মিছিলের নাম শপথ
এম. আর আখতার
শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কয়েকজন ছাত্র মিলে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসলাম । ওয়ারী এলাকায় ডক্টর নন্দীর বাড়ির ঠিক উল্টো দিকটার খােলা জায়গাটাতে রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তীর আয়ােজন করলাম। আজ থেকে একুশ বছর আগে, ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবার মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত ঢাকা নগরীর বুকে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালনের প্রচেষ্টা একটা
৪৯
দুঃসাহসিক কাজ বইকি! প্রথমে বে-সরকারী পর্যায়ে আমাদের নানাভাবে এ ধরনের একটা আদর্শ-বিরােধী কাজ না করার জন্য বলা হলাে। এরপর আকারে ইঙ্গিতে ভীতি প্রদর্শন করা হলাে কিন্তু কিছুই আমাদের দমন করতে পারলাে না। একদল আমাদের এমর্মে উপদেশ দিলেন যে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর একই সঙ্গে আমরা যেনাে ইকবালের জন্মদিনটাও পালন করি। কেননা এতে করে সরকারের ইঙ্গিতে ভীতি প্রদর্শন করা হলাে, কিন্তু আমাদের এক কথা। বাঙালি সংস্কৃতি-বাঙালি কৃষ্টি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক রবীন্দ্রনজরুল জয়ন্তী উৎসব করবােই। রেডিওর নামকরা গায়ক-গায়িকারা আমাদের অনুষ্ঠানে যােগদানে অক্ষমতা জানালাে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা পর্যন্ত বিনীত-ভাবে ক্ষমা চাইলেন। তবুও নির্দিষ্ট স্থানেই আমাদের আয়ােজিত রবীন্দ্র-জয়ন্তী অনুষ্ঠান হলাে। কিন্তু এর পরেই দেখা দিলাে আসল বিপদ। আমাদের মধ্যে তিনজনের নামে বিনা বিচারে আটক করবার হুলিয়া বেরুলাে। কুমিল্লার ওলী আহাদ, রংপুরের জাহেদুল হক আর ময়মনসিংহের সেলিম আত্মগােপন করলাে। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুদের পরামর্শে বরিশালে আব্বার কাছে চলে গেলাম। আব্বা এই বরিশালেই তখন পুলিশের ডি এস পি । দিন কয়েক পরের একটা ঘটনায় পাকিস্তানের আসল চেহারাটা আমার কাছে উলঙ্গ ভাবে ধরা পড়লাে।
বরিশাল শহরের টাউন হলটার ঠিক উল্টো দিকে ছােট একটা বইয়ের দোকান। মালিক আর কর্মচারী বলতে একজনই থাকতেন। শুনলাম সেই ভদ্রলােককেই বিনা বিচারের ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরাধ—ভদ্রলােকের দোকানে ম্যাক্সীম গীর প্রখ্যাত উপন্যাস ‘মা’ বইটার বাংলা অনুবাদ (নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ) পাওয়া গেছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম।
মুসলিম লীগের নেতৃত্বে নুরুল আমীন সরকারের তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। পূর্ব বাংলায় তখন বাংলা সাহিত্য কৃষ্টি আর ভাষার দারুণ দুর্দিন। অনেকেই জাতে উঠবার উদগ্র বাসনায় অনেক কষ্টে উর্দু ভাষা আর ‘তাহজীব তমুদুন রপ্ত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাকীরা ইংরেজির আশ্রয় নিয়েছেন। খােদ ঢাকা শহরেই দোকান-পাটের সাইনবাের্ডগুলাে উর্দু ভাষায় বদলিয়ে যেতে লাগলাে। আর মওলানা মােহাম্মদ আকরাম খার দৈনিক আজাদের প্রচেষ্টায় রাতারাতি বাংলাভাষায় শত শত উর্দু শব্দের আমদানি হলাে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সিলেবাস-গুলাের দ্রুত পরিবর্তন ঘটলাে। ছােটদের ইতিহাস বই-এ লেখা হলাে ‘আলেকজান্ডারের পাকিস্তান আক্রমণ, নাদির শাহের কাফের নিধন আর আরবের ‘খেলাফতে রাশেদীনের কাহিনী। ছলে, বলে, কৌশলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বুঝানাে হলাে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও কৃষ্টি হিন্দু-বাংলার সম্পদ। প্রকৃত মুসলমান হতে হলে বাঙালিদের আরবী ও উর্দু ভাষা শিখতে হবে, আরবের ইতিহাসকে নিজেদের ইতিহাস বলে গণ্য করতে হবে আর ধর্মীয় ভিত্তিতে জাতির কথা চিন্তা করতে হবে। জাতীয় কবি হিসেবে আল্লামা ইকবালের লেখা পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথা ভুলে যেতে হবে ; বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্রের কথা ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করা যাবে না।
এমনি এক পরিবেশের মধ্যে ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন শুরু হলাে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ’জন ছাত্র নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলাে। সমগ্র গণতন্ত্র বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখলাে পূর্ব বাংলার মুসলমান ছাত্ররা বাংলা মাতৃভাষার অধিকার রক্তের বিনিময়ে আদায় করলাে।
কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী অত্যন্ত সন্তর্পণে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও কৃষ্টির উপর তাদের হামলা অব্যাহত রাখে। এরই অংশ হিসেবে নুরুল আমীন সরকার কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমস্ত বাংলা দৈনিক পত্রিকার বিক্রি বেআইনী ঘােষণা করে। এছাড়াও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব বাংলা সরকারের সুপারিশে দুই বাংলার মধ্যে সহজ যাতায়াত বন্ধের উদ্দেশ্যে পাক-ভারত পাসপাের্ট প্রথা চালু করা হয়। কেননা ক্ষমতাসীন চক্রের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিলাে যে, উভয় বাংলার মধ্যে সহজ যাতায়াত এবং পত্র-পত্রিকার আদানপ্রদান অব্যাহত থাকলে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ দারুণভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
তবুও ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ আসনের ২২৮ টা আসনে পরাজিত হলাে। নুরুল আমীন মন্ত্রিসভার সমস্ত সদস্যই পরাজয়ের গ্লানি বহন করলাে। পূর্ববাংলার ছাত্র ও যুব সমাজ এই নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে অভূতপূর্ব ফল লাভ করলেন।
৫০
অত্যন্ত ধীর ও মন্থরগতিতে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবী মহল, বিশেষ করে শিক্ষক সম্প্রদায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সচেতন হলাে। তবুও এরা মধ্যবিত্ত সুলভ মনােভাবের দরুণ নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসতে সংকোচ বােধ করলেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে প্রকাশ্যেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের আহ্বান জানালেন। কলকাতা থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্ৰীতারাশংকর, শ্রীমতী রাধারাণী দেবী, শ্রীপ্রবােধকুমার সান্যাল, জনাব আব্দুল ওদুদ ও জনাব হুমায়ুন কবীর প্রমুখও এই সম্মেলনে যােগ দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে তিতুমীর, সূর্যসেন ছাড়াও ডা: বিধান রায় তােরণ পর্যন্ত তৈরি করে বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টা করলেন। এই সম্মেলনেই মওলানা সাহেব ঘােষণা করেছিলেন, “পূর্ব বাংলার প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসন যদি আদায় না হয় তবে আমি পশ্চিম পাকিস্তানকে আস্-সালামু-আলায়কুম(চিরবিদায়ের শেষ ইঙ্গিত) বলতে বাধ্য হবাে।” এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানী-ঘেষা ও প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক মহল মওলানা ভাসানীর এ ধরনের বিবৃতির তীব্র সমালােচনা করলাে। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের চীফ রিপাের্টার হিসেবে মওলানার পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ধরনেরই বিবৃতি সংগ্রহ করতে লাগলাম। এমনি এক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ নির্দেশক্রমে পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলা বইয়ের আমদানি দারুণভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হলাে। বাংলা গানের রেকর্ড ও বাংলা সিনেমা আমদানিও দ্রুত হ্রাস পেলাে। পূর্ব বাংলার বাজারে বিশ্ব ভারতীর বই পর্যন্ত দুর্লভ হয়ে উঠলাে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ও গুটি কয়েক জায়গা ছাড়া বাংলা সাহিত্যের গবেষণামূলক পুস্তক একেবারে উধাও হয়ে গেলাে। ছাত্রদের দাবি অনুসারে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা হলেও সরকারী কারসাজির ফলে এর কর্তৃত্ব এক রকম বলতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলদের কুক্ষিগত হলাে।
এমনি এর সময়ে সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৬ সালে সর্বপ্রথম বিদেশ সফরের সুযােগ লাভ করলাম। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে আমরা বারােজন সাংবাদিক তুরস্ক সফরে গেলাম। পাকিস্তান অবজারভারের বার্তা সম্পাদক এ বি এম মূসা ও আমি ছাড়া বাকী দশ জনই পশ্চিম পাকিস্তানের। একদিন বিকেলে ইস্তাম্বুল রেডিও স্টেশনে বসে আমরা জনা কুড়ি তুর্কী সাংবাদিকের সঙ্গে ঘরােয়া আলাপ করছিলাম। এমন সময় একজন তুর্কী সাংবাদিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ..সংবাদপত্র নওয়ায়ে ওয়াক্ত পত্রিকার সম্পাদক আমিন নিজামী জবাব দিলেন, “উর্দুই হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ গম্ভীরভাবে এ বি এম মূসা বললাে, “নিজামী সাহেব ভুল জবাব দিয়েছেন বলে আমরা দুঃখিত। বাংলাই হচ্ছে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা আর বাঙালিরাই হচ্ছে পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ। আর যায় কোথায়? তুর্কী সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাে। এদিকে আমাদের মধ্যে শুরু হলাে তুমুল ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত একটা শর্তে ঝগড়ার মীমাংসা হলাে। প্রথমে আমিন নিজামী তার বক্তব্যের সংশােধন করে ওদের জানাবেন যে, বাংলা আর উর্দু, দুটোই হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা পরে মূসা এই সংশােধিত বক্তব্যের সমর্থন করবেন।
পাকিস্তানে এরকম ঘটনা তখন অহরহ ঘটতে শুরু করেছে। আর সরকারী প্রচার-যন্ত্র গুলাে খুবই সন্তর্পণে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরােধিতা করেই চলেছে। নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে শুধু বেছে বেছে নজরুলের ইসলামী গজল ও সংগীত পরিবেশন করা হচ্ছে তাই-ই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নজরুলের গান এডিট পর্যন্ত করা হচ্ছে। সংবাদপত্রের অফিসগুলােতে উজিরে আজম না প্রধানমন্ত্রী, উজিরে আলা-না মুখ্যমন্ত্রী, পানিস্ফীতি না জলস্ফীতি জল-পানি না নাস্তা, তাহজ্জীব না সংস্কৃতি, জবান না ভাষা এসব শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে প্রায় রােজই দুপক্ষের মধ্যে জোর তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। আর ছাত্রদের রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালনের সংবাদ না ছাপার জন্য ‘অদৃশ্য স্থান থেকে জোর তাগাদা আসছে।
এমনি এক অবস্থায় পাকিস্তানে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে প্রথম সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলাে। চারদিকে এক সন্ত্রাসের অবস্থা। ছাত্র নেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দলে দলে কারান্তরালে পাঠানাে হলাে। সংবাদপত্রের উপর জারি হলাে কড়া সেন্সরশিপ। সরক পােষকতায় সৃষ্টি হলাে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরাে। পূর্ববাংলায় বাংলা সাহিত্যে শুরু হলাে এক বন্ধাত্বের যুগ। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন করার
৫১
ব্যাপারে সরকার থেকে তার বিরােধিতার সৃষ্টি হলাে। এমন কী সরকারী চাপে অনেকেই রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি থেকে সরে দাঁড়ালেন। তবুও ছাত্র সমাজের সক্রিয় সমর্থনে বেশ কয়েকজন মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সরকারী পৃষ্ঠপােষকতার রবীন্দ্র-বিরােধী অভিযান অব্যাহত থাকলাে। পূর্ব বাংলার ৪৫জন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সঙ্গীতজ্ঞ ও বেতার শিল্পী প্রকাশ্য বিবৃতিতে রবীন্দ্র বিরােধিতার সমর্থন জানালেন। এঁদের মধ্যে সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ‘মুজিবুর রহমান খান, মােহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, কবি ফররুখ আহম্মদ, শিক্ষাবিদ ডা: সাজ্জাদ হােসেন, বজলুর রশীদ, ডা: হাসানুজ্জামান এবং কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা অন্যতম। অবশ্য ডা: কাজী মােতাহের হােসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, ড. কুদরাত-ই-খুদা-প্রমুখ বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক রবীন্দ্র চর্চার সপক্ষে বিবৃতি দান এমনকি শােভাযাত্রা পর্যন্ত বের করলেন।
পূর্ব বাংলার রবীন্দ্র ভক্তদের মধ্যে ডক্টর কাজী মােতাহের হােসেন পরিবারের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়। কাজী সাহেবের কন্যা সনজীদা খাতুন (মিনু) ও তাঁর স্বামী প্রখ্যাত সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকের সম্মিলিত
ন্দ্র সংগীতের চর্চার অন্যতম সংস্থা ছায়ানট গড়ে ওঠে। অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পূর্ব বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় লেখক আহমেদুর রহমান কায়রােতে পি আই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। জনাব রহমান দৈনিক ইত্তেফাকে ভীমরুল ছদ্মনামে লিখতেন।
এর মধ্যে ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা পাওয়া একেবারেই দুষ্কর হয়ে উঠলাে। চোরাচালানী হয়ে যেসব পত্র-পত্রিকা আসলাে তা সীমান্তবর্তী জেলাগুলােতেই নিঃশেষিত হতাে। সামান্য আমদানি লাইসেন্সে যে কজন পুস্তক আমদানিকারক পশ্চিম বাংলা থেকে বই আমদানি করতে সপ্তাহে কয়েকবার করে তাদের দরজায় ধর্না দিতে হতাে। নিয়মিত দেশ পত্রিকা পাবার জন্য আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের (ভাসানী যখন ইউরােপে পুস্তকের লেখক)। এ পুস্তক পূর্ব বাংলার বেআইনী ঘােষিত হয়েছে) বুকস অ্যান্ড ম্যাগাজিন্স-এ দশ টাকা করে সিকিউরিটি জমা রাখতাম। এরপর ‘দেশ’এর প্যাকেট এলে ভদ্রলােক সিকিউরিটি জমা দেয়া গ্রাহকদের নাম প্রতিটা ‘দেশ’-এর উপরে লিখে লুকিয়ে রাখতেন। এভাবেই আমরা ‘দেশ’ পড়তাম। পশ্চিম বাংলার শারদীয় সংখ্যাগুলাে সংগ্রহ করতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হতাে। উল্টোরথ আর জলসা শারদীয় সংখ্যার জন্য আমাদের অগ্রিম পঁচিশ টাকা করে জমা রেখে কিনতে হতাে। এগুলাে কাঠমুণ্ডু হয়ে ঢাকায় আসতাে। আর রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড সে তাে দুপ্রাপ্য জিনিস। ভারতীয় শিল্পীদের গাওয়া চিত্রাঙ্গদা লংপ্লে রেকর্ড কিনেছিলাম পঁচাত্তর টাকায়। গুটিকয়েক রেকর্ড সিংগাপুর হয়ে ঢাকায় এসেছিলা। এ ছাড়া কালে ভদ্রে দু একজন বন্ধু কলকাতায় যাচ্ছে শুনতে পেলে টাকা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। শুধু অনুরােধ রবীন্দ্র সঙ্গীতের লংপ্লে আর না হয় বাংলা বই ও পত্র পত্রিকা।
নতুন বাঙালি জাতির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের বই পড়ার এক অভূতপূর্ব প্রবণতা লক্ষ্য করে পূর্ব বাংলায় এক নতুন ধরনের ব্যবসা শুরু হলাে। এ ব্যাপারে ঢাকার স্ট্যন্ডার্ড পাবলিশার্স সবচেয়ে অগ্রণী হলেন। এঁরা বেপরােয়াভাবে পশ্চিম বাংলার বই পুনর্মুদ্রণ শুরু করলেন। সরকার আইন মতাে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারলাে না। কেননা বই তাে আর আমদানি করা হচ্ছে না বইগুলাে পুনর্মুদ্রণ করা হচ্ছে। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিকেশানের দেখাদেখি অজস্র প্রকাশক কলকাতার বই পুনমুদ্রণের ব্যবসায় মেতে উঠলাে। এক সময় দেখা গেলাে যে ঢাকার শতকরা প্রায় চল্লিশটা প্রেসই শুধুমাত্র ভারতীয় পুস্তক পুনর্মুদ্রণে ব্যস্ত রয়েছে। ঢাকা শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে সুদূর গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রচুর বই পুনর্মুদ্রিত অবস্থায় বিক্রি হতে শুরু করলাে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, প্রবােধ সান্যাল মনােজ বসু ছাড়াও সৈয়দ মুজতবা আলী গৌরকিশোের ঘােষ (রূপদর্শী)। বিমল মিত্র, শংকর, যাযাবর প্রমুখ লেখকদের বইয়ের দারুণ চাহিদা দেখা দিলাে।
৫২
আর কলকাতার বই পুনর্মুদ্রিত বেআইনী করে অর্ডিন্যন্স পাস করেনি। আর দ্বিতীয়ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত পুস্তকের পূর্ববঙ্গে আমদানি সরকার বন্ধ ঘােষণা করেনি কিংবা করতেও পারবে না।
এদিকে পূর্ব বাংলায় কলকাতার বইয়ের এ ধরনের বাজার দেখে করাচী আর লাহােরের পুস্তক ব্যবসায়ীরাও এ ব্যবসায়ে মেতে উঠলাে। লাহাের থেকে এক অদ্ভুত উপায়ে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারী ছাপা হলাে। এরা এক কপি এ টি দেবের ডিকশনারী জোগাড় করে প্রতিটি পাতা ফটো অফসেট করে বই ছাপালাে। এমনকি শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ বই-ই লাহােরে ফটো অফসেটে পুনর্মুদ্রিত হলাে।
কিন্তু সবাইকে টেক্কা দিলেন ঢাকার এক পুস্তক ব্যবসায়ী। তিনি দিব্যি ঢাকা থেকে সঞ্চিতা ও সঞ্চয়িতা ছাপালেন আর সঠিকভাবেই নিজের নাম ও ঠিকানা প্রকাশকের স্থানে উল্লেখ করলেন। শুনেছি ভালাে উকিলের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েই তিনি এই কাণ্ড করেছিলেন। শুধু দুটো বইয়ের উপরে অধ্যাপক রাহাত খান সম্পাদিত কথা কটা জুড়ে দিলেন। অর্থাৎ অধ্যাপক রাহাত খান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা ও নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা ঢাকা থেকে সরকারের আইনের চোখে ধুলাে দিয়ে ছাপা হলাে। শেষ পর্যন্ত ঢাকার ফুটপাতগুলাে কলকাতার পুনর্মুদ্রিত পুস্তকে ভরে গেলাে। আর-প্রতিটা ট্রেন ও স্টীমারে এক ধরনের ফেরীওয়ালা প্লাস্টিকের ব্যাগে করে এসব বই প্রচুর বিক্রি শুরু করলাে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেলাে।
তবু পূর্ব বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলা গবেষণামূলক পুস্তকের অভাবে নিদারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হলাে। কেননা পুস্তক প্রকাশকেরা এসব গবেষণামূলক পুস্তকের পুনর্মুদ্রণে বিশেষ মুনাফার আশা নেই দেখে পিছিয়ে পড়লেন। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে কয়েকটা গবেষণামূলক পুস্তক প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ডক্টর আহম্মদ শরীফের পদ্মাবতী, ডক্টর নীলিমা ইব্রাহীমের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, ডক্টর আনিসুজ্জামানের বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ডক্টর দীন মােহাম্মদের ভাষার ইতিহাস অধ্যাপক, আব্দুল হাইয়ের ধ্বনি তত্ত্ব ও ধ্বনি বিজ্ঞান, অধ্যাপক আব্দুল হাই ও অধ্যাপক আনােয়ার পাশার যুগ্ম সম্পাদনায় চর্যাপদ প্রভৃতি অন্যতম। তবুও বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে গবেষণামূলক পুস্তক থেকে নােট টুকতে হয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সমস্ত বছরই এসব ছাত্র-ছাত্রীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হয়েছে। তবুও এদের মনে-প্রাণে এক দুর্জয় প্রতিজ্ঞা, বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে জানতেই হবে। সমস্ত হামলার বিরুদ্ধে ঐতিহ্যপূর্ণ এই বাংলা সাহিত্যকে রক্ষা করে বিশ্বের দরবারে প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।
পাক-ভারত সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন থেকে আইয়ুব খাঁর দোসর ও পূর্ব বাংলার তৎকালীন গভর্নর মােনেম খান নতুনভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর আক্রমণ চালালাে। গভর্নর মােনেম খা একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ আব্দুল হাইকে গভর্নর ভবনে ডেকে নিয়ে বললেন আপনারা খালি খালি বইয়া থাকুন ক্যান? দুই চারটা রবীন্দ্র সংগীত লিখবার পারুন না?’ অধ্যাপক হাই ক্ষণিকের তরে হতবাক হয়ে গেলেন। পরে মৃদু হেসে বললেন, স্যার সেটা তাে রবীন্দ্র সংগীত হবে না, হবে আব্দুল হাই সংগীত।
খাজা শাহাবুদ্দীন পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিলেন, ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ রাখতে হবে। সমগ্র পূর্ব বাংলা প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠলাে। তিনি আরও নির্দেশ দিলেন যে, ঢাকা টেলিভিশনে কোন মেয়ে টিপ পরে অনুষ্ঠান করতে পারবে না। ফলে সমস্ত বাঙালি মহিলা শিল্পীই টেলিভিশন বর্জনের হুমকি দিলে উপায়ন্তর বিহীন অবস্থায় এ নির্দেশ কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
এদিকে খাজা শাহাবুদ্দীন বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরা নিয়েও কটাক্ষ করলেন। ফলে পূর্বে বাংলার নারী সমাজের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রীই টিপ পরতে শুরু করলাে। এমনকি বসন্তকালে এসব ছাত্রীরা প্রতিদিনই বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরে ঋতুরাজ বসন্তকে বন্দনা করলাে। বাঙালিদের জোয়ার পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লাে। এমনি সময়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের মহানগর’ প্রদর্শনের ব্যবস্থা হলে কর্তৃপক্ষকে ঢাকা স্টেডিয়ামে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করতে হলাে। কলকাতার বাংলা ছবির জনপ্রিয়তা দেখে শাসক কর্তৃপক্ষ হতভম্ব হয়ে পড়লাে। শুধুমাত্র মহানগরী’ ছবিটা দেখার জন্য পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলা থেকে বাঙালি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই ঢাকায় এসে ভিড় জমালাে। সমগ্র ঢাকা শহর উৎসব মুখরিত হলাে।
৫৩
এর পরেই শুরু হলাে আইয়ুব-বিরােধী গণ-অভ্যুত্থান। এদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সামরিক হেফাজতে রয়েছেন। কিন্তু তার ঘােষিত ছয় দফায় তখন বাঙালি মাত্রই অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বললেন, অস্ত্রের ভাষায় শেখ মুজিবের ছয় দফার জওয়াব দেয়া হবে। কিন্তু গুলি, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, বেয়ােনেট কিছুই এ গণ-অভ্যুত্থানকে দমন করতে পারলাে না। তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হলাে। অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব কারামুক্ত হয়েই গর্জন করে উঠলেন, ‘আনি তিতুমীর, সূর্যসেন আর রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণমুক্ত করতে চাই। আমার এই সংগ্রাম চলবেই। সমগ্র বুদ্ধিজীবী আর শিক্ষক মহল এক অদৃশ্য যাদুমন্ত্রে শেখের প্রতি সক্রিয় সমর্থনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। পূর্ব বাংলা অচিরেই বাংলাদেশে পরিণত হলাে। ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি শােভাবর্ধন করতে লাগলাে। কোটি কণ্ঠে উচ্চারিত হলাে ‘ও আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি।
সুদীর্ঘ তেইশ বছর পর পাকিস্তানের গ্রামােফোন কোম্পানী রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড তৈরি করলে শেখ মুজিব স্বয়ং সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে হাজির হলেন। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে আর সুস্পষ্ট ভাষায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ বাংলাজাতি আর বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করলেন। যে আন্দোলন এতােদিন পর্যন্ত ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা পরিব্যাপ্তি লাভ করলাে। সমগ্র বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির একাত্ববােধের ফলে অন্তরের পুঞ্জীভূত দুঃখ বেদনা ও ক্ষোভের সমন্বয়ে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেলাে। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের প্রায়ই তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পরিষ্কার জানিয়ে দিলাে যে, ক্লাসে সমস্ত বিষয়েরই বক্তৃতা: বাংলা ভাষায় দিতে হবে। এতেই কাজ হলাে। অধ্যাপকেরা দিব্যি বাংলায় বক্তৃতা শুরু করলেন। বাংলাদেশের সর্বত্র মােটর গাড়ির নম্বর প্লেট থেকে শুরু করে দোকানের সাইনবাের্ড পর্যন্ত রাতারাতি পাল্টে বাংলা হলাে। এমন কী দোকানের নামগুলাে পর্যন্ত বাংলায় রূপান্তরিত হলাে।
‘বিশ্রাম’, ‘কিছুক্ষণ’, ‘পান্থশালা’, ‘তৃষ্ণা’ এসব হচ্ছে ১৯৭১ সালে ঢাকায় কয়েকটা রেস্টুরেন্টের নাম। বর্ণমালা’ একটা বইয়ের দোকানের নাম। আবরণী’ হচ্ছে একটা কাপড়ের দোকান। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তার নিওন লাইটের বিজ্ঞাপনগুলাে পর্যন্ত বদলে বাংলা হয়ে গেলাে। কই কারাে ব্যবসার সামান্যতম লােকশান পর্যন্ত হলাে না তাে?
ব্যাঙ্কের চেক বই, মনিঅর্ডার ফরম থেকে বের করে সমস্ত কিছুই বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় অনেক আগেই চালু হয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও তাে কারাে অসুবিধা হলাে না? বরং সাধারণ মানুষেরই এতে সবচেয়ে সুবিধা হয়েছে।
এদিকে অনেক আগেই বাংলাদেশে পুরুষদের কাপড়ের পরিবর্তন ঘটেছে। শত প্রচেষ্টা করেও শাসক কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের আচকান-সেরােয়ানীতে অভ্যস্ত করতে পারেনি। পাজামা-পাঞ্জাবিই সেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভালাে একটা সঙ্গীতানুষ্ঠানে গেলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলাে ১৯৭১ সালে মহান নেতা শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে সেই বাঙালি জাতীয়তাবােধ আজ বাংলাদেশে পূর্ণতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক নতুন বাঙালিজাতির জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী বাঙালি জাতিকে সাম্প্রদায়িকতা হিংসা আর বিদ্বেষের অহিফেন খাওয়াতে চেয়েছিলাে, কিন্তু তারা নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে নবজন্ম লাভ করেছে। শােষকের বিরুদ্ধে শােষিতের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্যেই এই নব বাঙালি জাতির সৃষ্টি। বিশ্বের কোন শক্তিই এদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এদের জন্ম অনিবার্য। জয় স্বাধীন বাংলা।
দেশ ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮