You dont have javascript enabled! Please enable it! পলায়ন প্রচেষ্টা-পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু পিছু ধাওয়া করার সময় যাত্রাপথের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে - সংগ্রামের নোটবুক

পলায়ন প্রচেষ্টা

সপ্তাহান্তে প্রায় প্রতি শনিবারে যেতাম রাওয়ালপিণ্ডি, নতুন খবর শুনতে ঢাকা  থেকে যদি কেউ সেই সপ্তাহে এসে থাকে, তার কাছে ছুটে যাই দু’চারজন পাকিস্তানি বন্ধু-বান্ধব ছিলেন তাদের কাছেও যাই গল্প করতে—যদি ঢাকার কোনাে খবর পাওয়া যায়। ইসলামাবাদে যে সিভিলিয়ান বাঙালি অফিসাররা ছিলেন তাদের কাছেও অনেক খবর পাওয়া যেত। অতএব, রােববার ঢাকা তথা পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে অনেকটা হাল নাগাদ খবর নিয়ে মংলা ফিরতাম। খবর পেলাম শেখ সাহেব ও ড. কামাল হােসেন ব্যতীত প্রায় সব আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে চলে গিয়েছেন এবং সেখানে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। অবশেষে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের সীমান্তে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হলাে। এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের সৈনিকরা শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছে। মেহেরপুরে গঠিত নতুন বাংলাদেশ সরকারে (পরে মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত) কর্নেল ওসমানী এম.পি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হয়েছেন। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু পিছু ধাওয়া করার সময় যাত্রাপথের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। গ্রামে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই হত্যা করছে। সেই সঙ্গে নারী ধর্ষণ, লুটপাট তাে চলছেই। এর ফলে নিতান্ত প্রাণ বাঁচানাের জন্য হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ নর-নারী উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে পৌঁছাতে লাগল। অতএব, অতি শিগগির ভারতও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য-সহায়তা দেয়া এবং উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার কাজ সরকারিভাবে নিতে বাধ্য হলাে। ভারতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলাে এবং নিয়মিত সৈনিক ও ইপিআর সৈনিকদের রেজিমেন্টে ভাগ করে পুনর্গঠিত করে বিভিন্ন সেক্টরে বিন্যস্ত করা হলাে। এসব খবর আমরা পিণ্ডিতে পেতাম ও পরিষ্কারভাবে বুঝতাম যে, ঠিক এই সময়টিতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের প্রয়ােজন পাকিস্তান প্রবাসী আমাদের মতাে বাঙালি অফিসারদের, বিশেষ করে সিনিয়র অফিসারদের।

অতএব, আমরাও পথ খুঁজতে লাগলাম কি করে পালিয়ে গিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধে যােগ। দেয়া যায়। জানতাম যে-কোনাে দিক দিয়েই হােক একবার পাকিস্তান সীমান্ত পার হলে তাে আর বাধা নেই। তবে একটি রাস্তা ছিল পুরােপুরি বন্ধ । সে হলাে বিমানযাত্রা। বাঙালি সামরিক অফিসারকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিমানে পাকিস্তানের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিতাে না। কিছুদিন পর আমাদের পাসপোের্টও আটক করা হলাে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। শুনলাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন তার কর্মস্থল মুলতানের ‘কোর’ (Corps) কমান্ড থেকে দু’একদিনের জন্য পিণ্ডি এসেছেন। শুনেই ছুটে গেলাম তার কাছে। তিনি রাওয়ালপিণ্ডি অর্ডন্যান্স অফিসার্স মেসে থাকতেন। সাদরে তিনি বসতে দিলেন। কথাবার্তা শুরু হলাে কিন্তু প্রাত্যহিক মামুলি আলাপ ছাড়া আমাদের মনের কথা কেউই খুলে বলতে পারছিলাম না। কি জানি, মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কার মনের কী ভাব, কী চিন্তাধারা? হঠাৎ আমার মনে পড়লাে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি জেনারেল ওয়াসি তাঁর। বাঙালি ব্যক্তিগত সহকারীকে নিজের উদ্যোগে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর দিয়ে যে, ১০ ফেব্রুয়ারির কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র হামলা দ্বারা উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা হবে। মার্শাল ল’ অব্যাহত থাকবে। শিগগিরই পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানাে শুরু হবে। সামরিক জান্তার প্রত্যাশা ছিল সামরিক শক্তি বৃদ্ধি মার্চ মাসের মাঝামাঝি শেষ হবে এবং তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর সামরিক আঘাত হানা হবে। এখানে বলে রাখা দরকার, শেখ সাহেব ও তার ঘনিষ্ঠ সহযােগীরা জানতেন এ খবর; কিন্তু তাদের সামনে অন্য কোনাে পথ খােলা ছিল না।

যতক্ষণ পর্যন্ত সামরিক জান্তা আলােচনা করতে চায় ততক্ষণ আলােচনা করতে হবে। তবে মার্চের মাঝামাঝি এই শক্তি বৃদ্ধির কার্যক্রম সমাপ্ত হয় নি বলেই ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চের পরবর্তী সময়ে আলােচনার প্রহসন চালিয়ে গিয়েছেন। ২৫ মার্চ প্রস্তুতি শেষ এবং সেই রাতেই ঘটে চরম আঘাত। বঙ্গবন্ধুর সমালােচকরা বলে থাকেন, তিনি যদি মার্চ মাসের প্রথমেই স্বাধীনতা ঘােষণা করতেন তবে এতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতাে না। এই সমালােচনার উত্তর দীর্ঘ এবং তা বর্তমান রচনার আওতায় পড়ে না। তবে একটি কথা বললে সমস্যার জটিলতা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ উপলব্ধি ঘটবে। নেহায়েত আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে কোনাে প্রদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশই মেনে নিতে পারে না; কারণ বহু দেশে তাদের অংশবিশেষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে। তাছাড়া এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানােও সহজ নয়। সর্বোপরি, অত্যন্ত অবিশ্বাস্য ও লজ্জার ব্যাপার হলেও এ কথাটি আজ স্বীকার করতেই হবে যে, ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে যিনি নিজে কিংবা তার পরিবারবর্গ বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে এমন মুসলমান এখনও এ দেশে আছেন যিনি পূর্বেকার পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যদি ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করা হতাে তবে এ দেশের বহু বাঙালি মুসলিম পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভুট্টোকে নয়, ইয়াহিয়াকে নয়, মুজিবকেই দায়ী করে আহাজারি করতাে। যাক, একথাটাও এই আলােচনার বিষয়বস্তু নয়। তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ রেখে বরং আমার পলায়ন প্রসঙ্গে আসা যাক। জেনারেল ওসমানীর মাধ্যমে শেখ সাহেবের কাছে জেনারেল ওয়াসির বার্তা পাঠানাের কথা তার একান্ত সহকারী সুবেদার সাহেবের কাছে শুনেছি। অতএব, আমিই সাহস করে কথাটা পাড়লাম এবং বললাম যে এখন আমাদেরও তাে কিছু করা উচিত।  কথাটা বলে ফেলে বুঝতে পারলাম জেনারেল ওয়াসিও উসখুস করছিলেন আমাকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা এমন ছিল যে, এসব কথা বাঙালি হয়েও হঠাৎ একজন আরেকজনকে চট করে বলতে পারতাে না। অত্যন্ত ঔৎসুক্য নিয়ে ওয়াসি কথাটা শুনলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘কি করা যায়?’ আমি একটি পরিকল্পনা চিন্তা করে এসেছিলাম। ওয়াসি ছিলেন ‘কোর’ অধিনায়ক। প্রত্যেক কোরেই একটি করে ক্ষুদ্র বিমানের ইউনিট থাকে। এই বিমানগুলাে যুদ্ধক্ষেত্রে নিচু দিয়ে উড়ে দীর্ঘপাল্লার কামানের গােলা কোথায় পড়লাে। দেখে এবং সেগুলাে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া কোর’ অধিনায়কের জন্য একটি বিশেষ বিমান থাকে, যাতে তিনি যখন ইচ্ছে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন, প্রস্তাবিত আক্রমণ কীরকম ভূমির ওপরে কীভাবে হতে পারে ইত্যাদি পর্যবেক্ষণে যেতে পারেন। জেনারেল ওয়াসির অধীনে যে বিমান স্থাপনাটি ছিল তার অধিনায়কও বাঙালি, মেজর (পরে মেজর জেনারেল) লতিফ। এদিকে মুলতান ভারত সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরত্বে নয়। অতএব, ঐ বিমানে ওয়াসি, আমার আর লতিফের পরিবার ঠাসাঠাসি করে হলেও উঠে সােজা পূর্ব দিকে গিয়ে সীমান্ত। পার হতে পারবে।

ওয়াসি অনেকক্ষণ ধরে পরিকল্পনাটি মনে মনে ওলটপালট করে পরীক্ষা। করে নিলেন। অবশেষে বললেন, “উত্তম। বাস্তবায়নযােগ্য পরিকল্পনা।’ ওয়াসি ছিলেন অল্পকথার মানুষ। আমি কাল-পরশু মুলতান ফিরে যাচ্ছি। এ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা যাবে। তার দু’দিন পূর্বে তােমাকে জানাবাে। তুমি পরিবারসহ মুলতান চলে আসবে।’ সব ঠিকঠাক করে আমি বিদায় নিলাম। মনটা প্রফুল্ল হওয়ার কথা, তাই হলাে। বুক থেকে কেমন একটা অপরাধবােধজনিত বােঝা নেমে গেল; কিন্তু কি  আশ্চর্য  অন্যদিকে বুটায় যেন কিছুটা দুরু দুরু ভাবও অনুভূত হতে লাগলাে। এমনটা হবে ভাবি নি। তবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনের গভীরে প্রবেশ করে বােধগম্য হলাে, পরিকল্পনাটিতে যে ঝুকি ছিল, ব্যর্থতা অর্থাৎ ধরা পড়ে যাওয়ার ভীতিটা, একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগে পরিণত হয়ে মনের প্রত্যাশা পূরণের প্রফুল্লতাকে অনেকটা কাবু করে ফেলতে পারলাে। মংলায় ফিরে এসে এই প্রফুল্লতা-উদ্বেগ মেশানাে অনুভূতিতে দিন কাটতে লাগল। পরিবারের কাউকে কিছু বললাম না। তবে মনে মনে, কি কি সঙ্গে নেব সব গুছিয়ে ফেললাম। বাস্তবে গােছাতে ঘণ্টা। দুয়েকের বেশি লাগবে না হয়তাে। মােটামুটি তৈরি হয়ে বসে আছি। আর জেনারেল ওয়াসির টেলিফোনের অপেক্ষা করছি; কিন্তু টেলিফোন আসে না। প্রায় দিন দশেক হয়ে গেল। ভাবছি আমিই টেলিফোন করব কিনা।  এমন সময় একদিন জেনারেল ইরশাদ আমাকে বললেন, ‘শুনেছ তাে, জেনারেল ওয়াসি সেনাসদরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আসছেন। হয়তাে এসেই গিয়েছেন।’ ইরশাদ ভাবলেন, একটা ভালাে খবর আমাকে দিলেন। ওয়াসি মুলতানে ফিরে গিয়ে দু’একদিনের মধ্যে আদেশ পেলেন তাঁকে পিণ্ডি সেনাসদরে বদলি করা হয়েছে। এর ফলে আর যাই হােক, আমাদের পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়ে গেল। আমি যেন চুপসে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম আমার বদলিরও দেরি নেই। পাকিস্তান প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা প্রণয়ন, যা আমার ওপরে ছিল, কোনাে বাঙালিকে সেই গুরুতর দায়িত্বে বহাল রাখবে না ওরা।  এর মাসখানেক পরে আমারও বদলির পালা। আমি মংলায় এসেছিলাম বছরখানেকের জন্য। কোর’ সদরে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি আমার পেশাগত কর্তব্যের অংশবিশেষ। অতএব, জুন/জুলাইয়ের দিকে আমাকে বদলি করা হলাে সেনাসদর পিণ্ডিতে। পেশাগত দিক দিয়ে পদটি একজন ব্রিগেডিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত খুশির কারণ হতে পারে। কিন্তু দেশে যখন যুদ্ধাবস্থা তখন এই অফিসটির গুরুত্ব ততােটা নয়। অতএব, একজন বাঙালি অফিসারকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে নিষ্কর্মা ও দায়িত্বহীন রাখার জন্য পদটি ছিল অত্যন্ত উপযুক্ত। রাওয়ালপিণ্ডি গেলাম, একটা ভালাে বাড়ি দেয়া হলাে।

জীবন আরামের পাঞ্জাবি সহকর্মীরা ঈর্ষান্বিত। কারণ আমার নতুন অফিসের পূর্বসূরিরা সবাই পরবর্তী জীবনে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। অতএব, এই অফিসের ঐ পদটির জন্য অনেকে নানাভাবে চেষ্টা করতেন। তাঁরা সবাই ধরে নিলেন আমার ভবিষ্যও অতি উজ্জ্বল। কিন্তু আমার মনের অবস্থা ভিন্ন। জেনারেল ওয়াসির সাথে সীমান্ত অতিক্রম করার পরিকল্পনা তাে ভেস্তে গেল। পিণ্ডিতে এসে ভাবতে লাগলাম, সীমান্তনিকটবর্তী আমাদের আরও একজন বাঙালি অফিসার আছেন। তিনি করাচিতে অবস্থিত সপ্তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। তাঁর দায়িত্ব সিন্ধু-রাজস্থানের সীমান্তের এক অংশের প্রতিরক্ষা। অতএব, সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়ায় তাঁর কোনাে বাধা নেই। স্থির করলাম তার সাথে আলাপ করতে হবে।  যদিও আমার পাকিস্তানের বাইরে যাওয়ার পাসপাের্ট বাজেয়াপ্ত করা। হয়েছিল; কিন্তু তখনও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আমার যাতায়াতের ওপর কোনাে বাধা আরােপ করা হয় নি। একটি পরিদর্শন কার্যক্রম অনুমােদন করালামকরাচির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখবাে। যথাসময় উপস্থিত হলাম করাচিতে। ঐদিন সন্ধ্যায় গেলাম মালীর সেনানিবাসে সপ্তম বেঙ্গল সদর দফতরে, লে. কর্নেল এরশাদের (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) বাসায়। আমরা অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরস্পরের চিন্তাধারাও জানতাম। অতএব, সময়ক্ষেপণ না করে আলােচনা শুরু হলাে। আমি, এরশাদ। ও এরশাদের স্ত্রী তিনজনে আলােচনা করছি কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়া যায়। ম্যাপ খুলে বসলাম-এরশাদের সপ্তম বেঙ্গলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সীমান্ত এবং করাচি থেকে সেখানে জিপে করে যাওয়ার রাস্তা ও পথের দূরত্ব সবকিছু আলােচনায় এলাে; কিন্তু সন্তোষজনক কোনাে ফলাফল বেরুলাে না । করাচি থেকে সীমান্তের দূরত্ব, যেদিক দিয়ে গণনা করা যাক না কেন, পাঁচশ’ মাইলের কম নয়। রাস্তার বেশির ভাগ অংশই পাকা নয়। এই রাস্তায় সারারাত বিরামহীনভাবে গাড়ি চালালেও সকালের আগে গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। অথচ আমাদের সীমান্ত অতিক্রম এক রাতের মধ্যে করতেই হবে। কারণ পরদিন সাতসকালে সবাই জানতে পারবে যে, আমরা পালিয়েছি। অতএব, অত্যন্ত ভগ্নহৃদয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিদায় নিলাম এরশাদ দম্পতির বাসা থেকে। পরদিন ফিরে এলাম রাওয়ালপিণ্ডিতে।

রীতিমতাে অফিসে যাই; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনাে কাজ নেই। তখন স্বভাবতই পাকিস্তান সেনাসদরের মনােযােগ ও ব্যস্ততা নিবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে। যে দু’একটা কাজের আদেশ এসেছে তা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কিত। ভারতের সাথে যুদ্ধ হলে ভারতের জন্য কোন্ অঞ্চল দিয়ে অগ্রসর হওয়া বেশি সুবিধাজনক সে সম্বন্ধে বিশ্লেষণ। বলাবাহুল্য, এই কাজের জন্য আমার দিক দিয়ে মনােযােগ দেয়ার মতাে কর্তব্যবােধ আমি অনুভব করতাম না। অতএব, কাজটি আমার সহকারী পাঞ্জাবি। কর্নেলের ওপর ন্যস্ত করে দিলাম। বিশেষ খোঁজখবরও নিতাম না হেতু ধীরগতিতে চলছিল কাজ। ‘ এদিকে একমাত্র ভাবনা কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করা যায়। ইসলামাবাদের বেসামরিক অফিসার ও বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করি। ইশারা-ইঙ্গিতে বলি যে, যদি কোনাে পথ পাওয়া যায় তবে যেন দয়া করে আমার জন্যও বন্দোবস্ত করেন। একদিন পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম-সচিব আবদুর রশীদ কানে কানে বললেন যে, তিনি একটি যােগসূত্র হয়তাে বের করতে পারবেন। আমি যেন তৈরি হয়ে থাকি। তিনি জামালপুর জেলার লােক, আমার বাড়ির কাছের, বিশেষ অন্তরঙ্গ  তিনি ধার্মিক মানুষ, নিয়মিত ইসলামাবাদের মসজিদে নামাজ পড়তে যান। সেখানকার ইমাম সাহেব ‘গায়ের এলাকা’ অর্থাৎ সীমান্ত প্রদেশ ও আফগানিস্তানের সংলগ্ন এলাকার অধিবাসী, যেখানকার পাঠানরা বাহ্যত পাকিস্তানের অংশ, কিন্তু কার্যত স্বাধীন। রশীদ সাহেব তাকে বােঝালেন যে, পাঠানরা যেমন নিজেদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করে থাকেন, তেমনি বাঙালিরাও পাঞ্জাবিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দেয়ার জন্য রশীদ সাহেবের দু’চারজন বন্ধু বাঙাল মুলুক যেতে চান। সরকার তাে ওঁদেরকে যেতে দেবে না, অতএব গােপনে তাদেরকে আফগানিস্তানের সীমান্ত পার করিয়ে দিতে হবে। এর জন্য যাবতীয় খরচপত্র তারাই বহন করবেন। ইমাম সাহেব যদি তাদের সাহায্য করেন তবে অত্যন্ত উপকার হবে। ইমাম সাহেব, বাঙালিদের বিশেষ করে রশীদ সাহেবকে পছন্দ করতেন। তিনি সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। তবে বন্দোবস্ত করতে কয়েকদিন সময় লাগবে ইমাম সাহেবের বাড়ি খাইবার পাসে এবং আফগান সীমান্তের কাছাকাছি। অতএব, পেশাওয়ার-কাবুল সীমান্তের চেকপােস্টের কাছ দিয়ে পার হতে হবে

তবে ভয়ের কিছু নেই। সাহায্যকারীরা ইমাম সাহেবের বিশ্বস্ত লােক। তখন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। সপ্তাহখানেক পরে রশীদ সাহেব এসে বললেন, সব তৈরি, তবে ডেপুটি সেক্রেটারি ড. সাত্তার ও তার ভাই ক্যাপ্টেন দেলওয়ার অনেক কাকুতি-মিনতি করায় তাদেরকে তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন। যে তারা দু’জনই প্রথমে যাবেন। অতএব, ঠিক হয়েছে তারা যাবেন আগস্টের শেষের দিকে এবং ওখানে পৌছে খবর পাঠাবেন। সেই খবর পেয়ে আমি পরিবারসহ আমার গাড়িতে করে পেশাওয়ার পৌঁছাবাে। তারপর সমস্ত ব্যবস্থা ওদের ঠিক হলাে সাত্তার সাহেবরা নিরাপদে সীমান্ত পার হওয়ার পর খবর পাঠাবেন। খবর হবে এইরকম, মেহমান মঙ্গলমতাে পৌঁছেছে, জলিল।’ চিঠিখানা লেখা হবে বাংলায়। অতএব, আবারাে সেই আগের মতাে অনুভূতি, মুক্তির প্রত্যাশায় উৎফুল্লতা, সেই সঙ্গে বুকে দুরুদুরু ভাব। একদিন বাসার বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় একটি চিঠি দিয়ে গেল ডাকপিয়ন। চিঠিখানা বিলেত থেকে আসা। চিঠি পড়ে অবাক হলাম সেই বহু পরিচিত হাতের লেখা, কর্নেল ওসমানীর। গােটা গােটা অত্যন্ত সুন্দর হাতের  লেখা, খলিল, আমরা ২৪ সেপ্টেম্বর কুসুমের বিয়ে ঠিক করেছি। এ বিয়েতে তােমাকে আসতেই হবে—যেভাবে পারাে। তােমাদের চাচা।’ ওসমানীকে আমরা ‘চাচা ওসমানী’ বলে একে অপরের কাছে পরিচয় দিতাম। ওসমানীও কথাটি জানতেন। চিঠিটা প্রথমে বিলেতে কারাে কাছে পাঠানাে হয়েছিল। ঐ বিলেতি ভদ্রলােক পরে নতুন লেফাফায় চিঠিখানা আমাকে পাঠিয়েছেন। বলা বাহুল্য, চিঠিখানা একটি অবর্ণনীয় অনুভূতির উদ্রেক করলাে। মনে হলাে, “আহা যদি শামিল হতে পারি।’ যদিও তখন পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের সেন্সরশিপ ব্যবস্থা অতীব কঠোর ছিল তথাপি লিখলাম, চাচা সাহেব, আমাদের প্রিয় কুসুমের বিয়েতে আসার উদগ্রীবতা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। ভাগ্য ভালাে থাকলে হয়তাে হাজির হতে পারি।’ চিঠিখানা পাঠালাম আমার এক চাচাত ভাইয়ের ঠিকানায়। নিচে দিলাম একটি নাম যে নামে আমাদের রেজিমেন্টের সব অফিসারই আমার স্ত্রীকে কৌতুক করে ডাকতাে। যদিও কর্নেল ওসমানী আমার হাতের লেখার সাথে পরিচিত, তবুও ঐ ছদ্মনাম দেখে আরও নিশ্চিত হবেন। চিঠিখানা শহরের রাস্তার পাশে একটা ডাকবাক্সে ফেলে এলাম। সেই সাথে আমার সেই চাচাত ভাইকে আরও একটা চিঠিতে সঙ্কেতে জানালাম ওসমানীর চিঠি তাঁর কাছে কীভাবে পৌঁছাতে হবে। এদিকে ড, সাত্তার সাহেবদের পৌছানাের সংবাদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি। কথা ছিল ওঁরা যাওয়ার পরদিন রাতের মধ্যে খবর পাঠাবেন, লােক মারফত হাতে হাতে। পরদিন, তার পরদিন, তাও নয়, তিনদিন হয়ে গেল খবর নেই। রােজ দু’বার করে রশীদ সাহেবের কাছে খবর জিগ্যেস করি ।

পরের দিকে রশীদ সাহেবও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। যতাে দূর মনে পড়ে সেদিন ছিল ৩ সেপ্টেম্বর। তখনও গরম কাল, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বেশ শীত শীত। বেলা আড়াইটা নাগাদ হঠাৎ কোথা থেকে ক্যাপ্টেন তাহের (পরে মুক্তিযুদ্ধে আহত ও জাসদের সামরিক শাখা গণবাহিনীর সংগঠক কর্নেল তাহের, যাকে জিয়ার আমলে ফাসি দিয়ে হত্যা করা হয়) ও ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন (পরে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে সর্বহারা পার্টিতে যােগদান), দু’জনেই এসে হাজির। | তাহেরের চোখেমুখে তাড়াহুড়াে ভাব। বেশি ভূমিকা না করে সােজাসুজি জানালেন তার প্রস্তাব। তিনি পিণ্ডি থেকে প্রায় একশ’ মাইল দূরে সীমান্ত প্রদেশের অ্যাবটাবাদ জেলায় নিয়ােজিত। সেখান থেকে দশ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে এসেছেন। এসেই পিণ্ডির বন্ধু-বান্ধবের কাছে খবর নিয়ে বেড়াচ্ছেন, কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করা যায়। এভাবে তার ছুটির তিন দিন কেটে গেছে। বাকি রয়েছে সাত দিন। এই সাত দিনের মধ্যে তাকে ভারত পাড়ি দিয়ে ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী শহর নেত্রকোনায় পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে শিশুপুত্রসহ স্ত্রীকে নিয়ে পুনরায় সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যেতে হবে। নতুবা দশ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর তার রেজিমেন্টে খবর রটে যাবে যে, তাহের পলাতক এবং নেত্রকোনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওঁৎ পেতে বসে থাকবে। অতএব, তাঁর হাতে সময় নেই, কিন্তু আজই তিনি ও ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন খবর পেয়েছেন যে, আগামীকাল আমি পরিবারসহ সীমান্ত পার হয়ে কাবুলে যাচ্ছি। অতএব তাহেরের একান্ত অনুরােধ যে, আগামীকাল তাহের যাবেন এবং আমি আরেকদিন পরেই যাবাে। আমি প্রস্তাবটি শুনে আশ্চর্যান্বিত হলাম এই ভেবে যে, এই অতি গােপনীয় পরিকল্পনাটি তাহের এবং জিয়াউদ্দিন জানলেন কী করে। প্রশ্ন করে সদুত্তর পেলাম না। ওরা প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন। এদিকে আমি ভাবছি যে, জীবনে অনেক পরিস্থিতি দেখা দেয়, যেখানে উদারতার অবকাশ থাকে এবং উদারতা দেখিয়ে স্বার্থত্যাগ করা যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিটি ছিল এমন যে, এখানে উদারতা নয়, স্বার্থপরতাই প্রয়ােজন। অতএব, আমি সােজা বলে দিলাম যে তা সম্ভব নয়। আমি যাচ্ছি পরিবারসহ, আর ওঁরা দুজনই পুরুষ এবং একলা। তাই স্বার্থত্যাগের প্রশ্ন ওঠে। না। আমি আগামীকাল যাবাে এবং ওরা দুজন যাবে পরের দিন কিংবা তার পরের দিন ।  এই কথা শুনে তাহেরের চোখে পানি এসে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমার হাতটা চেপে ধরে বসে থাকল। আমার মনটাও নরম হয়ে উঠল। আমি তাহেরের কথায় রাজি হয়ে গেলাম বললাম, তৈরি থাকো, আজই খবর আসবে। তােমরা কাল সকালে রওনা হবে।’

এতােক্ষণ তাহের ও জিয়াউদ্দিন অত্যন্ত উদ্গ্রীবতা নিয়ে আমাকে রাজি করার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু যেইমাত্র আমি রাজি হয়ে গেলাম, ওদের মনেও সেই মুক্তির প্রত্যাশা ও ঝুঁকির অনিশ্চয়তায় বুক দুরুদুরু ভাব শুরু হয়ে গেল।  আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে আমি ওঁদের মানসিক অবস্থা অনুভব করছিলাম। ওঁদের ওপর মায়াও হলাে। ঘরে ছিল ব্র্যান্ডি। নানা কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য রেখে দেয়া। উঠে গিয়ে দুটো গ্লাসে সামান্য ব্র্যান্ডি ঢেলে নিয়ে ওঁদের খেতে দিলাম। বললাম, “এক ঢােকে গিলে ফেল।’ ওরা তাই করলাে। মিনিটখানেক পরে দেখি ব্র্যান্ডি তার কাজ করেছে। দু’জনেই প্রফুল্ল। ওঁরা হাসতে লাগলাে। বললাে এখন তারা জিয়ার আবাসস্থল ইঞ্জিনিয়ার্স অফিসার মেসে গিয়ে তৈরি হবেন। রাতে এসে আমার কাছ থেকে আগামীকালের যাত্রার ব্যবস্থাদি জেনে নেবেন। ওরা দু’জনেই চলে গেলেন। তখন আনুমানিক বেলা চারটা। সন্ধে হতে দেরি নেই। টেলিফোন করলাম রশীদ সাহেবকে ইসলামাবাদে। তার কণ্ঠস্বর চাপা ও অতিশয় উদ্বিগ্ন। বললেন, খবর এসেছে এবং আমাদের নির্ধারিত ‘কোড অনুযায়ীই। তবে বাংলায় নয়, ইংরেজিতে এবং টাইপ করা, তাও বড় অক্ষরে। গেস্টস্ এরাইভ সেফ, জলিল।’ রশীদ সাহেবের মতাে আমিও বুঝলাম খবরটি সেনাবাহিনীর গােয়েন্দা বিভাগের লেখা। অর্থাৎ প্রথম ঝাঁক পাখি খাচায়। দ্বিতীয় ঝাকের জন্য খাচা প্রস্তুত। আর কথা না বাড়িয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। বুঝলাম ভাগ্য এবারও বিরূপ। শুধু ভাগ্য বিরূপ তাই নয়, এবার বিপদও আসন্ন। কারণ প্রথমত ড. সাত্তার ও ক্যাপ্টেন দেলওয়ার যে শুধু ধরা। পড়েছেন তাই নয়, গােয়েন্দা বাহিনীর গুঁতাে খেয়ে আমাদের ‘কোড’সহ সব কথা এবং পরিকল্পনাকারীর পরিচয় ও এর পরে কারা যাবেন সেসবও বলে। দিয়েছেন। তাই, খবরখানা লেফাফায় করে রশীদ সাহেবকে পাঠানাে হয়েছে। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম প্রাপ্য শাস্তির জন্য। বেচারা রশীদ সাহেবের জন্যই বেশি মায়া হলাে। প্রবল এক অপরাধবােধ মনকে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগলাে। তিনি একটি উচ্চপদের চাকরি থেকে শেষ নাগাদ জেল খাটবেন, নেহায়েত আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে! আর বাঙালি কয়েদিদের ওপর পাকিস্তানের পুলিশি অত্যাচারের কথাও আমার অজানা ছিল না। এইরূপ একান্ত ভারাক্রান্ত মনে অপেক্ষা করছি, রাতে তাহের ও জিয়া আসবেন আগামীকালের পরিকল্পনা শুনতে; কিন্তু ওঁরা এলেন না।

রাতে ভালাে ঘুম হলাে না। সকালবেলায় উঠে পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখি প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় হেডলাইনে লেখা : গতকাল পাকিস্তান সরকারে কর্মরত একজন যুগ্ম সচিব (আসলে উপ-সচিব) ও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অফিসার তাঁর ভাই খাইবার গিরিপথের কাছ দিয়ে পালানাের সময় পাকিস্তান গােয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক ধৃত।’ খবরে ড. সাত্তার ও ক্যাপ্টেন দেলওয়ারের নাম দেয়া হয়েছে। রশীদ সাহেবকে আর টেলিফোন করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলাম না। সকাল দশটা কি এগারােটা। শিয়ালকোট ব্রিগেড সদর দফতর থেকে টেলিফোন। আমার সাথে কথা বলবেন। টেলিফোন হাতে নিলাম। একজন মেজর পদবির অফিসার প্রশ্ন করলেন, “ওই ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর আবুল মনযুর (পরে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে মেজর জেনারেল) কি আমার বাসায়? বললাম, না তাে। কিন্তু কী হয়েছে তার?’ আজ সকাল থেকে তিনি তাঁর বাসায় নেই, তাঁর পরিবারও নেই। বাসা থেকে মনে হয় সবাই কোথাও গিয়েছেন। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে। তাই আমরা ভাবলাম আপনি। হয়তাে জানেন কোথায় গেছেন।’ একটু ধমকের সুরে বললাম, ‘এই মনযুর কিংবা অন্য কোনাে অফিসার কখন কোথায় থাকেন তা জানতে তােমরা আমাকে জিগ্যেস করবে কেন?’ তখন অপর প্রান্তের মেজর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে বলেই ফেললেন, বাঙালি অফিসাররা তাে সবাই সিনিয়র হিসেবে সাধারণত আপনার বাসায় যান। তাই জিগ্যেস করলাম। আমাকে মাফ করবেন স্যার।’ বুঝলাম মেজরটি গােয়েন্দা বিভাগের এবং তাদের কাছে এসব ব্যাপার গােপন থাকে না। এর আগেও দু’একজন অফিসার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে আমার বাসা হয়ে গেছেন। আমার বাসা ঘিরে রাখা গােয়েন্দারা নিশ্চয়। তাদের প্রতিবেদন সদর দফতরে পাঠিয়েছেন। অতএব, এ নিয়ে অতাে বেশি ঘাটাঘাটি না করাই স্থির করে আর কথা না বাড়িয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম।

পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম মেজর মনযুর পালিয়েছে ও পরিবারসহ সফলভাবে পালিয়েছে। খুব খুশি হলাম; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটু রাগও হলাে মনযুরের ওপর। ওর সুবিধে ছিল যে তার ব্রিগেড শিয়ালকোটের সীমান্তে অবস্থিত। পরিদর্শনের ভান করে সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়া ওর জন্য কোনাে সমস্যা ছিল না। অতঃপর দরকার সুবিধাজনক জায়গা দেখে রাস্তা ছেড়ে ভারতমুখী করে জিপের অ্যাক্সিলেটরের ওপরে জোরে চাপ দেয়া ও স্টিয়ারিংটি শক্তভাবে ধরে রাখা। ও নিশ্চয় জানতাে আমিও আমার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ছিলাম। একটু খবর দিলেই পারতাে। সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করে টেলিফোন করা তাে এমন কোনাে সমস্যার ব্যাপার নয়। এদিকে ভাবতে লাগলাম জিয়াউদ্দিন ও তাহেরের কী হলাে? জিয়ার মেসে খবর নিলাম। আশ্চর্য, তারাও নেই। তারাও নাকি কাউকে কিছু না জানিয়ে কাল রাতে উধাও। একদিন পরে জানতে পারলাম সমস্ত ঘটনা। | আমার বাসা থেকে মেসে ফিরে গিয়ে জিয়াউদ্দিন ও তাহের ঠিক করলেন যে, সেই রাতে জিয়ার নিজস্ব গাড়ি করে প্রায় শ’দেড়েক মাইল দূরে শিয়ালকোটে যাবেন এবং চটজলদি মনযুরকে রাজি করাবেন সীমান্ত অতিক্রম করতে। প্রয়ােজন হলে মনযুরের শিশু সন্তান আর এক ছােট বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে সীমান্ত পার হতে হবে রাতে রাতেই। শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনামাফিক তারা তিনজন অগ্রসর হন ও সফলভাবে সীমান্ত পার হয়ে যান। 

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল জিয়া ও তাহের উভয়ে অত্যন্ত ভালাে করে জানতেন যে, আমি আধ ঘণ্টার নােটিশে পরিবারসহ আমার গাড়িতে করে তাঁদের সঙ্গে যােগ দিতে পারতাম মনে হলাে ওঁরা অত্যন্ত স্বার্থপর। এদিকে ড. সাত্তার ও দেলওয়ার ধরা পড়ার পর সবসময় আশঙ্কা করছিলাম কখন আমাকে পরিবারসহ বন্দি করা হবে এই অবস্থায় ওঁদেরকে বিশেষভাবে স্বার্থপর মনে হলাে; কিন্তু পরে উপলব্ধি করলাম এসব ব্যাপারে বােধহয় সবাই স্বার্থপর হয়। হয়তাে এমনি অবস্থায় আমিও অনুরূপ স্বার্থপরতাই করতাম। তখন সীমান্ত পার হওয়ার বিপদ ও সমস্যাসঙ্কুল দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে বােধহয় অন্য কোনাে চিন্তার জন্য স্থান সঙ্কুলান হয় না। এভাবে মনকে প্রবােধ দিয়ে ভাবতে লাগলাম আমার ও যুগ্মসচিব রশীদ সাহেবের কী হবে।  যথারীতি অফিসে গেলাম। শুনলাম রশীদ সাহেবও তাই করেছেন। মনের ভেতরে গােপনে একটু আশা ছিল। রশীদ সাহেবের নাম তাে ড. সাত্তারের মুখ থেকে গােয়েন্দা বিভাগ বের করে নিয়েছে। তা না হলে চিঠিটি এলাে কি করে । তবে হয়তাে আমার নাম নাও বলে থাকতে পারেন, কিন্তু না। অফিস-ফেরত পাঞ্জাবি আরদালি ও আমার বাঙালি বাবুর্চির মুখে শুনলাম যে, আমার বাড়ির সামনে ও পেছনের গােয়েন্দা রক্ষী দ্বিগুণ করা হয়েছে।  এমনিভাবে গেল কয়েকদিন। একদিন এক বাঙালি উপ-সচিবের কাছ থেকে খবর শুনলাম যে, রশীদ সাহেবকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং সাত দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ভাবলাম, আহা যদি অনুরূপ বন্দোবস্ত আমার ক্ষেত্রেও করা হতাে; কিন্তু তা হবে না জানতাম। কারণ রশীদ সাহেব সম্বন্ধে যা ছিল শাস্তিমূলক, আমার বেলায় তা হতাে আমার জন্য আশীর্বাদমূলক। যা হােক, আমার পলায়ন ও সীমান্ত অতিক্রমের এই তৃতীয় চেষ্টা শেষ চেষ্টাতে পরিণত হলাে। গােয়েন্দা রক্ষী এমন প্রবল হলাে যে, তাদের ফাঁকি দেয়ার প্রচেষ্টা অসম্ভব ছিল। কুসুমের বিয়েতে উপস্থিত হওয়ার ভাগ্য আমার হয় নি।

সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা