এই সংগ্রাম অনিবার্য ছিল
অমিতাভ চৌধুরী
সুভাষচন্দ্র বসুর পর সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাবে আমরা গর্বিত। তৎসঙ্গে কিঞ্চিৎ বিস্মিতও। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী কাহিনী পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে এই বিস্ময় অহেতুক, বাংলাদেশের’এই গণ জাগরণ মােটেই আকস্মিক নয়। বাঙালি অবাঙালি বিরােধ সেখানে পর্যায়ে পর্যায়ে এত তিক্ত হয়েছে যে, তেইশ বছর পর তার স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবেই অভ্যুদয় ঘটেছে শেখ
৮০
মুজিবুরের। ইয়াহিয়াশাহীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি-বাঙালি যেইতিহাস সৃষ্টি করল, তার পিছনেও আছে দীর্ঘ ইতিহাস।
সে ইতিহাস মােগল পাঠান আমল থেকে উত্তর পশ্চিম ভারতের কর্তৃত্ব অস্বীকারের ইতিহাস, প্রাক স্বাধীনতাকালে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের বশীভূত না হওয়ার ইতিহাস এবং শােষক মহাজন ও জমিদারের হাত থেকে মুক্তিলাভ প্রচেষ্টার ইতিহাস।
ফজলুল হক সাহেব একবার বলেছিলেন, “পলিটিকস্ ইন বেঙ্গল ইজ ইন রিয়েলিটি ইকনমিক্স অব বেঙ্গল।” -বাংলার অর্থনীতিই বাংলার আসল রাজনীতি। সত্যিই তাই। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান এবং তাদের প্রায় সকলেই দরিদ্র চাষী এবং জমিদারের প্রজা। জমিদাররা প্রধানত হিন্দু। স্বাধীনতা লাভের আগে মুসলমানদের নিজস্ব আন্দোলন বলতে ছিল ওই প্রজা আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক কারণেই তার লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার। কিন্তু সেটাকে উভয় পক্ষ থেকেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দুই দলের সম্পর্ক বিষাক্ত করা হয়েছে। এই সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের একটি মন্তব্য উল্লেখযােগ্য। গােড়ায় কংগ্রেস কর্মী, পরে লীগ সমর্থক, ইত্তেফাকের সম্পাদক আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী মনসুর সাহেব তাঁর “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইয়ে লিখেছেন–
“বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান, বাংলার মহাজন হিন্দু ঘাতক মুসলমান, উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু রােগী মুসলমান, জেলার হিন্দু কয়েদী মুসলমান, হাকিম হিন্দু আসামী মুসলমান। শুধু হিন্দু জমিদারেরাই মুসলমান প্রজাদিগকে তুই তুকার করিয়া অবজ্ঞা করিতেন এবং তাদের কাছারিতে ও বৈঠক খানায়
৮১
এদের বসিতে আসন দিতে অস্বীকার করিতেন তাহা নয়, তাঁহাদের দেখাদেখি তাঁহাদের আমলায়লা, আত্মীয়স্বজন ঠাকুর পুরােহিত, উকিল ডাক্তাররাও মুসলমানদের নিজেদের প্রজা ও সামাজিক মর্যাদায় নিম্নস্তরের লােক মনে করিতেন। এটা জমিদার প্রজার স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না। ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক। কারণ একদিকে বামুন কায়েত প্রজারা জমিদারের কাছারি বৈঠকখানায় বসিতে পাইত, অন্যদিকে বর্ণহিন্দুর কাছে অমন নিগৃহীত হইয়াও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু তালুকদার বা ধনী মহাজনরাও মুসলমানদের সাথে বর্ণ হিন্দুর মতই ব্যবহার করিত।
এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা ছিল। কিন্তু আগেই বলেছি কারণ যতটা সাম্প্রদায়িক তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক এবং সেই অর্থনৈতিক কারণেই আজ দেশ বিভাগের তেইশ বছর পর পূর্ববঙ্গের মুসলমান স্বধর্মী পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। জিন্নার দুই জাতি তত্ত্ব ছিল ধর্মীয়, এখন পূর্ববঙ্গে যে নতুন দ্বিজাতি তত্ত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাতে ধর্মের স্থান নেই, আছে ভাষাও সংস্কৃতি। এবং বলাবাহুল্য রয়েছে অর্থনীতিও।
গত তেইশ বছরের ইতিহাস শােষণের ইতিহাস, রাষ্ট্রের একটি গরিষ্ঠ অংশকে ঔপনিবেশিক মনােবৃত্তি নিয়ে পদানত করে রাখার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সেই টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানে কারখানা বানিয়ে সেই কারখানার মাল পূর্ববঙ্গে বিক্রি করার যে বিশুদ্ধ পদ্ধতি, তার অন্য নাম শােষণ। বছরের পর বছর সেই শােষণ চলেছে এবং পূর্ববঙ্গ হয়েছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর। আর পশ্চিম পাকিস্তান? সেখানে দুধ ও মধুর বন্যা।
৮২
অর্থনীতির উপরে ভাষা ও সংস্কৃতি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই জিন্না সাহেব কর্তৃক গরিষ্ঠ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে অস্বীকারের চেষ্টা, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন ও আত্মবলিদান, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি আয়ুবশাহীর আক্রমণ এবং তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ধিক্কার সাম্প্রতিক ঘটুনাবলীর দিকে অনিবার্য রূপে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
সারা পূর্ববঙ্গে যে নতুন চেতনা, নতুন জাতীয়তা তার মূলে রয়েছে বাঙালিয়ানা।’ এই বাঙালিয়ানার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান। গত তেইশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রবল প্রতাপে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি দেশের যুবক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সেই প্রতিক্রিয়াকে গণ বিপ্লবে সঙ্ঘবদ্ধ করার কৃতিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের। মুজিবুরের পরিচয় তিনি জাতীয়তাবাদী বাঙালি মুসলমান। এদিক থেকে তাঁর পূর্বসুরী এ কে ফজলুল হক। ফজলুল হক সাহেব ছিলেন আগাগােড়া বাঙালি। এই বাঙালিত্বের জন্যেই তিনি বারবার সার্বভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করে নিজস্ব কৃষক প্রজাপার্টি গঠন করেছিলেন।
তবে বর্তমানের সব আন্দোলন এ তার নেতা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ফজলুল হক সাহেবের নীতিগত হলেও চরিত্রগত পার্থক্য ছিল। দেশ বিভাগের আগে ফজলুল হকের অনুগামী ছিলেন দরিদ্র চাষী মুসলমান, যারা ছিলেন মুখ্যত হিন্দু জমিদারের প্রজা। অর্থনৈতিক কারণে তাঁরা সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তি থেকে মুক্ত ছিলেন না। কিন্তু মুজিবুরের প্রধান সমর্থক সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এঁরা মুক্তমনা এবং তাদের ক্রোধ হিন্দুদের প্রতি নয়, পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুদের প্রতি। দেশ বিভাগের সময়ে বালক অথবা দেশ বিভাগের পর জন্ম হয়েছে এমন পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের কাছে হিন্দু জমিদারদের শােষণকাহিনী অতীতের ব্যাপার বহুলাংশে কল্পিত: তাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের বড় পরিচয়, তাঁরাও বাঙালি, তারাও একই ভাষা ও একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। তাই যে-সব-ভারতীয় বা সর্বপাকিস্তানী নেতৃত্ব ওই বাঙালির এই দুই অংশের মধ্যে প্রাচীর তুলে বিরােধ সৃষ্টি করে চলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আঘাত হানল পূর্ববাংলার বাঙালিরা। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দিল্লির ঔদাসীন্য পিনডি-ঢাকার সম্পর্কের মতাে নয়, তাই দুই বঙ্গের তুলনা এক্ষেত্রে অচল। শুধু এইটুকু বলা যায়, দুই বাংলায় আন্তর্জাতিক সীমানা কৃত্রিম, পাসপাের্ট ভিসা অচল এবং অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বন্ধনে দুই বাংলা অবিভাজ্য। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি ফজলুল হক সাহেবের কয়েকটি উক্তি। আজ শেখ মুজিবুর রহমান দুই বঙ্গের সম্পর্কে যেসব কথা বলছেন তা ফজলুল হকের বক্তব্যের ধারাবাহী।
১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল পূর্ব বঙ্গে নবগঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক তার ষাট বছরের পরিচিত ও প্রিয় শহর কলকাতায় এলে নানা স্থানে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। হিন্দু ভাইয়ের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হক সাহেব বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিবৃতিতে যা বলেন তাতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিস্ময় ও ক্রোধের সীমা থাকে না, কিন্তু বাঙালি মাত্রেই উল্লসিত হন। হক সাহেব বলেছিলেন-
১. “দুই বাংলার মধ্যে পাসপাের্ট ও ভিসা প্রথা প্রবর্তনের যৌক্তিকতা আমি বুঝি না। দুই দেশের মধ্যে এই ব্যবধান কৃত্রিম । দুই বঙ্গের মধ্যে অবাধ যােগাযােগের সব বাধানিষেধ অবিলম্বে দূর করা প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি। আমি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করব এবং আমি আমার এ প্রচেষ্টায় আমার বন্ধু বিধানবাবুর সহযােগিতা কামনা করি।”
২. “জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে আমার আর কোন আশা বা আকাঙ্ক্ষা নেই। উভয় বঙ্গের মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর রচিত হয়েছে, তা অপসারিত করবার কাজ যদি আমি আরম্ভ করে যেতে পারি তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। দুই বাংলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে, তা একটা স্বপ্ন ও থােকা মাত্র। করুণাময় খােদাতালার দরবারে আমার একমাত্র প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন এই ব্যবধান দূর করতে পারেন। আমার এই আকাক্ষা যাতে পূরণ হয় সেজন্য আপনারা আমাকে দোয়া করুন।”
৩. “বাঙালিরা পূর্বে বা পশ্চিমে যে যেখানেই থাকুন না কেন তারা অখণ্ড এবং তাদের মধ্যে সদ্ভাব ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেই হবে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক দিক থেকে দুভাগ হয়েছে সত্যি
৮৩
কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে উভয় বঙ্গে কোন ফারাক নেই। রাজনীতিকরা দেশটাকে দু ভাগ
করে এই সাংস্কৃতিক ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেননি, ভবিষ্যতেও কোনদিন পারবেন না।”
৪. “একটি দেশের রাজনৈতিক বিভাগে আমি বিশ্বাস করি না। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান এই দুটি বিভেদার্থক শব্দের সঙ্গে আমি এখনও পর্যন্ত সুপরিচিত হতে পারিনি। ভারত বলতে আমি এখনও হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান উভয় অংশকেই বুঝি। যারা আমাদের এই সােনার দেশকে দু ভাগ করেছে, তারা দেশের দুশমন। আমার মতে পাকিস্তান বলতে কিছুই বােঝায় না। এই শব্দটি বিভ্রান্তি সূচনা করবার ও স্বার্থসিদ্ধির একটি পন্থামাত্র।”
৫. “আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আজ আমাকে ভারতের ইতিহাস গঠন করতে হচেছ। আশা করি ভারত কথাটি ব্যবহার করায় আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি ভারত বলতে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ উভয় অংশকেই বুঝিয়েছি।”
৬. “বাঙালি অখণ্ড এক জাতি, তারা একই ভাষায় কথা বলে এবং তাদের আদর্শ এক। জীবনের উদ্দেশ্য এক এবং জীবনধারণের পদ্ধতিও এক। দেশ বিভাগ সত্ত্বেও দুই বাংলা মিলিতভাবে অনেক বিষয়ে দেশকে পথ দেখাতে পারে।”
হক সাহেবের দিলখােলা স্বীকারােক্তির পরিণাম মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে তার বিদায় এবং স্বগৃহে বন্দি জীবন। শেখ মুজিবুর হক সাহেবের চেয়ে আরও মুক্তমনা, আরও উদার, তিনিও ওই একই ধারায় চিন্তা করছেন বলে তার এবং দেশের ও দলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাক ফৌজ। জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব তার চেলাদের বর্বর হত্যাকাণ্ডে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন দ্বিজাতি হিন্দু আর মুসলমান নয়, বাঙালি পাঞ্জাবী । যে বিরােধ ও বিভাগে পাকিস্তানের জন্ম সেই বিরােধ ও বিভাগের মধ্যেই জন্ম নিতে চলেছে নতুন রাষ্ট্র যার নাম বাংলাদেশ যার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতি, এবং যার কেন্দ্রে রয়েছেন বাঙালির নব জাগরণের কেন্দ্রমণি, শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশ
৩ বৈশাখ ১৩৭৮