বাঙলাদেশ: ভাবী বাঙালির আবির্ভাব
গােপাল হালদার
১৯৪৭এ দেশ বিভাগের পরে অনিবার্যরূপেই একটা জিজ্ঞাসা আমাকে পেয়ে বসেছিল, কী করে সম্ভব হলাে বাঙালির এই হারিরি’? বা আমার ধারণা তা বলবার জন্যই লিখতে বসেছিলাম বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা। লেখা শেষ হয়নি বিশেষ করে যেখানে এসে দুর্ভাগ্যের সূচনা- ঊনবিংশ শতাব্দী সেখানে পৌঁছতে-পৌঁছতেই দ্বিতীয় ভাগ শেষ হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা সাহিত্য থেকে বাঙালি মুসলমানদের স্বেচ্ছা নির্বাসন কেন, তার ফল কী? বিশদ করে তা বলবার সমর্থ আয়ুতে আর কুলােবে কিনা জানি না, কিন্তু তার কথা বলবার সুযােগ আর উপেক্ষা করলাম না। দিল্লীতে ১৯৭১ এর গত ১০ই এপ্রিলের বাঙলা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়ােজিত সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের আলােচনাসভার সভাপতির মৌখিক ভাষণে সে-চেষ্টা করেছি। সে-সভায় সমসাময়িক বাঙলা সাহিত্যের বিষয়ে চমৎকার আলােচনা করেছিলেন শ্রীযুক্ত নীহাররঞ্জন রায়, শ্রীযুক্ত আশাপূর্ণা দেবী, শ্রীশান্তি সিংহরায়, আমার বক্তব্য কিন্তু সমসাময়িকে’র সেরূপ সমীক্ষা ও পরীক্ষা নয়, তার পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধান। ইতি ১৭/৪/৭১ইং লেখক)
সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য একটা বিশেষ বিবর্তনের সম্ভাবনায় এসে দাঁড়াচ্ছে কারণ ভাবী বাঙলার জন্মবেদনায় আজকের বাঙলা অস্থির। নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষায় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সােনার বাঙলার জন্য অপেক্ষমান। গােড়ার একটা কথা, সমসাময়িক কাল বলতে আমি শুধু এই ১৯৭০-৭১ এর বা ওরূপ
৮৪
দু-একটা বৎসর বােঝাতে চাই না। অবশ্য এ-যুগে সভ্যতার গতিবেগ দিনের পর দিন খরতর হয়ে উঠছে। তাই মানুষ আর দীর্ঘ করে যুগ গণনা করে না। বাঙলা সাহিত্যে প্রায়ই পঞ্চাশের দশক ষাটের দশক এরূপ দশক হিসাবে সাহিত্য সমীক্ষাও এখন একটা নিয়ম। সে-হিসাবে সমসাময়িক বলতে ষাটের দশকই বােঝানাে উচিত। সত্তরের দশক মাতৃগর্ভে না থেকে এখনাে মাতৃক্রোড়ে। এরূপ গণনায় সাময়িকতার সম্মান রক্ষা হতে পারে। সমতার অর্থ সঙ্কীর্ণ হওয়া অনিবার্য। সাহিত্যের দিক থেকে বরং আমরা বলতে পারি-রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের (১৯৪১) পরেই সমসাময়িক কালের প্রারম্ভ। অথবা, ১৯৪৭ এ স্বাধীনতা লাভের থেকেই কালান্তর; আর বাঙলাদেশের পক্ষে বাঙলা বিভাগেই সেই কালান্তর অর্থাৎ সঙ্কটকাল, কালগ্রাসের বিভীষিকা। অবশ্য কেউ কেউ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত কালটাকে ‘সাম্প্রতিক বলতে পারেন, আর ১৯৬০এর পরেকার বছরগুলিকে বলতে পারেন, সমসাময়িক। আপত্তি করি না। তবে ১৯৪৭এ যে একটা কালান্তর তা এই ১৯৭১এ পৌঁছে আমাদের কাছে স্পষ্ট। কথাটা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে যদি আমরা সমগ্রভাবে বাঙলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে চেষ্টা করি তাহলেই ১৯৭০-৭১এর বাঙালি জীবনের এই মুহুর্তের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়, সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত রূপটা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।
অতীতের উত্তরাধিকার
সে দৃষ্টিতে রামমােহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কালটাকে আমরা বলতে পারি আধুনিক যুগ’, তার পূর্বেকার যুগটাকে ‘মধ্যযুগ’ অন্তত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত যার বিস্তার। পিছনে অবশ্য ছিল চর্যাপদের কাল বা প্রাচীন বাঙলা সাহিত্য। এই প্রেক্ষাপটও অবশ্য চূড়ান্ত নয়, কারণ বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের পিছনেও তাে ছিল ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতির হাজার দুই বৎসর। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তাে সেউত্তরাধিকার বঞ্চিত নয়—ভারতের আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যের থেকে বাঙলায় এ-সম্পদ বেশি সঞ্চিত। সমসাময়িক বাঙলা সাহিত্য সে-বিষয়ে উৎসাহী না হতে পারে, কিন্তু সে-দান অস্বীকার করাও তার পক্ষে অসম্ভব। রামমােহন থেকে রবীন্দ্রনাথে এই উত্তরাধিকার আবার নায়িত হয়েছে।
বাঙলা সাহিত্য আরও যে বিষয় গৌরবে পরিপুষ্ট তা মনে রাখাও এজন্য প্রয়ােজনীয়। বাঙলা সাহিত্যের প্রধান বিষয় কী কী?—একটা প্রধান বিষয় তাে দেখলাম—প্রাচীন ভারতীয় বিষয়; সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তা বাঙলা ভাষায় এসে পৌঁছেছে বেদ, উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত জাতক কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন প্রভৃতি অজস্র গ্রন্থের সূত্রে একটা বৃহৎ ঐতিহ্য প্রবাহিত হয়ে চলেছিল সমগ্র ভারতেই তার বিস্তার কখনাে ক্ষীণ কখনাে বিপুল, কিন্তু একেবারে লুপ্ত হতে পারেনি। এ-একটা সর্বভারতীয় ঐতিহ্য প্রাচীন ভারতীয় বিষয়। বিশেষ করে রামায়ণ’ ভারত মহাভারত ও ভাগবত মুক্তি দিল এক অফুরন্ত উৎস। দ্বিতীয় বিষয় হলাে মধ্যযুগের দেশজ বিষয়-অঞ্চলে-অঞ্চলে তা বিভিন্ন হলেও ভারতীয় ভূমিতেই সকল কথারই উদ্ভব। আমাদের মঙ্গল কাব্যের কাহিনীগুলাে তার একটা অংশ, মনসা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি। এবং অন্যঅংশ শ্রীচৈতন্য। কবির, নানক, শঙ্করদেব, নামদেব প্রভৃতি মধ্যযুগের সাধকদের প্রেরণায় উদ্ভূত ভক্তি সাহিত্য প্রাচীন ভারতীয় বিষয়ের সঙ্গে অন্তরে-বাইরে তার গভীর যােগ, অঞ্চল বিশেষে তবু তার বৈশিষ্ট্যও আছে, তাও স্পষ্ট। বাঙলাদেশের দিক থেকে এই ‘দেশজ বিষয় হচ্ছে একদিকে তাই মঙ্গলকাব্য অন্যদিকে চৈতন্য সাহিত্য মধ্যযুগ পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের দুটি প্রধান বিষয়ই ভারতীয়। কিন্তু মধ্যযুগেই তৃতীয় একটা বহিভারতীয় বিষয় এসে হানা দিয়েছিল—তাও মধ্যযুগীয় ধর্মে ও ধারণায়। বাংলা সাহিত্যে সে আপনার স্থান করে নিতে পারল মধ্যযুগের শেষপর্বে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তুর্কি, পাঠান, মােগল বিজয়ে ইসলামের ধ্বজা উড়িয়ে এল এক এক নতুন বিষয় যা নিছক আরবের নয়, বলা যেতে পারে প্রধানত ফারসি, এবং ফারসিতে চোয়ানাে আরব্য ঐতিহ্য, এক কথায় বাঙলা সাহিত্যের এই তৃতীয় বিষয়কে বলা যায় ‘ফারসি-আরব্য বিষয়’-একদিকে নানা রম্য কাহিনী, জাগতিক প্রণয় কথা, অন্যদিকে সুফী আধ্যাত্মিক কথা যার অন্তর্গত। এই তৃতীয় বিষয়টা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে আপনার হতে সময় নিয়েছে প্রায় চার শ বৎসর। যখন তা আর বাইরের রইল না তখন বাঙালি জীবনে ও সমাজে ফারসি-আরব্য কায়দা-কানুনের একটা চাপ সহজ হয়েছে হিন্দু-মুসলমানের
৮৫
শিক্ষিত অংশ তখন ফারসি ঐতিহ্যকে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে একরকমে মানিয়ে নিয়েছে। আলাওল থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত আমরা সপ্তদশের শেষার্ধ ও অষ্টাদশ শতকের বাঙলায় পাই তার প্রমাণ—ভাষায়ও যে ফারসি-আরবী কতকটা তখন গৃহীত, তা তখনকার বাঙলা চিঠিপত্রের ভাষা দেখলে বােঝা যায়। আসলে, হিন্দু-মুসলমান সকল বাঙালির একটা মিলিত জীবন ও ভাবনা ১৮শ শতকে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তা ঠিক স্থির ভিত্তিতে দৃঢ় হবার আগেই এসে গেল ব্রিটিশ শাসন। সঙ্গে সঙ্গে ছেদ পড়ল মধ্যযুগের জীবনধারায় আর ছেদ পড়ল সেই অষ্টাদশ শতকের নাতিপুষ্ট মিলিত জাতীয় ভাবনায়। তাতে করে ইংরেজ শাসনে ফারসিআরব্য বিষয়টা বাঙলা সাহিত্যে ক্ষীণ হয়ে রইল।
অবশ্য বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হলাে ব্রিটিশ শাসনে। আর তাতে অনিবার্য হলাে চতুর্থ একটি বিষয়ের বিপ্লবী আবির্ভাবে—এটি হলাে আধুনিক যুগের বিষয়—এটিও বহির্ভারতীয়, তবে মধ্যযুগীয়ও নয় বরং দুর্জয় এবং অভিনব। আধুনিক যুগ যে বিপ্লবী আবির্ভাব তা না মেনে উপায় নেই। তার কারণ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা যার সন্ধান পেলাম তাকে বলা যায় আধুনিক যুগ ইংরেজি শাসন, ইংরেজি ভাষা ইংরেজি ভাষা বাহন হলাে তখনকার ১৮শ-১৯শ শতাব্দীর উন্নততম বুজোয়া সংস্কৃতির যে সংস্কৃতির মূল বাণী যুক্তিবাদিতা, বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা, জাতীয় স্বাধীনতা, মানুষের অধিকার; যে সংস্কৃতির মধ্যে একদিকে মিশেছিল গ্রীক-লাতিন-হিব্রু চিন্তার ধারা, অন্যদিকে যার সম্পদ ইউরােপীয় ‘রেনাইসেন্স, ইউরােপীয় রিফর্মেশন, ইউরােপীয় ফরাসী বিপ্লবের সম্মিলিত সামাজিক রাজনৈতিক দান। ফারসি-আরব্য বিষয় বা সংস্কৃতি কিন্তু এরূপ বৈপ্লবিক শক্তির আধার ছিল না—তা মধ্যযুগেরই জিনিস। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা মধ্যযুগের ভাবলােক ছাড়িয়ে আধুনিক যুগের ভাবলােকে উত্তীর্ণ হতে চললাম, অবশ্য জীবনযাত্রায় তখনাে আমরা পরাধীন। সেই বন্ধনে আমাদের পা তখনাে শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাই বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ হতে পারব কেন? সেই বিক্ষোভে মানসিক ক্ষেত্রে আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে আধুনিক ভাবলােকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়তে চাইলাম। সম্পূর্ণ যে পারলাম তা নয় তথাপি আমাদের ভাষা ও সাহিত্যে বিপুলভাবে লাভ করল একটা নতুন বিষয়, যাকে বলেছি আধুনিক কালের বিষয়, নতুন মন্ত্র বিজ্ঞানসম্মত যুক্তির মুক্তি, জাতীয় মুক্তি এবং মানুষের অধিকার আর পরােক্ষ ভাবে তাতেই আধুনিক যুগের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য যখন বিকশিত হতে লাগল তখন তাতে প্রাচীন ভারতীয় বিষয়, মধ্যযুগের ‘দেশজ বিষয় এবং ‘ফারসী আরব্য বিষয় সবই রূপান্তরিত হয়ে গেল ইংরেজি শিক্ষার আধুনিক, ভাবনা ধারণার সংযােগে। বিশেষ করে আবার ফারসী-আরব্য বিষয়টা যা সবল হতে পারেনি তা প্রায় চাপাই পড়ে যেতে লাগল। কেন, তা বুঝতে হলে ঊনবিংশ শতকের বাঙালি জাগরণের (রিনাইসেন্সের) স্বরূপটা একটু মনে রাখতে হয়।
খর্বিত জাগরণ
বাঙলার জাগরণ ঘটল বাইরের থেকে আঘাতে ইংরেজি শাসন ও সভ্যতার সংঘাতে, দেশের ভেতর থেকে সহজভাবে এ-স্রোত উদ্ভূত হয়নি হতাে কিনা সে ভিন্ন বিতর্ক। প্রথমত ঘটল আমাদের পরাধীন অবস্থায় রাজনৈতিক পরাধীনতার সঙ্গে তাতে ছিল দেশের অর্থনৈতিক পরাধীনতার দুর্যোগ। তাই বাস্তব ক্ষেত্রে বাঙালির উদ্যোগ ছিল ব্যাহত, বৈষয়িক প্রয়াসে, শিল্পোদ্যোগে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, এমনকি বৈজ্ঞানিক চিন্তায় চেষ্টায়ও নিরুদ্যম সংরুদ্ধ। ঠিক সে-জন্যই এই জাগরণকালীন জীবনােন্মাদনা চেয়েছে ভাবলােকে সুতীব্র প্রকাশ, অন্তর্মুখী চিন্তায়-ভাবনায় (subjective) লাভ করেছে প্রখর গতি, শিল্পে, সাহিত্যে তীব্রতা ও সুক্ষ্মতা ভাবাতিশয্য কল্পনার প্রবণতা। দ্বিতীয়ত এই নবজীবনের জোয়ার একটা সঙ্কীর্ণ সমাজ চক্রের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে—যাকে বলা যায় ‘ভদ্রলােক শ্রেণী, বাঙালি মধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত গােষ্ঠী, প্রধানত হিন্দু উচ্চবর্ণের মধ্যেই যারা আবার সীমাবদ্ধ। … এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করে দিয়ে তাদের আত্মপ্রসারের পথ করে দিয়েছিল। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি শিক্ষা বিশেষ করে এই ভদ্রলােক শ্ৰেণীকে ইংরেজের শাসন-চক্রে সুযােগ দান করে.কিন্তু অন্যদিকে দেশের ও সমাজের আপামর সাধারণের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই গণ্ডী ভেঙে তাই বাঙলাভাষী ও বাঙলা শিক্ষিতদের নিকট বাঙলা রিনাইসেন্সের ধ্যান-ধারণাকে দ্রলােকেরা পৌছতে পারেনি। এমনকি শিক্ষিত গােষ্ঠীর ধর্ম ও
৮৬
সমাজ-সংস্কার আন্দোলনও ভদ্রলােকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে শাসকগােষ্ঠী চায়নি বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনা মতাে বঙ্গ বিদ্যালয়, বা বাঙলা ভাষায় শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার করে সেই আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান (Western science and knowledge) দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবর্তিত করতে; শ্ৰেণী স্বার্থে যে-শতাব্দীর শিক্ষিত ভদ্রলােকরাও চাননি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় বা আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান দেশের ভাষার খাতে ঢেলে দিতে, সেই কৌশলে স্বদেশের সাধারণ হিন্দুমুসলমানকে জাগ্রত করতে, দ্রলােক বা শিক্ষিত শ্রেণীর নতুন যুগের উদ্যোগী ভাবনায় নিজেদের জনগণকে সহযােগী করে দিতে। এমনকি, যা এই শতাব্দীর ভদ্রলােক শ্রেণীর প্রধান দুই কীর্তি বাঙালির স্বাধীনতার সাধনা ও বাঙালির সাহিত্য সাধনা—তাও এই জনসমাজের থেকে তাই প্রাণরস আহরণ করতে পারেনি। সেই ‘ভদ্রলােকের জাগরণ’ অনেকাংশে একদিকে দেশের জনশক্তির থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাদেশিকতা (national movement with weak democratic content) হয়ে গেল এবং অন্যদিকে দেশের মাটির সঙ্গে ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক খুঁজে না পেয়ে হয়ে উঠল জন-জীবনের প্রাণ-সম্পদে বঞ্চিত এক ভাবকল্পনায় সমৃদ্ধ, কিন্তু বহুলাংশে খর্বিত জাগরণ ‘ভদ্রলােকের সংস্কৃতি। তা সমগ্র বাঙালির নয়। একাংশের প্রকাশ এরই অনিবার্য বিকৃতি একদিকে হিন্দু স্বাজাত্য’ অন্যদিকে বাবু কালচার’।
বাঙালি মুসলমানের বিভ্রান্তি
অবশ্য, আরেকটা বিষম দুর্বিপাকের কথাও এই সূত্রেই স্মরণ না করলে এই বিকৃতির অন্য একটা কারণও অনুল্লেখিত থাকে। তা হচ্ছে মুসলমান ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের সাধারণভাবে উনবিংশ শতাব্দীতে যুগধর্মের প্রতি বিমুখতা। এই শতাব্দীতে হিন্দু ‘দ্রলােকের অভ্যুদয়’ যেমন ঘটছিল একদিকে আধুনিকতা সম্বন্ধে সচেতনতা অন্যদিকে তখনি জুটেছিল মুসলমান বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর (ফারসি-আরবী শিক্ষিত কাজী আমলা প্রভৃতি) দুর্ভাগ্য। ইংরাজ শাসন এলে হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণীর (ফারসি ও সংস্কৃত শিক্ষিত মসীজীবি) পক্ষে জীবিকার দায়ে ফারসির মতােই ইংরেজি গ্রহণে বাধা হয়নি। কিন্তু রাজ্যাধিকার হারা বিক্ষুব্ধ মুসলমান শিক্ষিতদের পক্ষে সেই পালাবদল, সারা’র ভাষা ও শিক্ষা-দিক্ষা গ্রহণ ছিল স্বভাবতই ঘৃণার্হ। তাহারাম হয়েও উঠল সাবেক কারণে, অচিরেই। কেন মুসলমানের এই রাজ্যচ্যুতি?’-এ প্রশ্ন নিয়ে যে-মুসলমান নেতারা সেদিন ভারতে বসেছিলেন তাদের পক্ষে মনে হলাে ইসলামের বিশুদ্ধতা থেকে বিচ্যুতিই মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের কারণ। অতএব উদ্ধারের উপায় বিশুদ্ধ ইসলামে পুনঃপ্রবর্তন। এই ধারণাই নৰােদ্বুদ্ধ ওহাবী-নীতিই মনে হলাে মুসলমানের আত্মসংগঠনের একমাত্র পথ। তার অর্থ আধুনিক যুগকে অস্বীকার করে পঞ্চম-সপ্তম শতকে আরব্য ইসলাম-এ পুনঃপ্রবর্তন। ভারতের তথা বাঙলাদেশের বুকে স্বাভাবিকভাবে যে ইসলাম বিকশিত হয়েছে তাকেও মনে হলাে ইসলামের নীতি-লঙ্ঘন ভারতের ও বাঙলাদেশের দুয়ারে যখন আধুনিক যুগের ডাক এসে পৌঁছেছে হিন্দু শিক্ষিতরা তাতে জাগ্রত হয়েছেন, মুসলমান শিক্ষিতরা তখন তার প্রতি মুখ ফিরিয়ে দূরে বসে রইল। (এমনতর বিশুদ্ধ আর্য গরিমার নামেই উনবিংশ শতাব্দীর রিনাইসেন্স অনেকটা হিন্দু পুনর্জীবনে’ Hindu Revival এ পরিণত হবার হাস্যকর চেষ্টা করেছিল, তাতেই হিন্দু স্বাজাত্যও দেখা দিয়েছিল।) বাঙলাদেশে এই ওহাবি আন্দোলনের যথেষ্ট বিস্তার ঘটেছিল তিতুমীর তারই এক সংগ্রামী মুখপাত্র তার সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতারও তাই মূল প্রেরণা। সাধারণভাবে মুসলমান সমাজ বিশেষ করে পূর্ববাংলার মুসলমানগণ আসলে ঐ নসারার প্রতি বিদ্বেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর দুইতৃতীয়াংশ কাল ধরে ইংরেজি শিক্ষা বা আধুনিক যুগের শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনযাত্রার প্রতি বিমুখ হয়ে থাকে। সেই প্রভাবেই নিজেদের আরব পারস্যের ঐতিহ্যের বাহক হলেও ক্ষুব্ধ অভিমান পােষণ করে, এবং আধুনিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হিন্দু ভদ্রলােকদের পক্ষে দূরতর হয়ে যায়, বরং হিন্দু শিক্ষিতের চক্ষে বিদেশীয়’ বিজাতীয় (?) যবন’ সম্প্রদায় হয়ে ওঠে। কারণ আধুনিক শিক্ষিত হিন্দু ঠিক এই শতাব্দীতেই পুনরাধিকার করে প্রাচীন (অর্থাৎ হিন্দু ভারতের) মহিমা। বাঙলায় অনুবাদও প্রবর্তন করতে থাকে বৈদিক, বৌদ্ধ, পৌরাণিক হিন্দুশাস্ত্র। মূঢ় মােহে মেকস্মূলর প্রভৃতির সার্টিফিকেট পেয়ে ‘আর্যামিতে নতুন করে দীক্ষিত হয়ে ওঠে এবং ইংরেজিতে নতুন-শেখা ইতিহাসের পাঠে সুলতান মামুদ থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত সকল মুসলমান শাসকদেরই এক সূত্রে গেঁথে স্থির করে বসে মুসলমান শাসকমাত্রই ভারতের স্বাধীনতার শত্রু’ ‘অত্যাচারী
৮৭
যবন’। এক কথায় বিপরীতমুখী হয়ে উঠতে থাকে দুই ধর্মের বাঙালি শিক্ষিতদের দৃষ্টি, এমনকি, শিক্ষিতদের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্কে ধারণা সন্দেহের ও সংশয়ের হয়ে ওঠে তাই উনবিংশ শতকের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের নব-আয়ােজনে আধুনিক বুদ্ধির হিন্দু ভদ্রলােক যতই এগিয়ে গেল তার কাছে সেই ‘ফারসি-আরবী বিষয় ততই বিজাতীয় মনে হলাে, অন্যদিকে, আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় বিমুখ মুসলমান শিক্ষিতরাও বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের সেই আধুনিক আয়ােজনে (নিজেদের আধুনিক দৃষ্টির অভাবে) যােগদান করতে অসমর্থ হলাে—ভাবল বাঙলা-চর্চা ও ভারত-চর্চা থেকে ফারসি-চর্চা বুঝি তাদের বেশি বাঞ্ছনীয়। তাই উনবিংশ শতকে মুসলমান বাঙালি শিক্ষিতরা আলাওল দৌলৎ কাজীদের মতাে আর সৃষ্টি ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে পারল না বরং বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি কতকটা উদাসীন হয়ে উঠল। অন্তত পঞ্চাশ বৎসর পিছনে পড়ে গেল আধুনিক যুগের হিসাবে মুসলমান বাঙালি।
যখন সত্যই মুসলমান বাঙালি তার বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠল তখন বিংশ শতাব্দী সমাগত। তার অনেক পূর্বেই বাঙালি হিন্দু ভদ্রলােকরা অর্থনৈতিক জীবনে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত তারাই জমির মালিক মহাজন তালুকদার; তারাই ১৮৩৮ এর পর থেকে সরকারী চাকরিতে সাহেবদের আজ্ঞাবহ আমলা-মণ্ডল বেসরকারী নানা জীবিকার উকিল, ডাক্তার, মাস্টার হিসাবে একছত্রাধিকারী। আবার, এই কয়েক দশকে সেই ভদ্রলােকদের বংশবৃদ্ধি ঘটেছে, শিক্ষার বিস্তারে সংখ্যাবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দেখা দিয়েছে এসব শিক্ষা, জীবিকা ক্ষেত্রে ভিড়। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের সে-ক্ষেত্রে আবির্ভাবও তাই দ্রলােকের কায়েমী স্বার্থের (vested interest) পক্ষে ভয়ঙ্কর কথা। বলা বাহুল্য, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের থেকেই এই বৈষম্যের বিস্তার, আর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই তার তাণ্ডবের আরম্ভ। বঙ্গভঙ্গের যুগ থেকেই তাই স্পষ্ট এই বাঙালির অন্তঃপ্রতিদ্বন্দ্বিতা, চাকরির কাড়াকাড়ি, পর্যায়ে পর্যায়ে তা হয়ে উঠল হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, বিচ্ছেদ, বিদ্বেষ, বিরােধ, দাঙ্গা, সংহারলীলা এবং শেষ পর্যন্ত বঙ্গ-বিভাগ (১৯৪৭)। তুর্কী, আরব, ইরান প্রভৃতি পৃথিবীর মুসলমান দেশে স্বাভাবিক দেশপ্রীতির সঙ্গে বহির্জগতের মুসলমান প্রীতির সামঞ্জস্য যখন সহজে ঘটেছে, বাঙলা ও ভারতে ঠিক তখনই মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রীতির কাছে এ-যুগীয় দেশপ্রীতির সংঘর্ষ ঘটল, -তারই একটা সংক্ষিপ্ততম হিসাব আমরা এখানে গ্রহণ করলাম। এ-সংঘর্ষের আরও অনেক ছােটবড় কারণ এ-হিসাবে বাদ দিতে বাধ্য হলাম। মূলত এই কথাটাই আমাদের স্মরণীয় উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মুসলমান বাঙালি ভিতরের বাহিরের নানা সংঘাতে না পেয়েছে আধুনিকতার সুস্থ চেতনা রিনাইসেন্স, রিফর্মেশন ফরাসী বিদ্রোহের সম্মিলিত দান, সেই জীবনবােধ, সমাজবােধ, না পেরেছে মুসলমান বাঙালিকে মহাযুগীয় অবস্থা ছাড়িয়ে আধুনিক ভাবনায় দীক্ষিত করতে। ফলে তাদের স্বদেশেও তাদের দান থেকে বঞ্চিত হয়েছে, স্ব-ভাষা ও স্ব-সাহিত্যকেও তারা ওভাবে বঞ্চিত করেছে। আর তাতে আপনাকেই করেছে মুসলমান বাঙালি সর্বাধিক বঞ্চিত। সে বঞ্চনা শেষ করতেই ওয়াজিদ আলী, নজরুল ইসলাম প্রমুখেরা আধুনিক যুগের প্রবক্তারাই প্রথম অগ্রসর হন। কিন্তু যুগের দুর্যোগ তখন ঘনায়িত, ওয়াজিদ আলি, নজরুল প্রভৃতির শ্রেষ্ঠ দানও তখন বাঙালি মুসলমান এগিয়ে এসে গ্রহণ করতে পারেননি। আজ তাই বাঙলা ভাষা ও বাঙলা সাহিত্য ১৯৪৭ পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালির সুস্থ, প্রাণবন্ত ভাবনা ও চেতনা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। বাঙলা ভাষার ও সাহিত্যের ইতিহাসও থাকে খর্বিত।
ভাষা আন্দোলন ও সার্বিক জাগরণ
১৯৪৭ এ সেই বঞ্চনার বলি হতে না হতেই বাঙালি মুসলমান ১৯৪৮ এ চীৎকার করে ঘােষণা করলে-না, না,
না , কায়দে আজমের হুকুমেও সে আত্মবঞ্চনার বলি হবে না বাঙালি মুসলমান। বাঙলাই তার মাতৃভাষা। তারপর, ১৯৫২এর ২১ ফেব্রুয়ারি এই দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালির আত্ম-অভ্যুদয়ের সূচনা। আর সেদিন থেকে বলতে পারি-‘সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের’আত্ম-আবিষ্কারের প্রারম্ভ। খণ্ডিত, স্থবিত বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের স্থলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের পূর্ণতার সাধনা সেদিন থেকে সমারব্ধ হয়েছে, আজ বাঙলা দেশের প্রতিষ্ঠায় তা অপ্রতিরােধ্য হতে চলেছে—এই কথাটি আজ আমাদের প্রথম ও প্রধান উপলব্ধ সত্য। বাঙলাদেশ’অর্থ ভাবী বাঙলার আবির্ভাব বাঙালির পরিপূর্ণ প্রকাশের উদ্যোগ খর্বিত বাঙালির নয়, সমগ্র বাঙালি জীবনের বিকাশ। সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের হিসাব নিতে হলে আজ তাই
৮৮
পশ্চিমবঙ্গের বাঙলা সাহিত্যের হিসাব নেওয়া হয়ে ওঠে গৌণ সৃষ্টিতে বা পরিমাণে তা তুচ্ছ নয়, কিন্তু সম্ভাবনার দিক থেকে তা গৌণ। ভাবীকালের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশই মুখ্য। কারণ ভাবীকাল ওই দুইতৃতীয়াংশ বাঙালিরই হাতে পাচ্ছে প্রাণ, শুধু সংখ্যার জন্য নয়, বাঙলাদেশের সম্ভাবনা উদ্ভাসিত তার জীবন উন্মাদনায়, জাগরণ দীপ্তিতে বৈপ্লবিক অগ্নিপরীক্ষায় বিচ্ছুরিত প্রাণসম্পদে—জীবনে জীবনযােগে। অবশ্য সংখ্যাও স্মরণীয়।
একবার আমরা যেন মনে রাখি-বাঙলাদেশ’ আন্দোলনের প্রাণভিত্তি কী—১৯৫২এর ভাষা আন্দোলন। এই বিষয়টা বিশেষ তাৎপর্যময়। অনেক দেশেতে জাতীয় আন্দোলনই ভাষা ও সাহিত্য আন্দোলনকে আশ্রয় করে বিকাশ লাভ করেছে দেখা যায়। ভাষা জনসমাজের আত্মীয়তার প্রধান বন্ধন, আত্মীয়তাবোেধ জাতিসত্তার প্রাণমূল, আর ভাষা ও সাহিত্যেই জাতিসত্তার প্রাণ স্বরূপ। পূর্ববাঙলায়ও তারই প্রাধান্য দেখলাম। গভীরতর তার তাৎপর্য বাঙালি মাত্রেরই পক্ষে। বাঙলার উনবিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাহিত্য-সাধনার মধ্যে ছিল অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক একই জাতীয় আত্মপ্রকাশের দুই পিঠ সাহিত্যে জাতির আত্মপরিচয়, স্বাধীনতার জাতির আত্ম-প্রতিষ্ঠা। সেদিনের রিনাইসেন্সে দুএরই অঙ্কুর ছিল। তাইতাে উনবিংশ শতাব্দীর সেই জাগরণ খর্বিত জাগরণ হলেও মিথ্যা নয় সে জাগরণ কিন্তু সে রিনাইসেন্স যে শত হলেও খর্বিত রিনাইসেন্স, তাও বাঙালি ভদ্রলােকের আত্মপ্রকাশ। তারই প্রতিক্রিয়ায় বিংশ শতকের প্রথম পাদে বাঙালি শিক্ষিত মুসলমান চেয়েছিল তার সঙ্কীর্ণ আত্মপ্রকাশের সুযােগ-বাবু কালচারের মতােই মিঞা কালচার’। কিন্তু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকে অবলম্বন করে পূর্ববাঙলার যে রিনাইসেন্স (বা ‘জাগরণ’) ঘটল তা কোনাে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতের আন্দোলন নয়, শ্রেণী বিশেষের আত্মস্বার্থের সিদ্ধলাভ তার উদ্দেশ্য নয়।-এ সার্বিক জাগরণ-সর্বাঙ্গীন, সার্বজনীন’।
প্রথমত, মুসলমান সমাজে, মুসলমান বাঙালির মধ্যে অমন জাতি-ও-বিত্তে পাকা করা ভদ্রলােক গােষ্ঠী পাকাপােক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। পূর্ববাঙলায় শিক্ষিতরা সেরূপ শ্রেণীবদ্ধ হবার মতাে যথেষ্ট সময়ও পায়নি। পৃথিবীর পারিপার্শ্বিক অবস্থাও আজ অমন সঙ্কীর্ণ বিদ্যমান শ্রেণীর নেতৃত্বলাভের পক্ষে অনুকূল নয়। এবং জনগণের জীবনের সঙ্গে জীবন যােগ না করে কোনাে যথার্থ জাগরণ বা রিনাইসেন্সই আজ অসম্ভব। কোনােদিনই তা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব হয় না। পূর্ববাঙলার শিক্ষিত শ্রেণী জনগণের সন্তান। সে বন্ধন ছেদনের মতাে দুর্বিপাকে পড়েনি বাঙলার দ্রলােকেরা যেমন পড়েছিলেন উনবিংশ শতকে ইংরেজির মােহে। পূর্ববাঙলা প্রথম থেকেই প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছে বাঙলা ভাষা। তার ভাবনা চিন্তা ধ্যান—স্বপ্ন সেই মাতৃভাষার খাতেই প্রবাহিত। তাতেই তার নিরক্ষর সাধারণ মানুষের মধ্যেও পূর্বাঙলার শিক্ষিতদের চেতনা ভাবনা সহজেই উৎসারিত হয়ে গিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণে সেখানকার সাধারণ মানুষেরও জাগরণ, তার সাহিত্যসৃষ্টি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী পুরুষ সকলের প্রাণের রঙে রাঙা, শ্যামলী পূর্ববাঙলার জীবনরসে সতেজ, পূর্ববাঙলার নদী জল বিধৌত মাটির রসে গন্ধে ভরা। আর ঠিক এই কারণেই তার হাইকোর্টের বাঙালি জজ থেকে তার পাঞ্জাবী লাটের বাঙালি বাবুর্চি একই সঙ্গে দাঁড়ায় তার নেতৃত্বের নির্দেশে, একইভাবে পেতে দেয় ট্যাঙ্ক ও মেশিনগানের সামনে বাঙলাদেশের বাঙলা ভাষা, বাঙলা সাহিত্য, বাঙালি সাধনা শ্রেণী-সঙ্কীর্ণতার বাধা উড়িয়ে দিচ্ছে সার্বজনীন ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতি হয়ে উঠছে, ১৯শতকের বাঙালির অসম্পূর্ণ জাগরণ বাঙলাদেশে রক্তের অভিষেকে আজ লাভ করছে পরিপূর্ণতার দীক্ষা। পশ্চিম বাঙলার বাঙালির মধ্যে উনবিংশ শতকের প্রাণােদ্যম যখন মনে থিতিয়ে এসেছে, হয়তাে না মন্দস্রোত, বুঝি কোথাও বা বদ্ধস্রোত তখনি পূর্ববাঙলার বাঙালির মধ্যে দেখলাম বাঙলা সংস্কৃতির দুরন্ত প্রাণময় প্রকাশ—ভাষায়, গবেষণায়, সাহিত্যের আলােচনায়, সৃষ্টির সাধনায় সর্বত্রই দেখি সেখানে প্রাণৈশ্বর্য, অকুণ্ঠিত সাহসিকতা, দুর্বার গতিময়তা। যা একদিন আরম্ভ হয়েছিল পশ্চিমবাঙলায়, আজ সেখানে স্তিমিত, সে প্রয়াসই আজ পরিস্ফুরিত পূর্ব বাঙলায়। ভাষার হিসাবে দেখি আজ প্রায় পূর্ববাঙলায় প্রত্যেকটি জেলায় উপভাষার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক অভিধানের মতে মহৎ কীর্তি ডক্টর শহীদুল্লাহ এর সম্পাদনায় সুসম্পূর্ণ। বাঙলা ভাষার আলােচনার পক্ষে যদি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ (ODBL) হয় প্রধান গ্রন্থ, উ: শহীদুল্লাহ এর সম্পাদিত এই অভিধানও হবে দ্বিতীয় অপরিহার্য উৎস যার অনুরূপ পশ্চিমবাংলার আঞ্চলিক অভিধান আমরা এখন পরিকল্পনা করতেও সাহসী নই। ঢাকা বাঙলা একাদেমি, রাজশাহী
৮৯
বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা ইতিহাসের গবেষণায় পূর্ববঙ্গের এশিয়াটিক সােসাইটি স্থির কীর্তির অধিকারী। লােককথা, লােকগীতি প্রভৃতির সংগ্রহ আরম্ভ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। আজ পূর্ববঙ্গ সে পথেও সে কীর্তি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যে নতুন যারা এগিয়ে এসেছে, বিশেষ করে পূর্ববাঙলার নতুন কবিরা, দেখে চমৎকৃত হতে হয়—কী সরল, সতেজ, কল্পনার সজীব প্রকাশ। তাদের সাহিত্যে গল্পে-উপন্যাসে উঠে আসছে চাষী, মাঝি-মাল্লা, মজুর, মেয়ে-পুরুষের আশ্চর্য মিছিল জীবনে জীবন যােগ করা সাহিত্যিকদের দান।
এমন কথা কেউ বলব না—পূর্ববাঙলার সবই পারটে অথবা, পশ্চিম বাঙলার সাহিত্যকীর্তি সবই সে-তুলনায় ম্লান। বরং এ-কথাই সত্য—অপরিণত শক্তির চিহ্ন পূর্ববাঙলার পরিণত সাহিত্যে অজস্র। একদিকে আছে নব জীবনের সবল প্রাণশক্তির উন্মাদনা, অন্যদিকে পরিক্লান্ত ক্ষীয়মান শক্তির সূক্ষ্মতাজটিলতা, কলা-কৃতিত্বের মােহবশতা। অর্থাৎ পশ্চিমবাঙলার সৃষ্টি বৈদগ্ধ্য সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সংশয় ও আশঙ্কা জমে উঠে বই কমে না; আর পূর্ব বাঙলার সৃষ্টি সমৃদ্ধিতে জন্মে এক নুতন আশা, দেখি বলিষ্ঠ জীবনের প্রতিশ্রুতি। তাই পূর্ববাঙলার জীবনে জীবন লভিয়ে সমগ্র জাতি জাগবে দুইশত বৎসরের (১৮৬৪-১৯৭০) দুর্যোগ পীড়িত বাঙালির ইতিহাসের এবার অপেক্ষিত কনসামেশন-পরম পরিণতি-বাঙালির ভাষা বাঙালির আশা সত্য হয়ে উঠছে।
সমসাময়িক বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যকে এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখে আজ অনুভব করি—বাঙলাদেশের আত্মপ্রতিষ্ঠায় ভাবী বাঙালির আবির্ভাব।
পরিচয়
বাংলাদেশ সংখ্যা, ১৩৭৭-৭৮