You dont have javascript enabled! Please enable it! মৌলবাদী ধর্মভিত্তিক সরকার -সন্ত্রাসের ছায়া- ইস্পাতের খাঁচায় আমাদের হৃদয় - সংগ্রামের নোটবুক

সন্ত্রাসের ছায়া এবং ইস্পাতের খাঁচায় আমাদের হৃদয়

এরই প্রেক্ষাপটে একটি ছােট লেখা তৈরী করেছিলাম, যার শিরােনাম ছিল “Shadows of terrorism and our soul in the iron cage” : wife কয়েকটি পত্রিকার জন্য লিখিত ঐ ছােট নিবন্ধে এমনটা আশা করেছিলাম যে, আমেরিকার জনগণ ও সরকার অপ্রত্যাশিত আঘাতের ক্ষত, ক্ষতি ও ভয় অতিক্রম করে স্বাভাবিক জীবন ও আচরণে ফিরে আসবে অতিসত্ত্বর। ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষের মর্যাদা, জীবন ও আকাক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নানা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সংকুচিত হয়ে আসছে চিরচেনা আমাদের এই পৃথিবী। পদে পদে স্বাধীনতা এতটাই খর্ব এবং ব্যক্তিমর্যাদা এতটাই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে যে, নিজেকে আক্ষরিক অর্থে গুটিয়ে এনেছি ছােট খাঁচায়। আজ আর মন চায় না আকাশে উড়তে। অনন্ত নীলিমাও যেন সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ। এই সুযােগে দেশে দেশে স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের তল্পিবাহকদের দোর্দন্ড প্রতাপ বেড়েই। চলেছে। সর্বত্র মানবাধিকার ও মানবমর্যাদাকে দেখা হচ্ছে একটি সরু দৃষ্টিকোণ থেকে। সন্ত্রাস বিরােধী অভিযান নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারগুলাে অপ্রতিরােধ্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। হীন স্বার্থপরতা, প্রতিহিংসা ও কুটিল মতলবে ব্যক্তি ও সংগঠন চিহ্নিত হচ্ছে সন্ত্রাসী বলে। একারণেই ধর্ম, জাতি, গােষ্ঠী সংক্রান্ত যে বিদ্বেষ ও বৈষম্যগুলাে এতকাল কিছুটা চাপা পড়ে গিয়েছিল, তাই এখন মানবাধিকারের প্রত্যাশাগুলােকে ঠেলে উঠে এসেছে। এতে করে দেশে দেশে মৌলবাদী সরকারগুলাে এবং অসুস্থ চিন্তায় আক্রান্ত ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ দলগুলাে সমর্থন পাচ্ছে অস্তিত্বের সংকটে নিপতিত ভীরু জনগণের নিকট। উপমহাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনের দিকে চোখ ফেরালেই এর যথার্থ উদাহরণগুলাে পাওয়া যাবে।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কয়েক হাজার মানবাধিকার কর্মী, শত শত এনজিও এবং আলােকিত অগ্রসর চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশগুলাে, গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে মিলিত হয়ে ন্যায়ের অধিকার ও সুবিচারের অধিকারের অঙ্গীকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে যে ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করে মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে তা পদদলিত হয় ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুভব করেছি যে, পৃথিবীবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে আছে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার উপর। ক্ষমতাধরদের অত্যাচার, শাসন, শােষণে নিষ্পেষিত বিশ্ববাসী মুক্তির পথ খুঁজছে। তাই দেশে দেশে সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও মনবতাবিরােধী অপরাধের বিচার এবং নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয়গুলাে যখন যৌক্তিক ভিত্তি পাচ্ছিল, তখনই কুচক্রীমহল বিশ্ব ঐক্য নস্যাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমগ্র দানব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে। পাশ্চাত্য সভ্যতার নির্মাতারা আজ আর আফ্রিকার দাসদেরকে ক্ষতিপূরণ দানের ব্যাপারে কোন চাপের মধ্যে নেই। দেশে দেশে গণহত্যার তদন্তগুলাে সম্পাদন করে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইনগুলাে আর হয়ত কখনই আলাের মুখ দেখবে না। রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রেক্ষাপটে গাচাচা (Gachacha) জাতীয় ক্ষতিপূরণ কিংবা Redress Agreement -এর মাধ্যমে কানাডা কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তাদের দেশে বসবাসরত জাপানিদের প্রতি নির্যাতন ও অবিচারের কারণে ক্ষতিপূরণ দানের (জনপ্রতি ২১ হাজার ডলার) বিষয়গুলাে দূরকল্পনার বিষয় হয়ে থাকবে।

আর আমাদের মত দেশে যেখানে নির্যাতনের স্বীকৃতিই নেই এবং সরকারী হেফাজতে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই, সেক্ষেত্রে এসব ভাবনা নির্বোধ পর্যায়ের মশকরা ছাড়া আর কী? মানুষের জীবনের মূল্য আছে, অর্থ আছে একথা আজ ভুলে যেতে হবে। অথচ নিঃস্বার্থ চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশ স্বাধীন করেছিলাম। অগণিত মানুষ জেনে বুঝে আত্মদান করেছিলেন আত্মমর্যাদা ও মানবিক অধিকারগুলাে অর্জনের জন্য। ১১ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মাটিতে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের নিকৃষ্ট তাবেদারদের নির্মম নিষ্ঠুর দৌরাত্বে স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের জীবন আজ ওষ্ঠাগত। অথচ কত স্বাধীনতার প্রবক্তা জন্ম নিয়েছেন ঐসব দেশে। জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ধারা, চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের। আজ প্রশ্ন জাগে জর্জ ওয়াশিংটন, ভলতেয়ার, রুশশা, মার্কস, এঙ্গেলস- এঁরা ক’জন সার্থক উত্তরসূরী তৈরী করে গেছেন উন্নত বিশ্বে? এটাও প্রশ্ন জাগে যে, তৃতীয় বিশ্বের নেহেরু, সুকর্ণ, চৌ এন লাই, মার্শাল টিটো, নাসের- এঁরা কী সম্পূর্ণই ব্যর্থ হয়েছেন কোন ঘরানা রেখে যেতে? নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটু প্রমূখের দর্শন শুধুই কী সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের দেশে? জাতির ব্যর্থতা, পৃথিবীর ব্যর্থতা নিদারুণ কষ্টে ফেলেছে আমার আত্মাকে। কষ্ট হয় তাদের জন্য যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে এক ধরনের পরাধীনতার গ্লানি মেনে খাচার মধ্যে বেঁচে আছেন। কষ্ট হয় তাদের জন্য যারা পিঞ্জরিত ব্যর্থতা ও ব্যর্থ স্বপ্ন নিয়ে জীবন ধারণ করছেন। অন্তহীন কষ্ট ও দুঃখ হয় নিজের ভাইসহ স্বাধীনতার অযুত সেনাদের জন্য, যাদেরকে রেখে এসেছি স্বাধীনতা নামক এক কীটদংশ অন্ধকারে।

তারিখ: ২০০৫

সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান