You dont have javascript enabled! Please enable it! বাঙলাদেশ: নবজাগরণ ও স্বাধীনতা | তরুণ সান্যাল - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশ: নবজাগরণ ও স্বাধীনতা
তরুণ সান্যাল

আমাদের যখন বয়স কম ছিল, সেই প্রাক-স্বাধীন ভারতবর্ষে, আমাদের নানা স্বদেশপ্রেমমূলক গল্প-কাহিনীকবিতা পড়তে হতাে। মেবারের বীরত্বের কাহিনী, বারাে ভূঁইঞার কাহিনী, এমনি কত কী। দেশটা তখন স্পষ্টতই পরাধীন ছিল। কিন্তু লেনিন যেমন বলেছিলেন, জবরদস্তিমূলক প্রতিক্রিয়ার শাসনকালে অনেক সময় ঈশপীয় কায়দায় সত্য কথা বলতে হয়, তেমনি ভাবে পুরনাে দিনের গল্প-কাহিনীর মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাজাত্যবােধ জাগাবার চেষ্টা চলত। জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের সেই যুগে শিক্ষাব্রতীরা অনেকেই ছিলেন স্বদেব্রতী। স্বদেশ সম্পর্কে আদর্শবােধও ছিল । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যখন ভারতের পঞ্চতন্ত্র চেকোশ্লোভাকিয়ায় অনুবাদ হয়েছিল, অনুবাদক-সম্পাদক বইখানির পরিচিতি দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, অনেক সময় পশুপাখির মুখ দিয়েই সত্য কথা বেরােয়। বলা বাহুল্য, চোকোশ্লোভাকিয়া তখন পরাধীনই ছিল।
আমাদের ছােটবেলায় পড়া চাঁদ রায় কেদার রায়ের কাহিনীতে উল্লেখিত দুটি চিঠির কথা মনে পড়ছে। আমি ভুলি না যে বারাে ভূঁইঞার সেই বালক-পাঠ্য গল্পকথায় ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুপস্থিতই ছিল। আমি জানি, রায় ভ্রাতাদের মধ্যে মানুষের আত্মবিকাশের লক্ষ্যগুলাে আদৌ পরিচ্ছন্ন ছিল না, জাতীয়তার বােধ জাগাবার মতাে রাজনৈতিক, অর্থনীতিক সমাজব্যবস্থাও তখন গড়ে ওঠেনি।
সে যাই হােক। পড়েছিলাম, মানসিংহ চাঁদ রায় কেদার রায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন: “ত্রিপুর মগবাঙালি কাকুলি চাকুলি/সকল পুরুষমেতৎ ভাগ্ যাও পলায়ি/… হয় গজ নয় নৌকা প্রকল্পিত বঙ্গভুমি…’ ইত্যাকার। অর্থাৎ ত্রিপুর মগ ও বাঙালি অধ্যুষিত বঙ্গদেশের অধিবাসীরা প্রতিবারই কেন্দ্রীয় ম্রাটশাহীর আক্রমণে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। সুতরাং মানসিংহের সেনাপতিত্বে আকবর বাদশার পদাতিক, অশ্বারােহী, হস্তিও নৌ-বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত বাঙলাদেশের পরাজয় স্বীকার করা ছাড়া কোনাে পথ নেই।
পড়েছিলাম, মানসিংহকে চিঠির উত্তরে রায় ভ্রাতারা লিখেছিলেন, ‘ভিনক্তি নিত্যং কবীরাজ কুম্ভং বিভৰ্তিবেগং পবনাতিকেং। করােতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে। তথাপি সিংহ পশুরেবনাস্য।’ অর্থাৎ গজমস্তক বিদীর্ণকারী সিংহ যে গিরি শৃঙ্গবাসী, সেবিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রাজকীয় ম্যাজেষ্টি থাকা স্বত্ত্বে
৯০
ও, সিংহ পশু ছাড়াতাে আর কিছুই নয়। মানসিংহ সেই সিংহ। অপরদিকে ত্রিপুর মগ ও বাঙালি মানুষ। পশু ও মানুষের মধ্যে যে তফাৎ শাহানশাহের বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি পাইক-লাঠিয়াল বাহিনীর ঠিক সেটুকুই তফাৎ। অবশ্য আমরা যে বইখানি পড়েছিলাম তাতে মানসিংহের সিংহত্ব ভুলে গিয়ে বৃটিশ লায়নই ইঙ্গিতবহ হয়ে আমাদের মনে অন্য অনুসঙ্গের আলােড়ন তুলত। এখন পূর্ববঙ্গে ‘বাঙলাদেশে যে লড়াই চলেছে, কেন যেন তা আমার কাছে বারবার এই আধা বাঙলা আধা সংস্কৃত ছড়া দুটির কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।
কেন মনে পড়িয়ে দিচ্ছে, সে কথাও বলি। আমার মতে বাঙলাদেশে’সত্যিকারের নবজাগরণ’এসেছে। অর্ধসমাপ্ত বা ভাঙাচোরা নয়। আর এযুগে নবজাগরণের সারাৎসার বা কনটেন্ট সােশ্যালিস্ট হতে বাধ্য। এবং এই সামাজিক কনটেন্ট নিয়ে যে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হবে তার পথ সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রসারিত হতে বাধ্য। পূর্ব-বাঙলায় এই নবজাগরণের ব্যাখ্যা করার কাজে, অন্তত নিজের বােঝার জন্যেও এমন চিন্তাটাও লেখা দরকার। কে না-জানে মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারা অস্পষ্ট চিন্তাগুলিও লেখার মধ্য দিয়ে নিজের কাছেই অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে যায়।
ভারত ইতিহাসের পৃষ্ঠপট
ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারতের কথা বলছি না। বলছি, বিশেষ ভাবে উপমহাদেশের উত্তরভারতের কথা। আমাদের দেশের দীর্ঘ ইতিহাস কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সেই মােটা ধারা—অর্থাৎ আদিম সাম্যতন্ত্র, দাসযুগ, সামন্তযুগ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এই চার পর্বের মধ্যে কী করা যাবে? যারা মার্কসবাদী, তাঁদের কাছে এমন সমাধারণীকৃত কালপর্ব পাওয়া যায়। বিশেষভাবে শােনা যায় স্বয়ং স্তালিন কোনাে দেশের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার কাজে সােভিয়েত ইতিহাস চর্চাকারীদের তৎবিলিসি ও লেনিনগ্রাদ সম্মেলনে (১৯৩০-৩১) প্রাক সমাজতান্ত্রিক ইতিহাস কালপর্ব বিচারে এই চার ধাপের সরলীকরণের মধ্য দিয়ে সর্ব প্রশ্নের উপরে যবনিকা টেনে দেন। কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম। কোনাে কোনাে ভাবনার উপরে স্কুলহস্তাবলেপের ফলে রাহুগ্রাস ঘটে যেতে পারে কিছুদিনের জন্য কিন্তু “They suffer eclipses but they come back again, … There we may call great ones-it is no disadvantage of this definition that links greatness to vitality. Taken in this sense, this undoubtedly the word to apply to the message of Marx.” (J.Schumpeter)। এবং ভারত-ইতিহাস সম্পর্কে মার্কসের সেই message কী?
ভারতের ইতিহাসের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার সূত্রপাত করে গেছেন স্বয়ং মার্কস। ১৮৫৩ সালে মার্কস নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে দুটি প্রবন্ধ লেখেন ‘ভারতে বৃটিশ শাসন’ ও ‘ভারতে বৃটিশ শাসনের’ভবিষ্যৎ ফলাফল। ঐ প্রবন্ধ দুটি অদ্যাবধি স্থায়ীমূল্যে চিহ্নিত হয়ে আছে। ঐ প্রবন্ধ দুটিতে বৃটিশ-পূর্ব ভারতের অবস্থা সম্পর্কে মার্কসের মন্তব্য আছে। যেমন, “ভারতীয় সমাজের কোন ইতিহাস নেই, অন্তত জানা ইতিহাস নেই। আমরা যাকে ভারতের ইতিহাস বলে জানি আসলে তা অপ্রতিরােধী অপরিবর্তমান সমাজের উপরে যে আক্রমণ-পরম্পরা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে তারই ইতিহাস।”
সেই ভারতীয় সমাজ ছিল বর্ণাশ্রম ধর্মের শিকলে আপাদমস্তক বাধা। গ্রাম-সমাজ বা ভিলেজ কমিউনিটির আবহমানতার ঐতিহ্যসাপেক্ষ ছিল তার রাজনীতি-অর্থনৈতিক জীবনচারণা। তাবৎ ভূমির মালিকানা ছিল কেন্দ্রীয় রাজশক্তির করায়ত্ত (অর্থাৎ রাষ্ট্রের) এবং উত্তর ভারতের শুষ্ক ভূমিকে কৃষিকার্যের প্রয়ােজনে জল সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হতাে কেন্দ্রীয় রাজশক্তিকে। এই কেন্দ্র পরিচালিত এবং গ্রামসমাজ থেকে খাজনা আহরক রাজপ্রতিনিধি পরিচালিত সেচব্যবস্থার কল্যাণে এশীয় স্বৈরতন্ত্রের উপরে সে সমাজের নির্ভরশীলতা ছিল। ভারতীয় সমাজের নিষ্ক্রিয়তা ও স্থাবরত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস তাই বর্ণাশ্রমধর্ম, গ্রামসমাজ, এশীয় স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি কেন্দ্রীয় সেচ সংগঠনের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তির অনুপস্থিতির কথাই উল্লেখ করেছেন। ফলে ভারতের অতীত রাজনৈতিক চেহারাটা যতই পরিবর্তনশীল বলে মনে হােক
কেন, সুদূর পুরাকাল থেকে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তার সামাজিক অবস্থা অপরিবর্তিত থেকেছে।”
৯১
এ ধরনের সম্পত্তিব্যবস্থা কেবল ভারতেই নয়, এঙ্গেলস ১৯৭৮ সালে অ্যান্টিহরিং গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, ‘আ-ভারত রুশদেশ’-এ টিকে থাক। আদিম সমাজ প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি ছিল। বিবিধ সম্পত্তিধারার মধ্যে বলাবাহুল্য গ্রাম-সমাজের হাতে ব্যক্তিগত মালিকানাহীন সম্পত্তির অস্তিত্বের এই বিশেষ রূপটি সবচেয়ে আদিম এবং তা বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল (এশিয়া, রাশিয়ার স্লাভ অঞ্চলগুলােতে ও কেন্টিয় অঞ্চলে)। প্রাচীন নগরভিত্তিক সমাজ দাস-প্রথায় বিকাশ লাভ করে। গেৰ্মান সমাজ শেষ ধাপে ভূমিদাস প্রথার রূপ ধারণ করে। এগুলাে সহ এশীয় ধারাটি ধরলে, মার্কসের মতে এই এশীয় ধারা (যার মধ্যে প্রাক্-বৃটিশ ভারত পড়ে যায়) “সবচেয়ে বেশি দিন আর সবচেয়ে একদেশদর্শী হয়ে অপরিহার্যতায় টিকে রয়েছে। অবশ্য এঙ্গেলস আলােচনা প্রসঙ্গে এও বলেছেন যে, প্রাচ্য দেশগুলােতে বিজেতা তুর্কীরা জমিতে “এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার সৃজন ঘটায়”।
এতটা আলােচনার প্রয়ােজন হলাে, কেননা আমাদের দেশে ঐতিহ্যচারণার নামে হয় অতীত ভারত সম্পর্কে গদগদ ভাষণ চোখে পড়ে, অথবা একেবারে উল্টো, অতীত ভারতে প্রায় কিছুই পাবার নেই—এসব উৎকেন্দ্রিক ভাষ্যও নজরে আসে। আবার ভারত-ইতিহাসের এই পৃষ্ঠপটের উল্লেখ এজন্যেই প্রয়ােজনীয়, কেননা এর উপরেই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ভারতের বণাশ্রমভিত্তিক সনাতন সংস্কৃতি। “যেন না ভুলি যে, ছােট ছােট এই সব গােষ্ঠি ছিল জাতিভেদ-প্রথা ও ক্রীতদাসত্ব দ্বারা কলুষিত, অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত না করে তাকে করেছে বাহিরের অবস্থার অধীন, স্বয়ং বিকশিত একটি সমাজব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তমান প্রাকৃতিক নিয়তিরূপে এবং এইভাবে আমদানি করেছে প্রকৃতির পশুবৎ পূজা, প্রকৃতির প্রভু যে মানুষ তাকে হনুমানরূপী বানর এবং শবলারূপী গরুর অর্চনায় ভূলুণ্ঠিত করে অধঃপতনের প্রমাণ | দিয়েছে। আমি বলতে চাই যে, উত্তর ভারতের নিরঙ্কুশতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন এই কেন্দ্রীয় সেচব্যবস্থা-সাপেক্ষ গ্রামসমাজও জাতিভেদ-প্রথার দুর্মর হস্তাবলেপের বাইরে ছিল পূর্ববঙ্গের অস্তিত্ব। তাই পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে ও মানব-সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক ভাবেই জীবনধর্মী মানবতাবাদী ঐতিহ্যের বীজ আবশ্যিকভাবে উপস্থিত ছিল।
ভারত সংস্কৃতির পৃষ্ঠপট ও বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি
ভারতের সংস্কৃতি সাধনার মঞ্চটি তাহলে উল্লিখিত চারটি পায়ার উপরে দাঁড়িয়ে আছে যার ক্ষুদ্রতম রাজনৈতিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবন গ্রাম-সমাজ ভিত্তিক। অন্য দিকে তার পেশা এবং সামাজিক অবস্থান বর্ণভিত্তিক। বর্ণভিত্তিক বলে যে কোন পেশা কুলপেশা, এবং পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে বিস্তৃত তার প্রক্ষেপ ও পৌনপুনিকতা। বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতায় হস্তকৌশল বেড়েছে কিন্তু কৃৎকৌশলের পরিবর্তন হয়নি। এমনকী শ্ৰম-প্রয়ােগের রীতি-নীতিও প্রথানির্ভর হয়ে দাঁড়ায়। এর অন্যতম প্রমাণ, হরপ্পার যুগের লাঙলের কায়দা এই সেদিন পর্যন্তও বদলায়নি। কৃৎ কৌশল যেমন অনড়, উৎপাদিত সামগ্রীর সামাজিক বন্টনও তেমনি প্রথানির্ভর ছিল। আর এজন্য ভারতে, বিশেষভাবে উত্তর ভারতে সাংস্কৃতিক জীবনে দুটি স্পষ্ট ধারা ছিল । একদিকে রাষ্ট্রশক্তির চতুর্দিকে সজ্জিত নবরত্নের’ মেলা, অন্যদিকে গ্রাম-সমাজের তলায় মানুষগুলাের শ্রমভিত্তিক কৃতি বা সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির বিচারে প্রাকৃতিক অন্ধ শক্তির সঙ্গে যুধ্যমান সাধা উৎপাদন ভিত্তিক আবশ্যিক জীবনচারণা বা বিশ্বদৃষ্টি আবর্তিত ছিল। কিন্তু যেহেতু উৎপাদন-পদ্ধতি (mode of production) অপরিবর্তিত এবং উৎপাদনশক্তি জাড্যতায় সুস্থির ছিল, সেইহেতু একই লােকায়ত আবেষ্টনীতে সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিভাবনা নিশ্চিত ও নির্ধারিত পথে অনুক্রমিত হয়েছে। ফলে স্বয়ংবিকশিত একটি সমাজ-ব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তমান প্রাকৃতিক নিয়তিরূপে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তির দেব-দ্বিজে ভক্তি রাষ্ট্রের শােষণভিত্তিক ভাবাদর্শই প্রকাশ করে। রাজা এবং দেবতাকে সমান আসন দেবার মধ্য দিয়ে সেচ পরিচালনার কেন্দ্রকে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জানাবার পথ বলে ধরে নিতে পারা যায়। অবশ্য সুলতানশাহী যুগে এবং মােগল যুগে রাজসভাকে ঘিরে এক ধরনের সামন্তপ্রথার রূপ দেখা দেয়। তাও অবশ্য অনেকখানি সামরিক প্রয়ােজনে গড়ে উঠেছিল।
রাজসভায় তাই সংস্কৃত ও ফারসি চর্চা হয়েছে। লৌকিকভাষা কখনও রাজভাষা হয়ে গড়ে ওঠেনি। বরং সঙ্কীর্ণ একটি শােষকসম্প্রদায় এবং শশাষণব্যবস্থা অব্যাহত রাখার কাজে গ্রামসমাজ, প্রদেশ, সুবা প্রভৃতিতে ঐ স্বল্পসংখ্যক শাসকদের যােগাযােগের ভাষা সংস্কৃত বা ফার্সীতেই পর্যবসিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় শােষকেরা
৯২
শোষণেরও একটি ব্যাপ্তভুমির পিরামিড গড়ে তুলেছিল। প্রথাসিদ্ধ বণ্টনের তাৎপর্যে ব্রাহ্মণ ও রাজ্য ছিল সেই শােষণ ব্যবস্থার গ্রামীণ ভিত্তি। সুলতানশাহী ও মােগল যুগে সামরিক বাহিনীর অংশীভূত ফারসি বয়ান ও সাধারণ গ্রামসমাজের হিন্দুস্তানি ভাষা মিলে সামরিক শিবিরের ভাষা উর্দুভাষা গড়ে উঠেছিল। উত্তর ভারতের এই সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বাঙলাদেশের , বিশেষত পূর্ববঙ্গের বেশ তফাৎ ছিল।
প্রকৃতপক্ষে, পূর্ববঙ্গের ব্যাপারটি ছিল অনেকখানিই আলাদা।
নদীমাতৃক পূর্ববাঙলার তথাকথিত সেচব্যবস্থার প্রয়ােজন ছিল না। দ্বিতীয়ত, শােষণের চাপ ও শাসনের দাপট বাড়লে নদীমাতৃক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষ দল বেঁধে চলে যেতে পারত এবং উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হতাে। এজন্য খাজনা আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় রাজশক্তি অনেকখানিই প্রায় বংশানুক্রমিক জমিদারের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হতাে। সেই জমিদারের উপরে খাজনার চাপ বাড়লে একদিকে তার নিজের খাজনা আদায়ের নিরঙ্কুশ ভূমিকার বলে, অন্যদিকে নদীমাতৃক জঙ্গলাকীর্ণ ভূমিখণ্ডের তাৎপর্যে তারা বিদ্রোহীও হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু কোনক্রমেই তারা চাষী বা অন্যান্য উৎপাদনবৃত্তিজীবী মানুষের উপরে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করতে পারত না।
অবস্থা বদলালাে ইংরেজ শাসনে।
বাঙলাদেশের সমস্ত ভূমিই কার্যত জমিদারদের মধ্যে বণ্টিত হলাে। নির্ধারিত রাজস্বদানের অধিকার পেয়ে জমিদাররা জমির প্রজাকে ব্যক্তিগত মালিকানা দিল উচ্চ খাজনার পরিবর্তে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভূমিহীন হলাে। তাদের উপরে নেমে এলাে উচ্চ খাজনার শােষণ, তা ছাড়া নানকার, চাকরান, ঠিকা, টঙ্ক প্রভৃতি নানা ধরনের শােষণ এবং অন্যবিধ অ-অর্থনীতিক শােষণও শুরু হয়ে গেল। কিন্তু এই শােষণ ও শাসনের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়, মাত্র শ’ দুই বছরের।
বাঙলাদেশের মুসলমান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা দেখলেও একবার যথার্থ আরাে বেশি করে প্রমাণিত হয়। মধ্য বা উত্তর ভারতে সুলতানী বা মােগল আমলে জনসংখ্যা ক্রমাগত মুসলমান হয়েছে, এ ছবি পাওয়া যায় না। শাসককুল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও জাতিভেদ প্রথা ও গ্রামসমাজকে তাঁরা ভাঙতে অগ্রসর হননি, কেননা বর্ণাশ্রমধর্মভিত্তিক গ্রামসমাজে যে উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল, বর্ণাশ্রম ভেঙে দিয়ে তারা তা পরিবর্তন করতে চায়নি। গ্রাম সমাজ অব্যাহত থাকলেই তাঁরা অবলীলাক্রমে রাজস্ব পেতে পারতেন, সুতরাং রাজস্ব আদায়-প্রবাহের এতদিনের পরীক্ষিত পদ্ধতিটি তারা ভাঙলেন না। ফলে ধর্মান্তরকরণের প্রশ্ন কখনই জরুরি হয়ে ওঠেনি। তাই মুসলমানী শাসনের একেবারে ভর-কেন্দ্রের কাছাকাছি রয়ে গেল অনড় বর্ণাশ্রম প্রথা ও গ্রামসমাজ। সেচ-ভিত্তিক উৎপাদনে যখনই শােষণ ও অবহেলার চাপ বেড়েছে, লােকজন তখন বিদ্রোহী হয়েছে, যেমন পাঞ্জাবের শিখ-সম্প্রদায়।
পূর্ববাঙলার জনগণের একদা ধর্ম ছিল লােকায়ত। পরে নাথপন্থা বা পরিবর্তিত বৌদ্ধধর্ম সেখানে দেখা যায়। উৎপাদন ও বণ্টন-পদ্ধতি যেখানে অনেকখানিই গণতান্ত্রিক, সেখানে ধর্মগত দৃষ্টিও অনেকখানি বর্ণাশ্রমধর্মবিরােধী হতে বাধ্য। বর্ণাশ্রমধর্মের চাপ যে-উৎপাদন পদ্ধতিতে দুর্বল, গ্রামসমাজের উত্তর ভারতীয় রূপ যেখানে প্রায় অনুপস্থিত, সেখানে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি উৎপাদন বাড়াবার জন্য উৎপাদকদের নানা সুযােগ দিতে বাধ্য। এমন কী রাজশক্তির ভাবাদর্শ ব্যবহার করে যে অঞ্চলে গ্রামসমাজ ও বর্ণাশ্রমের মতাে built-ic stabiliser নেই, সে অঞ্চলে এক দিকে শাসন অক্ষুন্ন রাখা অন্যদিকে রাজত্বের প্রয়ােজনে উৎপাদনের পরিধি বাড়ানাে, এ-দুটির জন্যে ইসলাম ধর্মপ্রচার তাদের প্রয়ােজন ছিল। তারা তা করেছে। পশ্চিম দেশ থেকে একাধিক বিশিষ্ট পীর, মওলানা ও হাজী ঐ পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে গেছেন এবং নানা লােকায়ত সূত্র ধরে জনগণের কাছে কেন্দ্রীয় শাসক ও শােষকদের ধর্মাদর্শ পৌঁছে দিয়েছেন। ইতিপূর্বে উচ্চবর্ণের যেসব ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী জমিদারেরা জনগণের প্রতি নানা ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, এবং কেন্দ্রীয় রাজশক্তির শাসনের পরিধির বাইরে উৎপাদনের মােটা অংশ স্বাধীনভাবে ভােগ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাদের খর্ব করার জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসন অব্যাহত রাখার জন্য রাজধর্মের তারা প্রচার ঘটিয়েছেন। জনগণ তা গ্রহণও করেছে। কে না জানে, ইসলাম ধর্ম জাতিভেদ প্রথা মানে না। কে না জানে, ইসলামের মধ্যে গণতান্ত্রিক বােধ অনেক বেশি। একদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী স্থানীয় প্রপীড়ক জমিদারদের হাত থেকে আত্মরক্ষা, লােকায়ত ও বৌদ্ধ জীবনচর্যার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ইসলামের আত্মিকতা, অন্যদিকে
৯৩
কেন্দ্রীয় রাজশক্তির নিজস্ব স্বার্থ চেতনা—এই তিনে মিলে পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে। কিন্তু এই ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে ছিল লােকায়ত গণতান্ত্রিক জীবনচর্চা—যা উত্তরভারতে অনুপস্থিত ছিল। শূন্যপুরাণ, ধর্মমঙ্গল এবং নানা লৌকিক উপকাহিনীতে লােকায়ত হিন্দু দেব-দেবীর সঙ্গে মুসলিম পীরের সহাবস্থানএ-সবের স্মৃতিবহ।
অর্ধসমাপ্ত নবজাগরণের ভিত্তি
উনিশ শতকে বাঙলাদেশে নবজাগরণ এল। কোন নবজাগরণ?
১৭৯৩ সালের পর থেকে বাঙলাদেশের তাবৎ ভূ-সম্পত্তিতে সাধারণ প্রজা অধিকার হারলাে। সূর্যাস্ত আইনের নির্ধারিত রাজস্ব দেওয়ায় নিয়মে বাঁধা জমিদারবর্গ বিভিন্ন জমিদারীর মালিক হলাে। ইংরেজ সাম্রাজ্যের সামন্ততান্ত্রিক ভিত্তি হলাে তারা। ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত অবশ্য শােষণ আরও প্রত্যক্ষ ও আতঙ্কজনক ছিল। তখন দু-এক বছরের জন্য রাজস্ব আদায় দেওয়া এবং ঐ-ক-বছরে লাখােপতি হবার তাগিদে নিলাম ডাকত নানা দুষ্কৃতিকারী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, পুরনাে জমিদাররা নীলামে যারা ডাক তুলেছে তাদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় যদি ব্যর্থ হতেন তবে যে ভূ-সম্পত্তি তাঁদের পিতৃপুরুষ পুরুষানুক্রমে ভােগ দখল করছিলেন সেখান থেকে তাঁদের বিতাড়িত করা হতাে। যদি বর্ধিত রাজস্ব দিয়ে চাষী হিসাবে তারা তাদের ভূ-সম্পত্তি রাখতেন এবং সত্ত্বর রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হতেন, তাহলে তাদের জমিজোতের উপরে জোর করে ম্যানেজার চাপিয়ে দেওয়া হতাে এবং তারা জমির চাষীদের উপর লুণ্ঠন চালাত, দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনত ও গ্রামকে গ্রাম জনশূন্য করে তুলত। অবশ্য চরম বল প্রয়ােগ সত্ত্বেও ভূমি-রাজস্ব ঠিক মতাে আদায় হলাে না; বঙ্গদেশের কর্ষিত জমির এক-তৃতীয়াংশ জঙ্গলে ছেয়ে গেল।”
এইভাবে কৃষি ধ্বংস হলাে । কেবলমাত্র কাঁচা মাল উৎপাদন এবং নানা শিল্প-উৎপাদনের বত্তিজীবীদের যথার্থ শ্রমমূল্য না দিয়ে, ইংল্যান্ডের উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী উৎপাদন ধ্বংস করে এবং বাণিজ্যকেন্দ্রগুলােতে জবরদস্তির মধ্য দিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদন চূর্ণ করা হলাে। বঙ্গদেশ থেকে জবরদস্তি করে মূলধন তুলে তা লাগানাে হলাে চীনদেশে উপনিবেশ বাড়ানাের কাজে। লগ্নি চললাে বৃটেনে। ব্যয় হলাে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে দমনমূলক কাজে, সৈন্যবাহিনী রাখার প্রয়ােজনে। রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষায় বলা যায়, “ভূমি-প্রশাসনের এক নিপীড়নমূলক ও চিরপরিবর্তনশীল ব্যবস্থার কুফলগুলাে আরাে গুরুতর হয়ে উঠল এই কারণে যে, কার্যত প্রদেশের সমস্ত রাজস্বই বাইরে চলে যেতে লাগল এবং জনসাধারণের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিকে ফলপ্রসূ করার জন্য তা কোনাে রূপেই তাদের কাছে ফিরে এল না।” আর এসবের ফলে অযােধ্যা প্রদেশে “অসংখ্য মানুষ তাদের গ্রাম ত্যাগ করে এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তাদের পলায়ন বন্ধ করার জন্য ফৌজ মােতায়েন করা হয়। অবশেষে এক বিরাট বিদ্রোহ দেখা দেয়। ভূ-স্বামী ও কর্ষকেরা অসহ্য জবরদস্তি আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন; তারপর আসে বীভৎস ভয়াবহ। ও জল্লাদবৃত্তি যার সাহয্যে ক্রোধােন্মত্ত সৈন্যরা অসামরিক চাষীদের দমন করে।”
উপরের উদ্ধৃতিগুলাের সঙ্গে বাঙলাদেশ-এর সাম্প্রতিক পরিস্থিতির যথেষ্ট মিল আছে। যাই হােক, ‘নবজাগরণের কথা বলছিলাম, সে প্রসঙ্গেই ফিরে আসা যাক।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুণ একদল ‘অনুপস্থিত ভূ-স্বামী’ দেখা দিল, যারা কৃষির উন্নতি তাে দূরের কথা, তার সম্পর্কে সামান্য চিন্তাও মাথায় স্থান দিল না। স্থবির উৎপাদনপদ্ধতি, জমির উপর অত্যধিক চাপ, বঙ্গদেশের তাবৎ অঞ্চলে নানা ঘরানার জমিদারি সব কিছু মিলে জবরদস্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জঙ্গল কেটে নতুন আবাদ গড়ে তুলে স্বাধীন চাষবাসের আর সুযােগ রইল না। অবশ্য ইংরেজদের আর্থনীতিক আক্রমণ“এদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে এবং এইভাবে যে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করেছে সেটা এশিয়ায় যা শােনা গেছে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ, সত্যিকথা বললে একমাত্র বিপ্লব’—তার ধ্বংসকারী ফলের বিপরীতে যে সৃষ্টিধর্মী দিক আসবার ব্যাপার ছিল তা বিড়ম্বিত হলাে। আর তখনই কলকাতায় এলাে মেকলে প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষা, যে-শিক্ষা এ-দেশে ইংরেজ প্রশাসনে কাজ করার জন্য করণিক তৈরি করতে পারে। ১৭৮৩ সালের সিলেক্ট কমিটির নবম রিপাের্টের ৫৫পৃষ্ঠায় এই ধরনের কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা (ভারতীয়রা।) শুধু ইউরােপীয়দেরই নফর বা এজেন্ট হিসাবে
৯৪
নিযুক্ত হয় অথবা যখন তাদের সাহায্য ছাড়া এক পা-ও অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন তাদের নিযুক্ত করা হয় আমাদের নিম্নতর বিভাগগুলােতে।”
এই সমস্ত জমিদারদের সন্ততি ও ইংরেজদের এজেন্ট বেনিয়ানের দল কলকাতায় বসবাস করার সময়, হতভাগ্য স্বদেশবাসীদের সম্পর্কে খুব বেশি মানবিকতা সম্পন্ন না হয়েও ইংরেজি শিক্ষার কল্যাণে পুঁজিবাদী উৎপাদন ও তার ভাবাদর্শের সংস্পর্শে আসে। সে যুগটা ছিল ইয়ােরােপের বাধারহিত পুঁজিবাদ বিকাশের যুগ। জমি থেকে উদ্ধৃত্ত ও বেনিয়ান-বৃত্তি থেকে অর্জিত মুনাফা এরা ইংরেজ মালিকানার অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থার মধ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছে। অবশ্য উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বৃটিশ শাসন ভারতের পুরনাে ঘরানার সামন্ততন্ত্রকে আঘাত করেছে, নতুন বৃটিশ প্রবর্তিত সামন্ততন্ত্রের জন্ম দিয়েছে এবং নির্মমভাবে পুরনাে রাজন্যবর্গের অধিকার খর্ব করে পুরনাে সামন্ততন্ত্রের গােড়া ধরে টান দিয়েছে। সতীদাহ প্রথা রদ, ব্যবস্থা বিলােপ, শিশু হত্যা ও ঠগী অত্যাচার বন্ধ, পশ্চিমী শিক্ষা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রবর্তন সে-শাসনের অনেকগুলাে প্রগতিশীল দিক। কিন্তু এগুলাে প্রায়ই সুপারিস্ট্রাকচারের ব্যাপার। এশীয় ধরনের উৎপাদন ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মানসজগৎ তখনও অনড়। এ পরিবর্তন এক জগদ্দল পাথর সরিয়ে আরেক পাথর আমদানি করল মাত্র। এক ঘরানার সামন্ততন্ত্রের বদলে তারা জমিদারীপ্রথার সামন্ততন্ত্রের সৃজন ঘটাল। বৃটিশ পুঁজিবাদের বিস্তারের সেই যুগে উদারনীতি তখনও কার্যকর ছিল—অবশ্য বৃটিশ প্রশাসন ভারতে চালু রাখবার জন্য যেসব প্রগতিশীল কাজ তাদের দরকার ছিল সেগুলােই তারা করেছেন। তাঁরা “Rigid in their outlook, unsympathetic to all that was back-ward in Indian tradition, convinced that the Nineteenth Century British Bourgeois and Christian conception was the norm for humanity, and early administrators nevertheless carried on a powerful work of innovation, representing the spirit of the early ascendant bourgeoisie of the period.” (R.Palme Dutt: India Today, pp 305)। এই সভ্যতাবিস্তারমূলক কাজগুলাে একদিকে পুরনাে ভারতীয়-এশীয় ধাচের সামন্ততন্ত্রকে চূর্ণ করছিল এবং অন্যদিকে বাণিজ্য পুঁজির পর শিল্প-পুঁজির দ্বারা শােষণ-ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করছিল ।) রজনী পামদত্ত এ-প্রসঙ্গে বলছেন, “ The most progressive elements in Indian society at that time, represented by Ram Mohan Roy and the reform movement of the Brahmo Samaj looked with unconcealed admiration to the British as the champions of progress, gave unhesitating support to their reforms, and saw in them the vanguard of a new civilization.” (ঐ পৃ ৩০৫)
উপনিবেশ বাংলাদেশ ও খণ্ডিত ‘নবজাগরণ”
বৃটিশ শিল্পপুঁজির শাসনের প্রথম যুগে, অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, বৃটিশ প্রবর্তিত সংস্কার সাধনকে এক অর্থে নতুন শােষণ ও শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য ‘clearing of the decks’ বলা চলতে পারে। কিন্তু তার আগে আদি পুঁজি সঞ্চয়ের কাজে বঙ্গদেশকে কিভাবে রক্তশূন্য করা হয়েছেবাণিজ্যপুঁজির অন্তিম যুগে (১৭৫৭ থেকে ১৭৯৩ পর্যন্ত, তার অকিঞ্চিৎকর একটি চিত্র আমরা ইতিপূর্বেই দিয়েছি। বলেছি, কিভাবে এক তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ জনশূন্য হলাে। অর্থাৎ ইংরেজ শিল্পপুঁজি কাজে লাগাবার মতাে ঔপনিবেশিক সমাজ-অর্থনীতিক ভিত্তিভূমি রচনায় যখন ব্রতী তখন তাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন এ দেশের নবজাগরণের পথিকৃতেরা। এ-কথা ঠিক তারা আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে অনেকাংশেই পুরনাে এশীয় সামন্ততন্ত্রের বিরােধী ছিলেন, কিন্তু বৃটিশ প্রবর্তিত সামন্তশাসন যার ফলে চাষী জমি হারাল অনেকেই তার বিরােধী ছিলেন না। সে যাই হােক, তাঁদের কারাে কারাে কাছে হিন্দু রিভাইভালিজম, কারাে কাছে নির্ভেজাল বুর্জোয়া উদারনৈতিকতা, কারাে কাছে হিন্দু ও প্রােটেস্টান্ট খ্রিস্টান ধর্মের সমন্বয়, কারাে কাছে খ্রিষ্টান আদর্শ মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। সম্ভবত একমাত্র বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিস্তার, নারীমুক্তি, সমাজসংস্কার, ভাষা-গঠন ও নতুন সাহিত্য আন্দোলন ইত্যাদির তাৎপর্যে একই সঙ্গে এশীয় সামন্ততন্ত্রের ভাবাদর্শ ও বৃটিশ প্রবর্তিত সামন্ততন্ত্রের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে আঘাত করেছিলেন। সে যাই হােক, এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে, এই নবজাগরণের নায়কদের মুক্ত মানবতার ভাবাদর্শ বঙ্গভূমিতে প্রােথিতমূল হতে পারেনি। এ ছিল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সহযােগী হয়ে এ-দেশে
৯৫
গলা টিপে ধরা স্বদেশী বুজোয়ার বিকাশের পক্ষে তা পরিপূরক হওয়া সম্ভবপর ছিল না। বৃটিশ প্রবর্তিত সামন্ততন্ত্রের পরিপােষকতা, যে সামন্ততন্ত্র এ-দেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শােষণ ও শাসনের ভিত শক্ত করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্তর্গত হয়ে তাে স্বাধীন বুর্জোয়া বিকাশ হতে পারে না। সেই সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসাবশেষের উপরেই ছিল স্বদেশী শিল্পবিস্তারের সম্ভাবনা। বৃটিশ পুঁজির সহযাত্রীদের পক্ষে সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নব-জাগরণ নবমানবতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া তাই প্রকৃত অর্থে অসম্ভব ছিল। নবজাগরণ গড়ে ওঠার জন্য প্রয়ােজন মৌল আর্থনীতিক সামাজিক অবস্থা। শিকড়ে যেখানে সাম্রাজ্যবাদ প্রবর্তিত শােষণের বিষ সঞ্চারিত, সেই প্রশাসন শিক্ষা অর্থনীতি ও সমাজের গাছের মাথায় নবজাগরণের সূর্যোদয়ের কথঞ্চিৎ রক্তছাপ পড়তে পারে, কিন্তু তা বাইরের, শিকড়কে তা স্পর্শ করেনি। এই সূর্যোদয়ের আকাশও ছিল মেঘম্লান। ফলে, সেই সূর্যালােক আমাদের জাতির গভীর শিকড়ে পৌঁছতে পারেনি। শহরে শশাষণের যাবার নিচে ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম। আলাের তলায় যেন অন্ধকার। অথচ সেই অন্ধকারের মধ্যেই প্রাক্-বৃটিশ সামন্ততন্ত্রে যেমন, তেমনি বৃটিশ প্রবর্তিত সামন্ততন্ত্রেও অন্ত্যজ নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে গায়ে গতরে খেটে খাওয়ার জীবন অব্যাহত ছিল। চাষীর ধান বিনিময় হতাে তাতীর মােটা কাপড়ের সঙ্গে, কামারের লাঙলের ফলার সঙ্গে। জীবনধারণে ছিল সেখানে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সেদিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া নায়কদের নজর পড়েনি।
এই ইতিহাস গঠন নয়। তবু বলা যেতে পারে বৌদ্ধধর্মের পর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণাধিকার, কান্যকুজের ব্রাহ্মণ আনা ইতাদি নানা ধরনের সত্য ও অর্ধ কল্পনা মিলে একটি সত্যের দিকে চোখ ফেরায় তা হলাে রাজশক্তি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়ে গণতান্ত্রিক জীবন-ভাবনার উজানখাতে রাষ্ট্রতরণী ভাসিয়েছিল। বঙ্গদেশের বিভিন্ন মুসলিম রাজন্যবর্গ এই ব্রাহ্মণধিকারকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের আগমনে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা ইংরেজি শিক্ষা বর্জনের হাঁক দিলেন সারা’ (ইহুদিভাবাপন্ন) বলে। মুসলিম বুদ্ধিজীবী ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও শােষণ-ব্যবস্থায় অপাঙক্তেয় রইল। কুম্ভকবৃত্তির মধ্যে তারা ইসলাম বাঁচাতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাও বাঙালি দরিদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে শােষিতের আত্মাভিমানের জন্ম দেয়।
আমরা ভালাে বলি বা মন্দ বলি, এখন তাতে আর কিছু এসে যায় না। বঙ্গদেশের ভূম্যধিকারী, বেনিয়ান, পাটের দালাল, তেজারতি কারবারী যারা বৃটিশ সাম্রাজ্যের পরিপােষক ছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু-ধর্মাবলম্বী। স্বাধীনতার অর্থ যে চাষীর হাতে জমি পাওয়া, ফসলের ন্যায্য দাম পাও তেজারতি শােষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া—গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শ হিসাবে এখন আমরা তা জানতে পেরেছি। দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান চাষীর সামন্তবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল, ইংরেজ সেই আর্থনীতিক ও সামাজিক বিক্ষোভকে ধ্বংস করতে পারত না, ফলে গণতান্ত্রিক ও জাতীয় বিপ্লবের বিপ্লববিকাশের নিয়মটি বুঝতে পেরে, এবং তা ধ্বংস করা অসম্ভব বিবেচনা করে তারা তাকে নিয়ন্ত্রণ ও বিকৃত করার প্রচেষ্টা চালায়। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তারা মদত দেয়। আমাদের খণ্ডিত নবজাগরণ যে কতখানি অগভীর ছিল, তার প্রমাণ বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার জবরদস্তির মধ্যেই প্রকট। ১৯০৬ সালে হিন্দুমহাসভা ও মুসলিম লীগ জন্ম নেয়। মুসলিম লীগের রাজনীতি শ্রেণী ঘৃণাকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৩৫ সালের ভারত-সংস্কার আইন ও জনপ্রতিনিধি আইন মারফত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ রাজনীতি কার্যকর করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যখন দেশে দেশে জাতীয় মুক্তিআন্দোলন জোরালাে হয়ে উঠল, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত সামন্ততন্ত্রকে মদত দিয়ে তারা তখন ভারত বিভাগ করে দিল। উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্যে দিয়ে যে সমঝােতায় বিশ্বাসী বুর্জোয়াভাবুকদের দেখতে পাই, তাদেরই ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা, প্রদীপের তলার অন্ধকারের মানুষগুলাের জীবনযাপন ও জীবনচারণা থেকে বিযুক্ত রাজনীতিক নেতাদের কাছে স্বাধীনতা বা জাতীয় বিপ্লবের অন্তত আট আনা অংশই ছিল সহযােগিতার ব্যাপার, আপােষের ব্যাপার, নিয়মতান্ত্রিকতার ব্যাপার। আর স্বাধীনতার পরবর্তী তেইশ বছর ধরে পর্বে পর্বে নয়া ঔপনিবেশিকতার চাপ বিভক্ত ভারতের পাকিস্তান অংশে বাড়তেই থাকে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও পূর্ববঙ্গের মানুষ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল রাষ্ট্রশক্তির চাপে পিষ্ট হতে থাকে।
৯৬
নয়া ঔপনিবেশিকতা কী?
সস্তা কাঁচামাল, সস্তা মজুর এবং পুঁজিবাদী দেশের উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক বাজার নিয়ে গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিকতা। অর্থাৎ অন্যদেশে পুঁজি খাটিয়ে অর্ধসমাপ্ত পণ্য উৎপাদন করা এবং ঐ অর্ধসমাপ্ত পণ্যকে মূল পুঁজিবাদী দেশে সম্পূর্ণ করা এবং তারপর সেই পণ্য পুনরায় অর্ধ-সমাপ্ত পণ্য উৎপাদনকারী । বিক্রয় করা ঔপনিবেশিকতার অন্যতম মূল লক্ষণ। এই সব কাঁচামাল তুলে আনা সস্তা মজুর ব্যবহার করার প্রয়ােজনে সাম্রাজ্যবাদী দেশ এই অংশে নিজের দেশের সর্বোচ্চ আমলাদের দিয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলে। সাম্রাজ্যবাদী দেশের সরকার এই অঞ্চলে শাসন-ব্যবস্থা প্রচলিত রাখে। এই পরাধীন দেশই ধ্রুপদী অর্থে উপনিবেশ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশেষভাবে এই সব পরাধীন দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরালাে হয়ে ওঠে। তখন বহুক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আপােষের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে ভাওতা দেয় এবং বহুক্ষেত্রেই একটি করে পুতুল সরকার স্বাধীনতা দেওয়ার নামে উপহার দেয়। প্রত্যক্ষত সাম্রাজ্যবাদী উচ্চপদস্থ আমলারা এ সব দেশে তখন প্রশাসন চালায় না। যদিও পুরনাে আমলের প্রশাসনিক কায়দাকানুন বজায় থাকে। তখন ঐ পুতুল সরকারকে তারা কোনাে না কোনাে এক সামরিক গােষ্ঠীতে জড়িয়ে ফেলে, এবং দেশে জনগণের সংগ্রামের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য এই সব সামরিক চুক্তিবদ্ধ দেশগুলাের পুতুল সরকার নানাবিধ সহায়তা পায়। আসলে সমস্ত সহায়তার পেছনে থাকে কলকাঠি হাতে সাম্রাজ্যবাদ। আর এই সাম্রাজ্যবাদের শেষ পর্যন্ত গণবিদ্রোহ ঠেকাতে নিজেই সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে লড়াইয়ে নেমে পড়ে। যেমন ঘটেছিল কোরিয়ায়, ঘটছে ভিয়েতনাম-কম্বােডিয়া । লাওসে—পাকিস্তানের পুতুল সরকার বর্তমানে বাঙলাদেশের সংগ্রামের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সামরিক চুক্তিবদ্ধ দেশগুলাের সহায়তা পাচ্ছে। সংগ্রামের নায়কতার শ্রেণী চরিত্র বদল হলে, নিজেই নেমে পড়বে পালের গােদা। পশ্চিম পাকিস্তানের পুতুল সরকার, অর্থাৎ সামরিক-আমলাতন্ত্রী চক্রকে মদত দেবার জন্য আছে একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বড় বড় ভূম্যধিকারীর দল। এদের রাজনীতিক দলই হলাে মুসলিম লীগ, জামাত-ই ইসলাম ইত্যাদি। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক ‘জুন্টা’শক্তি আসলে পুরনাে উপনিবেশে নতুন নতুন পুতুল সরকার। পাকিস্তান হয়ে পড়েছে নয়া উপনিবেশ। বাঙলাদেশকে তারা গােলামের গােলাম বানাতে চায়।
বাঙলাদেশের সগ্রামের আর্থনীতিক ভিত্তি
পূর্ববঙ্গ অধুনা বাঙলাদেশের জাতীয়তা বিকাশের পেছনে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কারণ বড় কম নেই। ১৯৫২-৫৩ সালে খাদ্যের ঘাটতি সে দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি করে। মার্কিন তােষামােদের উপঢৌকন স্বরূপ ১৯৫০-১৯৫১, ১৯৫২ পর্যন্ত কোরিয়ার যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে পাটের দাম বাড়ে। পাট আড়তদারদেরই এতে মুনাফা বৃদ্ধি পায়। পাট চাষীদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। তার উপর আবার ১৯৫৩৫৪ সালে কোরিয়া-যুদ্ধের পর পাটের দাম হু হু করে পড়ে যেতে থাকে। সরকারের বিনা অনুমতিতে বােনা পাটের ক্ষেত ধ্বংস করে দিল পাক-সরকার। চাষীর আয় সর্বনিম্ন ধাপে পৌঁছলাে। খাদ্য ও কাঁচামালের অভাবে সৃষ্টি হলাে কালােবাজারি, মুনাফাখখারি। ফাটকাবাজারের চাপে অর্থনীতিতে নাভিশ্বাস উঠল। অন্যদিকে তাঁতবস্ত্রের মতাে কুটিরশিল্পও শেষ হতে বসল। সুতাে আমদানি হতাে বিদেশ থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা অন্তত বাঙলাদেশের তন্তুবায়দের চেয়ে শতকরা কুড়ি থেকে পঞ্চাশ শতাংশ কম দামে সুতাে কিনতে পেতাে। এ-ছাড়া ছিল রঙের অভাব। পশ্চিম পাকিস্তানী বস্ত্র-শিল্পের প্রতিযােগিতা, রঙ ও সুতাের অভাব তাঁতশিল্পীদের নিরন্ন করে ফেলে। বাস্তুহারার চাপে এবং দরিদ্র পাটচাষী ও হস্তশিল্পের ভাঙনের ফলে দেশে নিরন্ন কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। নয়া ঔপনিবেশিকতার পুতুল সরকারের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের এতে কিছুই এসে যেতাে না। মুসলিম লীগের রণধ্বনি ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-বিদ্বেষ। স্বাভাবিক আর্থনীতিক পরিবেশ থেকে বাঙলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার জিগির দিয়ে শােষণের মাত্রা তারা বাড়িয়েই চলে। ভারত-বিদ্বেষের প্রয়ােজনে ক্রমবর্ধমান সামরিক বাজেটের দায়ে পূর্ববঙ্গের উপরে চেপে বসলাে ট্যাক্সের বােঝা। আগে যেসব আদায়কৃত ট্যাক্স পূর্ববঙ্গেই ব্যয়িত হতাে এখন তা বরাদ্দ হলাে শেষহীন সামরিক ব্যয়ের ‘গহ্বর’ ভরাট করার কাজে। [s.M.Akhtar ,
৯৭
Distribution of Revenue Resource between Centre and Provinces, Lahore.p11). Gasinca চললাে পশ্চিম-পাকিস্তানকে আর্থনীতিকভাবে বিকাশ করা। ফলে, পূর্বঙ্গের কৃষিজাত কাচা মালের অঢেল রপ্তানী শুরু হয়ে গেল। কিন্তু শিল্পবিকাশের জন্য আমদানীর পরিমাণ গেল কমে। এরই ফলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ২৯০ কোটি টাকা তার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হয়। আর পূর্ববঙ্গের এই বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্য-ঘাটতি পূরণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-বিকাশের জন্য যন্ত্রপাতি, শিল্প-কাঁচামাল ইত্যাদির চলছিল বিপুল আমদানী, আর সেই আমদানীকৃত বিদেশী শিল্পবিকাশকারী দ্রব্যসামগ্রীর দাম মেটাচ্ছিল পূর্ববঙ্গের গরিব চাষী। পশ্চিম-পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গের চেয়ে ঢের কম মূল্যের সামগ্রী রপ্তানী করত, কিন্তু আমদানী করত পাকিস্তানের মােট আমদানীর সত্তর শতাংশ। অন্তত পক্ষে প্রতি বছর ৩০ কোটি টাকা পূর্ববঙ্গ থেকে দোহন করে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিকাশের জন্য কাজে লাগান হতাে(The Pakistan Times, Feb-7, 8, 1956) এর মধ্যে পাকিস্তানের দু-অংশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারি এক মজার ছবি পাওয়া যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে দ্রব্য আমদানী-খাতে ঋণী হয়ে পড়ে। এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০কোটি ৯০লক্ষ টাকা। (স্টাটিসক্যাল বুলেটিন, ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯)। ১৯৫৩-৫৪ সালের নয় মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের উপরে বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ১৬কোটি ৭০লক্ষ টাকা। এসবের অর্থ কী?(১) পূর্ববঙ্গ থেকে সস্তা দামে কাঁচামাল কিনে নিয়ে গিয়ে সর্বশেষ পণ্য পশ্চিম-পাকিস্তানে তৈরি করে পূর্ববঙ্গে বিপণনের মধ্য দিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তােলা—আর সেই মুনাফা পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা। (২) পূর্ববঙ্গের উৎপাদিত বহু কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানী করে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য শিল্পসম্ভার ক্রয় করা এবং বিদেশী মূলধনের ঋণ, মুনাফা ও আসল পরিশােধ করা। (৩) পূর্ববঙ্গে ট্যাক্স বাড়িয়ে, গরীব মানুষের পকেট কেটে পশ্চিমপাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রী চক্রের ক্ষমতা বাড়িয়ে ভােলা। তাের’শিল তাের নােড়া তােরই ভাঙি দাঁতের গােড়া’-অনেকখানি এই বৃটিশ প্যাটার্ন। বৃটিশ আমলা ও ভূমধ্যসাগরে বৃটিশ নৌবাহিনী রাখবার জন্য যে ধরনের হােমচার্জের গুনগান দিতে হতাে, একবারে সেই ধরনের ব্যয় করতে হতাে পূর্ববঙ্গকে; আর এ-টাকা আসত অতিরিক্ত ট্যাক্স থেকে। ১১৩ কোটি টাকা, বা ২২.১ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ করলেন ১০০০ কোটি টাকা, কাঙাল বাঙালির ভাগ্যে জুটলাে ১২৬ কোটি টাকা। (Dawn, Jan, 9, 1956)।
পাকিস্তান শিল্প-বিকাশ কর্পোরেশন যে-সব মূলশিল্প গড়ে তুলছিল সেগুলাের সবই হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, শিল্প-বিকাশমূলক আমদানীর ৮০ শতাংশই যাচ্ছিল পশ্চিম অঞ্চলে। পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজির মালিকানায় পূর্বাঞ্চলে যে পাটকলগুলাে তৈরি হয়, তাদের মালিকদেরও ছিল একই লক্ষ্য-স্বর্ণতন্তুজ পণ্য বিশ্বের বাজারে বিক্রয় করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প গড়ে তােলা। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ১৫৫টি নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে পূর্ববঙ্গে। মােট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩৫ থেকে ৪৯০তে। এ সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাে ১লক্ষ ৩০হাজার শ্রমিক (পাটশিল্পে, ৪৪০০০, বস্ত্রশিল্প ১৬, ০০০, চর্মাশিল্পে ১০,০০০, চা শিল্পে ২৪,৬০০)। এই কলকারখানা-বাগিচাগুলাের অধিকাংশেরই মালিক পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি।
কৃষি বিকাশেও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ্যে সিংহভাগ জোটে। পশ্চিম পাকিস্তানে গেল ৭৯.৬ শতাংশ বা প্রায় সাতানব্বই কোটি টাকার মতাে। কেন্দ্রীয় ঋণেরও ৮৩.৯ শতাংশ জুটলাে পশ্চিমের ভাগ্যে। বাকি যেটুকু জুটল পূর্বাংশের কপালে, বরাদ্দকৃত সেই অর্থেরও ৪৯.৯ শতাংশ মাত্র ব্যয় হলাে। অবশ্য পশ্চিম বললেও সবটাই পুরাে পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ব্যয় হবার নয়। অধিকাংশটাই ব্যয়িত হলাে পাঞ্জাবে ও করাচীতে। পাঞ্জাবী খানদানী ভূম্যধিকারী পরিবারগুলাে তাদের সঞ্চিত মূলধন শিল্পে খাটাচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিবিকাশের জন্য ২২কোটি ৬৫লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এর মধ্যে সিন্ধুপ্রদেশ মাত্র ৬০লক্ষ টাকা, আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ৪কোটি ৫২লক্ষ টাকা পায়। বালুচিস্তানের জন্য একটি কানাকড়িও ধার্য করা হয়নি। বাদবাকি টাকার সবটাই ব্যয়িত হয় পাঞ্জাবের কৃষি-বিকাশের জন্য। পাঞ্জাবের হাজার হাজার একর জমির মালিক ছিল বড় বড় সামন্ততন্ত্রী পরিবার। তাদের প্রয়ােজনেই এ-টাকা বরাদ্দকৃত হলাে।
৯৮
তাছাড়া ছিল আমলাতান্ত্রিক চাপ। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অধিকাংশই ছিল পাঞ্জাবী। তারা বাঙালিদের মানুষ বলেই গণ্য করত না। পূর্ববঙ্গে কাজ করতে আসাটাকে তারা উনিশ শতক বা বিশ শতকের গােড়ার দিকে কৃষ্ণ আফ্রিকায় সাদা চামড়া আমলাদের কাজ করার মতাে মনে করত। (ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, জানুয়ারি, ৭, ৮, ১০, ১৯৫৫)। জনাব আতাউর রহমান কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বলেছিলেন, “…. মুসলিম লীগের নেতারা মনে করেন আমরা হলাম বিজিত জাতি এবং তারা হলেন বিজয়ী জাতি।” (K.Callard, Pakistain:A Policical Study London 1957, p172-173)।
গােলামের গােলাম বাঙলাদেশ
বাঙলাদেশের আয়তন প্রায় ৫৫,১৪৬ বর্গমাইল। ১৯৬১সালের আদমশুমারী অনুযায়ী প্রতি বর্গমাইলে লােকসংখ্যা ১১০০ জনেরও বেশি। আর, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি বর্গমাইলে লােকসংখ্যা মাত্র ১০০জন। পূর্ববঙ্গে জমি মাথাপিছু বণ্টন করলে দাঁড়ায় মাত্র আধ একরের মতাে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে অনাবাদী জমির পরিমাণ বহুগুণ বেশি। ফলে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার আর্থনীতিক বিকাশ সম্পর্কে যে কমিশন বসান, তার প্রধান সদস্য প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কলিনস ক্লার্ক বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে সেচ-ব্যবস্থা বিকশিত হবার যেমন চমৎকার সম্ভাবনা আছে, তেমনি রয়েছে বিপুল পরিমাণ অনাবাদী জমি। ফলে , পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষির উপরেই ঝোঁক দেবার সুপারিশ করেন তিনি। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে কৃষিযােগ্য জমির অনুপাতে লােকসংখ্যার ঘনত্ব হ্রাস করার জন্য ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের প্রয়ােজনে তিনি পরিকল্পিতভাবে শিল্পবিকাশের সুপারিশ করেন। পূর্ববঙ্গে বিশাল কাঁচামালের উৎস বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতাে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সরকার ঠিক এর উল্টো কাজটিই করলেন। তারা পূর্ববঙ্গে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে, এমনকি কাঁচামাল ও শিল্পদ্রব্য আমদানী করে পশ্চিমাংশকে, বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশকে শিল্পায়িত করে তােলেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষিবিকাশ বিড়ম্বিত হয়, পূর্ববঙ্গের কৃষিবিকাশকে ত্রস্ত রাখা হয়, এবং এই সুপরিশের তিনবছরের মধ্যেই গােটা পাকিস্তান জুড়ে দেখা দেয় তীব্র খাদ্যসঙ্কট।
দেশবিভাগের সময় পাকিস্তানের আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষের শিল্পোৎপাদনের মাত্র চার শতাংশ পড়েছিল। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানে একটি শিল্পনীতি ঘােষিত হয়। তার আগে মােট জাতীয় আয়ের সাড়ে সাত শতাংশ ছিল মাত্র শিল্পজাত আয়। কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের অংশ ছিল ছয় ভাগ। বৃহৎ সংগঠিত শিল্পের উৎপাদন ছিল মাত্র দেড় শতাংশ। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে পাকিস্তানের ৬৫৫টি শিল্পে ৬৪৪কোটি টাকা লগ্নি করা হয়, পূর্বাঞ্চলে মােট লগ্নির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯১ কোটি টাকার কাছাকাছি। সরকারী লগ্নির পরিমাণ ছিল ৮৩ কোটি ২৩ লক্ষ টাকার মতাে। পূর্বাঞ্চলের ভাগ্যে জুটলাে তার থেকে মাত্র চারকোটি টাকা।
বিদেশী পুঁজির শােষণের অবস্থাটা দাঁড়ায় আরও ভয়াবহ। ভারতে যেমন দেশী পুঁজিপতিদের সঙ্গে বিদেশী পুঁজিপতিদের সহযােগিতার চুক্তি করতে হয়, পাকিস্তানের নিয়মটি তেমন নয়। পাকিস্তানে সরাসরি বিদেশী পুঁজি লগ্নি হতে পারে। প্রায় দু হাজার কোটি টাকার বিদেশী ঋণ ও লগ্নিপুঁজি এবং তজ্জাত মুনাফা ও সুদ মিলে পাকিস্তান হয়ে উঠেছে শােষণের একটা চমৎকার মৃগয়াভুমি। বিদেশী পুঁজির মুনাফা, স পরিশােধের খাঁই মেটাতে পূর্বাঞ্চলকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হয়। ১৯৫০সালে বিদেশী ঋণ বাবদ পাকিস্তানের দায় ছিল ৫০ কোটি টাকা, ১৯৬৮ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০০ কোটি টাকা, আর এ টাকার দায় নিতে হয়েছে কামধেনুরূপী পূর্ববঙ্গকে।
১৯৬৩-৬৪ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, পূর্বাঞ্চলের বর্তমান লােকসংখ্যার ৭৬ শতাংশ কৃষিজীবী, ৬% শিল্পউৎপাদনে নিরত, ৮% চাকুরিজীবী ও ১০ শতাংশ অন্যান্য কার্যে রত। ১৯৫১-৬১ সালে কৃষি শ্রমের বদ্ধি ঘটেছে ৩৩৮ শতাংশ। এ-সময় পশ্চিম পাকিস্তানে লােকসংখ্যার ৬০শতাংশ ছিল কষিজীবী, ১৪% শিল্পউৎপাদনে নিরত এবং ২৬ শতাংশ অন্যবিধ নানাকার্যে রত। পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষিবহির্ভূত জনসংখ্যা সেখানে বেড়েছে ৫৫.১ শতাংশ পূর্বাঞ্চলে সেখানে তা বেড়েছে মাত্র ১৬.৭ শতাংশ। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৬৮ শতাংশ পূর্বাঞ্চলের পাটের উপরেই নির্ভরশীল। অথচ পাট চাষের বিকাশ বা পাটচাষীর আয় বাড়াবার কোনাে প্রচেষ্টাই হয়নি। বরং গ্রাম্য ঋণ ও আড়তদারীর মধ্য দিয়ে ব্যাপক সামন্ততান্ত্রিক
৯৯
শোষণ অব্যাহত রেখেছে বৃহৎ ভূস্বামী, মহাজন ও মহাজনকে ঋণদাতা পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যাঙ্কগুলাে। দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গে ৩১,৯০৫ টি সমবায় ঋণদান সংস্থার ২৪,৬৭৫টি লােপ পায়। খাদ্যদ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধি, করবৃদ্ধি এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ভােগ্য পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য—সব মিলিয়ে পূর্ববঙ্গের কৃষককে ঋণগ্রস্ত করে তুলেছে। একমাত্র উত্তর বাঙলাতেই ১৩ লক্ষের বেশি চাষীর উপরে সার্টিফিকেট মামলা রুজু করা হয়। ১৯৭০ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের পুর্বে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ রপ্তানি দ্রব্য উৎপাদন করত। কিন্তু জাতীয় আমদানীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তার ভাগ্যে জুটেছে। বিদেশী সাহায্য ও বিকাশ তহবিলের অর্ধেকের কম অর্থই এ অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ হয়ে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর কেন্দ্রীয় সরকার সর্ববিধ আর্থনীতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করেন। কেন্দ্রীয় আয়ের ৯৫ শতাংশ পশ্চিমাংশই শেষ দিকে ব্যয়িত হয়েছে।
অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে সরকারী দপ্তরের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। দপ্তর গুলাের মাথায় এনে বসানাে হয়েছে পাঞ্জাবী সামন্ততান্ত্রিক প্রবল প্রতাপান্বিত পরিবারগুলাের সন্তানদের। ঐ দপ্তরগুলাের মধ্যে অনেকগুলিই অপ্রয়ােজনীয়। এগুলাে চালাবার জন্য কৃষিকর বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৪৭সালে তিনকোটি টাকা থেকে ১৯৬৫সালে ১৬ কোটি টাকায়। কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষককে আগের চেয়ে প্রাদেশিক সামরিক সরকারের খাই মেটাবার জন্য দশগুণ বেশি কর দিতে হয়েছে।
বিদেশী মালিকানার কথা বাদ দিলে, পাকিস্তানের মােট শিল্পের ৬৬ শতাংশ, বীমা কোম্পানীর ৭৯ শতাংশ এবং ব্যাঙ্কিং কোম্পানির ৮০শতাংশের মালিক মাত্র ২২টি পরিবার। এদের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে একটি পরিবারকেও দেখা যাবে না। মাত্র ১৫টি পরিবার সরকারী ঋণদান সংস্থায় ৮০শতাংশ ঋণ পেয়ে থাকে। করাচী স্টক এক্সচেঞ্জে রেজিস্ট্রি করা ১৮৯ টি কোম্পানীর ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক মাত্র ১৯টি পরিবার। বাকি ২৫শতাংশের মাত্র পাঁচ শতাংশ আছে সাধারণ মানুষের হাতে। ২০টি বড় ব্যবসায়ী ডিরেক্টর ১৫৯টি কোম্পানী মাথায় বসে আছে। ৩৪.৫ শতাংশ শহরের আয় ধনীব্যক্তিদের উপরতলায় দশ শতাংশের কজার মধ্যে রয়ে গেছে। ৫০ শতাংশ শহরের মানুষ মাত্র ২৩.৮ শতাংশ শহরের আয় পেয়ে থাকে। এ-যদি মােট পাকিস্তানের ছবি হয়, পূর্বাঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চাকরি-বাকরির বাজারে বাঙালির অবস্থা আরও খারাপ। পাকিস্তানের উন্নয়ন দপ্তরে নিযুক্ত ১৫২০ জনের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা মাত্র ১৬৬জন; ৯৩জন ক্লাস ওয়ান অফিসারদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা মাত্র সাত;১১৯জন ক্লাস টু গেজেটেড অফিসারের মধ্যে চার জন মাত্র বাঙালি। সৈন্য বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চার শতাংশ মাত্র বাঙালি। পূর্বাঞ্চলে নার্সের সংখ্যা ৬১৯, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪২৯০।
ওপরের পরিসংখ্যানের জঙ্গলে পথ না হারিয়েও এ কথা দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট যে, বিদেশী পুঁজি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে পাকিস্তানের অর্থনীতি আর তারই মাইনর পার্টনার হয়ে ২২-২৩টি বৃহৎ পুঁজিবাদী পরিবার বিদেশী পুঁজিবাদের পথপ্রদর্শক ফেউয়ের কাজ করছে। এই বৃহৎ পুঁজিবাদী পরিবারগুলি সামন্ততান্ত্রিক জোটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমলাতন্ত্র ও সাময়িক শক্তির মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করেছে। বিদেশী পুঁজির গােলামেরা আবার পূর্ববঙ্গের জনগণকে গােলাম বানিয়েছে। দাসের দাস। পূর্ববঙ্গ এখন এই নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের ও শােষণের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লড়াই করছে। বিশ্বের পটপরিবর্তনের বিশাল লড়াইয়ে তারা তাই সার্থক ও অগ্রণী যােদ্ধা।
গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বাঙলাদেশ
এতটা আলােচনায় একটাই লক্ষ্য—আর সেটি হলাে বাঙলাদেশের বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতটি বােঝার প্রচেষ্টা। লেনিনের মন্ত্রীসভার জাতি-বিষয়ক মন্ত্রকের কর্ণধার জে.ভি.স্তালিন-এর জাতি গড়ে ওঠার মূল চাবিকাঠি-মূলক বক্তব্যটি এ প্রসঙ্গে স্মরণে আসছে। তিনি বলেছিলেন, ‘ইতিহাস বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি স্থায়ী জনগােষ্ঠী যখন ভাষা, ভু-খণ্ড, আর্থনীতিক জীবন এবং মানসিক গঠনভঙ্গীর সাযুজ্যের মধ্য দিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সাধারণ অধিকার ভােগ করে থাকে, তখনই গড়ে ওঠে তার জাতি। এই সংজ্ঞাটিতে বাঙলাদেশে বাঙালি জাতিসত্তা’ গঠনের সবগুলাে দিকই বিধৃত হয়ে আছে।
১০০
আমাদের এই আলােচনায় পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে জাতিসত্তার কতখানি প্রকাশ ঘটেছে, সে বিষয়ে বিস্তৃত কিছুই বলা হয়নি। পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে বহু আলােচনা হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে লেনিনের একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে সামন্ততন্ত্রের উপরে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। পণ্য উৎপাদনের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য বুর্জোয়াশ্রেণীকে স্বদেশী বাজার দখল করতেই হয় এবং রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ভূখণ্ড থাকতেই হবে। ভাষা ও তার সাহিত্যকে সংহত করার জন্য সমস্ত বাধা দূর করে যেখানকার জনগণ একটি ভাষাতেই কথা বলে, সেখানেই আছে জাতীয় আন্দোলনের আর্থনীতিক ভিত্তি। মানুষের ভাবের আদান প্রদানের জন্য ভাষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন।… সুতরাং প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনের প্রবণতাই হলাে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন…।..জাতীয় আন্দোলনের ঐতিহাসিক আর্থনীতিক প্রেক্ষিতগুলাে পরীক্ষা করে অবধারিতভাবে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে, জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে বােঝায় বিদেশী জাতীয় অঙ্গ থেকে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গঠন।”
এই বিজয়ের আবার অন্যবিধ তাৎপর্য আছে।
পূর্ববঙ্গে আর্থনীতিক শােষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক আক্রমণ। বাঙলাদেশের জাতীয় জীবনে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে, তাকে গােড়া ধরে নড়িয়ে দেবার জন্য পাকিস্তানী শাসকদের চক্রান্তের শেষ নেই। শাসকচক্র জানে, বাঙালির জাতিসত্তা ভুলিয়ে দিতে পারলে সহজেই ইসলামী তমুদুনের নামে তাদের আরও কিছুদিন শাসন করা যাবে এবং শােষণের ব্যবস্থাটা আরও দুর্মর করা যাবে। তাই আর্থনীতিক শােষণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের উপর নির্মম আক্রমণ করায়, গণতান্ত্রিক জীবনভাবনায় ও লােকায়ণে জারিত বাঙালি জাতি উঠে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে পূর্ববাঙলার বাঙালি জাতির শিকড়সন্ধানী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও নিতান্ত কম নয়।
আমরা আগেই বাঙলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের বিশেষ গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের মূল অন্বেষণ করতে গিয়ে বাঙালি লােকজীবনের সংস্কৃতির উপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ, এমন এক নবজাগরণের ইঙ্গিত সেখানে আমরা পাই, যা কেবল গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শ নয়, এ যুগে সমাজতন্ত্রী উত্তরণের দিক পর্যন্ত তা বিস্তৃত। ইউরােপীয় নবজাগরণের যুগ ছিল বুর্জোয়া মানবিকতা বিকাশের যুগ। এ-যুগে নবজাগরণ যখন বাঙলাদেশের কৃষকের ঘর থেকে উৎসারিত হয়, বাঙলাদেশের নতুন বুদ্ধিজীবী যখন তা ধারণ করেন, তখন সেই গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তি এই সমাজতান্ত্রিক যুগে কখনই বুর্জোয়া মানবিকতার খণ্ডিত অভিব্যক্তি হতে পারে না। আমরা ইতিপূর্বে লক্ষ্য করেছি, বাঙলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে গণতান্ত্রিক মনুষ্যত্ব, যাকে তথাকথিত গ্রাম সমাজ, সেচব্যবস্থা ও বর্ণপ্রথার মধ্যে বিড়ম্বিত করা কোনােকালে নিরঙ্কুশভাবে সম্ভব হয়নি। এই ঐতিহ্যের সামগ্রিক ও পরিপূর্ণ মুক্তি সমাজতন্ত্রের মধ্যেই একমাত্র সম্ভব। আমরা তাই দেখেছি, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার সঙ্কল্প কার্যকর করার জন্য বারংবার কী নিদারুণ জন-অভ্যুত্থান ঘটেছে। রক্তদানের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তর যেন তৈরি হয়ে গেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে বাবুর্চি পর্যন্ত সে-সঙ্কল্পে অনমনীয়। একে আমরা একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও জাতীয় বিপ্লবের রূপ ছাড়া অন্য কোনাে নামে অ করতে পারি?
বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং বাঙলাদেশে বাঙালির ব্যক্তিগত মালিকানায় পুঁজিবিকাশের স্বল্পতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাঙলাদেশ আর কখনই পুঁজিবাদীবিকাশের ও শশাষণের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে না।
স্বাধীন বাঙলাদেশের স্বাভাবিক আর্থনীতিক বিকাশ বুর্জোয়া কায়দায় ঘটাও তাই এখন প্রায় অসম্ভব। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত আকাক্ষা যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে, আর্থনীতিক শােষণ ও অগণতান্ত্রিক শাসন যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দিকে জনগণকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে, গণতান্ত্রিক বিজয়াভিযানের প্রতি সাধারণ মানুষের আপ্রাণ আকুতি সাম্রাজ্যবাদ-একচেটিয়া পুঁজি, সামন্ততন্ত্র আমলা ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে রায় জানিয়েছে, তা এশিয়ায় নতুন মনুষ্যত্বের জন্ম দেবে। অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির যে অর্ধসমাপ্ত নবজাগরণের কথা আমরা এই প্রবন্ধের প্রথমে বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছি, অন্যতর
১০১
পরিপ্রেক্ষিতে তাকেও সফল সমাপ্তির দিকে অগ্রসর করে দেবে। মােটকথা, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে তা যেমন আপােষহীনভাবে অ-মুলধনতান্ত্রিক বিকাশের ধারা অর্গলমুক্ত করবে, তেমনি তা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যে রূপান্তরিত করবে। নতুন বাঙালি জাতির যে মহৎ রূপটি নানা বাধা ও আবরণের মধ্যে ঢাকা ছিল, তার স্বরূপটি এইভাবে আমাদের চোখে পড়ছে। আমরা বাঙলাদেশের বাঙালি জাতির এই নব-জাগরণকে তাই আজ স্বাগত সম্বর্ধনা জানাই।
পরিচয়
বাঙলাদেশ সংখ্যা, ১৩৭৭-৭৮