মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক ঘটনাবলি ও পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের মনােভাব
২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু
তারিখ : ২৯ মার্চ ১৯৭১, স্থান : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১ নং কোর’ (corps)-এর সদর দফতর মংলা, সময় : সকাল এগারােটা। কোর সদর দফতরের অফিসারদের চায়ের মিলনী। সভাঘরে সকলে একত্র হয়ে চা-পানের কথা। একজন মেজর জেনারেল, দু’জন ব্রিগেডিয়ার, কয়েকজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও মেজর উপস্থিত। আমিও রয়েছি সেখানে। আমরা অপেক্ষা করছি কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইরশাদের জন্য। একটু পরেই তিনি তার অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন এবং চা-পর্ব শুরু হলাে সেনাবাহিনীর এই সাপ্তাহিক চা-পর্বের উদ্দেশ্য, একত্রে চা-পানের মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য গড়ে তােলা ও বজায় রাখা। এছাড়া বিভিন্ন দফতরের অফিসারদের মধ্যে যদি ছােটখাট সমস্যা থাকে পরস্পরের সাথে আলােচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা। আর তার চাইতেও প্রয়ােজনীয়, কোর কমান্ডার বিভিন্ন অফিসারের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথাবার্তা বলেন, পরস্পর পরিচিত হন এবং কারাে কোনাে সমস্যা থাকলে সে সম্পর্কে অবগত হন কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে কোর কমান্ডারের কাছে কোনাে সমস্যা নিয়ে পৌঁছানাে। নিম্নপদস্থ অফিসারের পক্ষে বহু সময় ও বাধাসাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে বিকল্প এই প্রথাটি বিশেষ কার্যকর ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ও অকল্পনীয় হত্যাকাণ্ড শুরুর পর এই প্রথম চা-চক্র। অতএব, সে ব্যাপারে আলােচনা উঠবেই জানতাম। তাই যাওয়ার কোনাে ইচ্ছে ছিল না; কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই, যেহেতু অফিসে এসেছি। ২৫/২৬ মার্চ রাতে ঢাকায় সংঘটিত ঘটনাবলি সম্পর্কে জানার জন্য প্রায় ষাট মাইল দূরে রাওয়ালপিণ্ডিতে গিয়েছিলাম ২৭ মার্চে। সবই যে জানতে পেরেছি তা নয়। তবে যতােটুকুই জেনেছি তাতে আমার ও আমার পরিবারবর্গের যে মানসিক অবস্থা হয়েছিল তা বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। মনে বারবার একটি প্রশ্ন জেগে উঠতে লাগল- আধুনিক ও সভ্য মানবসমাজে এমন বর্বরতা কী করে সম্ভব? অথচ এরা উচ্চস্বরে দাবি করে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানেরই অর্ধাংশ এবং দুই অংশ পরস্পরের ভাই নিজেকে কোনাে রকমে টেনেটুনে অফিসে যাই। যথাসম্ভব কাজ করি। কারাে সাথে বিশেষ কথা বলি না। ওরাও কেউ ঢাকার প্রসঙ্গ আমার কাছে তােলে নি। আশা করছিলাম হয়তাে আজকেও কথাটি না উঠতে পারে। কিন্তু ২/৪ মিনিট একথা-ওকথার পর ‘কোর’ কমান্ডার লে. জেনারেল ইরশাদ। আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ঢাকার ঘটনাবলি সম্পর্কে শুনেছি। কিনা। কিছু কিছু শুনেছি বলার পর জানতে চাইলেন আমার প্রতিক্রিয়া কি অর্থাৎ বাঙালির প্রতিক্রিয়া কি?
কারণ সেখানে আমিই ছিলাম একমাত্র বাঙালি পাঞ্জাবিদের প্রতিক্রিয়া জানার আগ্রহ তাে তার থাকার কথা নয়। যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলার চেষ্টা করলাম; কিন্তু বলার সময় গলা। কিছুটা কেঁপে উঠলাে তাে বটেই বললাম, আমি সব খবর শুনতে পাই নি। মনে হয় আংশিকই শুনেছি তবে যা শুনেছি তার এক-দশমাংশও যদি সত্যি হয় তবে নিশ্চিতভাবেই ধরে নিতে। পারেন যে পাকিস্তান নামক দেশটি একটি অতীতের বিষয় হয়ে গেছে (পাকিস্তান ইজ এ থিং অব দি পাস্ট)। উপস্থিত সবাই হয়তাে কিছুটা বিরূপ। প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছিল, কিন্তু দেশটি ভেঙে গেছে’ এমন কঠোর মন্তব্য আশা করে নি। মনে হলাে সবাই যেন একটু চমকে উঠল। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতায় কাটল তারপর জেনারেল ইরশাদ অনেকটা ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘এই দেশটি রক্ষা করার দায়িত্ব তাে সেনাবাহিনীরও রয়েছে। তাই না? সেই। অনুসারেই ঢাকায় অ্যাকশন নিতে হয়েছে আর তাে উপায় ছিল না।’ এই বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। বলা বাহুল্য এ সম্বন্ধে কোনাে কথাই আমার। ভালাে লাগছিল না। তবুও উত্তরের অপেক্ষায় তিনি তাকিয়ে রয়েছেন দেখে বললাম, “সেনাবাহিনীর কর্তব্য আদেশ-প্রাপ্ত হয়ে দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা। জাতিকে রক্ষা নয়। ঢাকার ব্যাপারটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নয়। যা হােক, এসব তর্কের ব্যাপার। আমি কেবল বলতে চাইছি এরপর পাকিস্তান নামক দেশটির কী হবে। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই দেশটি ভেঙে যাবে।’ আমার মন্তব্য শুনে সেখানে উপস্থিত কেউ সন্তুষ্ট তাে হলেনই না, বিশ্বাসও করলেন না। তাদের চেহারা দেখে গােড়াতেই মনে হয়েছিল যে, তারা ঢাকায় গৃহীত সামরিক তৎপরতায় অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এতদিন পর্যন্ত যে সামরিক বাহিনীকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বাঙালিরা সেনাছাউনিতে অপমানজনক ও অসহায়ভাবে আটকে রেখেছিল তার সমুচিত জবাব দেয়া হয়েছে বলে এরা সামরিক বাহিনীর ওপর অত্যন্ত খুশি। ঢাকায় কিছু আওয়ামী লীগপন্থীকে হত্যা করা হয়েছে? তা তাে হবেই। এছাড়া উপায় কি? এই রকমই একটা মনােভাব ছিল এদের সবার; কিন্তু বাঙালি জনগণও যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে পারে এ চিন্তা তারা মােটেই করে নি। আর এই প্রতিরােধের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে, এসব তাে একেবারেই অবিশ্বাস্য। জেনারেল ইরশাদ আমার জবাব শুনে বললেন, আমি বুঝতে পারি এই তিক্ত ঘটনায় তােমরা কতটা আহত বােধ করছে। কিন্তু তুমি কি জান আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা কী রকম নৃশংসতার সাথে বিহারিদের হত্যা করেছে, তাদের ওপর কত অত্যাচার চালিয়েছে? এরপর কি সেনাবাহিনীর ওপর কর্তব্য বর্তায় না এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার?’।
উপস্থিত সবার প্রতি আমার অন্তরে তখন ঘৃণা ও প্রতিশােধ-আকাক্ষা। তর্ক কিংবা আলােচনা করার মতাে মনের অবস্থা আমার একেবারেই ছিল না। বরং ঘৃণা, অপমান, অসহায়ত্বের বেদনায় স্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে চুপ করে গেলাম কিন্তু জেনারেল ইরশাদ আবার বললেন, “দেখ খলিল, আমি তােমার মানসিক যন্ত্রণা দেখে অত্যন্ত দুঃখিত। তবে আমি তােমার কাছে কয়েকটা জিনিস জানতে চাচ্ছি। তুমিই বল, সেনাবাহিনী এই অবস্থায় কি করতে পারত আলােচনার প্রতি আমার প্রবল অনীহা দেখে এবং সর্বোপরি আমার আশাতীত রূঢ় মন্তব্য শুনে জেনারেল ইরশাদের সেদিন আর প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি প্রশ্ন করেই চলেছেন এর কারণ মনে হয়, আমার মনের বিদ্যমান অবস্থা বুঝেও কিছু খবর আমার কাছ থেকে, একজন বাঙালির কাছ থেকে তিনি জানতে চাচ্ছিলেন।আর এতেই আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলেন যে, তখনকার পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধেও তার খেয়াল ছিল না। কোর সদর দফতরের সব ক’জন অফিসার আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে। এঁদের সকলের সামনে এইসব স্পর্শকাতর আলােচনা একেবারেই নিষিদ্ধ হওয়ার কথা; কিন্তু তিনি কথা চালিয়েই যাচ্ছেন আমার মনে একবার সন্দেহ জাগল, কি ব্যাপার? সবাইকে সাক্ষী রেখে আমার এইসব দেশদ্রোহী বক্তব্য নেয়া হচ্ছে না তাে? তবে সঙ্গে সঙ্গে মনে হলাে, আমার দেশের এই পরিণতির মধ্যে আমাদের ভূত-ভবিষ্যৎ তাে একেবারেই ফরসা অতএব এ নিয়ে আর চিন্তা কেন? সেই সঙ্গে আমার এটাও মনে পড়ল, জেনারেল ইরশাদ আমার সঙ্গে এমনি বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ইতােপূর্বেও বহুবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলােচনা করেছেন ও করে অভ্যস্তই ছিলেন। জেনারেল ইরশাদ পেশাগত জীবনে এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। পাকিস্তান, ভারত ও অন্য যেসব দেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কিত তাদের সম্বন্ধে তার ভালাে জ্ঞান ছিল। এদিকে দেশ-বিদেশের খবর শােনা আমারও বিশেষ অভ্যাস।
বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ভারতের আকাশবাণী শােনা আমার নেশা। সেই সূত্রে আমাদের মধ্যে একটা কথােপকথন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইরশাদ ছিলেন স্বল্পভাষী। গাড়িতে চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ পরিক্রমণকালেও তিনি নির্বাক ও নিপ বসে। থাকতেন। গাড়িতে এ ডি সি ছাড়া কাউকে নিতেন না; কিন্তু এ ডি সির সাথেও বাক্যালাপ হতাে না। এমনি প্রকৃতির ইরশাদ আমাদের সাপ্তাহিক চা-পানের আসরে পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় কার্যক্রম, কুমতলব ইত্যাদি নিয়ে মাঝে মাঝেই কথা বলতেন এবং ওখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য তুলে ধরতেন তার কথার যুক্তি হিসেবে। এইসব কথাবার্তার মাঝে আমি দু-একবার বলার চেষ্টা করেছি যে, ইরশাদ যা শুনেছেন সেসব একতরফা ভারতে অন্য ধরনের অবস্থানও রয়েছে, যেমন অমুক ভারতীয় নেতা এ সম্বন্ধে এই বলেছেন ইত্যাদি। এভাবেই আলাপচারিতা দীর্ঘায়িত হতাে এবং কখনাে কখনাে চা-বিরতির সময় ফুরিয়ে যেত বলে আমাকে অফিসে ডেকে নিয়েও অসমাপ্ত আলােচনা চালিয়ে যেতেন। ভারতের আকাশবাণীর সম্প্রচার কোনাে পাকিস্তানি অফিসারই শুনতেন না। তারা ধরে নিয়েছিলেন ওটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ব্যাপার এদিকে অন্তর্মুখী মনের ইরশাদের যে দু-একটা বিষয়ে আগ্রহ, তার মধ্যে প্রধান ছিল বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও গােয়েন্দা সম্পর্কিত খবরাখবর এই সূত্রে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি, আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, ছয় দফা ইত্যাদি প্রসঙ্গ আমাদের আলােচনায় প্রাধান্য পেত; কিন্তু আজ পাকিস্তানের, বিশেষ করে পূর্ব। পাকিস্তানের অবস্থা ভিন্নরূপ। আর আমার মনের অবস্থাও আলােচনার উপযােগী নয় কিন্তু তবুও হয়তাে আগেকার কথাবার্তার জের ধরে তিনি আমাকে প্রশ্নটি করেছেন। একবার ভাবলাম সরাসরি না করে দিই যে আজকে কোনাে কথা হবে না। আবার ভাবলাম, ইরশাদ পাকিস্তানের যে কোরটির অধিনায়ক তা। গুণগত ও শক্তিগত মানে পাকিস্তানের সামরিক শক্তির অর্ধাংশের অধিকারী। সে কারণে জাতীয় নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তির বড় রকমের প্রভাব আছে। অতএব, ঠিক করলাম যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে তাকে বােঝাতে যে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও সামরিক শাসকগােষ্ঠী দেশের অস্তিত্বই ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভাবলাম যদি কথাটি ইরশাদকে ভালাে করে বােঝাতে পারি তবে হয়তাে এই ধ্বংসযজ্ঞ বাধা পেয়ে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে মােড় নিতেও পারে। বললাম, “এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর করণীয়ের স্বরূপ নির্ধারণ করতে হলে কয়েকটা মৌলিক ব্যাপার আপনাদের উপলব্ধি করতে হবে। প্রথমত, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে এবং সন্দেহাতীতভাবেই করেছে।
অতএব, গণতন্ত্রের অমােঘ বিধান অনুযায়ী সামরিক শাসকের জন্য একমাত্র, আমি পুনরায় বলছি একমাত্র কর্তব্য পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। এ ক্ষেত্রে কোনাে রকম কিন্তু’র অবকাশ থাকতে পারে না। অথচ সামরিক সরকার নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তাে করেই নি বরং সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনেতা অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছে। আমি কোনাে আবেগের মাথায় কথাগুলাে বলছি না। বলছি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। আশা করছি উপস্থিত সকলেই ঠাণ্ডা মাথাতেই পরিস্থিতিটি অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন।’ এই পরিস্থিতিতে যদি কেউ প্রশ্ন করে সেনাবাহিনী নামক সংগঠনটিকে এ অধিকার কে দিয়েছে? অধিকার দেয়ার একমাত্র শক্তি দেশের জনগণ রাখে। জনগণ তাে তাদের মতামত নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছে। এখানে সামরিক শাসক ও সামরিক বাহিনীর তাে কোনাে কর্তব্য নেই, অধিকারও নেই।’ আমাকে থামিয়ে জেনারেল ইরশাদ পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে নির্বাচিত নেতা যদি পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে চায়?’ উত্তরে বললাম, এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য দ্বিতীয় মৌলিক বিষয়টির। উপলব্ধি প্রয়ােজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি দেশের প্রশাসনিক, সাংবিধানিক কাঠামাে ইত্যাদি একটি বিশেষরূপে পরিবর্তিত ও রূপান্তর করতে চায়, তবে রাজনৈতিকভাবে তাে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রাজনীতিক দলগুলাে মিলেই সেই প্রশাসনিক সাংবিধানিক কাঠামােটি ঠিক করেছে। এ ব্যাপারেও সামরিক বাহিনীর কোনাে ভূমিকা থাকতে পারে না। এ অধিকার তাে জনগণ তাদের দেয় নি। তারা তাে গণতান্ত্রিক দেশে নিয়ােগপ্রাপ্ত বেতনভােগী কর্মচারী মাত্র। জনগণের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপ কেন? এবার আপনার তৃতীয় প্রশ্নে আসা যাক আওয়ামী কিংবা বাঙালি ‘গুণ্ডারা বিহারি অভিবাসনকারীদের ওপর নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে। এমনকি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। হ্যা, পুরােপুরি না হলেও সেখানকার ঘটনা কিছু কিছু আমিও শুনেছি, বাকিটা অনুমান করতে পারি যে নির্বাচনে জয়ী হয়েও ক্ষমতা পাওয়ার দিকে না গিয়ে বরং দেশদ্রোহী’ আখ্যা পেয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা অর্থাৎ সমগ্র বাঙালি জনগণ হতাশাগ্রস্ত ও অপমানবােধে উত্তেজিত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ও ইতস্তত হয়তাে এ ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা চালিয়েছে; কিন্তু সেই অপরাধগুলাে আইন-শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা। হতে পারে গােষ্ঠী দাঙ্গা। এর জন্য তাে আইন-শৃঙ্খলা প্রয়ােগকারী সংস্থাই আছে।
পরিস্থিতি তাদের সাধ্যের বাইরে গেলে বেসামরিক প্রশাসন সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে পারে। সে সাহায্য হবে একদিকে যেমন বেসামরিক প্রশাসনের অনুরােধে, অন্যদিকে হতে হবে অতি সীমিত আকারে ও অতি সীমিত সময়ের জন্য। শুনেছি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী অনুরূপভাবেই আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার্থে জনতার ওপর গুলিও চালিয়েছে। বিহারি-বাঙালি দু’ পক্ষেই হতাহত হয়েছে। প্রয়ােজন হলে এ প্রচেষ্টা আরও চলতাে। কিন্তু তাই বলে কি একটি আধুনিক সভ্যরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী কামান দাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপরে ঝাপিয়ে পড়বে? ‘আমি যতটুকু শুনেছি, ২৫ মার্চের রাতে তারা ছাত্রদের হােস্টেলে কামানের গােলা ছুড়েছে। রিকশাচালক, পথচারী নির্বিশেষে শত শত, কেউ কেউ বলে হাজার হাজার মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে। অধ্যাপকদের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে তাদেরকে পরিবার-পরিজনের সামনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয় ইংরেজের দুশাে বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ও মাত্র একবারই ব্রিগেডিয়ার ডিওর কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগে সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারতবাসীর ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার সেই প্রথম ও শেষ। এজন্য জেনারেল ডিওর বিলেতে বিচারের সম্মুখীন হয়ে শাস্তি পেয়েছে। আর আজ? স্বাধীন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের দেশবাসীদের ওপর কেবল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নয়, গােলন্দাজ বাহিনীও ব্যবহার করেছে। জনগণ দ্বারা বিহারিদের ওপর অত্যাচার আইনসিদ্ধ নয়; কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই শক্তি প্রয়ােগ পাকিস্তানের কোন্ আইনে আছে?’ ‘আপনি বলেছেন আমি মানসিকভাবে আহত। আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। ধরুন কোনাে কারণে লাহােরের রাজনৈতিক কর্মী কিংবা জনসাধারণ, পাঞ্জাবের পাঠান কিংবা সিন্ধি কিংবা বালুচ বাসিন্দাদের ওপর অনুরূপ হত্যা ও অত্যাচার চালায়, তবে কি পাঞ্জাবি-প্রধান সামরিক বাহিনী কামান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে লাহােরের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার লােককে (অধ্যাপকসহ) হত্যা করবে? আর যদি করে, তবে কি অন্যান্য পাঞ্জাবি জনগণ ঘরে বসে তামাশা দেখবে? এছাড়া কোন্ পাঞ্জাবি জেনারেলের এমন সাহস আছে যে, পাঞ্জাবি সিপাহিকে আদেশ দেবে পাঞ্জাবিদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতে? আজ বাঙালির দুর্ভাগ্য যে তাদের অঞ্চল তাদের সৈনিক দ্বারা রক্ষিত নয় । বুঝতেই পারছেন বাঙালি সৈনিক বাঙালি জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতাে না, যেমন পাঞ্জাবি সৈনিক পাঞ্জাবি জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে । ঠিক এই কারণটির জন্য পাকিস্তান নামক দেশটি শেষ হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার।’
একনাগাড়ে এতাে কথা বলে আমি চুপ করলাম। জেনারেল ইরশাদ সকলের মুখের দিকে তাকালেন, পরে ঘড়ি দেখে বললেন, ‘সময় হয়ে গেছে। চল কাজে যাই।’ এই বলে তিনি তার কক্ষে ফিরে গেলেন। আমরা যার যার দপ্তরে চলে গেলাম। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝলাম যে, আমার এই বক্তৃতা দেশপ্রেমহীন এবং আঞ্চলিকতা-দোষে দুষ্ট এক দেশবাসীর প্রলাপ বলেই উপস্থিত সকলে ধরে। নিলেন। কোথায় পাঞ্জাবি জনগণ আর কোথায় পাকিস্তান ভঙ্গকারী অর্থাৎ পাঞ্জাবের অবাধ্য ও হিন্দুঘেসা বাঙালি জনগােষ্ঠী। অফিসে এসে ভাবতে লাগলাম, বললাম তাে যে পূর্ব পাকিস্তান আজ থেকে আর পাকিস্তানের অংশ নয়; কিন্তু বললেই তাে হবে না। বাঙালিদের তাে এই নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংগঠন আছে। নেতৃত্বও আছে, কিন্তু এই প্রতিরােধ তাে সশস্ত্র প্রতিরােধ। নিরস্ত্র, প্রশিক্ষণবিহীন জনগণের পক্ষে তাে এর বিপরীতে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলা কঠিন, যদিও অসম্ভব নয়। অতএব, এ কয়দিনে ঢাকার অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়েছে সেটা জানতে হবে। অপমানবােধ থেকে যেসব দম্ভোক্তি করেছি। সেগুলাে অর্থহীন প্রমাণিত হয়ে গেলে, নির্বোধ কাপুরুষতার গ্লানি ও অপমানের বােঝা চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবে না তাে? হঠাৎ অসহায়ত্বের বেদনায় আরও অস্থির হয়ে চলে গেলাম বাসায় এদিকে চাকরিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তাে পুরােপুরিই ছিল। আমার এমনি বক্তব্যের পর আমাকে ওরা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যবিহীন সামরিক অফিসার হিসেবে কোর্ট মার্শালও করতে পারে; কিন্তু অপমানবােধে সে চিন্তা মনে এলেও বেশিক্ষণ ঠায় পায় নি। দেশের অবস্থা যদি এইরূপ করুণ হয় তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কি হবে তা ভাবা অর্থহীন মনে হয়েছে। সেদিন আবার গেলাম পিণ্ডি, খবর জানতে অনুমান করতে পারতাম বহু বছর পর যে বাঙালি জাতি আজ সম্পূর্ণভাবে একাত্ম সে জাতি পাঞ্জাবি সৈন্যের এই আঘাত অসহায়ভাবে মেনে নেবে না—অস্ত্র তুলে নেবে হাতে। তবে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া তাে অস্ত্র পাওয়া যায় না, ব্যবহারও করা যায় না। কিন্তু যদি এই সংগ্রামে পুলিশ, ই পি আর এবং সেনাবাহিনীর দলত্যাগী বিদ্রোহী সৈনিকরা যােগ দেয় তবে অতি শিগগিরই সেই প্রতিরােধ শক্তি গড়ে উঠবে।
২৯ মার্চ পিণ্ডি গিয়ে শুনলাম যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল পুলিশ, ই পি আর, আনসার সবাই সঙ্ঘবদ্ধ ও সংগঠিত হয়েছে তাই নয়, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরাও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগ দিয়েছে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাে প্রায় সংগঠিতভাবে যােগ দিয়েছে। ইতােমধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অর্থাৎ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার যে ঘােষণা দিয়েছেন তা সব বাঙালিই শুনেছে। এই খবরগুলাে পেয়ে আর সন্দেহ রইলাে না যে, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সামরিক বিশ্লেষণ এই ছিল যে, হাজার মাইল দূর থেকে সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে এ সংগ্রামে বিজয় লাভ অসম্ভবই বলা চলে। বিশেষ করে একটি কথা মনে রাখলে এ সত্যটি অনুধাবন করতে কষ্ট হবে না যে, এই সংগ্রামে ভারতকে জড়িয়ে পড়তে হবে, ভারতের ইচ্ছা থাকুক আর নাই থাকুক এই সত্যটি বিশেষ করে আমার হতাশাপূর্ণ মনকে অনেকটা স্বস্তি দিলাে। বাসায় এসে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও ভারতীয় রেডিও’র সংবাদ শুনতে লাগলাম শেখ মুজিবকে বন্দি করা হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রামে-গঞ্জে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড, বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছাই করা, ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদি কার্যক্রমে মেতে উঠেছে। শুনে মনের অবস্থা অবর্ণনীয়ভাবে কাতর হলেও একটা আশাব্যঞ্জক দিকও মনে জেগে উঠলাে। এবার আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী সবাই নিজেদের রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে একত্র হবে, আপামর জনসাধারণ এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বে।
সূত্র : পূর্বাপর ১৯৭১ – পাকিস্তানি সেনা-গহবর থেকে দেখা