You dont have javascript enabled! Please enable it! মওলানা মওদুদীর ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী - সংগ্রামের নোটবুক

বিভিন্ন মুখােশে জামায়াত

মওলানা মওদুদীর ইসলামের নামে বাতিল ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। উপমহাদেশের রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা সবাই জানেন, জামায়াতে ইসলামী একটি কালাে শক্তি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই দলটি ইসলামের মুখােশ পরে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিসহ বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের দালালী করে আসছে। বৃটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলােতে মওদুদী একদিকে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন, অপরদিকে বলেছেন, “যদি ইংরেজদের সাথে আপনার শত্রতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছ’ হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে, আপনার দেশের। বাসিন্দা নয়, তাহলে আপনার এ শক্রতা ইসলামী শক্রতা নয়, অজ্ঞতাপ্রসূত শক্রতা।’ তিনি ব্যঙ্গ করে পাকিস্তানকে ‘লেংড়া পাকিস্তান’ ‘লুলা পাকিস্তান’ আরাে কত কিছু বলেছেন। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। পর ভারত থেকে পাকিস্তানে এসে তাঁর ও দলের অতীত ভূমিকা। বেমালুম ভুলে যান। বলতে শুরু করেন, তিনি নাকি পাকিস্তান আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামীকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে আলাদা রেখেছিলেন। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে তিনি দল নিয়ে মাঠে নামতেন। সে সময় উল্টো তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে দায়ী করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেও জামায়াতের ভূমিকা একই ছিল। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতিদের জঘন্য ভূমিকা এদেশের মানুষ আজো ভুলতে পারেনি। জোট সরকারের শরিক দল হওয়া সত্ত্বেও একাত্তরে স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকার জন্য এদেশের সচেতন নাগরিকরা জামায়াতকে পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিস্ট চক্র মনে করে। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের আশীর্বাদে আত্মপ্রকাশের পরও জামায়াত স্বাভাবিক সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারেনি এরূপ পরিস্থিতিতে তারা নানা ধরনের অঙ্গ ও সহযােগী সংগঠন গড়ে তােলার প্রতি গুরুত্বারােপ করে। পাকিস্তান আমলের ইসলামী ছাত্র সংঘের সংঘ’ শব্দটি বাদ দিয়ে শিবির শব্দ সংযােজন করা হয়।

এছাড়া ছাত্র সংঘের দলীয় পতাকা, মনােগ্রাম ইত্যাদি সবই ঠিক রাখা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা নেতৃত্বের সবাই ছিল আগেকার ছাত্র সংঘের নেতা ও খুনী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কিংবা সদস্য। জামায়াতের অন্যান্য সংগঠনগুলাের মধ্যে রয়েছে ছাত্র শিবির, যুব শিবির, ফালাহ আম ট্রাস্ট, ইসলামিক সমাজ কল্যাণ। পরিষদ, ইসলামিক ইকোনমিকস্ বুরাে, ইসলামিক সেন্টার, বিপরীত উচ্চারণ, সাইমুম শিল্পী গােষ্ঠী, ফুলকুড়ি আসর, আধুনিক প্রকাশনী, ইসলামিক এডুকেশন সােসাইটি, চাষী কল্যাণ সমিতি, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, মসজিদ মিশন, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক প্রভৃতি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এসবের রয়েছে হাজারাে শাখা-প্রশাখা। অনেকের মতে এছাড়াও রয়েছে শতাধিক ইসলামিক এনজিও। জামায়াতের নেতা ও রােকনরা। এসব পরিচালনা করেন। এছাড়াও রয়েছে মােমিনীন সালেহীন নামের একটি আর্মড ক্যাডার সংগঠন। অনেকের মতে একাত্তরের বদর বাহিনীর বাংলাদেশ সংস্করণ হচ্ছে মুমিনীন সালেহীন সংগঠন। ১৯৭৫ সালের পর কোনাে এক সময়ে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় থেকে শিবির ও মুমিনীন সালেহীনের তাণ্ডব সারা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য নিরীহ ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কাটা ও হত্যার অভিযােগ রয়েছে শিবির ও মুমিনীন সালেহীন ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। এমনকি, আশির দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সমাজ ও ছাত্র দলের নেতা-কর্মীরাও শিবিরের নির্যাতনের খড়গ থেকে রেহাই পায়নি।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ‘৮৭ সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,“আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন অপকৌশল এবং স্বাধীনতা বিরােধী কর্মকাণ্ডের বিচিত্র তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় আমরা জামায়াত এবং শিবিরের সঙ্গে আলাপ করেছি। জামায়াতের জনৈক ফয়সাল আহমেদ আলােচনা প্রসঙ্গে আমাদেরকে জানান, ‘… প্রয়ােজনের সময় একাত্তরের অস্ত্রগুলাে আবার ব্যবহার হবে।… জামায়াত কাউকে ক্ষমা করে না।” গত ক’বছরে সারা দেশে আরাে বেশ কিছু জঙ্গী মৌলবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। গােয়েন্দা বিভাগের মতে এসব সংগঠনের সংখ্যা ১২। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরাে অনেক বেশি। এসবের মধ্যে রয়েছে হরকাতুল জিহাদ, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, শাহাদাতে আলহিকমা, জামায়াতে ইয়াহিয়া আততুরাত, হিজবুত তওহীদ, আল হারাকাত আল ইসলামিয়া, আল মারকাজুল ইসলামী, জামায়াতুল ফালাইয়া, তওহিদী জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জামায়াতুল আল সাদাত, শাহাদাতে নবুয়ত, আল্লাহর দল প্রভৃতি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী থেকে পরিচালিত এসব সংগঠনের শীখাপ্রশাখা বিভিন্ন জেলা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজশাহী, বগুড়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিভিন্ন সময়ে এসব সংগঠনের জঙ্গীরা ধরা পড়ার পর তাদের কাছ থেকে টাইম বােমা তৈরির সার্কিট, ব্যাটারি, রিমােট কন্ট্রোল, রিভলবার, গুলি, লিফলেট, বই, মােবাইল ফোন, অডিও ক্যাসেট, চাঁদার রসিদ বই, জেহাদী কাগজপত্র ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে।— রাজশাহীর পবা উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা ডা. মােজাম্মেল হকের দারুশা বাজারস্থ বাড়িতে বােমা তৈরির সময় ৭ জামায়াত কর্মী গুরুতর আহত হওয়ার পর দুজন মারা যায়। মামলার তদন্ত শেষে সিআইডি চাশিীট দাখিলের পর বিচার কাজের জন্য আদালতে উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়।” (জনকণ্ঠ, ১৯/৮/০৩)। অপর একটি সংবাদে বলা হয়,“রাজশাহীর আতঙ্ক বলে খ্যাত নিষিদ্ধ ঘােষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন শাহাদাত আল হিকমা এখনাে সক্রিয়। তবে বদলে গেছে তাদের কার্যকলাপের ধরন।

আপাতত পাঠচক্র, খেলাফত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। … রাজশাহী মহানগরী জামায়াতের একজন নেতাই সার্বিকভাবে দলটির দেখাশােনা করছেন।” (ভােরের কাগজ, ২০/৮/০৩) এক প্রতিবেদনে বলা হয়,“জয়পুরহাটে ইসলামী জঙ্গী হামলার ঘটনা নিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছে। প্রথমত, এখন পর্যন্ত লুট করা অস্ত্র, গুলি এবং ওয়্যারলেস সেট পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। দ্বিতীয় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে এমন সব তথ্য বেরিয়ে আসছে, যা জো৯ সরকার এতােদিন অস্বীকার করে এসেছে। পুলিশের কাছে দেয়া গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসীদের জবানবন্দী এবং উদ্ধার করা কাগজপত্র থেকে | জানা গেছে, ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। তারা এও স্বীকার করেছে, দিনাজপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বােমা হামলা ঘটনার সঙ্গে তাদের সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন জড়িত। দেশের প্রায় সকল জেলায় এই সংগঠনের নেটওয়ার্ক এবং ঘাঁটি রয়েছে। এদের রয়েছে অস্ত্র তৈরির বিশেষজ্ঞ। নিজেদের তৈরি অস্ত্র দিয়েই এরা বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে থাকে। দেশের যেখানেই তাদের অপারেশনের পরিকল্পনা হয় সেখানে সারা দেশ থেকে জঙ্গীদের সমবেত করা হয়। এসব তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর জামায়াতুল মুজাহিদীন জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর একটি গােপন অঙ্গ সংগঠন কিনা, এ নিয়ে। আইন-শৃংখলা বাহিনীকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।…” (জনকণ্ঠ, ২০/৮/০৩) ‘জামায়াতুলের আবরণে ইসলামী গণবাহিনী’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “সত্তরের দশকে জাসদের গণবাহিনীর মতাে জামায়াতুল মুজাহিদীনের মাধ্যমে সারা দেশে ইসলামী গণবাহিনী গড়ে তােলা হচ্ছে। যেখনেই জামায়াতুল মুজাহিদীনের সদস্য ধরা পড়ছে, দেখা যাচ্ছে তারা কোনাে না কোনােভাবে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জড়িত। জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের উত্তর মহেষপুরের যে বাড়িতে পুলিশের সাথে মুজাহিদীনদের সংঘর্ষ হয়, সে বাড়ির মালিক মুনতেজার দু’বছর আগেও জামায়াতে ইসলামীর সাথে জড়িত ছিল। সংঘর্ষের আগ পর্যন্ত মানুষ তাকে স্থানীয় জামায়াত নেতা বলেই জানতাে। এই ঘটনায় আরাে যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের অধিকাংশ জামায়াতের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। ফলে এরূপ সন্দেহ করার কারণ জোরালাে হচ্ছে। 

যে, এরা এখন জামায়াতের প্রকাশ্য রাজনীতির পরিবর্তে গণবাহিনীর মতাে গােপন সংগঠনে কাজ করছে। এরূপ মনে করার আরাে কারণ হচ্ছে যেসব জায়গায় জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে সেসব স্থানেই জামায়াতুল মুজাহিদীনের নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। গত মার্চে চাপাইনবাবগঞ্জের পােড়াবাগ মহল্লায় জামায়াতু” মুজাহিদীনের ঘাঁটি আবিষ্কার থেকে শুরু করে জয়পুরহাট, দিনাজপুর সর্বত্রই এমন প্রমাণ মিলছে। “জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার সদর দফতর থেকে জামায়াতুল মুজাহিদীনের সকল জঙ্গী তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে। আহলে হাদিসপন্থী মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র, মসজিদের ইমাম, অধ্যাপক, ব্যবসায়ীসহ যারা এর সদস্য তাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির রাজনীতির দীক্ষাপ্রাপ্ত। চীফ কমান্ডার মওলানা আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহও এক সময় জামায়াতের প্রকাশ্য রাজনীতি করতাে বলে জানা গেছে। এছাড়া জঙ্গীরা যেখানেই ধরা পড়ছে সেখানেই জামায়াতের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলছে। একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনী, যা জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল, তাদের সাথে জামায়াতুল মুজাহিদীনের সাদৃশ্য থাকায় এ সন্দেহ আরাে জোরালাে হয়ে উঠেছে। বদর বাহিনীরও জন্ম হয়েছিল তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে এই ময়মনসিংহেই। “দিনাজপুরের রানীশংকৈল উপজেলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াতুল মুজাহিদীনের প্রশিক্ষক ফজলে রাব্বী ও তার সহযােগী লুত্যর রহমানকে সিআইডি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা দিনাজপুরের বােমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। লুত্যর জামায়াতে ইসলামীর একজন সক্রিয় সদস্য বলে পুলিশই জানিয়েছে। সে যে দলকে নিয়মিত চাঁদা দেয় তার কাগজপত্রও পুলিশ উদ্ধার করেছে।

পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় জামায়াতুল মুজাহিদীনের শক্ত ঘাঁটি থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু জঙ্গীদের চিহ্নিত করতে তাদের এজন্যই বেগ পেতে হচ্ছে যে, তারা প্রায় সকলেই সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী।…” (জনকণ্ঠ, ২৫/৮/০৩) সারা দেশে ইসলামী জঙ্গীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার এধরনের বহু খবর সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলােতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলাে। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাগুলাে সংবাদপত্রেও আসে না। এসব খবর প্রকাশ শুরু হওয়ার পর জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বক্তৃতাবিবৃতিতে হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেশের সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়। আগে জামায়াতের আমির থেকে শুরু করে নেতাপাতিনেতারা প্রায়ই বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলন ইসলামী বিপ্লবের’ হুঙ্কার দিতেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, আমির মওলানা নিজামী পল্টনে ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে বলেছেন, “জামায়াত ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে ইসলামী বিপ্লব করতে।” (জনকণ্ঠ, ৪/১/০৩)। কিন্তু জঙ্গী মৌলবাদীদের একটার পর একটা নাশকতা ফাঁস হয়ে পড়তে দেখে জামায়াতিরা এখন তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের বয়ান আরম্ভ করেছে। জামায়াতের আমীর মতিউর। রহমান নিজামী সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বলেছেন, “ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে অপবাদ দেয়ার জন্য বিশ্ব ইহুদী চক্র বিভিন্ন দেশে জঙ্গী গ্রুপ তৈরী করছে। এই জঙ্গী তৎপরতার সাথে বিশ্বের মূলধারা ইসলামী শক্তির কোনাে সম্পর্ক নেই। …

নবী-রাসূলগণ (আঃ) মানুষের উপর বল প্রয়ােগ করে ইসলাম চাপিয়ে দেননি। অথচ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীগােষ্ঠি অপপ্রচারের মাধ্যমে বােঝাতে চাচ্ছে, ইসলাম মানে সন্ত্রাস।…” (সংগ্রাম,৩০/৮/০৩) । তিনি লালমনিরহাটে বলেছেন, “ইসলামে সন্ত্রাসের কোনাে স্থান নেই। ইসলামের লেবেল এঁটে যারা সশস্ত্র আন্দোলন করছে এরা প্রকৃতপক্ষে ইহুদীচক্রের ক্রীড়নক। প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন ধ্বংস করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অথচ সারা বিশ্বে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস চালিয়ে ইসলামী চেতনা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আল কায়েদা, তালেবান, জামায়াতুল মুজাহিদীন। নানা নামে সাধারণ মুসলমানদের ব্ৰিত করা হচ্ছে।” (সংগ্রাম, ১৪/৯/০৩)। আগে যে ক’টি নাশকতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দেখা যায় পুলিশের জিজ্ঞাবাদে অধিকাংশ অভিযুক্ত বলছে, তারা জামায়াতের স্থানীয় নেতা-কর্মী। জনাব নিজামীর দুটো বয়ান থেকে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তাহলে জামায়াত কি বিশ্ব ইহুদী চক্রের সাথে আঁতাত করে এসব জঙ্গীকে বাংলাদেশে নাশকতা তৎপরতায় নিয়ােগ করেছে?

নিজামী এখন আল কায়েদা-তালেবানের সমালােচনা করছেন। অথচ আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের সময় তালেবান আল কায়েদার সমর্থনে জামায়াত-শিবির মিছিল-শােভাযাত্রা বের করে ঢাকার রাজপথ জনপদ গরম করেছে। খােদ নিজামী আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সমালােচনা করেছেন। সাবেক আমির গােলাম আজম লন্ডনের সাপ্তাহিক ‘ইউরাে বাংলায়’ (৮-১৪/১/০২ সংখ্যা) আশা প্রকাশ করেছেন, তালেবানদের প্রতি তাদের সমর্থন বহাল রয়েছে। তারা যথাসময়ে সংগঠিত হয়ে পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং তাদেরকে উৎখাত করবে ইনশাআল্লাহ।… তালেবান সরকারের পতনের ফলে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হলাে, নতুন করে কোনাে দেশে ইসলামী সরকার কায়েমের আন্দোলন। ক্ষতিগ্রস্ত হলাে।’ (জনকণ্ঠ, ২/৩/০২)। এখন জামায়াতেরই পরবর্তী আমির মাওলানা নিজামী তালেবান আল কায়েদার সমালােচনা করছেন, ইহুদী এজেন্ট বলছেন। আজ যদি এসব জঙ্গী মৌলবাদী গ্রুপ ইহুদী এজেন্ট হয়ে থাকে, সেদিন তারা কার এজেন্ট ছিল? সেদিন নিজামীরা তাদেরকে সমর্থন করেছিলেন কেন।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরাে বহু জঙ্গী মৌলবাদী। সংগঠন রয়েছে যেমন মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমীন, ফিলিস্তিনে হামাস, হিজবুল মুজাহিদীন, লেবাননে হিজবুল্লাহ, আলজিরিয়ায় ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট, তিউনিসিয়ায় আননেদাউল মুসলিমীন, ইন্দোনেশিয়ায় জামা ইসলামিয়া, পাকিস্তানে জায়শে মােহাম্মদ, লশকরে তাইয়েবা প্রভৃতি। নিজামীর ভাষায় এসব সংগঠনও কি আন্ত র্জাতিক ইহুদী চক্রের এজেন্ট? এরাও কি সাধারণ মানুষকে ‘ব্রিত’ করছে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে নিজামীদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। এই বিড়াল আড়াল করার জন্য এখন নিজেদের অতীত ভূমিকার দিক না তাকিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলছেন। মওলানা নিজামী বলেছেন, ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু তাঁর গুরু মওলানা মওদুদী বলেছেন, বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।”(তরজমানুল কোরআন, ডিসেম্বর, ১৯৪৫) “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই।” (সিয়াসী কাশমকাশ, তৃতীয় খণ্ড) “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রাতাত, সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।” (রাসায়েল ও মাসায়েল, প্রথম খণ্ড, ৪৫ পৃষ্ঠা-মওদুদী). মওলানা নিজামীর কথা তার গুরুর কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। নিজামী বলছেন, ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তাঁর গুরু বলেছেন, বর্তমান যুগের সব কটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাঁর গুরু বলেছেন, বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর। প্রতিষ্ঠিত পার্লাসেন্টের সদস্য হওয়া, ভােট দেয়া হারাম।

তাহলে পার্লামেন্টের সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে, নির্বাচনে ভােট দিয়ে নিজামীরা কি হারাম কাজ করেছেন এবং করছেন? কোন্‌টা সঠিক আর কোন্টা বেঠিক তা দেশবাসীকে জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মওদুদীর উত্তরসূরি হিসেবে জামায়াতের আমির মওলানা নিজামীর উপরই বর্তায়। এই দায়িত্ব নিজামী কোনােভাবেই এড়াতে পারেন না। সম্প্রতি জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নন। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের যেসব নেতাকর্মী ধরা পড়ছে, তাদের সম্পর্কে নিজামী সাহেবের পরিষ্কার কোনাে বক্তব্য নেই। তিনি উদোর পিণ্ডি বুধাের ঘাড়ে চাপানাের চেষ্টা করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে এসব ঘটনার সাথে জড়ানাের চেষ্টা করছেন। তার এই বক্তব্য কি এদেশের গণমানুষকে বিশ্বাস করানাে যাবে? প্রতিটি সচেতন নাগরিক জানে, আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের ইতিহাস নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস। অপর দিকে পাকিস্তান আমল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎপরতা চালানাের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। স্বয়ং গােলাম আজম এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন,“ঐ সময় জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ইসলামী দল এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি (হানাদান পাকিস্তানী বাহিনীকে। সহযােগিতা করেছে) এমন সকল রাজনৈতিক দলই বে-আইনি ছিল । আদর্শবাদী দল হিসাবে জামায়াত আইনের পরােয়া না করে ‘৭২ সালের জুন মাসেই আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামাে দাঁড় করায়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়ও জামায়াত অপ্রকাশ্যে সুসংগঠিত ছিল। ‘৭২ সালের পরিবেশ ও পরিস্থিতি ঐ সময়কার তুলনায় অনেক বেশি কঠিন, প্রতিকূল ও বিপদসংকুল ছিল।” (জীবনে। যা দেখলাম, ১৩০ নং কিস্তি, সংগ্রাম, ১২/৯/০৩) রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে চরম প্রতিকূল অবস্থায় যে দল আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে, তাদের পক্ষে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলা বিচিত্র কিছু নয়। তাতে করে সময় ও সুযােগ মতাে বিএনপিসহ শরিক দলগুলােকে ল্যাং মেরে ক্ষমতায় থাকা যাবে। জোট সরকারের শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর এধরনের স্বপ্নবিলাসী পরিকল্পনা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী সারা দেশে বিভিন্ন নামে সশস্ত্র ইসলামী গণবাহিনী গড়ে তােলার একটা ব্যাপক উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারে। 

সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত