একাত্তরের গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি
যখন জোট সরকার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়টিকে গৌন করে সমগ্র জাতিকে স্মৃতি বিভ্রম বা ন্যাশনাল এ্যামনেশিয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে ঠিক সেই মুহঁতে নবাগত পাকিস্তানি হাইকমিশনারের ‘৭১ সংক্রান্ত মন্তব্য একাত্তরের গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলােকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা শুধু অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলবার অপকৌশল নয়। এটি ভয়ংকর একটি অপরাধের পৃষ্ঠপােষকতাও বটে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিহ্ন শুধু ইতিহাসের পাতায় এবং আমাদের শরীরে নয়, এর চিহ্ন রয়েছে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা এবং আমাদের চেতনায়। এটা কখনই মােছা যাবে না। আর এ সংক্রান্ত ক্ষমার কথাটি আসে তাে অপরাধের অনুভব ও ক্ষমা ভিক্ষা চাবার পরই। অপরাধী রাষ্ট্র পাকিস্তান তাে তাদের নৃশংসতা ও নির্যাতনকে সঠিকভাবে অনুভবই করেনি। অপরাধবােধ, গ্লানি এবং সত্যিকারের ক্ষমা স্বীকার- এগুলাে তাে অনেক দূরের ব্যাপার। তারা এখনও নানা ধরনের মিথ্যে উক্তি, প্রতারণামূলক প্রচার ও মনগড়া গবেষণার মাধ্যমে গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে প্রমাণ করতে চাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হল এই যে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ‘৭১-এর ন’মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালীকে ঘর ছাড়া করে Forced migration -এ বাধ্য করে। এটাই তাে একটা বড় যুদ্ধাপরাধ। প্রমাণ রয়েছে যে প্রথম ৬ মাসে হত্যা ও ধর্ষণের পর সম্মান ও সম্পদ লুঠ করে ভিটে মাটিতে আগুন দিয়ে ৬৯.৭১ লক্ষ (মার্চ-আগস্ট, সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস পৃষ্ঠা৪৪৬, ভারত সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত) সংখ্যক হিন্দুদেরকে দেশ ছাড়া করে তারা ethnic cleansing- এর কাজটি সমাধা করেছিল। তারা। দেশে প্রায় তিন হাজার হিন্দুকেও জোরপূর্বক ধমান্তরিত করেছিল।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চলতি গবেষণা অনুযায়ী পাকি হানাদার ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালে দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায় তাতে প্রায় সাড়ে বারাে লাখ লােক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি গবেষণায় (সূত্র: WCFFC গবেষণা)। এর বাইরে। আরাে হিসাব রয়েছে। এ যাবৎ গণকবর ও গণহত্যা স্পট আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় ৯২০টি। ৮৮টি নদী ৬৫টি ব্রিজের উপরে হত্যা নির্যাতনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। চার লাখ ষাট হাজার নির্যাতিত নারীর পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে পাকি দোসররা সহায়তা করলেও পাকিস্তানি বাহিনীই নিজেরাই এই সমস্ত ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও গণহত্যায় অংশ নেয়। ধর্ষিতা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের নাম উল্লেখ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ২৮৭জন সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীকে শনাক্ত করেছে। এরমধ্যে ১৯১ জন বড় মাপের যুদ্ধাপরাধী। ৩০/৪০ জন রয়েছে। শীর্ষ অপরাধী। যারা হত্যা ও নির্যাতনের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক সংশ্লিষ্ঠতাকে অস্বীকার করতে চায় তাদের প্রতি আহ্বান রইলাে আমাদের সাথে আলােচনার টেবিলে বসবার। আমাদের সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন পৃথিবীর কয়েকজন শীর্ষ জুরি, আইনবীদ ও মানবাধিকার কর্মী। আমরা এ বিষয়ে জেনারেল পারভেজ মােশাররফের সাথে একটি ডায়ালগ চাই। তিনি বা তার প্রতিনিধি সশরীরে গণহত্যার স্পটগুলাে দেখে এবং নির্যাতিতা নারীদের সাথে কথা বলে মানবতা ও ন্যায় বিচারের পক্ষে অবস্থান নেবেন এটা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের প্রত্যাশা। পাকিস্তান সরকার ও তার প্রতিনিধিকে সত্য স্বীকার করে Truth & Reconciliation Process-এ সামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছি। এখন দেখবার বিষয় হল, সত্যের মুখােমুখি হবার সৎ সাহস তাদের কতটুকু রয়েছে। এরপরও তারা অপরাধী ও তাদের দোসরদেরকে নিজ গৃহে বরণ করে নিতে পারে। নিজেদেরকে একটি অপরাধী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এটা তাদের স্বাধীনতা। তবে ন্যায়বিচার নিজস্ব পথে চলবে এবং সত্যের অধিকার কেউ রুখতে পারবেনা। তারিখ: ২৯ অক্টোবর ২০০৫
সূত্র : প্রসঙ্গ ১৯৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম এ হাসান