You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | বাঙলাদেশের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে | রঘুবীর চক্রবর্তী - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে
রঘুবীর চক্রবর্তী

বাঙলাদেশের অভ্যুদয় (২৫-২৬ মার্চ, ১৯৭১) এবং তার স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ (১৭ই এপ্রিল) দক্ষিণ এশিয়ায়, তথা সমগ্র বিশ্বে, রীতিমতাে এক আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। এই আলােড়নের অন্যতম একটি কারণ হলাে এই যে এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা পূর্ব পরিকল্পিত কোনও এক রাজনৈতিক চক্রান্তের প্রতিফল নয় অথবা কোনও বিদেশী শক্তির(ভারতেরতাে নয়ই)ষড়যন্ত্র প্রসূত নয়। বাঙলাদেশ নিঃসন্দেহে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্রের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। বাস্তবিকই, সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে যে অসহ্য শশাষণ ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের উপর আরােপ করেছিল, তার অবসান কামনা প্রত্যেকটি পূর্ববাংলার মানুষের হৃদয়ের দাবি হিসেবে দেখা দিল। তারপর যখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই দাবি পরিপূরণের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গেল, তখনই প্রশ্ন উঠল সক্রিয় আন্দোলনের। এই আন্দোলন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল সম্পূর্ণ অহিংসাত্মক ও শাসনতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ প্রায় গান্ধীজীর প্রদর্শিত এবং মার্টিন লুথার কিং পরিচালিত আন্দোলনের ধারায় মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া চক্রান্ত সব বরবাদ করে দিল এবং তাদের ২৫-২৬ মার্চের কর্মসূচি বাঙলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম স্বতন্ত্র এক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে সংগঠিত করতে বাধ্য করল। অর্থাৎ, বাঙলাদেশের অভ্যুদয় যদি কেউ অবশ্যম্ভাবী করে তােলে সে হলাে পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং এই ঔপনিবেশিক লুঠতরাজ বজায় রাখার জন্য ব্যাপক গণহত্যার চক্রান্ত।
১৫২
ঔপনিবেশিক শােষণও কিন্তু এক ধরনের গণহত্যা। তবে এখানে শােষণ-ব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হয় যে হঠাৎ করে সাধারণ মানুষের কাছে তার স্বরূপ ঠিক ধরা পড়ে না। তবে । ধীরে শােষিত অঞ্চলকে রক্তশূন্য করে ফেলে, এবং জনগণকে অকালে ভবলীলা সাঙ্গ করতে বাধ্য করে। তবে সাম্রাজ্যবাদের এই প্রক্রিয়া বহুদিন ধরে চলতে থাকে বলে এর গণহত্যার প্রতিফল অনেকেই অনুভব করে উঠতে পারে না। এই শােষণ বজায় রাখার জন্যই শেষ পর্যন্ত ভুট্টো-ইয়াহিয়া জল্লাদচক্র মরীয়া হয়ে উঠল। শুরু হলাে অবর্ণনীয় ও মধ্যযুগীয় অত্যাচারের পালা, যে পালার মধ্যেই জন্ম নিল বাঙলাদেশ, যে বাঙলাদেশ এখন বিশ্ববাসীর প্রায় প্রধান এক আলােচ্য বিষয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বর্তমান নরমেধ যজ্ঞ বিগত ২৩ বছরের সাম্রাজ্যবাদী শােষণেরই সর্বাধুনিক এক পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়।
বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি হবে না সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে এই ঐতিহাসিক সত্য বারবার মনে করা দরকার যে বাঙলাদেশ পাকিস্তানেরই বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী এক প্রতিফল। সুতরাং এই কারণেই একে সাদরে অভিনন্দন জানানােই যে কোনও প্রকৃত শান্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রের অন্যতম এক মহান দায়িত্ব। যে ঐতিহাসিক ঘটনাস্রোত বাঙলাদেশের জন্ম অবধারিত করেছে সেই ঐতিহাসিক শক্তির বলেই পূর্বপাকিস্তানের মহাশ্মশান সােনার বাঙলার রূপ পরিগ্রহ করবে। ইতিহাসের এই ধারা স্মরণ রাখলেই বাঙলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন নতুন করে বিশ্লেষণ করা যাবে।
আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতির বিষয়ে কোনও বাধাধরা নিয়ম নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বীকৃতি লাভ করেছে। স্বীকৃতির প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইনের কোনও সুনির্দিষ্ট অনুশাসন নেই। বাস্তবিকই, বিভিন্ন রকমের স্বীকৃতির দৃষ্টান্ত যদি বিশ্লেষণ করা হয় তবে দেখা যাবে যে এর ধরন-ধারণ এত নানামুখী যে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আইনের অজুহাতে কোনও রকম নিষ্ক্রিয়তা সমর্থনযােগ্য নয়। মূলত জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেই এক একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।
একদিকে যেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে অনেক রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩৩ সালের আগে সােভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকার করেননি এবং এখনও পর্যন্ত চীনকে পিংপং কূটনৈতিক অধ্যায় সত্ত্বেও স্বীকার করে নেয়নি) আবার অপরদিকে চালচুলাে কিছু না থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ল্যাটভিয়া, এস্তোনিয়া, ইত্যাদি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র রাষ্ট্রবর্গকর্তৃক নির্বাসিত সরকারদের নিঃশর্ত স্বীকৃতি)। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৪০ সালের ফ্রান্সের পতনের পর যখন দ্যগল এককভাবে হিটলারের কাছে ফরাসী সরকারের আত্মসমর্পণ নীতির বিরােধিতা করলেন এবং ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলেন তখন কিন্তু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল কোননারকম সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও দ্যগলকেই ফরাসী সরকার হিসেবে প্রকাশ্যভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বাঙলাদেশ একটি সুপরিচিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। এতদিনের মারমুখী সামরিক অভিযান সত্ত্বেও, ভুট্টো-ইয়াহিয়া। চক্র একে ধ্বংস করতে পারেনি। সুতরাং এর স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কোনও রক অবকাশ থাকতে পারে না। এদিক থেকেও বাঙলাদেশ নিছক আইনানুগভাবেই স্বীকৃতি দাবি করতে পারে। | বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকার ইতিমধ্যেই জনসাধারণের অকৃত্রিম ভালােবাসা পেয়েছে। ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা চলার সময়ে যেভাবে মুজিবের ব্যক্তিগত নির্দেশাবলী প্রশাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল তার তুলনা সত্যিই ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। মুজিব-নেতৃত্বের অনন্যসাধারণ জনপ্রিয়তার এর থেকে বড় স্বাক্ষর আর কী থাকতে পারে?
ভুট্টো-ইয়াহিয়ার প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ নিঃসন্দেহে এই জাতীয় জন-জাগরণের ভিত্তি অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যালীলার কর্মসূচী প্রয়ােগ করে বাঙলাদেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার এক চক্রান্ত করা হয়েছে। বাঙলাদেশ থেকে ৫০লক্ষের উপর মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এর ফলে পশ্চিম-পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রাম স্তিমিত হয়ে এসেছে। কিন্তু তা
১৫৩
সত্ত্বেও, গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক আক্রমণের ঘটনায় আজ সুস্পষ্ট ভাবেই প্রতীয়মান হয়েছে যে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী তার কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পারেনি; বরং ফল হয়েছে ঠিক বিপরীত। প্রভূত রণসম্ভার থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া-বাহিনী আজ বিভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত। স্থানীয় জনসাধারণের কোনও রকমের সহানুভূতি বা স্বেচ্ছামূলক সহযােগিতা এই বাহিনী আজও পর্যন্ত পায়নি এবং সে আশাও সুদূর পরাহত। এই কারণেই, পশ্চিম-পাকিস্তানের এই জল্লাদ-বাহিনী গণহত্যা, গণধর্ষণ, সন্ত্রাস ও সর্বাত্মক ধ্বংস দ্বারা আজ বাঙলাদেশের ঐতিহাসিক সভ্যতার বিরােধিতায় মগ্ন আছে। এই ধরনের মারমুখী অভিযান তার ব্যর্থতার নিদর্শনই বহন করে আছে না কি?
বাঙলাদেশ আজ সুপ্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রের প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের অবিমিশ্র আনুগত্য আছে। অবশ্য একথা স্বীকার করতেই হবে যে এই সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনও সীমারেখা আজও পর্যন্ত নেই। সুতরাং এক্তিয়ার ও অধিকার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে বিতর্ক ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তবুও প্রত্যুত্তরে এ কথা বলা যেতে পারে যে সুস্পষ্ট সীমারেখা না থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে যদি পৃথিবীর ২৬টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে পেরে থাকে তবে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পথে বাধা কোথায়?
স্থায়িত্ব, জনপ্রিয়তা, সুনির্দিষ্ট সরকারী ব্যবস্থা, ইত্যাদির দাবিতে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে স্বীকৃতি পাবার যােগ্য এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে এর যে সব আনুষঙ্গিক দুর্বলতা আছে সেগুলাে নিতান্তই সাময়িক এবং আপৎকালীন সময়ে এইসব ঠিক হয়ে যাবে। সুতরাং বাঙালাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নে কোনাে রকম আইন-কানুনেরর বাধা নেই বা থাকতে পারে না।
এখন এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্বীকার করা হবে কি হবে না সেটি নির্ভর করবে ভারতীয় সরকারের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞার উপর। এখানেও মনে হয় যে, এদিক থেকেও স্বীকৃতির প্রশ্নে পরিপক্কতার একরূপ ইতিমধ্যেই ধারণ করেছে। বাঙলাদেশ সর্বপ্রথম ভারতের এক প্রকৃত বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দিক থেকে এর অপরিসীম অবদান উত্তরােত্তরকালে স্বীকৃতি পাবে। বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সৌহাদ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে এবং জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণের দিক থেকেও বাঙলাদেশ ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের সর্বাপেক্ষা সহায়ক এক শক্তি। যে দিক থেকেই প্রশ্নটি বিবেচিত হােক না কেন, বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ভারতের অবশ্য এক পবিত্র কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। এই কারণেই ভারতীয় সরকারের হ্যামলেটের মতাে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের কাছে স্বীকৃতির সিদ্ধান্তকে বন্ধক দেওয়া সঙ্গত কাজ হবে না।
পরিচয়
বাংলাদেশ সংখ্যা, ১৩৭৭-৭৮