You dont have javascript enabled! Please enable it! আমাদের গৃহবন্দি জীবন-ক্ষমতার লড়াই-হামিদ গ্রুপের পরাজয় - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের পরাজয় ও নতুন পরিস্থিতিতে ক্ষমতার লড়াই

আমাদের গৃহবন্দি জীবন

১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ ঘটে পাকিস্তানের পরাজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। আমরা প্রায় ১১০০ সামরিক অফিসার এবং ৩০ হাজার সৈনিক তখন পাকিস্তানে। এছাড়া সরকারি দফতরে বেসামরিক কর্মকর্তা/কর্মচারী ছিলেন আরাে অনেক আইনত এরপর সপ্তাহখানেকের মধ্যে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমাদের কাছ থেকে আনুগত্য ফরম্ সই করে নেয়ার কথা এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারীদের দেশে পাঠানাের বন্দোবস্ত করা। আমাদের মতামত নেয়ার পর একটি তালিকা প্রস্তুত হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী আমাদের সরকারি কিংবা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের খরচে দেশে পাঠানাের কথা ক্রম-তালিকায় নাম ওঠার আগেই যদি আমরা কেউ কেউ নিজ ব্যবস্থায় বাংলাদেশে যেতে চাইতাম তাদেরকে ইচ্ছেমতাে যেতে দেয়াও উচিত ছিল। যে কোনাে সভ্য দেশে তাই করা হতাে; কিন্তু দেশটি পাকিস্তান—কোনাে সভ্য দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যােগ্য নয় তাই যা ঘটবার কথা ছিল হলাে তার অন্যরূপ আমাদের আনুগত্য প্রকাশের ফর্ম্ পূরণ করানাে হলাে ৩/৪ মাস পরে। এরপর নিয়মানুযায়ী আমাদের দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা; কিন্তু তার পরিবর্তে আরও ৩/৪ মাস পর আমাদের সবাইকে একত্র করে বিভিন্ন বন্দিশালায় পাঠানাে হলাে। এই বন্দিশালাগুলাে সামরিক বন্দিশালা তাে নয়ই, বরং উপচে পড়া সাধারণ কয়েদখানার চেয়েও অনেক খারাপ ও অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা সংবলিত । এটাই ছিল। আমাদের আনুষ্ঠানিক বন্দিজীবন ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় আমাদের এই জীবন। তবে আমাদেরকে প্রথমে নজরবন্দি ও পরে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে। 

এই অদ্ভুত অব্যবস্থাগুলাে সম্বন্ধে সংক্ষেপে বর্ণনা না দিলে পুরাে ব্যাপারটা ঠিক বােঝা যাবে না।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই অনুকূল সুযােগ-সুবিধায় অবস্থিত অফিসাররা ভারতের মধ্য দিয়ে পলায়ন করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে শুরু করলাে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাসেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ সদস্যরা বিদ্রোহ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানিদের মনে কোনাে সন্দেহ থাকে না যে সব বাঙালি সৈনিক মনে-প্রাণে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ স্পৃহা প্রবলভাবে পােষণ করে। তখন থেকেই বাঙালিদেরকে নজরবন্দি করে রাখা শুরু হলাে সিনিয়রদের বাড়ির চারদিকে বেসামরিক পােশাকে গােয়েন্দা গার্ড রেখে কার্যত তাদেরকে গৃহবন্দি করা হয়। বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল না, তবে একটি টিকটিকি গাড়ি সবসময় তাদের গাড়ির পেছন পেছন যেত। এক শহর থেকে আর এক শহরে গেলেও ওই গােয়েন্দা গাড়িটি নীরবে অনুসরণ করতাে অফিসের কাজে যুক্ত থাকায় কোনাে নিষেধ ছিল না। তবে বাঙালি সিনিয়র অফিসারদের উপস্থিতিতে যুদ্ধঘটিত কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়া হতাে না  বাঙালিদের পাসপাের্টও নিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাদের দপ্তর ঠিকই ছিল; কিন্তু ব্যক্তিগত স্টাফ ছাড়া অধস্তন কোনাে অফিসার ছিল না। তাদের কাজও ছিল না। কাজগুলাে অন্য পাকিস্তানি অফিসারদের দিয়ে করানাে হতাে।

ক্ষমতার লড়াই

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আমাদের অপশন অর্থাৎ আনুগত্য প্রকাশের ব্যাপারটা সম্ভব হলাে না। কারণ পাকিস্তানে তখন চলছে ক্ষমতার তীব্র লড়াই। এতােদিন পাকিস্তানে ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার অনুগত সামরিক শাসন। ইয়াহিয়া যুদ্ধে পরাজিত। পরাজিত একনায়ককে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে কি এই নিয়ে দ্বন্দ্ব অতএব, কে ক্ষমতা দখল করবে তাই নিয়ে তুমুল লড়াই ও ষড়যন্ত্র। এসব চরম সিদ্ধান্তকর প্রশ্নের তুলনায় আমাদের বন্দিত্বের ব্যাপার কিছুই নয়। তাই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিবরণই প্রথমে দেয়া প্রয়ােজন ক্ষমতার লড়াইয়ে ছিল তিনটি গ্রুপ। প্রথমটি ইয়াহিয়া গ্রুপ অর্থাৎ ইয়াহিয়া ও তার ব্যক্তিগত চেলাচামুণ্ডা সমন্বিত গােষ্ঠী। দ্বিতীয়টি জেনারেল হামিদ গ্রুপ ইয়াহিয়ার দু’নম্বর জেনারেল আবদুল হামিদ খানের নেতৃত্বে ইয়াহিয়ার সাবেক পরামর্শদাতাকারী জেনারেল, যারা ছয় চক্রান্তকারী’ বলে কুখ্যাত ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই অর্থাৎ সর্বজেনারেল পীরজাদা, ওমর, আবু বকর মিঠা, খুদা বখশ প্রমুখ একত্র হলেন জেনারেল হামিদের নেতৃত্বে এদেরকে পাঞ্জাবি গ্রুপও বলা হতাে।  তৃতীয় আর এক গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াহিয়ার তিন নম্বর জেনারেল, সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান খান। সঙ্গে ছিলেন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আবদুর রহিম খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভুট্টো ছিলেন ইয়াহিয়ার চাকরিতে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করতে ব্যস্ত। জাতিসংঘে ইয়াহিয়ার দূত হিসেবে শেষ ভাষণ দেয়ার পর জেনারেল গুল হাসান গংদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানে ফেরত আসার পথে রােমে অপেক্ষায় ছিলেন। পরিকল্পনা ছিল যে সময় হলেই ভুট্টোকে ইতালি থেকে নিয়ে আসার জন্য রহিম খান বিমানবাহিনীর বিমান পাঠাবেন। ভুট্টো পেছিবেন রাওয়ালপিণ্ডি এবং ক্রান্তিলগ্নটির জন্য পাঞ্জাব হাউজে অপেক্ষমাণ থাকবেন। এই ছিল ক্ষমতার লড়াইয়ে তিন সামরিক প্রতিপক্ষের অবস্থান।

এদিকে দেশের সাধারণ জনগণের অবস্থান ও মনােভাব ছিল একেবারেই ভিন্ন এবং বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। ১৬ ডিসেম্বর কৃত আত্মসমর্পণে পাকিস্তান অর্থাৎ পাঞ্জাবের জনগােষ্ঠী ছিল। চরমভাবে ক্ষুব্ধ, অপমানবােধে পাগলপ্রায়। কারণ তাদের পরমবীর পাঞ্জাবি যােদ্ধারা চরম অযােদ্ধা ভারতীয়দের কাছে শােচনীয়ভাবে পরাজিত। আরও অপমানকর এই যে, পরাজয়টি পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। কেবল তাই নয় পূর্ব পাকিস্তানে ৯৩ হাজার পরমবীর, পৃথিবীতে অপরাজেয়, পাকিস্তানি সৈনিক, ‘শেষ সৈনিক শেষ গুলি’ পর্যন্ত লড়াইয়ের পরিবর্তে চরম কাপুরুষতার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে এবং জান বাঁচিয়ে বন্দি হয়েছে।  এসব অচিন্তনীয় ও অসহ্য অপমানকর পরিস্থিতির জন্য স্বাভাবিকভাবে সমস্ত দোষ এসে বর্তায় সৈন্যদের, বিশেষ করে অফিসারদের ওপর। তারা তখন জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্র। একটি উদাহরণ দিলে তাদের মনােভাব পরিষ্কারভাবে বােঝা যাবে। শিয়ালকোট হচ্ছে কাশির ও ভারত সীমানা সংলগ্ন একটি জেলা। শেষ সিদ্ধান্তবাহী ট্যাঙ্ক যুদ্ধটি, যেখানে এক রাতে পাকিস্তানের ১০০টি ট্যাঙ্ক ভারতীয়দের হাতে বিধ্বস্ত হয়েছে, তা এখানেই ঘটেছে। সেইদিনই ইয়াহিয়া।খান বেতারে ঘােষণা করলেন, “আমরা ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক প্রস্তাবিত যুদ্ধ বন্ধ অর্থাৎ সিজ ফায়ার প্রস্তাবটি গ্রহণ করলাম।  এই শিয়ালকোট থেকে পিণ্ডি যাওয়ার সড়কপথ গুজরানওয়ালা জেলা শহর হয়ে। এক বাঙালি ক্যাপ্টেন শরীফ (পরে ব্রিগেডিয়ার) একটি জিপে করে বাঙালি ড্রাইভারকে নিয়ে পিণ্ডি আসছিলেন। ক্যাপ্টেন শরীফ বেশ দীর্ঘদেহী ও গঠন অনেকটা পাঞ্জাবিদের মতাে। এদিকে ড্রাইভারের ছােটোখাটো চেহারা দেখেই বােঝা যায় সে বাঙালি। গুজরানওয়ালা শহরে অন্য সব জায়গার মতাে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। চলছে সৈনিক দেখলেই অপমান করা ইত্যাদি। সেখানে পৌঁছানাের পর ক্যাপ্টেন শরীফের জিপটি ঘেরাও করা হলাে। শরীফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামানাে হলাে। শরীফ প্রাণভয়ে অস্থির তাকে হুকুম দেয়া হলাে গাড়ির বনেটের ওপর দাঁড়াতে। শরীফ তাই করলেন। তারপর জনতার পক্ষ থেকে হুকুম এল, আভি তুছি লেকার করাে।’ কি লেকচার করবে তাও বলে দিয়েছে কেউ কেউ প্রচণ্ড চিৎকার করে। বলতে হবে কিভাবে জনগণের রক্ত দিয়ে অর্জিত অর্থে কেনা অস্ত্রশস্ত্র ওরা চরম কাপুরুষতার সঙ্গে ভারতীয়দের হাতে তুলে দিলাে। কেউ কেউ চিৎকার করে বলে, বলাে তুমি কী রকম কাপুরুষ ইত্যাদি। এই সময় কয়েকজন এসে ড্রাইভারটিকেও হুকুম দিলাে সেও যেন নেমে উক্ত রূপ লেকচার দেয়। কিন্তু বাকি লােকেরা তাদেরকে নিষেধ করলাে, ‘নেহি নেহি। ওঁ লােগ তো ‘দালের (বীর) লােগ হ্যায়।

নিজ দেশের জন্য কেমন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ওকে লেকচার করতে হবে না। ওকে তাে চা খাওয়ানাে উচিত।’ তখন নিতান্ত সাহস করে ড্রাইভার বললাে যে, আমাদের সাহেবও তাে বাঙালি, পাঞ্জাবি নয়। শুনে জনতা হঠাৎই থেমে গেল এবং বললাে, ওদেরকে যেতে দাও। পাঞ্জাবি হারামিদেরকে ধর। এই ছিল মােটামুটিভাবে পাঞ্জাবের জনগণের মনােভাব। এদিকে পাঞ্জাব মানেই পাকিস্তান। এহেন পরিস্থিতিতে কোনাে জেনারেলের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা ছিল সুকঠিন। সেই বিবেচনায় ভুট্টো ভাগ্যবান। তার বুদ্ধিও ক্ষুরধার । চরম ধূর্ততাও এই সময় কাজে লাগালেন। এদিকে তার ষড়যন্ত্র-সঙ্গীদ্বয়ও অন্য দুই প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিক দক্ষ ও করিতকর্মা প্রমাণিত হয়েছিলেন। তাঁদের পরিকল্পনা এমনই ছিল যে, এই ক্ষমতার লড়াই যেদিকে মােড় নিক না কেন পরিস্থিতি মােকাবিলার বন্দোবস্ত পরিকল্পনার মধ্যেই থাকবে।  প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ ইয়াহিয়া খানকে দমন করা বিশেষ কষ্টকর হবে না। প্রথমত, যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরও কোনাে একনায়ক রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ তার পূর্বপদে বহাল থেকেছেন, এমন উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। নেই বললেই চলে। ইয়াহিয়ার চেলা-চামুণ্ডারা জানতাে, ইয়াহিয়ার প্রতি সামরিক-বেসামরিক কোনাে পক্ষের সমর্থন বিশেষ ছিল না। তবুও শেষ চেষ্টা। তবে এদেরকে নিরস্ত করার জন্য এয়ার মার্শাল রহিম খান বন্দোবস্ত রেখেছিলেন যে, প্রয়ােজনবােধে ইয়াহিয়াকে বিমান বাহিনী দ্বারা প্রাণের ভয় দেখানাে হবে। এরপর রইলাে হামিদ গ্রুপ। হামিদের প্রচেষ্টা হবে, ইয়াহিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে সামরিক অফিসারদের সমর্থন নিয়ে কুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ প্রচেষ্টার সফলতার সম্ভাবনা স্বল্প।

কারণ সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ জনগােষ্ঠীর আস্থা জেনারেলদের ওপর ছিল না বললেই চলে। তবুও যদি হামিদ সফল হয়ে যায় তবে গুল হাসানের বিশ্বস্ত সেনাগােষ্ঠী শক্তি প্রয়ােগ এবং রক্তপাতের মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে হবে অতএব, ক্ষমতায় আসার জন্য গুল হাসানকে যে প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হবে তার আকৃতি ও প্রকৃতিও কুর আকার ধারণ করতে বাধ্য বস্তুত হয়েও ছিল তাই যাই হােক, গুল হাসান-ভুট্টোর পরিকল্পনা ছিল একেবারে নিচ্ছিদ্র। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়ােজন যে, ধূর্ত ভুট্টোর ক্ষেত্রে এবং গুল হাসান—রহিমের জন্য, এই ষড়যন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু অভিন্ন ছিল না। ভুট্টো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতেন যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যেমন জেনারেলদের পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়, তেমনি আবার জেনারেলদের অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর সমর্থন ব্যতীতও ক্ষমতা দখল ও প্রাথমিকভাবে তা কবজায় রাখা সম্ভব নয়। অতএব ভুট্টো জানতেন যে, এই ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রাথমিকভাবে একজন বেসামরিক নেতাকেই, প্রতিভূ হিসেবে হলেও, সামনে রেখে জেনারেলদের অগ্রসর হতে হবে। আর অনুমান করা কঠিন। নয় যে, গুল হাসান ও রহিম খানও জানতেন প্রাথমিক পর্যায়ে ভুট্টোকেই সামনে রাখতে হবে পরে সময়মতাে ভুট্টোকে গুম করে দিলে ল্যাঠা চুকে যাবে।

হামিদ গ্রুপের পরাজয়

ক্ষমতার এই লড়াই ১৬ ডিসেম্বরের পর একেবারেই চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তিন পক্ষ তৈরি। গুল হাসান তার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপগুলাে আগে থেকে নিয়ে রেখেছিলেন, তবে তা ছিল অদৃশ্য। দৃশ্যত প্রথম ও খােলাখুলি পদক্ষেপ নিলেন হামিদ খান। তারই আদেশ অনুযায়ী ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল দশটায় রাওয়ালপিণ্ডিতে যতাে অফিসার ছিলেন তাদের মধ্যে মেজর ও তদোর্প পদবির সবাইকে আইয়ুব হল অর্থাৎ এক সময় যা পাকিস্তান পার্লামেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত, সেখানে একত্র হতে বলা হলাে। হলটি সেনাসদরের পাশে অবস্থিত। তখনাে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি। নীরবে নিজ প্রাসাদেই আছেন। তদুপরি তাঁর ব্যাপারে সর্বজনবিদিত বদনাম ছিল যে, তিনি প্রায় সর্বদাই নেশাগ্রস্ত থাকেন। অতএব হামিদই সর্বেসর্বা।  এই সমাবেশে হাজির হলেন প্রায় সাতশ’ অফিসার। আদেশকারী জেনারেল হামিদ খান। উদ্দেশ্য, ভারত বিজয় তাে হলাে না, এখন নিজেদের দেশটাকে বিজয়। প্রথম দুই-তিন সারিতে উপবিষ্ট প্রায় শ’খানেক অফিসার, যাদের’ কোর্টের কলারে লাল ট্যাব, অর্থাৎ তারা কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল পদমর্যাদার। বাকি সবাই লে. কর্নেল ও মেজর। বলা যায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসারদের বৃহৎ অংশ। এদের সমর্থন পেলে গােটা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন পেতে কিংবা তাদেরকে দমিত রাখতে কষ্ট হবে না। ভুট্টো, জেনারেল গুল হাসান ও এয়ার মার্শাল রহিম খান- এই তিনজন পাক-ভারত যুদ্ধের আগে থেকেই আলােচনা অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করে চলেছিলেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, ভুট্টো তাে ইয়াহিয়াকে দিয়ে শেখ মুজিব ও তার বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়ার বন্দোবস্ত ১৯৭১ সালের শুরুতেই করে রেখেছিলেন। অগণতান্ত্রিকভাবে হলেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে দেশদ্রোহী ঘােষণা করাতে পারলে সেক্ষেত্রে ভুট্টোই থাকবেন পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দল। দুই পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলে তাে কথাই নেই। ভুট্টো তখন থাকবেন পাকিস্তানের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা। অতএব, ভুট্টোই হবেন ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে সর্বপ্রকারে উপকৃত। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে যখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, তখন ভুট্টো ইয়াহিয়াকে পরিত্যাগ করে অন্য জেনারেল খুঁজতে লাগলেন ষড়যন্ত্রের জন্য। ১৯৭১ সালে জেনারেলদের মধ্যে ছিল সুস্পষ্ট দুটো ভাগ।

প্রথমটি ছিল, আগেই বর্ণিত, ছয় চক্রান্তকারী কিংবা পাঞ্জাবি জেনারেলদের গ্রুপ নামে খ্যাত। হামিদ খানের গ্রুপ। হামিদ ছিলেন ক্ষমতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে এবং ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য উত্তরসূরি। অন্য গ্রুপটি ছিল ক্ষমতার দিক দিয়ে তৃতীয় এবং পাঠান জেনারেল গুল হাসানের নেতৃত্বাধীন। ইয়াহিয়ার উত্তরসূরি হওয়ার উচ্চাভিলাষ গুল হাসানেরও ছিল। অতএব, পাঞ্জাবি হামিদ খানের সঙ্গে কোনােদিন হাসানের বনিবনা ছিল না, বরং অত্যন্ত প্রকট বৈরিতা ছিল। মিথ্যাচারে ঠাসা গুল হাসানের লেখা বইটিতেও এই বৈরিতার কথা লেখক অত্যন্ত জোরালাে ভাষায় প্রকাশ করেছেন।  হামিদ খান ছিলেন ভুট্টোর প্রধান প্রতিপক্ষ। অতএব, ভুট্টো গুল হাসানকে বেছে নিয়েছিলেন। ইয়াহিয়ার পরে যদি সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তবে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় আসার কথা হামিদ খানের, ভুট্টো কিংবা গুল হাসানের নয়। এদিকে দেশে যদি বেসামরিক শাসন ফিরে আসে তবে ক্ষমতায় আসার কথা ভুট্টোর। হামিদ খানের এই অফিসার সমাবেশের বিপরীতে গুল হাসানের কার্যক্রমও শুরু হলাে। ইয়াহিয়াকে দমানাের জন্য রহিম খানের বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমান। রাষ্ট্রপতির প্রাসাদকে বাহ্ (Buzz) করতে আরম্ভ করলাে অর্থাৎ বিমানগুলাে অত্যন্ত নিচু দিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে উড়ে আবার ওপরে উঠে যাচ্ছিল। এই বাযিং-এর উদ্দেশ্য ইয়াহিয়াকে পরিষ্কারভাবে বােঝানাে, আক্রমণ করলেই সব শেষ, অতএব প্রতিরােধ করাে না এবং তােমার দিক থেকে প্রতিরােধ করার কেউ নেই।’ গুল। হাসান ও রহিম খান গ্রুপ নিশ্চিত হলাে যে, ইয়াহিয়ার পক্ষে কেউ নেই। এরপর হামিদ খানের সাথে মােকাবিলা। গুল হাসান পিণ্ডি থেকে ৬৮ মাইল দূরে খারিয়ানে অবস্থিত তার একান্ত অনুগত আর্মার্ড ডিভিশনের একটি বড় অংশ পিণ্ডিতে মার্চ করালেন। ২০ ডিসেম্বর আইয়ুব হলে আয়ােজিত সমাবেশের আগেই সকালবেলা আমার সঙ্গে দেখা হলাে মিলিটারি একাডেমির এককালের সহপাঠী কর্নেল জাভেদ ইকবালের সাথে। তিনি খারিয়ান ডিভিশনের স্টাফ প্রধান অর্থাৎ ক্ষমতার দিক দিয়ে ডিভিশন অধিনায়কের পরেই তার স্থান। ডিভিশনের জিওসি ছিলেন একজন বাঙালি, জেনারেল ইসকান্দরুল করিম। জাভেদ ছিলেন যুদ্ধসাজে সজ্জিত। আমি হেসে হেসেই প্রশ্ন করলাম, কোথায় যুদ্ধে যাচ্ছাে জাভেদ? জাভেদ আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, চল যাই, তােমার বাসায় একসাথে দুপুরে খাওয়া হয়ে যাক। তখন অনেক অনেক খবর। শােনাবাে তােমাকে। জাভেদের মুখে শুনলাম যে, আজ খারিয়ান ডিভিশনকে এখানে আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য পিণ্ডিকে ঘেরাও করা, যাতে হামিদ গ্রুপ ক্ষমতা দখল করতে না পারে, বরং গুল হাসানের হাতে বন্দি হয়।

বস্তুত সেদিনই গুল হাসান ও রহিম খান তথা ভুট্টোর জয় সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। এবারে জেনারেল হামিদের সমাবেশে ফিরে আসা যাক। হামিদ তার বক্তৃতা শুরু করলেন। ঢাকায় ২৫ মার্চের রাতের ঘটনা, তথা পূর্ব পাকিস্তানে সেই কালরাতে সুসজ্জিত পাকসেনাদল নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে পশুসুলভ হিংস্রতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল মানবেতিহাসের সেই নিকৃষ্টতম ঘটনা কৌশলে এড়িয়ে গেলেন। ওই ঘটনাবলি কিছু কিছু ছুঁয়ে এসে গেলেন ডিসেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে। বললেন, ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করে বসলাে (আসল সত্যটা উলটো)। তারপর যুদ্ধ শুরু হলাে। অপরাজেয় পাকিস্তানি অর্থাৎ পাঞ্জাবি সৈনিকরা অসম সাহসে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু ভারতীয়দের সমরাস্ত্র উন্নতমানের এবং সংখ্যায় তারা প্রচুর। তাই পাকিস্তান বাহিনী সুবিধা করতে পারলাে না। হামিদ খান অনেক বিস্তারিতভাবে কথাটি বললেন। এরপর তিনি এলেন পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গনে। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন যে, জেনারেল নিয়াজির যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল ফোট্রেস প্রতিরােধ। অর্থাৎ সারাদেশের সীমান্তে কতােগুলাে দুর্গ বা ফোট্রেস গড়ে তােলা হবে। দুশমন এগুলাে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলে তাদেরকে পেছন থেকে আক্রমণ করা হবে। অতএব, তাদের অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে। এই ফোট্রেসগুলাে হবে খুলনা, যশাের, বগুড়া, হিলি, কুমিল্লা ইত্যাদি সামরিক ঘাঁটিগুলােতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের চারদিক ঘিরে থাকবে। কিন্তু শত্রু করলাে কি, প্রথমেই আমাদের দুর্বল বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিলাে। আকাশে তাদেরকে বাধা দেয়ার মতাে কেউ থাকলাে না। এরপরই প্যারাসুট দিয়ে সৈন্যদল নামাতে আরম্ভ করলাে ঢাকার চারদিকে। বড় নদীগুলাে যুদ্ধ করে পার না হয়ে নদীর অপরপারে প্যারাসুটের সাহায্যে নামতে আরম্ভ করলাে। তখন যুদ্ধের সাতদিন গত হয়েছে অর্থাৎ ডিসেম্বরের ১০ তারিখ । আমি নিয়াজিকে আদেশ দিলাম সীমান্তের দুর্গ প্রতিরক্ষা’ পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে সমস্ত সৈন্যদল ঢাকায় একত্র করতে। যতােদিন ঢাকা ও ঢাকা বেতার পাকিস্তানের দখলে থাকবে ততােদিন পর্যন্ত বহির্বিশ্বকে বােঝানাে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয় নি। আর ইতােমধ্যেই পূর্বেকার সমঝােতা ও পরিকল্পনামতাে বিশ্বের দুই পরাক্রমশালী শক্তি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। চীন আসবে উত্তর থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অজেয় নৌ-বাহিনী আসবে দক্ষিণ থেকে। এদের সামনে ভারত টিকতে পারবে না সন্ধি করবে। বহাল হবে স্ট্যাটাস কো অ্যান্টি (পূর্বাবস্থা) অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের পুনরুদ্ধার, শেখ মুজিব জেলে (ঠিক এই ভাষায় তা বলেন নি হামিদ খান, যা বলছিলেন তার মর্মটি ছিল এই)। কিন্তু এখানে বাদ সাধলাে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়াজির অভিমত, হামিদ বললেন।

নিয়াজির বক্তব্য ছিল, সীমান্ত থেকে সৈন্য ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব। নয়। কারণ দিনের বেলায় সৈন্য দেখলেই ভারতীয় বিমান ছোঁ মেরে নামে যেন খােলা উঠোনে একলা মুরগির বাচ্চাটি ধরবে। আবার রাতের অন্ধকারে সৈন্য নড়ানাে অসম্ভব; কারণ মুক্তিরা (হামিদ খান মুক্তি কথাটিই ব্যবহার করলেন) ওঁৎ পেতে আছে সর্বত্র। অতএব এ আদেশ মান্য করা সম্ভব নয়, এই ছিল নিয়াজির উত্তর।  দশ ডিসেম্বর গেল, এগারাে গেল, বারাে চলে যাচ্ছে কিন্তু দুই পরাশক্তির সৈন্য ও নৌবাহিনী নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসার নাম-নিশানা নেই। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জার গংয়ের প্ররােচনায় সিকিউরিটি কাউন্সিল যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব পাস করার চেষ্টা চালায় প্রায় প্রতিদিনই । কিন্তু প্রতিবারই তা নাকচ করে দেয় সােভিয়েত রাশিয়া একাই ভেটো দিয়ে। আমরা প্রমাদ গুণলাম । অতএব, পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ জয় ছাড়া অন্য উপায় নেই।  আইয়ুবের আমল থেকে অবিসম্বাদিতভাবে স্থিরকৃত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতি ছিল যে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, অর্থাৎ ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে তবে, একথা ঠিক যে, একেবারে প্রতিরক্ষাবিহীন পূর্ব পাকিস্তানের পতন অনিবার্য এবং দু’একদিনের মধ্যেই, তখন আমরা পাঞ্জাবিরা পৌছে যাব। দিল্লিতে। তারপর ভারত ‘বাপ’ বাপ’ করে সন্ধির প্রস্তাব দেবে। এই নীতি অনুসরণ করে বর্তমান যুদ্ধও চলছিল, হামিদ বললেন। কিন্তু দিন-দশেক যুদ্ধের পর পশ্চিম সীমান্তে পরিস্থিতি যা দাঁড়ালাে তাতে আমরা প্রমাদ গুণলাম। পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করা তাে দূরের কথা, এদিকে ভারত যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে লাহাের পৌঁছতে তাদের বেশি দেরি হবে না। অতএব, পাঞ্জাবের মা-বােনদের ইজ্জত বাঁচাতে আমরা পশ্চিমে আমাদের যুদ্ধ আরও জোরদার করলাম; কিন্তু আমরা ভারতে প্রবেশ করার পরিবর্তে ভারতই শিয়ালকোটের প্রায় অর্ধেক দখল করে নিয়েছে। অবস্থা চরম। ওদিকে পূর্ব। পাকিস্তান প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ভারতের হাতে অর্থাৎ স্বাধীন। এমন সময় কপাল।

জোরে পুনরায় ইন্দিরা গান্ধী রেডিওতে ঘােষণা জানালেন, “আমরা যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করছি। বাস্তব অবস্থা মেনে নিয়ে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধের বিপর্যয় বিবেচনা করে, তােমরাও নিজেদের মঙ্গলের জন্য তা মেনে নাও।’ | সেদিন ১৪/১৫ ডিসেম্বরের রাত, হামিদ বললেন, আমাদের একটি পুরাে আর্মার্ড ব্রিগেড অক্ষত অবস্থায় শিয়ালকোটের নিকটে ছিল। এই ব্রিগেডটিই ছিল আমাদের শেষ আর্মার্ড শক্তি। আদেশ দিলাম প্রাণপণে আক্রমণ করাে এবং ভারতীয় আর্মার্ড শক্তিকে ধ্বংস করাে কিংবা সুদূরে হটিয়ে দাও। যুদ্ধের প্রচণ্ডতম আর্মার্ড লড়াই হয়েছিল সেদিন; কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। আমাদের একশ’ ট্যাঙ্ক একদিনেই ধ্বংস হয়ে গেল, হামিদের কণ্ঠ করুণ। এরপর মুহূর্তখানেক হামিদ চুপ করে রইলেন। মনে হচ্ছিল কি বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে বললেন, ‘এদিকে ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ বন্ধ প্রস্তাব ঘােষণা করেই চলেছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম যে, ওটাও নিচ ও কাপুরুষ ভারতীয়দের আর একটা চালাকি বৈ কিছু নয়। তারা জানতাে আমরা মুসলমানরা কিছুতেই যুদ্ধ বন্ধ করবাে না—শেষ সৈন্য ও শেষ গুলি পর্যন্ত। লড়ে যাবাে। আর এদিকে সমস্ত দুনিয়াকে ওরা বােঝাতে পারবে যে, পাকিস্তান। জয় করা ছাড়া এ যুদ্ধ বন্ধ হতাে না। এই ছুতােয় তারা গােটা পাকিস্তান দখল করে নিতাে। কিন্তু আমরা তাদের চালাকি ধরে ফেললাম এবং ১৫ ডিসেম্বর রাতেই ঘােষণা করে দিলাম, আমরা যুদ্ধ বন্ধ প্রস্তাব মেনে নিলাম। শেষের কথাগুলাে বলার সময় হামিদ তার কণ্ঠস্বর ভারি করে ফেললেন, ভান। করলেন যে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছেন এবং আর কথা বলতে পারছেন না। সেই অবস্থায় তিনি পােডিয়ামের পেছন দিয়ে যাতায়াতের পথে দাড়ানাে তার। এডিসির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এডিসি প্রস্তুত ছিলেন—তিনিও একটি 

রুমাল হামিদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ছােট দরজা দিয়ে কিছুটা পেছনে গেলেন; কিন্তু পুরােপুরি বেরিয়ে গেলেন না এবং সবাই দেখতে পায় এমন করে চোখ মুছতে লাগলেন। এসব কিছুর জন্য তাঁর মিনিট দুই সময় লাগলাে । তারপর আবার লেকচার স্ট্যান্ডে ফিরে এসে বললেন যে, তিনি জানেন উপস্থিত শ্রোতাদের মনের অবস্থা; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে কেউ লড়তে পারে না। একথা বলে একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তারপর তিনি শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করলেন। এরপর যে দৃশ্যের অবতারণা হলাে তেমনটা আমি জীবনে কখনাে দেখি নি। দেখবাে বলে কল্পনাও করতে পারি নি। হামিদের বক্তৃতার সময় প্রশস্ত হল ঘরে উপস্থিত প্রায় সাতশ’ অফিসারই যেন কড়াইয়ের তেলের মতাে মিনিটে মিনিটে সেকেন্ডে সেকেন্ডে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। শেষের দিকে কড়াইটি যেন অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠলাে। এই সময় হামিদের আহ্বান, ‘কোনাে প্রশ্ন।’ তপ্ত কড়াইটা এবার যেন ফেটে পড়লাে। কিংবা চার্জ করা বােমাটি পেল যেন দিয়াশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ। প্রায় বিশজন মেজর ও লে. কর্নেল পদবির অফিসার একসাথে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁদের চোখে আগুন। উচ্চস্বরে চিৎকার। কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সবাইকে নিজেরাই থামিয়ে দিয়ে মেজর রউফ নামক একজন অফিসারকে বক্তব্য রাখার সুযােগ দেয়া হলাে। মেজর রউফ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত । কিন্তু একটা নির্ধারিত বয়স পর্যন্ত সব সৈনিক আর্মির রিজার্ভ হিসেবে থাকেন অর্থাৎ যুদ্ধ লাগলে তাদের ডাকা হয় ও কর্তব্য দেয়া হয়। সেই সুবাদে রউফও রি-কড় হয়ে এসেছিলেন। অন্য সবার মতাে তিনিও অপমানে ক্ষোভে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন। রউফের ব্যবহৃত ভাষার হুবহু পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। তবুও চেষ্টা করবাে যথাসম্ভব তার বক্তব্য তুলে ধরতে। রউফ বললেন, “জেনারেল হামিদ (রউফ হামিদকে ‘স্যার’ না বলে নাম ধরে সম্বােধন করলেন), আপনার কাছে আমার প্রথম প্রশ্নটি হলাে এই যে, আপনারাই আমাদের শিখিয়েছেন এবং বিশ্বাস করিয়েছেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অজেয়। একজন পাকিস্তানি তিনজন ভারতীয় সৈন্যের সমান। তাই যদি হয় তবে আপনি ও আমাদের সামনে বসা এই চাকচিক্যময় পােশাকধারী। জেনারেলদের অধীনে আমাদের সেনাবাহিনী হারলাে কেন? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমি যুদ্ধের ডাক পেয়ে চিঠি পেলাম মাস দুয়েক আগে। খবর নেয়ার জন্য গেলাম গুজরানওয়ালা জেলার ডিসির অফিসে।

ডিসি সাহেব বললেন, রি-কর্ড। তাে হয়েছেন, এখন পাকিস্তানের যেকোনাে জায়গায় বদলি হতে পারেন। যদি কোনাে বিশেষ জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে বলুন। হামিদকে (জেনারেল) বলে দেব ও সেই জায়গাতে আপনার পােস্টিং দেবে। এখন আমার প্রশ্ন, আপনি জেনারেল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বজ্যেষ্ঠ অধিনায়ক। আপনাকে ‘হামিদ’ বলার সাহস ও অধিকার একজন ডিসি কি করে পেল? এই সময় জেনারেল হামিদ কিছু বলার জন্য উদ্যত হলেন। রউফ ধমকের সুরে বললেন, আমি জানি ডিসি কেন সাহস পেল। সীমান্ত এলাকায় আপনি সরকার থেকে ২৫০ একর জমি নিয়েছেন। কৃষি বিভাগের ট্রাক্টর ও বীজ ইত্যাদি। দিয়ে ডিসিই আপনার জমি চাষ করিয়ে দেয় আর আপনি উৎপাদনটি নেন। কী, যা বলেছি—ঠিক নয়?’ | হামিদ কিছু বলার আগেই অন্য একজন মেজর দাঁড়িয়ে গেলেন। তার কথা, “আপনারা সব জেনারেলরাই এ সমস্ত দুর্নীতি করে আর দেশটাকে লুট করে আরামপ্রিয় হয়েছেন। আপনারা যুদ্ধে জিতবেন কী করে? আপনারা হারবেন না তাে হারবে কে? এই সময় অন্য এক মেজর উঠে দাঁড়ালেন এবং উচ্চস্বরে চিল্কার করে বলতে লাগলেন, আপনারা কি মনে করেন আপনাদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কিভাবে খরচ করেন আমরা তা জানি না? জানি, খরচ করেন মদ্যপান ও মেয়েবাজি করে। এই সময় আর একজন মেজর দাড়িয়ে বললেন, ‘আপনি এখনি মদ ত্যাগ করুন এবং প্রতিজ্ঞা করুন যে জীবনে কখনও মদ ও মেয়েবাজি করবেন না।

এই সময় আরও দু-একজন মেজর/লে, কর্নেল সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলেন, “কেবল আপনি নন, সামনে বসা সব জেনারেলরাই এখনি পদত্যাগ করুন।’ এক পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ার কোরের ব্রিগেডিয়ার ফজলে রাযিক (পাঠান তিনি। মদ্যপান করতেন না) দাঁড়িয়ে অনেকটা মেজরদের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করলেন, কিছুটা জনপ্রিয়তা লাভ করা ও পরে মেজর জেনারেল হওয়া যায় কিনা। তিনি বলতে লাগলেন, “ঠিক কথাই তাে। মদ, দুনীতি এসব সামরিক বাহিনীতে থাকা উচিত নয়।’ কথাটি বলে তিনি সমর্থনের আশায় চারদিকে কিছুটা গর্বের সাথে তাকালেন। এই ফাঁকে এক মেজর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে প্রশ্ন করলেন, আপনি ব্রিগেডিয়ার ফজলে রাযিক ভাে? আপনার মতাে চোর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর আছে কিনা সন্দেহ। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, পাকিস্তানের বড় শহরের প্রত্যেকটিতে আপনার জমি নেই? আপনিও পদত্যাগ করুন এবং এখনি। আপনার জমিগুলােও বাজেয়াপ্ত করা হবে।’ ফজলে রাযিক ‘চোরের মতােই বসে পড়লেন। এই দৃশ্যটি দেখে আমার মনে হয়েছিল, যে ভয়াবহ নাটকটি সেদিন প্রত্যক্ষ করছিলাম তা একেবারে কৌতুকবিহীন ছিল না। ‘বিশ্ববিখ্যাত মার্শাল জাত’ পাঞ্জাবি সৈনিকদের এহেন কাণ্ড দেখে অন্যান্য পাঞ্জাবি ও পাঠান জেনারেল/ব্রিগেডিয়াররা ভীত অবস্থায় মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাদের প্রচণ্ড ভয় ছিল যে এতােক্ষণ তাে কেবল কথাই চলছে, কখন না মারপিট শুরু হয়। এদিকে লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন ও আমরা দু’তিনজন সিনিয়র বাঙালি, দৃশ্যটিতে প্রথমত কিছুটা ভীত বােধ করলেও শেষের দিকে আনন্দই অনুভব করছিলাম এবং হলের মধ্যে কেবল আমাদের মাথাই উচু ছিল।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা