বর্তমানে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে সৎ ও ত্রাতারূপে তেমনভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে না এবং পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার জন্য প্রধানত। সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে। এ নিয়ে খােলাখুলি লেখালেখি হচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বা যৌথ কমান্ডের কাছে। ঢাকায় আত্মসমর্পণ [অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিম সীমান্তে ব্যর্থতা] এখনাে সেখানকার মানুষজন, বিশেষ করে এলিট ও স্টাবলিশমিন্ট মেনে নিতে পারছে না। পাকিস্তান ভাঙার জন্য সে সময়কার কর্তাব্যক্তিদের দায়ী করা হচ্ছে। যারা ১৯৭০-৭১ সালে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের কাছে এটি বিব্রতকর ।আরেকটি বিষয়ও প্রাসঙ্গিক এখনও গণহত্যার প্রসঙ্গ উঠে আসছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে- এ কথা শােনার পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। গণহত্যার প্রসঙ্গ এলে শুধু সেই সময় যারা ছিলেন তারাই নয়, বর্তমানে যারা আছেন তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে। কারণ, গণহত্যার দায়দায়িত্ব বর্তাচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর। এসব কারণে, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে জেনারেলরা বা সেনা কর্মকর্তারা] বই লিখছেন উল্লেখ্য, সেই ১৯৭২ থেকেই এ ধরনের বই লেখা। হচ্ছে যার খবর আমাদের অনেকের জানা নেই। ১৯৭২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। প্রকাশিত জেনারেলদের ২১টি বই আমি আলােচনার জন্য বেছে নিয়েছি। নিচে বছরের ক্রম হিসেবে বইগুলির নাম দিচ্ছি। উল্লেখ্য সবগুলি বই-ই ইংরেজিতে। লেখা
সম্পর্কি এ বই হলাে : The Report of the Hamoodur Rahman Commission of Inquiry in to the 1971 War, Lahore (vanguard)
আত্মজীবনীগুলি পড়লে বােঝা যাবে এক ধরনের ইতিহাসতত্ত্বের কাঠামাে তারা তৈরি করেছেন এবং সেই কাঠামাের আওতায় বইগুলি (দু-একটি ব্যতিক্রম হতেই পারে) লেখা হয়েছে। আলাদা আলাদাভাবে পড়লে বিষয়টি ততটা সুষ্ঠু হবে না হয়তাে। কিন্তু এ ধরনের বেশ কিছু বই একসঙ্গে পড়লে কাঠামােটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে এবং বােঝা যায় কিছু পূর্ব ধারণা নিয়ে বইগুলি রচিত হয়েছে। এ ইতিহাসতত্ত্বের ভিত্তি গণতন্ত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কে পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত ও নীতিনির্ধারক এলিটদের চিন্তা-ভাবনা। কয়েকবার পাকিস্তান যাওয়ার সুবাদে আমার সুযােগ হয়েছিল সেখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলার। তাদের সঙ্গে আলােচনার পর ধারণা হয়েছে তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে জেনারেলদের চিন্তা-ভাবনার বেশ মিল। ফলে, বলা যেতে পারে, এ ইতিহাসতত্ত্ব বিচ্ছিন্ন কোনাে বিষয় নয়, পাকিস্তানের মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গিই এ তত্ত্ব নির্মাণে সাহায্য করেছে। তবে, যারা বামপন্থী তারা এর সঙ্গে একমত নন। কিন্তু এ বিষয়ে তারা প্রকাশ্যে বলেন না। জেনারেলদের মনােভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বােঝা যায়, কিছু পূর্ব ধারণা তাদের মনের গহীন গভীরে গেঁথে আছে। প্রাক-পাকিস্তান ও পাকিস্তান পর্বের রাজনীতি এ ধারণার সৃষ্টি করেছে। অনেকে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলােচনা শুরু করলেও দেখা যায় অন্তিমে এ পূর্ব ধারণা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেননি। এ পূর্ব ধারণার সৃষ্টির ভিত্তি, ইতিহাস ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা। সামাজিক সংগঠিত সমাবেশের ক্ষেত্রে ইতিহাস একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্ষমতায় যাওয়ার পটভূমি তৈরি করতে পারে যা পরে দিতে পারে ক্ষমতার বৈধতা । ১৯৪৭ সালের আগে ভারতে মুসলমান নেতৃবৃন্দ সামাজিক সংগঠিত সমাবেশ ঘটানাের জন্য ইতিহাসের সূত্রগুলি তুলে ধরতে চেয়েছেন। তারা মুসলমান নৃপতিদের কথা তুলে ধরেছেন, যারা শৌর্যে-বীর্যে ছিলেন অতুলনীয় এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন ভারতীয় মুসলমানরা তাদেরই বংশধর। ইসলামী শাসনের যুগ স্বর্ণ যুগ। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের (কংগ্রেস] চক্রান্তে আজ তারা হীনাবস্থায়। এই হীনাবস্থা থাকবে না যদি মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য, অর্থনীতির বঞ্চনাটাই ছিল মূল প্রতিপাদ্য।
এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান আন্দোলনের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্গের, ভূস্বামী বা ক্ষয়িষ্ণু ভূস্বামী । অন্য অর্থে সামন্তবাদী। ধর্ম ব্যবহার তাদের স্বার্থ রক্ষায় সহায়তা করেছিল। জিয়াউল হক এর ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, “সামাজিক দায়িত্ববােধ ও সততা থেকে বিচ্ছিন্ন এই ধর্মবােধের উপর বেশি গুরুত্ব নানারকম ভণ্ডামীর জন্ম দেয় এবং শাসক শ্রেণীর হাতকেই আরাে শক্তিশালী করে। ধর্মের রাজনীতিকরণ দরি জনগণের বিভ্রান্তি ও তাদের উপর শােষণকেই আরাে বৃদ্ধি করে এবং যে দুর্নীতিকে তারা চারিদিকে দেখে আসছে এবং যে দুনীতির ভেতরে তারা সুদীর্ঘকাল ধরে আটকে রয়েছে, সেটাই বৃদ্ধি করে। ধর্মের বাহ্যিক আচার-আচরণ এক ধরনের প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করে যা দিয়ে এর প্রবক্তারা নিজেদেরকে সামন্ত তন্ত্র ও পুঁজিবাদ সৃষ্ট দুর্নীতির ক্লেদ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে।” ইতিহাসের এই ব্যবহার মুসলমান তরুণদের সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে। এবং পাকিস্তান মানসিকতা তৈরি করেছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, পাকিস্তান মুসলমান, ভারত হিন্দু। এই মানসিকতা গঠন এত তীব্র ছিল যে এর রেশ এখনাে উপমহাদেশের মুসলমানদের পক্ষে একেবারে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। হিন্দুদের পক্ষেও, হয়তাে ১৯৪৬ সালে, এ কারণে শরত্বসু ও সােহরাওয়ার্দীর স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব গুরুত্ব পায়নি, না মুসলিম লীগ না কংগ্রেসের কাছে। মুসলিম লীগ তখন এবং পরবর্তীকালে সফলভাবে এই তত্ত্ব প্রয়ােগ করেছে।
পাকিস্তান হওয়ার পরও শাসকরা ইতিহাসের ক্ষেত্রে একই নীতির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে, আমরা যারা পড়াশােনা করেছি তাদের মধ্যে এই বােধই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই সময় মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম রচিত দশম শ্রেণীর পাঠ্য পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টিতে (১৯৬৯) “খিলাফত আন্দোলন, লক্ষৌ চুক্তি ও অসহযােগ আন্দোলন’ অধ্যায়ের উপসংহারে দেখান হয়েছে, জিন্নাহ কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, খিলাফত আন্দোলনের বিরােধী ছিলেন অর্থাৎ তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদেই বিশ্বাস করতেন) “কিন্তু এই আন্দোলন চলাকালেই তাহার জ্ঞানােম্মােষ হয়েছিল যে, উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান দুইটি সম্প্রদায় দুইটি পৃথক জাতি এই সময়টিতেই একদিকে গোঁড়া হিন্দু মহাসভীদের আর অন্যদিকে উগ্রপন্থী কংগ্রেসীদের হাতে মুসলমানদের বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাই এই সময়েই কায়েদে আজম মুসলিম লীগের স্থায়ী সভাপতির পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন। অত্যুক্তি হবে না যদি বলা হয় যে, লক্ষৌ চুক্তির ব্যর্থতা এবং খিলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসমূহই পাক-ভারতের কোটি কোটি মুসলমানকে ১৯৪৭ সালে মুক্তির পক্ষে নেতৃত্ব দানে জাতির পিতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রয়ােজনীয় মনােবল ও প্রেরণা যােগাইছিল। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় যা বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল, ছাত্রদের দাবির মুখে দেশ ও কৃষ্টি পাঠ্য তালিকা থেকে প্রত্যাহার করতে বাের্ড বাধ্য হয়। অন্যদিকে, ভারতেও এই ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে ভাবনার জগতে।
ভারত ভাগের পর ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন বা যে তত্ত্ব প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তা হলাে, ভারত বিভাজনের জন্য মুসলমান বা মুসলিম লীগই দায়ী। এর সমালােচনা যে খানিকটা হয়নি তা নয়। তবে দল হিসেবে কংগ্রেস ও কংগ্রেসের আদর্শে বিশ্বাসীরা এই তত্ত্ব বেশি প্রচার করেছেন যাতে ভারত বিভাগের দায় তাদের ওপর না পড়ে। বাংলা বিভাগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জী দেখিয়েছেন এর সবটাই সত্য নয়। তিনি লিখেছেন, ১৯৮০ সালে যখন তিনি গবেষণা শুরু করেন, “তখন একটা সাধারণ ও অনুকূল ধারণা প্রচলিত ছিল যে ভারত বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ। হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোনাে কিছুই করেনি ঐ সময়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে, স্বাভাবিক ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য হলাে সহনশীল এবং বহুত্ববাদী তাই হিন্দুত্বে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযােগ নেই। … ঐ গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার হিন্দু ভদ্রলােকদের (elites) ক্ৰম-সহিষ্ণু ক্ষমতা, ধন-সম্পদ ও মর্যাদা হুমকীর সম্মুখীন হওয়ায় তারা সামাজিক অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ঐ কূট-কৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িক হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।” গত শতকের শেষ দশক থেকে ভারতে আবার হিন্দুত্ববাদের বা রাজনীতির প্রবল প্রতাপ, তাতে, জয়া জানাচ্ছেন, তার যুক্তিগুলিই “কত বিতর্কিত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।”
গত দু’শ বছরের ইতিহাস চর্চায় এ ধরনের অসঙ্গতি সব সময় ছিল । ভাবতে বা বাংলায় কী ধরনের ইতিহাস লেখা হয়েছে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ইতিহাসের উত্তরাধিকার প্রবন্ধে। যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস প্রবন্ধটি নিত্য আমরা উদ্ধৃত করি আমাদের ইতিহাস রচনার স্বল্পতা ও ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সেটি সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যাবে আসলে বঙ্কিম কাদের বাঙালি মনে করতেন এবং কাদের ইতিহাস তিনি চেয়েছিলেন। বাঙালি তাঁর কাছে ছিল হিন্দু বাঙালি, অন্যরা তাে নয়ই এমনকি মুসলমান বাঙালিরাও এই সংজ্ঞার বাইরে ছিল। সেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারা অব্যাহত থেকেছে, জোরদার হয়েছে, মাঝে মাঝে রাজনৈতিকভাবে পরাজয়ের কারণে পিছু হটেছে কিন্তু সব সময়ই ঐ ধারা পুষ্ট ছিল এবং ১৯৯০-এর দিকে তা আবার প্রবল হয়ে ওঠে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “সেকুলার ইতিহাস চর্চার সংকট এইখানেই আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এই জন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে। এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান। উপাদান। সত্যি বলতে কি বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলে একটা সাংঘাতিক সত্য বেরিয়ে আসবে। সেটা হলাে যে, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিচ্ছবি, আয়নায় মুখ দেখার মতাে তার রূপ। আকৃতি গড়ন, অবিকল এক।” স্বল্প মেয়াদী সুবিধার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি মাঝে মাঝে এমন পন্থা গ্রহণ করে যা অন্তিমে শুধু তাদেরই নয় দেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। এবং এ পন্থা তারা গ্রহণ করে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে। অর্থাৎ অনেকক্ষেত্রে ইতিহাস বিশ্লেষণে বিপরীতমুখি দুটি দল বা ধারার আঁতাত বা সমঝােতা হতে পারে। গত শতকের আশির দশকে ভারতের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। হিন্দুত্ববাদ বিকাশের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন আবার পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। তাদের ক্রমবর্ধমান প্রাধান্যে কংগ্রেস ও হিন্দু মৌলবাদী দলগুলি শংকিত ছিল। তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল, ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টি গাদ্দারের ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং ইঙ্গিতটি হচ্ছে স্বাধীন ভারতে তাহলে কমিউনিস্ট পার্টির বৈধতা কী?
অন্যদিকে কংগ্রেস স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে আর হিন্দু মৌলবাদী দেশগুলিতে হিন্দুরই প্রতিনিধি। প্রখ্যাত সাংবাদিক অরুণ শৌরি পরে বিজেপির ‘দি গ্রেট বিট্রেয়াল’ নামে চার কিস্তিতে এক প্রবন্ধ লিখে আক্রমণ পরিচালনা করেন। কমিউনিস্ট নেতা নাম্বুদ্রিপাদ তখন বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বমূলক শাসন ও ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল লড়াই করছে এবং এখন তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে অকমিউনিস্ট দলগুলি। এতেই দুপক্ষ আতঙ্কিত হয়েছে। উল্লেখ্য অরুণ শৌরি শতকে বিজেপি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই ধরনের আঁতাত বিজেপিকে সহায়তা করেছে। পরবর্তীকালে বাবরি মসজিদ ঘটনায় ইতিহাস ব্যবহার করে তারা জনমত সংগঠন করেছে। তারা কতটা উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে তা ব্যক্ত করেছেন কয়েকজন ঐতিহাসিক। “উর্দুকে বিদেশী ভাষা এবং দাসত্বের সূচক বলে নিন্দা করা হয়, যদিও উর্দুর জন্ম ভারতে। একটি প্রবন্ধের জোরালাে আওয়াজ : “উর্দুর নামে আর একটি পাকিস্তান যেন না হয়। অনুরূপভাবে, ভারতীয় খ্রিস্টানরা সংস্কৃত বা হিন্দির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে বলে তাদের নিন্দা করা হয়। জৈনধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মেরও অবমাননা করা হয়। কারণ, তারা অর্থনীতিক দার্শনিক চিন্তায় সেরকম কিছু প্রভাব রাখেনি।” বিজেপিভিএইচপি আরএসএস এর বহুল প্রচার যে তারা মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে (সুতরাং, তারাই আসল ধর্ম নিরপেক্ষ); এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অর্গানাইজার-এর এই অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করা যায় : হিন্দু শুধু চায় যে তার সংস্কৃতি মহিমা অর্জন করুক। সে হতবাক হয় যখন একজন মুসলমানকে রাষ্ট্রপতি আর একজন মুসলমানকে প্রধান বিচারপতি করার পরে তাকে বলা হয় যে, সে মুসলমানদের চাকরি দিচ্ছে না… মুসলমানদের স্বীকার করতে হবে যে ভারত ঠিক ততটাই হিন্দু রাষ্ট্র যতটা মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান অথবা ব্রিটেন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র।” উপযুক্ত আলােচনার পরিসরে বলা যায় ইতিহাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সবাই কারণ ইতিহাস মাধ্যম হয়ে দাড়ায় জনমত বা জনসমাবেশ সংগঠনে যা সাহায্য করে ক্ষমতায় যাওয়ায় এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইতিহাসের যে যুক্তি ব্যবহার করা হয় তা বাস্তবায়নে যে ক্ষমতা পায় তা ব্যবহার করে বৈধতা পাওয়ায়।
এখানে গণতান্ত্রিক কাঠামাের কথা আসতে পারে তার ইঙ্গিত আগে দিয়েছি গণতান্ত্রিক কাঠামােয় ইতিহাস সরকারিভাবে চাপিয়ে দেয়া সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না কারণ, বিকল্প ধারায় তা প্রতিরােধ করা যায় ভায়ােলেন্স ছাড়াই। যেমন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসে পাঠ্য বই বদলানাের কর্মসূচি গ্রহণ করে কিন্তু সব রাজ্যে তা করা সম্ভব হয়নি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিকাল রিসার্চের তারা খােলনলচে পাল্টে ফেলেছিল কিন্তু এর বেশি কিছু করতে পারেনি। কারণ এর বহুমাত্রিক প্রতিবাদ হতে পারে, হয়েছেও। তবে, চাপিয়ে দেয়া ইতিহাস অন্তিমে গৃহীত হয় না। হিন্দুত্ব ও তার ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়ে জনসমাবেশ বিজেপি করেছিল, অর্থনৈতিক সুফল তা বয়ে আনতে না পারায় তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আমাদের মতাে দেশে সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সত্যাসত্য থেকে অনেক দূরে। দৈনন্দিন অর্থনৈতিক বিষয়টিই অভিঘাত হানে বেশি। এলিট রাজনৈতিক নেতা ইতিহাস ব্যবহার করে জনসমাবেশ সংগঠন করতে পারে কিন্তু অন্তিমে সে আবেগ থাকে না। কংগ্রেস গত নির্বাচনে কমিউনিস্টদের সঙ্গে জোট বেধে ক্ষমতায় গেছে এবং বিজেপি ইতিহাস নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল তা বিলুপ্ত করছে। পাকিস্তানে শাসকরা ইতিহাসের পথ ধরেই এসেছে এবং বৈধতা অর্জন করতে চেয়েছে। ১৯৪৭-এর পর প্রথম কয়েক বছর সংসদীয় ব্যবস্থা থাকলেও অচিরেই তা হস্তগত করে বেসামরিক আমলারা এবং পরে সামরিক আমলারা। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের আগে যারা শাসন করেছেন তারা মুসলিম লীগের ব্যানারেই করেছেন।
শুরু থেকে যে ইতিহাস দিয়ে জনসমাবেশ সংগঠিত করা হয়েছিল সেই ধারাটিই অক্ষুন্ন ছিল। অর্থাৎ প্যান ইসলামিক মতবাদ, ভারতে মুসলমানদের আগমন ও মুসলমান শাসকদের শাসন-এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং এর ধারক মুসলমানরা। মুসলমানদের আনুগত্য থাকবে পাকিস্তান যিনিই শাসন করুন না কেন তার প্রতি এবং মুসলিম উম্মাহর প্রতি এই ইতিহাস বােধ তীব্র করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রথম থেকেই পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিমের মুসলমানদের উঁচু স্থান দেয়া হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ পরিণত হয়েছে কলােনিতে। বিষয়টি বিদেশীদের চোখেও এড়িয়ে যায়নি। সেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় রিচার্ড পার্ক ও রিচার্ড হুইলার নামে দুজন গবেষক ফার ইস্টার্ন সান্ডে’তে । CIC : “Gradually East Pakistanis have been impressed that their economic and development interests were being subordinated to those of west; that East Bengal was being treated as a ‘colony by the central Government. This feeling has been intensified by the language issue in the longstanding attempt of the Pakistan Government to popularise Urdu as the national language, to the detriment of Bengali. These grievances against the Muslim League Government at the centre compounded by the alleged corruption and inefficiency of the provincial Muslim League Government.”
পাকিস্তানের ইসলামী আদর্শের মূল বিষয়টি সরলভাবে বলতে দাঁড়ায় এরকম- পাকিস্তান : মুসলমান যারা শৌর্যে বীর্যে শ্রেষ্ঠ। ভারত : হিন্দু, শৌর্যে। বীর্যে যারা অধস্তন। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান এর যােগ আছে ভারতীয়দের সঙ্গে। মুসলমান হ্রলেও তারা ঠিক ততটা মুসলমান নয় যতটা মুসলমান পশ্চিম পাকিস্ত নিরা। সুতরাং হিন্দুদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান থাকবে পূর্ব পাকিস্তানসহ তবে, পূর্ব পাকিস্তানি বা বাঙালিরা অধস্তন হবে । ১৯৬৭ সালেও দেখি মুসলিম লীগের মুখপত্র ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ ঐ ইতিহাস নিয়েই চিৎকার করছে। “পাকিস্তান ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট কর্মসূচি লইয়া দুনিয়ার বুকে জন্মলাভ করিয়াছে। আমরা পাকিস্তানিরা তাই স্বকীয় তাহজীব তমদুনের পরিপন্থী কোনাে প্রচেষ্টাই বরদাশত করিতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ বহু সঙ্গীতে মুসলিম তমদুনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান গাহিয়াছেন । সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমদিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনকে পবিত্র রাখা প্রয়ােজন ছিল। তাই বিলম্বে হইলেও সরকার এই সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া জনগণের প্রশংসাভাজন হইয়াছেন আমরা সরকারের এই মহৎ প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাইতেছি।”২৪ এই ছিল পাকিস্তানি মতাদর্শ যার মূল বিষয়-ই ছিল সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিভেদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর যখন নিজস্ব দল গড়লেন তখন এই ‘ইতিহাস ঐতিহ্য’-কেই গ্রহণ করলেন। মুসলিম লীগের একটি অংশ নিয়ে গড়লেন কনভেনশন মুসলিম লীগ কারণ, মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছে। সুতরাং, পাকিস্তান রাখতে পারে একমাত্র মুসলিম লীগ-ই। পরবর্তীকালে, সামরিক শাসক জে. মুশাররফ মুসলিম লীগ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। ছাত্র জীবনে আমরা যে ইতিহাস পড়েছি পাকিস্তান আমলে, সেখানে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস প্রায় ছিল না বললেই চলে। এরপর এসেছে ১৯৭১, পাকিস্তানের বর্তমান ইতিহাসে আবার যার কোনাে উল্লেখ নেই। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। আইয়ুব খান সচেতনভাবেই ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালের সামরিক শাসকরাও সে ধারা অপরিবর্তিত রাখেন।
আব্বাস রশীদ লিখেছেন- “উলেমাগােষ্ঠীর নিকট আইয়ুব খানের নির্ভরশীলতার মধ্যদিয়ে সামরিক বাহিনী এবং সনাতনপন্থী সংগঠনের মাঝে অসম হলেও পারস্পরিক ফলপ্রসূ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ১৯৭১ সালে ঐ সম্পর্কগুলাে বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে সনাতনপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে অগঠিত, অসংঘবদ্ধ উলেমাগােষ্ঠী নয় বরং তাদের স্থান ইতােমধ্যে দখল করে নেয় সুসংগঠিত জামায়াতে ইসলামী। জামাত-ই-ইসলামীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞকে কেবল সমর্থনই করেনি, তাদের কর্মী ও সদস্যরা শান্তি কমিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।” আব্বাস আরাে লিখেছেন, জামাত-ই-ইসলামীর এ সমর্থন সামরিক বাহিনীকে আশ্বস্ত করে এবং বাঙালি ভাব বিরােধী যে প্রচারণা তারা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা তা বিশ্বাস করেছিল। এভাবে ইসলামপন্থী দলগুলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে পরস্পরকে ব্যবহার করে। কয়েক বছর আগে আমি পাকিস্তান গিয়েছিলাম। সেখানে নীতি নির্ধারক থেকে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অধিকাংশই স্বীকার করতে চান না যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে কারণ, তারা তা জানতেন না’। এখনাে তাদের ধারণা এখানকার বাঙালিরা ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু প্রভাবান্বিত। তাই বাঙালিরা সম পর্যায়ের হতে পারে না। এবং পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতই দায়ী। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী নিয়ে মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান একটি বই লিখেছেন। তাতে বলেছেন, “The Pakistan cause came to be connected with West Pakistan only. Thus the internal disenssions were being fostered to destroy Pakistan and regional affinities were being encouraged and Pakistan patriotism downgraded. The seeds of the crisis between East and West Pakistan, shown by Professors and teachers of the minority community, yielded a flourishing crop. In twenty-four years, the type of education imparted to them together with insistent Indian propaganda change the East Pakistani Muslims to Bengalis. A considerable reaction of young East Pakistan was therefore the first to break away from Pakistan and its basis.”
জেনারেল মুকিম উল্লেখ করেছেন এ অঞ্চলের মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমান থেকে বাঙালি হয়ে গেল। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু হয় ১৯৪৭ থেকে। পাকিস্তানি আদর্শ প্রবল ছিল। কিন্তু তরুণ, প্রগতিশীলদের মধ্যে বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভও জন্ম নিচ্ছিল । ঐ প্রশ্নই তাদের বিদ্ধ করেছিল যে এই পাকিস্তান কি আমরা চেয়েছিলাম? স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের নায়ক তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে এ রূপান্তরের বিষয়টি দেখা যায়। বাঙালি জাতীয়তা বােধের বিকাশ হচ্ছিল সমান্তরালভাবে যদিও পাকিস্তানি আদর্শও প্রবল ছিল এবং একেবারে উপড়ে ফেলা তা সম্ভব হয়নি, বর্তমান অবস্থা তার প্রমাণ। কিন্তু পাকিস্তানি আদর্শের বিপরীত বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিত্ব নিজের স্থান করে নিয়েছে এবং অন্তিমে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জয়লাভ করেছে। এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর একটি প্রবন্ধে । উদ্ধৃতি খানিকটা দীর্ঘ সত্ত্বেও সংক্ষেপে সামগ্রিক বিষয়টি বােঝার জন্য তা প্রয়ােজনীয়। “বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাসের ব্যবহার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা জরুরি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্ছেদ পর্যন্ত সময়কাল বিশ্লেষণ করলে ইতিহাসবােধের নির্মিত ও জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাস ব্যবহারের একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, সাবেক পূর্ব বাংলায় সর্বব্যাপ্ত কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়ে ধর্মজ জাতীয়তাবাদ ক্ষয় করেছে এবং পর্যায়ে পর্যায়ে সেকুলার জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী করেছে। ধর্মজ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাঙালি কোলাবরেটর : রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, বিভিন্ন পীর ঘরানার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি পর্যায়ে নিঃশেষ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রের হেজিমনি ও পাকিস্তান রাষ্ট্র উথিত ধর্মজ জাতীয়তাবাদ সার্বিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং প্রতিরােধকারী ও প্রতিযােগী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হেজিমনি এবং বাংলাদেশ আন্দোলন উথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মজ জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতার বদলে সেকুলার জাতীয়তাবাদের বহুত্ববাদিতা কলােনিয়াল ইতিহাসের অবদমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে। এ হচ্ছে পাকিস্তান আমলের উপনিবেশের অধীন একটি জনসমষ্টির ইতিহাস পুনর্দখলের এক লড়াই এবং এই লড়াইয়ে জয়ী একটি জনসমষ্টির নিজস্ব ইতিহাস নির্মাণের লড়াই।”
জেনারেলদের আলােচনা, মনােভঙ্গি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভারত বা হিন্দুকে তারা পাকিস্তানের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছেন। বাঙালি ও হিন্দু সমার্থক। সুতরাং, যা কিছু হয়েছে ১৯৭১ সালে তার জন্য ভারতই দায়ী । অন্যান্য উপাদানও আছে (যা পরে আলােচ্য)। তবে মূল কথা এই-ফজল মুকিম খানের উদ্ধৃতি যা আগে দিয়েছি তা এর উদাহরণ। জেনারেলদের কাছে, পূর্ববঙ্গ ছিল বাড়তি। তাদের আলােচনার ধাচটা এরকম-পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে (পাঠকদের বােঝানাে যে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মোহ)। তবে, যতটা বলা হয় ততটা নয়। ব্রিটিশ আমল থেকে পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল দুর্বল। দক্ষ জনশক্তি ছিল না। পাকিস্তান (কেন্দ্র কী করবে? যতটুকু করার ততটুকু করা হয়েছে। ফজল মুকিম যেমন লিখেছিলেন, ইসলামাবাদ ঢাকাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে- এই তত্ত্ব বিশ্বপ্রেস মেনে নিয়েছে। তারা এই ‘অতিরঞ্জন’ মেনে নেয়ায় তিনি বিস্মিত। ফরমান লিখেছেন, বাঙালিরা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার কথা ভুলে গেছে। শুধু তাই নয়- “History was sought to be falsified and disowned, presumably in vain as has been.“
যে সব জেনারেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন তাদের ভাষ্য, তিনি এখানে যে পদে ছিলেন সে পদে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কাজ করতে ‘ চেয়েছেন। । পাকিস্তানে গণ্ডগােল বাধিয়েছে বাঙালিরা। এ ধারণা অধিকাংশ পাকিস্তানির। অনেকে এর বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে যে, পশ্চিমে ছিল সামন্তবাদী কর্তৃত্ব, পূর্ব ছিল তা থেকে মুক্ত। পূর্বের মধ্যবিত্ত এ ধরনের আধিপত্য মানতে রাজি হয়নি। বিরােধটা সেখান থেকে শুরু। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য যেভাবে হাহাকার করেছে পশ্চিমে হাহাকার ততটা ছিল। গণতন্ত্রের বিষয়টা পাকিস্তানের এলিট শাসকবর্গ কখনাে পছন্দ করেনি। [ এ বিষয়ে সাহায্য করেছে কিছু পূর্ব ধারণা। জেনারেলরা কেন, পাকিস্তানের খুব কম মানুষই এ ধারণা থেকে মুক্ত। ধারণাটা হলাে বাঙালির মুসলমানত্ব নিয়ে সন্দেহ। যাদের নিয়ে আলােচনা করেছি তাদের অধিকাংশই আমার সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারে বলেছেন, বাঙালির মুসলমানত্ব নিয়ে তাদের কোনাে সন্দেহ নেই। বাঙালিরা বেশি মুসলমান। কিন্তু যখন তারা লিখেছেন অজান্তেই পূর্ব ধারণায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে গণহত্যার সময়ও পাকিস্তানি সৈন্যদের মনে একই ধারণা কাজ করেছিল। এ ধারণা গড়তে সাহায্য করেছে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড ভারত ও হিন্দুবিদ্বেষ। তারা দেখেছে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে মিল বেশি এবং পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জনসংখ্যাও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি। তাছাড়া বাঙালিরা তেমনভাবে হিন্দু ও ভারত-বিদ্বেষী নয় যেমনভাবে পাকিস্তানিরা বিদ্বেষী। সে কারণে দেখি যে কথাটিই কোনাে না কোনােভাবে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মজীবনীতে, তা হলাে বাঙালিদের মনমানসিকতা প্রভাবিত করেছিল হিন্দুরা। আর হিন্দুরা তো ভারতীয়দেরই অংশ। ভারত সবসময় পাকিস্তানের শত্রুতা করেছে, পাকিস্তানের বিনাশ চেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা
৮. আইয়ুবের ভুল হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। -গুল হাসান
৯. শেখ মুজিবকে হিন্দুরা টাকা যােগাত। -ঐ
১০. রাজনীতিবিদরা সৃষ্টিশীল মিথ্যাবাদী। -ঐ।
এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়ােজন। রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দায়ী করলেও তাদের আক্রোশটা বেশি বাঙালি রাজনীতিবিদদের প্রতি। কোনাে বাঙালি রাজনীতিবিদদের প্রতি তারা একটি ভালাে বাক্য উচ্ছারণ করেনি। ১৯৭১ সালের ঘটনা বিশ্লেষণকালে তারা যতটা না ভূট্টোর প্রতি তার চেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধুকে শুধু দায়ী নয় হেয় করেছে। প্রায় ক্ষেত্রে তাকে ‘গুণ্ডা’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘জারজ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা যে কতটা বর্ণবাদী ছিল মনেপ্রাণে এগুলি তার প্রমাণ। পাকিস্তান যে ভেঙে গেল তার জন্য বাঙালিরা তাে দায়ী-ই তবে, পাকিস্তানে কেউ দায়ী হলে সে হচ্ছে ভূট্টো এবং ইয়াহিয়া । ইয়াহিয়া খান যেহেতু অসম্মানিত, মৃত এবং তার কোনাে রাজনৈতিক সাপাের্ট নেই, সেহেতু পাকিস্তান ভাঙার জন্য তাকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গেই আসে সেনাবাহিনীর কথা। জেনারেলরা সবাই সামরিক শাসনের বেনিফিশিয়ারি। তা সত্ত্বেও তাদের স্বীকার করতে হয়েছে সামরিক শাসন জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। কিন্তু সামরিক শাসন কেন এলাে? কারণ, পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি ও পাকিস্তান ভাঙার জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ভারই বেশি। সেনাবাহিনী বরং পাকিস্তানের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছে। যেমন- ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের টর্নেডাের সময় তারা প্রাণপণে খেটেছে কিন্তু কোনাে কৃতিত্ব তাদের দেয়া হয়নি। তারা ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য দেখায়নি। বৈধভাবে কেন্দ্রের কর্তৃত্বের অধীনে থেকেছে। আর সৈনিকরা বা জেনারেলরা তাে খারাপ কিছু করতে পারে না। এই যেমন, টিক্কা খান, সবাই তাকে ভুল বােঝে। ফরমান লিখেছেন, টিক্কা ছিলেন – “Straight forward, honest, obedient soldier. রা:সেনাবাহিনীকে সমালােচনা করার অর্থ শত্রুকে সহযােগিতা করা। রাষ্ট্রে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ১৯৫০ সাল থেকেই সেনা কর্তৃপক্ষ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা ঠিকই অনুধাবন করেছিল এই আধিপত্য। সুদৃঢ় করতে হলে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে এবং বেআইনীভাবে তারা তা গড়ে তুলেছিল, আয়েশা সিদ্দিকা যাকে ‘milbus’ বলে উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতা করায়ত্ত করার এবং তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য সেনাবাহিনী ১৯৫০ থেকে একধরনের ইমেজ তৈরি করেছে যার বর্ণনা পাওয়া যাবে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির বইতে। প্রচারের কয়েকটি উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-
১. সেনাবাহিনী ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। অর্থ : অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি তা নয়।
২. সৈনিকরা সহজ, সরল, ধর্মভীরু। অর্থ : অন্যরা তা নয়।
সৈনিকরা মুজাহিদ। তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষায় বিশ্বাসী। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হলে বেহেশত। অর্থ : অন্যরা ধর্মের রক্ষক নয়। ভারত কাফের। সুতরাং সেনাবাহিনীকে সবসময় জিহাদী জোশে রাখা। বাংলাদেশে তারা গণহত্যা চালিয়েছিল এই কাফের নিধনের অজুহাতে । ৪. সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক। অর্থ : অন্যরা তেমন নয়। রাজনীতিবিদরা তাে নয়ই কারণ তারা নিজের বা নিজদলের প্রতি বিশ্বস্ত। ৫. সৈনিকরা সৎ। অর্থ : অন্যরা দুর্নীতিপরায়ণ। ৬, সেনাবাহিনী কর্মদক্ষ। অর্থ : অন্যরা নয়। সুতরাং, দেশ চালাবার অধিকার সেনাবাহিনীর। এ কারণেই পাকিস্তানে আর্মড ফোর্সেস ডে’ নামে একটি বিশেষ দিবস পালিত হয়।
ধর্মের বিষয়টির ওপর সজ্ঞানে জোর দেয়া হয় জিয়াউল হকের সময় । অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল কাইউমের লেখা “জিয়া: অ্যান্ড আই’ (১৯৯৬) গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। কাইয়ুম: ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সাের্ড অব অনার পান। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি তাঁর ওপর এখন অভিঘাত সৃষ্টি করে যে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু স্ত্রী পাকিস্তানি হওয়ায় পাকিস্তান থেকে যান। জিয়ার সঙ্গে তিনি একত্রে কাজ করেছেন, ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জিয়া ক্ষমতায় আসার পরই কাইয়ুমকে বলেন, কীভাবে সেনাবাহিনীকে আরাে ধর্মের পথে আনা যায় তার পরিকল্পনা দিতে। কাইয়ুম বিভিন্ন ইউনিটে ‘ঈমান, তাকওয়া ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এর ওপর বক্তৃতা দিতে লাগলেন। জিয়া এ তিনটি শব্দকে সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র করেছিলেন কাইয়ুমের আপত্তি সত্ত্বেও আব্বাস রশীদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, জিয়াউল হক সচেতনভাবে একটি মতাদর্শ গড়ে তােলেন এবং জামাত-ই ইসলামী তাকে সাহায্য করে। “ইসলামকে ঐ মতাদর্শে ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে সংগঠিত করা নয় বরং তাকে আদর্শহীন করে গড়ে তােলা, তাকে নিরস্ত্র করা। “সামরিক বাহিনী ঐ মতাদর্শের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা গ্রহণ করে জামায়াতে ইসলামী থেকে। “যেমন মজলিস-ই-সুরা, কাজী কোর্ট, মসজিদ-স্কুল কর্মসূচি। লাভ-লােকসান ভাগ-বাটোয়ারা কর্মসূচি, জাকাতের উপর গুরুত্ব এবং সত্যিকার ধর্মপালনকারী একজন মুসলিম হিসেবে জিয়াউল হককে প্রচার মাধ্যমে আনার কর্মসূচির মাধ্যমে সামরিক জান্তার ভাবমূর্তিকে ইসলামী বলে প্রচার করা সম্ভব হলাে। ফলে তার বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরােধ দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব হলাে।
হামজা আলাডী লিখেছেন, সৈনিকদের মাঝে “ধর্মীয় মতবাদ, জাত্যাভিমান ও দক্ষিণ পন্থী ধ্যান-ধারণা”, বেশি করে ছড়ানাে হয়েছে। “সৈনিক ও ছােট অফিসারদের ক্ষেত্রে মতাদর্শের বিষয়টি খুবই জরুরি (কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে নিজ দেশের জনগণকে নিপীড়ন নির্যাতন করতে হয়) এবং তাদের জন্য মনের জোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের মনমানসিকতাকে এক ধরনের জাত্যাভিমানের বিকারে পূর্ণ করে দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ইসলামী মতবাদ দিয়ে ও বিরােধীপক্ষরা ইসলামের শত্রু’ এই আখ্যায় চিহ্নিত করে দিলে ভালাে কাজ হয়।” এক্ষেত্রে মিলবাসে’র বিষয়টি সম্পর্কে খানিকটা আলােকপাত করতে হয়। আয়েশা সিদ্দিকা তাঁর বিখ্যাত বই “মিলিটারি ইনক্ : ইনসাইড পাকিস্তান’স মিলিটারি ইকোনমি’ গ্রন্থে এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-* Milbus refers to military capital that is used for the personal benefit of the military fraternity, especially the officer cadre, but is neither record nor part of the defence budget. In this respect, it is a completely independent genre of capital. Its most significant component is entrepreneurial activities that do not fall under the scope of the normal accountability procedures of the state and are mainly for the gratification of military personal and their cronies.” (পৃ. ১] উল্লেখ্য, এই সুবিধা সমভাবে বিতাড়িত হয় না, অফিসারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে ১৫
আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করেছিল সেনাবাহিনী যে, শুধু দেশ রক্ষা নয়, জাতীয় উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রাখে। রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয় তখন বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে হয়। বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে লিখেছিলেন ফজল মুকিম খান- যে সেনাবাহিনী “is above politics and parties. The performance of its officers and Jawans and the basis of its traditions spring from there readiness to serve the state and the nation in the best way they can do… it has acquired a unique spirit and sense of purpose and has proved itself Pakistan’s greatest stabilizing force.”14.20-801
সন্তোষ গুপ্ত একটি প্রবন্ধে একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন“১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এই দশকে তৃতীয় বিশ্বের ৭৭টি স্বাধীন দেশের উপর সমীক্ষা চালিয়ে রবার্ট জ্যাকসন বলেন, সংক্ষেপে অর্থনীতিক উন্নয়নের মাত্রা কিংবা ভৌগােলিক অঞ্চল নির্বিশেষে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ সামাজিক পরিবর্তনে কোনাে অনন্য ফল রাখতে পারে না।’ পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সামরিক শাসকরা যে সব যুক্তি দিয়েছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাংকম্যান চার্চের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করতে হয়। তিনি বলেছিলেন- “আমার বেশ মনে আছে। . শৈশবকালে তখনও রাজনীতিতে প্রবেশ করিনি, তখন ইউরােপে ফ্যাসিস্টরা রাজনৈতিক দল উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পক্ষে একই যুক্তি দিয়েছিল। সুতরাং কোনাে সামরিক শাসকই রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি ও প্রশাসন সম্পর্কে নতুন কথা বলেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে এশিয়া ও আফ্রিকায় সামরিক স্বৈরশাসকরা অবশ্য কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন। ফ্যাসিস্টদের সাথে তাদের এই বাহ্যিক পার্থক্যটুকু এসব দেশে জনসাধারণের ঔপনিবেশবাদী বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐতিহ্য হেতু বজায় রাখা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ বাতাবরণ তৈরি করেছিল একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করার জন্য ‘মিলবাস তাদের সে ক্ষমতা যুগিয়েছিল। এ মিলবাসের কারণেই তারা ১৯৭১ সালে ঐ ধরনের ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছিল। ইতিহাস বলে, যেসব কারণে তারা বারবার ক্ষমতা দখল করেছিল তা কথার কথা এবং এ ধরনের প্রচারণা মিথ্যা। তারা পাকিস্তানের কী করেছে আজকের পাকিস্তান তার প্রমাণ। এ কারণে বিলাল হাশমী তাঁর প্রবন্ধে: পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বিষবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন- “ঔপনিবেশিক যুগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে বীজ জন্ম নিয়েছিল, নয়া উপনিবেশবাদী যুগে তা এক মহীরুহে পরিণত হচ্ছে, স্যার ওলেফ ক্যারাে যথার্থই ব্রিটিশ সৃষ্ট এই বিষবৃক্ষের বীজটাকে চিনতে পেরেছিলেন এবং সাম্রাজ্যবাদের নতুন যুগে এটা কিরকম বীভৎস এক রূপ নেবে সেটাও যথার্থভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি বা এসব উপাদান থেকেই নির্মাণ করা যায় একটি নতুন প্রত্যয় ‘পাকিস্তান। অর্থাৎ সেনাবাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্র দখল করে, রাষ্ট্র ধ্বংস। সামগ্রিকভাবে খারাপ অর্থেও আমরা বলি যে, সে পাকিস্তানি বা পাকিস্তানি মন। আর জেনারেলরা যে আলােচনা করেছেন তা এই পাকিস্তান প্রত্যয় মনে রেখেই।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও খানিকটা আলােচনা করতে চাই, না হলে আলােচনা অসম্পূর্ণ মনে হবে।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যা ঘটেছে তার সঙ্গে আমরা পরবর্তী ইতিহাসের মিল খুঁজে পাই। কেন? বাংলাদেশের সামরিক শাসকরাও এ সংজ্ঞাটির বাস্তব রূপায়ণ করেছিলেন নিজের দেশে। এ মনোভঙ্গির অর্থ দাঁড়ায়, আমলাতন্ত্র, বিশেষ করে সামরিক আমলাতন্ত্র-কর্তৃক সিভিল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ লুটের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ তা যেভাবেই হােক না কেন। এ কারণে দেখি, সামরিক বাহিনীর (তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অংশ) অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, বীরত্ব দেখিয়েছিলেন কিন্তু অন্তিমে ঐ মনােভঙ্গির বাইরে যেতে পারেননি। কারণ, বেড়ে ওঠার বয়সে তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পাকিস্তানে, পাকিস্তানি প্রশিক্ষকের কাছে, যৌবনও কাটিয়েছেন। সেখানে। বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে, তারা সেই পাকিস্তান তত্ত্বও প্রচার করেছেন মাতৃভূমিতে। এটাই আমাদের ট্র্যাজেডি । এই পাকিস্তানি মন বা তত্ত্ব কিভাবে প্রভাবিত করেছিল আমাদের শাসক ও রাজনীতিবিদদের একাংশকে তার কয়েকটি উদাহরণ দিই। জেনারেল জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মতাে একই ভঙ্গিতে ক্ষমতা দখল করে হাঁ-না ভােট করেন। রাজনৈতিক দলগুলি বিলুপ্ত করেন, পরে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাদের কাজের অনুমতি দেয়া হয়। শাসনতন্ত্রের মূলধারাগুলাে পরিবর্তন করেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় সে সব দেশ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছিল প্রচারমাধ্যম সম্পূর্ণ করায়ত্ত করে নিজের ও সেনাবাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধিতে ব্যবহার। জিয়াউর রহমান যা করেছেন তার আমলে, তাতে স্পষ্টভাবে বলা যায়।
কাকুল ভাবধারা থেকে তিনি বেরুতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে তার যােগদানটা ছিল দৈব ঘটনা মাত্র। না হলে, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযােদ্ধার বাতাবরণ তৈরি করে দেশটিকে পাকিস্তান করতে পারেন না। তিনি প্রথমেই ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করলেন সেই প্রাক-১৯৪৭ সালের মুসলমানদের ইতিহাস ইঙ্গিত করে। ক্ষমতা আরােহণের দু বছর পর জেনারেল জিয়া সংবিধান সংশােধন করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ উৎপাটন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শব্দটি স্থাপন করলেন। আপাতত দৃষ্টিতে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু, এই একটি শব্দই বাংলাদেশে মানুষকে দুভাগ করে দিয়েছে, জিয়া এই বিভক্তি চেয়েছিলেন তার ক্ষমতার স্বার্থে এবং তার দ্বারা তিনি তার ক্ষমতারােহণের যুক্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন ইতিহাসের আলােকে এবং এ ঘটনা প্রমাণ করে যে এই জেনারেল জাতির সঙ্গে কত বড় প্রতারণা করেছিলেন। এই ঘটনা আবার অন্যদিকে প্রমাণ করে তিনি বাধ্য হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন যার অনেক প্রমাণ বর্তমান কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধার সম্মানের কারণে কেউ তা প্রকাশ করতে চায় না। ১৯৭২ সালে জেনারেল জিয়া সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলেন, যেদিন মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘােষণা করলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা, “আমার মতে ঠিক সেই দিনই বাঙালি হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতির।” এখানে লক্ষণীয় বাঙালি হৃদয় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ শব্দ দুটি।
এর ঠিক পাঁচ বছর পর, জেনারেল জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করলেন সংবিধানে সামরিক আইন মারফত বন্দুকের জোরে। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক কাঠামাে তৈরি করে দিলেন সাংবাদিক খােন্দকার আবদুল হামিদ। ১৯৭৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর আলােচনা সভায় এক প্রবন্ধে তিনি বললেন : আমাদের জাতীয়তাকে বাংলাদেশী জাতীয়তা’ বলাই এপ্রােপিয়েন্ট বা সঙ্গত।… এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশানা, ওয়ারিশীউত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, যবান-লিসান, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, সংগঠন ও সবকিছু। বাংলাদেশী জাতির আছে নিজস্ব জীবনবােধ, জীবন ধারা, মনস্তাত্ত্বিক গড়ন-গঠন, ভাবধারা। আছে সমষ্টিগত বিশেষ মনােভঙ্গি, আবেগ, আকাঙক্ষা ও হৃদয়ানুভূতির বন্ধন। এদের হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে একই সুখ-দুঃখের সুর, একই আবেগ অনুভূতির ঝঙ্কার। এদের জীবনে ও মনােজগতে রয়েছে এমন অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, যা সারা পৃথিবী থেকে এদের স্বাতন্ত্র্য দান করেছে এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলাভাষী ও ইসলাম অনুসারীদের থেকেও । ইসলামের কথা বললাম, এ জন্য যে, এদেশের ৮৫ শতাংশ লােকই মুসলিম। এই বৈশিষ্ট্যগুলিই বাংলাদেশী জাতীয়তার উপাদান। এগুলি বাকল নয়, আসল সারাংশ। আর এই সারাংশই আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার আসল শক্তি, ভিত্তি ও বুনিয়াদ।” | এই জাতীয়তাবাদে যুক্ত হয়েছিল ধর্ম আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধের এবং সংবিধানের মূল নীতির একটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমান প্রচারিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মানুষকে স্পষ্টত দুভাগ করেছিল। এই জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচলিত হলো এমন কিছু শব্দ যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শ্লোগানের বিপরীত। যেমন ‘জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। ‘আমার সােনার বাংলা’র পরিবর্তে প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ। অথচ জেনারেল জিয়া ১৯৭৫-এর পূর্ব পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ শব্দটি শুধু ব্যবহারই করতেন না কোনাে বাণী বা ভক্তকে স্বাক্ষর দেয়ার পরও লিখতেন ‘জয় বাংলা’ । এভাবে তিনি নিজের স্থান করে নিতে চাইলেন ক্ষমতা ও বৈধতাসহ। জিয়াউর রহমান সামরিকায়ন ও পাকিস্তানের যে কাজ শুরু করেছিলেন। এরশাদ সে ধারাকে বিকশিত ও পুষ্ট করলেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলেন। নিজে অধার্মিক হয়েও ধর্মকে ব্যবহার করলেন নিজের আধিপত্য বিস্তারে।
জিয়াউর রহমান এ দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনপ্রতিষ্ঠা করে জামায়েতকে বিকশিত করার পথ করে দেন। বেগম জিয়ার আমলে গণতন্ত্রের বাতাবরণে পাকিস্তানি সামরিক আদর্শটি বলবৎ থাকে যার পরিণতিতে জামায়েত ক্ষমতায় যায় ২০০১ সালে। এ সময়ই ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বিকশিত হয়। জেনারেল জিয়া, তার পত্নী ও এরশাদ বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছেন তা পূরণ করতে কয়েক যুগ লেগে যাবে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকার পাকিস্তানি সামরিক কালচারের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে যে “মিলবাস শুরু করেছিলেন জেনারেল মঈন তা সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানে আই এস আইয়ের মতাে বাংলাদেশের ডিজিএফআই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী নিজেদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে। আয়েশা সিদ্দিকা তার বইতে প্রশ্ন রেখেছিলেন, পাকিস্তানের ‘মিলস’ দেখেও বাংলাদেশের মানুষ কেন সেখানে মিলবাস’ গড়তে দিচ্ছে? অর্থাৎ এ ধারা চললে বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। পাকিস্তানি কায়দায় ১৯৭৫ সালের পর সেনাবাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি নতুন বাক্য চালু করা হয় প্রচারমাধ্যমে যা পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদরাও তােতাপাখির মতাে আওড়ে যাচ্ছেন। যেমন১. সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। অর্থ : অন্যরা বিশৃঙ্খলা ও অধস্তনতার প্রতীক। সেনাবাহিনীর উল্লেখ করলেই বলা হয়-“এ স্মার্টলি ড্রেসড কনটিনজেন্ট।” অর্থ : সেনাবাহিনী স্মার্ট অন্যরা নয়। পৃথিবীতে পাকিস্তান ছাড়া বােধহয় আর কোথাও সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে এ ধরনের বাক্য উচ্চারিত হয় না। সৈনিকরা সরল ও সৎ। উদাহরণ, প্রচারণায় জিয়ার ছেড়া গেঞ্জি ও ভাঙা স্যুটকেসকে গুরুত্ব দেয়া। এরশাদের সাইকেল চালানাে। অর্থ : অন্যরা নয়। আঁকালােভাবে সেনা প্যারেড প্রদর্শন। সামরিক জাদুঘর নির্মাণলক্ষ করুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নয়। যদিও এ সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। রাজনীতিবিদরা সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী। তারা দুর্নীতিবাজ।
এরা বা এদের অনুসারীরা কখনাে পাকিস্তানকে দোষারােপ করেননি, করেছেন ভারতকে (অর্থাৎ হিন্দু-ভারত]। বাংলাদেশের যাবতীয় দুর্দশার জন্য এরা দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগকে [এর মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনও অন্তর্ভুক্ত, কারণ আওয়ামী লীগ ছিল মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বকারী দল]। কারণ তাদের মতে, আওয়ামী লীগ ভারতের এজেন্ট। এসব এজেন্ট ও হিন্দুরা ধর্মবিরােধী অর্থাৎ ইসলামবিরােধী। ইসলাম এদের চোখে সবসময় বিপন্ন মনে হয়, ইসলামের ঠিকাদারি তারা নিয়েছিলেন । এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন করেছিলেন। এসব প্রচারের আড়ালে তারা দেশের সম্পদ লুট করেছেন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তা চুইয়ে পড়েছে। এভাবে সেনাবাহিনীকে তারা নিজেদের হাতে রেখেছেন। বিচারপতি কায়ানি বলেছিলেন, পাকিস্তানি সৈনিকরা বীর, তারা নিজেদের দেশ জয় করেছে। বেঁচে থাকলে হয়তাে বলতেন, তারা নিজের দেশও ভেঙেছে। আমাদের শাসকরাও বীর। নিজের দেশ জয় করেছিলেন। কিন্তু দেশের অস্তিত্ব বিনষ্ট করার আগেই বাংলাদেশের সজীব সিভিল সমাজ তাদের হটিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু, সেই পাকিস্তানি তত্ত্ব, যা তারা পরিপুষ্ট করেছিল তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে এখনাে।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর মনে হচ্ছে নতুন প্রজন্ম পাকিস্তান প্রত্যয় ও মিলবাস’ মেনে নিতে রাজি নয়। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সিভিল সমাজ থেকে সশস্ত্রদের প্রতি এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে যা গত তিন দশকে করা হয়নি। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। কারণ, সিভিল সমাজের মনে হচ্ছে, আমরা একবারই মানুষের সম্মান পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালে যখন নিরস্ত্ররা সমাজের সর্বস্তর থেকে সশস্ত্রদের হটিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ঘটনাকেই গুরুত্ব দিয়ে যে সব বই বেরিয়েছে তার মধ্যে মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের বইটিই বােধহয় প্রথম। ১৯৭৩ সালে। ইসলামাবাদ থেকে তার লেখা পাকিস্তান ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ বইটি। প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী-| সম্পর্কিত বিভিন্ন বইতে পাকিস্তানস ক্রাইসিস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশী যারা লিখেছেন তাদের অনেকের মুখে সুখ্যাতিও শুনেছি। বইটির। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশ-কোনাে দেশ থেকে বইটির কপি| সংগ্রহ করতে পারিনি। পরে সাংবাদিক মতিউর রহমানের কাছ থেকে বইটির ফটোকপি সংগ্রহ করে সাগ্রহে পড়লাম। ২৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রায় তিনশাে পাতার বই ‘পাকিস্তানস ক্রাইসিস’| মূলত রচিত হয়েছে ১৯৬৯-১৯৭১-এই সময়টুকু নিয়ে। আর এ কারণেই এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেল কেন বইটি লিখেছেন? ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। ১৯৬৬ সালেই তাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যাতে তিনি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ নিয়ে না লেখেন। এর অর্থ, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ হয়তাে তিনি করেছিলেন যা কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি। সেই থেকে তিনি এসব করা থেকে নিজেকে বিরত রেখে সমাজকর্মে মনােনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে আবার বিপর্যয়ের পর বন্ধু বান্ধবদের অনুরােধে তিনি এ বইটি লিখেছেন।
ভূমিকার প্রথমে তিনি একটি উল্লেখযােগ্য মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তানের বিপর্যয় হলাে কেন? কী বিপর্যয়, সেটি অবশ্য তিনি উল্লেখ না করলেও আমরা বুঝতে পারি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ছিল পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়। অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে এ বিপর্যয় হয়েছে। ফজল মুকিম এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁর মতে, ষড়যন্ত্র যদি হয়েও থাকে তা হলে সেক্ষেত্রে দায়ভারটা পাকিস্তানের। নেতা ও মানুষরা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই ষড়যন্ত্র হয়। ভারত ও রাশিয়া যদি পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করে থাকে তাহলে পাকিস্তানও তাদের সাহায্য করেছে। তার 260, “Our own lack of political wisdom and vision of history and our own indifference to what might be our national interest brought the disintegration.” | এরপর তিনি মূল বিষয়- গণহত্যা নিয়ে আলােচনা করেছেন। তার মতে, ভারত ও ভারত দ্বারা উৎসাহিত বিদেশী রিপাের্টে বাংলাদেশে হত্যা, লুট ও ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়টি অনালােচিত থাকুক তা তিনি বা কোনাে পাকিস্তানিরা চায় না। তবে, ভারত থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা ফিরে এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যাবে [পাকিস্তানে যুদ্ধবন্দিরা ফিরে আসার আগে বইটি লেখা]। সৈনিকদের ওপর জেনারেলের এই অগাধ বিশ্বাসে বিস্মিত হতে হয়। তিনি কীভাবে আশা করেছিলেন যারা হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত তারা তা স্বীকার করবে? | ফজল মুকিম বলছেন, এ বিষয়ে ভারতীয়রা যা প্রচার করে তাতে কান না দেয়াই সমীচীন। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনের আগে ভারত অন্যান্য প্রচারের জন্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছে। তারা বারবার প্রচার করেছে ইসলামাবাদ ঢাকাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে। ফজল মুকিম আশ্চর্য হয়েছেন যে, বিশ্ব প্রেস এই অতিরঞ্জন মেনে নিয়েছে। এবং এভাবে পাকিস্তান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘Unjust impression’ গড়ে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানাের জন্য। এভাবে- “Objectivity, fairness and even reason went down before a thumping to punish and destroy Pakistan.” ফজল মুকিম খান ও অন্যান্য সমর-নায়কদের সমস্যাটা ছিল পাকিস্তানকেই তারা বিশ্ব ভাবতেন। আর ফজল মুকিম যদি তা না ভেবে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে সারা পৃথিবীর প্রেস মিথ্যাবাদী এবং টেলিভিশন বা বেতারে তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের যে রিপাের্ট প্রচারিত হয়েছে তা ছিল ভেলকিবাজি। এরপর তিনি বিভিন্ন হিসাব দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, গণহত্যা ও গণধর্ষণের কাহিনী আসলে ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, পাকিস্তানে এ বিষয়ে যাদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলছেন, এসব বিষয় তারা জানেন না। এমনকি জেনারেল নিয়াজী ও রাও ফরমানও তাই বলেছেন। বিষয়টি আমরা বুঝি। গণহত্যা হয়েছে বললে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও সমর-নায়কদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আর এখানেই আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর পূর্ব ধারণার।
জেনারেল ফজল মুকিম খানের প্রথম অধ্যায়ের নাম- ‘দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়। এই সময়টুকু হচ্ছে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১। দুটি যুদ্ধকেই লেখক দেখেছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসন হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ হলাে, “পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন’। এ অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য হলাে : শুরু থেকেই ভারত পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। এবং সবসময় সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভারত ‘failed to achieve her aim, ended in a stalemate and brought no glory to the Indian Armed forces. Instead of gaining in stature, they suffered a further loss of face.” এই মন্তব্য সত্য হলে জিজ্ঞাস্য তাসখন্দ চুক্তি করতে কেন পাকিস্তান বাধ্য হয়েছিল? কেনই-বা ভূট্টো পরবর্তীকালে তাসখন্দ চুক্তিকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন? ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে ক্রটিগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, লেখকের ভাষায় পাকিস্তান তা দূর করতে পারেনি, বরং পুরনাে ব্যবস্থাই অব্যাহত থেকেছে। লেখক অবশ্য একথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি যে, পাকিস্তান আন্দোলনে, বাঙালিরা ছিল অগ্রপথিক। যে মুসলিম লীগ এই আন্দোলনের পুরােধা সেই মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ঢাকাতেই। কিন্তু জিন্নাহ এবং লিয়াকতের মৃত্যুর পর যাদের কাজ ছিল বাস্তববাদী হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় রাষ্ট্র পরিচালনা করা, তারা তা পারেননি। এরা কারা? এরা হলেন আবদুর রব নিশতার, সােহরাওয়ার্দী, আকরাম খান ও তমিজউদ্দিন খান। লক্ষণীয় যে, এদের অধিকাংশই বাঙালি এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় এরা ছিলেন না। সুতরাং তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি। যারা পরিচালনা করেছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং তাদের প্রতিভূ ও সহযােগীদের কথা কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ তারা দায়ী নয়।
এ অধ্যায়ে তিনি আরাে বলেছেন, ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়েছিল সামন্ত শ্রেণীর এবং পূর্ব পাকিস্তানে ক্লাসলেস সােসাইটি’র। পাকিস্তানের যেসব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তারাও এ কথা বলেছেন, তবে শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলেননি, বলেছেন পূর্ব বাংলার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীই ছিল প্রবল এবং প্রভাবশালী। প্রাক-স্বাধীনতা (১৯৪৭) পর্বে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল অনুগত সুতরাং ব্রিটিশরা সব ধরনের চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ােগ দিয়েছে। পূর্ব বাংলার মানুষদের আনুগত্য সম্পর্কে ব্রিটিশরা ছিল সন্দিহান। ফলে এ অঞ্চলের মানুষরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৪৭-এর পর তাই দেখা যায় সরকারি চাকরিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলাে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ঐতিহাসিকভাবেই পূর্ব বাংলা ছিল ‘হিন্টারল্যান্ড’, এখানে শিল্প গড়ে ওঠেনি। ১৯৪৭-এর পর পূর্ববাংলা থেকে আধিপত্য বিস্তারকারী হিন্দু ব্যবসায়ী ও কারিগররা চলে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা তা কিনে নেয় বা নতুন শিল্প গড়ে তােলে। তাছাড়া বাঙালিরা সবসময় “Showed certain prejudices against foreign capital and capitalists, particularly Muslim” সবাইকে তারা পশ্চিম পাকিস্তানি ভাবত কিন্তু তাদের অনেকেই ছিল বহিরাগত, পশ্চিম পাকিস্তানেরও। অর্থাৎ, তিনি যা ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন তা হলাে : মুসলমানদের বাঙালিরা পছন্দ করত না। পছন্দ করত কাদের? হিন্দুদের।
ফজল মুকিম বলছেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তান। সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের মােহ ভাঙল। এটি অবশ্য সত্য। তিনি লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আইয়ুব খানের কাছে হারলেন ফাতেমা জিন্নাহ এবং বাঙালিরা তখন বুঝল এই ব্যবস্থায় তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবে। না। সেনাবাহিনী দুই অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারত। কিন্তু তখন দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত এবং “The feeling of uneasiness and loneliness produced by the war started taking root” যে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল কেন্দ্রীয় সরকার তা দূর করার কোনাে ব্যবস্থা নেয়নি। পাকিস্তানের ২৫ বছরের ইতিহাসে দুটি অঞ্চলকে সত্যিকারভাবে একত্রিত করার কোনাে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং সরকারের অনেক নীতি দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ কারণে ফজল মুকিম কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারােপ করেননি। তার। 200, “The Government case, therefore, went by default, so did that of the western wing. No literature and no white papers were ever issued, and the Government’s information media miserably failed. The great strides made in social and economic fields in East Pakistan remained unappreciated.” এ কারণেই সৃষ্টি হলো ৬ দফার।
এরপর একটি ইন্টারেস্টিং তত্ত্বের অবতারণা করেছেন ফজল মুকিম খান। তাঁর মতে, শুরু থেকেই ভারতের নীতি ছিল দ্বি-মুখী । পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তার দ্বার ছিল রুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল উন্মুক্ত। ১৯৪৭-এ নেহেরুলিয়াকত চুক্তি বলে লােক-বদলের যে নীতি গৃহীত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য হয়নি। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানে ৮০% সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানদের হাতে এলেও পূর্বাঞ্চলে যেসব সম্পদ রয়ে গেল হিন্দুদের হাতে ক্রমান্বয়ে তারা তা পাচার করল ভারতে। প্রতি বছর পূর্ব পাকিস্ত নি থেকে হিন্দুরা ৭৫০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টাকা স্মাগল করে বা অন্য উপায়ে নিয়ে যেত ভারতে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাটি ছিল তাই। ১৯৪৭-এ পূর্ববঙ্গের ১২১০টি হাইস্কুল এবং ৬৭ টি কলেজ চলত হিন্দুদের টাকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে হিন্দুশিক্ষকরা ভারতে প্রকাশিত বইপত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দিত যা ছিল ইন্ডিয়ান প্রপােগাণ্ডায় ভরা। ফলে, পাকিস্তানি কোনাে চেতনা পূর্ববঙ্গের তরুণ জেনারেশনদের মধ্যে জাগেনি; পরিণামে ‘ইস্ট পাকিস্তানি মুসলিমস’রা রূপান্ত রিত হলাে বাঙালিতে। এখানে লেখকের মন্তব্যটি দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃত করতে। চাই। কারণ, অধিকাংশ পাকিস্তানি এ তত্ত্বে বিশ্বাস করে এবং পাঠকদের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিকা সম্পর্কে পাকিস্তানি তত্ত্বটি পরিষ্কার হবে”The Pakistan cause came to be connected with West Pakistan only. Thus the internal disenssions were being fostered to destroy Pakistan, and regional affinities were being encouraged and Pakistani patriotism downgraded. The seeds oí the crisis between East and West Pakistan, sown by professors and teachers of the minority community, yiclded a flourishing crop. In twenty-four years, the type of education imparted to them together with insistent Indian propaganda changed the East Pakistani Muslirns to Bengalis. A considereable reaction of young East Pakistan was therefore the first to break away from Pakistan and it basis
শুধু তাই নয়, ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ এ সময়টুকুতে দেখা যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু নেতারা অনুপস্থিত। তারা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বরং সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে আত্মনিয়ােগ করে। সারা পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে এবং পাকিস্তান-বিনাশী কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায় । কিন্তু কেন হিন্দু-নেতারা অনুপস্থিত ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে? উত্তর দিতে হলে ফজল মুকিমকে বলতে হতাে, পাকিস্তান সরকার তাদের বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে মনে করত, তাদের দেশ ‘ভ্যাগে, আত্মগােপন করে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। তবে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিককর্মীরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা তাঁর নজর এড়ায়নি। এ বিষয়ে পাকিস্তানে তাে বটেই আমাদের এখানেও অনেকে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন।
এরপর এলাে আগরতলা মামলা। আইয়ুব খান বাধ্য হলেন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে। উপসংহারে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশ্লেষণ করলে ফজল মুকিমের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আরাে স্পষ্ট ধারণা হবে। তিনি বলছেন, স্বাধীনতার প্রথম দশকে রাজনৈতিক নেতাদের ‘misrule and misdeed’s এর কারণে আইয়ুবের উত্থান কিন্তু অন্তিমে তারাই সমর্থ হয় তাকে ধ্বংস করতে। প্রথম দশকে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ, লিয়াকত আলি, নাজিমুদ্দিন প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযােগ্য। অন্য কথায় প্রথম দশকের প্রথমার্ধে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। আমলাতন্ত্রের প্রভাবের কারণে তা পারা। যায়নি এবং আমলাতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবেই আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন। সিভিল সমাজের আধিপত্য যে জেনারেলের পছন্দ নয় তা বােঝাই যাচ্ছে। অবশ্য হবার কথাও নয়। পাকিস্তানের সব জেনারেলের লেখা আত্মজীবনীতেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায় সবাই তাদের বইয়ের উপসংহারে বলেছেন। পাকিস্তানের বিপর্যয়ের জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী। ১৯৬৯-৭১ এ সময় কালটুকু কেমন ছিল? যেমনটি হয় সামরিক শাসনামলে তেমনই ছিল, লিখেছেন ফজল মুকিম। ক্ষমতায় ইয়াহিয়ার আরােহণের পর এক বৈঠকে সিএমএলএ-র প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার বলেছিলেন-গতবার সিভিলিয়ানরা ভুল করেছে, দোষ পড়েছে আমাদের। এবার আমরা সব করব, ক্রেডিটও নেব। নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করেছিল সরকারের কর্মপদ্ধতি। অর্থাৎ এবার সামরিক আমলারা নির্দেশ দেবে, অন্য সবাই তা মানবে। ফজল মুকিম কিন্তু তারপর আবার বলছেন, তবে এটা বলাও ঠিক হবে না যে পুরােপুরি তা সামরিক শাসনই ছিল কারণ এর রুলস রেগুলেশন সামরিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রণীত হয়নি। বােঝা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনী বা সামরিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি কোনাে বিতর্কে জড়াতে চান না এবং সবার ওপরেই তাকে রাখতে চান, যে কারণে ১৯৬৯-৭১ এর ঘটনাবলির জন্য দোষারােপ করেছেন ইয়াহিয়া খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ চক্রকে, “It should not be mixed up with the HQ CMLA.” | ফজল মুকিম লক্ষ করেছেন, ১৯৬৯ সালের পর থেকে পূর্বাঞ্চলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসারদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি ও সেনাবাহিনীকে একই চোখে দেখা
হতাে এবং তাদের প্রতিও ঘৃণা বাড়ছিল। তিনি বুঝে উঠতে পারেননি কেন এই ঘৃণা বাড়ছে? কারণ, সেনাবাহিনী কি ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় কাজ করে নি? এই ঘৃণা সেনাবাহিনীকেও অবাক করেছে। লেখকের মতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কখনও কোনাে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য দেখায়নি। তারা বৈধভাবে (শব্দটি লক্ষ করুন, বৈধভাবে) স্থাপিত কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধীনেই থেকেছে। ফজল মুকিমকে এ প্রশ্নটি করা উচিত ছিল, সেনাবাহিনী যদি দেশের প্রতি অনুগতই হয় তাহলে সিভিল রুল উৎখাত করে কিভাবে তাদের প্রতিনিধি আইয়ুব বা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন? সিভিল শাসন উৎখাত করা বৈধ কি না? ফজল মুকিমরা এ ধরনের মন্তব্য করেন এ কারণে যে, তারা সেনা শাসনের বেনিফিসিয়ারি। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সরল চিত্তে তিনি এসব মন্তব্য করে গেছেন। আসলে, সেনা-কর্তৃক উৎখাতকার্য যে বৈধ তা-ই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। | ১৯৭০ সালে নির্বাচন হলাে। লিখেছেন মুকিম, শেখ মুজিব নির্বাচনে জিতলেন। ইসলামাবাদের শাসকচক্র তা ভাবেনি। ফলে, তারা যে চিন্তাভাবনা করে রেখেছিল নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য তা পাল্টাতে হলাে। আওয়ামী লীগ কিন্তু সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখানে তিনি একটি তথ্য দিয়েছেন যা কোথাও আগে বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়নি। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগের সামরিক পরামর্শক কর্নেল ওসমানী একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে। এর তিনটি পর্যায় ছিল :
প্রথম পর্যায় : রাজনৈতিক আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া, দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দূর করা এবং সময়-সুযােগ বুঝে স্বাধীনতা ঘােষণা করা।
দ্বিতীয় পর্যায় : প্রথম পর্যায় ব্যর্থ হলে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল। এ কারণে বাংলাদেশকে ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হলাে- ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা; চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা; কুমিল্লা, নােয়াখালি ও সিলেট জেলা; খুলনা, যশাের ও বরিশাল জেলা; দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলা এবং রাজশাহী ও পাবনা জেলা। প্রতিটি সেক্টরের জন্য কমান্ডার ঠিক করা হলাে। কমান্ডাররা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মারফত কাজ করবেন। কিন্তু যােগাড়ের ভার থাকবে গণপ্রতিনিধিদের ওপর। ৩.তৃতীয় পর্যায় : প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় ব্যর্থ হলে জনসাধারণ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার যার জেলার বিপরীতে ভারতীয় ভূখণ্ডে চলে যাবে এবং যাবার সময় পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ করবে। বস্তুত দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্য হবে, বাংলাদেশ ইস্যুর আন্তর্জাতিককরণ। এরপর শুরু হবে প্রতিরােধ ও গেরিলাযুদ্ধ।
এ ধরনের ইঙ্গিত আরাে অনেকে করেছেন। আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী মনে করেন, যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিল না। তারা পাকিস্তানের সঙ্গেই সবসময় থাকতে চেয়েছে। বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু উপরােল্লিখিত তথ্য মেনে নিলে ঐ তত্ত্ব নাকচ হয়ে যায়।
লে. জে. ওয়াসিউদ্দিন এ সময় রাওয়ালপিন্ডিতে অফিসার কুরিয়রের মাধ্যমে একটি সংবাদ পাঠিয়েছিলেন
১. পাকিস্তানের এক অংশ থেকে অন্য অংশে প্লেন যেতে ভারত বাধা দেবে।
২. ভারত পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করবে যাতে পূর্ব । সীমান্তে পাকিস্তান বড় ধরনের সমাবেশ ঘটাতে না পারে। | ফজল মুকিমকে এসব তথ্য দিয়েছেন তিন জন বাঙালি অফিসারবিগ্রেডিয়ার এম আর মজুমদার, লে. কর্নেল এ এস বি ইয়াসিন ও সামছুল হাসান। অন্যদের সম্পর্কে জানি না, তবে এটুকু জানি এম আর মজুমদার শুরু থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিলেন। যে কারণে তাকে ২৫ মার্চের আগেই গ্রেফতার করা হয়। ফজল মুকিমের মতে, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত ছিল এবং কিছু সিনিয়র সিভিল ও পুলিশ অফিসারের তা জানা ছিল। পরে সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি অফিসারদের এ বিষয়ে কনভিন্স। করে এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। | ১৯৭১-এর গােড়ার দিকেও জেনারেল ইয়াহিয়া ঠিক করতে পারছিলেন না যে তিনি কী করবেন। বিভিন্ন মহলের চাপ ছিল তার ওপর। তাছাড়া **Various intelligence agencies had a personal stake in ensuring that Mujib did not corne to power.” অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছিল বাঙালিদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেয়ার জন্য। | জেনারেলের ভাষায় পরামর্শটি ছিল এ রকম- “The killing of a few thousand would not be a high price for keeping the country together. Handing over power to Mujibur Rahman, a proved traitor, would be a blunder and history would never forgive Yahyah Khan for this 154 পাকিস্তানে বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলােচনাকালে অনেকে এ তথ্য সমর্থন করেছেন।
২৬ মার্চ পর্যন্ত কী ঘটেছিল, এরপর ফজল মুকিম তার বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ণনাটি অন্য অনেক বইয়ের মতােই বা বলা যেতে পারে অন্যান্য বইয়ের বিবরণকে সূত্র ধরে ফজল মুকিমের এই বিবরণ, কারণ তার বইটিই প্রথম। বেরিয়েছিল। ফজল মুকিমের এই বিবরণের মূল কথা হলাে- আইন-শৃঙ্খলা
পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছিল, আওয়ামী লীগ সবাইকে উত্তেজিত করে তুলছিল, বিহারিদের হত্যা করা হচ্ছিল, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চলছিল। আসলে কী ঘটেছিল তা আমাদের জানা। সুতরাং, এ বিবরণের কতটুকু সত্য, কতটুকু অনুমাননির্ভর তা পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে, এখানে বিশেষভাবে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। জেনারেলের এই দীর্ঘ বিবরণে জুলফিকার আলি ভূট্টোর উল্লেখ নেই, তার কর্মকাণ্ডের বিবরণ নেই, তিনি কীভাবে পরিস্থিতি ঘােলাটে করে তুললেন সে সম্পর্কে কোনাে মন্ত ব্য নেই, সেনাবাহিনী কীভাবে ভূট্টোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করল সে বিষয়েও কোনাে বক্তব্য নেই। ফজল মুকিমকে ভূট্টো সামরিক সচিব হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
ফজল মুকিম খানের বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়টি ২৫ মার্চের ওপর। ২৫ মার্চের ঘটনার বিবরণ তিনি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য জেনারেলদের বইতেও ২৫ মার্চের উল্লেখ আছে বিভিন্নভাবে। তবে, মনে হয়, পরবর্তীকালে। যারা লিখেছেন তাদের অনেকের প্রধান অবলম্বন ছিল ফজল মুকিমের এই বর্ণনা। এ বর্ণনারও কতটুকু সত্যি তা আমরা যারা ঢাকায় ছিলাম তাদের পক্ষে বােঝা সহজ। ফজল মুকিম লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে, সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের বাধা দূর করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিল। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল কেউ গুলি করলে গুলি করার বা প্রতিরােধ করলে তা ভেঙে দেয়ার। এবং বিরােধীদের মনে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত সৃষ্টি ও রাস্তার জনতা হটাবার জন্য কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে গুলি ছােড়ার । শেখ মুজিব পালাননি। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কেন পালাননি তিনি? এ প্রশ্নের জবাবে, ঢাকার স্টেশন কমান্ডারকে শেখ মুজিব বলেছিলেন- ‘To save Pakistan’. ফজল মুকিম বর্ণিত একটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিনি লিখেছেন, ইকবাল হল থেকে অনেক ভারতীয় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং উদ্ধার করা হয়েছিল বেশ কিছু অবাঙালি মেয়েকে যাদের পতিতা হিসেবে সেখানে রাখা হয়েছিল। এই অপারেশনে সেনাবাহিনীর পক্ষে মারা গিয়েছিল ৪ জন, ৯৭ জন সিভিলিয়ানকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১৫০, অন্যান্য হিসাবে ৫০০ জন ৫০ এ বর্ণনা পড়লে মনে হবে, সারাবিশ্বের পত্রপত্রিকা যা লিখেছে বা
সংবাদমাধ্যমে যা প্রচারিত হয়েছে তা ছিল মিথ্যা আর জেনারেল ফজল মুকিম খানের বিবরণ সত্যি! আসলে, জেনারেলদের এ ধরনের ধারণা পাকিস্তানের পতন ত্বরান্বিত করেছে। ফজল মুকিমের ষষ্ঠ অধ্যায়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। এর শিরােনাম মুক্তিবাহিনী’ । আপনাদের নিশ্চয় ১৯৭১-এর পাকিস্তানি প্রপাগাণ্ডার কথা মনে আছে যেখানে মুক্তিবাহিনী’ ছিল ‘দুষ্কৃতকারী’। পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনী তাই ছিল । জেনারেলরা যখন ১৯৭১-এর যুদ্ধের কথা লিখেছেন তখন পারতপক্ষে মুক্তিবাহিনী’ শব্দটির উল্লেখ করেননি। জেনারেল নিয়াজীর বইতে অবশ্য উল্লেখ আছে মুক্তিবাহিনীর । কিন্তু এভাবে অধ্যায়ের শিরােনাম কেউ দেননি। এর একটি কারণ হয়তাে হতে পারে যে, জেনারেল খান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ফজল মুকিম অবশ্য অধ্যায়ের গােড়াতেই এ কথা উল্লেখ করতে ভােলেননি যে, ভারতই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছে। মুক্তিবাহিনীতে কয়েকবার হতাশা দেখা গিয়েছিল কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিক্রমের কাছে তারা বা ভারতীয় বাহিনীরা সুবিধা করতে পারছিল না। অনেকে ফেরতও আসছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের হতাশার সুযােগ নিতে পারেনি। এ ধরনের মন্তব্য স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ‘ অধ্যায়টিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবদানটা তিনি চাপা দিয়ে রাখতে পারেননি।
তিনি অবশ্য বলেছেন, ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকেই সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের অনেক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যেমন, রুশপন্থি জঙ্গী বাহিনী, চীনভক্ত মুক্তি কমিটি, আর্মি ফর লিবারেশন অফ ইস্ট বেঙ্গল, জাতীয় মুক্তি জোট। আমরাও আজকাল এ ধরনের তথ্য পাচ্ছি যে, এক ধরনের নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে। তবে, ফজল মুকিম যেভাবে বলছেন, সেভাবে নয় নিশ্চয়। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৬৯ সালের ১১ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক চলাকালীন আইয়ুব খান বলেছিলেন মুজিবকে যে, ভারত থেকে কিছু লােক। প্রবেশ করছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং সৃষ্টি করছে অস্থিতিশীলতার, তারা বন্দুক বিক্রি করছে ৪০ টাকায়। মুকিম যা বলতে চেয়েছেন তা হলাে, এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে মানসিকভাবেই অনেক বাঙালি প্রস্তুত ছিল, যে কারণে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে তেমন অসুবিধা হয়নি। লিখেছেন তিনি, পাকিস্তানে। অনেকে মুক্তিবাহিনীকে খাটো করে ভারতীয় সেনা, সীমানা রক্ষা-বাহিনীকে ক্রেডিট দিতে চায়। ভারতও প্রথমে তাই করত, পরে দেখল যে, এরকম প্রচারে
তারই ক্ষতি। তিনি বলতে চেয়েছেন, মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। লিখেই ফেলেছেন এক জায়গায়- “Particularly the EBR had fought with skill, courage and fanaticism which should have surprised no one who knew these units.” এর পরের চারটি অধ্যায়ের শিরােনাম হচ্ছে- ডিফেন্স প্ল্যানস, ইন্ডিয়ান প্রিপারেশনস, স্টেট অফ দি আর্মি ইন নভেম্বর, ১৯৭১। এসব অধ্যায়গুলি আমাদের বর্তমান আলােচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রায় জেনারেলদের এ ধরনের আলােচনাগুলি গত্বাধা। আমাদের বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক উল্লিখিত শেষ অধ্যায়টি।
নভেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পর্কে মতামত এই যে, এদের মনােবল হ্রাস পাচ্ছিল, ছিল না সমন্বয়, ভুগছিল তা অনিশ্চয়তায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি হিসাব দিয়েছেন যা অন্য কারাে বইতে দেখি নি, হিসাবটি হলাে পাকিস্তানি সেনাদের মৃত্যুর হার । মার্চ-এপ্রিলে মৃত্যুর হার ছিল প্রতিদিন ১৫-এর নিচে। মে-জুন মাসে এ হার ছিল প্রতিদিন ৩ জন, জুলাই থেকে আবার মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে এবং নভেম্বরে গিয়ে তা দাঁড়ায় ১০০০ জনে। সেনাবাহিনীর ওপর এর অভিঘাত ছিল প্রচণ্ড, ‘ডিমরালাইজিং’। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ-সমর হচ্ছে না অথচ গেরিলা আক্রমণে মারা যাচ্ছে এটাতে তারা হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছিল এবং তা “Adding to the strain on the proud army.” পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের অনেক কারণ তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, এর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং কিভাবে তা ক্ষতিকর হয়েছে ইত্যাদির বিবরণ দিয়েছেন। তবে একটি মন্তব্য তিনি করেছেন যা তার কাছে তেমন উল্লেখযােগ্য মনে হয়নি কিন্তু আমার কাছে হয়েছে এবং পাকিস্তানিদের পরাজয়ের এটি অন্যতম কারণ বলে মনে হয়েছে। সেটি হলাে, দীর্ঘ সময় নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশের কারণে ক্রমান্বয়ে সৈন্যরা বাধ্য হচ্ছিল এমন সব অঞ্চলে থাকতে যা সহজে রক্ষা করা যায়। সব সময় তারা পরিবেষ্টিত এবং আত্মরক্ষার জন্য যে কৌশল দরকার তাও নেই- এ সবই তাদের জন্য সৃষ্টি করেছিল গা শির শির করা ভবি। তার ভাষায়- “They were getting fixed,
with no manoeuvreability left to them. The feeling of being surrounded was creeping in as any laxity on their part was invariably punished by the Mukti Bahini.”
‘ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করল’- বইয়ের একাদশ অধ্যায়ের শিরােনাম। তারপর ‘ঢাকার পতন। এ দুটি অধ্যায়ের বাঙালি পাঠকদের আকর্ষণ করার মতাে কোনাে বিত্তান্ত নেই। পরবর্তী তিনটি অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের যা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। শেষ অধ্যায় ‘রিজনস ফর ডিবাকল’ বা বিপর্যয়ের কারণটি বরং আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এটি লিখতে যে তার ভালাে লাগেনি সেটা বােঝা যায় অধ্যায়ের শুরুর বাক্যটিতে “Pakistan was not defeated; it was humilated, which is still worse.” এরপর বিস্তারিতভাবে বিপর্যয়ের কারণগুলি তিনি বর্ণনা করেছেন। এগুলি হলাে : একটি কার্যকর শাসনতন্ত্র তৈরির ব্যর্থতা, শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব, জাতীয় বিষয়ে অনিশ্চয়তা, তথ্যমাধ্যম কর্তৃক কিছু ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর জন্য প্রচারণা। আরাে আছে, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রতিরক্ষা বিষয়টি জনমানসের অগােচরে রাখা এবং কারাে কাছে এদের দায়বদ্ধ না থাকা। এ বিষয়টি সাধারণ সামরিক অফিসাররা অবসর গ্রহণের পর উল্লেখ করেন। তিনি আরাে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে সমস্ত ক্ষমতা সিএমএলএ-এর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকাও বিপর্যয়ের মস্ত কারণ। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে একটি যুদ্ধের মুখােমুখি হয়েছে। কোনাে জাতীয় লক্ষ্য ছাড়া। শুধু তাই নয়, তার মতে, পূর্বপাকিস্তানে যুদ্ধটা হলাে শুধু ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য। ঢাকায় আত্মসমর্পণের কারণ হাইকমান্ডের এবং তাদের নিযুক্ত কমান্ডারদের অযােগ্যতা। এরপর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিভাবে ঢেলে সাজানাে যায় তার উল্লেখ করেছেন তিনি।
কিন্তু এগুলি অর্জিত হবে কিভাবে? এগুলি অর্জিত হবে তাঁর ভাষায়, “Well defined and efficient political institutions for conducting the affairs of state.” এসব প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। ২৫ বছরের সৃষ্ট পটভূমিকার জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে গেল। এ জন্য সবাই কমবেশি দায়ী তবে বেশি দায়ী রাজনীতিবিদরা। সবকিছু ভুলে তাদের এখন ভালােভাবে দেশ শাসন করতে হবে। “They mustponder earnestly over what great damage they have already done to the country and get down to redemning their past mistake.” | ফজল মুকিম খানও শেষাবধি অন্যান্যদের মতাে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, পাকিস্তান ভাঙার জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী এবং রাজনীতিবিদদের
পরামর্শ দিয়েছেন। এই যে পরামর্শ দেয়ার এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি গায়ের জোরে ভেঙে দেয়াই পাকিস্তানের পতনের কারণ, জেনারেলদের মাথায়ই তা ঢােকেনি। বা বুঝলেও নিজ স্বার্থে তা এজেন্ডার বাইরে রাখতে চান। জেনারেল ফজল মুকিম খানের বইটি তার আরাে একটি উদাহরণ । এই বইটি খুব পরিচিত নয়। আমি মূল বইয়ের একটি ফটোকপি করাতে পেরেছিলাম বছর দশেক আগে। বইটির নাম ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ। লিখেছেন ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লা খান, হিলাল ই জুরাত । লাহােরের ‘লাহাের ল’ টাইমস পাবলিকেশন’ বইটি প্রকাশ করেছিল ১৯৭৫ সালে। সাদুল্লা বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘টু দোজ হুম উই ফেইলড’। দুই পর্বে বইটি বিভক্ত, অধ্যায়ের সংখ্যা ২৮
সাদুল্লার র্যাংক মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ছিল তা তিনি উল্লেখ করেননি। তবে তার লেখার সূত্র ধরে অনুমান করছি তা হতে পারে লে. কর্নেল বা কর্নেল। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারতে অবস্থান করেন। পাকিস্তানে ফেরত আসার পর ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। পাকিস্তানি সামরিক অফিসার যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে ছিলেন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। তাদের মধ্যে সাদুল্লাহর বইটিই খুব সম্ভব প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। যুদ্ধের স্মৃতি বা সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ ও পরাজয়ের স্মৃতি সব কিছুই তখন উজ্জ্বল (বা ক্ষতটা দগদগে) সে জন্য তার আসল সত্ত্বা অনেকখানি প্রকাশিত এই বইয়ে যা অন্যান্য গ্রন্থে পাওয়াটা দুষ্কর। একজন পাকিস্তানির মনােভাব আসলে কী পরে অনেকে তা লুকিয়েছেন কিন্তু সাদুল্লাহ সে সময় পাননি। বইটির ছত্রে ছত্রে তার পরিচয় পাওয়া যাবে।
প্রারম্ভিকের প্রথম অনুচ্ছেদটিই দেখা যাক
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহ করল। তাদের ‘সূনসর ছিল ভারতীয়রা। বিদ্রোহ তাৎক্ষণিকভাবে দমন করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তাদের জালে আটকা পড়ে। তারা যে রক্ত জমাট করা অপরাধ করেছিল নিষ্পাপ ও অস্ত্রহীন অবাঙালিদের বিরুদ্ধে বাচ্চাই সাকাই (কাবুলে বিদ্রোহী) আমলে, তার বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেয়া হতে পারে অনুমান করে পরিবার-পরিজন ও বাক্সপ্যাটরা নিয়ে তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যায়। বিদ্রোহ দমিত হলাে বটে কিন্তু insurgency-র জন্ম হলাে। বাঙালি সামরিক নেতৃত্ব অবসান হলে তার স্থান গ্রহণ করে ভারতীয় জেনারেল স্টাফ। এপ্রিলের শুরুতে ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন কমান্ডকে ভার দেয়া হয় ‘Perpetuating Insurgency in East Pakistan.” ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ সিং ছিলেন প্রথম কমান্ডার। তিনি সীমান্ত বন্ধ করে দেন যাতে বাস্তুহারারা ভারত ত্যাগ করতে না পারে। বাস্তুহারারা ভারতে থেকে যেতে পারত কিন্তু বেরুতে পারত না। তরুণদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ‘enroll’ করা হলাে। শুরুতে এই স্বেচ্ছাসেবীরা উৎসাহ উদ্দীপনা দেখিয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনদের আলাদা করে রাখা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, যাতে তারা অন্নকষ্টে না থাকে, আসলে তাদের রাখা হয়েছিল “Protective custody’-তে। ব্যবস্থাটি ছিল সমায়ােচিত। সাদুল্লা আরাে জানাচ্ছেন, স্বেচ্ছাসেবীরা ঘরে ফিরতে চাচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ভারতীয় অক্টোপাশের নাগপাশে তারা বন্দী। তবে, স্বেচ্ছাসেবীরা অনেকে অনুপ্রবেশ করতে চায়নি, অনেকে অস্ত্র ত্যাগ করল। কিন্তু, তারা তাে ভারতীয়দের চেনেনি। ভারতীয়রা তাদের পরিবার-পরিজনদের শিরচ্ছেদ করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতে লাগল। নদীতে ভেসে ভেসে তা আসতে লাগল পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানিরা প্রথমে বুঝতে পারেনি এতসব লাশ আসছে কোথা থেকে? পরে, আওয়ামী লীগ সূত্রেই তা জানা গেল। লীগও অনুপ্রবেশকারীদের বলেছে তারা পক্ষ ত্যাগ করলে তাদের অবস্থা এমন হবে। পুরাে বিষয়টির সারসংক্ষেপ বােঝা যাবে এক গ্রেফতারকৃত মুক্তি’র মন্তব্যে। হায় আল্লাহ! কী যে করি। যুদ্ধ করলে পাকিস্তানিরা হত্যা করবে। না করলে ইন্ডিয়ানরা ধ্বংস করে দেবে।
সাদুল্লার পুরাে বর্ণনা যে ডাহা মিথ্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কী ধরনের প্রচারণা চালিয়েছিল তখন, সেটি সাদুল্লার বর্ণনায় পাওয়া যায়। এই প্রচারণা চালানাে হয়েছিল সৈন্যদের মধ্যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাদুল্লার ভাষা প্রসঙ্গে বলতে হয় । ভারতীয় প্রসঙ্গ এলে তার ভাষার পরিবর্তন ঘটে। যেমন- “The Indian octopus had them in their vile and lethal embrace by now.” (4. ii) * “It is bad enough to have ‘hostages to fortune’, the rebels dear ones were now hostages to ‘kali রণজিৎ গুহ নিম্নবর্ণের ইতিহাস আলােচনার সময় সরকারি দলিল পড়ার যে পদ্ধতির কথা বলেছেন, তা প্রয়ােগ না করলে এ ধরনের টেক্সট ব্যবহার ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। যা হােক, সাদুল্লার মতে, বিদ্রোহীরা প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল যদি না ভারতীয়রা তাদের রক্ষা করত। নভেম্বরের দিকে ভারতীয়রা স্বেচ্ছাসেবী তামাশা বন্ধ করে নিজেরাই নেমে পড়ল “…They discarded the force of volunteers fighting in civies and started attacking with regular troops in uniform.” (পৃ. iii)
সাদুল্লার বইয়ের প্রথম পর্বে অধ্যায়ের সংখ্যা ১৫টি। প্রথম পর্বের শিরােনাম “গৃহযুদ্ধ’। প্রথম দু’তিনটি অধ্যায় ছাড়া বাকি সব অধ্যায়ই যুদ্ধ সম্পর্কিত। প্রথম অধ্যায়টি ১৯৭০ সালের সাইক্লোন সম্পর্কিত। পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা এই সাইক্লোন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, সাদুল্লার বর্ণনা তার থেকে আলাদা কিছু নয়। তার মতে, সাইক্লোন হয়েছিল, তবে যে রকম ভয়ংকর হবে মনে করা হয়েছিল তেমন নয়। সিভিল প্রশাসন ত্রাণে ব্যর্থ হলে সেনাদের ডাক পড়ে। কেন্দ্র থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। এখানে সেনাদের তেমন টেকনিক্যাল সাপাের্ট ছিল না। কিন্তু পাক সেনারা তাে দেশপ্রেমে অদম্য। একটি হেলিকপ্টার ছিল বা চালালে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লে. কর্নেল বাবর সেটি করে উদ্ধার কাজ চালাতে চাইলেন। এ ধরণের ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্য কোর্ট মার্শাল হতে পারে। কিন্তু বাবর তার ক্যারিয়ার বা কোর্ট মার্শালের ভয় করেননি। তার দেশের মানুষজন মারা যাবে আর তিনি বসে থাকবেন!
(“If hundreds of thousands of our country men are dying for lack of support. I will risk both my neck and career.”) ত্রাণ কাজে সাদুল্লারা কী দেখেছেন? দেখেছেন সিভিল সরকারের ব্যর্থতা। অবলােকন করেছেন সেনাদের দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততা। সাধারণ মানুষ নানা অসুবিধায় ছিল বটে কিন্তু ত্রাণের জন্য বা অর্থের জন্য তারা সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল। এমনকি তারা মৃতদেরও কবর দিত না আরাে ত্রাণের আশায়। তারপর এলাে নির্বাচন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ছিল। তুঙ্গে তারপর তাতে ভাটা পড়ছিল। তবে সংগঠিত ছিল লীগ আর তারা দুটি | বিদেশী দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছিল। সাদুল্লী দেশ দুটির নাম করেন নি, করলে একটি হতাে ইন্ডিয়া। এপ্রিলে পটুয়াখালি উদ্ধারের পর বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে সাদুল্লারা ত্রাণের অনেক জিনিসপত্র পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ কর্মীরা ১৯৭০ সালেই ত্রাণের জিনিসপত্র সরাচ্ছিল যাতে ১৯৭১ সালে তা কাজে লাগে।
ত্রাণ কাজের সময় শেখ মুজিব সেনাদের প্রশংসা করলেও প্রকাশ্যে তাদের প্রশংসা করা থেকে বিরত থেকেছেন। আওয়ামী কর্মীরা উদ্দাম হয়ে উঠছিল । সরকারের আওয়ামী তােষণ নীতি চরমে উঠেছিল। সাদুল্লা একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। ভােলায় তােফায়েল ত্রাণ দিতে যাবেন। এক হাবিলদার নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল । তােফায়েল হাবিলদারকে বললেন, তাকে ও তার সঙ্গীদের পাশের গ্রামে পৌছে দিতে। হাবিলদার বিনীতভাবে জানালেন, তিনি তার কমান্ডিং অফিসারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তােফায়েল তাকে চড় মেরে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার থেকে কি তােমার পশ্চিমা কমান্ডার বেশি গুরুত্বপূর্ণ?” তােফায়েল তার সঙ্গীদের ইমপ্রেস করতে চাইছিলেন, দেখাতে চাইছিলেন আর্মি কিছু নয়। সাদুল্লার মন্তব্য
“He was right. The army was being prostituted in the name of Martial Law.” [পৃ. ১৫]।
তােফায়েলের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেও কিছু হয়নি। বরং, পত্র পত্রিকায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলতে লাগল । | সাদুল্লার মূল বক্তব্য, সেনাবাহিনী মানুষের সেবা করেও মানুষের মন পায়নি। আওয়ামী লীগ ওয়াজ উইনিং’। সাদুল্লার বিবরণ যদি ঠিক হয়, নিজেকেই তার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, তাহলে কারণটা কী? এ প্রশ্ন সেনাবাহিনী নিজেদের কখনও করেনি। আর তা না হলে বলতে হয় সাদুল্লার বিবরণ মিথ্যা। একটি উদাহরণ দিই। প্রায় প্রত্যেক পশ্চিমা সেনা অফিসার ১৯৭০ সালের সাইক্লোনের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, বেশি ত্রাণ বা টাকা পাওয়ার আশায় বাঙালিরা মৃত আত্মীয়স্বজনদের লাশ দাফন করেনি বা কয়েকবার কবর দিয়েছে। এত বড় জঘন্য মিথ্যা পাকিস্তানিদের বিবরণ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না । এমনকি সেই সময় প্রকাশিত জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামেও। দ্বিতীয় অধ্যায় ‘দি রােড টু ডিজাস্টার’ । বা বিপর্যয়ের পথে। ঢাকার ১৪ ডিভিশনের কলােনেল স্টাফ হিসেবে ছিলেন সাদুল্লা। ইয়াকুব খান ছিলেন কমান্ডার । তাকে ‘গ্রেট টিচার’ বলে উল্লেখ করেছেন সাদুল্লা। তিনিই তাদের এ বিষয়ে সচেতন করেছিলেন যে, পূর্ববঙ্গে কোনাে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। সাদুল্লার ভাষায়, এর তাৎপর্য আমাদের পূর্ব পাকিস্তানি সহকর্মীরা ভালােভাবেই অনুধাবন করেছে। | ১৯৭১ চলে এলাে। আওয়ামী লীগের হাতে সব কর্তৃত্ব। আর্মি ব্যারাকে
আবদ্ধ। তবে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল বিহারিরা। সাদুল্লা লিখেছেন, তাদের জীবন, সম্মান, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সংগঠিত হত্যাকাণ্ড শুরু হলাে। বিহারিরা পালাতে লাগল। ঢাকা বিমানবন্দর বাস্তুত্যাগীদের ভিড়ে একাকার। তাদের ক্রোধ সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। দুটি টিকেটের জন্য একটি গাড়ির হাতবদলের কথাও শােনা গেল। বিমানবন্দরের কাছে ফৌজদের সামনে কিছু অবাঙালিকে হত্যা করা হলাে। তাদের অনেকে ক্রোধে মাটিতে রাইফেলের বাট ঠুকতে লাগল কেননা গুলি করার কোনাে হুকুম ছিল না।
“It was utterly humiliting.” (9. 3b]
বিহারিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ‘ভায়ােলেন্সের কথা প্রায় সব পশ্চিম পাকিস্তানিই উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গ পরে বারবার আসবে। শুধু উল্লেখ করতে চাই, যদি মেনেই নিই এরকম হত্যাকাণ্ড হয়েছে তাহলে ২৫ মার্চের ঘটনা কি তার প্রতিশােধ? তাহলে, সেনাবাহিনী বলতে গেলে অখন্ড পাকিস্তানের নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের। সুতরাং, পাকিস্তান রক্ষার যৌক্তিকতা তখন আর সেনাবাহিনী দিতে পারে না। সাদুল্লা এমন একটি তথ্য দিয়েছেন যা অন্য কোনাে পাকিস্তানি দেননি। সেটি হলাে, এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন জড়ভরত হয়ে বসে থাকার চাইতে। এটি যে ডাহা মিথ্যা তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা ত্রিশলক্ষ হত্যা করতে পারে নির্বিচারে তারা কিছু বিহারি ‘হত্যা’র জন্য পদত্যাগ করবে সেটি অকল্পনীয়। তার
192, ‘Some officers offered to resign their commissions rather than suffer this agonizing pantomime.’ 14. Sol
এবং প্রশ্ন বিহারিদের জন্য যে জেনারেলদের এতাে ভালােবাসা সেই জেনারেলরা পাকিস্তান হওয়ার পর তাদের কেন প্রত্যাখ্যান করলেন?
২৪ মার্চ জেনারেল খাদিম হােসেন (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) রাজা সাদুল্লাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে একটি পরিকল্পনার কথা শােনালেন। রাজার ভাষায়, “আমরা ২৫/২৬ তারিখে আঘাত হানব! হয়তাে আওয়ামী লীগও প্রস্তুত হচ্ছে। তারাও একটি ডি’ ডে ঠিক করেছে। নির্দিষ্ট তারিখ আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জানি, তাদের সামরিক প্রস্তুতি যা করার ছিল তা হয়নি। আমি ইতােমধ্যে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করেছি। ফরমান যশাের ও খুলনার কমান্ডারদের ব্রিফ করেছে। আগামীকাল তুমি রংপুরের কমান্ডারকে ব্রিফ করাে। রাজশাহীর কমান্ডিং অফিসার গতকাল হজ থেকে ফিরেছে। আমি তাকে বলব কী করতে হবে। রংপুর থেকে ফেরার পথে তাকে
রাজশাহী নামিয়ে দিয়াে।” পাকিস্তানি সেনাদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ যে প্রস্তুত ছিল তা নিশ্চিত করে এ মন্তব্য। রাও ফরমান আলী আমাদের কাছে সাক্ষাৎকারে ও গ্রন্থে যে লিখেছেন, তিনি শুধু বেসামরিক বিষয় দেখতেন এবং এসবের কিছুই জানেন না, সেটি যে ডাহা মিথ্যা, সাদুল্লার বক্তব্যই তার প্রমাণ। এরপর আছে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা দখলের বিবরণ। রাজশাহীর কিছু ঘটনাবলির বিবরণ। এ প্রসঙ্গে র্যাডক্লিফ রােয়েদাদের বিবরণ। মুর্শিদাবাদ ভারতে, সাদুল্লার খেদোক্তি, “এই মুসলিম এলাকাটিকে কসাই র্যাডক্লিফ insatiable হিন্দুদের খিদে মেটাবার জন্য কেটে দিল, এখন তারা আরাে বেশি চায়। পুরাে পূর্ব পাকিস্তানকেই চায়।” সাদুল্লার আফসােস, পাকিস্তানিরা যারা তাদের দেশের জন্য ত্রাণ দিল তাদের পুরস্কার দূরে থাক, মনেই রাখেনি কেউ। অধিকাংশের বক্তব্য, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারেনি। সাদুল্লার এই বক্তব্য, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা নিয়ে। পাকিস্তানিরা কী চোখে। তখন সেনাদের বিচার করছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এ মন্তব্যে।
সাদুল্লা এরপর বেশ কিছু ছােট ছােট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি বােঝাতে চেয়েছেন। যেমন- কামালপুর। কামালপুরে সব সময় হামলা পাল্টা হামলা চলেছে। সাধারণ মানুষ ও সেনাদের সঙ্গে প্রথমদিকে যে ভুল বােঝাবুঝি ছিল তা মিটে গেছে। জাতীয় . লােকেরা সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করছে সেনাবাহিনীদের। ভারতীয়রা আছে। অনুপ্রবেশকারির ভূমিকায়। হজরত আলী স্থানীয় লােক। সে আঞ্চলিক কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করে, ভারতীয়রা যা করছে, পাকিস্তানিরা তা করছে না কেন। কমান্ডার বললেন, হুকুম নেই। [সেই কথােপকথনের মাধ্যমে বােঝাতে চেয়েছেন ভারতীয়রা অবৈধ কাজ করে, পাকিস্তানিরা করে না। পাকিস্তানি সেনাদের হুকুম নেই। কিন্তু সে তাে পাকিস্তানি সৈন্য নয়। সুতরাং আলী তার সাথীদের নিয়ে ফাড়ি পাহারা দিতে চলে গেল। ভারতীয়রা আক্রমণ করল কিন্তু নড়েনি আলী ও সাথীরা। তারা সব শহীদ হলাে। কাহিনীর শেষে জানতে পারি তারা ছিল রাজাকার। সাদুল্লার বক্তব্য, শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তার সাহস বাঙালিদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল । তারা ভারতীয়দের রুখে দাঁড়াতে প্রণােদিত হলাে।’
ধল্লার চৌধুরী
জুন, ১৯৭১ সালের সাদুল্লা গেছেন টাঙ্গাইল সফরে। এক বৃদ্ধ তার সঙ্গে দেখা করে জানালেন। “আমি এসেছি ধাল্লা থেকে। আমার বাড়ি মুক্তিরা ঘিরে রেখেছে। সম্পত্তির পরােয়া করি না কিন্তু আমার দুই নাতনী আছে ঘরে। আমি কোথাও কোনাে সাহায্য পাচ্ছি না । লাহাের প্রস্তাবের পক্ষে হাত তুলেছিলাম দেখে আজ আমার এই হেনস্থা।” সাদুল্লা জানালেন, ছেলেবেলায় তিনিও শ্লোগান দিয়েছেন শেরে বাংলা’ জিন্দাবাদ। ধল্লার লােকটির নাম চৌধুরী আমিনুল হক। সাদুল্লার বাহিনী চৌধুরী ও তার পরিবারকে নিয়ে আসে। সৈন্যরা চলে আসার পর মুক্তিরা বাড়িটি দখল। করে নেয়। চৌধুরীও পরে রাজাকার দল নিয়ে বাড়ি উদ্ধার করে। ফের তা দখল হয়ে যায় । এমনিই চলতে থাকে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত। নকশি সাইদু মুক্তাগাছার লােক। সাদুল্লার ভাষায়, ময়মনসিংহে আছে মুক্তাগাছা ম্যানসন। এর মালিক এক নষ্ট হিন্দু জমিদার। তার জমিজমা ময়মনসিংহে, টাকা পয়সা কলকাতায়। এই প্যাটার্নটি সাধারণ। ফরিদপুরেও সাদুল্লা এক বিশাল অট্টালিকা দেখেছিলেন। মালিক এক ধনী হিন্দু অ্যাডভােকেট। তারও জমিজমা ও বাড়ি এখানে, টাকা পয়সা কলকাতায়। মার্শাল ল’র সময়, লিখেছেন সাদুল্লা, “আমরা হিন্দুদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখেছি। তাদের কারাে ব্যাংক ব্যালান্স চার অংকের ওপর নয়। অর্থাৎ, তারা টাকা-পয়সা। সব পাচার করে ভারতে। সত্তরের নির্বাচনের পর ঐ অ্যাডভােকেট তার বাড়িঘর সারাই করে কারণ এই প্রথমবার দেখা যাচ্ছিল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ‘হিন্দুরা আবার শাসন করবে। সাঈদুর বাপদাদারা এদের হাতে নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। বর্তমান জেনারেশন এসব চিন্তা করে না। তাদের পরে পস্তাতে হবে।” গারাে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে নকশি। সীমান্তবর্তী এলাকা। এর পাহারায় ছিল সুবেদার হাকিম- এক ‘rabid’ বাঙালি জাতীয়তাবাদী। সে চেয়েছিল অফিসার হতে। আওয়ামী লীগ তাকে আশ্বাস দিয়েছিল অফিসার করবে। শর্ত একটি-পশ্চিমা অফিসারদের মারাে। ২৫ মার্চের পর হাকিম অবাঙালিদের হত্যা করল । সাঈদু ছিল তার সঙ্গী। এখানে সাদুল্লা আবার রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তার মতে বাঙালিরা ভুলে গিয়েছিল “The Bengalis had forgotten Rabindranath Tagore. A thousand crimes take birth where a single drop of blood is spilled through tyranny.”
যা হােক, হাকিম বলল এবার ভারত যেতে হবে। অবাঙালি হত্যা কতে সাঈদুরের খারাপ লাগেনি কিন্তু ভারত! অসম্ভব, সাঈদু ফিরে এলাে মুক্তাগাছা। আগস্টে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হলাে। টাঙ্গাইলে ফেরৎ আসা শরণার্থীদের জন্য শান্তি ভবন খােলা হলাে। সাঈদু আত্মসমর্পণ করল। একটি অনুষ্ঠান ও অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন কাওরাইদ বাণিজ্য কেন্দ্র। বাজার পুনরুজ্জীবন ও বাঙালিদের মাঝে সাহস ফিরিয়ে আনার জন্য সাদুল্লা কাওরাইদে এক সভার আয়ােজন করলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের অনারারী প্রপাগাণ্ডা সেক্রেটারি ছিলেন ময়মনসিংহের এক কলেজের পরিচিত এক ইংরেজির শিক্ষক। প্রথম বক্তা ছিল একজন ছাত্রগফরগাঁও-এর আলবদরদের সভাপতি। সভায় ছিল এক প্রাক্তন আওয়ামী লীগ। এমপি। তিনি সপ্তাহ দুয়েক হলাে প্রকাশ্য হয়েছেন। আর ছিল কাদের সিদ্দিকীর দলের একজন। কাদের সিদ্দিকী তখন আহত, তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ । সাদুল্লা নিজেও বক্তৃতা দিলেন। বললেন, পাটের ব্যবসা উজ্জীবিত করতে হবে। ঋণ দেয়া হবে। সবাই আশ্বস্ত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করল। তার ভাষায়
“The stray elements of our nation was getting back into its fold. Pakistan was more profitable. Kaoroid bazar was re-habilitated. The price of jute almost immediately doubled in the local bazar.” 14.ou) সাদুল্লা জানিয়েছেন জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ময়মনসিংহ ছিল। বাংলাদেশে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ এলাকা। কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ। ‘ টেঙ্গাবাের ঘটনা। কাওরাইদ আর বানার নদী যেখানে মিশেছে সেখানে টেঙ্গাবাে। টেঙ্গাববার এক মক্তবের শিক্ষক ২০ বছর বয়সী মান্নান। তার প্রতিপক্ষ স্থানীয় জমিদার যে” হিন্দু। জমিদার তাকে বলেছিল, মক্তবেই থাকো এর বাইরে পাকিস্তান নিয়ে। কথা বলাে না। পাকিস্তানিরা তােমাকে রক্ষা করবে না। মান্নানের জবাব, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। তাকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এ খবর পেয়ে টেঙ্গাবাে রওয়ানা হয়। এসডিওকে নিয়ে অনেক কষ্টে টেঙ্গাবাে “শহীদ” মান্নানের বাসায় পৌছে। মান্নানের পরিবার বিস্মিত। সেনা অফিসাররা ‘, “শহীদের শিশু কন্যাকে আদর করেন। এসডিও ৫০০ টাকা সাহায্য করেন। ‘শহীদ পরিবার উচ্ছ্বসিত।
টেঙ্গাবাে যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বর্ণনা করেছেন সাদুল্লা। “এটি হিন্দু অধু্যষিত ইউনিয়ন। এ ইউনিয়ন থেকে ৬০ জন হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে আর ২০০ হিন্দু মহিলা এম,এ পাস করেছে। একটি মুসলিম দেশ কিন্তু ১৯৬২ পর্যন্ত সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে পরিচালিত হিন্দু স্কুলে কোনাে মুসলমান ভর্তি করা হতাে না।” এ কাহিনীগুলাে সাড়ম্বরে বিবৃত করার মাজেজা কী ? মাজেজা একটি। তা হলাে : হিন্দু প্রভাবিত আওয়ামী লীগ বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। হিন্দুরা ভাবছিল আবার তারা মুসলমানদের শাসন করার ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে। ভারত তাদের সক্রিয় সহযােগিতা দিচ্ছে। তার লেখায় তাই বারবার হিন্দু জমিদারদের কথা এসেছে। ‘অথচ হিন্দু/মুসলমান জমিদারদের দিন শেষ হয়ে গেছে সেই পঞ্চাশ দশকের শুরুতে। | বাঙালিরা প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও পরে ভুল বােঝে, লিখেছেন সাদুল্লা। পাকিস্তানকে অটুট রাখার জন্য বাঙালিরা বিভিন্নভাবে এগিয়ে এসেছে। সহযােগিতা করেছে পাকিস্তানি বাহিনীর। হ্যা, এ কারণে তাদের অনেকে নিহত হয়েছে যে আত্মত্যাগের কথা কেউ মনে রাখেনি।
বাঙালিদের সহায়তায় সেনাবাহিনী শান্তি স্থাপন করতে পেরেছিল। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, আগস্টে কাওরাইদ বাজারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আর এসব কারণে সাদুল্লার নেতৃত্বে ময়মনসিংহ শান্তির দ্বীপে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বইটি বেরিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত। বাংলাদেশকে পাকিস্তান। করার স্বপ্নে বিভাের তখনও জেনারেলরা। এ বই পাকিস্তানিদের এই ধারণা দিতে চেয়েছে, এখনও সব হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তখনও বহির্বিশ্বের মানুষ কমই জানত। যারা এ বই তখন পড়েছে তাদের মধ্যে সে ধারণাই হয়তাে সঞ্চারিত হয়েছে। মূল বিষয় হলাে, পাকিস্তান ভারতের কাছে যুদ্ধে হেরেছে বটে কিন্তু আদর্শের লড়াইয়ে তারা পরাজিত । অভিজ্ঞ মহল খুঁটিয়ে পড়লে দেখবেন যতগুলি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে তা হয় অতিরঞ্জিত নয় মিথ্যা। | প্রথম কথা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জমিদার আসবে কোথায়? এর ২০ বছর আগে বাংলাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল। পাকিস্তানে জমিদারি প্রথা তখনও ছিল। এক সময়ে হিন্দু জমিদারদের সম্পর্কে যে পূর্ব ধারণা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল তাই রয়ে গেছে সাদুল্লার মাথায় তার মনে হয়েছে তার দেশে জমিদারি প্রথা থাকলে বাংলাদেশেও আছে। পাকিস্তানিদের অজ্ঞতার বহর কোথায় এটি তার একটি মাপকাঠি হতে পারে।
কালিকচ্ছের যে কথা উল্লেখ করেছেন তা পাকিস্তানি সরকারি উপাত্তেও পাওয়া যাবে না। আইয়ুব খানের সময়, পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে স্কুলে মুসলমান ছাত্র ভর্তি করা হচ্ছে না হিন্দুদের কারণে এটি বিশ্বাসযােগ্য? মুহম্মদ আব্দুশ শাকুরের একটি বই আছে, নাম ময়মনসিংহে একাত্তর (ইউ পি এল, ২০০০)। ময়মনসিংহ শহরের চমৎকারর বিবরণ আছে সেই গ্রন্থে তার বর্ণনায় দেখা যায়, মানুষ বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাদের কারণে আতঙ্কিত। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি। প্রতিদিন নতুন নতুন গুজব একদিকে যেমন মানুষকে আতঙ্কিত করত, তেমনি মুক্তিবাহিনী সম্পর্কিত নানা গুজবও মানুষকে উদ্দীপিত করত। আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হানা দিতে শুরু করে সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগীরা তখন শঙ্কিত হয়ে ওঠে। আব্দুশ শাকুর শুধু নয়, ময়মনসিংহের ওপর (১৯৭১ সাল নিয়ে) আরাে অনেক বই পড়েছি। কিন্তু সাদুল্লা বর্ণিত গালগল্পের উল্লেখ কোথাও নেই। বরং শাকুরের বই থেকে দুটি ঘটনার উদাহরণ দিই। তাহলে বােঝা যাবে বাঙালি তৃণমূল পর্যায়ে কী ভাবছিল। ১৪ আগস্ট। কে একজন এসে খবর দিল, ঈদগা ট্যাঙ্কের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে ভােরবেলা। দেখলাম অনেকেই যাচ্ছে কিন্তু ভাবখানা যেন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে, অথবা সিগারেট ফুকতে ফুকতে নিতান্ত ‘ই বেখেয়ালে ওপথে হাঁটছে। পরে ট্যাঙ্কের কাছে গিয়ে টুক করে দেখে নিচ্ছে নিশানখানি। ফেরার পথে এক আধবুড়াে ভদ্রলােক হাত ধরে টানল, লােকটা অপরিচিত। বলল, “দেখলেন স্যার?” আমি কোনাে কথা বলি না। কী জানি যদি স্পাই-টাই হয়। লােকটি আবার বলল, ‘দূর থেকেই দেখছি অনেকক্ষণ ধরে। কাছে যেতে ভয় পাই। কী জানি শালারা আবার মার্ক করে কিনা।’ পরে বলল, ‘লক্ষ্য করেছেন স্যার? কী চমক্কার কালার আর ক, এক্সেল্যান্ট ম্যাচিং!’ । কথা না বলে আমি ফিরে চলি। লােকটা তখন নিচু স্বরে গান ধরেছে : আমার সােনার বাংলা , আমি তােমায় ভালবাসি। লােকটা স্পাই না পাগল, কে জানে!” (পৃ. ৭৮) ৪০ আরেকটি ঘটনা/গুজব/গল্প যাই বলুন না কেন ফরাজী বলতে শুরু করেন, পাকুন্দিয়ার এক রাজকারের ঘটনা। সেদিন ছিল হাটবার। বিক্রির লাগ্য যার যার জিনিস খুল্যা লইয়া বইছে মানুষ। তাগাের
পাশে আস্যা একটা পোঁটলা লইয়া বইলাে আরেকজন। নতুন মানুষ দেইখ্যা কেউ কেউ তার মুখের দিকে চায়। মানুষটা কারাে দিকে না চাইয়া বাস, পোটলাখানি খুলল । আর তক্ষুনি ডরে সবতে চিল্লায়া উঠল।” ‘কেন? গ্রেনেড, না এস এল আর, নাকি সাপখোপ ধরে এনেছিল?’ ‘না, না, ওইগুলা কিছু না। কান। মানুষের কয়েকজোড়া কাটা কান।’ ‘কন কী!’ আমি মাথা নাড়ি। এগুলাে স্রেফ গুল।’ ফরাজী কিন্তু উৎসাহ হারান না। বলেন- কথাটা আমিও প্রথম প্রথম বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু একজন যে নিজ চক্ষেই দেখেছে। তাছাড়া আরেকটা খবর তাে শুনছেন বােধ করি। একজন কানকাটা রাজাকার সেদিন হাসপাতালে ভর্তি হইছে তা তাে শুনি নাই। আপনে দেখছি কিছু খবর রাখেন না, অথচ টাউনেই থাকেন। খবরটা। কিন্তু সেন্ট পারসেন্ট খাঁটি।’ বললাম, যাক, ঐ কানওলার কী হলাে? ফরাজী বলল, ‘আসলে তাে বিক্রি করতে যায় নাই। কান বিক্রি করবাে কেন, আর কান কিনবেই বা কে? গেছে অন্য কারণে। সবে যখন জিগাইলাে, কার কান গাে? মানুষটায় কয়, “দেশের দুশমন রাজাকারগাে কান।’ তখন রাজাকার যারা হাটের মধ্যে টহল দিতাছিল তারা আইস্যা চাপা ধরলাে তারে। বাস, তখনই হৈ হৈ করা ছুটা আসলাে বিশ জনের মতাে মুক্তি। সবের হাতেই এস এল আর তারপর? তারপরে আর কী? হাটের মানুষ তাে সব ডরে ভাগলপুর। মুক্তিরা আইসা বাইন্দা নিলাে রাজাকার সবকয়টারে। পরে কইলাে, কান দিবি না যাবি আমগাের সাথে? কান কাটতে রাজি অয় কেডা কন? তাই মুক্তিবাহিনীর সাথেই মিল্যা গেল তারা। [পৃ. ১০৬]
নরকে অবস্থান করে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ কীভাবে পরস্পরকে সাহস যােগাত এগুলাে তার উদাহরণ। সাদুল্লা যেসব বিবরণ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বাঙালিরা ক্রমেই ‘ভুল’ বুঝতে পেরে হানাদারদের (তথা পাকিস্তানের) সহযােগী হয়ে উঠছিল তা এইসব ঘটনা প্রমাণ করে না। প্রথম পর্বের একাদশ থেকে পঞ্চদশ অধ্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধের খণ্ড চিত্র যেগুলােতে জড়িত ছিলেন কর্নেল সাদুল্লা। এগুলাে হচ্ছে : কসবা, লাটুমুরা (চাঁদপুর), সালদা নদী, মুকুন্দপুর ও অন্যান্য। স্বাভাবিকভাবেই এগুলিতে এসেছে পাকিস্তানি হানাদারদের শৌর্য বীর্যের কাহিনী । তবে রাজাকারদের সহযােগিতার প্রসঙ্গেও এসেছে নানাভাবে। বস্তুত, আমি যতগুলি বই পড়েছি। তাতে দেখেছি এই জেনারেলের বইতেই রাজাকার প্রসঙ্গ এসেছে বিস্ত রিতভাবে। এর একটিই কারণ, বইটি যুদ্ধের পরপরই লেখা, রাজাকারদের সাহায্য সহযােগিতার কথায় তিনি বিস্মৃত হননি এবং তিনি বইয়ে যত কিছুই লিখুন না কেন, তিনি তাে জানেন যে, রাজাকার, আলবদর ছাড়া কেউ তাদের সহযােগী ছিল না। এইসব যুদ্ধের বর্ণনার মধ্যেও হিন্দু/ভারত বিদ্বেষ এসেছে কোনাে না কোনাে ভাবে। তার আগে তার বর্ণিত একটি কাহিনীর উল্লেখ করি যা পরােক্ষভাবে হানাদারদের অধীনে বাঙালিদের জীবনের চিত্র তুলে ধরে। | নৌকো করে রাতে তারা যাচ্ছেন। একটি নৌকা এগিয়ে আসছে তাদের নৌকার দিকে। নৌকা থেকে আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে। নৌকার কাছাকাছি হতেই তারা চ্যালেঞ্জ করলেন। পানিতে কারাে ঝাপিয়ে পড়ার শব্দ হলাে। নৌকাটা অন্যদিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। ফাকাগুলি ছোড়া হলাে কিন্তু কোনাে প্রত্যুত্তর এলাে না । নৌকার কাছাকাছি হওয়ার পর সাদুল্লার দু-একজন ঐ নৌকায় উঠল । নৌকাটি বেদে নৌকা।
নৌকায় একটি পুরুষ ও একটি শিশু। কে কাঁদছিল?’ উত্তর নেই। সাদুল্লা বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, নদীতে ঝাপ দিল কে?’ আমার স্ত্রী।’ সাদুল্লা হতবাক। আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সে ঠিক আছে তাে? ঠিক আছে। সে সাঁতার জানে’, নির্লিপ্ত সুরে মাঝি জানাল, ‘অপর তীরে পৌছে যাবে সে।’ “কিন্তু কাদছিল কেন? উত্তর নেই। জোরাজুরি করার পর বলল, ‘আপনারা আসার আগে এরকম একটি দল আমাদের মারধর করে টাকাপয়সা নিয়ে গেছে।’ ‘তাদের পােশাক কেমন ছিল?’ সাদুল্লা জিজ্ঞেস করলেন। তাদের পােশাক ছিল আপনাদের মতাে।’ মনে হলাে কেউ বুঝি আমাকে ছুরি মারল’, লিখেছেন সাদুল্লা। ‘চল্লিশ’ জানাল সে। ক’টাকা নিয়েছে?’ আমি দ্রুত ৪০ টাকা দিয়ে দিলাম তাকে। এর মধ্যে নৌকা ভর্তি রাজাকাররা এলাে। তারা সাদুল্লার নৌকা অনুসরণ করেছিল। কয়েকজন রাজাকার তাকে বাংলায় ভালােভাবে জিজ্ঞাসা করার পর জানাল, সে মিথ্যাবাদী। তার জিনিসপত্রের দাম ৪০ হতে পারে না। সাদুল্লা তাদের কথায় কর্ণপাত না করে আরাে ২০ টাকা দিলেন । তারপর দেখলেন, ছােট একটি ছেলে ঠাণ্ডায় কাঁপছে। “তােমার নাম কী?’ বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন সাদুল্লা। | ‘বিলাল ‘। “মনে হলাে কেউ আমাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল। আমার ছােট ছেলের নাম বিলাল। একই বয়সী। ছােট বিলালের পরনে কাপড় নেই, ঠাণ্ডায় কাঁপছে। তার মা নদীর অন্য তীরে কাদায় বসে কাঁদছে। আমি আরাে দশ টাকা বিলালের হাতে দিয়ে সরে এলাম । না হলে হয়তাে আরাে আবেগতাড়িত হয়ে পড়তাম।” সাদুল্লা এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন নিজের মানবিকতা প্রদর্শনে। কিন্তু সেনাবাহিনীও যে নির্যাতন করছে এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তিনি যে তা জানতেন না তা নয়) । মহিলারা সেনাদের দেখলেই আতঙ্কিত হতাে। কারণ, সেনারা মহিলা পেলেই ধর্ষণ করত। সাদুল্লা প্রথম ৫০ পাতায় যা উল্লেখ করেছেন এই একটি ঘটনা আবার তা নস্যাৎ করে দেয় ।
হিন্দু বিদ্বেষের আরেকটি উদাহরণ দিই : কিশােরগঞ্জের বিটঘরে গেছেন। তার ভাষায়, “স্থানীয় হাইস্কুল পেরুবার সময় আমরা দেখলাম একটি শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় ২/৩ জন ছাত্র মারা যায় (অজ্ঞতা ও তাচ্ছিল্য লক্ষণীয়, ইতােমধ্যে সারা দেশের প্রতিটি স্কুলে ‘শহীদ মিনার গজিয়ে উঠেছে। মিনারের পাদদেশে আছে একটি কবর। সকালে মিনার প্রদক্ষিণ একটি রিচ্যুয়াল । খালি পায়ে, হাতে ফুল নিয়ে প্রভাত ফেরিতে অংশ নিতে হয় । হিন্দুয়ানী না হলেও হিন্দু সংস্কৃতি তাে বটে। শুধু হিন্দু বিদ্বেষ নয়, ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের প্রতি তাচ্ছিল্যও লক্ষণীয়। এর সঙ্গে আছে সরাসরি মিথ্যা বলা। শহীদ মিনারের পাদদেশে কবর [প্রতীকী] কোথায়? দ্বিতীয় পর্বে অধ্যায়ের সংখ্যা ১১টি। ষােড়শ থেকে ষড়বিংশ] । এই পর্বের নাম ‘দি ইন্ডিয়ান ওয়ার’ বা ভারতীয় যুদ্ধ। মূলত মিত্র বাহিনীর অন্তিম আক্রমণ নিয়েই অধ্যায়গুলাে রচিত। এখানে বিস্তারিতভাবে যে সব যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা হলাে : আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ ভৈরবের যুদ্ধ। অন্যান্য সবার মতাে এ যুদ্ধকেও তারা ভারতীয় যুদ্ধ বলেছেন। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যে মুক্তিবাহিনী ছিল এবং এর নাম ছিল মিত্রবাহিনী বা যৌথ বাহিনী এটি তারা কেউ-ই উল্লেখ করেননি। যুদ্ধ নিয়ে আলােচনা করব না, কারণ তা আমাদের মূল আলােচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। যুদ্ধের বর্ণনায় আছে পাকিস্তানি সেনাদের বীরত্ব, অসীম ধৈর্য ও আত্মত্যাগের কথা এবং সেটি স্বাভাবিক। আমি এখানে শুধু আত্মসমর্পণ অংশটির বর্ণনা করব।
সাদুল্লারা ছিলেন তখন ভৈরবে যখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তের কথা শুনলেন। তারা বিশ্বাস করেননি। ঢাকার সঙ্গে অনেক কষ্টে যােগাযােগের পর শুনলেন, হ্যা সিদ্ধান্ত হয়েছে। “আমরা বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমাদের পরামর্শ নেয়া হয়নি। এমনকি একটি ওয়ার্নিং অর্ডারও আমরা পাইনি।” | পৃ. ১৮৪-৮৫] উপসংহারে সাদুল্লার যাবতীয় বেদনা প্রকাশিত হয়েছে একটি অনুচ্ছেদে “The utter humiliation that followed is too painful to pen. Pakistan had lost the war. We had lost in the East and failed to win in the West. We had already been outmanoeuvred diplomatically, politically and now militarily. We had lost the war without losing in battle (93 TRAIL 15121).Defence of East Pakistan lies in West Pakistan ‘neverberated in my mind.’ East Pakistan had slumped into ‘Bangladesh.” 13. sbal | শেষ দুটি লাইন নিজেকে সান্ত্বনা প্রদানের :
“Some day from the dust through their own effort perhaps they will rise”. ১৯৭৫ সাল তাে, তাই দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা। তারও প্রায় ২৫ বছর পর যখন পাকিস্তান যাই, এক পাটিতে বাওয়ানী পরিবারের একজন আমায় বলেছিলেন, স্বাধীন হয়ে তােমরা সঠিক কাজটি করেছিলে।’ বাংলাদেশ সম্পর্কে সাদুল্লা আলাদা ছােট একটি অধ্যায় লিখেছেন। বাঙালি কেমন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে এসব বিষয়ে তার ধারণা লিপিবদ্ধ করেছেন। তার মতে, বাঙালি সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বাংলায় দুশাে বছরের ব্রিটিশ কুশাসন বাঙালিদের করে তুলেছে অজ্ঞ ও দরিদ্র। চরম দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও আলস্য একটি নষ্ট বৃত্ত যা থেকে বেরুনাে মুশকিল। এ বৃত্ত ভাঙ্গার চেষ্টা কেউ করেনি। এর সামাজিক ফল পিতাই হচ্ছেন পরিবার প্রতিপালনের প্রধান।
সূত্র : পাকিস্তানী জেনারেলদের মন -বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন