You dont have javascript enabled! Please enable it! ৮ম পর্ব পাকিস্তানী জেনারেলদের মন -বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ - মুনতাসীর মামুন - সংগ্রামের নোটবুক

লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির সাক্ষাৎকার

প্র: তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে আপনার সাধারণ ধারণার কথা বলবেন?

উ: পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে কখনও প্রকৃত সত্য বা বাস্তবতা কি তা জানান হয়নি। এর কারণ, যখন জেনারেল টিক্কা পূর্বপাকিস্তানে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তিনি বিদেশী সাংবাদিক, রিপাের্টার ও ক্যামেরাম্যানদেরকে হুঁশিয়ার করে দেন ও সেখান থেকে তাদেরকে অবমাননাকরভাবে বের করে দেন। এর পরিণতি হিসেবে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। আর সব বানােয়াট খবর প্রচার করতে ও ছাপাতে থাকে। তাদের ঐ সব কাহিনির উপাদান যােগাড় করত ঐ সময় যেসব লােক পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাচ্ছিল তাদের কাছ থেকে। তাদের কথার ওপরই নির্ভর করছিল বিদেশী তথ্যমাধ্যমগুলি। ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে আসা লােকজনের মাথা ধােলাই করছিল আর ভারতীয়রা যা-ই বলুক বিদেশীরা তা। লুফে নিচ্ছিল। ফলে যা হবার তাই হয়, প্রকৃত সত্য কখনও বেরিয়ে আসেনি। যাহােক, তখন পশ্চিম পাকিস্তানেও সামরিক আইন বলবৎ ছিল। তাই জনসাধারণও পূর্বে কি ঘটছে তা খুঁজে পেতে জানার জন্য তেমন আগ্রহ বােধ করেননি। আমি যখন দায়িত্বভার নিই তখন সরকার পরিস্থিতি বদলানাের চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া ও ভূট্টো চেষ্টা করেন বাংলাদেশে তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। ভূট্টো ও ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিজেদেরকে আরও বলিষ্ঠ, শক্তিশালী করে তুলতে ও পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করতে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে না ঘটছে তা তারা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষ পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছিল তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। এর আরও একটা কারণ হলাে, দেশের কাগজপত্রেও তখন ঘটনা সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছিল না। 

প্র: জেনারেল আপনি এসব কথা বলছেন কারণ এখন আপনার এসব জানার সুযােগ হয়েছে। আপনি পরবর্তীকালে অন্তদৃষ্টি লাভ করেছেন। ভালাে কথা। কিন্তু আমরা জানতে চাই, তখন তাদের চিন্তা-ভাবনা কী ছিল? তখন কি আপনি এ সব কথা জানতেন? 

উ: না, জানতাম না। কারণ, আমি তখন আমার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে লক্ষ করি, ওখানকার জনসাধারণ আসল ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না, ওরা সব আমার কাছে নির্বোধসুলভ প্রশ্ন করছে। এর ফল হিসেবে সত্য-মিথ্যার আঁস্তাকুড়ে চাপা পড়ে থাকে, প্রহসন হয়ে ওঠে সবকিছু। কেউ-কেউ আসলে ঘটনা কী তা লেখেও; কেননা, কারা পাকিস্তান ভেঙেছে তা জানতে তারা আগ্রহী ছিলেন। এ ভাঙনের নায়ক ভূট্টো, এ ভাঙনের নায়ক মুজিব । তাই এই নির্মম, নিষ্ঠুর যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হলে বাইরের জগতের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তখন উপায় ছিল না।

প্র: এই বাইরের, বিদেশীরা কারা? উ: তারা হলাে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, আফগানিস্তান ও ইসরাইল। এ কারণেই তারা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলিতে নির্বাচনে লড়েনি।

প্র: না, কথাটা ঠিক নয়। কেননা, আওয়ামী লীগ তাে পশ্চিম পাকিস্তানেও নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে, লড়েছে।

উ: কিন্তু ওরা নির্বাচনে জেতেনি। ওরা তা চায়ওনি। প্র: আওয়ামী লীগের তাে নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক দলীয় সংগঠন ছিল।

উ: ওরা ভােটের জন্য লােক খুঁজত বটে। তবে ভূট্টোর পার্টিই ছিল আধিপত্যশীল । আমি পাকিস্তানে ফেরার পর একটা দল গঠন করেছিলাম।

প্র: তা ঐ দলটির নাম কী ছিল?

উ: দলটির নাম… মুজাহিদ… না ফেদাইন পার্টি। তবে সরকার এ দল। গঠনের অনুমতি দেয়নি।

প্র: কেন? কেন, এই অনুমােদন দেওয়া হলাে না?

উ: কেননা, ওটা আমার দল, তাই! আর জানেনই তাে ভূট্টোর সরকার আমার বিরুদ্ধে ছিল। আমাকে এ ব্যাপারে অনেক আশ্বাসঅঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে দলীয় একটা টিকেট আমাকে দেওয়া হবে। অবশ্য নানা মহলে যে কথা প্রচলিত তা হলাে, টিকেট পাওয়ার জন্য কিছু লােকই থাকে যেখানেই যেতে চায় সেখানে যাবার টিকেট পেয়েও যায় তারা, পেয়ে যায় তা আবশ্যিকভাবেই। কাজেই কিছু জিনিস আছে যার প্রতিবন্ধকতা। কখনও সরে না। তারপর আমি এই বইটি লিখি। আমার প্রায় নিশ্চিত আশঙ্কা ছিল যে, বহু লােক আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে। কেননা, আমার যা কিছু চোখে পড়েছে আমি তার সবকিছুই ফাঁস করে দিয়েছি কোনাে রাখঢাক করিনি । প্রকৃত সত্য কী তা হেঁকে তুলতে আমার ৫ থেকে ৬ বছর সময় লেগেছে গবেষণা-সমীক্ষায় আর তারপর যদি আমি বাস্তব প্রমাণসহকারে না বলি তাহলে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না কারণ আমি তাে ক্ষতিগ্রস্ত । আপনারা যা জানতে চাচ্ছেন তার সব বিষয়ই আমি আমার এই বইয়ে সন্নিবেশিত করেছি। আবার আমি গােড়ায় ফিরে যাই, মুজিব সমর্থকও ছিল, মুজিববিরােধীও ছিল। কাজেই সত্যিকার অর্থে তখন ভূট্টোই সরকার হিসেবে কাজ করছিলেন তার সমর্থকদের সেটিই ছিল কাম্য। কিন্তু নেপথ্যের আসল ঘটনা তারা কখনও জানতে পারেনি। তবে আমি আপনাদের কাছে একটা বড় জিনিসের উল্লেখ করতে চাই সেটি হলাে আমাদের তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক দলউপদল ছিল, মতভেদের অন্ত ছিল না পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে। সেদিন আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম। যে সব অফিসার আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন তারা ছিল আমার ছাত্র। তারা আমাকে ভালাে করে চিনত। আমিও তাদের চিনতাম ।

এদের তিনজন অফিসার মেসে থাকত আর আমি তাদের খরচ যােগাতাম। একদিন চোর হানা দেয় তাদের সেই মেসে, তাদের সবকিছু লাপাত্তা হয়ে যায় । এরপর সংশ্লিষ্ট ঐ অফিসারটি যখন এখানে ছিল তখন তার স্ত্রী আমাদেরকে * ঠাট্টা করে বলত, আরে এখানে তাে কোনাে রুশী নেই! আসলেও ঐ সময়টায় সবরকমের প্রচারণা, রটনা চলছিল তার কোনাে শেষ ছিল না। তা সে যা-ই হােক, আমি এখনও ‘৭১-এর নিষ্ঠুরতার পক্ষপাতি নই। আমি এখানে তাে ফিরে এলাম। আমি এখন আপনাদেরকে এ বিষয়ে কিছু উপকরণ দেব যা একজন ব্রিটিশ নাগরিকের প্রকাশনা যাতে পূর্ব পাকিস্তানিরা কী নিষ্ঠুরতা। চালিয়েছে তার বর্ণনা রয়েছে। আমি ধরুন সেখানে ছিলাম, আপনারা ওখানে ছিলেন। এখন আসা যাক, কিভাবে ঘটনা গড়িয়েছে আপনাদের ওখানে। ৭০এর মহাঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের দুর্যোগ ছিল দারুণ গুরুতর রকমের ঘটনা। ঐ সময় রিয়ার অ্যাডমিরাল এ কে এম আহসান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। গভর্নর। সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাধিনায়ক। আহসান ঐ সময় প্রথম দিকে ঘূর্ণিদুর্গতদের কাজে হেলিকপ্টার চেয়েছিলেন। সামরিক তরফে ক্ষমতাবান সাহেবজাদা ইয়াকুব সে অনুরােধ রাখেননি। অথচ সে সহযােগিতা করা তার জন্যে ছিল নৈতিক কর্তব্য। এতে যা হলাে তাতে দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের বিপদের দিনে তাদের সেই দুঃখ-কষ্টের অংশীদার তিনি হলেন না। এর পরে আরেকদল যারা এলাে, তাতেও অবস্থার তেমন রকমফের হলাে না, ভালাে কিছু হলাে না। আর এর ফলে ওখানকার মানুষের মনে একধরনের সংশয়-সন্দেহ জন্ম নিল। ওরা ভাবল, আমাদের সঙ্কটের সময়ে ওরা আমাদের সাহায্যে এলাে না । তবে তারা যেসব মানুষকে দোষারােপ করতে চেয়েছে তারা কোনাে সমষ্টি নয় আসলে একজন ব্যক্তিবিশেষ। কিন্তু একথাও সত্যি, তিনি তাে আসলে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন কোনাে এক জনসমষ্টির। আর তাই ব্যাপারটা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তবে সে সময়ে সেনাবাহিনীতে দেশের দুই অংশের সমতা ছিল। ১২ ব্যাটালিয়ান সৈন্য ছিল পশ্চিম ও পূর্ব উভয় তরফে। আর উভয় দিকেই ছিল ১ জন করে ইউনিট অফিসার। তাই বিভেদের রেখাটি ঠিক এখানে তৈরি হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই এসব ইউনিট অফিসাররা ছিল। আর সে কারণে একটা বৃহত্তর ধারণায় তখন সেনাবাহিনীতে একটা শৃঙ্খলা ছিল। তবে আনুষ্ঠানিকতা-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কিছুটা হতাশা ছিল ।  এরপর আসে নির্বাচন। সেই সময়ে ইয়াহিয়া ছিলেন প্রধান সেনাপতি।

আমরা তাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে যেভাবেই জানি-না কেন, তিনি নিঃসন্দেহে স্বার্থপর ও লােভী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কোনাে-না-কোনােভাবে আইয়ুবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন ও মুজিবকে এমন সব কাজে উৎসাহিত করেন যাতে সামরিক আইন জারি করার অবকাশ ঘটবে না, ওটা করা হবে না যদি তাকে (ইয়াহিয়াকে) ক্ষমতা থেকে সরাবার ব্যবস্থা না করা হয়। আর তাদের মধ্যে এই মর্মে একটা সমঝােতা ছিল যে, যদি মুজিব কথা দেন যে তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে তারপরেও ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থেকে যাবেন তাহলে ইয়াহিয়া আপনারা, যাকে বলেন প্যারিটি ও এক ইউনিট ভাঙার সেই প্যারিটি ও এক ইউনিট ভাঙার পর পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে ওঠে ৩৫%, পূর্ব পাকিস্তানও ৩৫%, তারপর আমরা আবার এক ইউনিটের সুবাদে… ।

প্র: আমি তাে মনে করি, ভাের্টের বণ্টনের ব্যাপারটি সবসময় ঘটে থাকে জনসংখ্যা অনুপাতে…. 

উ: না, তবে প্যারিটির আওতায় ঠিক হয় হবে সমান সমান অনুপাতে; ৫০ আসন এখানে ৫০ আসন ওখানে… এভাবে। অন্যথায় যে অঞ্চলে জনসংখ্যা বেশি সেখানে ভােটও বেশি হওয়াই উচিৎ ছিল। তবে এ ব্যবস্থার আগে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল ও তার কারণও এরকম ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে একটি শিক্ষিত হিন্দু জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। যদি তারা সরকার গঠনে একটা বড়রকমের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় তাহলে ঐ হিন্দুসম্প্রদায় সেখানে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারবে । । প্র: তা পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কত ছিল?

উ: ঐ সময়ে প্রায় এক কোটি। তারা ছিল সবাই শিক্ষিত । তারা সবাই ভালাে সরকারি পদে কায়েমি ছিল। ওদের মধ্যে অনেকে ছিল অধ্যাপক, শিক্ষক। ওদের প্রায় সকলেই ছিল শিক্ষক। এরকম অবস্থায় দেশের জন্য কোনাে শাসনতন্ত্র রচনা ও সেটি অনুমােদন করতে হলে সে ক্ষেত্রে হিন্দুরা তাদের জোর প্রভাব ফেলবে । অন্তত এখানে তখন সে ধারণাই কাজ করে।

প্র: কোথায় এ ধারণা দেওয়া হয়? পশ্চিম পাকিস্তানে?

উ: ঠিক তাই।

প্র: সে হােক, তবে আপনি নিজেও কি সেই একই ধারণা পােষণ করেন?

উ: আরে না, না, আমি তাে একজন সৈনিক ৰৈ নই! আমার এসব নিয়ে কিছুই করার ছিল না। আমি সেভাবে বিষয়টি ভেবেও দেখিনি। আমাদের কালে আমরা প্রশিক্ষণ পেয়েছি তা ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। আমাদের সেই প্রশিক্ষণের আওতায় আমাদের বলা হতাে : কি ঘটে-না-ঘটে তাতে তােমাদের মাথা ” 

ঘামাবার কিছুই নেই, তােমরা তােমাদের দেশ ও শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত। আমরা তাই প্রতিষ্ঠান ও শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত, ঘটনা যা-ই হােক তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।

প্র: কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আপনারা অনুগত?

উ: আমার ইউনিট, সেনাবাহিনী, প্রতিষ্ঠান ও শাসনতন্ত্রের প্রতি যার আওতায় আমি এ মর্মে শপথ নিয়েছি যে, আমি দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, বিশ্বস্ত থাকব…। সেই সময়ে আমরা অসামরিক লােকজন সম্পর্কে একটা শৃঙ্খলা মেনে চলতাম। কেউ বাইরে থেকে এলে, ও সে ব্যক্তি কোনাে রাজনীতিক হলে আমি তাকে সেনানিবাস এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দিতাম

। এমনকি, আগন্তুক আমার বন্ধু হলেও তিনি যদি রাজনীতিতে লিপ্ত থাকতেন তাকেও আমি ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের অনুমতি দেইনি। যাহােক ওখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপি হয়। এ বিষয়ে আমাকে জানান মৌলভী…।।

প্র: কোন নির্বাচনের কথা বলছেন আপনি? ১৯৭০-এর…।

উ: ১৯৭০-এর। একথা আমাকে বলেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, মােনেম খান, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও আরও বেশকিছু লােক যারা ছিলেন পাকিস্তানপন্থি। একটিমাত্র লােক এখানে সবকিছু ঘটানাের পরিকল্পনা করছে, সবকিছু করছে, তাকে থামানাে দরকার। এ অবস্থায় সামরিক আইন প্রশাসন যদি বাংলাদেশে ঐসব লােককে নির্বাচনে আসতে না দিত আমরা নির্বাচনে বিভিন্ন নগর ও জনপদে ৫০ থেকে ৬০টি আসনে জয়ী হতে পারি । ঐ সময়ে আমাদের হাতে ৫০/৬০টি আসন থাকলে মুজিবুর রহমান এরকম বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেন না। আর সকল বিষয়ে তিনি এতখানি প্রভাব খাটাতেও পারতেন না। তবে সেক্ষেত্রেও সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষকে নন্দঘােষ করা হয়। বলা হয়, এই কর্তৃপক্ষই তাকে নির্বাচনে আসতে দিয়েছে। এসবের আলােকে, পশ্চিমপাকিস্তানে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা হয়নি। আমি মনে করি, আপনাদের হয়তাে মনে আছে যে, ফজলুল কাদের চৌধুরী… একজন মাননীয় ব্যক্তি, সবুর খান, মােনায়েম খান, টেকনাফের মৌলভী ফরিদ আহমদ- এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানপন্থি, তারা আমার কাছে আসতেন। সকলেই আসতেন। আপনারা হয়তাে জানেন না যে, ময়মনসিংহে গিয়ে আমি বলতে গেলে জনতার মাঝে মিশে যাই ।তাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, আমি তাদের কোনাে ক্ষতি করছি না। আমি এভাবেই জনতার ভিড়ে মিশে যেতাম, তাতে আমার কোনাে বিপদ ঘটেনি। মুজিব নির্বাচনে জয়ী হবার পর ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তিনি তখন বলতে থাকেন, শেখ মুজিবুর রহমান আমার ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। তবে মুজিব জবাবে জানান, কিন্তু আপনি আমার প্রেসিডেন্ট নন। কেন?… আপনি তাে অঙ্গীকার করেছিলেন! মুজিব তাকে সাফ জানিয়ে দেন, দেখুন, আমি একজন রাজনীতিবিদ। এর ফলে ইয়াহিয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়, তার চৈতন্যোদয় ঘটে। তার ভাবখানা ছিল এই যে, আমি তার জন্য এক ইউনিট ভেঙেছি, প্যারিটি ভেঙেছি তারই কারণে, নির্বাচনে তিনি কী করছেন-না করছেন তাতে ভ্রক্ষেপও করিনি আর সেই তিনি কি না এখন…! ইতােমধ্যে ভূট্টো যিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮২টি আসন পেয়েছিলেন তিনিও মুজিবের কাছে ছােটেন। তাঁর কাছে সরকারে নিজ দলের ভাগ চান তিনি। তিনি বললেন, আমাকে আপনার ২ নম্বর ব্যক্তি করুন। মুজিব তাতে বললেন, না। ভূট্টো বললেন, ঠিক আছে মন্ত্রিসভাতেই না-হয় কিছু প্রান্তিক দপ্তর দিন? না, তা-ও নয়। ‘ঠিক আছে, স্পিকারের পদটি তাে দেবেন?’ ‘না’ । ভূট্টো এরপর অন্য ধরনের পাঁয়তারা শুরু করেন। ইয়াহিয়া তাকে জানান, লােকটা আমাকে কথা দিয়েছে যে, সে আমাকে প্রেসিডেন্ট করবে। তাে বেশ তাে, আমিও আপনাকে প্রেসিডেন্ট বানাব! কী করে আপনি আমাকে প্রেসিডেন্ট করবেন?’ ‘ও সেই কথা, ভাববেন না, পশ্চিম পাকিস্তান তাে আমাদের থাকবে। আপনি হবেন প্রেসিডেন্ট আর আমি হব প্রধানমন্ত্রী। এসব কথাবার্তার আলােকে ভুট্টো তাকে শিকারের দাওয়াত দিয়ে লারকানায় নিয়ে যান। সেখানে তারা এক মতলব আঁটেন। এটিকেই বলা হয়, ‘লারকানা পরিকল্পনা’। পরিকল্পনাটি ছিল এরকম : ‘স্থলবর্তী হবার মতাে সরকার না রেখেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমরা সরে পড়ব, বাস।” আমি এরকম দাবি আবারও করছি।

প্র: জি হ্যা। আপনি সে কথা আপনার বইয়ে বলেছেনও। পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় কোনাে উত্তরাধিকারী না রেখেই আপনারা সেখান থেকে সরে আসবেন। কিন্তু আপনারা লারকানা পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারলেন কী করে?

উ: বিষয়টি গােপনীয় । কাজী আজম নামে একজন ডিএসপি ছিল। সিকিউরিটির লােকেরা তাকে লারকানায় পাঠায়। কাজী আজম লারকানায় গিয়ে এক লােকের সাথে দেখা করে । ঐ সময়ে ভূট্টো ও ইয়াহিয়া শিকার-ভ্রমণের নৌকায় বসে পরিকল্পনাটি করেন। ঐ আলােচনাকালে সেখানে এক লােক ছিল। আমি কাজী আজমের কাছ থেকেই বিষয়টি জানতে পারি, কাজী আজম জানতে পারে সেই লােকটির কাছ থেকে। তবে ঐ লােক তথ্য ফাঁস করার পর সেটি ভূট্টোর কানেও যায়। তিনি এটিকে চেপে যেতে চেয়েছিলেন এই মনে করে যে, বিষয়টি আর কেউ জানে না মনে করে। আর সে কারণেই এটা। জানাজানি হয়ে যায়। না হলে ঘটনাটি গােপনই থেকে যেত। কিন্তু কেউ । একজন বুদ্ধি করে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। পত্রপত্রিকাতেও তখন এ খবর ছাপা হয়। 

প্র: কবে এ খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়?

উ: ঐ সময়ই। আমার ধারণা, তখন ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। এরপর পরিকল্পনার হােতারা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। একটি পরিকল্পনামাফিক কাজে সর্বোত্তম ফললাভের উপায় ছিল দেশের পশ্চিমাঞ্চলে। জোরেশােরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যার অর্থ আমাদের এখানে অর্থাৎ পূর্ব। পাকিস্তানে লড়াই চালানাের জন্য সেনা সরবরাহ পাওয়া যাবে কম, বিপুল সেনা। মােতায়েন থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানে। এভাবে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতকে পরাজিত করব আর পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের কাছে পরাজয় বরণ করবে। লারকানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও ওরা একথাটি ভুলে যায় যে, তাদের বরাতজোর সবচেয়ে বেশি নিশ্চিত করতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে লড়েই সেটি জয় করে নিতে হবে। আর সে পরিকল্পনা শুধু ফলপ্রসূ হতে পারে যদি আমরা এখানে পরাজিত হই । যদি আমি ঘটনাক্রমে এখানে জয়ী হই বা কোনাে নাজুক, জটিল প্রকৃতির একটা নিষ্পত্তি এখানে সম্ভব হয় তাহলে সেক্ষেত্রে লারকানা পরিকল্পনা সফল হবে না। এ ধরনের নিষ্পত্তির আওতায় রাজনীতিবিদরা যদি সরকার করায়ত্ত করতে পারে তাহলে ইয়াহিয়া খানকে এজন্যে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আর তেমন পরিস্থিতিতে ভূট্টোও কোথাও পাত্তা পাবেন না কেননা, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাতে বাধ সাধবে। কাজেই এই খেলায় যে বাদ পড়বে তাকে চলে যেতে হবে বিস্মৃতির নিভৃত নেপথ্যে।

প্র: এ কারণেই সঙ্কটের রাজনৈতিক মীমাংসার সকল সম্ভাবনাই পুরােপুরি। নাকচ হয়ে যায়?

উ: সেটিই কারণ। ওটা হলে তাে ঐ দুটি লােকের কারাে তাে আর কোনাে সম্ভাবনাই থাকে না।

প্র: কখন আপনি বুঝতে পারলেন যে, সঙ্কটের কোনাে রাজনৈতিক । সমাধান হতে যাচ্ছে না?

উ: পরিকল্পনাটি নিয়ে যখন তারা উদ্যোগী হন। পরিকল্পনাটি ছিল এই যে…,

প্র: আপনি ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের অধিনায়ক। আপনি জানতেন যে, লারকানা পরিকল্পনা বা চক্রান্ত একটা রয়েছে?

উ: না, জানা ছিল না। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আমার বই লেখার সময় সেটি জানতে পারি। | প্র: ঐ সময়েই পত্রপত্রিকায় সে খবর ছাপা হলাে আর আপনি তা আদৌ জানলেন না, এ কেমন কথা? | উ: তখন ইয়াহিয়া মারা গেছেন। ভূট্টোও ক্ষমতা হারিয়েছেন। আর সে সময়টাই বহু লােকের কাছ থেকে বহু তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।… সে যা-ই হােক, তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। তাদের ধারণা ছিল আমার পরাজয়ে তাদের ফায়দা হবে। তাদের বিশ্বাস ছিল, গেরিলাযুদ্ধ যারা করে তারা কখনও পরাজিত হয় না। অথচ আমি মাত্র ২ মাসে গেরিলাদের পরাজিত করেছিলাম। আমি নিজে ইন্দোনেশিয় গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, লড়েছি মালয়ে চীনা গেরিলাদের বিরুদ্ধে।

প্র: আপনি সেসব আপনার বইতে উল্লেখ করেছেন।

উ: সে সামর্থ্য আমার ছিল। আমার চোর ধরার ক্ষমতা যেমন ছিল, তেমনি চোর আমি নতুন কোনাে বাড়িতে সেঁধিয়ে দিতেও পারতাম । দুমাসের মধ্যে আমি এমন এক অবস্থান নিয়েছিলাম ও অবস্থা যা দাঁড়ায় তা গেরিলাযুদ্ধে রীতিমতাে বিদ্যুতগতিসম্পন্ন অভিযান বলেই বিবেচিত হয়। এসবের বিবরণ আমার বইয়ে রয়েছে।

প্র: কখন সেই গেরিলা যুদ্ধের গুরু? উ: যেদিন আমি দায়িত্ব নিই সেইদিন থেকেই। • • • *** প্র: অর্থাৎ দিনটি?

উ: ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। ঐ সময় আমি দারুণ খােশমেজাজে ছিলাম। ওরা এতদিন ছিল কাদামাখা, উর্দিহীন। কিন্তু ঐ দিন থেকে ওদের গায়ে উর্দি চড়ে। কর্নেল ওসমানী হলেন ঐ গেরিলাবাহিনীর প্রধান। ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন আমার বন্ধুমানুষ। একসময় ওসমানী ছিলেন পাকিস্তানের সেনা সদরদপ্তরে, আর আমি তখন ছিলাম এখানে। আমার অন্যতম খেতাব ছিল ‘শেরা’ (বাঘ)। তাই ওসমানী যখনই আমাকে টেলিফোন করতেন তখনই বলতেন, ‘টাইগার! হ্যালাে, আমি টাইগার বলছি।

প্র: সেটার অভিজ্ঞতাও আপনার হয়েছে নিশ্চয়ই? “

উ: আমি জবাবে বলতাম, আরে আপনি তাে সিনিয়র টাইগার । আপনি তাে ইস্ট পাকিস্তান (বেঙ্গল রেজিমেন্টের লােক যাদের প্রতীক ‘বাঘ’! এজন্য | তাকে টাইগার হিসেবে ভালােই দেখাত। এভাবে ওসমানী হলেন প্রধান | সেনাপতি। আমি এই ভেবে খুশি হলাম যে, আমি এখন উর্দিপরা সশস্ত্রবাহিনীর

বিরুদ্ধে লড়ব, কিছু অসামরিক লােকের বিরুদ্ধে নয়।

প্র: এই শেরা’ ছাড়া আপনার খেতাব কী আছে?

উ: তারিখ বিন যিয়াদ, একজন পশ্চিম পাকিস্তানি আমাকে এই নামটা দেয়… আমার আরেক খেতাব মেরিডােন… আমি একসময় রাজপুত রেজিমেন্ট (ব্রিটিশ ভারতে) ছিলাম। আপনারা জানেন, রাজপুতরা রাজপুতানার লােক। রাজপুতরা সাহসী লােক। রাজপুতদের এক বীরনায়কের নাম অমর সিং রাঠোর। সেনাবাহিনীতে আমার মুসলিম সহকর্মীরা আমাকে ডাকত অমর সিং বাহাদুর বলে। এসব হলাে গিয়ে… মানে এসবের তিনটি খেতাব ছিল আমার পাকাপােক্ত। তাই আমি যখন গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযানে সীমান্ত অবধি পৌছে গেলাম… সে এক লম্বা কাহিনী গুছিয়ে বলতে গেলে…।

প্র: না, আপনি এসব বিষয় বিস্তারিত আপনার বইতেই লিখেছেন, লিখেছেন আপনার রণবিন্যাস সম্পর্কেও। আমরা বরং কিছুটা অন্য ধরনের । প্রশ্নের জবাব জানতে চাইব আপনার কাছে। আপনি ১০ এপ্রিল দায়িত্বে আসার পর জেনারেল টিক্কা খানের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল, বিদ্যুৎগতিতে এক অভিযান পরিচালনার। কথা ছিল সে অভিযান শুরু হবে ২৫ মার্চ। অভিযানের নাম ছিল : অপারেশন সার্চলাইট। এ অভিযানের পর পরই চলবে চিরুনি অভিযান (কম্বিং অপারেশন) ও অন্য আর সবকিছু। মনে করা হয়েছিল, এ অভিযানে বিক্ষোভ দমন হবে ও তাঁরা একটা রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে উপনীত হবেন। এ-ই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু আপনারা যদি, আপনাদের কথামতাে দুমাসের মধ্যে বিদ্রোহী বা মুক্তিবাহিনীকে কজা করেই ফেলেন তাহলে তখন কেন আপনারা একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছাতে পারলেন না? কেন আপনারা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মতাে বিকল্প বেছে নিলেন? শ্রীলঙ্কা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আপনাকে পূর্ব পাকিস্তানে রসদ, অস্ত্র, সেনা সাহায্য পাঠানাের কাজটিকে সেক্ষেত্রে খুব কঠিন ছিল না? | উ: সে কথা আমি আপনাকে বলছি। ইয়াহিয়া ও সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন। তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল যার নাম ছিল, ‘অপারেশন ব্লিৎজ’।

প্র: ‘৭০-এর গােড়ার দিকে? নির্বাচনের আগে না পরে? ০০৫

উ: না, না। নির্বাচনেরও অনেক আগে। এমনকি ১৯৬৯-এ তিনি এ পরিকল্পনা করেন।

প্র: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এ হলাে সেই পরিকল্পনা যা তিনি তৈরি করেছিলেন…

উ: নির্বাচনের আগেই পরিকল্পনা করা হয়। ঠিক করা হয়, নির্বাচন হােক

বা না হােক যদি গােলযােগ দেখা দেয়, কোনােরকম গােলযােগ দেখা দেয় তাহলে সে ধরনের উত্থান দমন করার জন্য তিনি এই পরিকল্পনা তৈরি করেন।

প্ৰ: না, আমি বলতে চাই, আপনি আপনার বইয়ে অপারেশন ব্লিজ্জ সম্পর্কে যা দাবি করছেন তার কিছু কিছু জবাব জেনারেল ইয়াকুব পত্রিকায় দিয়েছেন। আপনি কী তা দেখেছেন?

উ: দেখেছি। সেটি অন্য প্রশ্ন। ফিল্ড মার্শাল রােমেল বলেছেন, কোনাে পরিকল্পনায় তার শেষাবধি প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করে না। হুবহু একরকম থাকে।

। যদি সেনাপতি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী লড়াই করেন তাহলে ভালাে। কিন্তু তিনি কেমন করে সে লড়াই লড়বেন সেটি একান্তই ট্যাকটিক্যাল বা কৌশলের ব্যাপার। তাই রণপরিকল্পনা একটা রূপরেখামাত্র। যদি কোনাে রণপরিকল্পনা করা হয় সে পরিকল্পনা যা-ই হােক না কেন তাতে শক্তি প্রয়ােগের ব্যাপার থাকবেই। বলপ্রয়ােগ না করলে তেমন কোনােই সাফল্য আসবে না তা থেকে। তবে তিনি সময়ের বিষয় খেয়ালে রাখেননি। আর তাই মুজিব ও তাঁর সহযােগীরা ধ্বংসাত্মক ও নিষ্ঠুরতামূলক কার্যকলাপ নির্বিচারে শুরু করে দেন। এসবের উল্লেখ যা করা হয়নি আমি আমার বইয়ে সেসবের বিবরণ দিয়েছি। আর তিনি যখন এসব কাজকারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা নীরব ছিলেন। তিনি ঐ অবস্থায় সবকিছু অঙ্কুরেই খতম করে দিতে পারতেন। ঐ সময়ে তার সে ক্ষমতাও ছিল। তখনও পূর্ব পাকিস্তানি সেনারা বিদ্রোহ করেনি। তারা আমাদের সাথেই ছিল। যারা গােলযােগ করছিল তারা অত্যন্ত অসংগঠিত কিছু জনতা মাত্র।

প্র: কখন তার অপারেশনে যাওয়া উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন? উ: সাথে সাথে, তক্ষুনি। প্র: সেটা ঠিক কখন?

উ: নির্বাচনের পরের দিনগুলিতে যখন ওরা ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য হইচই করছিল।

প্র: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন ২৫ মার্চের আগেই?

উ: মার্চেই তার অ্যাকশানে যাওয়া উচিত ছিল যদিও তিনি তা করেননি। তিনি এতে বিলম্ব করেন ও পদত্যাগ করেন। আর এভাবে পাখি উড়ে যেতে দেন। এরপর টিক্কা পূর্ব পাকিস্তানে যান যখন বাঙালিরা দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে তুলেছে। তারও আগে থেকে ওখানকার উর্দুভাষী লােকজনের বিরুদ্ধে হামলা চলছিল। ইয়াকুবের কারণে এগুলি ঘটে। তিনি অন্তত সেগুলি থামাতে পারতেন। তারপর সেখানে যান টিক্কা। তিনি ২৪ বা ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের

বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেন। গােয়েন্দা বিভাগের খবর অনুযায়ী ঐ একই রাতে (২৫ মার্চ) মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন বলে খবর পাওয়া যায়। জানা যায়, তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন, ব্যবস্থাও নেবেন। তাই তিনি কয়েকদিন আগেই অ্যাকশান নেন। সেই অ্যাকশনের শক্তি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তা ছিল খুবই কঠোর।

প্র: ২৫ মার্চের রাতের অ্যাকশানের কথা বলছেন?

উ: আমি সে কথাই বলেছি। 

প্র: ব্যবস্থাটি খুবই কঠোর বলছেন?

উ: খুব বেশি রকমের কঠোর।

প্র: আমিও বলি খুবই নির্মম ধরনের কঠোর।

উ: কোন লােকের অধীনে এ অ্যাকশান চলছে তার ওপরই নির্ভর করে এর প্রকৃতি কী হবে। কেননা, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি যখন ছোঁড়া শুরু হয়ে যায় তখন এসবে জড়িত লােকের আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত হয়ে ওঠে। দেখা গেল তখন কর্তাব্যক্তি হালকা মেজাজে বসে শিকার ধরার সংলাপে ব্যস্ত, সেই জোশে মত্ত। এর পরিণতি হিসেবে আমরা দেখি, তিনি বলছেন, আমি মানুষ নয়, মাটি চাই ।

প্র: কে সেই লােক? টিক্কা খান?

উ: তিনিই। তিনিই বলেন, আমি মানুষ নয়, মাটি চাই। ইয়াহিয়া এসব দেখেশুনে ভড়কে গিয়ে টিক্কা খানকে ১০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। বলা দরকার এখানে যে, যদি কোনাে জেনারেল অপারেশানে থাকেন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া এক ভয়ানক ব্যাপার। এটি ঐ জেনারেলের জন্য মৃত্যুর পরােয়ানার শামিল। যাহােক, ঐ সিদ্ধান্তের আলােকে কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি আগাগােড়া বিবেচনার পর কিছু লােককে দায়িত্ব নেবার জন্য বলেন। আর তারপর তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক করেন, সিনিয়রিটি নিয়ে ভাবার এখানে অবকাশ নেই, ওটা ভুলতে হবে। এখন যে কাজটা পারবে তাকেই সেখানে পাঠাও। শেষ পর্যন্ত আমাকেই এজন্যে বাছাই করা হয়। যদিও আমি বেশ কয়েকজনের পেছনের অবস্থানে ছিলাম। তখন একডজন জেনারেল ছিলেন আমার চেয়ে সিনিয়র । আমাকে পাঠানাে হলাে যেখানে আমার আগে আমার চেয়ে সিনিয়র দুই জেনারেল ব্যর্থ হয়েছেন। যাহােক আমাকে বাছাই করার পর আমি পূর্ব পাকিস্তানে আসি। এখানে এসে দেখি সবকিছুই ওলটপালট হয়ে আছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টগুলির চারপাশে লড়ে চলেছে। আর যে যে শহর-নগর তাদের কজায় রয়েছে সেখানেও চলেছে তেমনি লড়াই। প্রদেশের অবশিষ্ট অংশ দখলে রয়েছে মুক্তিবাহিনীর। প্রাদেশিক সরকার অচল হয়ে গেছে। দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত গায়েব হয়ে গেছে। হিন্দুরা সীমান্ত পারাপার করছে অবাধে। আমাদের তথ্যসূত্র অনুযায়ী আমি যখন দায়িত্বভার নিই তখন অন্যান্য স্থানে আমাদের সৈন্যরা চারদিক থেকে পরিবেষ্টিত, রুদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাদের সাথে যােগাযােগের একমাত্র উপায় ছিল হেলিকপ্টার। ঢাকা ও প্রদেশের বাকি অংশের সড়ক ও নৌ-যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। এখন হলাে কি, স্থানীয় লােকজনের মাঝে এক লােক ছিল (মুক্তিযােদ্ধা?) তাকে সবাই ফিল্ড মার্শাল বলে ডাকত। কেউ একজন আমাদের এই অবস্থার খবর দেয় তাকে। সেই ফিল্ড মার্শাল আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন এই বলে যে, তােমাদের অবস্থা তাে কাহিল। আমাদের জন্য চমৎকার। তােমাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। আমরা এখন তােমাদের ওপর আক্রমণ চালাব। আমিও পাল্টা তাকে ঠিক একই কথা বললাম : “তােমাদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। তােমাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। তােমাদের রসদ নেই। অবস্থা চমৎকার। আমি এখন আক্রমণ চালাব তােমাদের ওপর। আমি আক্রমণও চালাই। এ আক্রমণটা ছিল সুনিশ্চিতভাবেই ভড়কে দেওয়ার মতাে, এটা ওদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তাঁরা এরকমটাই ভেবেছিল যে তাদের প্রতি গেরিলা যদি একজন করেও পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে তাহলে ওরা দুই মাসে খতম হয়ে যাবে। তাই তারা আশা করতে পারেনি যে আমি এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনার সাহস করব। আমি এ ধরনের চকিত অভিযান শুরু করেই সৈন্যদের নির্দেশ দিলাম দ্রুততম গতিতে তােমরা সীমান্তের সম্ভব সকল জায়গায় পৌছে যাও- এটাই আমার নির্দেশ। আমি সরাসরি এরিয়া কমান্ডারদের কাছে গেলাম । তারবার্তায় কোনাে কিছুই পাঠান গেল না কেননা কিছুই তাতে গােপন রাখা সম্ভব হতাে না। টেলিফোন স্থাপনাগুলি বাঙালিদের দখলে ছিল। তাই আমাকে ওভাবেই যেতে ও খবর দিতে হয়। আমি সেই মােতাবেক সােজা সীমান্তে গিয়ে হাজির হই সবজায়গায় সবকিছু নিয়েই। আর তারপর আমরা সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করে দিই। এটা গােপন রাখা হয়। একটা পরিকল্পনা ছিল এরকমের যে, যে সংখ্যক গেরিলা বাঙালিদের রয়েছে তা দিয়ে তারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর ওদের ঠেকাতে হলে আমার দরকার হবে তিন লাখ সৈন্যের।

কিন্তু আমার মােট সেনাশক্তি ছিল মাত্র ৪৫,০০০। এই ৪৫ হাজারের মধ্যে আবার ৩৪ হাজার ছিল নিয়মিত সৈনিক আর ১১ হাজার ছিল পুলিশ বা এ ধরনের আরও কিছু। বাহিনীর রেকর্ডে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে তার নিজ সৈন্য মােতায়েন করেছিল ৭ লাখ আর ঐ দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের মােট সরকারি সৈন্য ছিল ১০ লাখ  ভিয়েতনামে ৫০ হাজারের মতাে গেরিলার বিরুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল ১৭ লাখ সেনার এক বিশাল বাহিনী। আলজিরিয়াতে ফ্রান্স ১০ লাখ সৈন্য মােতায়েন করেছিল। আমার ৪৫ হাজার সেনা লড়েছে ৪ লাখ গেরিলার বিরুদ্ধে যা ছিল বাঙালি, রুশ ও ভারতীয়দের গালে চড়ের শামিল। তখন ভারতীয়রা… মানে রুশরা বলছিল যে, গেরিলাদের সঙ্গে রয়েছে ৫০ হাজার ভারতীয় সৈন্য। আমি যখন দায়িত্ব নিই তখনকার অবস্থা ছিল এরকম। আমাদের একটা জাহাজ ছিল কিন্তু তার কোনাে রাডার ছিল না, রাতে দূরের কিছু দেখার যন্ত্রপাতি ছিল না কিন্তু আমরা সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি প্রধান সেনাপতি জেনারেল হামিদকে অনুরােধ জানিয়েছিলাম, আমি এখন ভারত সীমান্তে রয়েছি, আমাকে ভারত প্রবেশের অনুমতি দিন। কিন্তু ওরা তাে আসলে আমার পরাজয় দেখতে চাচ্ছিল। কাজেই আমার সাফল্যের খবরে ওরা আঁতকে ওঠে।

আমি আগেই অনুমান করতে পেরেছিলাম ওরা হয়তাে আমাদের থামিয়ে দিতে পারে। আর সেজন্যই আমি কী করছি তা আমি ওদের জানাইনি। তারা প্রত্যাশিতভাবেই আমাকে অগ্রাভিযান স্থগিত করতে বলে। বলে, ভারত ভূখণ্ডের ভেতরে যাওয়া চলবে না। এর দুদিন পর জেনারেল হামিদ পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তাকে আমি বলি, আমি এখন ওদের ঠিক কলিজার কাছেই রয়েছি। ওরা পালাচ্ছে। . আমরা ওদের সাফ করছি। তাদের দিকে গুলি চালাচ্ছি। আপনি যদি এখন ভারতের দিকে এগিয়ে যাবার অনুমতি দেন, আমি বঙ্গের (পশ্চিমবঙ্গের) একটা বিশাল অঞ্চল কজা করতে পারব। আমি ব্ৰহ্মপুত্র ও নাগাল্যান্ডের এদিকে রয়েছি; সবকিছু আমাদের ঠিকঠাক রয়েছে। আপনি যদি একবার অনুমতিটা দেন, দুই ডিভিশন সৈন্য দেন কলকাতাও দখল করে নিই। আমি ভারতীয় বাহিনীকে চুরমার করে দিয়ে আসাম, বঙ্গ ও বিহারের গােটা অঞ্চলটিই পদানত করব। ভারত পরাজিত হবে। তিনি বললেন, বিলকুল ঠিক, আমি তােমাকে সাহায্য করব। কিন্তু জেনারেল এসেছিলেন পরিস্থিতি দেখতে, ভারতের সাথে খােলাখুলি যুদ্ধ করার জন্য নয়। ভারতীয়রা তাদের লেখায় স্বীকার করেছে যে, ইয়াহিয়া যদি ঠিক ঐ সময়টায় আঘাত হানতেন তার পক্ষে দেশের উভয় অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য জয় করা সম্ভব হতাে। আমি বললাম, আমি কাশ্মীরেও ঢুকে পড়তে পারতাম… শিলিগুড়ির দিকে এগােতে পারতাম। আপনি আমাকে অনুমতি দিন । তখনও ভারতীয়রা সবরকম অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হতে পারেনি। তাই সুযােগ ছিল অক্টোবর পর্যন্ত। অক্টোবরের পর আমার পক্ষে আর উল্লিখিত সাফল্য অর্জন সম্ভব ছিল না। আমার বাহিনীতে ১৮টি ভারী কামান, ৭৪টি মাঝারিপাল্লার কামান, একশ’টির মতাে অ্যাটাক গান ও ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামান ঘাটতি ছিল । গােটা পদাতিকবাহিনীতে ছিল এই অবস্থা। তবে আমার যা কিছু ছিল তা হলাে সেনাবাহিনীকে প্লাটুন থেকে নির্দেশ দেওয়া। এসব প্লাটুন আবার ১৮টি রণক্ষেত্রে লড়ছিল। ওরা ঐসব রণক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নিয়ে বসেছিল। তাই কেমন করে যুদ্ধ চালাতে হবে সেটি আমিই জানতাম। যেসব লােক আমার সমুক্ষে ছিল তারা তখনকার চ্যালেঞ্জ নেবার লােক ছিল না।

প্র: বিমানবাহিনীর অবস্থা কেমন ছিল?

উ: বিমানবাহিনীর মাত্র একটি এয়ারক্র্যাফট ছিল। তাই বিমানবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেবার মতাে সামর্থ্য ছিল না। এর আগে ছয়টি যুদ্ধবিমান ছিল। ছয়টিই খােয়া যায় । আমার হাতে কেবল স্থলবাহিনী তথা পদাতিকবাহিনীর শক্তিই অবশিষ্ট ছিল।

প্র: আমার মনে হয় আপনি যে অবস্থার কথা বলছেন তা বেশ চমক্কারই বলতে হয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের ভেতরের অবস্থা কী? আপনারা কি দরকার মতাে সৈন্য-রসদ আনতে পারছিলেন? না, সিভিল আর্মড ফোর্সের লােকদের বেশি করে ব্যবহার করেছেন?

উ: যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমরা তাদের কিছু লােককে কাজে লাগিয়েছি।

প্র: আপনারা কখন এই অসামরিক সশস্ত্রবাহিনী তথা আল-বদর, আলশামস বাহিনীতে লােক ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন? এজন্য তাে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার দরকার?

উ: আমার যদুর মনে পড়ে সেটা মে মাসের দিকে। মে মাসের দিকেই। আমি ওদের রিক্রুট করতে শুরু করি।

প্র: ওরা কি সরাসরি আপনার কম্যান্ডে ছিল?

উ: তাই। কেউ-কেউ বলে, ওরা জামায়াতে ইসলামীর অধীনে ছিল। কিন্তু আমি তা স্বীকার করি না। আল-বদর ও আল-শামস নাম হওয়ার নেপথ্যে জার্মানির এক শাসকের ধারণা রয়েছে। সেখান থেকে আমি ধারণাটি নিই।

প্র: আপনি আপনার বইয়ে বলেছেন, আপনি ওদের নেতাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন যারা…।।

উ: হ্যা, ওদের কিছু লােককে পাকড়াও করার জন্য লােকজন খোঁজাখুঁজি করছিল । ওরা ছিল অত্যন্ত পরিচিত। যেহেতু ওরা সকলের চেনা ওদের খতম করে দেওয়া হতাে

প্র: কেন? উ: কারণ, তাঁরা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন।

প্র: ওদের পরিচয় কী? উ: ওরা বাঙালি। প্র: আপনি কি ওদের সম্পর্কে…?

উ: আমি জানতাম না, আমার স্টাফের লােকেরা তাদের চিনত, তাদের সাহায্য-সমর্থন করত।

প্র: সেটা কি জামায়াতে ইসলামী রাজাকার তৈরিতে সাহায্য-সহযােগিতা করেছে বলে ?

উ: এমনকি, বাঙালিরাও আমাকে সমর্থন জানিয়েছে।

প্র: সে-তাে বটেই। কেননা, জামায়াতে ইসলামীর লােকেরাও তাে বাঙালিই বটে! 

উ: তারা জামায়াতে ইসলামীর কেউ নয়। আমি রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করি। যারা রাজনীতি করে আমি তেমন কাউকেই ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দিই । কাজেই আমি কেমন করে একাজে সাহায্য-সহযােগিতা করতে কোনাে রাজনৈতিক দলকে বলতে পারি?

প্র: রাও ফরমান আলির ভূমিকা কী ছিল? তিনি কী ছিলেন? উ: তিনি ছিলেন গভর্নরের পরামর্শদাতা। প্র: তাহলে তার কী কিছু করার ছিল না?

উ: যুদ্ধ কিংবা এসবে তার কিছুই করার ছিল না। তিনি কেবল গভর্নরের পরামর্শদাতা ছিলেন।

প্র: আপনি জানেন, আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও নিরপেক্ষ তথ্যমাধ্যমগুলি পর্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও অন্যসব ঘটনার ওপর রিপাের্ট প্রকাশ করেছে। তবে এজন্য দায়ী হবে সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষ, গভর্নরের পরামর্শদাতা নয়। এই কী?

উ: পরামর্শদাতা… আবদুল মােতালিব মালিক যখন গভর্নর হন ইয়াহিয়া খান তখন আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখাে, মালিক কোনাে আদেশ দিলে মনে করবে সে আদেশ আমার আদেশ। তাই তিনি আদেশ জারি করতেন।

প্র: আপনার বইতে তা বলেছেন।

উ: বলেছি যে, আমাদের আওতায় দেওয়া হয় সিভিল আর্মড ফোর্সকে আর গভর্নরের আওতায় থাকে পুলিশ…। আমরা পরিস্থিতির চাপজনিত কারণে ওদেরকে কোনাে কোনাে কাজে ব্যবহার করছিলাম ।

প্র: কার্যত ওরা ছিল আপনার কম্যান্ডে।

উ: কিন্তু ওদের বেতন দেওয়া হচ্ছিল সিভিল…। আমি তাে…। প্র: ওরা ছিল আপনার কম্যান্ডে দরকার মতাে আপনি তাদের কাজে লাগাতেন।

উ: কিন্তু ওদের বেতন দিত অসামরিক কর্তৃপক্ষ।

প্র: কিন্তু কাজ তাে করাতে চাইত সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষ। এমন হতে পারে তারা হয়তাে এমন সব কাজ ওদের দিয়ে করাচ্ছিলেন যা বস্তুত অসামরিক-কর্তৃপক্ষ না-ও চাইতে পারে। পুলিশ এমন কাজ করছিল যা সরকার চাননি তারা তা করুক।

উ: না, আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন টিক্কা খান ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষের এতে কিছুই করার ছিল না । সামরিক আইন টিক্কা খানের এখতিয়ার । ফরমান ছিলেন তার পরামর্শদাতা। | প্র: না, তিনি ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।

উ: আমি টিক্কা খানের অধীনে কাজ শুরু করি। তিনি ছিলেন সিএমএলএ। আমি সেপ্টেম্বরে আমার দায়িত্ব পালন শুরু করি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা করেছেন টিক্কা খান।

প্র: কিন্তু আপনি আপনার বইয়ে লিখেছেন যে, রাও ফরমান আলী অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে, নিখুঁতভাবে ২৫ মার্চে টিক্কা খানের আদেশ পালন করেন ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তিনি বলেছেন যে, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না!

উ: ওরা তা করেছে ঠিকই, কিন্তু ওদের একটা পরিকল্পনা ছিল। জেনারেল টিক্কা যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তার দায়িত্ব ছিল তিনটি : এক, তিনি ছিলেন, সামরিক আইন প্রশাসক; দুই, তিনি ছিলেন গভর্নর; তিন, তিনি ছিলেন সেনাধিনায়কও। তাই সে রাতে তিনি ও রাজা খাদেম ঐসব আদেশ জারি করেন। কাজেই টিক্কা ছিলেন সুপ্রিম কম্যান্ডার। ঢাকায়…। 

প্র: না, তিনি…

উ: টিক্কা লিখেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ-শ্যামল প্রান্তর লাল রঙে রাঙিয়ে দিতে হবে। আমার ধারণা, কাজী জাফর তাঁর এক রাজনৈতিক বক্তৃতায় এ কথার উল্লেখ করেছিলেন। তবে সে যা-ই হােক একটি ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ মাঠ লাল হয়ে যাওয়া উচিত। এটা যারই লেখা হােক, লেখাটা দেখানাে হয়েছিল ভূট্টো বা শেখ মুজিবকে, ঢাকায় দেখানাে হয়েছিল। এখন ভূট্টো বা মুজিব কেমন লােক তা তাে আপনারা জানেন। মুজিব এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি কিন্তু ভূট্টো তা ফাঁস করে দেন। তাদেরকে ঐ ডায়েরিটা তারিখসহ দেওয়া হয়। | প্র: আমরা এখন সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইছি আপনার কাছে পূর্ব পাকিস্তান ট্রাজেডির শেষের দিকটার যে বুদ্ধিজীবী নিধন ঘটে তার জন্য দায়ী। কারা? রাও ফরমান দাবি করেছেন, তিনি এসবের কোনাে কিছুতে জড়িত নন।

উ: বুদ্ধিজীবীরা আমার কাছে কোনাে তাৎপর্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার মাথাব্যথা ছিল আমার অস্ত্রধারী দুশমনদের নিয়েই। তাই বুদ্ধিজীবীরা। আমার কোনাে বিষয় নয়। তবে আলতাফ গওহর? একথা উল্লেখ করেছেন যে, কেউ একজন আমাকে জানায় যে, ফরমানের কাছে বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা রয়েছে। তিনি তার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য কেউ একজনকে পাঠান আর তার অনুরােধে রাও ফরমান ঐ তালিকা থেকে দুটি নাম কেটে বাদ দেন। আমি বিষয়টা জানতাম না। আমি এটি আলতাফ গওহরের কাছ থেকেই জেনেছি।

প্র: তাহলে, ফরমান ছিলেন এর নেপথ্যে? উ: সেটা হয়ে থাকতে পারে। প্র: হয়েছিল কি না?

উ: আলতাফ এ বিষয়ে কিছু লিখেছে, আপনারা সেটা জানেন। আমি কেন । এসব করতে যাব? কেন এমন তালিকা রাখার দরকার আমার হবে? আমি তাে। যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতার অধিকারী ছিলাম?

প্র: আমি আসলে সে কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আমি বলতে চাই এ কথাই। যে, আপনার ও বিষয়ে জানা থাকারই কথা কেননা…।

উ: আমি আপনাকে বলি, আমি বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এজন্য যে, তাদের প্রায় সকলেই ভারতের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে খুশি হতে পারেনি। তারা এজন্যে এটাকে দোষারােপ করছিল। তাদের সাহায্য-সহযােগিতা ছাড়া আমি এতগুলি লােকের (?) বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারতাম না। আমি তাে আর। ফেরেশতা নই। | প্র: আপনি এখানে বাংলাদেশে] ফিরে আসার পর আপনাকে প্রায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছে- সেটা আপনি এখন বুঝেছেন, সে অবস্থায় আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী ছিল সেটা জানতে পারি, জেনারেল নিয়াজি? আমার একথা বলার কারণ, এখানকার মানুষ তাে পাকিস্তানিই ছিল, তারাই। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছে… তারাই পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রণেতা?

উ: আমি আপনাকে একটা কথা বলি…. প্র: আপনার কি মনে এমন সন্দেহ ছিল যে, ওরা ঠিক যথার্থ পাকিস্তানি নয়? উ: আমি এখনও বিশ্বাস করি যে, তারা মুসলমান। প্র: তাহলে সেটাই আপনার ধারণা? 

উ: আমি ওটাই লক্ষ করেছি। আমি ওটা আগে থেকেই জানতাম। কেননা ওরা এখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৬৫-র যুদ্ধে লড়েছে।

প্র: কিন্তু ঐ সেনাদের মস্তিষ্ক ধােলাই তাে হয়েছিল যাদের দিয়ে তাদের ততা সবাই প্রায় ছিল হিন্দু। আপনিই…। ‘ 

উ: না, না, তা নয়। ওরা সবাই দেশপ্রেমিক। একটা কাহিনী বলি, শুনুন। | এক প্রাণবন্ত হিন্দু তরুণ ছিল। তার বাড়ি দেশের একেবারে ভেতরের দিকে | কোথাও। একদিন হলাে কি, আমার রক্ষী তাকে কী কারণে যেন এই বলে

হুমকি দেয় যে, আমি তােমাকে খুন করব। সে ছেলেটি রক্ষা পেতে আমার | শরণাপন্ন হলাে। মায় নে কাহা, কিউ, ইসকো তুম মারতে? তুম শায়েদ ইনকো। | মারতে, তাে মায় ভি তাে হাে সাকতা, তুম মুঝে মারতে? ইন লােককো তুম মারতে একেলে, তাে মারাে, মায় একেলে, মারাে। আমি আমার চায়নিজ রাইফেল তার হাতে তুলে দিয়েই কথাগুলি বললাম। বললাম, যে করছটা কী, | নিজের কাজ কর, যাও, ভাগ! আমি আপনাকে বলেছি, আমার এ ধরনের | ভাবনার কোনাে অবকাশই ছিল না। আমি ছিলাম এসব থেকে অনেক দূরের [লােক। আমি আপনাদেরকে বলেছি, জেনারেল হামিদ কিছু পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, আমি বলেছিলাম, বাঙালিরা সঙ্কটের একটা জটিল, নাজুক প্রকৃতির রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে রাজি। কেননা, ঐ সময় ফজলুল কাদের চৌধুরী আমার কাছে ঘনঘন যাওয়া-আসা করছিলেন তিনি আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন,  আমি ঐসব লােকজনের সাথে যােগাযােগ করতে চাই কি না। তারা এখন আমাদের কথা শুনতে তৈরি। তিনি আমাকে এ কথাও বলেছেন, নিয়াজি এ। নিয়ে তােমার খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই যদিও এটা আমার জন্য খুব শক্ত। ব্যাপারই বটে, বিশেষ করে, ব্যাপারটা যদি নাজুক ও জটিল প্রকৃতির হয়। শুধু দ্যাখাে একটা রফার প্রস্তাব তােমাকে দেওয়া হয় কি না। কেননা ওরা তাে আর রাজনৈতিক সমাধান চায় না। এই রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর স্বার্থের পরিপন্থী। তারা এটা চায় না। নভেম্বর অবধি রাজনৈতিক সমাধানের  একটা সম্ভাবনা ছিল হতেও পারত ভূট্টো যখন জাতিসংঘে যান তখনও রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সম্ভব ছিল। এটা সম্ভব হতে পারত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরে বাঙালিদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করলেই চলত। সেটিই হতাে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি। তাতে কোনাে আত্মসমর্পণের প্রয়ােজন। হতাে না কিছুই দরকার হতাে না। কিন্তু সেটা যে হবার নয়। আত্মসমর্পণের বিষয়ে একটি বিষয় বলার আছে। আমাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি পরাজিত হইনি। আমাকে পরাজিত করা যেত না! সেটা যদি করতেও হতাে আমি আমার অবস্থা বুঝে সেটা তাে করতে পারতাম। ওরা তাে। ওখানে বসে সময় কাটাচ্ছিল আর তাদের সিনিয়র ভূমিকা জায়েজ করছিল। ফলে তারা এখানেও হারে, পশ্চিম পাকিস্তানেও পরাজিত হয়। মালিক (গভর্নর মালিক) তার সম্পর্কে লেখেন ইয়াহিয়াকে এই মর্মে সতর্ক করে যে, জেনারেল নিয়াজি যদি এখানে আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানও হারাতে হবে। এই মালিক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক সবকিছু। সেই তিনিই একথা বলেন। এখন সেনাবাহিনী একই কথা বলে যে, এক আদেশে জানানাে হয় যে, আমাকে… সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

প্র: আমার জিজ্ঞাসা হলাে, আপনি বলেছেন যে, পূর্বপাকিস্তানের মানুষ অনেক ভালাে মুসলমান। তাহলে আপনি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব। পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন? এই। বিশ্বাসঘাতকতার অর্থ কী? পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম যদি অনেক ভালাে মুসলমানই হয়ে থাকে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা বলতে কী। বােঝাতে চেয়েছেন?

উ: পশ্চিম পাকিস্তানের কথা বলছেন? ঠিক তা নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাসঘাতক ছিল না। ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণও। এজন্যে দায়ী যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল, তারা ছিল সবকিছুর কর্ণধার… ইয়াহিয়া ও ভূট্টো… পাকিস্তানের সাধারণ নয়! পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এখনও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের লােকজনকে পছন্দ করে, ভালােবাসে। বরং নাটের গুরু হলাে ঐ সব লােভী লােক যারা তাদের ওপর শাসন চালাতে চেয়েছিল। আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে দোষ দেব না।

প্র: তিন হাজার অফিসারকে হত্যা করা হয়। তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের ধর্ষণ করা হয়। আপনার এ খবরের সূত্র কী?

উ: কারণ, এ ঘটনা ঘটেছিল।

প্র: কিন্তু এ খবর তাে খবরের কাগজে ছাপা হয়নি। আমরাও এরকম কোনাে খবর পাই নি? আপনার সূত্র কী?

উ: সূত্র হলাে সংশ্লিষ্ট অফিসার ও ধর্ষিত মহিলারা। তারাই বলেছে। প্র: কিন্তু এ-সংখ্যা আপনারা স্থির করলেন কী করে? উ: কারণ, আমরা তাে ওখানে ছিলাম।

প্র: কিন্তু আমি যদি বলি যে, ঘটনা আদৌ ঘটেনি, সে ক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন? ওটা কি কোনাে রিপাের্ট ছিল?

উ: ওটা একটা রিপাের্ট।

প্র: ওটা একটা অনুমান কেননা, এমনকি রাও ফরমান আলী ও আরও অনেকে বলেছেন যে, এটা হওয়া সম্ভব নয়।

উ: আমার সূত্র জানিয়েছে, ওরা আর ফিরে আসেনি।

প্র: কিন্তু আপনি তাে বললেন অফিসারদের স্ত্রী ও কন্যারা ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোনাে ঘটনা ঘটেনি। তাই আমি জানতে চাই, আপনি কোন সূত্রে এ খবর পেয়েছেন?

উ: সূত্র…। সূত্র আমি দেইনি। কেননা, যারা ঐ সব ঘটনায় প্রাণে বেঁচে পালিয়েছিল ও ফিরে এসেছিল তারা আমাকে বলেছে। সেসব বিবরণই আমি বইতে দিয়েছি। ওদের বর্ণনা খুবই মর্মান্তিক।

প্র: তাহলে এসব আপনার বইয়ের কথা। ওটা থেকেই তথ্যগুলি আসছে?

উ: না, আমি অবশ্য বলতে চাচ্ছি না যে আমি ভুল করতে পারি না, ভুল হতেই পারে।

প্র: তাহলে কখনও কখনও আপনার এমনও মনে হয় যে, কিছু কিছু ভুল আপনি করেছেন?

উ: হ্যা, আমি তা করেছি। এখন আপনাদের মতাে ব্যক্তিদের কেউ-নাকেউ, কোনাে কোনােভাবে কেননা আপনারা তাে জানেন, প্রতিটি হিন্দুই একজন শিবাজি; তারা যাই করুক না কেন তা অহিংস ব্যাপার নয়। ওরা আমাদেরকে নির্মূল, উৎখাত করতে চায়। আপনাদেরকে ধ্বংস করা ওদের পক্ষে কঠিন কাজ নয়। ওদের কারণেই আমরা বিচ্ছিন্ন, একাকী। আমাদের এক হতে হবে।

প্র: কবে আপনি ভারতীয়দের সাথে প্রথম যােগাযােগ করেন? উ: ১৪…। প্র: ১৪ ডিসেম্বর, ১৪-র আগে নয়?

উ: আর সেটা করা হয়েছিল আমেরিকানদের মাধ্যমে, ভারত নয়। যখন অরােরা আমাকে সতর্ক করে দেন তখনও আমার হাতে তিন থেকে চার ডিভিশন সৈন্য ছিল। আর ওরা যখন এলাে তাদের মধ্যে ছিল জ্যাকব, আর খার নামের এক কর্নেল। খারারা হলাে রিসলপুরের শিখ বংশদ্ভূত লােক। মােগল সম্রাটের আমলে তার পূর্বপুরুষ সরনাম সিং সাঙ্গা ইসলাম গ্রহণ করে হন গােলাম মােস্তাফা খা। আমার সাথে দেখা করে একথা-সেকথা আলােচনা করে। সে আমার কাছে জানতে চায় আমাদের কত… আছে। তাঁর কথার ইশারা আমি ধরতে পারলাম। আমি বললাম, তুমি তাে একজন শিখ।

তােমার তাে শিখের মতােই হওয়া উচিত, তাই নয়? আমার ৯ ব্যাটালিয়ন সেনা রয়েছে। তােমাদের ১০ হাজার সেনার সাথে আমরা কি আর লড়ব। একগুণ, দ্বিগুণ হয় তাহলে না-হয় লড়ার প্রশ্ন উঠতেও পারে। কিন্তু ১০,০০০! সেটা সম্ভব নয়। সে আমাকে জেনারেল আরােরার নির্দেশ পড়ে জানিয়ে দিল, আমাদেরকে ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে হবে।

প্র: এটা কোন সময়ের কথা?

উ: সে আসার পর, আর তখনই আমরা কোলকাতায় যাই। তখন ২০ ডিসেম্বর কিংবা ২১ ডিসেম্বর।

প্র: আপনাকে কি যুদ্ধবন্দি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়? উ: না।

প্র: কিন্তু রাও ফরমান আলী তার বইয়ে…।

উ: তিনি তা লিখে থাকতে পারেন। না, আমাকে নয়।

প্র: কিন্তু আপনার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই?

উ: ওরা তাে আমাকে নিয়ে গেল। আমি ভারতীয় অফিসারদের সংস্পর্শে গেলাম। আমাকে সেখান থেকে ভারতের আরও ভেতরে যেতে হয়। এখন আপনি ধরুন দূরে রয়েছেন সেই সুযােগে আমি কিছু বলিনি সে-রকম কিছু ফাঁস করে দিতেও পারি!

প্র: এখন একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে আপনার অনুভূতি কী, কেমন ছিল বলবেন? আপনি তাে বলেন, দিনটি ছিল হিন্দুদের কাছে আত্মসমর্পণের দিন…।

উ: ওহ! সেদিনই তাে আমার আত্মসমর্পণের দিন। আমি সেদিন চুপচাপ কাটিয়েছি। ম্যায় খামুশ থা । কেয়া করু। দেখুন, সেনাবাহিনী কার্যত একটা ঘােড়ার মতাে। ইয়াকুবের অধীনে আমাদের সেনাবাহিনীর কোনাে কিছু করার ছিল না। সেই একই সেনাবাহিনী টিক্কার অধীনে মানুষ মারতে শুরু করে দেয়। সেই একই সেনাবাহিনী পরে যুদ্ধ লড়েছে… লড়েছে কার্যত ক্লান্ত, ঘােড়ার মতাে। এর আচরণ ছিল তারই সওয়ারের মতাে। সওয়ার যদি দক্ষ না হয়। তাহলে ঘােড়া লাথি মারে। যদি সওয়ার সুদক্ষ অশ্বারােহী হয় তাহলে সে ঘােড়া ছােটে তীর-বেগে শিকারি কুকুরকে শিকারকে আমন্ত্রণ করে, পথ দেখিয়ে তাকে খাঁচায় ঢােকাতে, ওতে একরকমের অদ্ভুত মজা আছে। একই কথা বলা যায়, শাহীন বা শিকারি বাজপাখির বেলায়। একই কথা সেনাবাহিনীর বেলাতেও। শিকারির জানা উচিত কখন সে বাজকে তার মুঠো থেকে মুক্ত করে দেবে। কখন সে শিকারি কুকুরকে ছেড়ে দেবে শিকারের পেছনে…।

প্র: আমরা যে সময়ের কথা আলােচনা করছি, অর্থাৎ আমি বলতে

চাই এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কত লােক প্রাণ হারিয়েছে বলে আপনি। মনে করেন?

উ: আমাদের পক্ষে আনুমানিক ৩০ হাজার, হিন্দুরা অনেকে পালিয়েছে, মারা গেছে, আর মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি।

প্র: আর অসামরিক লােকজনের ব্যাপারে কি বলবেন আপনি?

উ: টিক্কা খান যে রাতে অ্যাকশনের আদেশ দেন তখন ৫০ হাজার লােক। নিহত হয়।

প্র: আর পরের বাকি সময়ে? উ: তেমন বেশি নয়।

প্র: আমি জানতে চাই এ জন্য একটা অফিসিয়াল হিসাবে তাে থাকতে। পারে! রেকর্ড নিশ্চয়ই! আপনাদের কি এ ধরনের কোনাে সরকারি রেকর্ড ছিল?

উ: আমরা সেকথা উল্লেখ করেছি। আমরা ওটা সংগ্রহ করেছিলাম। আমরা একটা সিচুয়েশান রিপাের্ট তৈরি করতাম। তাতে হতাহতের সংখ্যা। ইত্যাদি তথ্য থাকত।

 প্র: ওটা তাে আপনারা করতেন যুদ্ধ চলাকালে। ঘােষণা করা হয় । ডিসেম্বর রাতে।

উ: ২১ নভেম্বর। ভারত এইদিন আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। আমাদের ১৩ হাজার সৈন্য ছিল।

প্র: তারা তাে পুরােপুরি আধিপত্যমূলক অবস্থাতেই ছিল। ওদের সাথে । কোনাে সামনাসামনি লড়াইয়ের প্রশ্নই তাে ছিল না।

উ: এখানে মুক্তিবাহিনীর লােকজনের হতাহতের সংখ্যা দেওয়া হয়েছে। ৩০ হাজার। |

প্র: কিন্তু আমি তাে অসামরিক লােকজনের কথা বলছি।

উ: আমাদের কাছে সে হিসেব নেই। আমরা তাে সিভিলিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করিনি।

প্র: আপনি কি জানেন, রাজাকাররা… আল-বদর, আল-শামস ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছিল?

উ: না। আমার ৩৮ হাজারের মতাে সৈন্য ছিল। ওরা অকাতরে মারা পড়ছিল। তাই আমাকে মৃত সৈনিকের স্থান পূরণ করতে হতাে। আমি এসব আল-বদর ও আল-শামসদের বিভিন্ন সেনা ডিভিশনে নিয়ােগ করতাম। সেনা ডিভিশনগুলি তাদের কাজে লাগাত, সেটি অন্য কথা। এসব আল-বদর ও আল-শামস অনেকে দলছুট হয়ে পালিয়ে গিয়ে এটা- সেটা তখন করেছে।

তাদেরকে একটা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ােগ করা হয়। তাদেরকে ব্যবহারও করা হয় সেভাবেই। এখন যদি ওরা বাড়াবাড়ি কিছু করে থাকে সেটা নিশ্চয় করে বলার জন্য সময় লাগবে। তাছাড়া ওদের হাতে তাে অস্ত্রও দেওয়া হয়েছিল।  আমি আগে যেরকমটা বলেছি, ইয়াকুব যদি কাজটা ঠিকঠাক করতেন, টিক্কা আসতেন না। নিয়ন্ত্রণ করতেন কিছুই ঘটত না। সামরিক অ্যাকশানের দরকার হতাে না। আমি সেখানে যেতাম না। যা কিছু করা হয়েছে ওখানে কোনােকিছুই করার দরকার হতাে না। মুজিবকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হতাে যে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল- সে ক্ষেত্রে এতসব ঘটনা ঘটত না। তিনি নির্বাচনে জিতেছিলেন তাকে ক্ষমতা না দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। ভূট্টো সে ক্ষমতা দিতে দেননি যা একজনের প্রাপ্য ছিল। 

প্র: আপনি আপনার বই উৎসর্গ করেছেন রাজাকারদের উদ্দেশে, আপনার সৈনিকদেরকে নয়, কেন?

উ: আমাদের একটা কর্তব্য ছিল আর ওরা এসেছিল স্বেচ্ছায় ।

মেজর জেনারেল হাকিম আরশাদ কোরেশী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন লে. কর্নেল। যুদ্ধের আগ থেকে শেষ পর্যন্ত পুরােটা সময় ছিলেন বাংলাদেশে। যুদ্ধবন্দী হিসেবে দেশে ফেরেন। চাকরি ফিরে পান এবং মেজর জেনারেল পদেও উন্নিত হন। | হাকিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন ১৯৫৪ সালে । ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় বদলি হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুর, রংপুর ও দিনাজপুরে একটি পদাতিক বাহিনীর (২৬ এফএফ) দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তাকে পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিয়ােগ করা হয়। সে পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৫ সালে।

অবসর গ্রহণের পর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেন। কারণ, সৈনিক জীবনে এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। ইংরেজিতে লেখা তার বইটির নাম দি ১৯৭১ ইন্দো-পাক ওয়ার। এ সােলজার্স ন্যারেটিভ। ২০০২ সালে করাচির অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। বইটি প্রকাশ করে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় এর দ্বিতীয় সংস্করণ। এতে অনুমিত হয়, পাকিস্তানে বইটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।  হাকিম আরশাদ বইটি কেন লিখেছেন? তার মতে, ২৬ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ১৯৭১ নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি।

বাস্তবতা এড়িয়ে সবাই এমনভাবে ঘটনা সাজাচ্ছে এবং ব্যাখ্যা দিচ্ছে যাতে উপসংহারটি নিজের মনমতাে হয়। ১৯৭১ সালে তিনি দেখেছেন, কী ঘটেছে, তাই তিনি সে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে চান তরুণ ও মাঝারি ব্যাংকের অফিসারদের জন্য যাতে পরিষ্কার হয়।

“The strengths and weaknesses of the planning and execution of operations in East Pakistan.’

বইয়ে অধ্যায়ের ২৫টি, মােট পৃষ্ঠা ৩২৫।

পাকিস্তানের জেনারেলরা যখন স্মৃতিকথা লেখেন, তখন সবাই স্বাভাবিকভাবেই তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে যুক্তিগুলি সাজান। তাদের বর্ণনায় তফাৎ আছে কিন্তু ব্যতিক্রমী কেউ নন, কারণ, তাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক।

প্রথমেই দেখা যাক বইয়ের শিরােনাম। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ডিসেম্বরে ১৯৭১ সালের আগে রংপুর ও দিনাজপুরে কোথায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হলাে? দ্বিতীয়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কয়েকদিনের মধ্যেই রংপুর ও দিনাজপুরের পতন ঘটে। সে কয়দিন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে। আরাে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ভারত-বাংলাদেশ, যৌথ বা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে লড়াই হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ােজিতরা বলতে পারে তারা ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যারা ছিলেন তাদের সে কথা বলার সুযােগ নেই। কিন্তু এই সত্যটি পাকিস্তানি জেনারেলরা কখনও স্বীকার করতে চাননি।

এরপর উৎসর্গটি দেখা যাক। সেখানেও পূর্বধারণা জোরদার। হাকিম বাগাড়ম্বর করে দশ লাইনের উৎসর্গ লিখেছেন :

“To/

the martyrs/ of the 1971 upheaval in East Pakistan,/who fearlssy committed themselves to the task/of preserving national integrity and unheistatingly laid down their lives/with the hope/that we may live with honour/and dignity as a free and progressive people.

জেনারেল নিয়াজি এত ভণিতা না করে এককথায় উৎসর্গ সেরেছিলেন। রাজাকারদের হাকিমও রাজাকারদেরই উৎসর্গ করেছেন। এটিই স্বাভাবিক। শিরেনাম আর উৎসর্গ দেখেই আমরা মােটামুটি ধারণা করে নিতে পারি তিনি 

কী লিখবেন। উৎসর্গে উল্লিখিত ‘আপহিল’ শব্দটি বিষয়টিকে আরাে স্পষ্ট করে তােলে।

হাকিমের বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরােনাম… “টোটাল রিকল’। ১৯৮৫ সালে তিনি ছিলেন সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর মহা পরিচালক। পাক ভারত সীমান্ত পরিদর্শন করতে গিয়ে তার মনে পড়েছে ১৯৭১ সালের কথা। যুদ্ধবন্দী হিসেবে মাথা নিচু করে এই পথ দিয়েই এসেছিলেন। আজ সেই সীমান্তেই যাচ্ছেন মাথা উঁচু করে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণ । প্রসঙ্গত বলে রাখি, হাকিম অনেক অধ্যায়েই কতগুলি প্রশ্ন তুলেছেন এবং দার্শনিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এই পুরাে প্রচেষ্টার কারণ, যাতে বইটিতে একটি নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ ভাব জাগে এবং তিনি যে নির্মোহভাবে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন তা প্রমাণিত হয়। এই কৌশল সত্ত্বেও কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে তার পূর্ব ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওয়াগা সীমান্ত চৌকি আঁকজমকভাবে সাজানাে হয়েছে। এত শক্রতার পর এটি একটি ঐতিহ্য। সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর প্রধান তিনি যে দেশেরই হােন কেন, সীমান্ত চৌকি পরিদর্শনে এলে, চৌকি সাজান হয়, দুদিকের রক্ষীদেরই তিনি পরিদর্শন করেন, নগদ টাকা ও অন্যান্য উপহার দেন। পাকিস্তানি রক্ষীদের পরিদর্শন করে হাকিমের ভাষায়, ‘আমি গেলাম ভারতীয় দিকে। আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তারা বিশেষ প্রচেষ্টা নিয়েছিল। এবং তারা ভালােই বলতে হবে তবে পাকিস্তানি রেঞ্জারদের মতাে নয়।’ তিনি ইংরেজিতে। awe-inspiring’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন যার বাংলা প্রতিশব্দ আমি পাইনি। তার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম যে, ভারতীয় রক্ষীরা চৌকশ হতে পারে তবে পাকিস্তানিদের মতাে চৌকশ হবে না। এই ধারণাটা পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে গেথে দেয়া হয়েছিল। এর ব্যতিক্রম তাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তার মনে পড়ল, ১৯৭১ সালে ভারতীয় বিজয়ীদের (কংকারারস’ শব্দটি উর্ধ্বকমার মধ্যে, এটি করে তিনি খানিকটা ব্যঙ্গের ভাব আনতে চেয়েছেন) কাছে যে ৯০,০০০ (৪৫,০০০ সেনা) যুদ্ধবন্দী: আত্মসমর্পণ করেছিল হাকিম ছিলেন তার একটি অংশ এবং এ পথ দিয়েই তারা এসেছিলেন। তারা যারা শহীদ হওয়ার থেকে আত্মসমর্পণ শ্রেয় মনে করেছিলেন এবং অর্ধেক অংশ

ছেড়ে এসেছেন। তখন তাদের বীরের মতাে বরণ করা হয়েছিল যা ছিল অস্বস্তি কর ও বিষাদময়। পাকিস্তানির বিপদটা তার লেখায় বেশ স্পষ্ট

“Now, after having given up half of the country and having preferred surrender to martyrdom, there we were being recieved like heroes, with bands playing stirring patriotic tunes.” (4.0)

তার মনে পড়ল, ১৯৭০ সালে তিনি প্রমােশন পাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্ত নের সৈয়দপুরে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ২৬তম ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয় ৩০ আগস্ট পা রাখলেন ঢাকায়। তার বন্ধু তাকে সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা দিলেন। সমস্ত সেনা সদস্যদের ভ্রমণের সময় সশস্ত্র রক্ষী রাখতে হতাে। পুরাে আবহাওয়া সন্দেহের বিষ বাষ্পে ভরা । সমস্ত অবাঙালিরাই ছিল অপছন্দের পাত্র।

| ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই দেখা যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সতর্ক ছিল। অর্থাৎ ১৯৭১ হতে পারে এই ধারণাটা ছিল। এবং সে কারণেই তাদের ঐ পরিস্থিতি মােকাবেলার একটি পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। হাকিম কিন্তু তার লেখার বাবরার একথাই বলতে চেয়েছেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা ছিল না এবং তারা ছিলেন অসতর্ক। কিন্তু, তার বিবরণ থেকেই বােঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন।

পরের বর্ণনাটিও আমাদের যুক্তিকে সমর্থন করে। হাকিম লিখেছেন। পরদিন রক্ষী ছাড়াই তিনি রওয়ানা হলেন রংপুরের দিকে, ট্রেনে। চারদিকে জনসমুদ্র, অর্ধনগ্ন, দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট, অবস্থা করুণা উদ্রেককারি । তাদের কাছে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি কোনাে অর্থ বহন করেনি। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এরকম মানুষদের নিয়েই কবিতা লিখেছিলেন, যারা আক্রোশে সব ছিড়ে খুঁড়ে ফেলতে চায় যাতে প্রভুরা বুঝতে পারে কী তাদের অবস্থা।

“হঠাৎ ঘাবড়ে গেলাম, শরীর কেঁপে উঠল।”

[“Every where was a vast sea of humanity, half dressed, oblivious to the surroundings. Their poverty was visible their condition pitiable. Apparently, for them, freedom from British rule had been a hallucination,

without any benefits. I was reminded of a poem”If only they would revolt And teach arrogant man a lessonTear his fancy clothes, Bury their fangs in his boncs. If only someone Would make them see their terrible degradation I trembled all over, suddenly apprehensive.” 1পৃ ৩-৪

ট্রেনে তার সঙ্গে আলাপ হয় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে। হাকিমের মনে হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয়রা সবসময় | নিজেদের করুণ অবস্থার জন্য দায়ী করেছে বিদেশীদের। এখন পশ্চিম পাকিস্তান ভিলেনের জায়গায়। “আমরা ঘৃণার পাত্র।” এই দুটি অনুচ্ছেদ তিনি এমনভাবে লিখেছেন যাতে সত্যটা ঢাকা পড়ে যায়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর যদি পূর্ব পাকিস্তানের এই অবস্থা হয়। তাহলে তাে কেন্দ্রের [পশ্চিম পাকিস্তান সরকারই দায়ি। কিন্তু সেটি মেনে নেয়া পাকিস্তানিদের জন্যও ছিল কষ্টকর।  রংপুরে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভসনার সুরে | বললেন, রক্ষী ছাড়া ভ্রমণ করে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করেছেন। হাকিমের কাছে তখন মনে হয়েছে রক্ষী, পরিখা, দুর্গসদৃশ্য প্রতিরক্ষা এসব কিছু ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে আশেপাশের মূলধারার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শাসক, প্রশাসক বা মিলিটারি কমান্ডারের মনের অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে তার ফল হবে অতিরিক্ত ব্যবস্থা বা প্যানিক যা অন্তিমে ডেকে আনে বিপর্যয়। এ মন্তব্যে সত্যতা আছে। অবশ্য, তিনি এ মন্তব্য করেছেন পরবর্তী সময়ের গণহত্যার যৌক্তিকতা প্রদান করতে। অর্থাৎ গণহত্যাটি হয়েছে টেনশন বা প্যানিকের কারণে। এরপর নিজ মনেই সেসব দার্শনিক প্রশ্ন তুলেছেন কয়েক বছরের মধ্যে এরকম ‘incomprehensible change’ হলাে কীভাবে? এটি কি শাসক এলিট যারা প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানি তাদের দাম্ভিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে? এর কারণ | কি এই যে বাঙালিদের ধারণা জন্মেছে তাদের সবাইকে ‘flunkies’ হিসেবে ভাবা হচ্ছে? অথবা হতে পারে, এই অনুভব এসেছে যে স্বাধীনতা তাদের জন্য কিছুই বদল করেনি। তারা অনুভব করছে তারা এখনও ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন-শুধু প্রভু বদলেছে। হাকিম সত্যটা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু রেটরিক আকারে প্রশ্নগুলি | তুলেছেন। যাতে অনেক প্রশ্নের ভিড়ে সত্যটা অত চোখে না পড়ে।  হাকিম সৈয়দপুরে তার কমান্ড বুঝে নিলেন। এরপর তিন মাস, তার মতে ছিল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। নিজের সৈন্যদের বুঝে নেয়ার জন্য মাঠে এ ধরনের প্রস্তুতিই ভালাে। তার মতে, ভেতরে যে জ্বলন্ত লাভার উদগীরণ হচ্ছে তা।

তখনও তারা বােঝেননি। প্রাদেশিকতার বীজাণু। যে সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে তাও অনুধাবন করেননি। তার ভাষায় :

‘had been unable to the extant to which the virus of provincialism, parochialism and ethnicity had permeated society. পৃ ৮.]

আসন্ন বিদ্রোহ ছিন্নভিন্ন করে দেবে দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং চ্যালেঞ্জ করা হবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব তাও তাদের মনে হয়নি। এর প্রমাণ স্বরূপ বলেছেন, বাঙালি অফিসাররাও তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরের ফুটপাতে গেরিলা যুদ্ধের ওপর লেখা চে গুয়েভারার বইয়ের অনুবাদ বিক্রি হচ্ছিল যেখানে বােমা প্রস্তুত থেকে কীভাবে ব্রিজ ধ্বংস করতে হয় তার সব সচিত্র বিবরণ ছিল কিন্তু গােয়েন্দা সংস্থার নজরে তা পড়েনি। তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন- এ হলাে সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা। সব শেষে বলেছেন, আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পাবে তা তারা আশা করেননি।

দুটি বিষয় চলে আসে এখানে। তারা যে যুদ্ধের মহড়া বা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তা কি রুটিন বা স্বতস্ফুর্ত নাকি পরিকল্পিত? কারণ, সাহেবজাদা ইয়াকুব যিনি ছিলেন সেনাপ্রধান তিনি এ সব প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করছিলেন। এর অর্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের একটি পরিকল্পনা ছক ছিল যে, যদি বিদ্রোহ হয় এবং ভারত জড়িয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? হাকিমের মতাে নিম্নপদস্থ কর্মচারির তা জানার কথা ছিল না। বাঙালি অফিসারদের সরিয়ে না নেয়ার কারণ, তাহলাে এ পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়ে যেত। তবে, ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তা কেউ অনুধাবন করেনি। হাকিমের শেষ মন্তব্যটিই সত্য। কেউ ভাবেনি আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।

| এরিমধ্যে হাকিম তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এলেন। বিপদ যে আসবে তা তারা জানতেন না। সে কারণেই পরিবার নিয়ে এসেছিলেন। এরপর তিনি অবাঙালি বহু বিহারিদের কথা উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন তিনি, ‘গণ্ডগােলের পুরােটা সময় তারা ছিল আমাদের সহায় এবং অন্তিম বিশ্লেষণে দেখা যায় সংঘর্ষে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

“a part from our national pride, professional prestige, and ideological moorings.” পৃ ৯.]

তার মতে, ইয়াহিয়া ঘােষিত এলএফও অনুযায়ী মুক্তির যে সব কথা বলছিলেন তা তিনি বলতে পারেন না। কিন্তু, মুজিব এলএফও উপেক্ষা করেছেন কিন্তু কেউ কোনাে আপত্তি তােলেনি। নির্বাচনী প্রচারে মুজিব পাঞ্জাবিদের দ্বারা ‘এক্সপ্লয়েটেশনের কথা বলেছেন যা ছিল বিকৃত। এসব

মন্তব্য পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিল। ১৯ নভেম্বরের ঝড়ের কথা বলেছেন, সেনাবাহিনী যথাসাহায্য ত্রাণে সাহায্য করেছে, শেখ মুজিব নিজেও তা ‘প্রাইভেটলি’ স্বীকার করেছেন। তবে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনাে কর্মকর্তা। বা রাজনীতিবিদ আসেনি। ফলে, মুজিবের সমর্থকরা ও প্রিন্ট মিডিয়া তা ব্যবহার করেছে, নিঃস্ব মানুষের কষ্ট পুঁজি করে। তার ভাষাটা এরকম

‘Who made full capital out of the misery of the people whose cause they were professedly champoining.” 

হাকিমের একবারও মনে হয়নি এই মহাদুর্যোগে কেন্দ্র থেকে কেউ আসা চরম অবহেলা এবং মানুষ তাতে বিক্ষুব্ধ হবেই।

এর পরের যে অভিযােগ করেছেন তা মারাত্মক। ঐ ঘটনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। সেনাবাহিনীর জিপ দেখলেই মানুষ গালাগালি করত। বাঙালি শভেনিস্টরা মারাত্মক সব অস্ত্র নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘােরাফেরা শুরু করল এবং সবাইকে শাসাতে লাগল এ বলে যে, আওয়ামী লীগকে ভােট না দিলে ফলাফল খারাপ হবে। এ পরিস্থিতিতে বড় পরিবারসহ একজন বাঙালি কী করতে পারে? খানিকটা ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে লিখেছেন- “How could a poor hapless Bengali with a large family and limited means go against such ‘sound advice’?” [পৃ. ১০] আমাদের এবং আমাদের আগের জেনারেশনের যারা বেঁচে আছেন তাদের কি এমন কোনাে ঘটনা কি মনে পড়ে? এভাবেই জেনারেলরা আধা-সত্য আধা-মিথ্যার মিশ্রণে বা যা শুনেছিলেন গুজব হিসেবে বা পূর্ব ধারণা থেকে তাদের বয়ান দিতে থাকেন। পরের অধ্যায় নির্বাচন এবং তারপর’। এ অধ্যায়ে তিনি এমন সব বিবরণ ও বক্তব্য দিয়েছেন যা আমাদের ইতিহাসে কখনও উল্লিখিত হয়নি। আগের অধ্যায়ের মতােই কিছু দার্শনিক প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তর দিয়েছেন। কিছু কিছু শব্দ উর্ধ্ব কমার মধ্যে রেখেছেন।  হাকিম লিখেছেন, হাই কমান্ড তাদের নির্দেশ দিয়েছিল, নির্বাচন যাতে মােটামুটি স্বচ্ছ হয় তা নিশ্চিত করতে, তবে, ভােট কেন্দ্রের কাছাকাছি না। যাওয়ার নির্দেশ ছিল যদি না নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠায়। এ নির্দেশ দেয়ার কারণ, তার মতে, কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল বাঙালি সিভিল সার্ভেন্টরা নিরপেক্ষ ও যথাযথভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে। এবার তার উত্থাপিত প্রশ্নগুলি বিবেচনা করা যাক

১. কীভাবে আওয়ামী লীগ এমন ‘টোটাল ভিক্টরি ম্যানেজ করল?

২. একটি মুক্ত নির্বাচনে একটি দলের পক্ষে এমন আধিপত্য বিস্তার কি সম্ভব?

৩. যে সমাজ ভেতরে বিভক্ত, যেখানে বিরােধী দলের নেতা হিসেবে আছেন মওলানা ভাসানী, সেখানে এক রাতের মধ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় কীভাবে?

৪.  হঠাৎ করেই কি মানুষ স্বেচ্ছায় ‘প্যারােকিয়াল ফিলিং’ বা ‘ন্যারাে সেলফ

ইন্টারেস্ট’ থেকে মুক্ত হতে পারে?

৫. নাকি এটি করা হয়েছিল শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে?

৬, এ নাটকে পৃষ্ঠপােষকতা ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বাঙালি প্রশাসকরা কী ভূমিকা পালন করেছিল? নিজেই লিখেছেন, উত্তর সবার জানা। সে উত্তরগুলি কী?

১. প্রাদেশিক সরকার মওলানা ভাসানীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল তার

১,৪০০ সক্রিয় কর্মীকে গ্রেফতার করে। এর অর্থ মােনেম খান আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের পক্ষে ছিলেন।

২. সরকার মুসলিম লীগের পার্টি ফান্ড বাজেয়াপ্ত করায় মুসলিম লীগ বিপদে পড়ে যায়। এর অর্থ মােনেম খান বা সবুর খান নিজেদের অর্থ নিজেরাই বাজেয়াপ্ত

করেছিলেন।

৩. আওয়ামী লীগের শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে জামায়েত ইসলামী ও অন্যান্য

দলকে নতজানু হতে বাধ্য করেছিল। সম্পর্কিত রিপাের্ট তখনও পত্রিকায়, এমন কী জামায়াতের মুখপাত্রেও প্রকাশিত হয়নি। এমনকী পাকিস্তানের দালাল ও ঘাতক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারি জামায়েত নেতৃবৃন্দ পরবর্তীকালে তা বলেনি।

৪.  সিভিল প্রশাসক ও আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থীদের যােগসাজশে এরকম কমপ্লিট ভিক্টরি’ সম্ভব হয়েছে।

হাকিমের তকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ও পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্ট ভূট্টোও (যার সঙ্গে নিজের ছবি মলাটে ছেপেছেন] এধরনের অভিযােগ করেননি। না, এখানেও শেষ নয়, তিনি শুনেছেন, এখনও বাংলাদেশে লীগ কর্মীরা স্কুল শিক্ষকদের দলে টানে যারা পরবর্তীকালে নির্বাচনী ডিউটিতে থাকে লীগের পক্ষে ভােট কারচুপি করার জন্য।

এরকম কল্পনাশক্তি পাকিস্তানি জেনারেলদের ছাড়া আর কারাে পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তার আফসােস, “আমরা কায়েমী স্বার্থের হাতে পুতুল ছিলাম” এবং “আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলাম।দায়িত্বটা কি ছিল আওয়ামী লীগ যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তা নিশ্চিত করা? বাঙালি প্রশাসকরা কীভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল তার কারণ হাকিম বয়ান করেছেন। শুনুন তাহলে সে বয়ান। ভারত বুঝেছিল, দেশ বিভাগের সময় নির্বিচারে মুসলমান হত্যা, তাদের সম্পত্তি ধ্বংস সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, ১৯০৫ সালের তিক্ত স্মৃতির ‘রিভাইভাল’ এই সম্পর্ক আরাে জটিল করে তুলেছিল। ১৯১১ সালে। হিন্দুদের কারণে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এরপর তার ভাষায় ‘This big gap had to be bridged before Muslim Bengal could be brought to a common platform of language, heritage, and culture with the Hindu minority. They initiated measures for the credation of such a platform: ‘conversion through conviction, ‘friendly persuasion’, or coercion of young leadership amongst student bodies and the working classes, using a ‘lethal’ combination of wine, women and money, was started straight away.” [পৃ. ১৩] বাঙালি প্রশাসকদের জাতীয়তাবাদী হওয়ার এই হলাে ইতিহাস। আমরা জানি, ‘সিএসপি’রা ছিল একটি শ্রেণী। তাদের কারাে কারাে সহানুভূতি ছিল বাঙালিদের প্রতি, কেননা তারাও বঞ্চিত হতেন বিভিন্নভাবে। কিন্তু, তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বপ্ন দেখেছিলেন এটি ভাবা ভুল হবে। শফিউল আজমের মতাে সিএসপি বাঙালিদের মধ্যে কম ছিলেন না। ৭ই মার্চের ভাষণের পর সব অচল হয়ে গেলে সিএসপিরা আনুগত্য দেখিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি । লক্ষ্য করুন, ১৯৪৭ সালে খালি নির্বিচারে মুসলমান হত্যা ও তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে কী পরিমাণ হিন্দু নিহত হয়েছে, দেশ ত্যাগ করেছে তার হিসাব হাকিম দিতে কুণ্ঠিত কেন? ১৯৪৭ সালের পর ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা কেন মনে হবে, সেটা বােঝা গেল না। আর এটি ভুল ধারণা যে, বঙ্গভঙ্গ শুধু মুসলমানরাই চায় নি, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাও চেয়েছিল। আমার গবেষণা তাই প্রমাণ করে। আর ভারতীয়রা মদ, মেয়েমানুষ আর টাকা দিয়ে সবাইকে এখানে বশীভূত করেছে এ ফ্যান্টাসির উত্তর কী হবে আমার  জানা নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমি সম্পর্কেও তার বক্তব্য আছে। এখানে যদিও ভাষা আন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কিন্তু পটভূমি খুব একটা। বিকৃত করেননি। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘােষণা, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অবাঙালিদের আধিপত্য এবং তাদের ঔদ্ধত্য। হাকিম জানাচ্ছেন, এরপর সারা দেশে শহীদ মিনার স্থাপিত হ.. এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্থায়ী ঘৃণার প্রতীকে পরিণত হয়। ডিসিডেন্টদের সমাবেশের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই প্রতীক। ফুলবাড়ির কাছে জনতা একবার এক গরু চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। দৃশ্যটি অবলােকন করে তিনি শিউরে উঠেছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল বঞ্চনার লজ্জাজনক প্রদর্শনী [It was a shameful display of depravity, পৃ ১৪ তারপর টিক্কা খানের ক্ষমতা গ্রহণ পর্যন্ত বর্ণনা আছে। কিন্তু এ সময়টুকুর মধ্যে হাকিম উল্লেখ করেছেন, প্রতিদিন একজন দুজন করে সৈনিক মারা যাচ্ছিল (The murder of army personnel, caught in ones and twos, became an everyday occurrence, পৃ. ১৬] সমসাময়িক পত্র-পত্রিকার বিবরণ অন্যরকম। এই সময় বিক্ষোভ চলছিল নিয়মিত, শুরু হয়েছিল অসহযােগ আন্দোলন এবং নিয়ত সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছিল।

হাকিমের মূল বক্তব্য, চতুর্দিকে সেনা বা সরকার মাটি হারাচ্ছিল। তাদের সম্মান ভুলুণ্ঠিত হচ্ছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এসব দেখেশুনে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা পরিবার পরিজন দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। স্থানীয় পত্রিকা এটি জেনে এমনভাবে সংবাদ ছাপতে লাগল যাতে মনে হলাে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা ত্যাগ করছে। তখন সদর দপ্তর থেকে। এ ধরনের ‘evacuation নিষেধ করা হলাে। ফলশ্রুতিতে, এদের অনেকে লাঞ্ছিত, ধর্ষিত এবং নিহত হয়েছে। বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার অর্ডার দেয়ার পর অনেক জায়গায় প্রতিরােধ হয়েছে। নিহতও হয়েছে কিন্তু ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়নি। ঐ সময় কারাে ধর্ষণের সময় ছিল না কারণ প্রাণ ছিল তখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। হাকিম লিখেছেন, চারদিকে ভয়ংকর সব গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল ফলে অবাঙালিরা [সেনাসহ| সন্ত্রস্ত ও উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। শেখ মুজিব ৭ মার্চ বক্তৃতা করলেন। হাকিম ভুল করে লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছিলেন পল্টনে। তার ত, তখনই সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী অংশ [লক্ষ্য করুন শব্দটি] ও ভারতীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ইতিহাস হয়তাে অন্যভাবে লেখা হতাে। তার ভাষায়, “The course of history might have been changed if worth while action against chauvinistic, hellicose, and rebellion sections of the Awami League and the Indian

agents had been promptly initiated across the board.” [পৃ. ১৮-১৯]

কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা করেননি। পরে কী হলাে? বাঙালি যারা সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তারা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সমর্থকদের খবরাখবর পৌছে দিতে লাগলেন। জানা গেছে, মেজর খালেদ মােশাররফ, একটি ‘হাইলি সেনসিটিভি’ খবর পৌছে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের কাছে, খবরটি ছিল সৈন্যদের বলা হয়েছিল কাফ্ট চলাকালীন সময়, কার্ফ ভঙ্গকারিরা যদি আক্রমণ না করে তাহলাে গুলি না চালাতে। ফলে, সবখানে কার্টু ভঙ্গ হতে লাগল । পাকিস্তানি সৈন্যদের ঐ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কিনা জানি না। সে সময় চাকরিরত বাঙালি অফিসাররা তা বলতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখেছি। আন্দোলনরত মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে শ্লোগান দিয়ে, মিছিল করে কার্টু ভঙ্গ করেছে কারণ তা ছিল আন্দোলনের অংশ। কিন্তু, শ্লোগান ওঠা মাত্রই সেনাবাহিনী নিয়মিত গুলি চালিয়েছে। ৭ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত এ ধরনের গুলিতে নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। | ২৫ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিল ১২০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি, বাঙালি ছিল ৬০০০ যার অধিকাংশ ছিল ইবিআরএ। তবে ইপিআরের সংখ্যা ছিল। ১৫০০০ যার অধিকাংশ ছিল বাঙালি। পুলিশে কিছু বিহারি ছিল, আর ছিল। স্থানীয় আনসার ও মুজাহিদ। সরকার অবাঙালিদের বিরুদ্ধে এই  ‘ ভারসাম্যহীনতার বদল করার জন্য পুরানাে ইউনিট বদলির অজুহাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লােক আনা শুরু করল। কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি, পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের খবরাখবর ছাপা হওয়ার কারণে। এই ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল মার্চ, ১৯৭১ সালে। কিন্তু এর আগে ১৯৭০ সালে তিনটি সম্পূর্ণ বাঙালি ইউনিট তৈরির আদেশ দেয়া হয়েছিল। তার মন্তব্য “What a profound understanding we had of coming events.” [পৃ. ২০] হাকিমের মূল বক্তব্যই হচ্ছে তারা বা পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের মতলব বুঝতে পারেনি। কিন্তু উপরােল্লিখিত বক্তব্যে তার মূল থিসিস নস্যাৎ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা আনার কারণই ছিল নিষ্ঠুরভাবে গণহত্যা চালিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের দমন করা। হাকিমের মতাে জুনিয়র অফিসার তা না জানতে পারেন কিন্তু সদর দফতর তা জানত এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নিশ্চয় ২৫ মার্চ রাতেই পরুকুল্পিত হয়নি।

এরপর তিনি যে সব দার্শনিক প্রশ্ন তােলেন সেগুলি তুলেছেন এবং প্রচ্ছদে ভূট্টোর ছবি দেয়ার পরও স্বীকার করেছেন, ভূট্টো পরবর্তীকালের ঘটনাসমূহের জন্য দায়ী। হাকিমের সমস্যা হচ্ছে, ১৯৭১ কেন হয়েছিল তা তিনি জানেন, কেন তাদের বিতাড়িত হতে হয়েছিল এ ভূখণ্ড থেকে তা তার অজানা নয়। কিন্তু সেগুলি বিকৃত করতে গেলে তা বাঙালিদের পক্ষেই যায় যেটি মেনে নেয়া কষ্টকর। এ ছাড়া আছে পূর্ব ধারণা। ফলে দেখা যায় কখনও যৌক্তিক কথা বলে পরের অনুচ্ছেদে এমন সব পূর্ব ধারণাকৃত মন্তব্য করেছেন যে, পুরাে বিষয়টাই গােলমেলে হয়ে যায়।

চতুর্থ অধ্যায় ‘গ্রাউন্ড রিয়ালিটিজে’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, তিনি লিখেছেন, পরিস্থিতি বিস্ফোরণমূলক হয়ে উঠছে। “The behaviour of the leadership had ignited the fuse.”

মনে হবে তিনি ইয়াহিয়া খানের কথা বলছেন যেটি যৌক্তিক। কিন্তু পরের লাইনেই বােঝা যায় তিনি আওয়ামী লীগের কথা বলছেন। নিজেকেই কিছু প্রশ্ন করছেন

এরকম ফিরে না যাওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে কেন? সীমান্তের ওপারে আমাদের বন্ধুদের সৃষ্ট কিছু কৃষ্ণ চরিত্রের (ব্ল্যাকগার্ডস), কৌশলই কি এর জন্য দায়ী? বিশাল ষড়যন্ত্রের যার সামান্য অংশ মাত্র ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র তা আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি দেখেই কি এটি হলাে?

কেন আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ‘হােমােজেনিটি’ হারালাম? | এর উত্তর যখন দিচ্ছেন তখন বিহারি ও পশ্চিমাদের ঔদ্ধত্যের, কেন্দ্রের অবহেলার কথা বলছেন, বাঙালিরাই যে পাকিস্তান আন্দোলনের পুরাে ভাগে। ছিল সেটিও উল্লেখ করেছেন। এর কিছু কারণ উল্লেখ করে ভারতের বিকৃত প্রচারণা এখানকার যুবকদের মন বিষিয়ে দিয়েছিল। তার ভাষায়

“Furthermore, the Indians had been able to pollute the minds of Bengali youth by focusing their propoganda on perceived economic, administrative, and political disparities between East and West, most of the time falsifying facts to suit their claims.” (পৃ. ২৮)।

তিনি অভিযােগ করেছেন, শেখ মুজিব বড় বড় জনসভায় পশ্চিম পাকিস্ত নিকে আক্রমণ করে বিভিন্ন সংখ্যা তত্ত্ব তুলে ধরতেন “যা আমরা কাউন্টার

করতে ব্যর্থ হয়েছি।” তার তত্ত্বটি হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান সব সময় ছিল একটি ব্যাকওয়ার্ড এলাকা। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানকে দোষ দিয়ে লাভ কী? তবে, মারাত্মক ব্যাপার হলাে তার ভাষায়, উর্দুকে বাতিল করায় দু প্রদেশের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় এবং এর সুযােগ নেয় বাঙালি সাহিত্যিকরা যার অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। অথচ পশ্চিম বঙ্গীয়রা হিন্দি ভাষা জাতীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি করেনি। পড়াশােনার মান নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। বরং আমি মন্তব্য করব এভাবে যে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থিতাবস্থায় সরলভাবে যা শেখান হয় তাহলে মুসলমান + উর্দু = পাকিস্তান এবং হিন্দু + বাংলা = হিন্দুস্তান। | বাঙালিরা যুক্ত হবে বাংলা ঐতিহ্যের সঙ্গে উর্দুর সঙ্গে কেন সেটির ব্যাখ্যা তিনি দেননি। মুসলমান বলে? তাহলে ভারতীয় হিন্দুদের কী হবে যারা উর্দুতে অভ্যস্ত? না পাকিস্তানের জেনারেলদের সেগুলি বােঝানাে বাতুলতা। | প্রথম চারটি অধ্যায়ে হাকিম মূলত যা বলতে চেয়েছেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ যদি অনেক আগেই সতর্ক হতাে এবং বাঙালিদের দমন করত তাহলে ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতাে। পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ অধ্যায় পর্যন্ত আছে প্রধানত যুদ্ধের বর্ণনা। ২৫ মার্চ থেকে মুক্তিফৌজের প্রতিরােধ, পাকিস্তানি সেনাদের দখল হয়ে যাওয়া এলাকা পুনর্দখলের লড়াই ইত্যাদি। পুনর্দখলের লড়াইতে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যুৎপন্নমিতা, সাহস ইত্যাদির বিবরণ দেয়া হয়েছে। কীভাবে তাদের অফিসাররা ‘দেশ’ রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে তারও বর্ণনা আছে। আমি যুদ্ধ বিশারদ নই তাই ঐ সব বর্ণনা ও তার বিশ্লেষণে যাব না।’ কারণ এই বর্ণনার বিপরীতে যারা ঐ এলাকায় লড়াই করেছেন তাদের বিবরণ মেলাতে হবে। তা হলেই ভারসাম্যপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যাবে। আমি এসব বর্ণনার মাঝে বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি হাকিমের দৃষ্টিভঙ্গিটুকু শুধু তুলে ধরব। দেশের অভ্যন্তরে ভয়ংকর নিরপত্তাজনিত অবস্থার সৃষ্টি হলে তা মােকাবেলার জন্য অপারেশন ব্লিজ্জ নামে একটি পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে টিকা খান এটিকে উন্নীত করে নাম দেন ‘সার্চ লাইট’। ২৫ মার্চ হাকিমরা নির্দেশ পেলেন, অপারেশন ব্লিজ কার্যকর করতে। এর উদ্দেশ্য ছিল তিনটি

১. স্পর্শকাতর জায়গাসমূহ আয়ত্তে নিয়ে সংরক্ষণ করা।

২. নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ঝামেলা পাকায় এমন সব লােককে গ্রেফতার করা ।

৩. পুলিশে সন্দেহভাজনদের নিরস্ত্র করা।

তার মতে ২৫/২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল | নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যদি সক্রিয় ভারতীয় সাহায্যে [অ্যাকটিভ ইন্ডিয়ান কোলাবরেশন] বিদ্রোহ করতে চায় তা ব্যর্থ করে দেয়া। | হাকিমের এই বক্তব্যেই স্পষ্ট পাকিস্তানিরা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হলে যদি ঝামেলা হয় তাহলে তা আগেই দমন করতে হবে। এরপর হাকিম জেনারেল ফজল মুকিম খানের বইয়ের সূত্র ধরে জানাচ্ছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও মুক্তিবাহিনীর ‘গডফাদার’ ওসমানী ভারতীয় সাহায্যে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিল। এর লক্ষ্য ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার পর দুই প্রদেশের অসম অবস্থা সমতায় নিয়ে এসে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হবে। এবং তা যদি না হয় তাহলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ করতে হবে। সবশেষ উপায় হলাে, বাঙালি সৈনিকরা সমব্যথীদের সীমান্ত পার হবে। এসব সমব্যথীদের অধিকাংশ হিন্দু এবং তারা বিদ্রোহ শুরু করবে। তিনি তিনটি বইয়ের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ঐ সব বইয়ে এ ধরনের পরিকল্পনার উল্লেখ আছে। বই তিনটি হলাে : মেজর রফিকুল ইসলাম | বীরােত্তমের, অশােক রায়ের A Tale of Millions, Inside Raw এবং | বিগ্রেডিয়ার জগদেব সিংয়ের Disnemberment of Pakistan. | অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি, মেজর রফিকের বইয়ে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনাে পরিকল্পনার কথা লেখা নেই। তারা বরং পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের ভয় করছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ২৫ মার্চের আগে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়ার পর এই সন্দেহ ঘনীভূত হয়। আত্মরক্ষার জন্য কী করা যায় যে পরিকল্পনাই তিনি করছিলেন। রায়না ও সিংয়ের বই দুটি আমি পড়িনি সুতরাং, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না। | বাঙালিদের সে এরকম পরিকল্পনা ছিল তা প্রমাণের জন্য তিনি উল্লেখ করেছেন, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের ঘােষণা সমান্তরালে পাকিস্তানপন্থী বাঙালি, বিহারি এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের হত্যা। এ সংখ্যা তার মতে, শান্তাহারে ১৫০০০, চট্টগ্রামে ১০০০০, সিরাজগঞ্জে ৩৫০, ময়মনসিংহে

২০০০। পাবনার পুরাে সেনাদল ৩০০ এবং কুষ্টিয়ায় ১৫০।

প্রথমত, এরকম পরিকল্পনা থাকলে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে গণহত্যায় এত মানুষ মারা যেত না। ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলােচনা চলেছে। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমানবন্দরে থাকা এ.কে. খন্দকার সে খবর জানান এবং তখন আওয়ামী নেতৃবৃন্দের মনে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়।  দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান কীভাবে ঘােষণা দিয়েছিলেন তা নিয়ে বিস্ত রিত বিবরণ আছে। তা পুনরুল্লেখ করব না। শুধু বলব, জিয়াউর রহমানকে হঠাৎ হাতের কাছে পেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা একটি ঘােষণা দিতে অনুরােধ করে। তৃতীয়ত, চট্টগ্রাম ও শান্তাহারে ঐ দিন ২৫০০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল এটি অসম্ভব ঘটনা। তাই যদি হতাে, তাহলে শান্তাহার ও চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এত সহজে সাফল্য পেত না। পাবনা ও কুষ্টিয়ার কথা লিখতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, সেখানে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর একটি দল ছিল যাদের কাছে গােলাবারুদও তেমন ছিল না। ভারতীয় এজেন্টদের সহযােগিতায় বাঙালি চরমপন্থীদের আক্রমণ রােখা সম্ভব হয়নি। (“They were ill equipped to face the onslaught of Bengali militants, supported by Indian agents, when it came, repostedly preplanned and probably triggered by the army action.” এর বিপরীতে লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর কুষ্টিয়া প্রতিরােধ সংক্রান্ত বিবরণ পড়লে বােঝা যাবে হাকিমের উক্তি কতটা পূর্ব ধারণা আক্রান্ত দিনাজপুর শহরের কথা উল্লেখ করেছেন। দিনাজপুর পাকিস্তানি সৈন্যরা। পরিত্যাগ করে। ফলে অনুগত পাকিস্তানিদের ঠেলে দেয়া হয়, ‘ক্রিমিনাল কনডাক্ট অব দি ইনসারজেন্টসের’ সম্মুখে। পশুর মতাে তাদের খুঁজে বের করে এমনভাবে হত্যা করা হয় যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে এদের অনেককে রাস্তায় টেনে হেঁচড়ে নিয়ে অপমান করে ধর্ষণ করে, হত্যা করা হয় । শহর পুনর্দখলের পর পুনর্ভবা নদী থেকে এরকম ক্ষতবিক্ষত অনেক লাশ উদ্ধার করা হয়। ভারতীয়রা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে এভাবে বিহারি ও বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে সফল হয়। অথচ এর আগে তিনি উল্লেখ করেছেন, বিহারিরা মূল স্রোতের সঙ্গে স্বইচ্ছায় মেশেনি অর্থাৎ বিভেদ ছিল। আমি ছেলেবেলার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি ।

চট্টগ্রামে আমাদের কলােনিতে প্রচুর সংখ্যক অবাঙালি ছিল। তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের খেলার সাথী ছিল। কিন্তু কখনও তারা আমাদের সঙ্গে বাংলা বলেনি, বরং আমরাই উর্দু বলতাম, সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্কও ছিল না আমাদের। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জেতার পর থেকে বিহারিরা ক্রমেই শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে এবং কয়েক জায়গায় দাঙ্গার সৃষ্টি করে। অসহযােগ আন্দোলনের সময় বিহারিরা প্রকাশ্যে পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু অনেকবার বাঙালিদের পরামর্শ দিয়েছেন সবরকমের উসকানির মধ্যে তারা যেন শান্ত থাকে। উত্তরাঞ্চলে অনেক শহরে অবাঙালিদের হত্যা করা হয়নি এমন কথা বলব না, বাঙালিও হত্যা করা হয়েছে এবং দু’পক্ষে তখন যুদ্ধ চলছিল। একপক্ষে ছিল পাকিস্তানিরা, তাদের সহযােগী বাঙালি স্বাধীনতা বিরােধী ও পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালিরা। অন্যপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা। সুতরাং পরিপ্রেক্ষিত অনুমেয়। কিন্তু তিনি যে পরিমাণ খুনের কথা উল্লেখ করেছেন তাহলে পুরাে নয়মাস এত অবাঙালি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করত না। তবে তিনি এও উল্লেখ করেছেন, একবার খবর পেলেন এক বাঙালি অনেক অবাঙালি মহিলা আটকে রেখেছে। তার অফিসার গিয়ে দেখেন এক বাঙালি বৃদ্ধ বেশ ক’জন অবাঙালি মহিলাকে আশ্রয় দিয়েছেন। ২৫ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ ঢাকার মিরপুরে যখন বিহারিরা বাঙালি হত্যা করছিল তখন আমাদের অবাঙালি প্রতিবেশী আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। শত্রুতা ছিল এবং দু’পক্ষই মানবিকতা না ভুলে পরস্পরকে আশ্রয় দিয়েছে কখনও কখনও। প্রতিদেশেই দাঙ্গা এবং যুদ্ধের সময় এমন ঘটনা ঘটে। পরে, তিনি নিজেও বিষয়টি স্বীকার করেছেন অবশ্য অন্য পরিপ্রেক্ষিতে। এক পাকিস্তানি সৈন্য এক মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল। তিনি তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, “I can recall one individual who would happily have taken it upon himself, to eliminate all suspected Indian collaborators, specially Hindus, as a reaction to the devastation caused by them, had he not been restrained, and another who abhorred insurgents and took pleasure in scaring the day lights out of them by creating an illusion of savagery. The possibility that the add irresponsible hand might have inflicted injury on helpless opponents in response to wanton killings by the other sider, can not be entirely ruled out.” [ পৃ. ৮৯]

এরপর এক দার্শনিক অনুচ্ছেদে তিনি জানিয়েছেন যার সংক্ষিপ্তসার হলাে যত্রতত্র হত্যা কাপুরুষের কাজ, এ হত্যা তার নৈতিক আচরণের ক্ষতি করে, এ কারণে হয়তাে সে পরে আত্মহত্যাও করতে পারে। সৈনিকদের উচিত ভারসাম্য রক্ষা করা। অতিরিক্ত শক্তি প্রয়ােগে কাক্ষিত ফল লাভ হয় না বরং তা প্রতিষ্ঠানের বদনাম করে। সুতরাং সন্দেহভাজনদের সঙ্গে সতর্ক ব্যবহার

করতে হবে।” যদি হাকিম সাহসী হতেন তবে লিখতেন পাকিস্তান বাহিনী ঠিক এ কারণে সারা বিশ্বে নিন্দিত হয়েছিল। | না, তিনি তা লিখতে পারবেন না, লেখেননি। বরং দেখাতে চেয়েছেন। অধিকাংশ বাঙালি তাদের পক্ষে ছিল, নাহলে মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে তিন-চার কোটি লােকের বিরুদ্ধে থাকা যেত না। তিনি বলতে যেটি ভুলে গেছেন তাহলাে, বাঙালিরা সব নিরস্ত্র ছিল মুক্তি বাহিনী ছাড়া) এবং তারা সব সশস্ত্র ছিলেন। যদি বাঙালিরা আগে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র টের পেত বা বুঝত এবং সশস্ত্র থাকত তাহলে পাকিস্তানি বাহিনী ন’মাস বাংলাদেশে থাকতে পারত না। এর প্রমাণ স্বরূপ তিনি বলেছেন, পরবর্তীকালে ভূট্টোকে ‘tumultuous welcome’ দেয়া হয়। এটি পুরােপুরি সত্য নয়, অভ্যর্থনা দেয়া হয় তবে tumultuous’ নয়। বঙ্গবন্ধুও স্বাধীনতার পরপর লাহাের গেছেন ও মঞ্চে যখন উঠেছেন তখন দর্শকরা করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এতে কি প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তানিরা তাকে ভালােবাসত? তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান আণবিক বােমা বিস্ফোরণ করলে বাঙালিরা | এত খুশি হয়েছিল যে তাদের সামলাবার জন্য পুলিশ ডাকতে হয়েছিল অথচ ভারত বােমা বিস্ফোরণ করায় মানুষ তত খুশি হয়নি। এমন ঘটনা আমার মনে পড়ে না। যখন তারা যুদ্ধবন্দী হিসেবে দিনাজপুর ছেড়ে যাচ্ছেন তখন মানুষ বিষন্ন ছিল। তার ভাষায়

“The quiet remorse expressed by the man in the street during our passage through Dinajpur as Pows” 14. ]

| রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের সময়ও নাকি একই অবস্থা বিরাজ করছিল। এসবই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ব্যবহারের কারণে মানুষ। বাধ্য হয়ে বিরােধিতা করেছিল। তার ভাষায় “The stunned silence of the bewildered majority during the surrender ceremony at the Race Course Ground all these things point to a people coerced into following the Awami League’s diktats by terror and force of arms.” [পৃ. ৯১] এখানে তিনি জামায়েত, মেজর জিয়া ও খালেদ মােশাররফ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। জামায়াতের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, “তারাও ‘মটিভেটেড বেঙ্গলি মুসলিমস’রা শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা তাদের পরিত্যাগ করেছি। ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে তারা কবরে যেতেও

রাজি ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমরা শ্বেত পতাকা উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত। নিয়েছিলাম।” [পৃ. ৯২] এটি অর্ধাংশে সত্য এবং জামায়েত সম্পর্কে এখনও বলা চলে পাকিস্তানের জন্যও তারা জান কোরবান করতে রাজি। আর ইসলামকে অপব্যবহার করতে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জিয়া ও তার স্ত্রী সৈয়দপুরে হাকিম দম্পতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জিয়াকে তার পছন্দ হয়েছিল সুতরাং তার পরবর্তী আচরণ একজন বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘খুনি’ ভাবা কঠিন। পরবর্তীকালে তার কমান্ডিং অফিসারকে তিনি খুন করেন। জিয়ার প্রতি তিনি নমিত, তিনি যাই করেন না কেন? এর উত্তর তিনি দেননি। হয়তাে ১৯৭৫ সালের ঘটনা হাকিমকে প্রভাবিত করেছিল। জিয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করার আগে তিনি “in those days of madness” এবং alleged’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন যা অন্য বাঙালিদের সম্বন্ধে প্রায় ব্যবহৃত হয়নি। আবার অন্যদিকে খালেদ অন্যরকম ব্যবহার করেছেন। চাকরিতে থাকার সময় বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতেন, গেরিলা | যুদ্ধে প্রশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু, তিনি তার কমান্ডিং অফিসার ও অন্য পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের নিরস্ত্র করে আগরতলায় ভারতীয়দের কাছে তুলে দেন বাধ্য হয়ে। এবং আগরতলা যাবার পুরােটা সময় তিনি ছিলেন ‘অ্যাপােলােজেটিক’ । তিনি শেষে লিখতে পারতেন সেনা অফিসারের এরকম | হওয়াই উচিত। কিন্তু লেখেননি। খালেদ মােশাররফ এরকম করেছিলেন কিনা | জানি না কিন্তু পাকিস্তানিরা কোনাে বাঙালি অফিসারকে হয়তাে করেনি। | দার্শনিকভাবে শেষে মন্তব্য করেছেন, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের নামে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্তপাত হয়েছে। এটি সত্য। তার প্রমাণ হাকিম ও তার সহকর্মীরা যারা ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল।

দশম অধ্যায়ের শেষে বাঙালিদের আবার বেশ প্রশংসা করা হয়েছে। A | very cultured people’ বলে। কিন্তু বিদ্রোহ বা দুর্যোগ মানুষকে ক্রুদ্ধ করে তােলে। এরপর লিখেছেন, ১৯৭০ সালে বন্যার পর বন্যা উপদ্রুত থানায় প্রতিটি লাশ কবর দেয়ার জন্য নগদ টাকা দেয়া হতাে। মৃতের প্রিয়জনরা পরদিন আবার সে লাশ খুঁড়ে বের করত যাতে আবার কবর দেয়ার জন্য নগদ টাকা পাওয়া যায়। এরকম কোনাে ঘটনা তখন খবরে আসেনি। আমাদের দেশে কম ধর্মপ্রাণ মানুষও মৃতের এমন অবমাননা করবে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি বলতে চেয়েছেন এসব ঘটনা তাকে নিস্পৃহ করে তুলেছিল। ১৯৭৭ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি আবার কেঁদেছিলেন।

তবে ৫ থেকে ১৫ অধ্যায়ে তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতে ভুলেননি। যে, ভারতীয়রা ছিল সবকিছুর মূলে (পৃ. ৬৮] এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, বছরের পর বছর ধরে ভারতীয়রা আমাদের সমাজের বিভিন্ন পর্যায় ছাত্র, সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রিন্টমিডিয়ায় অনুপ্রবেশ করেছিল। এখানকার মানুষদের অনিরাপত্তা ও বঞ্চনাকে তারা ব্যবহার করেছে বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে। এবং “They had been able to capture the imagination of a segment of our people who mattered.” [পৃ. ১২২]

 

চতুর্দশ ও পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যুদ্ধের ও আত্মসমর্পণের বিবরণ। এ বিবরণে বারবার আত্মজিজ্ঞাসার বিষয়টি এসেছে যা আগেও হাকিম অনেকবার উল্লেখ করেছেন। তার মূল বক্তব্য হলাে- পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘােষণা উচিত হয়নি কারণ পাকিস্তান সেভাবে প্রস্তুত ছিল না যার সুযােগ ভারত পুরােপুরি নিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসছে এ গুজবও ক্ষতি করেছে। একটি ঘটনার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায়, “আমাদের উৎফুল্ল ব্রিগেড কমান্ডার তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ভারতীয় প্যারাট্রুপারদের চীনা ভেবে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল। বলাই বাহুল্য তারা সবাই বন্দী হয়েছিল এবং ভারতীয় প্রচার মাধ্যম তা প্রচার করেছিল। এ ধরনের ঘটনা ছিল ডিপ্রেসিং। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কেমন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তার বিবরণ আছে। ভারতীয় দুই সৈনিককে গ্রেফতারের পর তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতীয়রা তাদের দিনাজপুর থেকে হটাতে পারত না কিন্তু তখনই ঘােষিত হলাে আত্মসমর্পণের কথা যাকে হাকিম ‘অন্তিম লজ্জা বা আলটিমেট শেম’ বলে উল্লেখ করেছেন। | অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ও তার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেন সৈয়দপুরে । তারপর সৈয়দপুরেই তাদের রাখা হয়। ২১ ডিসেম্বর বাসে করে তারা রওয়ানা হন। তার বর্ণনা, “রাস্তার বাঙালিরা আমাদের চিনেছে। প্রায় সবাই হাত নেড়ে বিদায় জানাল, অনেকের চোখে পানি। কেউ আমাদের দিকে সুনির্দিষ্ট হাত ওঠায়নি, স্লোগানও দেয়নি যদিও তারা জানে আমরা বন্দী, প্রতিশােধ নেয়ার ক্ষমতা নেই।” (পৃ. ১৮৮]

এই বর্ণনায় তিনি তার আগের থিসিসই প্রমাণ করতে চেয়েছেন অধিকাংশ। বাঙালি তাদের বিরুদ্ধে ছিল না। কিন্তু ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে এমন কোনাে দৃশ্য সম্ভব? হাকিম, বলতে পারতেন, বাঙালিরা কিছু বলেনি কারণ তারা প্রতিশােধপরায়ণ নয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে তারা করুণার চোখে দেখছিল। এরপর তাদের বাঁচাতে বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের যেভাবে রাখা হয়েছে তার বর্ণনা দেখে বলতেই হয় ভারত জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছিল। বাঙালিদের পাকিস্তানে কীভাবে রাখা হয়েছিল তার যেসব বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে হাকিম বােধহয় তা পড়েননি। পড়লে জানতে পারতেন ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা। অবশ্য, পড়লেও বিশ্বাস করতেন না। তাদের পূর্বধারণাই হচ্ছে যা কিছু খারাপ তার প্রতীক হচ্ছে ভারত বা হিন্দু। | জীবিত থেকে তারা পালাবার চেষ্টা করেন কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। শাস্তিস্বরূপ তাদের কয়েকজনকে আগ্রা জেলে রাখা হয়। সেখানে তারা কীভাবে কাটিয়েছিল তার বর্ণনা আছে। ভারতীয়রা মাঝে মাঝে তাদের বােঝানাের চেষ্টা করেছে ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ তত্ত্ব। সেগুলি তারা খাঁটি পাকিস্তানির মতাে অগ্রাহ্য করেছেন।  সেখানে একবার গুজব শুনেছেন ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। হাকিম ভেবেছিলেন তিনিও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। আফসােস করে লিখেছেন, একজন ব্যক্তি হয় ‘ওভার রিঅ্যাক্ট করতে পারে কিন্তু তারা সবাই ব্রান্ডেড’ হচ্ছেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অথচ দোষ তাে তাদের নয়; কারণ আইনগত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তার ভাষায়- “but now we were all being branded as war criminals for actual or contrived acts of desperation committed under circumstances created by there who had rebelled against lawful authority.” [পৃ. ২২৯]

অর্থাৎ কোনাে কিছুর জন্যই তারা দোষী নয়। ফিরে যাওয়ার সময় তার অনেক স্মৃতি মনে হয়েছে কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি বা পরিকল্পনাহীনতাই তার কাছে বড় মনে হয়েছে। তার সেই পূর্ব ধারণা তখনও বলবৎ। তিনি লিখেছেন, একে একে বিচার করলে “আমরা ভারতীয়দের থেকে ভালাে। বিশ অধ্যায় পর্যন্ত এসব বর্ণনার মাঝে তার সেই লক্ষ্যহীন দার্শনিক রেটরিকের কমতি নেই। অবশেষে তিনি ‘পাকিস্তানে ফেরৎ যান এবং তাকে আবার সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়া হয়।

২১ অধ্যায় পর্যন্ত যা লিখেছেন ২২ থেকে ২৫ অধ্যায়ের মধ্যে তার মূল্যায়ন করেছেন। আগের অধ্যায়গুলিতে যে বর্ণনা দিয়েছেন যা আমি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি সেগুলিই আরাে সংহতভাবে বর্ণনা করেছেন মাত্র। তাতে নতুন কিছু নেই। তবে, তার সমস্যা হচ্ছে দোদুল্যমানতা। তিনি জানেন কেন ১৯৭১ হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে কী হয়েছিল? কিন্তু তার উদ্দেশ্য, বর্ণনা এমনভাবে দেওয়া যাতে মূল বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যায়। যেমন- ‘অ্যা রিঅ্যাপরাইজাল’ অধ্যায়ের উপসংহারে লিখছেন, যা হয়েছে তার জন্য ব্যক্তি (যেমন- নিয়াজি, ইয়াহিয়া, ভূট্টো, মুজিব) কয়েকজনকে দোষ দিয়ে বাকি সবাইকে দোষ দিলে তা ঐতিহ্য অনুযায়ীই হবে। অর্থাৎ সত্যকে এড়িয়ে ভবিষ্যতকে (posterity) বিকৃত করা ।

“Unless we probe, discover and remove the drawbacks in our modus operandi for advancement of genuine leadership in public institutions of national importance we shall continue to throw up new incompetents to torment us.” (পৃ. ২৫৮] এ ধরনের পরামর্শ ২২ থেকে ২৫ অধ্যায় পর্যন্ত লক্ষণীয়।

যেমন আরেক জায়গায় লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে তার অভিজ্ঞতা বলে, শক্তির ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না। তথ্যের অবাধ প্রবাহ, সহমর্মিতা, সরকারের সঙ্গে জনগণ ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি · অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে।  ২৪ অধ্যায়ের শিরােনাম ‘দি মিলিটারি অ্যাকশন’। এতে অনেকগুলি উপ অধ্যায় আছে। প্রথমটি এর কি প্রয়ােজন ছিল?’

বাংলাদেশে কি সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়ােজন ছিল? এর উত্তর প্রথমে তিনি। একটি পটভূমি দিয়েছেন যা আগেও উল্লেখ করেছেন। পটভুমি হলাে, পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বিষয় ছিল যা ইস্যুভিত্তিক নয় ‘caught the peoples imagination (পৃ. ২৬৬)। শব্দ তিনটির ব্যবহার লক্ষণীয়। এবং তারা ‘অশৃঙ্খলিত’ (আনফেটারড) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল। এ সমস্ত দাবি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হওয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন শুরু হয়। সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও ‘perecived economic exploitation’ (পৃ. ২৬৬)। | [শব্দ তিনটি লক্ষ্য করুন] চরমপন্থার বিকাশ এবং আইনগত ভিত্তি নিয়ে যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অতি শিঘ্র রাষ্ট্রবিরােধীরা হাইজ্যাক

করে নেয় এবং এটিকে ভায়ােলেন্ট এজিটেশনে পরিণত করে যা এথনিক কিলিং’সের পথ করে দেয়। পরিণতিতে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। | আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পটভূমি সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা তার সঙ্গে। এর অমিল নেই। কিন্তু কিছু শব্দের ব্যবহার বিষয়টিকে উল্টে দিয়েছে এবং ৭১ সম্পর্কে পাকিস্তানিদের ধারণাটিকে আরাে স্পষ্ট করেছে। যেমন, বঞ্চনার ব্যাপারটা মানুষকে আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে পিপলস ইমাজিনেশানে ধরেনি। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ‘অশুঙ্খলিত’ মানে কেন্দ্রকে মানা হবে না এবং এরই নাম ৬ দফা। অর্থনৈতিক ‘এক্সপ্লয়েটশন’ তাে ছিলই, সংখ্যাতত্ত্বই তা বলে, এটি ‘পারসিভড’ বা ধারণাগত হবে কেন? রাজনৈতিক আন্দোলন ‘হাইজ্যাক’ করল কারা রাষ্ট্রদোহিরা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকরা এবং তার ফলে “এথনিক কিলিং’ অর্থাৎ বিহারি হত্যা শুরু হলাে, সবশেষে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ২৫ মার্চ অপারেশন ‘ব্লিজ’ বা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তাহলে ঘটেনি? সুতরাং, লক্ষ্য করুন পটভূমিটা কীভাবে পাল্টে গেল। | এ পরিপ্রেক্ষিতে হাকিম মনে করেন, শক্তি প্রয়ােগ দরকার ছিল [“The use of force was also necessary for individual and collective survival. 19. 20) অথচ, আগে আবার বলেছেন শক্তি প্রয়ােগে রাজনৈতিক সমাধান হয় না। এ ধরনের উপসংহারই স্বাভাবিক। এবং পাঠক যাতে কনভিন্সড় হয় সে। জন্যই পটভূমিটি ঐভাবে লেখা। এর পরের বিষয়টি হচ্ছে বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়নি। এ থিসিস প্রমাণ করতে গিয়ে আবার যে উদাহরণ দিয়েছেন তা আগের পটভূমির বিপরীত।  শেখ মুজিবের বাসায় হানা দেয়ার নেতৃত্ব দেয় মেজর বিলাল। তিনি বিলালকে বলেন, সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার মতাে কোনাে কাজ তিনি করেননি। তাঁর একথা বলার উদ্দেশ্য কী? যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া নাকি সহানুভূতি আকর্ষণ? | পাকিস্তানি সৈন্যরা আওয়ামী লীগের করা যে খসড়া শাসনতন্ত্র উদ্ধার করেছিল তাতে দুটি দেশের উল্লেখ নেই বরং কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের (আগের অনুচ্ছেদে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত মন্তব্য দেখুন কথা আছে। এটি সত্য হলে সামরিক হস্তক্ষেপের সুযােগ থাকে না [আগে বলেছেন হস্তক্ষেপ প্রয়ােজনীয় ছিল]। হাকিম বলছেন, পূর্ব পাকিস্তানি অনেকে তার বন্ধু ছিলেন, সেখানে দুঃসময়ে কাজ করেছেন এবং এখনাে তিনি বিশ্বাস করেন না সংখ্যাগরিষ্ঠরা

বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ছিল

[“I am not covinced, even today, that it was the wish of the majority to break away from the west.” 4.691 | বিশ্বস্ত এক সূত্র মতে, জেলে বসে মুজিব যখন আসন্ন ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কে শুনলেন তখন তিনি অনুরােধ জানিয়েছেন টেলিভিশনে বক্তৃতা দিয়ে ভারতকে জানাবেন যা ঘটছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। জেনারেল ইয়াহিয়া তাতে রাজি হননি কারণ কয়েকদিন আগে যাকে বিশ্বাসঘাতক বলেছেন তাকে আবার স্বীকার করবেন কীভাবে?

এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, পাকিস্তানের জেল থেকে যখন প্লেনে দেশে ফিরছেন তখনও শেখ মুজিব ভারত বিদ্বেষী । পাকিস্তানীর পক্ষে মন্তব্য করেছেন। জেনারেল গুলাম জিলানী খান জানিয়েছেন, শেখ মুজিব সবসময় বলেছেন, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সুতরাং তিনি সারা পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেবেন। সুতরাং তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে পারেন না। এসব উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠরা পাকিস্তান ভাঙ্গতে চেয়েছে এটি বলা ঠিক হবে নাকি সংকটময় মুহূর্তে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা এর কারণ? তারপরই তিনি বলছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ একরাতে চিন্তা করে শুরু করা যায়  হাকিম মনে করেন, এটি পরিকল্পিত, আগরতলা ষড়যন্ত্র থেকে শুরু এবং ভারত অব্যাহতভাবে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য কাজ করেছে। তবে, পুর্ব পাকিস্তানি নেতৃত্ব এবং সেনারা এই পরিকল্পনার সচেতন পক্ষ ছিল কিনা তা বিতর্কের বিষয়। উপসংহারে বলছেন, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ মুসলমানদের একাংশকে শক্তি, অন্তর্ঘাতের দ্বারা বশীভূত করে এবং বােঝায় যে ভারতের সাহায্যে পাকিস্তানের জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, প্রগতির নতুন পথ খুলে যাবে। তার ভাষায়

“By 1971, the Awami League had, through coercion, subversion and clever manipulation of the print media managed to blur the thinking of a section of the Bengali Muslims, who had come to believe that freedom from Pakistani yoke would, with Indian help, open up a new world of progress for them. A mind-boggling ideological turnaround!” | [পৃ. ২৭১]

প্রতিটি অনুচ্ছেদ প্রতিটি অনুচ্ছেদের বিপরীত। তার দ্বিতীয় হাইপথেসিস অতিরিক্ত শক্তি কি প্রয়ােগ করা হয়েছিল?

এ প্রশ্নের উত্তরেও তিনি তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে পুরানাে বক্তব্য নতুনভাবে দিয়েছেন যার প্রচ্ছন্ন অর্থ শক্তি তেমন প্রয়ােগ করা হয়নি তার ভাষায়

“However, the magnitude of force deployed by us, though inevitable in view of the display of street power by the militant to over a number of weeks did provoke a backlash.”14.392) .

তার মতে, ভারত এর সুযােগ নিয়েছে যা পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। হাকিমের মতে, শক্তি প্রয়ােগ হলেও তা বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে।

পরের হাইপথেসিস সামরিক হস্তক্ষেপ কি এড়ান যেত? এ প্রশ্নের উত্তরে আগের মতাে তিনি অনেক প্রশ্ন করেছেন, উত্তর দিয়েছেন। যেমন, হ্যা এড়ান যেত যদি যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতেন। যদি জুলফিকার আলী ভূট্টো বিরােধী দলে বসতেন ইত্যাদি। মূল প্রশ্নের উত্তর নির্দিষ্টভাবে দেননি।

পরের বিবরণের শিরােনাম গণহত্যা ও ধর্ষণ।

বাংলাদেশের পক্ষে যে বলা হয় ত্রিশ লক্ষ শহীদ হয়েছে ও ধর্ষিত হয়েছে। কয়েক লক্ষ তা বিশ্বাসযােগ্য নয়। এটি প্রমাণ করার জন্য লন্ডন থেকে জামায়েত প্রভাবাধীন সংস্থা থেকে প্রকাশিত বই ও পাকিস্তানিমনা বিএনপির লে. কর্নেল আকবর হােসেনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিসাব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেই আগের মতাে প্রশ্ন রেখেছেন :

১. বিরাট সংখ্যক বাঙালি রাজাকার শেষ অব্দি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে যার অর্থ এ ধরনের ‘Extermination programme’ এ তারা অংশ নিতে পারে না। অথচ আমরা জানি বাঙালি জামায়েত ও রাজাকাররা কীভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণে অংশ নিয়েছিল।

২. বাংলাদেশ হওয়ার পর একটি ছাড়া কি কোনাে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে? আমি মুক্তিযুদ্ধ কোষ সম্পাদনা করছি। এ পর্যন্ত আমরা ১০০০ গণকবরের বিবরণ সংগ্রহ করেছি।

৩. কতজন গর্ভপাত করিয়েছিল বা কতজন ধর্ষিত হয়েছিল? পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশ ত্যাগ করার পর কতজনের সন্তান হয়েছিল ইত্যাদি? ধর্ষণ হয়নি, হলেও দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। | আমি এখানে বাঙালি বা পাকিস্তানি কারাে সাক্ষ্য দেব না। আমি সদ্য প্রয়াত অস্ট্রেলিয়ার শল্য চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিসের কথা উল্লেখ করতে চাই। তার পর্যবেক্ষণটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের বাংলার বাণীতে।

“সিডনীর শল্য চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস সম্প্রতি লন্ডনে বলেন, ন’মাসে পাক বাহিনীদের দ্বারা ধর্ষিত ৪ লাখ মহিলার বেশিরভাগই সিফিলিস অথবা গণােরিয়া কিংবা উভয় ধরনের রােগের স্বীকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই ইতােমধ্যে জ্বণহত্যাজনিত অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।…. | ডা, ডেভিস বলেন, বাংলাদেশে কোনাে সাহায্য এসে পৌছার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের ফলে ২ লাখ অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলার সংখ্যাগরিষ্ঠাংশ স্থানীয় গ্রামীণ ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন।…” এ প্রসঙ্গটি পাকিস্তানের প্রখ্যাত কলামিস্ট নকভীর সাক্ষাৎকার দিয়ে শেষ করব। করাচিতে আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম বছর পাঁচেক আগে। ‘পাকিস্তানি বাহিনী ছিল’, অকম্পিত স্বরে জানালেন নকভী, “বিশৃঙ্খল লুটেরা বাহিনী। এরা লুট করেছে, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সবরকমের অপরাধ করেছে। এ সেনাবাহিনী কত বােধহীন ছিল তার প্রমাণ জেনারেল টিক্কা খানের মন্তব্য। ঢাকা থেকে ফেরার পর সাংবাদিকরা যখন তাকে লুট, ধর্ষণ, হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তখন তিনি বলেন ধর্ষণের সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। তিন হাজার, মাত্র তিন হাজার ধর্ষিত হয়েছে…” নকভী এরপর যা বলেছিলেন তা হলাে, একজনকেও যদি ধর্ষণ করা হয় সেটিও অপরাধ। রাষ্ট্রের রক্ষক তাে ধর্ষণ করতে পারে না। ইসলাম ধর্মে আমানত-খেয়ানত করার মতাে বড় পাপ খুব কমই আছে।  তারপর হাকিম এনেছেন ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন। তার মতে, শর্তহীন ক্ষমা চাওয়ার অর্থ সেনাবাহিনী ও তত্ত্বালীন নেতৃত্বকে দোষারােপ করা ।

আর যে সেনাবাহিনী দেশ গড়ার নামে যুদ্ধ করেছে, বীরত্বসূচক পদক পেয়েছে সেগুলি নাকচ হয়ে যায় যা সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতে অভিঘাত হানবে। ক্ষমা চাওয়া উচিত বরং মি. জিন্নাহর কাছে। তার মতে, অর্থবহ ক্ষমা চাইতে হলে। দু’পক্ষকেই করতে হবে। (“For any apology to be meaningful, it must be mutual.”] শেষ অধ্যায়টির শিরােনাম কনকুডিং অবজারভেশন’। আগে উল্লিখিত বিবরণ ও যুক্তিসমূহের সারাংশই দিয়েছেন যার মূল্যায়ন দরকার নেই।” | হাকিম আরশাদের বিবরণ পড়ে যা জানতে পারি, তাহলাে, ১৯৭১ সালে ভারতীয় প্ররােচনায় ও সাহায্যে আওয়ামী লীগ বাধ্য করেছিল সেনাবাহিনীকে দ্বন্দ্বে যেতে। সেনাবাহিনী বাধ্য হয়েছে তা প্রতিরােধ করতে। বাঙালিদের অধিকাংশ সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল। গণহত্যা-ধর্ষণের যেসব কথা বলা হয় সেগুলি অতিরঞ্জিত। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তি ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি তারা। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। উপসংহার, তার মতে, ১৯৪৭ সালের পর একজন ব্যক্তিই সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন তিনি হলেন মি. জিন্নাহ। আর একটি প্রতিষ্ঠান সে রকম প্রশংসিত তাহলাে সেনাবাহিনী। (“The only other institutions that have invoked such admiration have been the Armed Forces, particulary the Army.” ২৯২) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনাে সদস্যের এর বাইরে চিন্তা করার | ক্ষমতা নেই। মেজর জেনারেল এ.ও, মিঠার নামটি নিয়াজি বা টিক্কাখানের মতােই আমাদের কাছে পরিচিত কারণ মার্চের দিনগুলিতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ। পরিচালনায় তারও ভূমিকা ছি। মিঠা সেটি অস্বীকার করেননি কিন্তু তার বর্ণনায় এমন একটা ভঙ্গি আছে তাতে এটি যে সে সময় একটি জঘন্য কাজ ছিল তা মনে হবে না। কারণ, বাঙালির প্রতি তার কোনাে তীর্যক মন্তব্য নেই। ভাবটি এমন, তিনি একজন সামরিক অফিসার যার কাছে দেশ রক্ষাই প্রধান কাজ। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে দেশ রক্ষার, তিনি তা করেছেন। তবে সম্পূর্ণ বইটি পড়লে অনেকের তার প্রতি সহানুভূতি জাগতে পারে বটে কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি মন্তব্যে তার পূর্ব ধারণা প্রকট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের অন্যান্য সামরিক অফিসারের সঙ্গে মিঠার খানিকটা পার্থক্য ছিল। এ. ও. মিঠার জন্ম কসমােপলিটান বােম্বে বা মুম্বাইয়ে ১৯২৩ সালে এক ধনী মেমন পরিবারে। সুতরাং, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাদেশিকতা ছিল না। দারিদ্র্যের কারণে নয় নিজ ইচ্ছায়ই সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে। বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। প্রেমে পড়েছিলেন বাঙালি খ্রিস্টান জেনারেল, তার বস রুদ্রের বােন ইন্দুর সঙ্গে। বিয়েও করেছিলেন তাকে। সে কথায় পরে আসব। সেনাবাহিনীতে যােগ দেয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। ত্রাণ কাজ করার জন্য মিঠাদের পাঠানাে হলাে কলকাতায়। ত্রাণ ও ওষুধ নিয়ে পূর্ববাংলায় তিনি ঘুরেছেন। সেই সময় তার মনে হয়েছে, এই অঞ্চলের মুসলমানরা গরিব এবং শােষিত। যে কোনাে

সমাবেশে তিনি দেখেছেন, হিন্দুরা চারপেয়েতে বসে আছে আর মুসলমানরা মেঝেতে । প্রশ্ন হলাে, হিন্দুরা কি মেঝেতে বসত না? সে সময়কার রীতিই ছিল ‘ভদ্রলােক বসতেন চেয়ারে বা চারপেয়েতে বাকিরা মেঝেতে। পশ্চিম পাকিস্তানে কি এই প্রথা ছিল না? মিঠা লিখেছেন, তিনি কখনাে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না কিন্তু “plight of the Muslims was so bad that one could not help notcing it.” (পৃ. ৬৯) দেশভাগের দাঙ্গার সময় তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, শিখ, হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পরকে হত্যা করছে। সেদিন থেকে নেহেরু এবং গান্ধীর ওপর তার আস্থা চলে যায়। তিনি লিখেছেন, এ ধরনের নৃশংসতা তিনি ফের দেখেছেন ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে। তবে, দ্বিতীয়বার তিনি আর বিস্মিত হননি। মিঠা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে চলে আসেন। তার পুরাে পরিবার থেকে যায় মুম্বাই । ইন্দুর বাবা তার বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু, জোর-জবরদস্তি করে ইন্দু চলে আসেন করাচি। সেখানেই তারা বিয়ে করেন। মিঠার বিবরণ পড়ে মনে হয়, প্রথমদিকে পাকিস্তানে যারা ছিলেন সেনাবাহিনীতে, তারা ব্রিটিশ আমলের। সেনাবাহিনীর মধ্যে তখনাে এক ধরনের সহনশীলতা ছিল। আক্ষরিক অর্থেই সেনাবাহিনীর লােকজনের নুন আনতে পান্তা ফুরাত । কিন্তু, পাকিস্তান আমলে সেনা রিক্রুট হতে থাকলে চালচিত্রটা বদলে যায়। সেই সময় মিঠা নিজেও মুম্বাই গেছেন কয়েকবার, তার আত্মীয়স্বজন, শ্বশুর বাড়ির লােকজনও পাকিস্তান ঘুরে গেছেন। পরবর্তীকালে তা ছিল অসম্ভব ব্যাপার এবং ১৯৫৮ সালের পর মিঠার প্রতিও গােয়েন্দা বাহিনী। নজর রেখেছিল। ১৯৬২ সালে মিঠা কর্নেল পদে উন্নীত হন। এ সময় ইয়াহিয়া, হামিদ প্রমুখের সঙ্গে তার সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময়ই তাকে পাকিস্তানের কমান্ডাে বাহিনী বা স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এস এস জি) গড়ে তােলার ভার দেয়া হয়। সাফল্যের সঙ্গে তিনি তার কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬-৬৮ সালে পাকিস্তান মিলিটারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। | মেজর থাকা অবস্থায়ই মিঠা পাকিস্তান বাহিনীতে সাশপ্রদায়িক মনােভাব লক্ষ করেন। লাহােরে অবস্থানের সময় তার ওপরঅলা তাকে একটি তালিকা ধরিয়ে দেন। মিঠা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে তিনি বলেন এটি কাদিয়ানী অফিসারদের। মিঠা তখনাে এর কারণ বুঝতে না পারলে জিওসি তাকে বলেন। আগের এম এস ছিলেন কাদিয়ানী । তিনি ব্রিগেড ও সদর দপ্তরগুলােতে

কাদিয়ানী অফিসারদের নিয়ােগ দিয়েছেন। প্রায় ৩০ ভাগ কাদিয়ানী ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়ান কমান্ডার। আইয়ুব খান নির্দেশ দিয়েছেন এই অবস্থা পরিবর্তনের । হামিদ ছিলেন তখন জিওসি। মিঠা লিখেছেন, মুম্বাইতে বড় হওয়ার কারণে তিনি এ লাইনে চিন্তাই করেননি। কারণ, যার যার ধর্ম তার তার। মিঠা জানতেন না এ বৈষম্য বাঙালিরা তাে আগেই হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে মিঠাকে পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বদলি করা হয়। বদলির আদেশ পেয়ে তিনি রওয়ানা হন পূর্ব পাকিস্তান। তার স্ত্রীসন্তানদের নিয়ে চলে যান মুম্বাই ছুটি কাটাতে। ঢাকা বিমান বন্দরে মিঠা নামছেন আর তার পূর্বসূরি করাচি যাচ্ছেন। পূর্বসূরিকে সিঁড়ির গােড়াতেই বিদায় জানালেন। সেদিন রাতে ঢাকায় থাকলেন তিনি । পরদিন সকালে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করলেন। ইয়াহিয়া তাকে জানালেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে একমাত্র পদ্ধতি হবে গেরিলা পদ্ধতি। সুতরাং মিঠা কি এক ইনফেনট্রি ব্রিগেড গড়তে পারবেন যারা গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করতে পারবে? যদি এতে সাফল্য আসে তাহলে বাকি ব্রিগেডকেও একই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ছয়মাস সময় দিলেন তিনি মিঠাকে তার মতামত জানাবার জন্য। তিনি আরাে বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা পূর্ব পাকিস্তানিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তিনি এ ধরনের আচরণ সহ্য করবেন না। মিঠাও যেন দেখেন তার ব্রিগেডে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। কুমিল্লায় ভার নেবার একমাস পর ক্লাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ইনফেনট্রির দুজন ক্যাপ্টেন বাঙালি অফিসার ও তাদের স্ত্রীদের সামনে এ ধরনের আচরণ করেন। মিঠা তখনই তাদের ক্লাব থেকে বের করে দেন। পরের দিন ইয়াহিয়াকে ঘটনাটি জানান এবং তাদের অন্যত্র বদলির অনুরােধ করেন। পরের দিন তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হয়। ইয়াহিয়া যে রণকৌশলের কথা বলেছিলেন তা যুক্তিযুক্ত তাবে পাকিস্তানি সামরিক কর্তারা তাতে গুরুত্ব দেয়নি। পরবর্তিকালে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা এই কৌশল অবলম্বন করেই পাকিস্তানিদের পরাজিত করে। ইয়াহিয়া ধরতে পেরেছিলেন বাঙালিদের প্রতি অবাঙালিদের আচরণ ভালাে নয়, তা প্রতিবিধানেও সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সেই ইয়াহিয়াই মাত্র ৮ বছর পর পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার নির্দেশ দেন।

কুমিল্লায় পৌঁছার পরদিন ভাের ৬টায় টেলিফোন পেলেন ইয়াহিয়ার । তিনি জজ্ঞেস করলেন মিঠা লাঠি টিলার নাম শুনেছেন কিনা। না, জানালেন | মিঠা । ইয়াহিয়া বললেন ব্রিগেড মেজর থেকে তা জেনে তখুনি সেখানে যেতে কারণ সেখানে ঝামেলা দেখা দিয়েছে। মিঠা লাঠি টিলা পৌছে দেখেন সেটি চার একরের জঙ্গলাবৃত একটি টিলা যা দুদেশই দাবি করছে। প্রতি বছরই সেখানে ঝামেলা হয় এবং পাকিস্তানের দু-একজন মারা যায় । মিঠা দেখলেন, | ‘সিচুয়েশন’ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের নিয়ন্ত্রণে আছে। কয়েকদিন এ সম্পর্কে খোঁজ-খবর ও পড়াশােনা করে মিঠা ইয়াহিয়াকে একটি চিঠি দিয়ে জানালেন, চার একর ‘unproductive land’ নিয়ে ঝামেলা করা ‘unnecessary waste of lives’, সুতরাং ভারতীয়দের সঙ্গে আলাপ করে স্থায়ী একটি সমাধানে আসা উচিত। মিঠা লিখেছেন, পরদিন ইয়াহিয়া তাকে বেদম ঝাড়লেন। (‘t got a terrific rocket from Yahya]। ইয়াহিয়া জানালেন মিঠার চিঠি তিনি নষ্ট করে ফেলছেন, মিঠাও যেন চিঠির কপি ধ্বংস করে ফেলে। মিঠা লিখেছেন, এ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারেননি ইয়াহিয়া কেন এরকম আচরণ করেছিলেন কারণ সাধারণত সে রকম আচরণ তিনি করতেন না। | মিঠা জানাচ্ছেন, তার স্ত্রী খুব খুশি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। তিনি ছিলেন বাঙালি এবং “Her interest in and knowledge of music and dance and her admiration of Tagore and Nazrul Islam were greatly appreciated by the East Pakistanis.” (পৃ. ২৪৫] ইন্দু ওস্তাদ বাহাদুর খান ও আয়াত আলী খানের মতাে লােকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। তারা ক্যান্টনমেন্টে এসে বাজিয়েছিলেনও। মিঠা জানাচ্ছেন, বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের ভালাে ছিল। ইন্দুর কারণে তা উন্নীত হয়েছিল । আর বাঙালিরা বিশ্বাস করতেন না যে ইন্দু খ্রিস্টান। তারা ভাবতেন ইন্দু, ব্রাহ্ম, নয়তাে একজন মুসলমানকে বিয়ে করে কীভাবে? | মিঠা দম্পতি তাদের মেয়েদের পাঠিয়েছিলেন কুমিল্লার স্কুলে। ক্যান্টনমেন্টে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, হােয়াইটওয়াশ বা এ ধরনের কাজ থেকে প্রশিক্ষণে তিনি আগ্রহী। ইয়াহিয়ার কথা মতাে এক ইউনিটকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়াও হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করায় গেরিলা ব্রিগেড গঠন করা হয়নি। | মিঠা জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক সপ্তাহ কাটানাের পর তিনি লক্ষ করেন ১৯৪৬ থেকে যে ইয়াহিয়াকে তিনি চিনতেন সে ইয়াহিয়া বদলে গেছেন। সব সময় অস্থির, অসহিষ্ণু, কাজে মন নেই। একবার অবশ্য মিঠাকে জানিয়েছিলেন, পারিবারিক কিছু ঝামেলা আছে যা তিনি মেটাতে চান এবং এ জন্য ছুটি নিবেন। হয়তাে এ কারণেই তিনি পেশােয়ার বদলি হয়ে যান। ইয়াহিয়া একবার কুমিল্লায় এলেন পরিদর্শনে। রাতে ডিনার। ডিনার প্রস্তুত। ইয়াহিয়াকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। তিনি কর্ণপাত করছেন না। মদ খাচ্ছেন আর কথা বলছেন। মিঠা তখন অন্যান্য অফিসারদের বললেন, খাওয়া শুরু করতে । ই

ন্দু তখন ইয়াহিয়ার পাশে বসলেন তাকে ডিনারে নিয়ে আসার জন্য। ইয়াহিয়া ইন্দুকে বােঝাতে লাগলেন যে, তাকে তিনি তার হাঁটু সমান থাকতে দেখেছেন। তারপর ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলীকে ডেকে বললেন, “অ্যাই শুয়ার কা বাচ্চা ইধার আও।” আলী এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি আলীর সন্তান, আমি শুয়ারের বাচ্চা হলাম কীভাবে? ইন্দু তখন ব্যান্ডকে বাজনা শুরু করতে বললেন। ইয়াহিয়া ইন্দুর সঙ্গে নাচতে চাইলেন। ইন্দু। ইয়াহিয়ার হাতে হাত রেখে তাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে এসে বসালেন। খানিক পর ইয়াহিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘Have I behaving badly’ ইন্দু বললেন, ‘হ্যা’। ইয়াহিয়া তারপর ডিনার শেষ করে মেসে ফিরে গেলেন। পরদিন সকাল ৬-১৫ মিনিটে মিঠার ইয়াহিয়াকে তুলে নেয়ার কথা। মিঠা রেডি হচ্ছেন। অর্ডারলি এসে জানালাে, ইয়াহিয়া চলে এসেছেন। কাপড় পরে মিঠা তাড়াতাড়ি বেরুলেন। ইয়াহিয়া তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্দু কোথায়? মিঠা জানালেন, ঘুমুচ্ছে। ইয়াহিয়া তখন বললেন, গত রাতের ব্যবহারের জন্য তিনি ইন্দুর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন। মিঠা জানালেন, ইন্দুকে তিনি তা জানাবেন। মিঠা মন্তব্য করেছেন, “That was Yahya at the time an arrogant boor when drunk, a through gentleman when soaber, and not afraid to apologize.” (পৃ.২৪৮] দুবছর দায়িত্ব পালনের আগেই মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানকে জিওসি হিসেবে আনা হলাে। ইয়াহিয়া ও মুকিম পরস্পরকে পছন্দ করতেন না। আবার মুকিমও ইয়াহিয়াকে পছন্দ করতেন না। সুতরাং মিঠা ও মুকিমের বনাবনি হয়নি। অবস্থা এমন হলাে যে, মিঠা মুকিমকে জানালেন যে, তার ওপর কনফিডেন্স না থাকলে মিঠাকে যেন বদলির বন্দোবস্ত করা হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় মিঠা এখানে ছিলেন। তেমন কিছু ঘটেনি পূর্ব পাকিস্তানে, তবে তিনি সিভিলিয়ান পদক সিতারাই কায়েদে আজম পেয়েছিলেন। মিঠা লিখেছেন, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬-এই তিন বছর তিনি কুমিল্লায়  ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। লিখেছেন তিনি, “আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙালি আর্মি অফিসার ও তাদের স্ত্রীরা উদারমনা ও সেকুলার। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও তাদের স্ত্রীদের থেকে তাদের জানার পরিধি বেশি, নাচ ও গানের ভক্ত এবং সংস্কৃতিবান। তবে, বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে যে অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ বিদ্যমান তাও অনুভব করছিলাম।” এই ক্ষোভ অন্তর্হিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় যখন দেখা গেল তাদের দেশপ্রেমও কম নয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে। মিঠার এই ইংরেজি বাক্যে একটি শব্দ আছে Proved’। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশপ্রেমিক এটা তাে স্বতসিদ্ধ।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানিরা প্রমাণ করেছে তারাও দেশপ্রেমিক এবং তাদের থেকে বেশি। এই একটি শব্দই তিনি নিজেকে যত মেট্রোপলিটন বলে প্রমাণ করুন না কেন তার পূর্ব ধারণাই তুলে ধরে। তার ভাষায়, “during the 1965 War, when the East Pakistanis of all classes proved themselves as Patriotic as any West Pakistanis, in fact more so. Despite to the feeling of complete isolation. They never lost heart and were willing to fight in the bitter end.” পৃ ২৬  পূর্ব পাকিস্তানে থাকার সময় মােটামুটি বন্ধুহীন ও নিঃসঙ্গ কাটালেও দুএকজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। এদের একজন ইরফান ও তার স্ত্রী খুরশীদ। মদ্যপানে প্রবল আসক্তি ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁকে অনেকেই পছন্দ করতেন। লিবিয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিল যাতে তিনি কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, মদ্যপান কমে। বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে তাকে আবার একই জায়গায় রাষ্ট্রদূত করা হয়। কিন্তু সে পদ গ্রহণের আগেই তিনি পরলােকগমণ করেন। খুরশীদের ছােট বােনকে বিয়ে করেন ড. কামাল হােসেন যাকে মিঠা উল্লেখ করেছেন। ‘more catholic than the Pope’ হিসেবে। অবসর গ্রহণের পর লিখেছেন মিঠা, তিনি জানতে পারেন, খুরশীদ করাচিতে আছে। ঠিকানা খুঁজে বের করে তিনি সস্ত্রীক তার সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু খুরশীদ তার সঙ্গে খুব শীতল ব্যবহার করেন। মিঠার ভাষায়, “We went to see her and were shocked and very upset to be received with a cold and hostile attitude. Neither of us has understood the reason for this attitude to this day…” [পৃ. ২৫৯]  মিঠার এ বক্তব্যে বরং আমরা বিস্মিত হই । ১৯৭১ সালে মার্চে যে গণহত্যা চালানাে হয় যাদের নির্দেশে মিঠা ছিলেন তাদের একজন। পাকিস্তান রক্ষায় তিনি নিয়ােজিত ছিলেন’ বা হুকুম মেনেছেন- এসব কথা বলে সে দায় এড়ানাে সম্ভব না। এ সহজ সত্য মিঠারা কখনাে বােঝেনি। এর অনেক পর আবার তার মেয়ে ইয়ামিনা ঢাকা এলে খুরশীদ তাকে  আপ্যায়ন করেন। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান কিন্তু একবারও ইন্দুর কথা জিজ্ঞেস করেননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে মিঠা যে মন্তব্য করেছেন সেখানে বােঝা যায়, গণহত্যার বিষয়টি তার মনে আছে কিন্তু ব্যক্তি দায় তাে তার নয়, তা হলে কেন এত বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে। তার ভাষায়- “It is puzzling and heartrending how there ‘partitions’ seem to lead to the break up of life-long friendships especially as neither friend seems to have done anything wrong personally.” [পৃ. ২৫৯]

 

সূত্র : পাকিস্তানী জেনারেলদের মন -বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন