বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ
হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তিন মাস গিয়ে চার মাসে পড়ল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের রকমফের হয়েছে, সম্মুখ সমরের অবসান হয়েছে। পূর্ববঙ্গ এমন নয় যে সম্মুখে সমরে পাকিস্তানকে এঁটে উঠতে পারে। এখন তাকে সময় সুযােগ বুঝে খণ্ড যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে এবং দীর্ঘকালীন প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
প্রাথমিক আবেগ উত্তেজনা ক্রমে প্রশমিত হয়ে আসছে। এখন স্থির মস্তিষ্কের শান্ত মনে সমস্ত অবস্থাটা ভাল করে ভেবে দেখবার সময় এসেছে। বাঙালি চরিত্রে মস্ত বড় একটা দুর্বলতা আছে: কিছু একটা ঘটলেই আমরা উত্তেজনায় এমন অধীর হয়ে উঠি যে তখন আর আমাদের সেন্স অফ প্রপাের্সান বা কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। রণক্ষেত্রে যাই ঘটুক সংবাদপত্রে জয় ঘােষিত হতে লাগল মুহুর্মুহু। স্বাধীনতা ঘােষণামাত্র আমরা স্বাধীনতা করায়ত্ত বলে ধরে নিলাম। জঙ্গী শাসনের ভাবভঙ্গি আমাদের জানা নেই বলেই ব্যাপারটাকে আমরা অত সহজ করে দেখেছিলাম। সে একবার ঘাড়ে চেপে বসলে আর ঘাড় থেকে নামতে চায় না। সর্বনামে সমৃৎপন্নে বুদ্ধিমানের মতাে অর্থাৎ ত্যজতি ডিমক্রেসি। ডিক্টেটরশিপের অত বুদ্ধি নেই, সে বিনা যুদ্ধে সুচাগ্র ভূমি ছাড়ে না। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও বেশি ছাড়তে হয়, তার উপরে গােটা রাজকন্যা। রাজকন্যার চাইতেও বেশি—পূর্ববঙ্গ হল পাকিস্তানের পাটরাণী কেননা পাটই তার প্রধান সম্বল।
পাট গেলে রাজ্যপাট সব যাবে। কাজেই পূর্ববঙ্গে তারা অত সহজে রণে ভঙ্গ দেবে এমন কথা ভাবাই অন্যায়। আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দও মারাত্মক ভুল করেছেন। ওরা ছয় দফা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, জানতেন না যে ডিক্টেটর কারাে দফাওয়ারী কাজ করে না ও শুধু দফা নিকেশ করতেই জানে। আগে থেকে বুঝতে পারলে আওয়ামী লীগ কিছুটা অন্তত প্রস্তুত থাকত। দেশবাসীকে প্রস্তুত করা তাে দূরের কথা আপকালে দেখা গেল নেতারা নিজেরাই সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। অথচ আজ যা ঘটছে তাকে মােটেই অভাবনীয় বলা চলে না বরং অবস্থা দৃষ্টে ব্যাপারটা এক রকম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাবার পরে অর্থাৎ সংঘর্ষ বাঁধবার তিন মাস আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বঙ্গ দর্শন’শিরােনামায় আমি একটি ক্ষুদ্র নিবন্ধ লিখেছিলাম; তাতে বলেছিলাম-“পাকিস্তানবাসী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেনি। এই সবে তার সংগ্রাম শুরু হতে চলেছে। নির্বাচন সমাধা হলেই জনপ্রিয় সরকার গঠিত হবে, দেশের মানুষ স্বাধীনতার মুক্তবায়ুতে নিশ্বাস নেবে এমন আশা করা অবাস্তব। দীর্ঘকাল সামরিক শাসন চলেছে, সে একবার পেয়ে বসলে সহজে ছাড়ে না। এবার সে মরণ কামড় দেবে।… স্বাধীনতার যে সংগ্রামকে মুসলিম সমাজ সময় কালে এড়িয়ে গিয়েছে আজকে তাকে সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হবে। সেদিন যে মূল্য দিতে রাজি হয়নি আজ তার দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে। পূর্ববঙ্গে সম্প্রতি যে প্রাকৃতিক ঝঞ্জা হয়ে গেল তার চাইতেও বিধ্বংসী ঝঞ্জা অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে। এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবে যা ঘটছে তা আরােই ভয়ঙ্কর। অগণিত মানুষের প্রাণ গিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন সর্বস্বান্ত হয়েছে, এরই মধ্যে ষাট লক্ষ লােক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এতখানি বর্বরতা এবং নৃশংসতা একমাত্র ধর্মীয় রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব, কারণ ধর্মীয় রাষ্ট্রের ন্যায় অধার্মিক রাষ্ট্র আর হতে পারে না। ধর্মীয় রাষ্ট্র যে কী অবাস্তব বস্তু তার প্রমাণ, তাকে রক্ষা করবার জন্যে ধর্মজ্ঞান ছাড়া আর সব কিছুর প্রয়ােজন হয়—গােলা বারুদ, কামান বন্দুক, সাঁজোয়া বাহিনী, বােমারু বিমান, নৌবহর ইত্যাদি। সব চাইতে নির্মম পরিহাস এই যে রক্ষা করবার প্রয়ােজন হয়েছে স্বধর্মাবলম্বীর হাত থেকে। এই ধর্মীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল চরম নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে, এ মুহুর্তে মতিগতি না বদলালে এর বিলােপ সাধনও হবে চরমতম নিষ্ঠুরতায়। অন্ধ বিশ্বাসে যার। রােষে তার অবসান।
একথা নিশ্চিত যে পাকিস্তানের দু অংশ আর জোড়া লাগছে না। জোর জবরদস্তি করে আরাে কিছু দিন ঘাড়ে চেপে থাকতে পারে কিন্তু সম্পর্কে এমন চিড় ধরেছে যে এর পরেও যদি টিকে থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে মুসলিম সমাজের আর মুক্তি নেই, ধর্মান্ধতা তার মনুষ্যত্বকে সমূল বিনষ্ট করেছে। তােমার ঘরের পাশের হিন্দু তােমার কেউ নয়। আরব কিম্বা তুর্কিস্থানের মুসলমান তােমার পরম আত্মীয় এমন উদ্ভট তত্ত্বের উপরে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত তার স্থায়িত্ব দৈবের আয়ত্তে মানুষের আয়ত্তে নয়। মুসলমান মুসলমানের কী
৭৪
সর্বনাশ করতে পারে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ আজ তা ভেবে দেখবে। ধর্ম কি মুসলমানের হাত থেকে মুসলমানকে রক্ষা করতে পেরেছে? (হিন্দুদের কী দশা ঘটেছে সে কথা বলে কী লাভ!) ধর্মটা এখন কোথায় গেল? মানুষের চতুর্বর্গ সাধনার মধ্যে পাকিস্তান বুঝেছে যে ধর্মের চাইতে অর্থ অর্থাৎ স্বার্থ বড় আর পূর্ববঙ্গ বুঝেছে যে ধর্মের চাইতে মােক্ষ অর্থাৎ মুক্তি বড়। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বােঝা উচিত ছিল গােড়াতেই। ধর্ম কোথাও মানুষকে এক করেনি। পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ নিরবধি কাল আত্মকলহে বিপর্যস্ত। খ্রিষ্টান ধর্ম ইউরােপের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে এক করতে পারেনি, দূর প্রাচ্যে পারেনি বৌদ্ধ ধর্ম।
মানুষের ঐক্যবােধ তাে গীতা কোরান বাইবেল পাঠ করে হয় না হয় অত্যন্ত সহজ সাধারণ দৈনন্দিন ব্যাপার থেকে—এক অবস্থায় এক পরিবেশে জন্মাবধি বড় হবে, এক ভাষায় সুখ দুঃখের কথা বলবে, এক হাটে বেচাকেনা করবে, পাশাপাশি ক্ষেতে খামারে কাজ করবে, বিপদে আপদে একে অন্যের কাছে ছুটে আসবে। বাঙালি মুসলমানের বিপদ ঘটলে পাঞ্জাব পেশােয়ার সিন্ধু দেশ থেকে মুসলমানরা ছুটে আসবে এমন অবাস্তব কল্পনা যে বাঙালী মুসলমানরা সজ্ঞানে করতে পেরেছে এটাই এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। ওই অন্ধ বিশ্বাসের ফলে আজ এত বড় মার খেতে হল। জীবনের সত্যকে অস্বীকার করলে জীবনাস্ত ঘটে। কোনটা খাঁটি সত্য সে তাে কার্যতই প্রমাণিত হল। বিপদের মুহূর্তে সর্বাগ্রে ছুটে এসেছে বাঙালি। এই সঙ্গে আবার এও লক্ষ্য করবার বিষয় যে পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধকে খুব একটা সুনজরে দেখছে না। অপ্রিয় সত্য হলেও এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে অনুধাবনযােগ্য। মুসলিম সমাজের এটেই প্রধান ব্যাধি এবং তাদের উন্নতির পথে প্রধান বাধা। দেশ এবং জাতির দাবির চাইতে সম্প্রদায়ের দাবিকে বড় করে দেখেন বলে তাদের মধ্যে যথার্থ জাতীয়তাবােধ অদ্যাবধি জন্মায়নি।
মুসলিম সমাজকে আজ অনেক জিনিস শীতল মস্তিষ্কে ভেবে দেখতে হবে। ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের পত্তন হল এই বাংলাদেশে। মনে রাখতে হবে যে মুসলিম রাজের হাত থেকেই ইংরেজ বণিক রাজত্ব কেড়ে নিয়েছিল। উনবিংশ শতকে যখন জাতীয়তার প্রথম উন্মেষ হল তখন সেদিনের বাঙালি নেতারা যুবক সম্প্রদায়ের মনে এই চেতনা জাগিয়ে দিয়েছিলেন যে, পরাধীনতার সূচনা যখন বাংলাদেশে হয়েছে তখন সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত সর্বাগ্রে বাঙালিকেই করতে হবে। সেদিন থেকেই বাঙালি জাতি স্বদেশিকতার ব্রত গ্রহণ করেছে। ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন-বাংলাদেশেই হয়েছিল। স্বদেশী যুগের বিপ্লবী ধারায় যে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হল তারও জন্ম বাংলাদেশে। বহু বাঙালি যুবক প্রাণ দিয়েছে, বহু নির্যাতন সহ্য করেছে। খুব দুঃখের কথা যে এসব আন্দোলন থেকে মুসলিম সমাজ দূরে থেকেছে। প্রাথমিক উৎসাহের বন্যায় কিছু সংখ্যক মুসলমান স্বদেশী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন, কিন্তু অত্যল্পকাল মধ্যে তারা সরে দাঁড়িয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলন; এর ঠিক এক বৎসর পরেই ১৯০৬ সালে ইংরেজের প্ররােচনায় মুসলিম লীগ এর প্রতিষ্ঠা। বিদেশী প্রভুর শলাপরামর্শে মুসলিম সমাজের সেই দেশ-বিরােধী প্রথম পদক্ষেপ। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোেধ করবার উদ্দেশ্যে স্বদেশী আন্দোলন আর স্বদেশী আন্দোলনকে প্রতিরােধ করবার জন্যে মুসলিম লীগ এর জন্ম। জন্মস্থান ঢাকা শহর। বর্তমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর কৌতুক কেননা ঢাকা-নগরী-জাত সেই মুসলিম লীগ এর রাজনীতির ফলে চল্লিশ বছর পরে ভারত বিভাগ যার ফলে আজ উভয় বঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত পঙ্গু। ইতিহাসের পরিহাসে ঢাকা শহরে আজ যে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটল এ সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। মুসলিম সমাজই এ ঘটনাকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
মুসলিম নেতারা মুসলিম সমাজের প্রতি প্রচণ্ড অবিচার করেছেন। দেশ বা জাতি গঠনের চেষ্টা মাত্র না করে সম্প্রদায় গঠনের চেষ্টা করেছেন। সরলপ্রাণ অশিক্ষিত মানুষদের নিরন্তর এক মন্ত্র জপ করিয়েছেন আমরা বাঙালি নই, আমরা মুসলমান, আমরা বিহারী নই, আমরা মুসলমান, আমরা গুজরাটী মারাঠী পাঞ্জাবী সিন্ধী নই, আমরা মুসলমান; এককথায় আমরা ভারতবাসী নই, আমরা মুসলমান। এর লজিকাল পরিণতি হল আমরা মানুষ নই আমরা মুসলমান। এই শিক্ষার ফলে যে অমানুষিকতার সৃষ্টি হয়েছে তার নানা রূপ প্রকাশ পেল পূর্ববঙ্গের ঘটনায়।
মুসলিম সমাজের পক্ষে এটা গৌরবের কথা নয় যে অর্ধ শতাব্দীব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অংশ যৎসামান্য। এক আধটি সােয়ালাে পাখি যেমন গ্রীষ্ম ঘােষণা করে না, মুষ্টিমেয় দেশপ্রাণ মুসলমান তেমনি
৭৫
মুসলিম সমাজের স্বাদেশিকতা প্রমাণ করে না। অধিকাংশ শুধু যে দূরে থেকেছে তাই নয়, অনেক সময় সক্রিয়ভাবে বাধা দিয়েছে স্বদেশী আন্দোলনের সময় যেমন, গান্ধীজীর অসহযােগ আন্দোলনের কালেও প্রথম উন্মাদনায় যারা যােগ দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশ অনতিকাল মধ্যে সরে দাঁড়িয়েছেন। অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলনকে যুক্ত করেও গান্ধীজী তাদের দলে রাখতে পারেননি। অবশ্য কংগ্রেস ভুল করেনি, এমন কথা বলব না। যখন যে ভাবে ডাকা উচিত ছিল সেভাবে হয়তাে তাদের ডাকা হয়নি। তবে দেশের ডাকে ঝাপিয়ে পড়াটাই নিয়ম, তখন কেউ লােক-লৌকিকতার বিচার করতে যায় না, কারণ দেশটা সকলের। হিন্দু সমাজের ব্যবহারেও দোষ ত্রুটি ছিল। কিন্তু সব চাইতে বড় কথা কুটিল ইংরেজ নিরন্তর প্ররােচনা যুগিয়ে মুসলিম লীগ মারফৎ মুসলিম সমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান প্রতিপক্ষ করে তুলেছিল। দোষ মুসলিম জনগণের নয়, দোষ মুসলিম নেতাদের। তারাই ইংরেজের কুচক্রে যােগ দিয়ে সমস্ত মুসলিম সমাজকে পথভ্রান্ত করেছেন। লক্ষ্য করবার বিষয় যে আজকেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম লীগ অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ। অর্থাৎ সে তার আপন স্বভাব অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছে; স্বাধীনতার মর্ম সে কোন কালেই বােঝেনি। এখানে বলে দেওয়া প্রয়ােজন যে বাংলাদেশে হিন্দু মহাসভা যেমন কোন দিন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি তেমনি ঢাকা শহরে জন্ম গ্রহণ করেও মুসলিম লীগ বহুকাল বাংলাদেশে খুব একটা মাথা তুলতে পারেনি। কারণ বাঙালি হিন্দু মুসলমান কোন সমাজেই স্বভাবের দিক থেকে সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন ছিল না। উভয় সম্প্রদায় মিলে মিশেই বাস করছিল। ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে বাঙালি মুসলিম সমাজ মুসলিম লীগ-এর প্রভাবকে বহুকাল ঠেকিয়ে রেখেছিল । কিন্তু একবার বিষবায়ু ছাড়ানাে হলে ক্রমে তা আকাশ বাতাস ছেয়ে ফেলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শুরু হল তখন দেখা গেল সমগ্র মুসলিম সমাজই মুসলিম লীগ-এর আওতায় এসে গিয়েছে। ইউরােপের রণাঙ্গনে ইংরেজ তখন নিরতিশয় বিপন্ন। কংগ্রেস মুসলিম লীগ এক হতে পারলে তখনই স্বাধীনতা আদায় সম্ভব হতে পারত। কিন্তু মুসলিম লীগ তখন পুরােপুরি ইংরেজের কজায়। লজ্জার কথা এই যে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়কেই ইংরেজ প্রধান অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এত করেও ইংরেজ টিকে থাকতে পারেনি। গান্ধীজীর কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন সুভাষ বসুর আই এন এ এবং সর্বশেষ ভারতীয় নৌবহরের বিদ্রোহ ইংরেজের ঝুঁটি ধরে এমন নড়ে ছিল যে তার পক্ষে ভারতে তিষ্ঠাননা আর সম্ভব হল না। মান থুইয়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে হল। যাবার আগে দেশ দু ভাগ করে দিয়ে আক্রোশ মিটিয়ে গেল। আক্রোশ হিন্দুর বিরুদ্ধে। কারণ ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে India’s fight for freedom in predominently a Hindu fight.
ভারত পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল। ইংরেজ বুদ্ধিমান জাত। সর্বনাশে সমুদ্রপথে ইংরেজ পণ্ডিত অর্ধেক কেন অর্ধেকের বেশিই ত্যাগ করেছে। বেশ বুঝেছে ভারত থেকে তার পাট উঠেছে, এখানে আর জারি জুরি চলবে না। ঘাঁটি রাখতে হবে পাকিস্তানে মুসলিম সম্প্রদায় চিরকাল তাকে মুরুব্বি বলে জেনেছে, এখনও মুরুব্বি বলে মানবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভারত পাকিস্তানের তফাৎ কোথায় এক নিমেষের দৃষ্টিপাতেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার সংগ্রাম করে ইংরেজকে তাড়িয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল । মুসলিম সমাজ না করল ইংরেজের সঙ্গে লড়াই না চাইল বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর লড়াইটা হিন্দুর কাছ থেকে যে তার রাজাও নয়, শাসকও নয়। এ যেমন দুঃখের কথা তেমনি লজ্জার কথা। আমরা হিন্দুর সমকক্ষ নই, আলাদা না হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না—এই inferiority বােধ থেকে পাকিস্তান দাবির উদ্ভব। সংখ্যালঘিষ্ঠতার দোহাই যারা দেন তাদের জিজ্ঞেস করা প্রয়ােজন মুসলমান যেদিন এসে এ দেশ জয় করেছিল সেদিন কোটি কোটি হিন্দুর তুলনায় মুসলমান আক্রমণকারীর সংখ্যা কজন ছিল। ইংরেজ যখন এ দেশ দখল করল তখন তারাই বা সংখ্যায় কজন? সংখ্যাটা কোন যুক্তিই নয়। পূর্ববঙ্গে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কই, তারা তাে ও দেশ ছেড়ে চলে আসতে চায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠরাই তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতবর্ষে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠকে ভয় করেছে, নিজ দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠকে, এ এক অদ্ভুত মনােভাব। আসল কথা যে inferiority বােধ থেকে সে আজও মুক্তি পায়নি, কোন দিন পাবে কিনা সন্দেহ।
৭৬
ইংরেজ মুসলিম লীগকে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে খাড়া করে রেখেছিল কিন্তু লীগ-এর রাজনীতি বলে কোন জিনিস ছিল না। কংগ্রেস যা করেছ সে তার উল্টোটি করেছে। কোন ব্যাপারে কংগ্রেস না বললে সে হাঁ বলেছে আর কংগ্রেস হাঁ বললে সে বলেছে না। এর ফলে তার রাজনৈতিক সাবালকত্বই হয়নি। ইংরেজ তাকে বরাবর নাবালক করে রেখেছে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও সে নাবালকত্ব ঘােচেনি। ভারতবর্ষ যা করবে ঠিক তার উল্টোটি তার করা চাই। আগে যেমন ভেবেছে কংগ্রেসকে জব্দ করতে পারলেই তার বেকাদায় ফেলতে পারলেই তার উন্নতির পথ সুগম হল। একে রাজনীতি বলে না। ইন্ডিয়া তার ভাবনা চিন্তাকে এমনভাবে গ্রাস করে রেখেছে যে সে স্বাধীনভাবে নিজের ঘরের কথা ভাল করে ভাবতেই পারছে না। এটা সে এক রকমের পরাধীনতা সেটা সে বুঝতে পারে না। এ সবই হল frustration. এর ফল এবং এ frustration- এর উৎপত্তি সংখ্যার লঘু গুরু ভেদ থেকে নয়। শিক্ষা দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত অগ্রসর বলে ইংরেজ আমলে পরাধীন অবস্থায়ও জনজীবনে সরকারী বেসরকারী চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে ওকালতি ডাক্তারি এমন কী ব্যবসা বাণিজ্যেও হিন্দুর প্রাধান্য বিস্তৃত হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে কোন কোন অঞ্চলে বিশেষভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও মুসলিম সম্প্রদায় নিজ শিক্ষাবলে অর্থাৎ নিজ গুণেই হিন্দুদের চাইতে বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এখানেই প্রমাণ যে জনবলের চাইতে গুণবল বড়। তবে সমগ্র দেশের কথা বলতে গেলে স্বীকার করতে হবে যে শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজ পিছিয়ে ছিল। দেশে প্রথম যখন ইংরেজি শিক্ষা এল তখন হিন্দুরা তাদের তামা তুলসী গঙ্গাজল সত্ত্বেও ইংরেজের পাঠশালার পাঠ নিতে এগিয়ে এল । কিন্তু মুসলমানরা তাদের মকতব মাদ্রাসাকেই আঁকড়ে বসে থাকল। ভুল বুঝতে পঞ্চাশ বছর লেগেছে। তারই ফল ভােগ করেছে পরবর্তী এক শতাব্দী ধরে। নিজের বিদ্যা বুদ্ধি ক্ষমতার উপরে আস্থা হারিয়েছে। হিন্দুর প্রতি ক্রোধ বা বিদ্বেষ প্রকাশ করে তাে তার ক্ষতি পূরণ হয় না।
স্যার সৈয়দ আহমেদ-এর প্রেরণায় মুসলিম সমাজে যখন ইংরেজি শিক্ষা প্রবেশ করল তখন থেকেই মুসলমানদের মধ্যে নতুন জাগরণ দেখা দিয়েছে। প্রথম যুগের ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে অনেকে দেশের কথা ভেবেছেন, সমাজ সেবায় উদ্যোগী হয়েছেন। অবশ্য তাদের উদ্যম আয়ােজন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপন সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে যুগােপযােগী নেতা বলতে গেলে একজনই ছিলেন। তিনি মুহম্মদ আলী জিন্না। শিক্ষিত হিন্দু নেতাদের ন্যায় তিনিও মনে-প্রাণে স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তাকে লীগ এর আসরে টানবার যথেষ্ট চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু জিন্না ঘৃণাভরে তা উপেক্ষা করেছিলেন। নিজ শক্তিতে পরিপূর্ণ আস্থা ছিল বলে কেবলমাত্র মুসলিম সমাজের নেতা সেজে নিজেকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করতে চান নি। সমগ্র দেশ এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত দেশবাসীর নেতৃত্ব লাভই তার মনােগত আকাক্ষা ছিল। তিনি তখন প্রথম সারির কংগ্রেসী নেতাদের অন্যতম। বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তি। এক সময়ে সর্বভারতীয় নেতৃত্ব বলতে গেলে তার হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ভারতবাসীর সহযােগিতা লাভের জন্যে ইংরেজ অনেক গাল ভরা আসা ভরসা নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধশেষে ও বিষয়ে কোন প্রকার উচ্চবাচ্য না করে রাউলাট আইন প্রবর্তন করে রাজদ্রোহের অপরাধে নির্বিচারে এর পাকড় শুরু করে দিল। জিন্না তখন ইম্পিরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল এর মেম্বার। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে তিনি তার সভ্য পদে ইস্তফা দেন। ভারতীয় নেতাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানালেন। দেশময় জিন্নার জয়জয়কার। সেদিন সমস্ত দেশ তাকেই অপ্রতিদ্বন্ধী নেতা বলে বরণ করে নিয়েছিল। গান্ধীজী তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে এসেছেন কিন্তু দেশের রাজনীতিতে তখনও সক্রিয় ভাবে যােগদান করেননি। ১৯১৯ এর এপ্রিল মাসে ঘটল জালিয়ানওয়ালাবাগ এর হত্যাকাণ্ড। এমন নৃশংসতার তুলনায় কিছুই নয়। সমগ্র দেশ শােকে মুহ্যমান স্তম্ভে বিহ্বল। নেতারা সকলে স্তব্ধ । সেই বিষম সংকট মুহূর্তে দেখা দিলেন গান্ধীজী। সেদিনকার ভীতি বিহ্বল মানুষের মনে সব চাইতে বড় প্রয়ােজন ছিল যে জিনিসের সেই অভয় বাণী নিয়ে তিনি এলেন যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তােমার চেয়ে। নির্ভয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইংরেজের সঙ্গে সম্মুখ সমরে প্রবৃত্ত হবার দিন এসেছে। সম্মুখ সমর পরিচালনা করতে পারেন এমন গাভীবধারী সেদিন দেশে আর কেউ ছিলেন না। দেশের অবিসম্বাদিত নেতৃত্ব অনিবার্য রূপে গান্ধীজীর হাতে এসে ছোঁ মেরে জিন্নার হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন।
৭৭
গান্ধী, জিন্না দুজনেই গুজরাটের মানুষ। দুজনেই ব্যারিস্টার। আইনজ্ঞ হিসাবে জিন্না অধিকতর প্রখ্যাত। রাজনৈতিক মহলে জিন্না সবিশেষ পরিচিত, গান্ধী বলতে গেলে দেশবাসীর কাছে অপরিচিত। সেই মানুষ এসে সমস্ত ওলট পালট করে দিলেন। জিন্না সাহেবের সাজানাে বাগান শুকিয়ে গেল। কংগ্রেসী রাজনীতি বলতে তখন বৎসরাণ্ডে একবার মিলিত হয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় নরম গরম বক্তৃতা করা কিংবা বিধানসভার কূট চালে আইনের প্যাচে ইংরেজ সরকারকে সময়ে সময়ে ব্যতিব্যস্ত করা। গান্ধীর নেতৃত্বে সে কংগ্রেস অকস্মাৎ চাষী মজদুরের কংগ্রেস হয়ে গেল। তাদের কাছে সাহেব সেজে ইংরেজি বক্তৃতার কোন মানেই হয় না। শৌখিন রাজনীতির অবসান হল। এতদিন ছিল বাকযুদ্ধ এখন সম্মুখ সমর কারাবরণ, পুলিশী নির্যাতন শত রকমের স্বার্থত্যাগ, দুঃখ ভােগ। ১৯২০-এর কলকাতা স্পেশ্যাল কংগ্রেসে গান্ধীজী তার অসহযােগ আন্দোলনের অভিপ্রায় ঘােষণা করলেন। উদ্বেলিত জন সমুদ্রে জিন্নার আর্তকণ্ঠ শােনা গেল— I appeal to Mr. Gandhi to cry halt to this dangerous movement. কিন্তু দেশ ময় তখন সাজ সাজ রব উঠেছে, পিছিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কয়েক মাসের মধ্যেই অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। এর পরেও বেশ কয়েক বছর জিন্না সাহেব কংগ্রেস অধিবেশনে উপস্থিত থেকেছেন, বক্তৃতা করেছেন। এতদিনের কংগ্রেস ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি। কিন্তু গান্ধীপন্থায় সমস্ত পিছুটান ছেড়ে, সাজানাে গােছানাে জীবনের আরাম ত্যাগ করে সকল রকম দুঃখ কষ্ট অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতি বা সাহস তাঁর ছিল না। অপর পক্ষে গান্ধীজীর আহ্বানে চিত্তরঞ্জন, মতি লাল, বল্লভভাই, জহরলাল, সুভাষ প্রমুখ বহু অসমসাহসী শক্তিধর পুরুষ গান্ধীজীর সহযােগী হিসাবে দেখা দিলেন। জিন্না বুঝতে পেরেছিলেন ত্যাগে বীর্যে সাহসে উদ্যমে দুঃখ বরণে তিনি এদের সমকক্ষ নন। নিতান্ত ভগ্ন হৃদয়ে এবং প্রচুর ক্ষোভের সঙ্গে কংগ্রেস ছাড়লেন কিন্তু নেতৃত্বের লােভ ছাড়তে পারেন নি। অতএব যে মুসলিম লীগকে একদিন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অগত্যা সেই লীগকেই এখন অগতির গতি হিসাবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু এই জিন্না পূর্বেকার সেই তেজোদৃপ্ত জিন্না নন—এক বিমর্ষ, বিবর্ণ ব্যর্থমনােরথ জিন্না। আগে দেখেছি মুসলিম সমাজের frustration, এবার নেতা হিসাবে জিন্নার frustration। এই উভয় frustration-এর আধার হল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ-এর frustration-জাত পলিটিক্স থেকে পাকিস্তানের জন্ম।
আগেই বলেছি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম সমাজ কখনাে পূর্ণোদ্যমে যােগ দেয়নি। ( খান আব্দুল গফুর খান এবং তার পাঠান অনুরাগীরা ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম নেতা সদলবলে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন না।) এর জন্যে মুসলিম নেতারাই দায়ী। জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি স্বাভাবিক বৃত্তি। নেতারা এদের স্বাধীনতার স্পৃহাকেই নির্মূল করে দিয়েছেন। কংগ্রেস যখন বিদেশী রাজার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবার সংগ্রামে লিপ্ত তখন মুসলিম লীগ কেবলমাত্র হিন্দুর প্রাধান্য থেকে মুক্তি কামনা করেছে। এ দুইয়ে আকাশ পাতাল প্রভেদ। মুসলিম নেতারা মুসলিম জনগণকে ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। যাদুশী ভাবনা তাদুশী সিদ্ধি। মুসলিম সমাজ পাকিস্তান চেয়েছে, পাকিস্তান পেয়েছে। স্বাধীনতা চায়নি স্বাধীনতা পায়ও নি। পাকিস্তানের পূর্ব পশ্চিম কোন অংশেরই জনগণ আজ পর্যন্ত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। বাঙালি মুসলমান বাঙালি বলেই পরাধীনতার জ্বালা এতদিনে টের পেয়েছে। সেজন্যেই স্বাধীনতার তৃষ্ণা জেগেছে। মুজিবুর নেতৃত্বের মহিমা এই যে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করে তাকে অর্থনীতির ভিত্তিতে স্থাপিত করেছেন। এদিক থেকে তিনি ফজলুল হক এর উত্তরাধিকারী। হক সাহেব বলতে গেলে সারাজীবনই সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত ছিলেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে নিজে যাই হােন, জনগণের মধ্যে তিনি অসাম্প্রদায়িক মনােভাব বিস্তার করতে পারেননি। মুজিবুরই সর্বপ্রথম দেশ গঠনের প্রয়াসে ধর্ম-নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মনােভাব গড়ে তােলবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য কতখানি কৃতকার্য হয়েছেন তা পরীক্ষা সাপেক্ষ। মনে হয় মুজিবুরের প্রভাব শিক্ষিত যুবক মহলে, প্রধানত তার সমাজেই আবদ্ধ। দেশের অভ্যন্তরে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত জনগণ ভােট আওয়ামী লীগকে দিয়ে থাকলেও কার্যকলাপে তারা মুসলিম লীগ পন্থী। (ভারতবর্ষেও একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ আছে। তারাও যে কালের সঙ্গে গা মিলিয়ে চলছে এমন নয়। এরও ফল শুভ হবে না।) পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ এখনও কতখানি সক্রিয় তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গ থেকে যারা পালিয়ে আসছে তার শতকরা আশিজন হিন্দু। এখনতাে শুনেছি শুধু হিন্দুরাই আসছে। তাদের বাড়ি ঘর জমিজমা জবর দখল করে, লুটপাট সর্বস্বান্ত করে
৭৮
যারা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে তারা পাক সৈন্য নয়, স্থানীয় মুসলমান। (ষাট লক্ষ মানুষ ওপার থেকে এপারে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। অর্থাৎ এপার বাংলা ওপার বাংলাকে আমরা যত কাছে মনে করছি তত কাছে নয়। অর্থাৎ হিন্দুর কাছে বাংলাদেশ এখনও দূর অস্ত। অপ্রিয় সত্য হলেও স্বীকার করতে হবে যে কোন সমস্যার অতিরিক্ত সরলীকরণ মূখতার লক্ষণ।) হিন্দু উচ্ছেদে পাক সৈন্যের উস্কানি কিছুটা থাকতেও বা পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আগেও যে বহু লক্ষ হিন্দুকে চলে আসতে হয়েছে তখন পাক সৈন্যের উস্কানি ছিল না। এখন প্রশ্ন হল পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হলেও এসব হিন্দু কি আর পুর্ববঙ্গে ফিরে যাবে? পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হওয়া যতখানি কঠিন ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হওয়া তার চাইতে ঢের বেশি কঠিন। পূর্ববঙ্গ থেকে পাক সরকারের উচ্ছেদ হলেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ উৎপাটিত হতে আরাে বহু বহু দিন লাগবে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে একটি কথা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে—শুধু দেশের নাম বাংলাদেশ দিলেই হবে না, তাকে বাঙালি জাতির বাসভূমি করে তুলতে হবে। বাঙালি বলতে তাে শুধু বাঙালি মুসলমান নয়। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান মিলে যে বাঙালি জাতি তার প্রকৃত বাসভূমি এখন একটিই আছে—সেটি পশ্চিম বঙ্গ। বাঙালি জাতির মর্যাদা রাখলে তবেই বাংলাদেশ নাম সার্থক হবে নতুবা সে নাম একটি প্রচণ্ড পরিহাসে পরিণত হবে।
ষাট বছরের বিষ ষাট দিনে যাবার নয়। তথাপি আশা করা যায় যুদ্ধের ফলে খানিকটা বিষক্ষয় অবশ্যই হবে। স্বাধীনতার অর্থ বুঝলে ধর্মান্ধতার অনর্থ তারা বুঝতে পারবে। মনে রাখতে হবে যে ইংরেজ রাজত্বের শুরু থেকে গত দু’শ বৎসরের মধ্যে এই প্রথম একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ একান্তে আপন স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে। এটাই একটা বিপ্লবাত্মক ঘটনা। এই সঙ্গে লক্ষ্য করবার বিষয় যে যাবতীয় মুসলিম সমাজ এ যাবৎ কথায় বা কাজে পূর্ববঙ্গের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তেমন কোন সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। পৃথিবীর যেখানেই মানুষ স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত স্বাধীনতা প্রেমিক মানুষ মাত্রই তাকে আন্ত জানাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলিম সমাজে এই অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াটি বড় একটা দেখা যায় না মুসলমান না হয় মুসলমানের উপর একটু অত্যাচারই করেছে—তাও মাত্র তেইশ বছর ধরে সেটাকে অত্যাচার না বলে ইসলামী কুটুম্বিতা বলে মেনে নেওয়াই ভাল—এই যার মনােভঙ্গি সে সমাজের ভবিষ্যৎ কী পূর্ববঙ্গবাসী মুসলমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমান মুসলমান বলেই একে অন্যের পরম বান্ধব, এই ভ্রান্তির অপনােদন আশা করি বিশলাকরণীর কাজ দেবে। পূর্ববঙ্গের যুবক সম্প্রদায় যারা শেখ মুজিবুরের প্রধানতম সহায় তারা যদি ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করতে পারেন তাহলে এর শুভ ফল সমগ্র মুসলিম জগতে দেখা দেবে। এই একটি কারণে পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম সমাজ পিছিয়ে আছে। তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক সে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার অবর্তমানে তুরস্ক আবার সেই গােলক ধাঁধায় গিয়ে পড়েছে। এককালে ইজিপ্টের নেতারাও ঐ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু স্থায়ী ফল কিছু হয়নি। পূর্ববঙ্গের এই ব্যাপারে আরব রাষ্ট্রসমূহের প্রতিক্রিয়া স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয় মুসলমানী প্রতিক্রিয়া।
পূর্ববঙ্গে যা ঘটেছে তা যে সত্যিকারের বিপ্লব শেষ পর্যন্ত তা প্রমাণিত হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। এ প্রান্তেও অন্ধ মানুষের চোখ ফুটবে। স্বাধীনতার অভাবে সাধারণ মানুষ কতখানি নিপীড়িত এবং প্রবঞ্চিত সে চিন্তা তাদেরও মনে আসবে। যে পাক সৈন্য আজ নির্বিচারে ধ্বংস করছে, হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তারাও নতুন কিছু শিখে যাবে। স্বাধীনতার স্পৃহা দুর্বল অসহায় মানুষকে কতখানি বলবীর্য দিতে পারে সে তাে তারা নিজের চোখে দেখছে। অবশ্য জঙ্গী শাহী সহজে কিছু শেখে না। আয়ুব-এর নাকানি চুবানি দেখেও ইয়াহিয়া কিছুই শেখেন নি। বেশি কেরানি দেখাতে গিয়ে সমস্ত পাকিস্তানকে এক বিপর্যয়ের মুখে এনে ছেড়েছেন। সারা দুনিয়ায় আজ পাকিস্তানের কোন প্রেস্টিজ নেই। বিদেশে পাকিস্তানীরা গর্বের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিতে পারছে না । এর ফলে নিজ দেশের শাসক সম্প্রদায়ের উপর দেশবাসী বিরূপ এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে। এভাবেই বিপ্লবের সূচনা হবে এবং এক আধ বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানেও তােলপাড় শুরু হয়ে যাবে।
অবশ্য সামরিক শাসন গিয়ে অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই সাধারণ মানুষের দুর্দশা ঘুচে যাবে এমন মনে করবার কোনই কারণ নেই। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এখনও মধ্যযুগীয় ফিউডেল সমাজের প্রতিনিধি। এদের কাছ থেকে জনকল্যাণমূলক শাসন ব্যবস্থা আশা করা সুদূরপরাহত। ধর্মকেই
৭৯
exploitation-এর প্রধান অস্ত্র হিসাবে এরা এতকাল ব্যবহার করে এসেছেন পরেও তাই করতে থাকবেন। এটি তাদের ব্রহ্মাস্ত্র, এ ছাড়া আরেকটি আগ্নেয়াস্ত্র আছে সেটি ভারত-বিরােধিতা। ভারতবর্ষ পাকিস্তানের একটি দুঃস্বপ্ন। দ্রিায় জাগরণে সারাক্ষণ ও ভূত দেখছে। ফলে তার কার্যকলাপ সমস্তই ভূগ্রস্তের মতাে। খুব মজার কথা বর্তমানের বিরােধটি বেঁধেছে পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগণের সঙ্গে কিন্ত ভাবে ভঙ্গিতে কর্মে চিন্তায় প্রধান প্রতিপক্ষ হল ভারতবর্ষ। আগেই বলেছি, আবারও বলছি শুধু এই কারণেই ও স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতেও পারছে না, করতেও পারছে না। পরােক্ষভাবে সে নিজেই নিজেকে ভারতের অধীন করে রেখেছে। যে মুহূর্তে ও দেশের জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পাবে সে মুহূর্তেই ভারতের ভূত ঘাড় থেকে নেমে যাবে।
শেষ করবার আগে আরেকটি কথা বলা আবশ্যক। বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে নানা লেখক ইংরেজি বাংলা নানা পত্রিকায় লিখছেন। ভারত সরকার নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কেন সর্বপ্রকার সাহায্য করছেন না তাই নিয়ে অনেকে অত্যন্ত অধৈর্য প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে ভারত সরকারের উচিত এ মুহূর্তে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা। এই ব্যাপারের যে পরিণতি সকলের কাম্য এরূপ অধৈর্যের ফলে সেটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবার আশংকা। মুসলমান মুসলমানের মিত্র না হয়ে কি ভয়ংকর শত্রু হতে পারে—এই উপলব্ধিটিই ঐ বিষবৃক্ষের অমৃত ফল। বিষক্ষয় একমাত্র এভাবেই হতে পারে। বর্তমান প্রতিরােধ যেভাবে চলেছে সে ভাবে চলতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাতে সময় লাগবে, অনেক ত্যাগ স্বীকার অনেক দুঃখ বরণ করতে হবে। স্বাধীনতাকে অর্ধমূল্যে ক্রয় না করে পূর্ণ মূল্য দিয়ে অর্জন করাই ভাল। বিশেষত ভারত যে মুহূর্তে যুদ্ধে লিপ্ত হবে সে মুহূর্তে ব্যাপারটার আকৃতি প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। সমস্ত মুসলিম জগৎ ক্ষিপ্ত হবে চেঁচাতে শুরু করবে হিন্দু ভারতবর্ষ মুসলিম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করেছে। ইসলাম বিপন্ন জিগীর ভােলা হবে। আজকে যে জিনিস স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা লাভ করেছে সে জিনিস হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় পরিণত হবে। তাছাড়া ভারত এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্র এখন নীরব তারা আর নীরব থাকবে না। তখন এদের সকলের পাকিস্তান প্রেম উপচে পড়বে। মনে রাখতে হবে যে নাবালক পাকিস্তানের মুরুব্বীরা সাবালক ভারত বর্ষকে কখনই প্রীতির চক্ষে দেখেনি।
পূর্ববঙ্গের ঘটনা নানা দিক থেকেই বিপ্লবাত্মক। বিপ্লবে নানাভাবে যেমন মানুষের প্রাণান্তও ঘটে তেমনি আবার নানা বিষয়ে ভ্ৰমান্তও ঘটে। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রের ন্যায়-অন্যায় বােধ এবং শুভবুদ্ধি কতখানি এই ব্যাপারে সকলের কাছে তা পরিস্ফুট হয়েছে। পৃথিবীর যত স্বার্থান্ধ জাতি অপর এক ধর্মান্ধ জাতির অধার্মিক কার্যকলাপে পরােক্ষভাবে সাহায্য দিতে ব্যগ্র। যেখানে বর্বরতা সেখানেই মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সুসভ্য আমেরিকা। মুখে সাধু ভাষণ, আড়ালে অস্ত্রের চোরাচালান। অপরদিকে রুশের পৌরুষ দেখা গেল চীনকেও চিনতে বাকি থাকল না। পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষ যেমন পূর্ববঙ্গের জনগণের কাছে সম্পূর্ণরূপে exposed. এ সব বড় বড় রাষ্ট্রও তেমনই সভ্য জগতের কাছে exposed অভিভাবক রাষ্ট্রসংঘ যে কী হাস্যকরভাবে অক্ষম এবং অসহায় তাও পৃথিবীর মানুষ দেখে নিল। সুখের বিষয় শত অভাব অনটন সত্ত্বেও ভারতবর্ষ যেভাবে আর্তজনের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সেই সঙ্গে আরাে একটি সত্য পরিস্ফুট হয়েছে যে বহু বর্বরােচিত প্ররােচনা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ এ ব্যাপারে যে বীরােচিত ধৈর্য এবং উদারতার পরিচয় দিয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ পৃথিবীর সুসভ্যতম দেশ।
দেশ, সংখ্যা ৩৭
১ শ্রাবণ ১৩৭৮