বন্দিজীবন কোহাট ও অন্যত্র
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে আমাদের বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হলাে। আমাকে নেয়া হলাে কোহাটে। আমার প্রতিবেশী লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন। নিজের বাসাতেই কিছুদিনের জন্য রয়ে গেলেন। তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মুহূর্তটি নেহাতই করুণ ছিল। ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হকও আমাদের সঙ্গে বিদায় নিতে গেলেন। জেনারেল ওয়াসি বললেন, সেখানকার সব খবরাখবর যেন আমরা জানাই। কোহাট সীমান্ত প্রদেশের একটি জেলা ও সেনাছাউনি। মরুভূমির মতাে উষর এবং গরম। এখান থেকে পেশাওয়ার উত্তর-পশ্চিমে প্রায় চার ঘণ্টার পথ। শহরটি এমন কিছু নয়। শহরে পাকা রাস্তা নেই বললেই হয়। তবে সিভিল অফিসারদের পাড়া এবং ছাউনির রাস্তাগুলাে পাকা ও ভালাে। ব্রিটিশ আমলে ঘরবাড়িগুলাে হয়তাে ভালােই ছিল। বর্তমানে ছাউনির একটা বড় অংশ অব্যবহৃত বলে নিম্নমানের। ছাউনির ওই অংশটিকে কিছু সংস্কার করে বাঙালি বন্দিদের ঠাসাঠাসি করে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। | এই কোহাট সেনাছাউনির একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আমার ও ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হকের পরিবারবর্গকে রাখা হলাে। মাটির ছাদ ও দেয়ালের বাসাটিতে তিনটি শােবার ঘর, বৈঠকখানা সংযুক্ত খাওয়ার ঘর । মজিদুল হকের বড় তিন ছেলেমেয়ে, আমার চারটি, ছােটটি ৩/৪ বছরের। সঙ্গে আমার মা। মায়ের চোখের অসুখ বেশ খারাপ গােছের। সবাই মিলে বাড়িটি ভাগ করে নিলাম। জিনিসপত্রও নেহাত কম নয়। একান্ত প্রয়ােজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই বের করা হলাে না। কিন্তু মুশকিল হলাে যে, রান্নাঘর একটি এবং আরও বড় বিপদ, পায়খানা দুটি স্যানিটারি ব্যবস্থা সংবলিত নয়। একটি আসবাবপত্রহীন ছােট কামরাতে কাঠের আলগা কমােড। প্রত্যেকবার ব্যবহারের পর মেথর এসে ওটাকে সাফ করে ফেরত রাখার কথা। দুই পায়খানা সাফ-সুতরাে রাখার জন্য একজন মেথর সার্বক্ষণিকভাবে থাকার কথা; কিন্তু আমাদের জন্য মেথর বরাদ্দ ছিল একটা বিশেষ সময়ের জন্য। তার ওপর সময়মতাে প্রায়ই সে আসতো না। ফলে সর্বমােট বারােজন বাসিন্দার জন্য প্রাণান্তকর অবস্থা। ছেলেপিলেরা কেঁদেই ফেলতাে।
বাড়িটির চারদিকে কিছু নেই, কয়েক একর জমির মধ্যে একটি বাড়ি। ঘাস-পাতার চিহ্নও নেই। কেবল বালু ও পাথর। বন্দিশালায় এসে গেলাম নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা দেখতে। তাদের রাখা হয়েছে অবর্ণনীয় অবস্থায়। মাটির দেয়াল, মাটির ছাদ, গত শতাব্দীর তৈরি লম্বা ব্যারাক, একটি হলঘরের মতাে। মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি চলার রাস্তা রেখে দু’পাশে দশ পনেরাে ফিটের একটি একটি করে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, প্রতিটি পরিবারের জন্য। কোনাে আসবাব নেই। মাটিতে শােয়ার ব্যবস্থা। মশারি খাটানাের মতাে রশি টানিয়ে নিজেরাই কাপড় ঝুলিয়ে প্রতিবেশীর কাছ থেকে পর্দার ব্যবস্থা। রাতে ঘুমের ঘােরে পাশ ফিরলে প্রতিবেশীর বিছানায় চলে যাওয়ার ভয়। পায়খানা দূরে, সবার জন্য পাশাপাশি কয়েকটি। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। বস্তুত ব্যারাকগুলাে ছিল সৈন্যদের জন্য। এ পায়খানাগুলােও স্যানিটারি নয়, মেথর এসে পরিষ্কার করতাে। বেশি ব্যবহার হলেই উপচে পড়বে ও ব্যবহারের অযােগ্য হবে। তাই হয়েছে। রান্নার। কাজের জন্য একমাত্র জায়গা বারান্দা। যে ব্যারাকে হয়তাে চল্লিশজন সৈনিকের জায়গা হওয়ার কথা সেখানে শ’দুয়েকের কম লােক নয়। বয়স্ক ছেলেমেয়ে, বাচ্চা শিশু, গর্ভবতী মহিলা, অসুস্থ মানুষ সব ঠেসে গাদাগাদি করে রাখা। সমস্ত দৃশ্যটাই বীভৎস ও অমানবিক। অথচ এরা সবাই গর্বিত সৈনিক ও তাদের পরিবার। জীবন বিপন্ন ও উৎসর্গ করে মাতৃভূমি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে যে সরকারের চাকরিতে ভর্তি হয়েছিল সেই সরকারের হাতে তাদের এই চরম। অবমাননা ও বিপর্যয়। বিশ্বাস করতেও পারি নি এই পাকিস্তান নামক সরকারের কর্তৃপক্ষ এতােটা নিচ। চোখে পানি এসে গেল। এরা কেউ মুখে নালিশ করলাে । করুণ কণ্ঠে শুধু বললাে, ‘স্যার নিজের চোখেই দেখুন।’ মহিলারাও অসহায় করুণ চোখে কেবল তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বলার দরকারও ছিল না। বাসায় ফিরে এলাম। মজিদুল হকের কাছে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে একজন পাকিস্তানি এসেছিল তাকে পৌঁছে দিতে। তার হাতে দেব বলে দু’জনে মিলে ক্যাম্পের অবর্ণনীয় ও অমানবিক অবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে একখানা চিঠি লিখলাম জেনারেল ওয়াসিকে। চিঠি নিয়ে লােকটি চলে গেল। পরে শুনেছি জেনারেল ওয়াসি চিঠিখানা বিবিসির স্থানীয় ভাষ্যকার পিটার গিলকে দিয়েছিলেন এবং সবিস্তারে তা প্রচার করা হয়েছিল বিবিসি থেকে। সে ভাষ্যে। নাকি এও বলা হয়েছিল যে, ক্যাম্প থেকে প্রেরিত কোনাে সিনিয়র বাংলাদেশি অফিসারের চিঠি থেকে এই রিপাের্ট তৈরি হয়েছে।
আর যায় কোথা! জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে ‘ধর ধর মার মার’ পরিস্থিতি। সপ্তাহ দুয়েক পরেই শাস্তির হুকুম এলাে স্থানীয় কমান্ডারের দফতরে। স্থানীয়। কমান্ডার একজন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার। আমার ডাক পড়লাে দফতরে। ব্রিগেডিয়ার কিছুক্ষণ ধানাইপানাই করে বললেন, “এ চিঠিখানা তুমিই লিখেছাে।’ কোনাে উত্তর দিলাম না। অর্ডার’ পড়ে শােনালেন, আমার বদলি হয়েছে ওয়ানা। (Wana) ক্যাম্পে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বালুচিস্তান ও আফগানিস্তানের। সীমান্ত যেখানে মিশে, ওয়ানা ক্যাম্পটি সেইখানটায়। ফ্রন্টিয়ার কনস্টেবুলারির। একটি ক্যাম্প। আশপাশে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোনাে শহর নেই, চারদিকে বৃক্ষহীন পর্বতমালা। পর্বতের পাশ কেটে পাথুরে পথ—কোনাে রকমে জিপ চলতে পারে। ৮/১০ ঘণ্টা লাগে কোনাে শহর থেকে ওয়ানা নামক গ্রামটিতে। পৌছতে। মায়ের চোখ ও ছােট শিশুর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশ্নই ওঠে না। জীবনের নিরাপত্তাও প্রশ্নের সম্মুখীন। মনের ভয় যথাসম্ভব চেপে রেখে প্রশ্ন। করলাম, তুমি বলছাে আমার বদলি হয়েছে। তা আমার অবস্থানটা কি? আমি কি তােমাদের বন্দি?’ এ কথাটি আমি পিণ্ডিতেই এক পাকিস্তানি বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম যে, আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থাৎ অফিসিয়ালি আমাদের বন্দি ঘােষণা করা। হয় নি। আমাদেরকে চাকরিচ্যুতও করা হয় নি। আন্তর্জাতিকভাবে নাকি অসুবিধা ছিল। কাজেই বহির্বিশ্বের দেশগুলােকে বলা হয়েছিল স্থান সংকুলানের কারণে আমাদের একসাথে করে অন্য নির্দিষ্ট সেনাছাউনিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে মাত্র। আমার প্রশ্নের উত্তরে ব্রিগেডিয়ার বললেন, না, তুমি ঠিক বন্দি নও। তবে | তােমাকে বদলি করার অধিকার পাকিস্তান সরকারের আছে।’ তখন আমার। অবস্থা অনেকটা বেপরােয়া। একান্ত মরিয়া হয়ে বললাম, তবে শােনাে। ওয়ানা নামক জায়গাটিতে ব্রিগেডিয়ার পদের কোনাে দফতর বা কমান্ড নেই। সেখানে আমার বদলি হতে পারে না। সেখানে আমি যাবাে না। যদি জোর করে পাঠাতে চাও তবে আমাকে বন্দি করে হাতকড়া পরিয়ে পাঠাতে হবে। এছাড়া আমার পরিবার আর্মি অ্যাক্টের আওতায় পড়ে না। তাদের পাঠাতে হলেও তাদের হাতকড়া পরাতে হবে।’ দম বন্ধ করেই কথাগুলাে বলে গেলাম; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্রিগেডিয়ার অনেকটা হতভম্ব। একজন বন্দির মুখে এ কি কথা! তাঁর সুর নরম হয়ে গেল। নরম সুরে বললেন, “হুকুমটি জি এইচ কিউ’র।’ তাকে বললাম, আমার কথাগুলাে জি এইচ কিউকে জানাতে এবং নতুন আদেশ আনতে। বাসায় ফিরে গেলাম। সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে ছিল। তাদেরকে বললাম ঘটনা। স্বভাবতই আমার পরিবার পরম আতঙ্কে ছিল, ভবিষ্যৎ ভেবে আর মজিদুল হকের পরিবার অত্যন্ত দুঃখিত। মজিদুল হক হয়তাে এই ভেবে বেশি।
দুঃখিত ছিলেন যে চিঠিখানা দু’জনে মিলে লিখেছিলাম । হাতের লেখা ভালাে বলে তিনিই লিখেছিলেন পত্রটি। অথচ শাস্তি হচ্ছে আমার একার। আমি বােঝালাম, ওতে কিছু এসে যায় না। শাস্তি হবে কেন সেটাই প্রশ্ন। দিন দুয়েক পরে পুনরায় আমার ডাক পড়লাে স্টেশন হেড কোয়ার্টার্সে। আবার কিছুক্ষণ একথা-ওকথার পর ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘খলিল, দেখ তােমাকে এখান থেকে যেতেই হবে। তবে যেখানে সামরিক হাসপাতাল আছে। এমন জায়গায় তােমাকে যেতে হবে। বল কোথায় যাবে, পেশাওয়ার নাকি নওশেরায়।’ তখন আমার মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। নিদারুণ আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। বললাম, ‘দুটির যে কোনােটিতে যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।’ ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘তবে নওশেরায় যাবে তুমি।’ ফিরে এসে জিনিসপত্র বেঁধে ফেললাম; কিন্তু মন থেকে আশঙ্কা গেল না। হতে পারে এ একটি চালাকি মাত্র যাবাে তাে ওদের কয়েদি হয়ে। রাস্তায় মােড়। ফিরে হয়তাে ওয়ানাতেই নিয়ে যাবে। মজিদুল হকের মনেও একই ভয়। পাকিস্তানিদের বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। ছাউনি থেকে বাঁ দিকে বেরিয়ে আধ মাইলখানেক দূরে বড় রাস্তা- ডান দিকে পেশাওয়ার/নওশেরা আর বাঁ দিকে ওয়ানা যাওয়ার পথ। ঠিক হলাে মজিদুল হক দেখবেন আমাদের গাড়ি কোন দিকে ঘােরে। যদি বাঁ দিকে ঘােরে তবে যেভাবে হােক খবরটি পিণ্ডিতে জেনারেল ওয়াসিকে জানাতে হবে। দম বন্ধ করে বসে থাকলাম। গাড়ি পেশাওয়ারের দিকে ঘুরতে দেখে প্রথম স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমাদের জিনিসপত্র একটি সামরিক ট্রাকে। আমি ও পরিবারের সদস্যরা আমার ফিয়াট ১১০০ গাড়িতে। পাহারাদারদের একজন আমাদের গাড়িতে বসার কথা; কিন্তু গাড়িটি আমার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে ভরা ছিল। দেখে বােধহয় ওদের মনে কিছুটা সঙ্কোচের উদয় হলাে। হাবিলদার এসে বললাে, “ঠিক আছে, আপনারা আমাদের পেছনে আসুন। ট্রাক থেকেই আমরা আপনাদের ওপর নজর রাখবাে।’ মনটা খুশি হলাে। গাড়ি আমিই চালাচ্ছিলাম।
এখানে গাড়িটি সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ক্যাম্পে আসার আগে যখন গুজব ছড়িয়ে পড়লাে যে, আমাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন সবাই উদ্গ্রীব। হলাে যা আছে সব বিক্রি করে দাও এবং যা দাম পাওয়া যায় তাতেই অর্থাৎ প্রায় বিনামূল্যে। আমরা দু’একজন সিনিয়র অফিসার ঠিক করলাম, যা হওয়ার হবে। আমরা কিছুই বেচবাে না। টিভি, রেডিও, আসবাবপত্র, অলঙ্কার কিছুই । ভাবলাম আমরা সিনিয়ররা যদি গাড়ি বিক্রি করি তবে জুনিয়ররা তাদের সােনাদানা এমনকি স্ত্রীর শাড়িও বিক্রি করে দেবে। বিক্রির হিড়িক পড়ে যাবে। আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানিরা তাই চাচ্ছিল, পানির দামে এগুলাে কিনতে। অথচ এগুলাে বাংলাদেশে নিতে পারলে যকঞ্চিৎ তােক সাহায্য হবে। অতএব, আমি গাড়ি বিক্রি করলাম না। দেখাদেখি কয়েকজন যারা গাড়ি বিক্রির বন্দোবস্ত করে বায়নার টাকাও নিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁদের গাড়ি ফেরত নিলেন। পরে অবশ্য আমাকে এজন্য অনেক কটুক্তি শুনতে হয়েছিল, যখন দিন দিন গাড়ি তাে দূরের কথা আমাদের নিজেদেরও দেশে ফেরার আশা অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল।
বন্দিজীবন-নওশেরা
পেশাওয়ার থেকে ২৮ মাইল দূরে রাওয়ালপিণ্ডি-লাহাের মহাসড়কের ওপর নওশেরা একটি সেনাছাউনি। নওশেরাতে আরও জনবিশেক বাঙালি অফিসার ও তাঁদের পরিবারবর্গ ছিল। ব্রিটিশ আমলে সার্জেন্টদের জন্য তৈরি, পরে পাকিস্তান আমলে প্রশিক্ষণরত অবিবাহিত অফিসার দ্বারা ব্যবহৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোয়ার্টার্স একটার সঙ্গে আর একটা লাগােয়া, লম্বা ব্যারাকের মতাে। যতাে ছােটই হােক, একটা বড় আশীর্বাদ, প্রত্যেক পরিবারের জন্য একটি করে বাথরুম, তাও আবার স্যানিটারি কমােডসম্পন্ন। সর্বমােট তিনটি ছােট কামরা। কোহাটের তুলনায় ভালােই। তাছাড়া ক্যাম্পের দেখাশােনার ভার পিএমএ-তে আমার এক সহপাঠী কর্নেলের ওপর। তিনি ভালাে লােক । মনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এলাে। কিন্তু সমস্যাও ছিল। সমস্যা প্রধানত নিজেদের শৃঙ্খলাবােধ নিয়ে। মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য—বেশির ভাগ লােকই স্বভাবসুলভভাবে শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আবার কেউ কেউ রয়েছে যারা শৃঙ্খলা পালন করে কেবল শাসনের ভয়ে। শাসনের ভয় না থাকলেই তারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ক্যাম্পে সেই শৃঙ্খলাবােধটাই ছিল প্রধান সমস্যা। প্রথমে পরস্পরের সাথে ঝগড়াঝাটি, পরে মারামারি শুরু হয়। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই—এতে মহিলারাও যােগ দেন। অথচ ভাবছিলাম যদি এঁরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিতে, নতুন বাংলাদেশে যেতে পারেন এবং তাদেরকে সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত করা হয় তবে নতুন সামরিক বাহিনী এঁদের অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি দ্বারা সমৃদ্ধ হবে ও নতুন সামরিক বাহিনী এদের বিভিন্ন জ্যেষ্ঠতা দ্বারা সুসমন্বিত হবে; কিন্তু এঁদের কিছুসংখ্যক শৃঙ্খলাহীন সদস্যদেরকে দেখে ভয় হতে লাগলাে এঁদের দ্বারা আমাদের সামরিক বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরও আশ্চর্যের কথা, এদের দেখাদেখি অন্য অফিসারদের মনেও সামরিক শৃঙ্খলার প্রতি অনীহা জেগে উঠছিল। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। এখানে আসার কয়েকদিন পর দেখলাম আর্মার্ড কোরের একজন জুনিয়র অফিসার চুল বড় করছে। ইতােমধ্যেই লম্বা বাবরি হয়ে গেছে এবং তাঁকে রাস্তার গুণ্ডাশ্রেণীর যুবকের মতাে দেখাচ্ছে। সিনিয়রিটির দিক দিয়ে আমার পরে ছিলেন কর্নেল মান্নান সিদ্দিকী। মান্নানকে বললাম, ওকে বললা চুল কাটতে।’ মান্নান আগে থেকেই ওই ক্যাম্পে ছিলেন। বললেন, বলে লাভ হবে না। বস্তুত তাকে বলাও হয়েছিল। উত্তরে তিনি বললেন যে, এখন আর তিনি কোনাে বাঙালি সিনিয়রের নিয়ন্ত্রণে নন।
স্বাধীন অতএব যা খুশি তাই করবেন। মান্নান জানালেন যে, অত্যন্ত রূঢ়ভাবেই নাকি অফিসারটি কথাগুলাে বলেছেন। যে সিনিয়র তাকে বলেছিলেন চুল কাটতে তিনি আর সাহস পান নি কিছু বলতে অত্যন্ত তিক্ত কণ্ঠে বললেন মান্নান। আমারও মুখটা কালাে হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘এভাবে হাল ছেড়ে দিলে তাে হবে না। একটা কিছু করতেই হবে।’ মান্নান বললেন, ‘কঠিন কাজ। অন্য অফিসাররাও হতাশাগ্রস্ত । ভবিষ্যতের কথা কেউ ভাবতে চায় না। ভাবখানা—যা হওয়ার হবে, যেভাবে চলছে চলুক। এ অবস্থায় কি করতে পারবেন? শুনে মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। ঘরে ফিরে গেলাম তখনকার মতাে। কথাটা ভেবে দেখতে হবে। বাঙালি এখন স্বাধীন। লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। অথচ আমরা এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদান করতে পারি নি। আমি নিজে তিন তিনবার চেষ্টা করেছি পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদান করতে। একবার তাে গােছগাছ করে বসেই ছিলাম যাওয়ার অপেক্ষায়; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সফল হই নি। এরকম প্রচেষ্টা আমার সঙ্গী-সাথিরা অনেকেই করেছেন। এই গ্লানি আমাদের মনে ছিল। এছাড়া আমরা বাঙালিরা বিশ্বাস করতাম যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার মতাে প্রশিক্ষণ, দায়িত্বজ্ঞান ও পরিপক্বতা আমাদের আছে। বরং যে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর ২৪ বছরের দুঃশাসন চালিয়েছে গায়ের জোরে, তাদের চাইতে আমাদের পরিপকৃত ও মানসিক গুণ বেশি বৈ কম নয়। এর মানে এই যে, একটি বাঙালি সমাজ সে যেখানেই থাকুক আর তার পরিধি যতাে বড় কিংবা যতাে ক্ষুদ্র হােক না কেন, তারা তাদের নিজস্ব সামাজিক ও মানসিক গুণ দ্বারা নিজেদেরকে একটি সুসমন্বিত ও সুসংগঠিত সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ। আর এই ক্যাম্পে তাে আমরা ক্ষুদ্র একটি বাঙালি সমাজ। তদুপরি আমরা এখানে সবাই শিক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত উচু সমাজের ব্যক্তি। এখানে একটি সুসংগঠিত সমাজ প্রতিষ্ঠা খুব তাে সহজ হওয়া উচিত। অন্যপক্ষে আমরাই যদি পাকিস্তানি ডাণ্ডা ব্যতীত নিজেদেরকে সুশৃঙ্খল রাখতে না পারি তবে আমাদের এই বাঙালি আত্মবােধ বাঙালি আত্মপ্রত্যয় মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সমগ্র বাঙালির এই স্বাধীনতার দাবি ও স্বাধীনতা অর্জন মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ভাবতে লাগলাম। সত্যিই কি আমরা স্বাধীনতার অনুপযুক্ত?
মন কিছুতেই সায় দিলাে না। মনে হতে লাগলাে প্রেরণা পেলে অনেকেই এগিয়ে আসবেন এটা প্রমাণ করতে যে, আমরা নিজেরা-নিজেদেরকে সুশৃঙ্খল সমাজে পরিণত ও পরিবর্ধিত করতে পারি। বিকেলে সিনিয়র কয়েকজন অফিসারকে ডাকলাম এবং আমার উপরােক্ত চিন্তাগুলাে বিশ্লেষণ করলাম। শুনে মেজর মুহিত (প্রয়াত) বলে উঠলেন, ‘স্যার, এ হতে পারে না যে, বাঙালি স্বাধীন সমাজে বাস করার যােগ্য নয়। আপনি বলুন কি করতে হবে।’ উপস্থিত অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তােমরা সবাই কি ভাবছাে যে ওই একটি উছুঙ্খল যুবকই আমাদের বাঙালি চেতনার প্রতিভূ। তােমাদের কারও যেতে হবে না বলাে আমি একাই ধরে নিয়ে আসছি ওই কলঙ্কসম বাঙালি যুবককে।’ বলেই তিনি যেতে উদ্যত হলেন। অসীম বল এলাে মনে। বললাম, তােমার সঙ্গে আরও দুজন সিনিয়র অফিসার যাবেন। মিনিট কয়েকের মধ্যে যুবককে ধরে নিয়ে এলেন তারা। যুবকের ঔদ্ধত্য তখন আর নেই। উজ্জ্বল মানব কখনাে সাহসী হয় না। শান্ত। সুরে বললাম, “কি, তুমি নিজে থেকে চুল কাটাবে, নাকি আমরা কেটে দেবাে তােমার চুল?’ আমাদের অনভিজ্ঞ হাতে তার বাবরি কাটার পর সেই সুরত দেখে তার নব বিবাহিতা স্ত্রীর মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে হয়তাে সেটা ভেবে এই ‘সাহসী’ যুবক অনুনয় করে বললাে, ‘স্যার, আমাকে এক ঘণ্টার সময় দিন দয়া করে। পরবর্তী ঘটনা সংক্ষেপ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে সামরিক প্যাটার্নের কু কাট গােছের চুল কেটে কর্নেল মান্নানের কাছে রিপাের্ট করলাে। আমাদের মনের বল ফিরে এলাে। হতাশাগ্রস্ত অফিসাররাও মনে হলাে একটা নতুন আত্মপ্রত্যয় ফিরে পেলেন। ভবিষ্যতে যা হবার হবে, আপাতত পুরনাে অভ্যস্ত জীবন প্রণালিতে ফিরতে পারবেন আশা করে সবাই যেন স্বস্তি পেলেন। ক্ষুদ্র ঘটনা কিন্তু ফলাফল বিশাল। আমার মনে হলাে যে, এভাবে শৃঙ্খলাবােধ সাময়িক ফিরে এলেও স্থায়ী হবে। সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড শুরু করা দরকার। সবাই মিলে ঠিক করলামসকালে সমবেত ব্যায়াম চর্চা ও বিকেলে আলােচনা সভা নিয়মিত হওয়া দরকার। ঠিক হলাে আলােচনা সভায় বাংলাদেশের ভৌগােলিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলাে আলােচ্য বিষয় হবে। এই আলােচনা সভাগুলাে অসীম মূল্যবান ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল শেষ অবধি। একদিন ঘটলাে একটি হাসির ব্যাপার। সেদিন আমাদের আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের ভূগােল ও যােগাযােগ ব্যবস্থা। উপস্থিত অফিসারদের মধ্যে ২৮ বছর চাকরিরত একজন প্রবীণ মেজর সাহেব ছিলেন। আলােচনার বিষয়বস্তু শুনে তিনি কৌতুকে ও হাসিতে ফেটে পড়লেন।
বাংলাদেশের ভূগােল এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা! এ আবার কে না জানে?’ এই নিয়ে সময় নষ্ট করতে তিনি রাজি নন। উত্তরে বললাম, ‘আপনি হয়তাে অত্যন্ত বিজ্ঞ এ ব্যাপারে। কিন্তু হতে পারে। কোনাে যুবক অফিসারের এ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান নাও থাকতে পারে। চলুন বসা যাক একসাথে। আমরা আপনার জ্ঞান থেকে উপকৃত হবে—এটাই উদ্দেশ্য।’ তিনি যথাযথ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বসলেন। আলােচনার এক পর্যায়ে বক্তা বললেন, বরিশালে একটি সড়ক নির্মিত হয়েছে।’ মেজর সাহেব বরিশালের লােক। ব্যঙ্গ করে উচ্চ সুরে বললেন, ‘কি বললেন? বরিশালে সড়ক? এই বুঝি আপনাদের জ্ঞান? বরিশাল আপনি চেনেন? গিয়েছেন কোনাে দিন? ওই রকম বিশাল বিশাল নদীর দেশে সড়ক? শুনুন, বরিশালে কোনাে রেলপথ নেই, কোনাে সড়কও নেই। আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বুঝলেন, ভালাে করে না। জেনে কথা বলবেন না।’ সভায় সবাই থ অনেকেরই জানা ১৯৭১ সালের আগেই বরিশালে সড়কপথে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যেত, যদিও কয়েকটি ফেরি ছিল নদী পারাপারের জন্য। বলাবাহুল্য, পদোন্নতির দিকে না হলেও চাকরিকালের দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে আমাদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ এই প্রবীণ মেজর সাহেবকে সেদিন শেষ পর্যন্ত নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল অনেক তরুণের হাতে। আমি বললাম, ‘স্যার, বাংলাদেশের ভূগােল ও ইতিহাসের কথা শুনলে মনে হয় এটা স্কুলের নিচু শ্রেণীর ছাত্রের ব্যাপার; কিন্তু আসল কথা- এসব আমাদেরও জানার ব্যাপার। এসবের আমরাও অনেক কিছু জানি না। আপনি আসুন, তরুণদেরকে উৎসাহিত করুন। আর নিজেও শিখুন।’ শেষের কথাটা নিচু সুরেই বললাম। | অন্যান্য ক্যাম্পের তুলনায় আমাদের জীবন নওশেরা ক্যাম্পে অনেকটা সহনীয় মন্দের ভালাে বলতে হবে। এর প্রধান কারণ ক্যাম্পের কমান্ডার কর্নেল আকরাম ছিলেন যেমনি ভদ্র তেমনি ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি ‘৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। একটি পা খোঁড়া। পি এম এ-তে আমার সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি বললেন, “দেখ খলিল, ভাগ্যের পরিহাস তােমরা এখানে বন্দি।’ বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। ‘আমাদের একটি অপ্রীতিকর দায়িত্ব তােমাদের নিয়ন্ত্রণ করা। এতে আমাদের কোনাে গৌরব নেই, আছে অশেষ গ্লানি। আমার ওপর দায়িত্ব তােমাদের ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখা আর দেখা যে কেউ যেন পালিয়ে না যায়। জানােই তাে কেউ পালিয়ে গেলে আমাদের ওপর শাস্তি নেমে আসবে সেনাসদর থেকে।’
আমি বললাম, ‘বলাে আমাদের কী করতে হবে। বললেন, ব্যক্তিগতভাবে তােমার সম্মানবােধ ও দক্ষতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। যদি কথা দাও যে তুমি এই একুশজন অফিসারের শৃঙ্খলা বজায় রাখবে, আর যদি কথা দাও যে কেউ পালানাের চেষ্টা করবে না, তবে আমি। তােমার হাতে এ দায়িত্ব অর্পণ করে আমার সরকারি কাজে মনােযােগ দিতে চাই।’ সেদিন কর্নেল আকরামের কথার উত্তর দিলাম না। ফিরে এসে সিনিয়র বাঙালি অফিসারদের ডাকলাম। তারা বললেন, আপনি এ দায়িত্ব নিয়ে নিন। আমরা আপনাকে সহযােগিতা করবাে। বিকেলে সব অফিসারকে ডাকলাম। তাঁরাও সমস্বরে বললেন, ‘আপনি এ দায়িত্ব নিন।’ বললাম, এখন আর পালিয়ে যাওয়ায় লাভ কি? ‘৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদান করতে আমরা পারি নি । এখন পালিয়ে যেতে হয়তাে আমাদের মধ্যে দু’একজন সফল হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখ পালিয়ে যাওয়ার পর বাকি সবার ও তাদের পরিবারবর্গের ওপর যে অত্যাচার নেমে আসবে তা তবে অসহনীয়। বর্তমানে তাে অনুমতি নিয়ে পরিবারপ্রধান বাজার করতে ও হাসপাতালে যেতে পারছে; কিন্তু তখন তাও পারবে না। অসুখ-বিসুখে, যতাে জরুরি হােক, বসে থাকতে হবে কখন পরদিন ডাক্তার আসবে, আরও কত কিছু। কাজেই আমাকে কথা দিতে হবে। তােমরা এই দুটি শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।’ সবাই কথা দিলেন। আমিও পরদিন কর্নেল আকরামের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নিলাম। সকালে শরীরচর্চা হতাে। সেখানে সবাই খুশি মনে হাজির হতেন। নিকটেই বাজার। সেখানেও পরিবারের একজন বাজার করতে যেতে পারতেন আমাদের নিযুক্ত একজন অফিসারের অনুমতিপত্র নিয়ে। হাসপাতালেও যেতে পারতেনঅনুমতিপত্র নিয়ে। এভাবে ভালােই কাটছিল দিন।
হঠাৎ একদিন ব্যতিক্রম ঘটলাে। কর্নেল আকরামের বদৌলতে আমরা যতােই স্বায়ত্তশাসন ভােগ করি না কেন, ঊর্ধ্বতন স্টেশন হেড কোয়ার্টার্সের ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপরে চোখ রাখা। একদিন একজন তীব্র বাঙালি-বিদ্বেষী, রগচটা, পাগল গােছের মেজর ছিলেন ডিউটি অফিসার। তিনি সকালবেলা এলেন আমাদের শরীরচর্চা দেখতে। কর্নেল মান্নান সিদ্দিকী পিটি পরিচালনা করতেন। সবাই হাজিরও ছিলেন পিটিতে। হঠাৎ মেজর চিৎকার করে উঠলেন, “ব্রিগেডিয়ার খলিল কোথায়?’ কর্নেল মান্নান জবাব দিলেন, তিনি তাে পিটিতে আসেন না। তার আসার কথাও নয়। ব্রিগেডিয়ারের তাে পিটিতে ‘ফল-ইন’ করার কথা নয়।’ মেজর গর্জন করে উঠলেন, তাকেও আসতে বলাে।’ কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর আমাকে খবর দেয়া হলাে। গেলাম। মেজর হুকুম করলেন, ‘ফল-ইন’ অর্থাৎ লাইনে দাঁড়ান। কর্কশ স্বরেই বললাম, “মেজর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কি ব্রিগেডিয়ার পিটিতে বা কোন প্যারেডে ফল-ইন’ করেন?’ মেজর কিছুটা দমে গেলেও হার মানলেন না, সজোরে বললেন, ‘আপনি আমাদের বন্দি। ফল-ইন। শান্ত কণ্ঠেই বললাম, ‘এ ব্যাপারে আপনি আপনার কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করুন। আমি ফল-ইন করবাে না। কারণ এটা নিয়ম-বিরুদ্ধ। তবুও আপনার সম্মান রক্ষার্থে আমি আমার ঘর থেকে এ পর্যন্ত এসেছি এটাই আপনার জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। এ কথা বলে আমি চলে এলাম। কিছুটা বিমূঢ় হয়ে মেজর চলে গেলেন। পরে শুনেছিলাম এই মেজরের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বাংলাদেশে বন্দি। একটু পরেই আমি আমাদের গার্ড হাবিলদারকে বললাম, “চল স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাংলােতে। আনুপূর্বিক ঘটনা বিবৃত করার পর ব্রিগেডিয়ার মেজরটিকে সাবধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর অনুরূপ। ঘটনা আর ঘটে নি। আর একদিনের ঘটনা। সন্ধ্যার পরপরই আমার মা রান্নাঘরে পা পিছলে পড়ে গেলেন ও তার হাতের একটি বড় অংশ ধারালাে কিছুতে কেটে গেল এবং ঝুলতে থাকলাে। মনে হলাে ১৫/২০টা ফোড়ন লাগবে জোড়া দিতে হলে।
প্রমাদ গুণলাম। পরদিন সকালে হাসপাতাল খুললে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে। সেখানে কি চিকিৎসা হবে সেটাও অজানা। ততােক্ষণ এই অসুস্থ বৃদ্ধার আর কি সঙ্কট হবে চিন্তা করতে লাগলাম। ক্যাম্পের অনেকে দেখতে এলেন। ডা. মেজর মুরতজাও এলেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ সার্জন। বললেন, এখনি সেলাই না করলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। ক্যাম্পে টেলিফোনও নেই যে কর্তৃপক্ষকে অবগত করবাে ও অনুমতি চাইবাে। কী করি ভাবছি। মুরতজা বললেন, ‘স্যার, ওঁকে তৈরি করুন, আপনিও তৈরি হােন। আমি আসছি।’ মিনিট পনের পরে মুরতজা এসে হাজির- সুন্দর। ইস্ত্রি করা উর্দি পরে কঁাধে চকচকে মেজরের পদবি চিহ্ন। অবাক হলাম। বললেন, ‘বন্দি হওয়ার আগে আমি এই হাসপাতালে সার্জন ছিলাম। এদেরকে কখনােই পর ভাবি নি। জাতভেদ করি নি । কর্তব্য করেছি। মানবতাকেই উর্ধ্বে। স্থান দিয়েছি। দেখা যাক এর মূল্য এরা দেয় কি না। আপনি গাড়ি চালান হাসপাতালের দিকে। গার্ড কমান্ডার হাবিলদারকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম সি এম এইচে । মুরতজা দারােয়ানকে ডেকে গেট খুলতে বললেন ও অপারেশন থিয়েটারের চাবি দিতে বললেন। চাবি নিয়ে তিনি অপারেশন থিয়েটারে কর্তব্যরত সমস্ত কর্মচারীকে হুকুম দিতে লাগলেন—ভাবটা এমনি যে তিনি এখনও এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্জন। আর তাজ্জব ব্যাপার। কর্মচারীরা প্রথমত একটু অপ্রস্তুত হলেও শিগগিরই অত্যন্ত খুশি মনে মুরতজার হুকুম পালন করতে লাগলাে। মুরতজা অপারেশন থিয়েটারে গেলেন। সাদা গাউন, টুপি দস্তানা, নিয়মমাফিক পরে সার্জারি করলেন প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে। প্রসন্ন মুখে রােগীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে গাউন ইত্যাদি ছেড়ে কর্মচারীদের পিতৃসুলভ স্নেহসিক্ত কথাবার্তা ও ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে বসলেন। প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় দেখেছিলাম মুরতজার চোখেমুখে সেদিন। এই আত্মপ্রত্যয় তার স্বকীয় নিশ্চয়ই। তবে কর্মচারীসহ সকলকে নির্বিচারে সেবার স্বভাবগত কার্যক্রম সে প্রত্যয়কে জোরদার করেছে সন্দেহ নেই। দ্বিধা মুরতজার। ব্যবহারে সেদিন ছিল না। আমার মনেও সন্দেহ রইলাে না যে এই মুরতজা মানবসেবায় আন্তরিকতা ও মানবতাবােধের সাথে এই কর্মচারীদের সবারই পরিচিত। তাই এই সশ্রদ্ধ ভালােবাসা।
মেজর মুরতজাকে অনুরূপ পরিস্থিতিতে আর একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের একদিন কি দুদিন পরে। দু’একদিন যাবৎ অফিসার ও তাদের পরিবারের ওপর সিপাহিদের হামলা হচ্ছিল। অফিসাররা সবাই আত্মগােপন করে আছেন—প্রায় সবাই সেনাছাউনি ছেড়ে চলে গেছেন। এক অরাজক অবস্থা। আমি তখন প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধান। সেনাছাউনিতে বিভিন্ন সেনা ইউনিট পরিদর্শন করছিলাম সৈন্যদের শান্ত করতে ও অফিসারদের মনােবল বাড়াতে। এক পর্যায়ে সিএমএইচ গিয়ে পৌঁছলাম। সব স্থাপনাতে যা করে থাকি এখানেও তাই করা হলাে। নির্দেশমতাে আমার দেহরক্ষী দল গেটের বাইরে থেকে গেল। আমি আর আমার এডিসি, দুজনেই নিরস্ত্র এগিয়ে গেলাম সামরিক হাসপাতালের দফতরের দিকে। দু’দিক থেকে দুটি রাইফেলের গুলির শব্দ। যেহেতু গায়ে লাগে নি বুঝলাম ফাকা আওয়াজ। এগিয়ে গেলাম। ইতােমধ্যে গুলির আওয়াজ শুনে দেহরক্ষী দল ধেয়ে এসেছে। তাদেরকে ফিরে গেটের বাইরে যেতে বললাম। শ’খানেক গজ সামনে জন দুয়েক সৈনিক দাড়িয়ে। ইশারায় কাছে ডাকলাম। আমাদের নিরস্ত্র দেখে বােধহয় তারা সাহস করে এগিয়ে এলেন। ওদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন এগিয়ে এলেন। ক্রমে শ’খানেক সৈনিক আমার চারদিকে সমবেত হলেন। | একজনকে বললাম আপনাদের অধিনায়ককে ডেকে আনুন। অধিনায়ক। এলেন। তিনি দ্বিতীয় অধিনায়ক, ভারপ্রাপ্ত। সিভিলিয়ান কাপড় পরা—দাড়ি কামানাে হয় নি। উষ্কখুষ্ক চেহারা। ভয়েই চেহারাটা মলিন। তাঁকে জিগ্যেস করলাম, আর কোনাে অফিসার নেই।’ উনি বললেন, আর একজন আছেন। তিনি সার্জন এবং অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন করছেন। বুঝলাম যেসব সিপাহি গত দিন-দুয়েক আহত হয়েছেন তাদের অপারেশন চলছে। মনটা খুশি হলাে। নিকটস্থ কর্মকর্তাকে বললাম, অপারেশনের ফাকে সার্জন সাহেবকে একবার আসতে বলার জন্য।
ইতােমধ্যে সমবেত সৈনিকদের সাথে কথা বলছিলাম (এর বিশদ বিবরণ আমার অন্য পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে)। কিছুক্ষণ পরে সার্জন বেরিয়ে এলেন। সদ্য ইস্ত্রি করা নিখুঁত সামরিক পােশাক। কাধে মেজরের পদবি চিহ্ন ঝকঝক করছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের পরে দু’একদিন যাবৎ কোনাে অফিসার কাধে পদবি চিহ্ন পরার সাহস পেতেন না। যেমন আমার পাশে দাড়ানাে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কটিও পান নি, পাছে ‘সিপাহি-সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই’ স্লোগানধারী সিপাহিরা আক্রমণ করে বসে। আসবার সময় একজন স্ট্রেচারবাহিত রােগী এলাে দেখে সার্জন সাহেব। উচ্চকণ্ঠে স্ট্রেচার বহনকারীদের হুকুম দিলেন কোথায় নিয়ে যেতে হবে। লােকগুলাে কিছুটা ভুল পথ ধরতেই চিৎকার করে, গালাগালি করে, তুই তুকারি করে পুনরায় নির্দেশ দিলেন। সব সৈনিক ভিজে বেড়ালের মতাে অনেকটা কাপতে কাপতে হুকুম তামিল করছিল। অদ্ভুত অসামঞ্জস্য আমার সামনের এই সিভিলিয়ান পােশাক পরা অধিনায়ক ও সার্জন সাহেবের। বলাবাহুল্য, এই সার্জন সাহেবই মেজর মুরতজা। বিধাতাকে প্রশ্ন করলাম, সবাই মুরতজা হয় না কেন? সবাই না হােক, নিদেনপক্ষে বেশির ভাগ মানুষ মুরতজা হলে তােমার ক্ষতি কি? নাকি তােমার সৃষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবেএই ভয়? পূর্বাপর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় নওশেরার বন্দিজীবন অন্য যেকোনাে জায়গার চেয়ে ভালাে কেটেছে। কর্তৃপক্ষ সহানুভূতিপূর্ণ ছিল। আগেই বলেছি, এর প্রধান কারণ কর্নেল আকরামের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ। আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশােনার সমস্যা ছিল। তাকে অনুরােধ করাতে তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন যে আমাদের ছেলেমেয়েরাও পাকিস্তানি ছেলেমেয়েদের মতাে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত রিসালপুর ছাউনির স্কুলে গিয়ে পড়তে পারবে। একটি বড় সমস্যার সমাধান হলাে। এখানে বলে রাখি পরের বন্দিশালায় আমাদের এ সুবিধা দেয়া হয় নি। আমার বড় ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। তাও আবার ভার্নাকুলার বাংলা। যদিও পেশাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, তবুও বাংলা প্রশ্নপত্র পাঠানাে হলাে ও ছেলে ঠিকমতাে পরীক্ষা দিলাে; কিন্তু বিপদ হলাে ফল প্রকাশ নিয়ে । ফলাফল যখন বের হলাে তখন দেখা গেল উত্তীর্ণ ছাত্রদের তালিকায় ওর নাম নেই। অথচ ছাত্র মােটামুটি ভালাে । খোঁজ নিয়ে জানা গেল। যে, ভার্নাকুলারে সে গরহাজির।
অনেক লেখালেখি করে পেশাওয়ারে বন্ধু কর্নেল চিরাগ শাহর (প্রখ্যাত ন্যাপপন্থী সাংবাদিক সৈয়দ আমানুল্লাহ শাহের ভাই) সাহায্যে ওর বাংলা নম্বর যােগ করে ফল পাওয়া গেল। ও প্রথম ডিভিশনে পাস করেছিল। একদিন এক মেহমান এসে হাজির আমাদের কোয়ার্টার্সে। দরজা খুলে দেখি জেনারেল ওয়াসিউদ্দীন সাহেবের স্ত্রী। যেমন অবাক হলাম, তেমনি মনটা খুশিতে ভরে গেল। মহিলা পেশাওয়ারের সম্রান্ত পরিবারের সদস্যা। কাজেই গাড়ি করে তার পাকিস্তানের কোনাে জায়গায় যেতে কোনাে অসুবিধা ছিল না। তাই স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে ঠিক করেছেন ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে বাঙালি পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়ে আসবেন। বেগম ওয়াসি ব্যাখ্যার সুরেই বললেন এই কথাগুলাে। জিগ্যেস করলাম, “গেটে ঢুকলেন কিভাবে? ওরা তাে কোনাে পাকিস্তানিকে এখানে ঢুকতে দেয় না।’ উত্তরে বললেন, ‘বলেছি আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাচ্চাদের শিক্ষিকা (ওস্তানী)। ওরা সন্দেহ করে নি। তিনি কোহাটে ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হক, কর্নেল এ আর খান প্রমুখের সঙ্গেও দেখা করে এসেছেন। ওখানে নাকি ক্যাম্পে ঢুকতে অসুবিধা হয়েছিল। অনেক বাদানুবাদের পর প্রহরীসমেত ঢুকতে হয়েছিল। ওঁদের তুলনায় আমরা অনেক ভালাে আছি মনে হলাে। | আমরা ২১টি পরিবার বন্দি। এই ২১টি কোয়ার্টার্স মুখােমুখি দুই সারিতে বিন্যস্ত। মাঝখানে একটি সুরকির রাস্তা। বাসাগুলাে ইংরেজ আমলে সার্জেন্টদের জন্য করা ছিল। ইদানীং অবিবাহিত অফিসারদের থাকার ঘর। এইসব অফিসার সাধারণত ২/৩ মাসের প্রশিক্ষণের জন্যই নওশেরাতে আসেন। কাজেই পরিবার নিয়ে আসেন না। আমাদের বাসাগুলাের এক প্রান্ত কাটাতার দিয়ে ঘেরা। বেরুনাের রাস্তা কেবল আরেক প্রান্ত দিয়ে—প্রহরী পরিবেষ্টিত। বাসাগুলাের পেছন দিকে খেলার মাঠ। ওখানেই সকালে আমাদের শরীরচর্চা ও বিকেলে খেলাধুলা হতাে; কিন্তু এই নওশেরা ক্যাম্পে আমাদের দীর্ঘদিন থাকা হয় নি।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা