মদ ও বিয়ার নিয়ে জামায়াতের রাজনীতি
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৩-৪ অর্থবছরের বাজেটে অন্যান্য পণ্যের সাথে মদ ও বিয়ারের শুল্ক ১শ’ শতাংশ হ্রাস করে। জায়নামাযের উপর ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরােপ করে। কয়েকটি সংগঠন মদ ও বিয়ারের শুল্ক হ্রাস প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মদ ও বিয়ারের শুল্ক হ্রাসের প্রস্ত বি প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করেন। এর আগেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দুটো শিল্প কারখানাকে মদ তৈরির অনুমতি দিয়েছিল। ব্যাপারটা সম্পর্কে সংবাদপত্রে লেখালেখি ও বাদ-প্রতিবাদ শুরু হলে জনমতের চাপে সরকার উক্ত অনুমতি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। মদ ও বিয়ারের উপর শুল্ক হ্রাস এবং জায়নামাযের সম্পূরক শুল্ক আরােপ সম্পর্কে জোট সরকারের শরীক দলগুলাের মধ্যে কারাে বিবৃতি দেখা যায়নি। জামায়াত প্রধান মওলানা মতিউর রহমান নিযামী গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মদ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে পবিত্র ধর্মের মুখােশধারী জামায়াতের স্বরূপ আরেকবার উন্মােচিত হয়েছে। মদের দাম কমানাের পূর্ববর্তী প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি প্রকারান্তরে সমর্থন করে বলেন, প্রকৃত ঈমানদারের কাছে এর দাম হ্রাস-বৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না। তা ছাড়া ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা চালু না করা পর্যন্ত মদ পুরােপুরি নিষিদ্ধ করা সম্ভবও নয়। জনাব নিযামীর উপরােক্ত বক্তব্য দেখে সারা জাতি বিস্মিত হয়েছে। তিনি প্রকৃত ঈমানদারের কাছে ‘মদের দাম হ্রাস-বৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না’ বলে পরােক্ষভাবে মদের দাম হ্রসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু জায়নামাযের উপর শুল্ক আরােপ সম্পর্কে তার কোনাে মন্তব্য সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০০৩-৪ অর্থ বছরের বাজেট অনুমােদিত হয়েছে। শুল্ক হ্রাসকৃত পণ্যসামগ্রীর তালিকায় জায়নামায দেখা গেল না। এক্ষেত্রেও কি নিযামী সাহেব মনে করেন প্রকৃত ঈমানদারদের কাছে জায়নামাজের দাম হ্রসবৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না?
মদ সম্পর্কে অতীতেও জামায়াতের দ্বৈত ভূমিকা দেখা গেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি জামায়াতের সমর্থন থাকলে কিংবা ক্ষমতার অংশীদার হলে জাতীয় সংসদে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় জামায়াত। নেতারা নীরব থাকেন। আবার বিরােধী দলে থাকলে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেন। পঞ্চম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে বিরােধী দলীয় আওয়ামী লীগ সদস্য এডভােকেট রহমত আলী সারা দেশে মদ্যপান ও জুয়া অনতিবিলম্বে বন্ধ করার। আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি কণ্ঠভােটে নাকচ হয়ে যায়। সে সংসদে মওলানা মতিউর রহমান নিযামী ও মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদীসহ জামায়াতে ইসলামীর তিনজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবটির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে তাদের কোনাে বক্তব্য সে সময় সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। তারা সে সময় সরকারে না থাকলেও বিএনপি সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল। আর তাই তারা এব্যাপারে কোনাে বক্তব্য রাখেননি। অপর দিকে বিগত অষ্টম সংসদে মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদী মদ জুয়া নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বেসরকারী বিল সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় জামায়াতের অতীত ভূমিকা টেনে এনে সাঈদীদের আন্ত রিকতা নিয়ে প্রশ্ন তােলা হয়। কিন্তু সাঈদী এর জবাব দিতে ব্যর্থ হয়ে উঠে চলে যান।
আসলে ইসলামী বিপ্লব, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি শ্লোগান জামায়াতিদের মুখােশ ছাড়া কিছু নয়। উঠতে-বসতে এসব শ্লোগান তারা এদেশের ধর্মপরায়ণ মানুষের বিবেক কেনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা পবিত্র ইসলামকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের এই কৌশল জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মওদুদীকে লেখা পাকিস্তান জামায়াতের এককালের নেতা মওলানা কাউসার নিয়াজি তাঁর একাধিক চিঠিতে এ বিষয়টি পরিষ্কার তুলে ধরেছেন। ষাটের দশকে এসব চিঠি ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। একটি চিঠিতে মওলানা নিয়াজি লিখেছেন, “প্রথমে আমরা নিজে সংসদে প্রার্থী হওয়া হারাম মনে করতাম। কিন্তু এখন বিরােধী দলগুলাের সাথে মিলিত হয়ে নিজেরাও প্রার্থীদের নিকট থেকে দরখাস্ত আহ্বান করছি। প্রথমে আমরা পার্টি টিকিট প্রথাকে অভিশপ্ত মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা সম্মিলিত জোটের সাথে অসৎ লােকদেরও টিকিট বিতরণ করছি।… প্রথমে আমরা নারী-পুরুষের সম্মিলিত সভাসমিতিতে যােগদান করতাম না। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এধরনের সমাবেশে বক্তৃতা করছি, সভাপতিত্ব করছি। প্রথমে আমরা। আলেমদেরকে ঐকদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। রাজনৈতিক দলগুলােকে সঙ্গে নেয়া নাজায়েয মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলাের ঐক্যজোটকে শক্তিশালী করা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কর্তব্য মনে করছি। প্রথমে আমরা মহিলাদের ভােটাধিকার প্রদানের। বিরােধিতা করতাম। কিন্তু এখন আমরা মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান করার জন্য। উঠেপড়ে লেগেছি।
প্রথমে আমরা ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বারণ করতাম। কিন্তু এখন আমরাই তাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রথমে আমরা মিছিল বের করা ও শ্লোগান দেয়া ইসলাম বিরােধী মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই মিছিল বের করছি, শ্লোগান দিচ্ছি, নেতাদের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছি। প্রথমে আমরা মানব রচিত আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত আদালতগুলােতে বিচার প্রার্থনা করা পাপ কাজ মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা এসব আদালতই ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার রক্ষক সাব্যস্ত করছি। প্রথমে আমরা আইনজীবীদেরকে শয়তানী সংঘের সদস্য মনে করতাম। কিন্তু এখন তাদেরকেই আমরা গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষক আখ্যায়িত করছি। … সময়ের দোহাই দিয়ে এতসব পরস্পর বিরােধী অভিমতকে আমরা ইসলামী ও দ্বিনী বলে গ্রহণ ও বর্জন করছি। এখন বিচার্য বিষয় হলাে, গ্রহণ ও বর্জনের এই মহড়ার পর জামায়াতের স্বার্থান্বেষী সদস্য ছাড়া কে আমাদের এই চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে? …” (সাপ্তাহিক শিহাব, লাহাের, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫)। মওলানা কাউসার নিয়াজির উপরােক্ত চিঠিটির অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করার পর এই সীমিত পরিসরে বাংলাদেশে জামায়াতের মদ বিয়ার নিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে বেশি কিছু বলার প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে তারাও তাদের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত কৌশলই অনুসরণ করছেন। পবিত্র ইসলাম নিয়ে তাদের এই কৌশল দেখে মহানবীর (সঃ) একটি হাদিস মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, শেষ যমানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের সাধুতা প্রকাশ ও মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ভেড়ার চামড়ার পােশাক পরবে (মানুষের কল্যাণকামী সাজবে)। তাদের রসনা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ের হৃদয়ের মতাে। | হিংস্র…।” (তিরমিযি) মহানবীর (সঃ) উপরােক্ত হাদিসের সাথে জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও অন্যান্য নেতা-কর্মীকে তাদের আচারআচরণ মিলিয়ে দেখার অনুরােধ করছি।
সূত্র : মুখোশের অন্তরালে জামাত