মুক্তিযুদ্ধের শেষ– দিনগুলাে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিজয় যাত্রা
লেখক একাত্তরের ৩১ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছুদিন পর্যন্ত দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। একজন কমিশন অফিসার হিসাবে তিনি ঐ ব্যাটেলিয়ানের অধীনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বল্প পরিসরে মুক্তিযুদ্ধে শেষ দিনগুলাের কথা লিখতে গিয়ে অনেক বীরত্ব, ত্যাগের কাহিনী ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে না পারায় তিনি পাঠকদের নিকট মার্জনা ভিক্ষা করছেন। স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে ঢাকা যখন মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লক্ষ্য, তখন মিত্রবাহিনীর দুটি ব্রিগেড ১৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের দক্ষিণ দিক থেকে এসে পদ্মা অতিক্রম করে কামারখালী ও ফরিদপুরের মাঝামাঝি এলাকায় একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে এবং ঐ এলাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি জেনারেল আনসারী ও তার সঙ্গীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উত্তর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ও মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি ৭ ডিসেম্বর ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে জামালপুরের দিকে এগিয়ে আসছিল। এই সম্মিলিত বাহিনী। জামালপুর-ঢাকা সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পাকিস্তানি ৩১ বেলুচ ও ৯৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অনেক সৈন্যকে হতাহত করে এবং আহতদেরকে জামালপুরে সাময়িকভাবে আটকে রাখে। পরবর্তীতে ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী ও ১৬৮ পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় জামালপুর গ্যারিসনের পতন ঘটে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এদিকে যৌথবাহিনী দুটি ভারতীয় ছত্রিশ ব্যাটেলিয়ানের সহায়তায় ১৪ ডিসেম্বর তুরাগ নদীর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখােমুখি অবস্থান নেয়। এখানেই ভেতরে ঢুকবার চেষ্টারত ভারতীয় বাহিনীর একটি পেট্রোল টিম পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডার। ব্রিগেডিয়ার কাদের ও অন্যান্যদেরকে নাটকীয়ভাবে পাকড়াও করে ফেলে। যৌথবাহিনীর এই দল ১৫ ডিসেম্বর সাভার দখল করে। ১৫ ডিসেম্বর রাতেই তারা সাভার থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। তবে ১৬ তারিখ সকাল পর্যন্ত মিরপুর ব্রিজ ও টঙ্গীতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরােধের মুখে তারা অগ্রসর হতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার উপকণ্ঠে কামানের গােলা ফেলে পাকিস্তানিদের মনােবল ভাঙ্গার চেষ্টা সফল হয়নি। ঠিক সেই সময়ে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরীর (বর্তমানে জেনারেল অব.) নির্দেশে ঐ রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির এক প্লাটুনের কিছু কম সেনা নিয়ে আমি ১৪ ডিসেম্বর রাত বারােটার সময় ডেমরার দিক থেকে ঢাকার বাড্ডা ও গুলশান অভিমুখে অগ্রসর হই। আমার নেতৃত্বাধীন ফাইটিং পেট্রোল টিমটি দুই সেকশন প্লাস বাছাবাছা সেনা সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল।
এরা প্রত্যেকেই ছিল দুর্দান্ত সাহসী, কষ্ট সহিষ্ণু এবং ঝুঁকির মধ্যে টিকে থাকার মানসিকতাসম্পন্ন। ভারী অস্ত্রের মধ্যে আমাদের কাছে ছিল একটি মেশিনগান, একটি ৮১ মিলিমিটার মর্টার, গােটা দুয়েক দু’ইঞ্চি মর্টার এবং লাইট মেশিনগান। ঐ শক্তির সেনা সদস্যদের বহনযােগ্য সর্বোচ্চ সংখ্যক গােলাগুলির মজুদ আমাদের কাছে ছিল। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর রাতে ডেমরায় পৌছানাের পর আমাদের মূল বাহিনী ডেমরার শিল্পাঞ্চলের পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতীয় বাহিনীর দুটি ব্যাটেলিয়ান (চতুর্থ গার্ড এবং ১৮ রাজপুত) শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে তারাবাে’তে অবস্থান নিয়েছিল এবং ১০ বিহার ছিল রূপসীতে। ভারতীয় ৩১১ ব্রিগেডের অন্যান্য সদস্যরা শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ান আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নিয়েছিল। তবে এই বাহিনীগুলাের কেউই ঢাকা শহরে পা রাখতে পারেনি। আমাদের ব্যাটেলিয়ানের প্রায় সবাই ঢাকায় প্রবেশের জন্য ছটফট করছিলাম। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন হেলাল মােরশেদ (বর্তমানে জেনারেল অব.), লে, সেলিম (শহীদ) ও লে, ইব্রাহিমের (বর্তমানে জেনারেল অব.) মধ্যে অস্থিরতা ছিল বেশি। এই অস্থিরতার মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে আমি আলফা কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এবং ব্রাভাে কোম্পানি কমান্ডার আমার সহােদর লে, সেলিমের (শহীদ) সাথে পরামর্শ করে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে ঢাকা প্রবেশের ফাঁক-ফোকরগুলাে দেখে নেবার চেষ্টা করি। আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল, আমাদের বিপরীতে পাকিস্তানি বাহিনী ডিপ্লয়মেন্টের কোন তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। এলাকার নিখুঁত ম্যাপেরও অভাব ছিল। তবে ভাগ্যক্রমে ঐ সময় স্থানীয় তিন তরুণকে পেয়ে যাওয়ায় কিছুটা সুবিধা হল। তাদের কাছ থেকে এলাকার বেশ কিছু তথ্য আমি জানতে পারলাম। এই তরুণদের একজনের নাম ছিল আনিসুর রহমান। অন্য দু’জন সম্পর্কে এটা মনে আছে যে, তারা কাউন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিল। তাদের মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ব্যাটেলিয়ান কমান্ডারের সাথে কথা বললাম।
ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার মেজর মঈন (বর্তমানে জেনারেল অব.) সব শুনে আমাকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘আমরা এখানে বসে থাকতে আসিনি।’ এ সময় তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন যে, ভৈরব নদী অতিক্রমের পর ব্রিগেডিয়ার মিত্র ১৩ ডিসেম্বর নরসিংদীতেই আমাদের থেকে যেতে বলেছিলেন। ভারতীয় ৩১১ ব্রিগেড আমাদের সম্মুখে থেকে ঢাকার পাশে অবস্থান নেবে এমন নির্দেশ এসেছিল মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে। উল্লেখ্য, আমার সাহস ও কর্তব্যপরায়নতার উপর আমাদের এই দুঃসাহসী ব্যাটেলিয়ান কমান্ডারের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই উক্ত ব্যাটেলিয়ানের আলফা কোম্পানির অফিসার হিসাবে যুদ্ধ পরিকল্পনার গােপন দলিলটি ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার ও এস ফোর্সের প্রধানের পক্ষে মিত্রবাহিনীর নিকট থেকে আমিই সংগ্রহ করেছিলাম। তারিখটি ছিল ২৭ নভেম্বর ১৯৭১। আমাকেই ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ কুয়াশাচ্ছন্ন জ্যোৎস্না ভরা এক শীতের রাতে আখাউড়া যুদ্ধে আমার রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির অগ্রবর্তী দলটি নিয়ে কয়েক মাইল বিস্তীর্ণ মাইন ফিন্ডের উপর দিয়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ব্যুহের মধ্যে ঢুকতে হয়েছিল। অস্পষ্ট চাদের আলােয় আমাদের দেখা যাচ্ছিল। তাই প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি শক্রর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হই। চষা ক্ষেতের আইলের মধ্যে মাইন খুঁজে এগােবার সময় ছিলনা। সমস্ত হৃদয় ছিল ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ও কিছুটা বিষাদে পূর্ণ। কেননা, ঐদিন সন্ধ্যায় আক্রমণ শুরুর পূর্বেই আমাদের ওয়্যারলেস অপারেটরসহ ১১ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আকষ্মিক গােলাবর্ষণে। আমি নিজেও শেলের ধাক্কায় একটি গর্তের মধ্যে ছিটকে পড়েছিলাম। মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হলেও অন্য সেনা সদস্যদের মনােবল অক্ষুন্ন রাখবার জন্য নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছিলাম। এতে ঘন্টা দুয়েক সময় নষ্ট হলেও এইচ-আওয়ার (H-hour) ১ ডিসেম্বর ভাের একটার আগেই আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে সক্ষম হলাম । অবস্থান গ্রহণ করলাম শক্ত ব্যুহের চার-পাঁচশ’ মিটারের মধ্যে- দ্রুত হাতে খুঁড়ে নেয়া ফাহােলে। আমার একটু পরেই পৌছালেন আমার কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (প্রয়াত জেনারেল অব.)। রাত একটা বাজতেই আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মত পাকিস্তানি সেনাদের বাংকার ও রক্ষণ ব্যুহগুলাে গােলার আঘাতে চুরমার করবার জন্য অয়্যারলেসে সংকেত পাঠালাম ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী ও আমাদের মুজিব ব্যাটারিকে।
চরম উত্তেজনার মধ্যে ধামাকা’ সংকেতটি উচ্চারণের পর পরই শুরু হল প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ। এর সাথেই শুরু হল পূর্বাঞ্চলে পরিচালিত শক্তিশালী যুদ্ধ ‘অপারেশন জ্যাকপট’। বিরামহীন ভারী গােলাবর্ষণের শব্দে আজমপুর রেল স্টেশন এবং আশেপাশের জনপদগুলাে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ঐ সময় কিছু গােলা আখাউড়া রেল স্টেশনকেও আঘাত করেছিল। মিত্রবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল শক্র ব্যুহগুলাে চুরমার করার সাথে সাথে তাদের রিইনফোর্সমেন্টের সাহস ও শক্তিটুকু নিঃশেষ করে দেয়া। আমার প্রতি নির্দেশ ছিল পুনরায় ধামাকা’ শব্দটি উচ্চারণের পরই গােলাবর্ষণ বন্ধ হবে। আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই প্রায় তিন ঘন্টা পর বন্ধুদের পুনরায় সংকেত পাঠালাম ‘ধামাকা…’। ততক্ষণে শত্রুবাহিনীর অনেকগুলাে বাংকারই চুরমার হয়ে গেছে। যাহােক, গােলাবর্ষণ বন্ধ হবার পর পরই হালকা মেশিনগান ও গ্রেনেড নিয়ে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর রক্ষণ ব্যুহের ওপর ঝাপিয়ে পড়লাম। চার্লি কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার ধীমান যােদ্ধা লে, ইব্রাহিম (পরবর্তীতে জেনারেল)। তিনি আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন আজমপুরের উত্তরে প্রায় শুকনাে একটি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পুরানাে জেটি এলাকায়। ওদিকে আজমপুর রেল স্টেশনের কাছে অবস্থান নিয়েছিল ব্রাভাে কোম্পানি। ভাের পাঁচটার দিকে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে নিজেদেরকে সুসংগঠিত করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপরে আঘাত হানতে শুরু করলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম, তাদের বেশ কিছু কংক্রিট বাংকার অক্ষতই রয়ে গেছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে সেখান থেকে তারা আমাদের দিকে গােলাগুলি বর্ষণ করে চলেছে। একসময় আজমপুর রেল স্টেশন থেকে কিছু পাকিস্তানি সেনা পূর্ব দিকে নেমে এসে আমাদের ওপর প্রচণ্ড পাল্টা আঘাত শুরু করল। সকাল হয়ে আসছিল। কিন্তু চারদিকে এত বেশি ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে ছিল যে দু’তিন ফুট দুরের বস্তুও দৃষ্টিগােচর হচ্ছিল না। আমাদের অনেকেই তখন খােলা স্থানে। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের অনেকে তাদের বাংকার ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যুহের আড়ালে। এক সময় তাদের সুতীব্র আক্রমণের মুখে কুয়াশার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে আমার কোম্পানি কমান্ডার (আলফা কোম্পানি) অধিকাংশ প্লাটুন নিয়ে আমার দু’পাশ থেকে পিছু হটে গেলেন। ইচ্ছাকৃত বা অন্য কোন ত্রুটির জন্য নয়, নেহাতই ভুল বােঝাবুঝির জন্য। আমি মাত্র তিন-চারজন সৈন্য নিয়ে একটি গাছের আড়াল থেকে পাকিস্তানিদেরকে প্রতিহত করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সুবেদার সুলতান আমার পেছন থেকে এসে এই বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলার খবর দিল। আমি তাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করলাম এবং পিছু হটতে অসম্মতি জানালাম। শেষ পর্যন্ত একরকম জোর করেই সুবেদার সুলতান আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে গেল।
এ অবস্থায় লে, ইব্রাহিমও পেছনে হটে গেলেন। এই উইথড্রলের পর ১ তারিখ সকাল আটটা-নটার দিকে বিমর্ষ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও অন্যান্যদেরকে দেখলাম কর্নেল শফিউল্লাহ (পরবর্তীতে জেনারেল) ও মেজর মঈনের নিকট তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। এরপর আমরা নিজেদেরকে সংগঠিত করে পুনরায় নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে গেলাম এবং বিকেল তিনটের মধ্যেই শক্রদের এরপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হলাম। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমি ক্যাপ্টেন (বর্তমানে অব: জেনারেল) মতিনকে দেখলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। অসম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি কেবল পূর্ব দিকে ধেয়ে আসা পাকিস্তানিদেরকে প্রতিহতই করেননি, উপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে আজমপুর স্টেশনের লাগােয়া উত্তরে অবস্থান নিলেন। তার সাথে ছিল তিন নম্বর। সেক্টরের মােজাহিদ মিশ্রিত দুই কোম্পানি সেনা। ঐ যুদ্ধে লে, ইব্রাহিমের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে আমরা সন্ধ্যার মধ্যেই আজমপুর স্টেশনের উত্তর দিকটা মুক্ত করে ফেললাম। ব্রাভাে। কোম্পানি কমান্ডার লে. বদিউজ্জামানও তার অবস্থান থেকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিল। বিকেলের পর আমাদের সম্মিলিত আক্রমণে আজমপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকের কিছু অংশও শত্রুমুক্ত হয়ে গেল। তবে ঐ এলাকায় অসংখ্য মাইন পোতা থাকায় এবং পাকিস্তানিদের কয়েকটি কংক্রিট বাংকার অক্ষত থাকায় আমরা এগুতে পারছিলাম না। দুই তারিখ ভাের থেকে আবার আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন। হলাম। আকস্মিক আক্রমণে আজমপুর স্টেশনের দখলকৃত স্থানটুকুও তাদের হাতে চলে গেল। রেল স্টেশনের দক্ষিণে পাকিস্তানিদের বাংকারগুলােতে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিল এবং আমাদের প্রাথমিক আক্রমণের পরেও তাদের কেউ কেউ সেখানে লুকিয়ে ছিল। যার ফলে ২ তারিখ রাতে প্রচণ্ড যুদ্ধের পরেও আমরা ঐ এলাকা কজা করতে পারলাম না। এরমধ্যে বিরামহীনভাবে চলছিল পাকিস্তানি আর্টিলারি গােলাবর্ষণ এবং দিনের বেলায় বিমান হামলা। তিন তারিখ ও চার তারিখে যুদ্ধ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। পাকিস্তানি কামান ও বিমান হামলা ভারতীয় আর্টিলারির সহায়তাকে অনেকটা গৌণ করে তােলে। তবুও এর মধ্যে আমরা এক ইঞ্চিও পিছু হটিনি। বৃষ্টির মত গােলাগুলি উপেক্ষা করে। আমাদের সেনারা অসম্ভব মরিয়া হয়ে পাকিস্তানি বাংকারগুলাের মধ্যে ঢুকে আক্রমণ চালায়। কোন কোন স্থানে যুদ্ধটা হাতাহাতি পর্যায়েও হয়েছিল।
এতে ৩ ডিসেম্বর বেশ কিছু অসম সাহসী যােদ্ধা বিজয় ছিনিয়ে আনতে শাহাদত বরণ করেন। এ সময়েই বেলােনিয়া অপারেশন থেকে ফিরে লে, সেলিম যােগ দিল ব্রাভাে। কোম্পানিতে। এই স্থানের যুদ্ধটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভয়ঙ্করতম যুদ্ধগুলাের মতই একটি। বীরত্বের শ্রেষ্ঠ ছবি হতে পারত এসব ঘটনাকে উপজীব্য করে । ৩ ডিসেম্বর শেষ বেলা থেকেই আমরা আখাউড়ার দিকে এগােচ্ছিলাম। এ পরিস্থিতিতে ৪ ডিসেম্বর আমাদের ওপর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করল পাকিস্তানিরা। দুটি পাকিস্তানি সেবর জেটও ঐ হামলায় অংশ নিয়েছিল। প্রচণ্ড গােলা এবং শেলের আঘাতে ৪ ডিসেম্বর শহীদ হলেন লে. বদিউজ্জামান। তিনি তখন নিজ বাংকার ছেড়ে শক্রর বাংকারের দিকে এগােবার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর চোয়াল ও মুখের একাংশ উড়ে গিয়েছিল গােলার আঘাতে। নায়েক সুবেদার আশরাফ ও সিপাহী। আমিরসহ বেশ ক’জন শহীদ হয় এ যুদ্ধে। লে, সেলিম এ সময় লে, বদির স্থানে অধিনায়কত্ব গ্রহণ করল ব্রাভাে কোম্পানির। বদির হাত থেকে ছিটকে পড়া রক্তাক্ত ঘড়িটি সযত্নে বুকে রেখে সে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে লাগল পাকিস্তানিদের ওপরে এক সময় সে তার সৈন্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের কংক্রিটের বাংকারগুলাের ভেতরে বেপরােয়া হামলা চালালাে প্রচণ্ড ক্রোধ ও প্রতিশােধ স্পৃহা নিয়ে। এ সময় আমাদের অধিকাংশ সেনাকেই থাকতে হচ্ছিল খােলা আকাশের নিচে। যুদ্ধ। করতে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে এবং গুটিকয় ফক্সহােল থেকে এতে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড গােলাগুলি এবং বিমান আক্রমণের মুখে আমরা সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের মনােবল ভাঙেনি সুতব্র আক্রমণ চালিয়ে আমরা চার তারিখেই পাকিস্তানিদের প্রায় সম্পূর্ণ কাবু করে ফেললাম। এরমধ্যে ভারতীয় বাহিনী আমাদর সাথে যােগ দিল। ৪ ডিসেম্বরের শেষ বেলায় এস ফোর্স’ ও ভারতীয় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়া ঘিরে ফেলল। ৫ তারিখে আখাউড়ায় সকল পাকিস্তানি সেনা যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করল। ৬ তারিখ সকালে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে রওনা হলাম। ১১ তারিখ আশুগঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ দিক দিয়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহর বাহিনী ও অন্যান্য পাকিস্তানিদেরকে বাইপাস করে ত্রৈব নদী অতিক্রম করলাম। এসময় আশুগঞ্জে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল। ৯ ডিসেম্বরেই রাজপুত ব্যাটেলিয়ান আশুগঞ্জের নিকট, এক ভয়ঙ্কর প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়েছিল।
তাদেরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে ১০ বিহার ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এখানেই বিহার ও রাজপুত ব্যাটেলিয়ানের বেশ ক’জন অফিসারসহ অনেক ভারতীয় সেনা প্রাণ দেয়। আমার দেশের স্বাধীনতার জন্য। এই প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যেই বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা ভৈরবে অবস্থান গ্রহণ করে। এছাড়া সিলেট থেকে পাকিস্তানি সেনারা আশুগঞ্জ ও ভৈরবের দিকে নেমে আসে। এ পর্যায়ে আমরা ভৈরবের কাছে একটি আক্রমণের আশংকা করলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সকল প্রতিরােধ এড়িয়ে ১৩ ডিসেম্বর সকালে মুড়াপাড়ায় পৌছাই। ঐদিন রাতেই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাইকে নিয়ে আমরা পৌছাই ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরার সন্নিকটে। ১৪ তারিখ থেকেই ঢাকা প্রবেশের জন্য মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও আমাদের মধ্যে নীরব প্রতিযােগিতা চলছিল। এর মধ্যেই আমি আমার কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে গাইড আনিসুর ও তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ার দিকে এগােতে থাকি। পুরাে পথটা ছিল মেঠো; খানা-খন্দে পরিপূর্ণ। আশেপাশে বেশ কিছু টিনশেড বাড়ি ছিল। প্রথম দিকে কয়েকটি বাড়ি থেকে মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও পরবর্তী বাড়িগুলাে গভীর নৈঃশব্দ্য ও আঁধারের মধ্যে জনমানবহীন বলে অনুভূত হচ্ছিল। এ পর্যায়ে আমাদের গাইড হাত দিয়ে বাড়ার শেষ প্রাপ্ত ও গুলশানের দিক দেখিয়ে দিল এবং সাবধান করে দিল- কাছাকাছি কোথাও পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান রয়েছে। কোথাও কোথাও মাইন পোঁতাও থাকতে পারে। মুহঁতের জন্য মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি ঠান্স প্রবাহ বয়ে গেল। মনে হল, ঢাকার এত কাছে এসে কোন হঠকারিতার মধ্য দিয়ে নিজের ও সাথীদের জীবন বিপন্ন করা কি ঠিক হবে? ধােয়াশাযুক্ত গাছগাছালিগুলাে আফ্রিকার অদ্ভুদ প্রাণীদের মত চারপাশে দাঁড়িয়ে। ওপরে তারা ব্রা আকাশ। গভীর নৈঃশব্দ্যের মধ্যে একবারও মনে হয় না, এখানে এ্যাদ্দিন এত বারুদ পুড়েছে। ভাবা যায় না, ঢাকার ভেতরের মানুষগুলাে কী ধরনের নির্যাতন ও মানসিক চাপের মধ্যে সময় কাটিয়েছে, কিংবা ঠিক ঐ সময়ে ঢাকার মধ্যে কী ঘটেছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, এই তারা ভরা আকাশের নিচে কোথাও খুব কাছেই আমাদের মা-বাবা, ভাই-বােন ও প্রিয়জনেরা আমাদেরই প্রতীক্ষায় রয়েছে। মনে হচ্ছিল শীতের রাতে ধেয়ে আসা ভারী বাতাস শহরের ভেতরে আটকে পড়া মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষগুলাের কষ্টের গন্ধ বয়ে আনছে। ভারী মর্টার বহনকারী সৈন্যদেরকে বিশ্রাম দেবার জন্য এবং পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে নেয়ার জন্য আমি শক্ত দেখে একটি মাটির ঢিবির ওপর মর্টারবেজ বসাতে বললাম।
অদূরে ঢাকা অভিমুখে কিছুটা পশ্চিম দিকে তাক করে মেশিনগানটি বসিয়ে দিলাম। মর্টার এবং মেশিনগানের দায়িত্বে নিয়ােজিত সৈনিকদের বলে দিলাম, আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন গােলাগুলি না করা হয়। সেই সাথে হিসেব করে নিতে বললাম আমাদের গােলার লক্ষ্যস্থল। গুলশান মার্কেট সংলগ্ন পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ও আশেপাশে বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা সদস্য আগে থেকেই একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে রেখেছিল। সম্ভবত কুটনৈতিক এলাকার শেষ প্রতিরক্ষা হিসেবে ঐ এলাকাটিকে তারা বেছে নিয়েছিল। দু’সাত জন সেনা সদস্যের একটি দল নিয়ে আমি আরও ভেতরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। প্রতি মুহূর্তে এন্টি-পারসন মাইনে পা পড়ার সম্ভাবনা ছিল। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম বেশ গাঢ় অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, দূরে একটা তারার দিকে চোখ রেখে। মাঝে মাঝে দু’একটি ঝােপঝাড় এবং পড়ে থাকা চালা দেখে সন্দেহ হচ্ছিল, ওগুলাে পাকিস্তানিদের বাংকার নয়তাে! পরীক্ষা করার জন্য শুয়ে পড়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েও দেখলাম। কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে আরও কিছু দূর এগিয়ে গেলাম। এ সময় আমাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, আমরা আরও এগিয়ে পাকিস্তানিদের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে আটকা না পড়ি! আমি কোন জবাব দিলাম না। পেছনে মর্টারম্যানকে নির্দেশ দিলাম গােলা ছোড়বার জন্য। আমাদের মাথার উপর দিয়ে গােলাগুলাে সই সই শব্দে উড়ে যেতে লাগল। কড়কড়-কড়াৎ করে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানতে লাগল। বিল্টআপ এরিয়ায় ধ্বনিপ্রতিধ্বনিতে শব্দটা একটু বেশিই হতে লাগল। ঐ গােলাগুলির মধ্যেই দূর থেকে হৈহল্লার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। কিন্তু কোন গুলি ছুটে এলাে না। কিছুক্ষণ পরে অনেক দূরে কয়েকটি রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনলাম। আমরা ধরে নিলাম পাকিস্তানিরা এতটা নিস্তেজ, ভীত ও মনােবলহীন হয়ে পড়েছে যে, তারা গােলার উত্তর দিতে পারছে না অথবা নিজেদের অবস্থান গােপন করছে কিংবা নিজেদেরকে নিরাপদ করা জন্য প্রত্যুত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে মেশিনগানটাকে আরও এগিয়ে সম্মুখে নিয়ে আসতে বলে আমরা দ্রুত এগুতে থাকলাম দূরে একটি লাইট পােস্টকে লক্ষ্য করে।
ঐ অল্প ক’জন সৈন্য নিয়ে এরপর আর ভেতরে ঢােকা সমীচীন মনে হল না। তবে | বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে আপাত স্বাধীন ঢাকার দিকে তাকিয়ে বড় বড় নিঃশাস নিয়ে স্বাধীনতার প্রথম স্বাদটুকু অনস্থ করতে চেষ্টা করলাম। অগ্রবর্তী সেনা হিসাবে দখলকৃত স্থানটিতে বাংলাদেশের একটি পতাকা গেঁথে দেবার আবেগ অনুভব করছিলাম এবং সেই সাথে দখলকৃত স্থানটিতে আমাদের ব্যাটেলিয়ানকে এগিয়ে নেবার প্রয়ােজনও বােধ করছিলাম। পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙ্গে দিয়ে আত্মসমর্পণকে ত্বরান্বিত করার অভিলাষ কাজ করছিল মনের ভেতরে। ঐ অবস্থায় চলমান সন্দেহজনক গতিশীল জিনিসগুলাের ওপর একনাগাড়ে কিছুক্ষণ গুলি চালিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ভােরের দিকে আমরা আমাদের অবস্থানে ফিরে গেলাম, গৌরবের ভূমি থেকে। ১৫ তারিখ রাত্রেও এমন একটা পেট্রোল টিম নিয়ে এগােলাম এবং পেছনের অদৃশ্য টানে আবারও ফিরে এলাম। সেদিন রাতে এক ধরনের ক্ষোভ, হতাশা ও ক্লান্তিতে অস্থায়ী হেডকোয়ার্টারের কাছে এক খড়ের গাদায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে অনুভব করলাম আমরা যেন ঢাকার কেন্দ্র বিন্দুতে প্রবেশ করছি। পরদিন ১৬ তারিখ দুপুর দুইটার পর ঠিক ঠিকই যৌথবাহিনীর নির্দেশে তিন নম্বর সিরিয়ালে পুরাে ব্যাটালিয়ান (দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল) নিয়ে আমরা ঢাকার কেন্দ্রে প্রবেশ করলাম। সূর্য তখন অস্তগামী। ধুলাে উড়িয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে মচমচ করে নগরে ঢুকছিলাম রক্তিম আলােকরশির মধ্য দিয়ে। ঐ রাতে ঢাকা স্টেডিয়ামের ফুটপাত হলাে আমাদের আশ্রয়স্থল। পুরাে ব্যাটেলিয়ান নিয়ে সবার আগে ঢাকা শহরে প্রবেশের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে পেরে আমরা মনােকটে ভুগছিলাম। ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার আমাদের সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। একসময় আমার পিঠে হাত রেখে সানা দেবার চেষ্টা করলেন। এরপর স্বাধীনতা লাভের আনন্দ এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করবার উঃকণ্ঠা সবকিছু ছাপিয়ে উপচে উঠতে লাগল। তারিখ : ১০ ডিসেম্বর ২০০৩
সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান