ঢাকার পথে লাহাের
ট্রেনে আমরা লাহাের পৌঁছলাম ২২ ডিসেম্বর সকাল এগারােটায়। তৃতীয় শ্রেণীর কামরা; কিন্তু আমাদের মনের অবস্থা এই শ্রেণী বিশ্লেষণের জন্য মােটেই প্রস্তুত ছিল না। মুক্তির হাওয়া বইছিল আমাদের মনের আকাশে। কিন্তু একি? লাহােরের স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষমাণ আমেরিকায় নির্মিত বিশাল একটি শেভ্রলে স্টাফ কার অদূরে দাঁড়িয়ে একজন ক্যাপ্টেন। আমার পরিবারের জন্য রয়েছে আলাদা ভদ্রোচিত গাড়ি আমার গাড়ির দু’দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন সিপাহি চৌকস অভিবাদন গ্রহণান্তে গাড়িতে বসলাম। ভাবছিলাম কোথায় যাবাে আমরা জিগ্যেস করি নি। জিগ্যেস করার প্রবৃত্তিও ছিল না। গাড়ি গিয়ে থামলাে অফিসার্স ক্লাবে। যে ক্যাপ্টেনটি আমাদের নিয়ে এসেছেন স্টেশন থেকে তিনি জানালেন যে, বিকেলে আমাদের দাওয়াত জি ও সির (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) ফ্লাগ স্টাফ হাউজে। আর দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য অনুরােধ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আলতাফ কাদের। ইনি আমার অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ অধিকর্তা ছিলেন তুরস্কে আনকারার সেন্টো (CENTO) হেড কোয়ার্টার্সে। তিনি বিশেষভাবে অনুরােধ করেছেন যে, পুরনাে দিনের খাতিরে হলেও আমরা যেন বাংলাদেশে ফেরার পথে তাদের সাথে একবার দেখা করে যাই। তিনি নাকি অনেকদিন ধরেই বারবার ফোন করছিলেন আমার খোঁজে জেনারেল আলতাফ কাদেরের কথা আলাদা। জিওসি’র বাড়িতে দাওয়াত, এমন সুদৃশ্য স্টাফ কার, চাকরিরত ব্রিগেডিয়ারের মতাে সম্মান প্রদর্শন, এসবের অর্থ কি? উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। পরে বুঝেছিলাম উদ্দেশ্য। কথায় বলে, নাটকের শেষ দৃশ্যটাই মনে রেখাপাত করে বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হয় মনবিহীন (মাইন্ডলেস) সাধারণ পাঞ্জাবি অফিসাররা হয়তাে ভেবেছে যে, শেষ মুহূর্তের ভালাে ব্যবহার বােধহয় আমাদের সুদীর্ঘ কারাজীবনের পশুসুলভ জীবনযাত্রা ভুলিয়ে দেবে অবলীলাক্রমে তাই এই ভালাে ব্যবহার দিয়ে বিদায় দুপুরবেলা আমরা গেলাম জেনারেল আলতাফ কাদেরের বাসায় বাসাটি তার নিজের এবং লাহাের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। ১৯৬৬ সাল থেকে অবসর নিয়ে এই বাসাতে আছেন স্বামী-স্ত্রীতে । খুব ভালাে লাগছিল যেতে। আনকারায় থাকতে উভয়ে অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাদের। বিশেষ ঘনিষ্ঠও ছিলাম। আনকারায় তিনি ছিলেন পাঁচ দেশের (আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান) পাঁচজন লে. জেনারেলের অন্যতম। আর মেজর হিসেবে আমি ছিলাম তার একমাত্র স্টাফ অফিসার। অন্যান্য দেশের কয়েকজন করে অফিসার। ছিলেন তাদের জেনারেলকে সাহায্য করতে; কিন্তু পাকিস্তান ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য মাত্র একজন অফিসারকে সাহায্যকারী হিসেবে রাখতাে। দেশে ফেরার আগে এঁদের সঙ্গে দেখা হবে ভাবি নি।
তাঁর রীতি অনুযায়ী আমার স্ত্রীকে গাড়ির দরজা খুলে অভিবাদন করলেন জেনারেল সাহেব। তিনি অত্যন্ত মার্জিত ভদ্রলােক। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সভ্য ব্যবহার তার স্বভাবজাত । তিনি স্যার আবদুল কাদেরের দ্বিতীয় পুত্র। প্রথম পুত্র প্রখ্যাত আইনজীবী মনজুর কাদের, যিনি খ্যাত হয়েছেন আইয়ুব খানের মন্ত্রী। হিসেবে আলতাফ কাদের পণ্ডিত ও সুলেখক বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আনকারা থাকতে যখনই তিনটি রিজিওনাল দেশের (তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান) জেনারেলগণ আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যকে চাপ প্রয়ােগ করার জন্য একত্র হতেন, তখন প্রস্তাবনার খসড়া লেখার ভার পড়তাে আলতাফ কাদেরের ওপর। ওই রকম সুলিখিত খসড়া আমি খুব কম দেখেছি। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর জেনারেল সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে। বললেন, ‘হালিল বে, (তুর্কি ভাষায় ‘খ’ উচ্চারণটি নেই বলে, ওরা ‘খ’-কে ‘হ’ বলে। সে সূত্রে আমার নাম ছিল হালিল আর জেনারেল সাহেব আমাকে সেভাবেই সম্বােধন করতেন) তুমি ১৯৬৬ সালে আমার আনকারার বাড়িতে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলে। তখন তােমার কথার তেমন গুরুত্ব দিই নি। পরে। সেগুলাে আক্ষরিক অর্থেই এতাে তাড়াতাড়ি এতাে সত্যি হবে জানতাম না।’ তার কথায় ছেদ টেনে বেগম আলতাফ বলে উঠলেন, আলতাফ, সেদিন আমরা একটি ভুল করেছি। খলিলের কথাগুলাে রেকর্ড করে রাখা উচিত ছিল। কেমন মজা হতাে, তাই না? আমি এক দারুণ লজ্জাকর ও ব্রিতকর অবস্থায়। জেনারেলের আমার প্রতি স্নেহ বরাবরই পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। মনে পড়ে তিনি যে আমাকে বার্ষিক গােপনীয় রিপাের্ট (এসিআর) দিয়েছিলেন তা পড়েও আমার কান গরম ও চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। কোনােক্রমে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম, আপনি অত্যন্ত সদয়।’ খটাখট জবাব, না, এসবই তােমার প্রাপ্য।’ ভাবছি কি বলব, জেনারেল আবার বললেন, ‘এবার তােমাকে বলতে হবে, কি হলাে আমাদের দেশটিতে আর কেন হলাে। আরও বলতে হবে ভবিষ্যতে কি হবে।
এবার আমি তােমার কথা লিখে রাখবাে।’ এদিকে আমার কেবল ভাসাভাসা মনে আছে আনকারায় সেদিন কিসব বলেছিলাম; কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী? কি বলেছিলাম? বললাম, ‘স্যার, আমি তাে কোনাে ভবিষ্যদ্বাণী করেছি বলে মনে পড়ে না।’ বললেন, ‘বাহ, তুমি বলাে নি যদি পাকিস্তান সরকার এই এই কাজগুলাে না করে তবে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে? বলাে নি?’ ধীরে ধীরে মনে পড়ছিল কথাগুলাে। তাছাড়া ওঁরা দু’জনে আমার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতেও সাহায্য করছিলেন। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি জেনারেলের ঘটনার কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ না দিলে পাঠক বুঝতে পারবেন না। | ১৯৬৬ সালের একদিন অফিসের পর আনকারায় আমার নিজের বাসায় ফিরে এসেছি। জেনারেল কাদেরের টেলিফোন, হালিল বে, তুমি আজ সন্ধ্যায় কি করছাে? যাই করাে না কেন এবং যেকোনাে অ্যাপয়েন্টমেন্টই থাকুক না। কেন, তােমাকে আমার বাসায় আসতে হবে।’ জেনারেলের স্বকীয় গুণে তার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল। ঠিক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক নয়। ঠাট্টা করে বললাম, এটা কি সামরিক আদেশ?’ ‘না, আদেশ নয়, তবে তােমাকে আসতে হবে এবং এখানেই খাবে এবং তুমি একা (অর্থাৎ স্ত্রী নয়)। বললাম, “কি ব্যাপার, স্যার?’ ব্যাপার কি সেটা এলে জানতে পারবে। তবে সন্ধ্যাটা চিত্তাকর্ষক হবে আশা করেছি’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। যথাসময়ে জেনারেলের বাসায় পৌছে দেখি সেখানে ওর সাথে বসে আছেন। জেনারেল ওমরাও খান (পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন জি ও সি), পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিষয়ক পরামর্শক গিয়াসউদ্দিন আহমদ আর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান। পরিচয়ের পর জেনারেল কাদের বললেন, ‘এর কথাই তােমাদের বলছিলাম। এঁর কাছে অনেক খবর পাবে বলে আমার বিশ্বাস খলিল, জানােই তাে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর আমাদের বন্ধু দেশগুলাে পাকিস্তানের প্রতি নারাজ হয়েছে ও সাহায্য বন্ধ করতে চাচ্ছে। এই অসন্তুষ্টির কারণগুলাের মধ্যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও অন্যতম। এঁরা এসেছেন এসব বিষয়ে বন্ধু রাষ্ট্রদেরকে পাকিস্তান সম্বন্ধে অবহিত করতে, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ কেন প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল সেটা বােঝাতে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জানাতে। তা পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে তুমিই তাে ভালাে জানাে। বলাে এঁদেরকে। তারপর একটি পানীয় ধরিয়ে দিয়ে ওঁদের সামনে আমাকে বসিয়ে দিলেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না এঁরা কি জানতে চান পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। কথায় কথায় মুখ খােলার সমূহ বিপদ সম্বন্ধে আমরা বাঙালিরা কেউই অনবগত নই। কঠোর পরিশ্রমের চাকরি। অধিকর্তা সবাই অবাঙালি। ক্ষমাশীল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সহানুভূতিশীলদের সংখ্যাও হাতে গােনা যায় (আলতাফ কাদের অবশ্য ব্যতিক্রম)। কাজেই সাবধান হলাম। বললাম, “কি জানতে চান পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে-রাস্তাঘাট, চলাচল, নাকি অন্য কিছু।’ জেনারেল কাদের সরাসরি এলেন প্রশ্নটিতে, এরা জানতে চান শেখ মুজিব যে ছয় দফা দাবি দিয়েছেন সে সম্বন্ধে ।
পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে এর কি প্রতিক্রিয়া হবে বা হচ্ছে বলে তুমি মনে করাে।’ একে তাে রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্ন, তার ওপর চরম সংবেদনশীল বিতর্কিত বিষয়। প্রমাদ গুণলাম। ঠিক করলাম এই প্রশ্নের ধারেকাছেও যাবাে না এঁদের সামনে। জেনারেল একা হলে হয়তাে বলতাম যা জানি। এঁদের কাছে বলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বােকার মতাে মুখ করে বললাম, ‘স্যার, আমি রাজনীতির ‘র’ও বুঝি না। তাছাড়া দেশছাড়া প্রায় দু’বছর। পত্রিকাও পাই না তেমন। কাজেই আমি দুঃখিত যে এ ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ।’ আগন্তুক তিনজন আমার কথা বিশ্বাস করলেন মনে হলাে এবং একটু নিরাশ হলেন। কিন্তু আলতাফ কাদের দমবার লােক নন, কারণ তিনি আমাকে ভালাে করেই চিনতেন পরম স্নেহভরে বললেন, ‘হালিল বে, এঁরা একটা জিনিস জানতে চান। আর তুমি বিষয়টা সম্বন্ধে জানাে। আমি জানি, তুমি জানাে এ সম্বন্ধে বলতে তাে কোনাে দোষ দেখি না আমি।’ কথায় অনেকটা অনুনয়ের সুর। মনটা নরম হলাে। আর ভাবলাম, এরা উচ্চতম পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্তকারী দল। যদি কথাটা ভালাে করে বুঝিয়ে বলা যায় যথা, পূর্ব। পাকিস্তানের জনগণ সত্যিই সত্যিই কি চায়, আর যদি এঁরা সেই আকাঙ্ক্ষা। পূরণে কোনাে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন তবে একজন সত্যিকারের বাঙালি হিসেবে তাে আমার বলাই উচিত তাতে পাকিস্তানের ও পূর্ব পাকিস্তানের দুয়েরই মঙ্গল। তবে হ্যা, এরা যদি মনবিহীন সাধারণ পাকিস্তানি হয়ে থাকে তবে আমার কথাটার উলটো অর্থই করবে। আমাকে পাকিস্তানের দুশমন ভাববে এবং আমার ভবিষ্যৎও হবে ফকফকে। কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। জেনারেল আলতাফ কাদেরের মুখের দিকে তাকালাম। নিঃশঙ্ক চিত্ত ও আশান্বিত একটি মুখ। নিশ্বাস ফেলে সােজা হয়ে বসলাম। বললাম, ‘প্রশ্ন করুন, যা বুঝি ও যা জানি বলার চেষ্টা করবাে। তাদের প্রশ্ন ছয় দফার আসল তাৎপর্য কি, শেখ মুজিব আসলে কি চান? পাকিস্তানকে কি ভাঙতে চান? এটা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল নয়? সাধারণ বাঙালিদের কি এর প্রতি সমর্থন আছে? যথাসম্ভব গুছিয়ে প্রশ্নগুলাের উত্তর আমার নিজের উপলব্ধি অনুযায়ী দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। বললাম, “দেখুন, ছয় দফা কি তা আমি পত্রিকায় পড়েছি। সে সম্বন্ধে আমি মােটামুটি বুঝিয়ে বলতে পারি। আমি জানি সেগুলাে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আপনারা তিনজনেও পড়েছেন। কিন্তু শেখ সাহেবের আসল উদ্দেশ্য কি, তিনি পাকিস্তানকে ভাঙতে চান কিনা, এসব প্রশ্ন শেখ মুজিবকে করাই সর্বোত্তম পন্থা।
তিনি কিংবা তার অন্তরঙ্গ লেফটেন্যান্ট ছাড়া তাে অন্য। কারও তাদের মনের কথা জানার কথা নয়।’ এ সময় আলতাফ কাদের বাধা দিয়ে বললেন, ‘ছয় দফা সম্বন্ধে আমি অতাে গভীরভাবে জানি না। এই দাবির প্রভাব কি কি হতে পারে সে সম্বন্ধে আমি আরও কম জানি। খলিল, তুমি তােমার নিজস্ব চিন্তাধারা সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলল না কেন?’ বুঝলাম আলতাফ কাদের নিজে ব্যাট ধরেছেন। বল করতেই হবে। ভণিতামূলক বল দিয়ে তার মনে আঘাত দেয়া যাবে না। কারণ তিনি তা বুঝতে পারবেন। তখন শান্ত কণ্ঠে ছয় দফার পুনরাবৃত্তি করলাম। মাঝে মাঝে কিছু ব্যাখ্যাও দিলাম। শেষে বললাম যে, এই ছয় দফার একটি পটভূমিকা আছে। এই পটভূমিকাটি হলো ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই কথা শুনে তিন আগন্তুক যেন নড়েচড়ে বসলেন। মনােযােগ আরও তীক্ষ করলেন। বললাম যে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব কোনাে প্রতিরক্ষার বন্দোবস্ত ছিল না। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত ছিল, নিতান্তই ভারতের দয়ার ওপর নির্ভর করে। তবে ভারত সত্যি সত্যি দয়া দেখিয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে নি। আমি তাে জানি, এখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও জানে যে আপনাদের প্রতিরক্ষা পলিসি হলাে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়, নিক। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের একটি বড় খণ্ড দখল করে নেবে। তারপর অস্ত্রবিরতির পর আবার বিজিত ভারত ভূখণ্ডের সাথে বিনিময় করা হবে পূর্ব পাকিস্তানের। অত্যন্ত। চমৎকার একটি চিন্তা। কিন্তু সামান্য একটু মন খুলে চিন্তা করলে চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভারতীয় সিপাহিরা পূর্ব পাকিস্তান জয় করবে। ইচ্ছামতাে আমাদের মা-বােনদের ইজ্জত হরণ করবে। আমাদের সম্পদ, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করবে, তাদের পদাঘাতে আমাদের সমস্ত সত্তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। এদিকে আপনারাও পদানত ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুরূপ আচরণ করবেন এবং তা দিয়ে আমার বােনের ধর্ষণের কথা ভুলে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হবে। এ অত্যন্ত উত্তম কথা; কিন্তু এই ব্যাপারহি দেখা হােক দৃশ্যটা একটু পালটে দিয়ে । ধরুন পাকিস্তানের প্রধান প্রতিরক্ষা শক্তি থাকলাে পূর্ব পাকিস্তানে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা দিল্লি না হােক এলাহাবাদ পৌঁছে গেলাম যুদ্ধ করে। দিল্লি থরথর করে কাপতে লাগলাে এবং জোড়হাতে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে ভারত হাজির হলাে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে পাঞ্জাবের সবটা ভারতীয় সিপাহিরা দখল করে নিলাে এবং ধর্ষণ ও লুটপাট যথারীতি সম্পন্ন হলাে, তারপর অস্ত্রবিরতি ও ভূখণ্ড বিনিময়। এই চিত্রটা কেমন লাগছে আপনাদের?’ আমি প্রশ্ন করলাম ওই তিন আগন্তুককে। আলতাফ কাদেরের মুখ ফ্যাকাসে। তিনজনের একজন বললেন, ‘তােমাদের ভূখণ্ডের অতাে গভীরতা নেই অর্থাৎ তােমাদের অংশ ছােট, দ্বিতীয়ত পাকিস্তানিরা সামরিক দক্ষতায় জগদ্বিখ্যাত। পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা বাস্তব?
উত্তরে বললাম, পাঞ্জাবিদের সামরিক দক্ষতা বর্তমানে আমাদের অজানা নয়। মাতৃভূমি রক্ষার্থে নিযুক্ত কিছু কিছু পাঞ্জাবি ব্যাটালিয়ন ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করতে অপারগ হয়ে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পশ্চাদপসারণ করেছে। অনেকেই পালিয়ে গেছে; কিন্তু আপনারা জানেন পাঞ্জাবের ‘পবিত্র ভূমি রক্ষার্থে। বেদীয়ান সেক্টরে নিযুক্ত হয় প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সিনিয়র টাইগার্স নামে খ্যাত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্য ব্যাটালিয়ন (মােট চারটি মাত্র) পূর্ব পাকিস্তানেই ছিল। পার্শ্ববর্তী কোনাে কোনাে পাঞ্জাবি ব্যাটালিয়ন পিছু হটে গেলেও প্রথম বেঙ্গল ছিল অটল। ডজনখানেক শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করে এই বাঙালি, আপনাদের কাছে ‘নন-মার্শাল’ জাতিগােষ্ঠীর লােকদের দ্বারা গঠিত ব্যাটালিয়ন, প্রথম বেঙ্গল । বহু ক্ষয়ক্ষতি হয় ভারতীয় আক্রমণকারীদের। ফলত, প্রথম বেঙ্গলকে প্রদান করা হয় ১৭টি সামরিক পদক। অন্য কোনাে পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন এতােসংখ্যক পদক পায় নি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে। অতএব, সামরিক দক্ষতায় পাঞ্জাব অদ্বিতীয় একথা আর কেউ না হােক, বাঙালি সিপাহি বিশ্বাস করে না। এটা তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণও করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তারপর রইলাে ভৌগােলিক গভীরতা ইত্যাদি। আপনারা বলবেন যে, উভয় পাকিস্তানকে রক্ষা করার মতাে যথেষ্ট শক্তি পাকিস্তান আর্মির নেই। এর জবাবে আপনাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রশ্ন যে, সমরবাহিনীর জন্য ব্যয়িত অর্থের শতকরা ৫০ ভাগ আসে পূর্ব পাকিস্তান হতে অথচ তা ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায়। পূর্ব পাকিস্তান রয়ে যায় সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত। এটা কেমনতর ন্যায়শাস্ত্র? শেখ মুজিব ঠিক এই প্রশ্নটি রেখেছেন সবার সামনে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সামনে। এক্ষেত্রে কোন ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে তাকে কি দোষ দেয়া যায়? আপনারাই বলুন। যদি শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব একটি প্যারামিলিটারি ফোর্স ছয় দফায় অন্তর্গত করে থাকেন তাকে কি দোষ দেয়া যায়?’ ওমরাও খান দু’ বছর পূর্ব পাকিস্তানে জি ও সি ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে তাঁর বেশ ভালাে জ্ঞান। উল্লেখ্য, বায়তুল মােকাররম নির্মাণের প্রধান উদ্যোগী তিনিই ছিলেন। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানের অনেকের কাছে পরিচিত ও প্রিয়ও ছিলেন। তিনি বললেন, ছয় দফার বাকি দফাগুলাে গ্রহণ করলে তাে পূর্ব পাকিস্তান অনেকটা স্বাধীন হয়ে যায়। এটা কি বাস্তব?’ উত্তরে বললাম, “পাকিস্তানে যদি গণতন্ত্র থাকতাে, তা হলে ছয় দফার প্রয়ােজন পড়তাে না। তখন হয়তাে একজন বাঙালিই হতেন প্রধানমন্ত্রী। আর হলেও কেন্দ্রীয় সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের গুরুত্ব থাকতাে অর্ধেক অর্থাৎ অলঙ্ঘনীয়। কোথাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে অর্থনৈতিক অসমতা (ডিসপ্যারিটি) সেটাও আস্তে আস্তে কমে আসতে বাধ্য হতাে।
চাকরির ক্ষেত্রে (সেনাবাহিনী সমেত) যে অসমতা তাও কমে আসতাে; কিন্তু সামরিক একনায়কতন্ত্রে তাে তা সম্ভব নয়। আর অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে এই সামরিকতন্ত্র পাকিস্তান থেকে যাওয়ার কোনাে লক্ষণ নেই।’ এ সময় ওমরাও খান প্রশ্ন করলেন, তা হলে বর্তমানে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রকে তুমি গণতন্ত্র বলতে চাও না?’ প্রশ্নটি শুনে আমি হেসে ফেললাম; কিন্তু দেখি ওমরাও খান ব্যতীত বাকি তিনজনের মুখেও হাসি। কাজেই ওমরাও খান আর এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করলেন না। বললেন, ‘খলিল, তুমি তাে জানাে তােমাদের পূর্ব পাকিস্তান আগে থেকেই অনেকটা ঐতিহাসিক কারণে পশ্চিমের চেয়ে গরিব; অর্থনীতি, চাকরি-বাকরি, উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি ব্যাপারে অনগ্রসর। তুমি কি মনে করাে না এদিক দিয়ে তােমাদের সাথে পশ্চিমের ফারাক আইয়ুবের আমলে দিন দিন কমে আসছে? এ নিয়ে কিছুক্ষণ আলােচনা ও তর্ক-বিতর্ক হলাে। আমি যা বললাম তার সারমর্ম হলাে, দুই অংশের মধ্যে এই ফারাক দিন দিন বাড়ছে।’ দু’একটি উদাহরণ দিলাম। মনে আছে বলেছিলাম, পি আই এ-তে প্রায় সতেরােশ’ স্থায়ী কর্মচারী আছে। এর মধ্যে বাঙালির সংখ্যা তিনশ’র অধিক নয়। আর চেয়ে দেখুন আমাদের এই দূতাবাসটি। বাঙালিরা তাে কেরানি তৈরি করার জন্য বিখ্যাত; কিন্তু এখানে ২০ জন কেরানির মধ্যে মাত্র ক’জন বাঙালি। এই সময় একটু রূঢ় কথাও বলে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম যে প্রায় অর্ধেক রাষ্ট্রদূতই তাে দেখি অযােগ্য। তাদের প্রধান কাজ তাে বিদেশের দামি বিলাসিতার দ্রব্য, যা আজকাল দেশে অপ্রাপ্য কিংবা দুপ্রাপ্য, সেগুলাের চালান করে দু’পয়সা কামাই করা। এমনি অযােগ্য ও অসৎ লােকও কি পূর্ব পাকিস্তানে দুর্লভ? তারপর সামরিক বাহিনী। কয়েক লক্ষ সৈনিকদের মধ্যে কেবল পাঁচ শতাংশ। বাঙালি হয় কেন? এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এক সময় আলতাফ কাদের বললেন, ‘খলিল যা বলেছে তা যদি সত্য হয় তা হলে তাে আমাদের কিছু করা দরকার ও সেই দরকারও অবিলম্বে। আচ্ছা খলিল, পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষই কি ছয় দফা সমর্থন করে বলে তুমি মনে করাে?’ এ সময় ওমরাও খান বললেন, ‘কাদের, সাধারণ বাঙালি কি বােঝে? তাদের যা বােঝানাে যায় তাই বােঝে । শেখ মুজিব ও তার সঙ্গীরা ঠিক এই কাজটি করছে বাঙালিদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই তাে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।’ | আলতাফ কাদের বললেন, ওমরাও, তােমরা তাহলে শেখকে বন্দি করে এই সমস্যাটার সমাধান করেছ বলে মনে করাে—তাই না? তা হলে তাে আর। দুশ্চিন্তার কোনাে কারণ নেই। এই আলােচনারও কোনাে প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না। তাই না ওমরাও, তাই না গিয়াস সাহেব? কিন্তু একজন দেশবাসী। হিসেবে আমি এতােটা নিশ্চিত হতে পারছি না।
দেখি একজন বাঙালি হয়ে খলিল কি মনে করে। খলিল তুমি মন্তব্য করাে।’ | এ ধরনের প্রসঙ্গে মন্তব্য করা নিরাপদ তাে নয়ই, নেহাত বিপজ্জনক; কিন্তু পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এখন আর পেছানাের উপায় নেই। তাই এগিয়ে চললাম। যা বললাম তার সারমর্ম, আমাদের দেশের মানুষ নির্বোধ, আমি তা মনে করি না। তাদের যা বােঝানাে যায় তাই বােঝে, এ কথায় সামান্য সত্যতা থাকলেও সবটা সত্য নয়। মানুষ সত্য কথা বুঝতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। কোনাে নেতা যদি মানুষের মনের সত্য অনুভূতি বুঝতে পারেন এবং সাহসের সঙ্গে তা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন, তবে মানুষ তাকে অনুসরণ করবে। প্রয়ােজনে মানুষ সেই নেতার কথায় আত্মাহুতি দিতেও প্রস্তুত হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে বাঙালিরা ইংরেজের কাছ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও আসল স্বাধীনতা পায় নি, অর্থনৈতিক মুক্তি পায় নি। কাজেই ছয় দফার আক্ষরিক অর্থে না ঢুকেও সে বুঝে ছয় দফার মতাে একটি দাবি প্রতিফলিত করছে তার অনুভূতি ও তার আকুতি। যদি সেরকম নেতৃত্ব পায় তবে বাঙালি এর জন্য আত্মত্যাগ করবে বলে আমার বিশ্বাস। অতএব, ছয় দফার প্রতি বাঙালি জনগণের একটি সাধারণ সমর্থন আছে বলে আমার বিশ্বাস।’ | আলতাফ কাদের প্রশ্ন করলেন, তাহলে এক্ষেত্রে উপায় কি, আমাদের। করণীয় কি?’ বললাম, “এর উত্তর পাকিস্তানে অবিলম্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর যদি পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশেষ করে পাঞ্জাবের সামরিক/বেসামরিক আমলাতন্ত্র গণতন্ত্র দিতে না চান—তারা চাইবে না বলেই আমার বিশ্বাস, তা হলে উচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফার প্রস্তাব গ্রহণ করা।’ এরপর আলতাফ কাদের প্রশ্ন করলেন, ‘ধর, যদি এর কোনােটাই দেয়া না। হয়। দেয়া হবে না বলেই আমার মনে হচ্ছে।’ | বললাম, তা হলে? অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক এবং অত্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ে কথাটা বলছি, তাহলে একমাত্র অবধারিত পথ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সগ্রাম। সে সংগ্রাম কিভাবে হবে, কিভাবে এগুবে, কি রূপ নেবে জানি না।’ | কথাটা বলে ফেলে যেমন আমি থ হয়ে গেলাম, তেমনি শ্রোতারাও থ হয়ে গেলেন। এরপর আর কথা চলে নি। আর বিশেষ কথা ছিলও না। অল্প পরে ডিনার পরিবেশন করা হলাে এই কথােপকথনটির প্রসঙ্গই তুলেছিলেন বেগম আলতাফ কাদের, ১৯৭৩ সালের ২২ ডিসেম্বর। যাওয়ার সময় জেনারেল কাদের বললেন, সেদিন তােমার।
কথাগুলাে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে রেখাপাত করেছিল; কিন্তু আমিও অতােটা। গুরুত্ব দিই নি কথাগুলােতে। আর আমার মনে হয় ওঁরা তিনজন তাে আরও গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু আমি ও আমার স্ত্রী প্রায় গােটা ১৯৭১ সাল জুড়ে তােমাদের কথা মনে করেছি। তােমাকে খুঁজেছি। একদিন টেলিফোন করেছিলাম; কিন্তু টেলিফোনে তােমার পক্ষে খােলাখুলি কথাবার্তা বলা সম্ভব ছিল না আমি জানতাম । এবার বলাে আমাদের এই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কি?” ব্রিগেডিয়ার রহিমকে বলেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি করলাম। অর্থাৎ, যদি গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় তবে পাকিস্তানের এই চার জাতির সহ-অবস্থান সম্ভব। না হলে দুরূহ। রাতের খাওয়া ছিল জেনারেল সওয়ার খানের বাসায়। পাঠককে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বলছি, ইনি সেই ব্রিগেডিয়ার সওয়ার খান, যিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে শবেবরাত সম্বন্ধে আমি পাকিস্তানে এসেই প্রথম জেনেছি কিনা। তিনি এখন লাহােরের জি ও সি। এক সময় আমার অধিকর্তা ছিলেন তখন বেশ হৃদ্যতা ছিল এই দম্পতির সঙ্গে। অতএব, ভালােই কাটলাে সন্ধ্যার পর্বটা পরদিন ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বেলা দশটার দিকে আমরা লাহাের। বিমানবন্দরে। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব রেডক্রস সংক্ষেপে আই. সি. আর. সি আমাদের সব বন্দিকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। ওদেরই ভাড়া করা বড় জেট বিমানগুলাে। এই আই, সি, আর, সি কর্মকর্তারা ছিলেন সুইজারল্যান্ডের। এদের পেছন ছিল ইউ, এন, এইচ. সি. আর.। জাতিসংঘের খরচেই এতাে বড় ও ব্যয়সঙ্কুল বন্দি বিনিময়। আই. সি. আর. সি করছিল দু’পক্ষের মধ্যে ঘটকালি অর্থাৎ সমন্বয়। | শ’ দুয়েক যাত্রী নিয়ে বিমান উড়ে চললাে ঢাকার দিকে। কয়েক মাস আগে কল্পনা করাও কঠিন ছিল এই মুক্তির দিনটি কবে আসবে কিংবা কখনও আসবে কিনা। নিজেদের ভবিষ্যৎ, জাতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি দুরূহ চিন্তার চাইতে আত্মীয়-স্বজনদের মুখ, আমার গ্রামের বাড়ি ও সেখানকার লােকজনের মুখ এই সব বিশেষ করে ভেসে বেড়াচ্ছিল মনে। জীবনের সবচাইতে আনন্দদায়ক দিনগুলাের অন্যতম ছিল এটি। সন্ধ্যার দিকে বিমান পৌঁছল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। বিমান অবতরণের আগে একবার মনে পড়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্টের কথা, সেদিন ছিল সামরিক জীবনে যােগদানের জন্য যাত্রা। সেদিন এই তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি অভিমুখে আমার যাত্রা। সেই পাকিস্তান থেকে শেষ প্রত্যাবর্তন এমনভাবে হবে ভাবি নি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা