বন্দিজীবন-মন্ডি বাহাউদ্দিন
১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্ডি বাহাউদ্দিন নামক বিশাল এক বন্দিশালায়। এখানে ছিল প্রায় সাড়ে তিনশ’ পরিবার। এখানে ছিলাম আমরা তিনজন ব্রিগেডিয়ার পদবির অফিসার। এদিকে এতােগুলাে পরিবার ও এতােজন অফিসার জেসিওর শৃঙ্খলাবােধও এতাে দীর্ঘ কারাবাসের পর স্বভাবতই অনেকটা ভেঙে পড়েছিল। যিনি নিজে এই বন্দিত্বের অবস্থায় কোনােদিন পড়েন নি, তাঁর পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন এই সত্যটি। আমরা যারা সিনিয়র ছিলাম তাদের পক্ষে এই শৃঙ্খলাহীনতা দেখে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল । আগেকার এই উচুমানের সুশৃঙ্খল বাঙালি অফিসারদের বর্তমান শৃঙ্খলাহীনতা দেখে আমাদের পাকিস্তানি কারারক্ষীরা আনন্দে হাসাহাসি করুক তা কোনাে বাঙালিরই কাম্য হতে পারে না। অতএব, এর প্রতিকারে কতক পদক্ষেপ নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলাম। এই প্রতিকারসমূহ বর্ণনার আগে আমাদের বন্দিজীবনের অনুভূতি, মানসিক ও বাহ্যিক অবস্থার বিবরণ দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে। বন্দিজীবনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অপরাধ মানুষের জন্য যতাে সর্বনেশেই হােক, জেলখানা তার চেয়ে ঢের বেশি। আর একজন বাঙালি কবির কথা, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ স্বাধীনতাহীনতা ব্যক্তির চরিত্র হনন করে। সে আর ‘বিধাতার শ্রেষ্ঠ জীব থাকে না। তার নিম্নগুণ বা দোষগুলােই প্রকট হয়ে ওঠে। উন্নত মস্তক, গর্বিত ও উন্নতমনা মানুষের জায়গায় স্বার্থপর, নিচ, বেহায়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানুষ বা অমানুষে পরিণত হয় বেশির ভাগ মানুষই হ্যা, ব্যতিক্রম থাকেন কিন্তু তারা সম্মানিত ব্যতিক্রমই। একজন বন্দি তাঁর ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে একটি সংখ্যায় পরিণত হয়। যেহেতু তখন তার আত্মপরিচয়, সামাজিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়, পরিশ্রমে সে যে প্রতিষ্ঠা। লাভ করেছিল সে প্রতিষ্ঠার গৌরব তার লােপ পায় এবং সে হয়ে যায় একটি অব্যক্তিত্ব অর্থাৎ নন-এনটিটি, তখন কোনাে নিচ কাজ করতে তাঁর আর বাধে না। যেমন আগেই আভাস দিয়েছি, সবাই যে এরূপ পশুত্বের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এবং গোড়াতেই সেটা ঘটে তা নয়। সকল মানুষের মনের জোর এক নয়। মানবত্ব থেকে পশুত্বের পর্যায়ে কে কতাে দ্রুত তলিয়ে যাবে তা নির্ভর করে মনের জোর কার কতাে বেশি বা কম তার ওপর। যার মনের জোর প্রচণ্ড, সে হয়তাে বহু বছরের বন্দিজীবনেও পশুত্বের স্তরে নামে না। উদাহরণ দেয়া যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার।
২৮ বছর একটানা অত্যন্ত হেয় ও অমানবিক বন্দিজীবনেও তার অশেষ অফুরন্ত মনের জোর কমে নি। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে, একদিন একজন কারা অফিসার তার সাথে নির্দয় ব্যবহার করেছিল এবং অত্যন্ত কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করেছিল। সেদিন সে ব্যবহারে তার ধৈর্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং তিনি কারা অফিসারকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। টেবিলের অপর পাশে বসা অফিসারের কাছে তিনি যখন টেবিল ঘুরে পৌছলেন, ওই মুহূর্ত কয়েকের মধ্যে ম্যান্ডেলার স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ফিরে এলাে। তিনি উদ্যত হাত নামিয়ে নিলেন। নিজেকেই বললেন, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। অনেক কাজ এখনও বাকি। তবে ম্যান্ডেলার মতাে মনের জোর কম লােকের থাকে। আমাদের মধ্যে কিছুটা হলেও মনের জোর কারাে কারাে ছিল। তাই রক্ষা। | মনে আছে একদিন অনুরূপ একটি দুর্বল মুহূর্তে এমন এক কাণ্ড আমি নিজেও করে বসেছিলাম। ক্যাম্পের অফিসারদের উদ্ধৃঙ্খলতা, কর্তৃপক্ষের। অপমানকর ব্যবহার ইত্যাদি মিলিয়ে মনটা ছিল যেমনি বিষন্ন, তেমনি তিক্ত। এমতাবস্থায় আমাদের বড় ছেলেটি অবাধ্যতা ও মুখের ওপর জবাব দিয়ে মেজাজ একেবারে খিচিয়ে তুললাে। অথচ ছেলেটি আমাদের শান্ত ও সংযত স্বভাবের এবং ছােটবেলা থেকেই পরিপকৃ-মনা। বন্দিত্ব ওকেও নিশ্চয় ওই মুহুর্তে অনুরূপভাবে প্রভাবান্বিত করে রেখেছিল। রাগের মাথায় চিৎকার করে বলে দিলাম, বেরিয়ে যা।’ ওর বয়স তখন ১৫/১৬ বছর, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। তখন বেলা গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যা আসন্ন। সেও রাগের মাথায় এক কাপড়েই বেরিয়ে গেল পেছনের মাঠের দিকে। ওদিকে কাঁটাতারের বেড়া; কিন্তু পাশের গাছে চড়ে লাফ দিয়ে তারের বেড়া অতিক্রম করা খুব দুঃসাধ্য নয়। ও কিছু দূর যাওয়ার পরই আমার চেতনা ফিরে এলাে। আমার স্ত্রীও হতবাক, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছেলে আমার জেদি, স্বভাব-শান্ত ছেলেরা যা হয়। জীবনে কোনাে দিন আমাদের মধ্যে কটুবাক্য বিনিময় হয় নি। জানতাম আমি সে মুহূর্তে মাফ চেয়ে ওকে ফিরতে বললেও ফিরতাে না। আমার স্ত্রীও জানতেন সে কথা। দুঃখে-ক্ষোভে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছিল। এ অবস্থায় পাঠান মুলুকে এই সময় বেরিয়ে গেলে ওর কী হবে চিন্তাও করতে পারছিলাম । আর ধরা পড়লে যে কি হবে তাও বলাই বাহুল্য। যা হােক, ঘণ্টাখানেক মাঠেই দাঁড়িয়ে থাকলাে। তারপর ধীর পদক্ষেপে বাসায় ফিরে এলাে।
জিগ্যেস করি নি কিছু, কিন্তু তারও স্বাভাবিক চেতনা ও চিন্তা নিশ্চয় ফিরে এসেছিল কিছুক্ষণ পরেই। ঘটনাটি উল্লেখ করার প্রয়ােজন মনে করলাম, বন্দিজীবন মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার কতােটা অবনতি ঘটায় তার একটা উদাহরণ হিসেবে। আগেই বলা হয়েছে, আমাদের ভাতা কমে যাওয়ার দরুন পিণ্ডিতে আমরা একটি সাহায্য তহবিল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পিণ্ডিতেই এর জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করি। আমাকে সভাপতি ও কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) ডা. এ আর খানকে সম্পাদক করে এই কমিটি গঠিত হয়। আমাদের কাজ ছিল অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অফিসারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে তা বিতরণ করা। এ কাজ করতে গিয়ে দেখি কিছু কিছু কর্মচারী আছেন যারা সত্যি সত্যিই অভাবী। যাদের পােষ্য বেশি তারাই সাধারণত এই শ্রেণীর; কিন্তু কিছু ব্যক্তি আছেন। যারা পূর্বাপর বিবেচনাশূন্য, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও স্বার্থপর এবং খরচে স্বভাবের লােক। হয়তাে আগামীকাল তাঁর ছেলেপুলেকে উপবাস করতে হবে, কিন্তু আজ তিনি অপ্রয়ােজনীয় খরচ করেই চলেছেন। এদের বেশির ভাগ হাতপাতা স্বভাবের হয় এবং বাড়ি এসে জ্বালাতন করে। অসীম ধৈর্য সহকারে কর্নেল এ আর খান বিতরণের কাজ করতেন। এই সময় আমাদের আরও একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, দায়িত্ব ও কাজ না থাকলে মানুষ বাজে কাজ বেশি করে ও বাজে কথা বেশি বলে । এই কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্তের পেছনে কল্যাণমূলক উদ্দেশ্য ছাড়াও অন্য একটি বড় উদ্দেশ্যও ছিল। আমরা জানতাম ওই ‘হাতপাতা’ স্বভাবের লােকগুলাে শিগগির পাকিস্তানিদের কাছে গিয়ে ধরনা দেবে। পাঞ্জাবিদের চোখে হেয় হওয়া? সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এই সম্ভাবনা ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্হিত ও অবমাননাকর। তাই সমূহ ত্যাগ স্বীকারও আমাদের অনেকের কাছে তুচ্ছ মনে হতাে তখন। আমাদের মহিলারাও তাই তাঁদের। গোপনে জমাকৃত টাকা থেকে হাসিমুখে আমাদের চাঁদা দিয়েছেন। এই দেখে কিছু নিষ্কর্মা অফিসার তাদের কর্মবিহীন আড্ডায় বসে কঠোর সমালােচনা করতে লাগলেন এই কমিটির কাজ সম্বন্ধে। এমনকি তাদের কথাতে এটাও স্পষ্ট হতে লাগলাে যে, কমিটি দুনীতিপরায়ণ। ভাবতেও অবাক লাগে যে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র ধরনের এই ফান্ডটি সম্বন্ধেও তারা সন্দেহ পােষণ করছেন। একদিন এই আড্ডায় নায়ক গােছের এক অফিসারকে ডেকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম এবং অত্যন্ত সুচারুরূপে সংরক্ষিত কমিটির হিসাব-নিকাশের বইটি নিরীক্ষা করতে বললাম।
এতােটা সে আশা করে নি। কাচুমাচু মুখে সে বলতে লাগলাে, ‘স্যার, আমরা কি আপনাদের মতাে সিনিয়র অফিসারদের সন্দেহ করি?’ ধমকের সুরে বললাম, “তােমাকে যা করতে বলা হয়েছে তাই করাে।’ অগত্যা সে হিসাব পরীক্ষা করতে বাধ্য হলাে। নিরীক্ষা শেষ হলে তাকে বলা হলাে, এইবার তােমার মন্তব্য লেখ এবং দস্তখত করাে। বলাবাহুল্য, অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে সে তাই করতে বাধ্য হলাে। এরপর আর এই কমিটির কাজ নিয়ে কোনাে গুঞ্জরণ শােনা যায় নি। বন্দিজীবন বড়ই অদ্ভুত। নওশেরা ছাউনি পেশাওয়ার থেকে মাইল পচিশেক দক্ষিণে রাওয়ালপিণ্ডির পথে ওখানে আমাদেরকে নেয়া হয় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। আবার ওখান থেকে আমাদের নেয়া হয় মন্ডি বাহাউদ্দিন। জায়গাটি পাঞ্জাবের ঝিলাম ও গুজরানওয়ালা জেলার সংযােগস্থলে। ওখানে যাই আমরা ১৯৭৩ সালের শুরুতে, ফেব্রুয়ারি/মার্চের দিকে। আগেই বলেছি, যে-তিনটি ক্যাম্পে আমি দেড় বছর কাটিয়েছি তার মধ্যে একমাত্র নওশেরার অবস্থান ছিল অপেক্ষাকৃত সহনীয়। আমাদের তিনটি ছেলে ও বড় একটি মেয়ে। মেয়ের বয়স ১৯ ছােট ছেলেটি বছর তিনেকের। এছাড়া আমার মা ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এই আটটি মানুষের খরচ ছিল যথেষ্ট। কতােদিন এই কারাবাস চলবে জানতাম না। সঞ্চিত টাকাও ছিল সীমিত। স্ত্রী ও মেয়ের গায়ে কিছু অলঙ্কারাদি ছিল। দুর্দিনের সহায়ক হিসেবে সেগুলাের দিকে নজর ছিল সবার; কিন্তু মাঝে মাঝেই শুনতে পেতাম পাকিস্তানিরা। ওগুলােও নিয়ে নেবে জোর করে। অত্যন্ত অসহায় লাগতাে তখন। প্রচণ্ড রকমের ব্যয় সঙ্কুলান করে চলতাম আমরা। গরুর মাংস আনুপাতিক হারে সস্তা ছিল বলে গরুর গােশত আর সবজি চলতাে মাসের পর মাস জুড়ে। ছেলেপিলেরা বায়না ধরতাে অন্য কিছু খাওয়ার জন্য, কিন্তু উপায় ছিল না। তবে খাওয়ার কথাটা বড় ছিল না। মারাত্মক প্রশ্ন ছিল নিরাপত্তার। নানা রকমের গুজব শুনতাম। মৃত্যুর ভয়ও বিশেষ কাবু করতে পারতাে না। কাবু হয়ে যেতাম মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে। রাতে ভালাে ঘুম হতাে না কারােরই।
মন্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলাে স্পেশাল ট্রেনে করে। কোহাট, পেশাওয়ার ও অন্যান্য নানা ক্যাম্প বন্ধ করে পাঞ্জাব ও ফ্রন্টিয়ার এলাকার সবাইকে একই ক্যাম্পে নেয়া হলাে। ঝিলাম হাইড্রো ইলেকট্রিক বাধের জন্য তৈরি হয়েছিল এই ক্যাম্পটি। অনেকগুলাে ছােট ছােট বাড়ি। কোনােটা এক কামরা, একটি বসার ঘর ও একটি বাথরুম এবং একটি রান্নাঘর। ছাদ নিচু, অত্যন্ত গরম। কোনাে গাছপালা নেই। এই বাসাগুলাে পরিবারসহ দু’জন অফিসারকে বরাদ্দ দেয়া হলাে। আর এক শ্রেণীর বাসা ছিল দুই বেডরুমের। সেগুলােতে বড় ছেলেমেয়েসহ দুই পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া হলাে। আর কিছু ছিল তিন বেড রুমের ও দুই বাথরুম। সেগুলাে দেয়া হলাে তিনটি পরিবারকে; কিন্তু মুশকিল হলাে, যখন দেখা গেল এই তিনটি পরিবারেই বয়স্ক ছেলেমেয়ে আছে—কেউ কেউ কলেজে পড়ে। মনে পড়ে এই তিন শােবার ঘরসমেত একটি বাসায় তিনজন অফিসার ছিলেন যাদের দশ বছরের অধিক বয়স্ক ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল তিন পরিবার মিলে সতেরােজন। দুটি বাথরুম ও একটি রান্নাঘর। বস্তুত এই অবস্থা দোজখখানাই মনে করিয়ে দেয়। একে তাে থাকার এই ব্যবস্থা, তার ওপর টাকার ভাবনা, ভবিষ্যৎ চিন্তা ও সর্বোপরি বন্দিজীবনে মানবিক মূল্যবােধের অবক্ষয়। মনােমালিন্য, ঝগড়াঝাটি জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললাে। মন্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পের এই অংশটি বরাদ্দ ছিল পরিবারসহ তিনশ’ অফিসারের জন্য। এর বাইরে আর একটি অংশ ছিল পরিবারসহ সুবেদার ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের জন্য। তাদের অবস্থা শুনেছি আরও খারাপ। এছাড়া এই ক্যাম্পের আরও দুটি অংশ ছিল- একটি পরিবারহীন নিম্নপদস্থদের জন্য, অন্যটি পরিবারহীন অফিসারদের জন্য। এগুলাে ছিল শ্রমিক কলােনির ব্যারাক। প্রত্যেকেরই অবর্ণনীয় অবস্থা। এছাড়া আমাদের অংশে কয়েকটি বাড়িতে ভৃত্যদের কোয়ার্টার্স ছিল। সেখানে রাখা হয় অধিক পােষ্যসহ কয়েকজন সুবেদার সাহেবকে। শুনেছি এঁরাই নাকি সবচেয়ে ভাগ্যবান ছিলেন।
এই সমগ্র বন্দিশালাটি উচু ও ডবল কাটাতার দিয়ে ঘেরা। আবার এটি ছিল তিন ভাগে বিভক্ত। প্রত্যেক অংশের জন্য একটি করে গেট—প্রহরী বেষ্টিত। কারও বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একটি ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠা করা হয়। চালডাল, মশলাপাতি ও গরুর গােশত থাকতাে সেই ক্যান্টিনে। লাইন লাগিয়ে কিনতে হতাে জিনিসপত্র। দামও বেশি। কালেভদ্রে এক আধদিন স্থানীয় গ্রামবাসী ক্যাম্পের অনুমতি নিয়ে এক আধ ঝুড়ি মাছ আনতাে। সেদিনটাতে হতে প্রবল সমস্যা। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তাে মাছের ওপর। একদিনের ঘটনা। এক ঝুড়ি মাছ এসেছে। তার মধ্যে কেজি দেড়েক পাবদা মাছ। সবারই চোখ পাবদার দিকে। কেউ কেউ বলাবলি করছেন, পাবদাগুলাে একটা দুটো করে ভাগ করে নিলে কেমন হয়। এই সময় একজন সিনিয়র মেজর পাবদাগুলাে হাতে তুলে হঠাৎ দিলেন দৌড়। প্রথমটা সবাই কিছুটা হতভম্ব। পর মুহূর্তে একজন সুঠামদেহি ক্যাপ্টেন দৌড়ালেন মেজরের পেছন পেছন। একশ’ গজ গিয়ে ধরে ফেললেন মেজরকে। তারপর ধস্তাধস্তি, গালাগালি ও মারামারি। আগেই বলেছি বন্দিজীবন মানুষকে নিচ করে দেয়। এঁরা সবাই কমিশড় অফিসার। এরকম দু’চার কেজি পাবদা মাছ দুপ্রাপ্য হলেও তারা স্বাভাবিক সময়ে পরস্পরকে উপহার দিয়ে অভ্যস্ত। ইতােপূর্বে পেশাওয়ার থেকে আগত একজন অফিসারের মুখে শুনেছিলাম ওখানে ওঁরা প্রায় গােটা দশেক পরিবার ছিলেন, অবিবাহিত অফিসারদের মেসের থাকার কামরাগুলােতে। পানির লাইনটি এক প্রান্ত থেকে ঢােকে ও অপর প্রান্তে শেষ হয়। পানির টানাটানি প্রায়শ লেগে থাকতাে। ক’জন অবিবাহিত অফিসারের জন্য নির্মিত ট্যাঙ্কটির পানি দশটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই অবস্থায় নাকি প্রথম প্রান্তে অবস্থিত এক মহিলা সাত সকালে উঠে সমস্ত কাপড় কাচা ও ধােয়া-মােছা সেরে বড় বড় বালতি ভরতি করতেন। তারপর পানির কলটি পুরাে খুলে দিতেন। ঘণ্টাখানেক খােলা কল চলার পর ট্যাংকের সব পানি পেছনের নালা দিয়ে বেরিয়ে যেত। পরে বাকি নয়টি পরিবারের সদস্যরা কোনাে পানি পেতেন না। হয়তাে দৈনন্দিন মনােমালিন্যের প্রতিশোধ হিসেবে এটিকেই সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রথমােক্ত মহিলা ও তাঁর স্বামী। অনুরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলাে। এসব দেখেশুনে এবং আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তা করতে লাগলাম এর একটা বিহিত করা দরকার। এসব ঘটনার ব্যাপারে যদি কোনাে অফিসার পাকিস্তানি কারারক্ষীর কাছে নালিশ করতেন তবে শুরু হতাে অত্যাচার ও অবিচার। ফলে আমাদের হেয়। জীবনে নেমে আসতাে হেয়তর অবমাননা। ক্যাম্পে আমরা তিনজন ব্রিগেডিয়ার ছিলাম। তার মধ্যে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জব্বার।
সিদ্ধান্ত হলাে তিনি হবেন সিনিয়র বাঙালি অফিসার অর্থাৎ এস বি ও তাকে ক্ষমতা দেয়া হলাে অনুরূপ শৃঙ্খলাভঙ্গের বিচার ও শাস্তি বিধান করার। আমরা দুজন ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হক ও আমি, এস বি ও সাহেবের উপদেষ্টা নিযুক্ত হলাম। অর্থাৎ আমরা তিনজন মিলে বিচার-আচার করবাে ও শৃঙ্খলাজনিত নির্দেশাবলি প্রচার করবাে। বিচার-আচার ছাড়াও আরও কতক ব্যাপার সমন্বয় করাও প্রয়ােজন ছিল। যেমন, আমাদের ক্যাম্পের জন্য একটি ডিসপেনসারি ছিল। কিছু ওষুধ সেখানে ছিল কিন্তু কোনাে নিয়মিত ডাক্তার ছিল না। অথচ আমাদের বন্দিদের মধ্যে অনেক খ্যাতনামা ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এঁরা সবাই রােগীদের। সেবা করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। অনেক মহিলা গর্ভবতী ছিলেন। তাদের জন্য কোনাে গাইনি বিশেষজ্ঞ ছিল না। অথচ আমাদের মধ্যে গাইনি। মহিলা বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ছিলেন। এদেরকে কাজে লাগানাে ও এঁদের কাজের সমন্বয় করা একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল এস বি ও সাহেবের। তাছাড়া আমাদের সন্তানদের মধ্যে কলেজ ও স্কুলে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ছিল। তাদের স্কুল-কলেজের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। এদিকে আমাদের মধ্যে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন। তাই সমন্বিতভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করাও একান্ত। প্রয়ােজনীয় ছিল। এস বি ও অফিস স্থাপনা অর্থাৎ বাঙালি বন্দিদের ওপর বাঙালি কমান্ড প্রতিষ্ঠা আমাদের অনেক বন্দির পছন্দসই ছিল না। এটা আমরাও জানতাম । মানবসমাজে কিছু লােক সর্বদাই থাকে যাদের আত্মসম্মানবােধ কম। তারা স্বাধীনতার চাইতে পরাধীনতা বেশি পছন্দ করে। ইংরেজ আমলেও দেখেছি কিছু ভারতীয় নিজেদের মধ্যকার গুণী ব্যক্তিকে সম্মান করতেন না, মান্য করা তাে দূরের কথা। তারা অনেক নিচু স্তরের হলেও ইংরেজ শাসকের পদসেবা করতে বেশি আগ্রহী হতেন। কারণ তার মাধ্যমে কিছু অন্যায্য পাওনা আদায়। সহজ হতাে। প্রয়ােজনে স্বদেশি ভারতীয়দের বিরুদ্ধেও তারা ইংরেজ শাসককে খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করতেন। ইংরেজও এদের ‘লয়ালিস্ট’ হিসেবে প্রশ্রয় দিতাে এবং সংরক্ষণ করতাে। এদের সাহায্যেই তারা উন্নতমনা ভারতীয়দের কাবু রাখতাে। পাকিস্তানি শাসন আমলেও এই শ্রেণীর নিচ চরিত্রের লােক বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে নিজের আখের গােছাতে প্রয়াস পেত। আমাদের বন্দিশিবিরেও এই রকম অফিসারের অভাব ছিল না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সিনিয়রও ছিলেন।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষও আমাদের সংগঠনটিকে সুনজরে দেখতেন না। কিন্তু নওশেরা-লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ঠিক করলাম যে, প্রয়ােজনে দৈহিক শক্তি দিয়ে হলেও আমরা বাঙালি কমান্ড স্থাপন করবাে। যেহেতু অধিকাংশ মানুষ হয় আত্মমর্যাদাপূর্ণ, অতএব এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের আশীর্বাদপুষ্ট কমান্ড, ওই কিছুসংখ্যক হীনমনাদের কাবু রাখতে সমর্থ হবে। আমরা এও জানতাম যে, হীন চরিত্রের লােক সাহসী হয় না। সৎসাহস ও সূক্ষ্ম সুবিচার দ্বারা এঁদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই কমান্ড প্রতিষ্ঠার আরও একটি বড় প্রয়ােজন ছিল। আমরা জানতাম যে, কারা কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ হীনমনাদের সাহায্যে প্রয়ােজনমতাে আমাদের অপমান করবে। আমরা যদি পরিবারহীন সৈনিক হতাম তাহলে হয়তাে এই অপমান সহনীয় হতাে। কিন্তু আমাদের মধ্যে ছিলেন মা, বােন ও সােমত্ত। মেয়েরা। প্রাণের বিনিময়ে হলেও এঁদের সম্মান তাে রক্ষা করতেই হবে। অতএব, একটি মজবুত সংগঠন একান্ত আবশ্যক। আগেই বলেছি, আমাদের তিনশ’ পরিবারের এই ক্যাম্পটি ছিল তিনভাগে। বিভক্ত—এ, বি ও সি। ‘এ’ বিভাগে ছিল প্রায় শ’দেড়েক পরিবার। ‘বি’ এবং ‘সি’ বিভাগে বাকি ১৫০টি। এই বিভাগগুলাে কাছাকাছি হলেও কাটাতারের বেড়ার সাহায্যে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন। প্রত্যেকটির আবার আলাদা গেট ও আলাদা প্রহরী । ডিসপেনসারিটি ছিল ‘এ’ বিভাগে। ‘বি’ ও ‘সি’ বিভাগের রােগীদের অনুমতি নিয়ে যেতে হতাে ডিসপেনসারিতে। এই অনুমতি পাওয়া ছিল এক তিক্ত সমস্যা এবং কারা কর্তৃপক্ষের নেহাত মর্জির ওপর নির্ভরশীল। অথচ রাত দুপুরেও কোনাে দুর্ঘটনা কিংবা সহসা করে অসুখ ঘটতে পারে এবং ঘটতাে। অতাে রাতে অনুমতি গ্রহণ ও রােগীর নিরাপত্তা বিধান, বিশেষ করে যদি মহিলা রােগী হতেন, ছিল একটি বড় সমস্যা। দ্বিতীয়ত ছিল স্কুল ও কলেজ সমস্যা। একটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠাই অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তিন-তিনটি করে বিদ্যালয় তাে অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য বিভাগগুলাের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যােগাযােগ প্রয়ােজন যাতে ছাত্রছাত্রীরা বাকি দুই বিভাগ থেকে একই স্কুলে আসতে পারে। | এসব বিবেচনা করে ঠিক করা হলাে প্রত্যেক বিভাগের কার্যক্রমে একজন। বাঙালি কমান্ডার থাকবেন। এই তিন কমান্ডার মিলে এসব কাজের সমন্বয় করবেন। স্বভাবতই প্রথমে কর্তৃপক্ষ বাধা দিয়েছিল; কিন্তু ততােদিনে আমাদের সংগঠন অনেকটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
এস বি ও অফিস এবং আরও দশ-বারােজন সিনিয়র অফিসার মিলে কর্তৃপক্ষের সাথে আলােচনা করা হলাে। আমাদের সংগঠনকে সহায়তা করলে প্রতি-সহযােগিতা দেয়া হবে, অন্যথায় যে-কোনাে পরিস্থিতি সামলানাের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, এইরূপ একটি আভাস পরিষ্কারভাবেই দিলাম কর্তৃপক্ষকে। এও বুঝিয়ে দিলাম যে, বন্দিদের শৃঙ্খলাজনিত বিচারে যদি আমরা মনে করি যে অবিচার হয়েছে তবে আমরা সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ করবাে। তাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলানাের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই কর্তৃপক্ষের। বলাবাহুল্য, ভয় দেখানােও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। এতে কিছু কাজ হলাে। আমরা কর্তৃপক্ষকে আরও কথা দিলাম যে, বিচার ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভার আমাদের ওপর ন্যস্ত করা হলে তার দায়দায়িত্ব আমরাই নেবাে। কর্তৃপক্ষ সবাই ছিলেন চাকরিজীবী। গােলযােগ হলে তাদের চাকরির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। এসব ভেবে তারা রাজি হলেন। ক্যাম্প তিনটির মধ্যে। আন্তঃযােগাযােগের অনেকটা অধিকার আমাদের দেয়া হলাে। ‘বি’ এবং ‘সি’ বিভাগেই বেশির ভাগ সিনিয়র অফিসার ছিলেন। ক্যাম্প দুটি ছিল পাশাপাশি। ‘এ’ বিভাগ একটু দূরে। ‘বি’ বিভাগে একটি মাঠ ছিল। সেখানে স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলাে। এর অধ্যক্ষ হলেন শিক্ষা বিভাগের অভিজ্ঞ একজন মেজর। অসাধারণ কর্মোদ্যোগী, স্বার্থহীন ও নিবেদিতপ্রাণ পুরুষ। তিনি সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্কুল ও কলেজ গড়ে তুললেন। শিক্ষক আমরা সবাই। স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে অনেকে এগিয়ে এলেন। মহিলারাও এলেন। শিক্ষকের অভাব নেই। গাছতলায়, মাটিতে বসে ক্লাস। শিক্ষার মাঝে। মাঝে মাঠে খেলাধুলা। কলেজের ছাত্রছাত্রী কম। তারা বিভিন্ন বৈঠকখানা ঘরে বেশির ভাগ ক্লাস করতে লাগলেন। বৈঠকখানা ঘরটিতে রাতে বিছানা পাতা। হতাে—দিনের বেলায় চলতাে ক্লাস। অল্প ছাত্র। পিতামাতারাই শিক্ষক, অল্পদিনেই স্কুল-কলেজের মান অবিশ্বাস্য রকমের উচুতে পৌঁছলাে। ছাত্ররা বলাবলি করতাে এমন মানের শিক্ষা তারা আগে কখনাে পায় নি। ডিসপেনসারিটিও একটি উঁচুমানের চিকিৎসালয়ে পরিণত হলাে। চিকিৎসকরা বড় বড় বিশেষজ্ঞ এবং তাদের হাতে সময়ও অফুরন্ত। ওষুধপত্র অনেক ক্ষেত্রে রােগী নিজে ক্রয় করতেন। যারা অপারগ ছিলেন, তাঁদের জন্য চাদা তুলে ওষুধপত্র ক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এদিকে আরও একটি সমস্যা দেখা দিলাে। শােনা গেল এমন পরিবারও আছে যারা ছেলেপুলেদের দু’বেলা খেতে দিতে পারে না। অতএব, পুনরায় চালু করা হলাে সাহায্য কেন্দ্র। ওই অবস্থার মধ্যেও অনেকে যথাসাধ্য অনুদান দিলেন।
তখন কেউ জানতাম না কতােদিন, কতাে বছর আমাদেরকে এই বন্দিশালায় জীবনযাপন করতে হবে। তাই অনুদান দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও অনেকে সাহস পেতেন না সঞ্চিত অর্থ দান করতে। কাজেই অনুদান ছিল অতি অল্পই একদিনের একটি ঘটনা এখনও মনে দাগ কেটে আছে। আমাদের বিভাগে একজন সুবেদার ছিলেন। তাঁর সাতজন ছেলেমেয়ে। শুনলাম সে পরিবার প্রায়ই অভুক্ত থাকে। লােক পাঠানাে হলাে তার কাছে একটি দরখাস্ত করার অনুরােধ জানিয়ে। আমরা অপেক্ষা করছি প্রেরিত লােকটির ফেরত আসার জন্য লােকটি ফেরত এলাে অধােমুখে। হাতে দরখাস্ত নেই। একটু আমতা আমতা করে যা বললাে তার মর্মার্থ দাঁড়ায়- সুবেদার সাহেব দরখাস্ত করবেন না। আমরা তিনজন অবাক। কৌতূহলও হলাে। সুবেদার সাহেবের বাসা নিকটেই। তাকে ডেকে পাঠালাম তিনি এলেন অত্যন্ত সৌম্য চেহারার পঞ্চাশাের্ধ ব্যক্তি। মুখে দাড়ি টকটকে চেহারায় নম্রতা ও ভদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট। অভাবী লােকের যে ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা থাকে তার কোনাে চিহ্ন নেই মুখে। বসতে বলায় বিনীতভাবে বসলেন জিগ্যেস করলাম, কেমন আছেন।’ উত্তর, ভালাে স্যার।’ বললাম, “শুনলাম আপনি অত্যন্ত অর্থাভাবে আছেন।’ তিনি ইতস্তত করতে লাগলেন। বললাম, তবে আপনি একটা দরখাস্ত করুন না। তার উত্তর শুনে আমরা হতবাক। তিনি বললেন, হাদিসে আছে নিজের অভাব-অভিযােগ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বলা ঠিক নয়। মুখ দিয়েছেন আল্লাহ, আহার তিনিই দেবেন।
এখন কিছু কষ্ট যাচ্ছে। আল্লাহই উপায় করবেন। বলেই মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। এরপর আমাদের মুখে রা সরার কথা নয়। কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, যদি আল্লাহর ওয়াস্তে আমরা আপনাকে কিছু সাহায্য কিংবা কিছু কর্জ দিই, নেবেন? অত্যন্ত স্বস্তির সাথে শুনলাম তার উত্তর, ‘যদি আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দান করেন কিংবা ধার দেন তা নিতে মানা নেই। নেবাে।’ সম্পূর্ণ আল্লাহ নির্ভর (তাওয়াক্কুলুল্লাহ) মানুষের কথা শুনেছি। মনে হলাে আজ নিজের চোখে দেখলাম। আমাদের শােবার জন্য খাটিয়া ছিল; কিন্তু আর কোনাে আসবাবপত্র ছিল। টিনের বাক্সগুলােকে সবাই বসার জন্য ব্যবহার করতেন। দেয়ালের পাশে ওগুলােকে রেখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসাই ছিল আরামদায়ক। খাওয়া হতাে মেঝেয় বসে পত্রিকার কাগজের ওপরে। খাওয়া শেষে কাগজগুলাে পুনরায় ব্যবহারের জন্য যত্ন করে তুলে রাখা হতাে। একটি রান্নাঘর পর্যায়ক্রমে দুইতিন পরিবারের রান্না চলে সেখানে। ঝগড়াঝাটি হওয়ার কথাই—হতােও; কিন্তু বেশি সমস্যা হতাে বাথরুম নিয়ে। কারও উদরাময় হলে সমস্যা করুণ আকার ধারণ করতাে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে যে উল্কণ্ঠার ছাপ ছিল সবার মুখে তা ছিল নিরাপত্তা, বিশেষ করে মেয়েদের আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এভাবে কতােদিন চলবে? এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরম। ছায়ার মধ্যেই ১১৪° ফারেনহাইট। রাতে দেয়াল ও ছাদ থেকে যেন আগুনের হলকা বেরুতে। এখানকার লােক রাতে বাইরে খােলা আকাশের নিচে শােয়। এজন্য বাড়ির পেছনে কিংবা ছাদে জায়গা থাকে। আমাদের অভ্যেস নেই, তাছাড়া এতােগুলাে মানুষের শােয়ার জায়গাও ছিল না বাইরে। গরমে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলাে। কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করা হলাে। তারা এর কোনাে সদবিহিত করতে পারবেন না বলে জানালেন। শেষে ঠিক হলাে ক্যান্টিনে পাখা রাখা হবে—ছাদ পাখা ও মেঝে পাখা। বন্দিদের তা কিনে নিতে হবে।
অগত্যা তাই হলাে। বেশির ভাগ পরিবারই একটির বেশি পাখা কিনতে পারে নি। সমস্ত পরিবারের জন্য একটি পাখা; কিন্তু পাখাটি পেয়ে মনে হলাে অকস্মাৎ স্বর্গবাস করছি। আমার কাছে চারটি সাধারণ কম দামি ডেক চেয়ার ছিল। যেহেতু মালের। পরিবহনের ওপর কোনাে নিষেধাজ্ঞা ছিল না, চেয়ারগুলাে আমি নিয়েই এসেছিলাম। ওর দু’খানা দুই বন্ধুকে ধার দিলাম। নিজে রাখলাম দু’খানা। ওই দু’খানা চেয়ারের জন্য আমার বাসাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রাত দশটায় খাওয়া-দাওয়ার পর কর্নেল (পরে জেনারেল) দস্তগীর আসছেন। এসে বলতেন, ‘স্যার, আপনার ঘরের সামনে বসে একটা সিগারেট খাবাে। আপনার একটা চেয়ার কিছুক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে পারি?’ একথা শুনে সজোরে হেসে উঠলেও অন্তরটা কান্নায় ভেঙে পড়তাে। সঙ্গে থাকতেন বেগম দস্তগীর। তার আবার পােলিও রােগে ভােগার দরুন ছােটবেলা থেকেই একটা পা অকেজো। তিনি নিচে বসতে পারতেন না। তাদেরকে দুটো চেয়ার দিয়ে রােয়াকে বসতাম আমরা দু’জন। অপেক্ষাকৃত সহনীয় তাপে রাত বারােটা পর্যন্ত গল্প চলতাে; কিন্তু কখনও কেউ কাউকে ফেলে আসা দিনগুলাের কথা স্মরণ করিয়ে দিতাম না। পাকিস্তানিরা আর কী কী অত্যাচার আমাদের ওপর করতে পারে তার কল্পনাই স্থান পেত গল্পে বেশি। তখন খুব গুজব চলছিল যে, পাকিস্তানিরা আমাদের ঘর সার্চ করবে ও অলঙ্কারাদি কেড়ে নেবে। অলঙ্কার হারানাের চাইতে ঘর সার্চের সম্ভাবনার ভয়ে কাঠ হয়ে যেতাম। ঘরে রয়েছে মহিলা ও বয়স্ক মেয়েরা। মনে মনে ভাবতাম কি দোষ করেছিল এসব এককালে গর্বিত সৈনিকরা, বিশেষ করে তাদের পরিবারবর্গ, যে তাদেরকে দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে কতগুলাে কাপুরুষ আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈনিকের মুক্তির জন্য। মনে পড়ে বন্দিজীবনের শেষের দিকে আমার জনৈক পাকিস্তানি বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনা কতােটুকু? উত্তরে বলেছিলাম, অন্যদের কথা জানি না, যারা তােমাদের এই বন্দিশালায় নরকের জীবনযাপন করে দেশে ফিরে যাবে তারা যদি সিদ্ধান্তকারী কোনাে ভূমিকায় আসে তবে তােমাদের প্রতি তাদের একটি তীব্র ঘৃণার সম্পর্কই থাকবে। তােমাদের মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই’ আর ‘ইসলামি রিপাবলিক অব পাকিস্তান’-এর ভাওতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হবে।’ শুনে খুশি হন নি আমার বন্ধুটি।
একদিনের ঘটনা। মেজর ওয়াজিউল্লাহ (পরে মেজর জেনারেল) আর মেজর আনিস ওয়াজি (পরে মেজর জেনারেল) প্রথমে তর্কাতর্কি পরে মারামারি করলেন। ওয়াজি হয়তাে বেশি মারলেন। ঘটনাটি ঘটলাে মাঠে এবং সকলের সামনেই। কোহাট থেকে ট্রেনে আসার সময় নাকি ওয়াজি আনিসের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলেন। মারামারিটা তারই প্রতিশােধ হিসেবে। ঘটনার রিপাের্ট হলাে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তৃপক্ষ ওয়াজিকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাে। ওয়াজি ছিলেন ‘এ’ বিভাগের বাসিন্দা। তার ওপর হুকুম হলাে, শাস্তি হিসেবে তার পরিবারের বাসস্থান ‘বি’ বিভাগে, সুবেদারদের জন্য নির্দিষ্ট অর্থাৎ সারভেন্ট কোয়ার্টারে স্থানান্তরিত হবে। ব্যাপারটি আলােচিত হলাে আমাদের এসবিও (সিনিয়র বাঙালি অফিসার) অফিসে অর্থাৎ এসবিওর ঘরে। সিনিয়র অফিসাররাও ছিলেন। শাস্তি দেয়াতে আমাদের আপত্তি ছিল না; কিন্তু এ কি রকম শাস্তি। একজন। অফিসারের পরিবার অফিসারদের কোয়ার্টারেই থাকবে। যদিও জেসিওদের কোয়ার্টারের চাইতে অফিসারদের কোয়ার্টার এমন কিছু উন্নত ধরনের ছিল না; কিন্তু প্রশ্নটি নীতিগত। কতাে রকম শাস্তিই তাে দেয়া যেত। অফিসার জেসিও মিশিয়ে ফেলার এই প্রচেষ্টা কেন? ওরা কি তা হলে বাঙালি সামরিক বাহিনীর কাঠামােগত ও সাংগঠনিক সত্তাকে ভেঙে ফেলতে চায়? এ প্রশ্নই আমাদের মনে বড় হয়ে দেখা দিলাে। দু’ একজন জেসিওকে ডেকে জিগ্যেস করা হলাে। তারাও এরূপ শাস্তির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেন। অতএব সিদ্ধান্ত হলাে, এই শাস্তির বাস্তবায়ন প্রতিরােধ করা হবে। বিকেলের দিকে ওয়াজিউল্লাহর পরিবারকে কর্তৃপক্ষের গাড়িতে করে ‘এ’ বিভাগ থেকে ‘বি’ বিভাগের গেটের সামনে আনা হলাে।
আমরা দল বেঁধে আগে থেকেই গেট আটকে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা বাধা দিলাম। সামরিক বাহিনীর জন্য অনেকটা অভূতপূর্ব ঘটনা। মনে হলাে কর্তৃপক্ষ এতােটা আশা করে নি। অনেকটা অবাক হয়ে গেল তারা কিছুটা হতবুদ্ধিও। আমরা খুব শান্ত ভঙ্গিতে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে আমাদের কথা ও দৃষ্টিভঙ্গি বুঝিয়ে বললাম। ওরা বুঝলাে শক্তি প্রয়ােগ ছাড়া কাজ হাসিল হবে না। শক্তি প্রয়ােগ করলে কি হবে এ নিয়ে আমাদেরও দুশ্চিন্তার অবাধ ছিল না। দুর্বলমনা লােক তাে ছিলই আমাদের মধ্যে। প্রায় আধঘণ্টা কথা কাটাকাটির পরও আমরা নড়লাম না দেখে কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলােচনায় বসলাে। দীর্ঘ আলােচনার পর ওরা সাব্যস্ত করলাে শক্তি প্রয়ােগ করা হবে না। ওরা আমাদের দাবি মেনে নিলাে। ওয়াজিউল্লাহর পরিবার পুনরায় ফিরে গেল। আমরা স্বস্তির একটি বড় নিশ্বাস ফেললাম। সংগঠিত শক্তির বিজয় হলাে দেখে সংগঠনের প্রতিও আমাদের আস্থা প্রচণ্ড রকম বৃদ্ধি পেল; কিন্তু আমরা স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে, এর প্রতিশােধ ওরা নেবেই আমাদের ওপর। আরও দুশ্চিন্তায় দিন কাটতে লাগলাে। অবশেষে সত্যিই একদিন আদেশ এলাে যে, আমাদের ঘরবাড়ি সার্চ করা হবে। মেয়েদের দেহ পর্যন্ত সার্চ করা হবে। এই সার্চের গুজব আমাদের কানে আগেই এসেছিল। শােনার পর আমরা সিনিয়ররা আলােচনায় বসেছিলাম। স্থির হলাে বাধা দিতে হবে। এটা আমাদের পরিবারবর্গের সম্মানের প্রশ্ন। পরিণতি যাই হােক না কেন, বাধা দিতেই হবে। কারা কর্তৃপক্ষকে তাই বলা হলাে। সার্চ স্থগিত হলাে। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে উর্ধ্বতন অফিসের সাথে যােগাযােগ শুরু হলাে। শেষে বলা হলাে যে, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খবর পেয়েছে যে কে বা কারা বেতার যন্ত্রের সাহায্যে বন্দিখানা থেকে বাইরে সংবাদ পাঠাচ্ছেন। অতএব, এই বেতার যন্ত্রটি উদ্ধারের জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে সার্চ করতে হবে। কি উদ্ভট চিন্তা, বন্দিশালা থেকে এমন। কি খবর পাঠানাে থাকতে পারে, যা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। তাছাড়া আধুনিক ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কোনাে বেতার যন্ত্রের সঠিক অস্তিত্ব আবিষ্কার অত্যন্ত সহজ একটি কাজ। পরে বুঝেছিলাম। পাকিস্তানিদের আসল উদ্দেশ্য তা ছিল না। আসল লক্ষ্য ছিল আমরা যে বন্দি হয়েও সংগঠিত ছিলাম, সেই সংগঠনটির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া, যাতে আমরা সংগঠিতভাবে প্রতিরােধ করতে না পারি । অতএব, এটা ছিল আমাদের ওপর একটি তৃতীয় ডিগ্রি পদ্ধতির আক্রমণ; কিন্তু গর্বের বিষয় পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনা সফল হয় নি। কিছু কিছু অফিসার অবশ্য আমাদের প্রতিরােধের পরিবর্তে আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিলেন; কিন্তু সংখ্যাগুরু অফিসাররা সংগঠনের পক্ষে ছিলেন। তবে সার্চ শেষ পর্যন্ত হয়েই ছিল। এবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিল।
একান্তভাবেই অনড়। আমাদের আলােচনা চলতে লাগলাে। অবশেষে স্থির হলাে। সার্চ হবে, কিন্তু কেবল বেতার যন্ত্র দেখার জন্য—অন্য কিছুর জন্য নয়। মহিলাদের ঘরে ঢুকবে কেবল মেয়ে-কারারক্ষীরা এবং তল্লাশি হবে তাদের স্বামী/অভিভাবকদের উপস্থিতিতে। কিন্তু এই চুক্তি ছিল পরম ক্ষমতাবানের সাথে নিতান্ত অসহায়ের চুক্তি। অতএব আমরা সকলে, বিশেষ করে মহিলারা, থাকলাম একরকম দমবন্ধ করেই । চরম অসম্মানের ভয় ছিল আমাদের; কিন্তু তা করা হয় নি। সঙ্গে মেয়েকারারক্ষী ছিল। তাই বলে পাকিস্তানের এই পরাজিত সেনাবাহিনীতে উদ্ধৃঙ্খল সৈনিকের অভাব ছিল না। শােনা গেল মরহুম কর্নেল এম আর আর রহমানের বাসা এবং এরূপ আরও দু’এক জায়গায় মেয়ে-কারারক্ষী ও পাক সৈনিকরা মিলে তাঁদের অলঙ্কারাদি ছিনিয়ে নিয়েছে। তবে এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে। নালিশ একান্তই নিস্ফল হবে জেনে সবাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা দেশের খবর পেতাম প্রধানত দুই উপায়ে। প্রথমত, রেডিও মারফত। বিবিসি তাে ছিলই। তাছাড়া বহু কষ্টে আমরা ঢাকা স্টেশনও ধরতাম। শুনলাম বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি বন্দিদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করবে। এটা আশানুরূপই ছিল। আর এটাও জানতাম যে, ওখানে বন্দিদের বিচার হলে, এখানেও এরা বেছে বেছে আমাদের কিছু অফিসার, বিশেষ করে সিনিয়র অফিসারদের একটা প্রহসনমূলক বিচারের ব্যবস্থা করবে এবং অনুরূপ। শাস্তি দেবে। তার জন্য আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম; কিন্তু পরিবারবর্গ নিতান্ত বিমর্ষ থাকতাে। রেডিওর খবরে জানতে পারলাম, সিমলা বৈঠক হচ্ছে। বন্দি বিনিময় আলােচনা হচ্ছে ইত্যাদি। তাতে কোনাে অগ্রগতি হলে আমাদের জুনিয়র অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গ খুশি হয়ে উঠতাে। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি পাকিস্তান-ভারত আলােচনায় অনেকটা অগ্রগতিও হচ্ছিল। দেশের খবর জানার দ্বিতীয় উপায়টি ছিল চিঠিপত্র । চিঠিপত্র সবই আসতাে বিদেশ হয়ে। আমাদের আত্মীয়-স্বজন চিঠি পাঠাতেন বিদেশে কোনাে আত্মীয়কে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে চিঠিখানা নতুন লেফাফাতে ভরে আত্মীয়রা পাঠাতেন আমাদেরকে। কারা কর্তৃপক্ষ সেগুলাে সেন্সর করে আমাদের দিতাে। এই চিঠি আসতে আসতে ২/১ মাস লেগে যেত। আমরাও অনুরূপভাবে চিঠি পাঠাতাম দেশে। এই চিঠিগুলােতে দেশে আমাদের পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনের খবর থাকতাে। কি যে আনন্দ ও স্বস্তি হতাে এই চিঠিতে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। | কিন্তু দু’একটা চিঠিতে দেশ সম্বন্ধে খারাপ খবরও থাকতাে।
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হতাে না। যেমন, দেশে সন্ত্রাস প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা শহর নিরাপদ নয়। এদিকে গ্রামেগঞ্জেও সন্ত্রাস। জনগণের মনে শাসকদলের সদস্যদের প্রতি বিরূপ মনােভাব গড়ে উঠছে দিনে দিনে। বহু আশা-আকাক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে দেশবাসী। একটি সােনার বাংলার স্বপ্ন সবার মধ্যেই; কিন্তু একি? রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলােতে চরম দুর্নীতি ও অদক্ষতার খবর। প্রথমে বিশ্বাস হতাে না। পত্রলেখকের ওপরে প্রচণ্ড রাগ হতাে। কিন্তু পরস্পরের সাথে আলােচনা করে জানতে পারতাম তাদের পাওয়া চিঠিগুলােও একই রকমের খবর দিচ্ছে—দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে। তখন আর অবিশ্বাস থাকে নি। মনটা বর্ণনাতীত খারাপ হয়ে যেত। ভাবতাম একটি আগুনে পােড়া জাতি সােনার মতাে খাটি হয়ে উঠবে, তার চারিত্রিক উজ্জ্বলতা হবে চোখ ধাধানাে। চরম অপমান, নির্যাতন ও আত্মাহুতি তার খাদগুলাে নিংড়ে নিঃশেষ করে নিখাদ সােনার মতাে পবিত্র করে তােলার কথা। এই জাতির নেতৃত্বে আছেন এমন একটি প্রিয় ব্যক্তিত্ব যার অঙ্গুলি হেলনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ওঠে, বসে, কাঁদে, হাসে, আগুনে ঝাঁপ দেয়। এই শুভ। সংযােগ তাে সােনায় সােহাগা। সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জনগােষ্ঠীর পুনর্গঠনের জন্য প্রয়ােজন তাে মাত্র কয়েকটি বছর। তারপরেই তাে জাতির পাখা মেলার কথা। আর এই পুনর্গঠনের পর্যায়ে তাে গােটা জাতির মুক্তিযুদ্ধকালীন একাত্মতা ও একাগ্রতা নিয়ে দিনরাত্রি নিবিষ্ট মনে কাজ করার কথা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পরে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা। সােনার মাটিতে সােনার বীজ বপন ও সােনার বাংলা বাস্তবায়নে আত্মনিবেদন করার কথা। সােনার বাংলা বিনির্মাণ তাে কোনাে তর্কের ব্যাপার নয়, কেবল সময়ের ব্যাপার।
অথচ চিঠিপত্রে যা খবর পাই তাতে মন ভেঙে যাওয়ার কথা। ঢাকার রাস্তায় সন্ধ্যার পর বের হওয়া নিরাপদ নয়? গ্রামেগঞ্জে সন্ত্রাসের বিস্তৃতি? রাষ্ট্রীয়কৃত কলকারখানাগুলােতে লুটপাট—শ্রমিক বিশৃঙ্খলা? অবিশ্বাস্য! এই খবরগুলাের মধ্যে যেটি সবচাইতে বড় আঘাত দিতাে তা হলাে। শাসকদলের কর্মী-নেতাদের মনােভাব। সবারই নাকি একটা সবজান্তাভাব এবং জনগণের প্রতি অবজ্ঞা ও নিজেদের ব্যক্তিগত উগ্রতা। এসব শুনে মনে হতাে। সমগ্র জাতিটাই হয়তাে দুর্ভাগা। এদিকে বন্দিজীবনের অপমান ও অসহায়তা একদিন একজন পাঞ্জাবি সিপাহি এলাে বাসায়। খবর পেয়ে বেরিয়ে এলাম। সালাম আদাব তাে দূরের কথা, দেখি একটা ভাঙা চেয়ারের ওপর এক পা তুলে দাড়িয়ে। তাচ্ছিল্যভরেই বললাে, ‘ত্যায় দফতর বুলায়। হঠাৎ রাগ চড়ে গেল মাথায়। উচ্চস্বরে। বললাম, “জওয়ান, ঠিক তরিকাসে খাড়ে হাে। ইতস্তত করছে দেখে আবার। চিৎকার সিপাহি সােজা হয়ে দাড়ালাে। বললাম, ‘স্যালুট। পাঞ্জাবিদের একটি গুণ, শক্ত করে হুকুমদাতার আদেশ পালন করা। সামরিক কায়দায়। অভিবাদন করলাে। বললাম যে, তােমার দফতরওয়ালা কর্নেল। ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে কখনও কর্নেল সাহেবরা ডেকে পাঠান না। প্রয়ােজনবােধে কর্নেলই আসেন ব্রিগেডিয়ারের কাছে। জিগ্যেস করলাম বুঝেছে কিনা। উত্তরে বললাে, জি হা বুঝতে পেরেছে। বললাম, ‘যাও।’ সে অভিবাদন না করেই চলে যাচ্ছিল। ফের চিৎকার, স্যালুট এতে কাজ হলাে স্যালুট করে সামরিক কায়দায়ই পেছন ঘুরে মার্চ করে গেট পর্যন্ত এগিয়ে উধাও হয়ে গেল রাগের মাথায় কাজটা তাে করলাম তারপর ভাবলাম এর প্রতিক্রিয়া আমার জন্য খুব আনন্দদায়ক না হওয়ারই কথা। অপমানের ওপর আর এক দফা অপমান আসার সম্ভাবনা সমধিক সবার সামনে দিয়ে অস্ত্রবাহী গার্ড দিয়ে আমাকে দফতর পর্যন্ত নেয়া বিচিত্র নয় যে দু’একজন সহবন্দি ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদেরও মুখ শুকনাে। তবে মুখে বললেন, ‘ভালােই করেছেন। যা হওয়ার হবে। এরা যখন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে তখন চরমেই যাক।’ বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম; কিন্তু না। কোনাে প্রতিক্রিয়া নেই। পরদিনও না। তার পরের দিনও না। বরং এরপর শিবির কর্তৃপক্ষই কিছুটা নমনীয় হয়েছিল।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা