You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.02 | আমলাশাহীঃ পাকিস্তানের প্রাণসংহারী ফ্রাঙ্কেনসটাইন মোবাশ্বের হাসান | ঢাকা ডাইজেস্ট - সংগ্রামের নোটবুক

আমলাশাহীঃ পাকিস্তানের প্রাণসংহারী ফ্রাঙ্কেনসটাইন

মোবাশ্বের হাসান

ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও বিশ্লেষণ ইনষ্টিটিউটের পত্রিকায় ১৯৭৩ এর জুলাই সংখ্যায় জয়ন্ত কুমার রায় পাকিস্তানের আমলাকুলের আমলনামা লিখেছেন ব্যুরোক্রেসী ইন পাকিস্তান শিরোনামে।
ক্ষমতার উৎস হিসাবে অরাজনৈতিক কাঠামো— আমলাতন্ত্রের উপর ক্ষমতাসীন প্রধান রাজপুরুষদের অসতর্ক অন্ধ নির্ভরশীলতা পাকিস্তানের অনেক অঘটন ও পরিণতির জন্য দায়ী। রায় বাবুর প্রতীতী, আমলাতন্ত্রই পাকিস্তানের আধিপত্য করেছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর, আর বিপর্যয় ওকারণেই। শিল্পপতি গোষ্ঠী আর বিদেশী প্রভুদের সাথে আমলাকুলের হৃদ্যতার ক্রমপ্রসার একসময় পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রকে জগদ্দল করে তোলে।
সন্দেহ নেই, ৪৭ এর দেশ বিভাগ কালে পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র বেশ সুগঠিত ছিল। নবরাষ্ট্রের প্রাথমিক সংকট যেভাবে তারা মোকাবেলা করেছিল জিন্না-লিয়াকতের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পক্ষে তা মোকাবেলা করা সম্ভব ছিলনা। এর সাক্ষ্য রয়েছে আইয়ুবের তথাকথিত আত্মজীবনীতে, ভারতীয় একাউন্টস সার্ভিসের নিম্নকাতারের কৃত্যক চৌধুরী মোহাম্মদ আলী লিয়াকত আলী খানের অতীব আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। আইয়ুবের খুশীর ফিনকি, “অনেক সময় আমার মনে হতো তিনি (লিয়াকত) আমার উপর বেশী থেকে আরও বেশী নির্ভরশীল হয়ে চলেছে।” তখন আইয়ুব দেশরক্ষার স্থল বাহিনীর সেনাপতি। জয়ন্ত বাবু লিখেছেনঃ মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে আস্থা স্থাপনার মত সহকর্মীর একান্ত অভাব জিন্না-লিয়াকতকে আমলাতন্ত্র নির্ভর করে তোলে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তাঁর বইতে লিখেছেন মুসলিম লীগের নেতৃত্ব রাজনীতিকদের ব্যাপারে এমনি সন্দেহগ্রস্ত ছিল যে, জিন্না আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকদের তৎপরতার ওপর চোখ রাখতে আদেশ দিয়ে বসেন এবং আমলাতন্ত্রকে সতর্ক করে দেন যে, খেয়াল রেখো, রাজনীতিকরা অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। নবীন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সমস্যায় আমলাদের প্রশংসনীয় ভূমিকায় অত্যুৎসাহ পেয়ে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী দাবি করে বসলেন, সঙ্গত পরিপক্কতার… (অস্পষ্ট) জন অভিজ্ঞ রাজকর্মচারী দেশের নীতি নির্ধারণের অবস্থানে পৌছে বহু বছর ধরে এক নাগাড়ে তারা চালিয়েছে দেশ।
পরে ধাপে আমলাতন্ত্রের এই আত্মপ্রত্যয় রূপ বদলে রাজনীতিক বৈরিতায় উপনীত হলো পাকিস্তানে। চৌধুরী সাহেব লিখলেন, “অন্তর্দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত রাজনীতিকরা আমলাতন্ত্রের শ্রদ্ধা হারিয়েছে।” এরপর পুনশ্চঃ “রাজনীতিকরা আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতাই রাখেনা।”
জয়ন্তবাবু এর সার সংকলন করেছেন এভাবেঃ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণবিহীন অবস্থায় কাজ করার অভ্যাস সাধারণভাবে রাজনীতিকদের প্রতি আমলাদের অশ্রদ্ধার মনোভাব জন্ম দিল। এই অশ্রদ্ধার জন্ম পরবর্তী ধাপে আমলাকে এনে দিল নিজ কৃতিত্ব সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যয়। তা থেকে ক্রমে ক্রমেই গজিয়ে উঠতে শুরু করলো পাকিস্তানী আমলাদের উচ্চাভিলাষ।
অডিট সার্ভিসের কৃত্যক পুরুষটি পাকিস্তান সরকারের মহাসচিব হিসেবে চারখানি বছর দায়িত্বপালনের সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সাধক এবং মন্ত্রীপর্ষদের সচিবরূপে সাফল্য দেখিয়ে ১৯..(অস্পষ্ট) ১ সালে “সে পদ ছাড়লাম। ডাক পড়েছে আমার অর্থ মন্ত্রী হবার জন্য।” সেখানেও রাজনীতিক বশীকরণে উৎফুল্ল চৌধুরী সাহেবঃ ‘আমি যা ই বলতাম মন্ত্রীপর্ষদ তাই শুনতো।” চৌধুরী সাহেবের ভাষা, “তারাও দেশ প্রেমিক।”— অর্থাৎ দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দেবার কতৃত্ব রাজনীতিকদের হাত থেকে আমলাদের হাতে চলে গেল ১৯৫১ সালের মধ্যে।
খালেদ বি সাঈদ পাকিস্তানের প্রশাসনিক ইতিহাসেও এই ইতিবৃত্ত স্বীকার করেছেন। রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যে চলছিল সংঘাত। ব্রিটিশ আমলের রাজকর্মচারী বাহিনীর ধারা ধারাবাহিকতায় উপনীত পাকিস্তানে। রাজকৃত্যরা ভাবতো, আগের মত করে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত অবস্থাইতো সেরা। স্বাধীনতার পর পরই আমলাতন্ত্র অপরিমেয় ক্ষমতা হাত করে বসলো।
মজার ব্যাপার হলো এই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শক্তির মধ্যে আপোষ রফার পথও ছিলনা। কারণ, আমলা ও রাজনীতিকদের সামাজিক বলয় ভিন্ন। আড্ডার আসরে তাদের দেখা সাক্ষাৎ, সামাজিক সমভুমে তাদের মিলন দুর্নিরীক্ষ। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল বুড়ো রাজনীতিক ও সামরিক অফিসাররা।
আঞ্চলিক ভেদবৈষম্যের সূত্রপাত সংঘাতের সূচনা এদের হাতে। সামরিক-বেসামরিক পাঞ্জাবী আমলারা বাঙ্গালীদের প্রতি চরম ঘৃণ পোষণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর সংখ্যালঘুর দুঃশাসন মামালো। গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে বাধা দিল নিদারুণ। মিয়া মোহাম্মদ ইফতেখারের সব আঙ্গুল গুণতু মুষ্টিমেয় রইলেন এই চক্রান্তের বাইরে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার দাবীতে যে আন্দোলন গড়ে উঠলো তাকে সাংস্কৃতিক অধিকার বলে সরাসরি অস্বীকৃতি জানালেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলীরা। ১৯৪৮ সালের ২৪শে মার্চ ঢাকায় অভিষেক ভাষণে জিন্নার উর্দু চাপানোর জেদ মূলতঃ বাঙ্গালী বিদ্বেষে সংহত হয়ে ওঠা আমলাতন্ত্রের প্রথম অভিপ্সাকেই প্রতিধ্বনিত করে।
এর প্রমাণ পরবর্তীকালে আমলাদের এমনকি সামরিক আমলাদের স্বীকারোক্তিতে মেলে ।আইয়ুবের জীবনীকার কর্নেল মোহাম্মদ আহমদও ভাষা আন্দোলনের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছেন। আইয়ুব এই আন্দোলনকে বলতেন, “ছাত্রদের সময় কাটানোর খেলা।” কিন্তু উপেক্ষা করার মনোভাবই তাতে ছিলনা, ছিল এ আন্দোলনের প্রতি গোপন হিংসা। আইয়ুব সরাসরি বলেছেন, “বিক্ষোভের ধারা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।”
বৃটিশ আমলের ঔপনিবেশিক শাসনের হাতিয়ার আমলারা নিঃসন্দেহে অধিকাংশ অবাঙ্গালী— ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয়ের হোমরা পদগুলো দখল করে বসে। রাজনীতিকরা তাদের পেছনে পেছনে হাঁটবার মানুষে পরিণত হয়। পূর্বাঞ্চলে প্রথম চীফ সেক্রেটারী বা মুখ্য সচিব হয়ে আসেন পাকিস্তানের বর্তমান পররাষ্ট্র ও দেশ রক্ষামন্ত্রী আজিজ আহমদ।
কেন্দ্রের সমর্থন — অন্যকথায় কেন্দ্রে রাজনীতিকদের উপর আধিপত্য পাওয়া আমলাদের সমর্থন নিয়ে আজিজ লোক নিয়োগ এমনকি গৃহবরাদ্দের মত সাধারণ ব্যাপারেই রাজনীতিকদের উপেক্ষা করার দুঃসাহস প্রদর্শন করে। স্বীকার্যে যে, এই ঔদ্ধত্য চ্যালেঞ্জ করার মত জোরদার রাজনৈতিক প্রবাহ সেদিন ছিলনা।
দূর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের একটা ভয় অন্ততঃ থাকে, তাকে একটা সময় অন্তর জনগণের সামনে হাজির হতে হয়। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধুসাধ্বীর লেবাস নিয়ে যে আমলাতন্ত্র দেশত্রাণে হাজির হয়, সে একবার নিজের ওপর থেকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ খসিয়ে দিতে পারলে তখন তার ল্যাজ নাগাল পাবার কেউ থাকেনা। আমলনামা লিখবার কেউ যখন না থাকে তখন এই আমলারা দুর্নীতিতে খুব আয়েশে নির্ভাবনায় হস্তপদ ডুবিয়ে নিমজ্জিত হয় আকণ্ঠ সুখে। পাকিস্তানেও তাই হয়েছে।
দেশের পরিকল্পনা থেকে দেশরক্ষা, আইন থেকে হাসপাতাল সবকিছু তাদের ইচ্ছার বশবর্তী হবার পর তারা দুর্নীতিতে নেমে যা করেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল আইয়ুব আর ইয়াহিয়া। মজার ব্যাপার, সামরিক আমলাতন্ত্র থেকে আগত এই মনুষ্যদ্বয় আমলাতন্ত্রের ঘরের কথা বাইরে ফাঁস করে জন আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে আশ্বাস দেয়, আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতি মুক্ত করা হবে। কিন্তু মগডালে বসে আগডাল কাটা যায় না—ক্ষমতার ভিত্তিকে উচ্ছেদ করতে পারেনা ক্ষমতাসীন— তাই সামরিক আমলাতন্ত্র থেকে আগত মনুষ্যদ্বয় তাদের ক্ষমতার ভিতে নখ বসালেও কোপ বসাতে সাহস পায়নি। উন্নয়ন দশক নামক স্থিতিশীলতার স্বর্গরাজ্যে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি পৌঁছেছিল উচ্চাঙ্গ ও সার্বজনীন মাত্রায়। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবে তখন আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধি আইয়ুব আমলাতন্ত্রকে আড়াল করে পুনঃপৌনিক অভিযানে নামেন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। সে সময় রাজনীতিকদের একদলকে আরেকদলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে আইয়ুব প্রাণপ্রিয় আমলাতন্ত্রকে রক্ষা করে।
দেশবিভাগের ৪৭-এর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রাজনীতিকরা দেশের কার্যাবলী দ্রুততার সাথে সম্পাদন করার জন্য জিন্নার হাতে তুলে দেয় ক্ষমতা, মন্ত্রীপর্ষদকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার। করুণ ব্যাপার হলো এই ক্ষমতা জিন্নার হাত থেকে কখন যে আমলাদের এখতিয়ারে চলে গেছে রাজনীতিকরা তা টেরও পেলেন না। খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষণিকের তরে পার্লামেন্টের শক্তি পুনরুদ্ধারের প্রয়াস পেলেও পরক্ষণে তার অনুবর্তী গোলাম মোহাম্মদ এসে রাষ্ট্রের কর্ণধার হলেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতাকে মিলিয়ে দিলেন আমলা ক্ষমতার বন্ধ জনস্রোতে।
জয়ন্তবাবু পাকিস্তানের সমগ্র ইতিহাস নিরীখ করে বলেছেন, আমলা তন্ত্রের অশুভ উত্থানের জন্য দায়ী বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের সঙ্গে জিন্নার প্রত্যক্ষ সংযোগ। ১৯৪৯ সালে গণপরিষদ পাবলিক এন্ড রিপ্রেজেন টেটিভ অফিসার্স ডিসকোয়ালিফিকেশন এ্যাক্ট —‘প্রোদা’ আইন পাশ করে গভর্ণর জেনারেল ক্ষমতা নিলেন তাতে রাজনীতিকরা হয়ে পড়লো করুণার পাত্র।
বৃটিশ অফিসারদের বিদায়ের পর তরতর করে পাকিস্তানী আমলারা উঠে গেল মহাশীর্ষে। আইয়ুবের ভাষায় “ভাগ্যবান বলতে হবে আমাকে, ব্রিগেডিয়ার হয়ে গেলাম তখুনি।” এ হচ্ছে পদসমূহের গুরুত্বের অমূল্যায়নের সূত্রপাত। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব যখন ফিল্ড মার্শাল বনে গেলেন, তখন জনগণ হেসেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, অবমূল্যায়নের সূচনা ৪৭- এই শুরু হয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রের উত্থান ঘটে সামরিক ব্যয়বৃদ্ধির সাথে সাথে। ৪৭-৪৮ এ রাজস্ব ব্যয় যখন ২০ কোটি, প্রতিরক্ষা বাজেট তখন ১৫ কোটি ৩৮ লাখ। ৫১-৫২তে এ অনুপাত ১২৭ঃ৬৫ কোটি। ৫৭-৫৮তে ১৩৪ঃ৮৫। ৬৫-৬৬তে ৩৭৯ঃ২৮৫। ৭০-৭১ এ ৬৪৬ঃ ৩২৯। ৭১-৭২ এ ৫৮৯ঃ৪২৬।
ভারত থেকে হিজরত করা নবাবজাদা লিয়াকত আলীই বোধহয় আমলাতন্ত্রের একমাত্র কাঁটা হয়েছিল। প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে উঠে আবার রাজনৈতিক স্রোতস্বিনীতে প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্খা নবাবজাদার। কিন্তু তিনি বোঝেননি, তাতে আস্কারা পাওয়া আমলাদের ক্ষমতাস্পৃহা আঘাত পাবে। তিনি বুঝেই করুন আর না বুঝেই করুন, তাকে এই আমলাতন্ত্র বিরোধিতার মূল্য দিতে হয়েছে প্রাণ দিয়ে। আইয়ুব তখনও ছোট আমলা। ব্রিগেডিয়ার হতে পেরেই খুশীতে বাগবাগ। অনেক খবরই তার আড়াল। তাই লিয়াকত মরে যাবার পর শোক বিলাপ আউয়ুব শুরু করে দেয়। কিন্তু চৌধুরী মোহাম্মদ আলী আর গোলাম মোহাম্মদকে আইয়ুব এ ব্যাপারে কোনদিন আফসোস করতে শোনেননি। আইয়ুব এক প্রসঙ্গে তাই বলেছিলেন, কী পাষণ্ড এরা!
ননি বা পাষাণের কিছু নেই এতে— স্বার্থই পরমার্থঃ তার প্রমাণ লিয়াকতের মৃত্যুর পরপরই ঘটলো দুটো নিযুক্তি প্রথম গোলাম মোহাম্মদ হলেন গভর্ণর জেনারেল, দ্বিতীয়, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বনলেন অর্থমন্ত্রী। এই নিযুক্তির কথা আইয়ুবও বলেছেন ঐ ‘পাষণ্ড’ প্রসঙ্গে— তবে নামোচ্চারণ না করে।
পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রের পরিচালনায় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র শুরু হলো। শুরু হলো সংবিধান রচনায় দীর্ঘ সূত্রিতা। গণপরিষদের বাঙ্গালী সদস্যরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, অযথা বিনা কারণে গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল ও মূলতবী করে দেওয়া হতো। বাঙ্গালী সদস্যরা সমবেত হলে দেখা যেতো পাঞ্জাবী সদস্যরা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর ঘরে বসে চা যোগে আপ্যায়িত হচ্ছে।
পাকিস্তানে সব রাজনীতিকের নিদারুণ শোচনীয় দশা। কেবল দৌলতানাজী আজো লন্ডনে রাষ্ট্রদূত গিরি করছেন। এ মাহাত্ন্যের মূলে ধুরন্ধর দৌলতানাজীর আমলাতন্ত্র তোষণ পুরোপুরি। তিনি ১৯৫২ থেকেই আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হলেন। সলা দিতেন। পলিটিক্স জব্দ করতে এই পতগ হবে মোক্ষ। ১৯৫৩ সালের ১৭ই এপ্রিল নাজিমুদ্দিন সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থনধন্য থাকা সত্ত্বেও তাকে নাকচ করে দিয়ে গোলাম মোহাম্মদকএ গভর্ণর জেনারেল করা হলো। আজও পাকিস্তানের রাজনীতিকরা যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে সে পাপ তারা করেছিল সেদিন। নাজিমুদ্দিনকে তাড়িয়ে তারা আমলাতন্ত্রের বিজয় লক্ষ্য করতে পারেনি, এই ভেবে সুখ পেয়েছে যে, পূর্বাঞ্চলের একটা লোক ন্যাকা হলো ভীষণ।
তারপর ১৯৫৪ সালের ২৪শে অক্টোবর গোলাম মোহাম্মদ যখন গণ পরিষদ ভেঙ্গে দিল তখন টনক নড়লো বাবাজীদের। কারণ, ততদিনে সংবিধান প্রায় প্রস্তুত। জিন্নার প্রতি তর্পন নিবেদন করে ১৯৫৪ র ২৫শে ডিসেম্বর (জিন্নার জন্মদিন) সংবিধানটা পাশ করবার জন্য গণপরিষদ বসেছিল। ২৫শে ডিসেম্বরের পর সংবিধান ঠেকানো সম্ভব হবেনা ভেবে আমলাতন্ত্র ২৪শে অক্টোবরই আঘাত করলো।
পাকিস্তানের অন্তিমকাল পর্যন্তই এই আমলাতন্ত্রের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ ছিল আজও আছে। ১৯৬৯-এ আইয়ুর ইয়াহিয়ার ক্ষমতা বহন করেছে দুই দশকের ক্ষমাবাহী আমলারাই।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকুলের সাথে বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের দহরকমকে পাকিস্তানের একজন ছাত্রনেতা স্রেফ ‘সঙ্গম’ (কপুলেশন) শব্দ দিয়ে অতিবাহিত করেছিলেন। আমলাদের অবসর নিয়ে যোগ দিতে দেখা যেতো কোন বিরাট ব্যবসা সংস্থার মোটা অংকের বেতনের পদে। তারা হতো ডিরেক্টর। আসলে,চাকুরিকালে শিল্পপতি ও ব্যবসাপতিদের এরা রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার যে মদত দিতো, অবসরের পরে তার প্রাপ্তি তুলতে যেতো মাত্র। এশিয়ার বৃহত্তম কাগজকল কর্ণফুলী মাত্র ৩ কোটি টাকা দামে দাউদরা কিনে নিয়েছিল—এর মাহাত্ন্য ওখানেই। পাকিস্তানের শিল্পখাতের হিসাবতো আজও খুঁজে পাওয়া যায়। সে হিসাব অনুযায়ী কর্ণফুলী কাগজ কলে সরকারী বিনিয়োগ ৮ কোটি টাকা। ৮ কোটির মাল ২ কোটিতে কিনতে পেলে আমলাদের পূজো শিল্পপতিরা কেন করবেনা বলুন।
তারপরও আছে অনেক ব্যাপার। পাকিস্তান আমলে কৃষিপণ্যের দাম কোনদিন বাড়েনি। জ্বীনা, তা জনগণের স্বার্থে নয়, স্রেফ শিল্পপতিদের স্বার্থেই। শিল্প খাতে বসে সস্তা কৃষিপণ্যের ও কাঁচামালের মজা যেন শিল্পপতিরা লুটতে পারে, তারই উদার ব্যবস্থা ছিল কৃষি পণ্যের মন্দা দরে। কৃষিপণ্যের রপ্তানী বাণিজ্যেও এই মজা লুটবার ফুরসত করে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। আর যে আয় হতো বৈদেশিক মুদ্রায় তা খরচ হতো ঐ উচ্চশ্রেণীর বিলাসব্যসনে।
আইয়ুবের ভূমি সংস্কার ছিল এমনি ধারার। আমলারা কোন এলাকার পতিত জমি জলের দরে কিনে তারপর সেখানে ঘোষণা করত শহর স্থাপন প্রকল্প। আইয়ুব নিজে পতিত জমি কিনে সরকারের কাছে লিজ দিয়েছিল সফেদ বাগান করতে, ঠিক তত বছরের জন্য, যতদিনে সফেদ ফলতে শুরু করে। অবশ্য ব্যবসায়ী— আমলাদের সঙ্গম ব্যাপ্ত হয় ৫৮ র পর থেকে।
আইয়ুব পরিবার আখ এলাকা ও চিনি কলের মালিক। ৪ বছরের মধ্যে গওহর আইয়ুব কোটি পতি হয়ে যায়। পরিবারটির মোট সম্পত্তি দাঁড়ায় ২৫ কোটি টাকায়। এ সবকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা এবং আমলাদের জমির ফটকা বাজারী জোরদার করার জন্য রাজধানী করাচী থেকে ইসলামাবাদে হিজরত করে।
আমলাচক্রের জানের জান কোথায় গাঁথা তা উপলব্ধি করা যায় ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর প্রথম মন্ত্রী পর্ষদের বৈঠকে আইয়ুবের উক্তিঃ আমার গণনার মধ্যে, সংশ্লিষ্ট ভাবনার হিসেবে দূতাবাস বলতে একটিই আছে তা মার্কিন দূতাবাস।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ যখন মুক্ত হয়ে যাচ্ছিল তখনও ইয়াহিয়া বসেছিলেন ত্রাতা হিসেবে। সেই মহামান্বিত ত্রাতা। আমলা পরিবেষ্টিত হয়ে ভুট্টো আজও সে জগদ্দল বয়ে চলেছে। চলেছে বললে ভুল হবে, ভুট্টোও লালিত ও চালিত আমলাতন্ত্রের হাতেই। বহুবার উচ্চারিত একটি মন্তব্য তাঁর ব্যাপারে, হি ইজ এ শো বয়। কিন্তু কার?—নিঃসন্দেহে আমলাতন্ত্রের।
পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের ইতিহাস ‘…(অস্পষ্ট) দো পীর’ গল্পের মতই ট্রাজিক। লিয়াকতের প্রাণসংহারের মধ্য দিয়ে রাজনীতিকদের প্রতি আমলাতন্ত্রের আদেশঃ যাওয়া বাচ্চা শো যাও। ‘কার্যকর হলো ৫১তেই কিন্তু সেই যে ‘বাচ্চা শুইল আর উঠিলনা’।