স্বাধীন বাংলাদেশ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সবুজ রঙের বনেদ—অর্থাৎ শস্য শ্যামল ভূ-প্রকৃতির প্রতীক, মাঝখানে উজ্জ্বল লাল রঙের বৃত্ত দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গীকৃত শহীদের রক্ত চিহ্ন, তার ওপরে সােনালি রঙে আঁকা পূর্ব বাংলার মানচিত্র। এই পতাকা উড়ছে এখন স্বাধীন বাংলাদেশে। সেখানকার নতুন জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি। আমাদেরও সবার ভালােবাসা যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে।
একজন উত্তর প্রদেশীয় ভদ্রলােক আমায় প্রশ্ন করলেন কয়েকদিন আগে, ওপারের ওরা যে নিজেদের দেশকে পুরােপুরি বাংলাদেশ নাম দিয়েছে, তাহলে ঐটুকুই কি শুধু বাংলাদেশ? বাঙালি বলতে বাংলাদেশের মানুষকে বােঝায়, তাহলে ওরাই শুধু বাঙালি? ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী যারা, সেই তােমরা তাহলে কী?
সরাসরি উত্তর না দিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলুম, আগে বলুন, ওদিকের ওরা যে স্বাধীনতা ও মনুষ্যত্বের অধিকারের জন্য জীবন মরণ লড়াই করছে, আপনি সেটা সমর্থন করেন তাে?
কথাবার্তা হচ্ছিল অপরিস্ফুট ইংরেজিতে। কারণ উত্তর প্রদেশীয় ভদ্রলােকটি বাংলা জানেন না, আমি হিন্দী জানি না। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি রীতিমত উত্তেজিত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই। শুধু সমর্থন কেন, যেকোনাে রকম সাহায্য করতেও আমরা প্রস্তুত। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতি সারা ভারতবর্ষ মাদ্রাজ থেকে পাঞ্জাব সবাই তাে সমর্থন জানিয়েছে এক বাক্যে। ধিক্কার জানিয়েছে ইয়াহিয়া চক্রকে।
আমি বললাম, তাহলে আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর জানাই। পূর্ব বাংলা যখন বাংলাদেশ’ নাম নিল, তখন পশ্চিম বাংলার প্রায় কেউই আপত্তি জানায়নি, কেউ ঈর্ষা প্রকাশ করেনি, কারণ, ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন, বাঙালিত্বের গর্ব বা পরিচয়ই ওখানকার মানুষকে এক করতে পারে, পেরেছে। আমাদের অস্তিত্ব সেরকমভাবে বিপন্ন হয়নি এখনাে। তা ছাড়া, যখন ওদিকের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং এদিকের নাম পশ্চিমবঙ্গ—তখনও ওদিকের এদিকের আমরা সবাই বাঙালিই ছিলাম। এর পরেও থাকবাে। পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে এর পরে আমরা বাংলারাজ্য’করে নিতে পারি। তাড়াহুড়াের কিছু নেই।
উত্তর প্রদেশীয় ব্যক্তিটিকে বিনয়ের সঙ্গে আমি আরও বললাম, আর একটা কথা জানেন তাে? আপনি বা আমি যদিও একই দেশের নাগরিক, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার যতটা সম্পর্ক-তার চেয়ে অনেক বেশি নিকট সম্পর্ক ঐ অন্যদেশ, বাংলাদেশের যেকোনাে মানুষের সঙ্গে। কারণ আমরা বাঙালি, আমরা একই বাংলা ভাষাতে কথা বলি।
তিনি বললেন, তােমরা বাঙালিরা বড্ড ভাবপ্রবণ।
আমি তৎক্ষণাৎ মেনে নিয়ে জানালাম হা সে কথা ঠিক। এই ভাবপ্রবণতা আমাদের একটা দোষ, আবার এই ভাবপ্রবণতাই আমাদের বন্ধন। প্রত্যেক সচেতন মানুষই নিজের মাতৃভাষাকে ভালােবাসে। কিন্তু বাঙালির মতন বাংলা ভাষা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়িও আর কেউ করে না। এটা তৈরি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের কয়েকটি বিশেষ পাকচক্রে।
নিরলে বসে চিন্তা করলে টের পাই, আমি নিজে যেমন, তেমনি অধিকাংশ বাঙালিই প্রখর যুক্তিবাদী নয়, একটু বেশি ভাবপ্রবণ। এদেশে যে তীক্ষ যুক্তিবাদী কেউ নেই তা নয়, আছেন কিছু কিছু কিন্তু তাদের কথায় জনচিত্তে এমন তুমুল-ভাবে সাড়া জাগায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের এই যে প্রবল উদ্দীপনা, দলমত নির্বিশেষে সবাই এখানে ওদের সাহায্যের জন্য বন্ধপরিকর, হাজার হাজার যুবক মনে মনে পােটেনশিয়াল সৈনিক হয়ে আছে, এর মর্ম কী? এই রচনা লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি বটে, কিন্তু পশ্চিম বাংলার সরকার কার্যত স্বীকৃতি জানিয়ে অনুরূপ অনুরােধ জানিয়েছে কেন্দ্রের কাছে। পৃথিবীর আর কোথাও কি এমন হতে পারতাে? কয়েকটা প্রশ্ন তাে উঠতােইকূটনৈতিক সুবিধে অসুবিধে, বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য টসকায় কিনা কিংবা এতে আমাদের নিজস্ব কোনাে লাভ আছে কি না। এখানে সেসব কিছু চিন্তা করার অবকাশই আসেনি, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জাগরণ হলাে, বিনা দ্বিধায় আমরাও বলে
১০৫
উঠলাম ঐ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যত দিন লড়াই চলবে ততদিন আমরাও সঙ্গে আছি। বাঙালি হিসেবে আমরাও সহযােদ্ধা।
স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মােটেই শুধু পাশাপাশি রাষ্ট্রের নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি। মুজিবুর বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক ভৌগােলিক নয়, ঐতিহাসিক।
স্বাধীন বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, আমরা তার জন্য গর্ব বােধ করবাে। ঐ দেশ আমাদেরও দেশ। তেইশ বছরের দুঃস্বপ্নের পর বাংলাদেশ আবার বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান’ এই নাম আর সে কখনাে বহন করবে না। পাকিস্তান ধারণার মৃত্যু হয়েছিল সেইদিন শেখ মুজিবুর স্বাধীনতা ঘােষণা করার অনেক আগে যেদিন আওয়ামী লীগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ আর ইসলাম রাষ্ট্র থাকবে না, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মরক্ষার নামেই পাকিস্তানের জন্ম। নতুন সংবিধানে যদি সেই গোঁড়ামিকে আর প্রশ্রয় না দেওয়া হয়, তাহলে দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন দুটি আলাদা ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ আলাদা জাতি চরিত্র ও সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষের একরাষ্ট্রীয় পতাকার তলে থাকার কৃত্রিম চেষ্টার মানে কী?
কিংবা পাকিস্তানের মৃত্যুসূচিত হয়েছিল তার জন্মের অব্যবহিত পরেই, যখন পাকিস্তানের সর্বেসর্বা জিন্না কড়া গলায় বলেছিলেন, আমি মুহম্মদ আলি জিন্না বলছি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন ঢাকার ছাত্ররা নির্ভীকভাবে উত্তর দিয়েছিল না! আমরা বাংলা ভাষা চাই। ধর্মকে ছাপিয়ে সংস্কৃতির অধিকারের সেই গােড়া পত্তন। তারপর থেকে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী ও সুস্থ লেখক সমাজ একবারও ভুল করেননি।
আমি হিন্দু নই, যেমন মুসলমান হিসেবে পরিচিত আমার কয়েকজন বন্ধুও মুসলমান নন্। আমি ঈশ্বর মানি না, কোনাে পরম ব্রহ্ম বা সূক্ষ্ম শক্তিও মানি না। শুধু মানি না, বলবাে না, ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথাও ঘামাতে চাই না। আমার ঐ কয়েকজন বন্ধুও তাই। ঈশ্বর উদাসীন ব্যক্তিদের হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিষ্টান নামে অভিহিত করার কি কোনাে যুক্তি থাকতে পারে? যদিও কিছু কিছু পারিবারিক বা সামাজিক আচরণ থেকেই যায় কিন্তু সেটা ধর্ম নয়, সংস্কৃতির অঙ্গ। আধুনিককালের উভয় বাংলার শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেইরকম আচরণগত বিভেদ কতটুকু? এই সরল সত্যকে উপেক্ষা করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগেও ধর্মের নামে একটি রাষ্ট্র চালানাের চেষ্টা কি অসম্ভব মূঢ়তা! যারা বন্দুক কামান নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তারা কালচার নামে ব্যাপারটাকে একেবারে গ্রাহ্যই করতে চায় না। কোনাে জাতির কালচারও যে বন্দুক কামানের প্রবল প্রতিপক্ষ হতে পারে, এটা তাদের মনেই আসে না কখনাে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা নানান দেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছে টাকা শুষেছে পূর্ব বাংলা থেকে। তারা খবর রাখেনি, বাঙালিদের মধ্যে একটা হাজার বছরের পুরােনাে সংস্কৃতি আছে—এর ভিত্তি আজ এত সুদৃঢ় যে ধর্ম বা সামরিক জিগির তুলে কিছুতেই একে ভাঙা যাবে না। দরিদ্র, শিক্ষাহীন এবং দুর্বল মানুষদের ধর্মের আফিমে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা অনেক পুরােনাে। কিন্তু বাঙালিরা দরিদ্র এবং কিছুটা দুর্বল হলেও সংস্কৃতিহীন নয় বলেই সাংস্কৃতিক ঐক্যের চেয়ে ধর্মের বিভেদকে শেষ পর্যন্ত বড় করে দেখতে পারে না। বদরুদ্দীন উমর এক জায়গায় এই ব্যাপারটাই সুন্দর ভাবে বলেছেন: “এ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বস্তরে এবং সর্বভাবে খর্ব করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া। এ প্রচেষ্টায় সফলকাম হলে, আমরা বাঙালি, না মুসলমান না পাকিস্তানী।’ এ ধরনের অদ্ভুত প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানরা আর কোনােদিন নিজেদের কাছে উত্থাপন করবেনা। এবং তখনই তারা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হবে নিজেদের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়।”
ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকুক। ধর্মের আর কোনাে সামাজিক ভূমিকা নেই পৃথিবীতে। ধর্মের নামে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ খুন হয়েছে। সব ধর্মেরই মূলকথা সাম্য ও মৈত্রী কিন্তু তার জন্যই এত নয় রক্তপাত। অহিংসার কথা সবচেয়ে বেশি আছে খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মে, কিন্তু ঐ দুই ধর্মাবলম্বী দেশগুলােই পৃথিবীতে ঘটিয়েছে দুটি মহাযুদ্ধ। কমিউনিজম না ইহুদী নিধন-এই দোটানায় পড়ে গিয়ে রােমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পােপ ইহুদী নিধনই সমর্থন করেছিলেন। এই খুনের বিষাক্ত । সাংঘাতিক যে ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য কোনাে আদর্শ অবলম্বন করলেও মানুষ তা ভুলতে পারে না। ধর্মকে বাদ দিয়ে যে আদর্শ সাম্য ও মৈত্রীকেই প্রধান বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রেণী বৈষম্যই পৃথিবীর সব সংঘর্ষের মূল কারণ বলে যেখানে সঠিকভাবে নির্ধারিত করা হয়েছে, সেখানেও এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য
১০৬
লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন না করলে চলে না। অনেক সময় আদর্শের চেয়ে খুননাখুনিই বড় হয়ে যায়। এখন পৃথিবীতে তারাই মহৎ রাষ্ট্র নায়ক, যাদের হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত।
পূর্ব বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হবার জন্য যে যুদ্ধে নেমেছে, ইতিহাসে তার কোনাে তুলনা নেই। ধর্মের নামে নয়, পররাজ্য আক্রমণের লােভে নয়, স্বজনধ্বংসী বিপ্লবের নামে নয়—শুধু সংস্কৃতির বন্ধনে যে একটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলাে পৃথিবীতে। প্রমাণিত হলাে, সৎ নেতৃত্ব ও সৎ আহ্বান পেলে একটা দেশের সকল শ্রেণীর মানু করে উঠে দাঁড়াতে পারে। সামরিক শিক্ষা না পেয়েও সাধারণ গ্রামবাসী প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে তুলে ধরতে পারে অস্ত্র। পারে, কারণ এই সংগ্রামের যুক্তির মধ্যে কোনাে ভেজাল নেই। ভিয়েৎনামে এই শতাব্দীর যে মহৎ লড়াই চলছে, তারই নবতর রূপ প্রকাশিত হলাে স্বাধীন বাংলায়।
দাবি আদায় করার জন্য বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ পথের সবকটিই পরীক্ষা করে দেখেছে। কে কবে ভাবতে পেরেছিল যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের একজন নেতা দেশের সমস্ত মানুষের হৃদয়ের সমর্থন পেতে পারে? দেশের সকলে একটি মাত্র দলের পতাকার তলায় দাঁড়ায়? স্বৈরাচারের এর চেয়ে বড় জবাব আর কী হতে পারে? গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থারও এক নতুন রূপ সূচিত হলাে। নির্বাচন ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি আছে—টাকার খেলা, ভয় দেখানাের খেলা অনেক কিছুই চলে। হিটলারও ভােটাভুটির খেলা খেলে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়েছিল। হিটলার ভােট পেয়েছিল বন্দুকের নল উঁচিয়ে আর এখানে শেখ মুজিবুরের দিকেই বন্দুকের নল তােলা ছিল। দেশের সামরিক শাসক স্পষ্টত শেখ মুজিবুরের বিপক্ষে এবং টাকাওয়ালা লােকেরা অবশ্যই সামরিক শাসকদের পক্ষে—তবু শেখ মুজিবুরের পাশে দাঁড়ালাে, তার দেশের শতকরা ৯৯ জন মানুষ। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল সেই মুসলিম লীগই পূর্ব বাংলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে এবার নতুন অধ্যায় জুড়তে হবে।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও শেখ মুজিবুরকে ক্ষমতা দেওয়া হলাে না। তখনও তিনি সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলাপ আলােচনার পথ খােলা রেখেছিলেন। অনেকে এই আলাপ আলােচনার ব্যাপারটা পছন্দ করেন নি। আমার কিন্তু সর্বান্তঃকরণ সমর্থন আছে। রক্তপাত এড়ানাের সবকটি পথই শেষ পর্যন্ত দেখা উচিত। তার জন্য সম্পূর্ণ অধিকার পেতে যদি কয়েকটি স্তর পার হতে হয় যদি দু এক বছর দেরী হয়ে যায়, তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। যারা কথায় কথায় রক্তপাতের পথ দেখায়, নিজে বেঁচে থেকে অপরের মৃত্যুতে উল্লাস করে, তাদের অসুস্থ হিস্টিরিয়া রােগী মনে হয় আমার। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখার জন্যই সামরিক শাসকগােষ্ঠীর মুখােশ সম্পূর্ণ খুলে গেল, দস্তানা খােলা হাতে দেখা গেল বাঘ নখ। আলােচনা চালাতে অস্বীকার করে শেখ মুজিবুর হঠাৎ এক তরফা স্বাধীনতা ঘােষণা করলে, দেশের একটা অংশের মানুষের মনে হয়তাে এমন খটকা লাগা অস্বাভাবিক ছিল না যে ইয়াহিয়া খা বােধহয় শেষ পর্যন্ত নিজেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতেন, শেখ মুজিবুরের হঠকারিতার জন্যই খুনােখুনি লেগে গেল কিন্তু এখন আর কোনাে মােহ রইল না।
ঘরে আগুন লাগলে কেউ স্বপ্ন দেখে না। বাংলাদেশে এখন বাস্তবযুদ্ধ। আত্মরক্ষা ও অধিকার অর্জনের জন্য বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে, যুদ্ধের অন্য কোনাে কলঙ্ক তাকে স্পর্শ করেনি। পৃথিবীর যেসব দেশ গণতন্ত্রের গর্ব করে যারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সমর্থক তারা যদি আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে এখনি না এগিয়ে আসে তাহলে পৃথিবীর আসরে তারা যেন আর কোনােদিন ওসব কথা বলতে না আসে। যেসব দেশের নাগরিকদের গলা ধাক্কা দিয়ে ঢাকা থেকে তাড়িয়ে দিল সামরিক বাহিনী, সেসব দেশের নীরবতার মর্মোদ্ধার কে করবে? যেসব দেশ এতকাল বলে এসেছে, তারা নিপীড়িত জনগণের সব সময় পক্ষে তারা আজ কোথায়? তাদেরই দেওয়া অস্ত্রে নৃশংস পশ্চিমী সৈন্যরা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে খুন করছে। বাংলাদেশে আজ কে অত্যাচারী আর কে অত্যাচারিত সে কথা জলের মতন স্পষ্ট কোনাে থিয়ােরী বা অঙ্ক কষার দরকার নেই—তবু অত্যাচারিতের পাশে এসে সেই সব রাষ্ট্র দাঁড়ায়নি। আরও কী প্রমাণ দরকার যে শেষ পর্যন্ত কোনাে আদর্শই আন্তর্জাতিক নয়? সবাই নিজের দেশের স্বার্থ আগে দেখে দর কষাকষি করে কোন দিকে গেলে তার বেশি সুবিধা। আমি যে রাজনীতি বুঝি না তার প্রমাণ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, কী করে ইয়াহিয়া খাঁর বর্বর বাহিনীর হাতে একই সঙ্গে মারকিন দেশ ও চীনের
১০৭
অস্ত্র থাকতে পারে। মারকিন ও চীনা অস্ত্রে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ কথা বাঙালি কখনাে ভুলতে পারবে?
আমাদের কাছে এটা অন্য দেশের ব্যাপার নয়। আমরা ভাবপ্রবণ, তাই আমাদের কাছে এটা বাঙালিদের লড়াই। বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে। এমন গৌরবময় যুদ্ধ বাংলাদেশে কখনাে হয়নি। আমার কাছে এটা যেমন প্রবল গৌরবের তেমন লজ্জারও। আমিও জন্মেছি পূর্ব বাংলায়। ঐ নদী-প্রান্তর, পাট ক্ষেত, ধান ক্ষেত আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। আমারই ভাই ও বন্ধুরা ওখানে প্রাণপণ লড়াই করছে এখন আমি অংশ গ্রহণ করতে পারলাম না! যুদ্ধ দীর্ঘদিন চললে নিশ্চয়ই আমাকেও যেতে হবে। ধর্ম ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তান আমি ছেড়ে এসেছি, গত আট ন’বছরের মধ্যে অনেকবার যেতে ইচ্ছে হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলায় আবার ফিরে যাবাে। আমি যুদ্ধনীতির বিরােধী, কিন্তু বাংলাদেশের এই যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া যে কোনাে বাঙালির পক্ষেই গৌরবের।
গত আট দশ বছর ধরে পশ্চিম বাংলার চেহারা দেখতে দেখতে কী বীভৎস হয়ে গেল! কী সাংঘাতিক নৈতিক অধঃপতন! এখানকার একজন নেতাকেও শ্রদ্ধা করা যায় না, এখানে কেউ সত্যি কথা বলে না, কেউ ভুল স্বীকার করে না, কেউ দোষ করলে ক্ষমা চায় না। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যে কোনাে অসৎ পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা নেই কারুর। দিনের পর দিন মন খারাপ হয়েছে আমাদের। আর এই ক বছরেই পূর্ব বাংলার চেতনা ক্রমশ বিশুদ্ধ হয়ে উঠেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান এক সঙ্গে মরছে, এক সঙ্গে লড়াই করছে। স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি নিয়েছে। এরপর যেন আমাদের পশ্চিম বাংলাতেও ধর্মভেদ বা সাম্প্রদায়িকতার কথা কোনােদিন না ওঠে। আজ বাঙালি হিসেবে একাত্ম হওয়ার সুযােগ এসেছে তা যেন আর কোনােদিন না হারাই। এই তেইশ বছরের মধ্যে অনেকবার আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছি, সেসব কথা আর মনে করার দরকার নেই। পুরােনাে কথা থাক, এখন নতুন দিন এসেছে।
এ লড়াই কতদিন চলবে জানি না। যতদিনই চলুক এর পরিণতি একটাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এই লড়াইতে অংশ গ্রহণ করার জন্য পশ্চিম বাংলার অসংখ্য যুবকের প্রাণ ছটফট করছে। কিন্তু অসংগঠিতভাবে ছুটে গেলে যুদ্ধের কোনাে সাহায্য হয় না। লড়াই জোরদার করার জন্য এখনই দরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া। ভারত সরকার বাংলাদেশকে আলাদা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তখন আর পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অজুহাত টিকবে না। তখন স্বাধীন বাংলার সরকারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অনায়াসে যেতে পারবে ওদিকে। আমরা অনেকেই যাবাে।
দেশ
৩ বৈশাখ ১৩৭৮