা হিসেবে। মাসের-পর-মাস দোকানের তালা চাবি বন্ধ থেকেছে আর ভোগ্যপণ্য সংস্থা সরবরাহকৃত মাল পাচার হয়ে গেছে খোলাবাজারে।
এর অন্য দিকও রয়েছে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রব্যসামগ্রীর গিয়ে পৌঁছায় নি। জনসাধারণ ধন্না দিয়েছে ন্যায্য মূল্যের দোকান। আর মাসের পর মাস শুধু বেতন তোলা কর্মচারীদের কাছে শুনেছে সেই একই জবাব ‘মাল আসেনি’।
ইউনিয়ন পর্যায়ে ওই দোকানগুলোর গুটিয়ে ফেলার ফলে সরকারের অন্তত বিশ লাখ টাকা মাসিক ব্যয় কমে যাবে কিন্তু বেকারের তালিকায় বাড়বে আরও পনেরো হাজার লোকের নাম। এই কলমের খোঁচায় অসংগঠিত এই পনেরো হাজার লোককে চরম দুর্দিনে চাকরীচ্যুত হতে হলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার কোনো সংস্থানও এদের অনেকের নেই। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা এদের জন্য করা হবে এমন কোনো আশ্বাসও সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়নি। যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা ক্ষুদে কর্মচারী। ন্যায্য মূল্যের দোকান পরিকল্পনা সফল করে তোলার ব্যাপারে এদেরও অবশ্য একটা ভূমিকা ছিল কিন্তু তা নিতান্তই নগণ্য। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত ছিল এমনকি অসৎ কর্মী নিয়োগ যদি এর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় তবে সেই কর্মী নিয়োগ যারা তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেননি তাদের কিন্তু শাস্তি হয়নি। না তাদের প্রমোশন আটকে থেকেছে, না চাকরি গেয়েছে। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বেকারত্বের অভিশাপ বহন করবার জন্য নির্দেশিত হয়েছেন সেই সকল কর্মচারী যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অতি সামান্য। কোনো মহল থেকে এদের প্রতি কোনো সহানুভূতি উচ্চারিত হয়নি, কেউ আসেনি তাদের সাহায্য। কথায় কথায় যারা বিপ্লবী বুলি আওড়ান একটি কলমের খোঁচায় পনেরো হাজার লোকের চাকরি হারানোটা তাদের নজরের বাইরে থেকে গেছে। এটা আমাদের দেশে বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির দৈন্যই তুলে ধরে।প্রমাণ করে আরও একবার যে এদেশে দায়িত্বশীল বিরোধীদলের সত্যিই বড় অভাব।
প্রগতিশীল নীতি বাস্তবায়নে সুষ্ঠু কর্মদ্যোগের অভাব এবং প্রশাসনিক গাফিলতি ও অযোগ্যতা যে মহৎ একটা উদ্যোগ ভেস্তে পাঠাতে পারে নায্যমূল্য দোকান পরিকল্পনার পরিণতি তারই একটা দৃষ্টান্ত। এ থেকে সরকারি নেতৃত্ব শিক্ষা গ্রহণ করবেন বলে আমরা মনে করি। একই সঙ্গে সরকারের কাছে আমাদের দাবি কর্মচ্যুত পনেরো হাজার কর্মচারী ব্যাপারে একটা মানবিক নীতি অনুসরণ করা হোক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন