You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলাে | আবুল মনজুর - সংগ্রামের নোটবুক

সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলাে
আবুল মনজুর

২৫শে মার্চ, বৃহস্পতিবার
চৈত্রের মধুময় দিনগুলাে শেষ হয়ে আসছে। পাগলা হাওয়ার মতন জীর্ণ পুরাতন সব কিছুকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রমনা পার্কের সবুজ প্রান্তরে গাছে গাছে শুরু হয়েছে কানাকানি। নতুন বছর আসছে। পার্কের সেই বুড়াে বটগাছটির মনে কেন জানি সন্দেহ জেগেছে। আকাশে বাতাসে কিসের যেন আলামত। সে জানে অন্যান্য বছরের মতাে এবার পয়লা বৈশাখে তার চরণমূলে বসবে গানের আসর। নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে ভাবে প্রজাপতির মতাে ছােট ছােট ছেলেমেয়ের দল বাগানে ছােটাছুটি করবে আবার। মাথা তুলে তাকায় বুড়াে বট আকাশের দিকে। দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে বটের বুক চিরে। পাতায় পাতায় উঠে মর্মর ধ্বনি।
সেদিন বিকেলে আমার ডিউটি ছিলাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায়। দেশবিদেশের নামজাদা সব সাংবাদিক ভিড় জমিয়েছেন ঢাকায়। আমাদের তাে ছােটাছুটির অন্ত নেই। একবার শেখ সাহেবের বাসা কখনাে বা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আবার কখনাে বা প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে। শেখ সাহেবের বাসায়
৪১
গিয়ে যখন পৌছেছি তখন বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা। সকালের দিকে শুনেছিলাম যে প্রেসিডেন্ট আজ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন এবং শেখ সাহেব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানাবেন। সবাই অনেক কিছু জল্পনা কল্পনা করছেন। সাংবাদিক ও জনতার প্রচণ্ড ভিড়। সবারই এক প্রশ্ন কী বলবেন, তিনি?
বিদেশী সাংবাদিকরা, কাগজ কলম ও টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। সন্ধ্যে প্রায় সাতটা বেজে গেছে। আমাদের কাগজের চীফ রিপাের্টার আমাকে বললেন, তুমি অফিসে গিয়ে হাতের কাজ সেরে নাও। আমি আসছি। রাত সাড়ে আটটা ন’টার দিকে তিনি ফিরে এলেন। না কিছু বলেননি শেখ সাহেব।
রাত সাড়ে নটা। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে টেলিফোন এল ভুট্টো রাত দশটায় করাচী চলে যাচ্ছেন, আপনারা প্রয়ােজন মনে করলে আসতে পারেন। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে দেখি খাকি পােশাক আর মেশিনগানের কড়া বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে ভুট্টো সাহেব গাড়িতে উঠছেন। কিছুই বলেননি তিনি। অনেক সাংবাদিকের ভিড় জমেছিল। ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গেল যে বিকেল ছটার ফ্লাইটে প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগ করেছেন। মনে একটা সন্দেহ জন্মল: প্রেসিডেন্ট চলে গেলেন, ভুট্টো সাহেবও যাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী?
হােটেল ছেড়ে রাস্তায় এসে দেখি তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। পথে পথে অজস্র লােক। সবাই খুব উত্তেজিত। রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে। একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কী? উত্তরে বললে-তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান, এখুনি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে মিলিটারির সাথে। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন।
তাড়াতাড়ি অফিসে ফিরে এলাম, ভাবলাম এখুনি কারফিউ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। এসে দেখি অফিসের সামনের দুটো গাছ লম্বা হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। আর ইট দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যারিকেড। জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় সােয়া এগারটা বাজে। আমার এক সহকর্মী বললে চলাে, যাবে নাকি বাসার দিকে। মনে হচ্ছে ব্যাপার সুবিধের না। বললাম, তুমি যাও দেখি না কী হয়। ব্যারিকেডের ফাঁক গলে স্কুটার নিয়ে ও বেরিয়েছে মাত্র ঠিক ওর পেছন পেছন প্রচণ্ড গর্জন করে ঠিক আমাদের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল বিরাট মিলিটারী ট্রাক। তাড়াতাড়ি সবাই ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মিলিটারী দেখে বিক্ষোভরত জনতা দৌড়ে পালিয়ে গেল।
রাত প্রায় বারােটা। কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ট্রাক চারটি পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। জনতা দূরে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। ভাবলাম কাগজের অফিসে টেলিফোন করে দেখি এদিকে কিছু হচ্ছে কিনা। লাইন কেটে গেলে বুঝলাম ব্যাপার ভালাে নয়। একটু পরেই শােনা গেল গুলির আওয়াজ। প্রথমে একটি রাইফেলের গুলির আওয়াজ। তারপর শুরু হলাে একটানা গুলির আওয়াজ, বাতি নিবিয়ে দেওয়া হলাে, সারা রাত ধরে চললাে একটানা গােলাগুলির আওয়াজ। আমাদের থেকে মাইল খানেক উত্তরে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি। মেসিনগান আর মটরের আওয়াজ আসছিলাে ওদিক থেকে।
শহরের সব দিকে থেকেই গােলাগুলির আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবাে। কারাে মুখে কোন কথা নেই। মিলিটারি গাড়ি। ভারী চাকার আওয়াজ মেসিনগান, মর্টার আর আগুন। সব মিলিয়ে এক নারকীয় তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজন মিলে ছাদের ওপরে গেলাম। নওয়াবপুর রেল লাইনের ওদিকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। কেবল ওদিকে নয়, আরাে বহু জায়গায় মিলিটারী আগুন লাগিয়েছে। একটু পরেই নওয়াবপুর রেল লাইনের ওদিক থেকে ভেসে আসতে লাগলাে পলায়নমান জনতার আকুল চিৎকার। চিৎকার আর মেসিনগানের আওয়াজ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলাে দেওয়ালে মাথা ঠুকি। আর সহ্য হয় না। এভাবে চললাে সারা রাত। খাওয়া দাওয়া নেই। দুটো টেবিল জোড়া দিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করলাম । বৃথা। এক অজানা ভয়, অনাহার সব কিছু মিলিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে দু’চোখের পাতা এক করা সম্ভব না। বুকের এক পাশ কাপছে থর থর করে। সব কিছুর শেষ হয়। অবশেষে রাত পােহালাে।
২৬শে মার্চ, শুক্রবার তখনাে গােলাগুলির আওয়াজ থামেনি। ছাদের ওপরে এসে দেখলাম শহরে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠছে। তখনাে কেউ কিছু বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কী ঘটছে। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। মিলিটারী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট চো চো করছে। টেলিফোন না থাকায় কোথাও যােগাযােগ করা যাচ্ছে না। সবাই চুপচাপ
৪২
বসে আছি। কাগজ বেরােয়নি। ঢাকা বেতার কেন্দ্র অচল। সুতরাং বােঝার কোন উপায় নেই কারফিউর মেয়াদ কতক্ষণ। সকাল দশটার দিকে মিলিটারী রাস্তায় রাস্তায় ঘােষণা করে গেলাে আজ সারাদিন কারফিউ। আরাে একটা দিন কাটলাে অনাহার, দুশ্চিন্তা, আগুন আর গােলাগুলির মধ্যে দুপুরের বারােটার দিকে ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেসন্স-এর গণ সংযােগ অফিসার মেজর সালেক এলেন। সাথে চারজন রাইফেল ও বেয়ােনেটধারী পাঞ্জাবী সৈন্য। সামরিক দফতরের কতকগুলাে নতুন নতুন বিধি ছাপিয়ে দিতে হবে। যাওয়ার সময় বললেন যে শেখ মুজিবুরসহ আওয়ামীলীগের নেতৃবর্গ প্রায় সবাইকে তারা গ্রেপ্তার করেছেন। মেজর সালেক যাবার পর কেউ কেউ বললাে—এ হতেই পারে না। ব্যাটা মিথ্যে কথা বলছে।
বেলা দেড়টা। কে একজন এসে বলছে ওরা ট্যাঙ্ক নামিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম ছাদে , কয়েকশাে গজ দূরে স্টেডিয়াম। মনে হলাে ওদিক থেকে প্রচণ্ড গােলা বর্ষণের আওয়াজ কানে আসছে, ভাবলাম হয়তাে ট্যাঙ্ক থেকে গােলা বর্ষণ করছে। নীচে নেমে এলাম এর মিনিট পনেরাে পর প্রচণ্ড গর্জন করে আমাদের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালাে তিনটে ট্যাঙ্ক ও দুটো মিলিটারী ট্রাক। দরজা ফাঁক করে কয়েকজন দেখছিল, হঠাৎ একজন চীৎকার করে উঠলাে গুলি করছে গুলি করছে। কাচের জানালা দিয়ে আমি দেখছিলাম সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লাম মেঝেয়, পর পর কয়েকটা গুলি এসে লাগলাে অফিসের দেয়ালে।
বেলা দুটো। ট্যাঙ্ক থেকে কয়েক দফা গােলাবর্ষণ করা হলাে বস্তী এলাকার দিকে, রাস্তার ওপর ব্যারিকেড তখনাে রয়ে গেছে। ট্যাঙ্ক থেকে নামলাে প্রায় জন দশ বার সৈন্য। হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বস্তী এলাকার দিকে এগিয়ে গেলাে তারা। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলাে, সঙ্গে বস্তীর বেশ কিছু লােক। তাদের বললাে ব্যারিকেড সরাও, ব্যারিকেড সরিয়ে দিলাে তারা, রাইফেলের বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা দিয়ে ওদের যেতে দিলাে।
বেলা তিনটে আবার অফিসে এলেন মেজর সালেক। সাথে তার বস ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী ও মিনিস্ট্রী অব ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিংয়ের সেক্রেটারী রােয়েদাদ খান। সাংবাদিকরা যেন কারফিউর সময় ঘােরাফেরা করতে পারে তার জন্যে পাসের বন্দোবস্ত করতে তারা এসেছেন। দেখলাম এ ব্যাপারে তারা বেশ মাথা ঘামাচ্ছেন।
ক্ষিধেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। রাস্তার ওপারে গলির ভেতর বাজার। একজন সাহস করে গিয়ে গােটা বিশেক পাউরুটি কিনে আনলাে। মুখে তেতাে তেতাে ভাব। খেতে পারলাম না। কাগজ বেরুবে না।
রাত হয়ে এলাে। রাস্তায় বাতি নেই, মনে হচ্ছে যেন প্রেতপুরী। গােলাগুলি আর আগুন, এই কেবল চলছে, সারারাত তাই চললাে। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আমার সাপ্তাহিক ছুটি, অন্য সময়ে এতক্ষণে প্রেস ক্লাবে জোর আড্ডা চলছে আমাদের। মুজিব-ইয়াহিয়ার আলােচনাই আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু। আচ্ছায় কারাে মত হচ্ছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা যখন বলেছে ইয়াহিয়া, নিশ্চয়ই তার ওয়াদা পালন করবে। কারাে কারাে মতে মিলিটারী ডিকটেটররা এতাে সহজে কোনদিন ক্ষমতা হস্তান্তর করে না, আর পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজীরও খুঁজে পাওয়া যায় না।
২৭শে মার্চ, শনিবার
সকাল আটটা থেকে বারােটা পর্যন্ত কারফিউ নেই। বেরিয়ে পড়লাম অফিস ছেড়ে রিকশা, বেবী ট্যাকসি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামনেই মর্নিং নিউজ আর দৈনিক পাকিস্তান অফিস। মর্নিং নিউজের জনৈক রিপাের্টারও বেরিয়েছে অফিস থেকে। সাথে তার ভেসপা স্কুটার। আমার বাসার কাছেই থাকে। তার পেছনে চাপলাম। ও বললাে, চলাে একটু রাজারবাগ হয়ে যাই। কিছুদূর যাওয়ার পর এগুনাে সম্ভব হলাে না, রাস্তায় এমনভাবে ব্যারিকেড। মাইল দুয়েক রাস্তা আসতে অন্তত গােটা বিশেক ব্যারিকেড দেখলাম। ভাবতে অবাক লাগে যে এক রাতের মধ্যে সারা শহরে এমন কতাে অসংখ্য ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। মুক্তি পাগল মানুষের এই তাে ছিল মােকাবিলা করার হাতিয়ার।
রাস্তায় এসে শুনলাম পঁচিশের রাতে আমাদের গলিতে মিলিটারী ঢুকেছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে। গল্প করছিলেন আমার বাড়িওয়ালা। হঠাৎ রাত দুপুরে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হলাে আমার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কারা জানি কথাবার্তা বলছে। কান পেতে শুনলাম। বুঝলাম তারা সৈয়দ নজরুল কোন বাড়িতে থাকেন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। মনে হলাে সাথে ম্যাপও নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর তারা সামনে এগিয়ে গিয়ে সৈয়দ নজরুলের আত্মীয়ের বাড়ি খুঁজে বার করলাে।
৪৩
কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলাে রাইফেলের গুলির আওয়াজ। আর তার সাথে ভেসে এলাে মিলিটারীর নির্দেশ নজরুল ইসলাম বাহার আইয়ে, নেই তাে গােলি মারকে ঘর উড়া দুঙ্গা। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন সৈয়দ নজরুলের ভাইপাে। সমস্ত ঘরে তল্লাশী চালালাে মিলিটারী। কিছুই পেলাে না তারা, কেবল সৈয়দ নজরুল যে কামরায় থাকতেন সেখানে পেলাে কিছু কাগজ আর শদুয়েক টাকা। অবশ্য তল্লাশী চালানাের সময় ঘরের অন্যান্য সবাইকে বাইরে রাস্তায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল। একদিন এক রাত খাওয়া দাওয়া নেই। ঘুমও হয়নি। গােসল করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসে না, বাবা মা রয়েছেন চাটগাঁয়, ওদের কী অবস্থা কে জানে। কাগজে দেখেছিলাম চট্টগ্রামের শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের দুটো সভা আমাদের বাসায় হয়েছিল। এর পর তাে আর বাবার বেঁচে থাকার কথা নয়।
২৮শে মার্চ, রবিবার
কারফিউ বিকেল চারটা থেকে ভাের সাতটা পর্যন্ত। ঘুম ভালাে হয়নি। সারা রাত চলেছে গুলির আওয়াজ, কেবল এপাশ ওপাশ গড়াই। আমার বন্ধুটির বেশ ঘুম হয় দেখলাম। সে খাচ্ছেও প্রচুর আমার তাে রুচিই হয় না খাওয়ার, পেটের চর্বি কমানাের জন্যে দুজনে সকালে ব্যায়াম করতাম। এখন দেখি এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সকাল দশটা নাগাদ এলাম প্রেস ক্লাবের দিকে। কেউ নেই, ভয়ে বেয়ারা ম্যানেজার সবাই পালিয়েছে। পশ্চিমের দেয়ালে বিরাট বিরাট দুটো গর্ত। নীচে ছড়িয়ে আছে ইট আর সুরকী। বেশ বড় বড় শেল ব্যবহার করেছে মনে হয়। দূর থেকে দেখলাম। ভেতরে ঢােকার সাহস হলাে না। অফিস কাছেই, অফিসে যাওয়ার পথে দেখলাম এ পি পি [অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান] অফিসের গায়ে অসংখ্য বুলেটের দাগ, সামনে বিপনি কেন্দ্র, বায়তুল মােকাররাম মসজিদের সাথে লাগানাে, সব দোকানপাট বন্ধ। অফিসে এসে দেখি পাকিস্তান অবজারভাব, পূর্ব দেশ, মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান বেরিয়েছে। এক পাতা। সব মিলিটারীর খবর, আরাে খবর শুনলাম যে ইত্তেফাক, সংবাদ ও দি পিপল এই তিনটি কাগজের অফিস মিলিটারী গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছে, কোন সাংবাদিক মারা যাননি। তবে সংবাদ অফিসে যখন মিলিটারী আগুন ধরিয়ে দেয় সে সময় যে লােকটি আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তার নাম অনেকেরই পরিচিত। তিনি হচ্ছেন শহীদ সাবের, এক কালে সংবাদের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। এবং ছােট গল্পেও হাত ছিল খুব ভালাে। পরের দিকে অবশ্য কোন এক কারণে তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
২৯শে মার্চ, সােমবার
শহর ছেড়ে দলে দলে পালাচ্ছে বাঙালিরা। অবাঙালিরা থাকে মীরপুর আর মােহাম্মদপুরে। লুঠতরাজ, হত্যা আর আগুন দেয়া এই তিন নৃশংস খেলায় মেতেছে অবাঙালি ও মিলিটারী । প্রাণের ভয়ে সবাই পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। ছেলে মেয়ে, স্ত্রী ও বুড়াে বাপ মার হাত ধরে যে যার মতাে চলেছে।“ হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনখানে”। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাচ্ছেন। উত্তরে বুড়াে বাপ আর পরিবারের অন্য দশজন সদস্যকে দেখিয়ে বললেন জানি না কোথায় যাবাে তবে এটুকু জানি নদী পার হয়ে যে কোন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেবাে। যদি আশ্রয় না দেয় তবে গাছের নীচেই থাকবাে।
৩০শে মার্চ, মঙ্গলবার
এমনিভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার লােক রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে যাচেছন গ্রামের দিকে। একদিকে সামরিক দপ্তর থেকে যদিও বলা হচ্ছে আপনারা শহর ছেড়ে যাবেন না, পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ ভার আমাদের ওপর। অপরদিকে শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা কোন কথা শুনতে রাজী নন। অফিস আদালত চালু করার ব্যাপারে কারাে কোন উৎসাহ নেই, ব্যবসা বাণিজ্য যাক চুলােয়। দলে দলে বাঙালিরা শহর ছেড়েই চলেছেন।
১লা এপ্রিল, বৃহস্পতিবার
এমন একটি দিন নেই যে মিলিটারী কোথাও না কোথাও আগুন দিচ্ছে। আর যেসব বাড়ি ছেড়ে লােকজন চলে গেছে তারা লুঠ করছে সেইসব বাড়িঘর। অফিসে কোন কাজ নেই রিপাের্টারদের। সবই এরা দিয়ে যায়। তাদের
৪৪
রিপাের্ট অনুযায়ী সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে, অফিস আদালতে আস্তে আস্তে সবাই যােগদান করছেন, তবে প্রদেশের কিছু কিছু এলাকায় সশস্ত্র দুস্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। তবে পাক সেনাবাহিনী তাদের সব জায়গা থেকে আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।
নওয়াবপুর এলাকায় প্রথম কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। অবাঙালিরা লুঠতরাজ ও ঘরবড়ি জোর দখল ও বাঙালি নিধনে খুব ব্যস্ত ছিলাে। আজ ভাবলাম শাঁখারি পট্টি দেখে আসি। আরেকজনকে সাথে নিয়ে গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম উর্দু ও ইংরেজিতে নতুন নতুন অনেক সাইনবোের্ড। শাঁখারি পট্টির ভিতর ঢুকতেই নাকে এল বিকট গন্ধ। মৃতদেহ এখনাে চাপা পড়ে আছে। মিলিটারী বড়াে চালাক। ঘরগুলাে তারা ধুলিসাৎ করে দেয়নি। ভেতরে ঢুকে গােলাগুলি করেছে আর আগুনে বােমা দিয়ে সব কিছু ধ্বংস করেছে। খুবই কর্মমুখর এলাকা ছিলাে এটি। এখন একেবারে চুপচাপ। ইসলামিয়া হােটেল, পাকিস্তান বাের্ডিং ইত্যাদি কয়েকটি সাইনবোের্ড কোন কোন ঘরের সামনে দেখলাম। কয়েকজন কাবুলীকে দেখলাম দোতলা দখল করে নিয়েছে।
২রা এপ্রিল, শুক্রবার
শুনলাম মুশতাককে মিলিটারী হত্যা করেছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলাে। পাকিস্তান, ভারতবর্ষ, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিংহল এ সমস্ত দেশের প্রায় সব নামজাদা ক্রিকেট খেলােয়াড়দের কাছে এ নামটি পরিচিত। কোলকাতা থেকে সে ঢাকায় আসে এবং দশ বারাে বছর ধরে ওকে দেখছি ক্রিকেট খেলার মরসুম এলেই মুশতাক তৎপর। কালাে বেঁটেপানা গােলগাল শরীর ছিলাে ওর। পরনে সব সময় কোর্তা আর পাজামা। বিয়ে থা করেনি, আজাদ বয়েজ ক্লাবের নিজস্ব ভবনে সে থাকতাে। কী তার আয়, কোথা থেকে খাওয়া পরা চলতাে কেউ জানতাে না। ঢাকার ছেলে বুড়াে স্টেডিয়ামের দিকে যাদের যাতায়াত, এমন কেউ নেই তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না বা ওর নাম শােনেনি। রিচি বেনাে, কারদার, মানকড়, কাউড্রে, সােবার্স আরাে অনেকের সাথে তার ছবি রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে চিঠিও লিখতাে।
৩রা এপ্রিল, শনিবার
শহরের প্রায় সব বাজারগুলাে মিলিটারী পুড়িয়ে দিচ্ছে। এমন একটি রাত বাদ নেই কোথাও না কোথাও আগুন জ্বলছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করলাে শেখ সাহেব যে বলেছিলেন তােমাদের ভাতে মারবাে, পানিতে মারবাে বাজারগুলাে পুড়িয়ে তার বদলা নিচ্ছে ওরা এখন। রাত আড়াইটের দিকে গােলাগুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলাে। উঠে দেখি আগুন দেখা যাচ্ছে। শান্তিনগর বাজারে আগুন দিয়েছে।
মনকে অনেক প্রশ্ন করলাম—এরা কী চায়? একদিকে মুখে বলছে আমরা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি অথচ গােলাগুলি আর আগুন দেবার বিরাম নেই কোন। শহর ছেড়ে দলে দলে লােক পালাচ্ছে প্রত্যেকদিন। এভাবে বাজার পােড়ানাে আর লুঠতরাজ চলতে থাকলে তাে কিছুদিন পর শহরে কোন লােকই থাকবে না।
৪ঠা এপ্রিল, রবিবার
এক একটি দিন যাচ্ছে, মনে হয় যেন এক একটি যুগ। প্রতিদিনের নতুন সূর্যোদয়কে অভিনন্দন জানাই। যাক, বিভীষিকার একটা রাত তাে কাটলাে। এর মধ্যে কারফিউ আরেকটু শিথিল করা হয়েছে। সন্ধ্যে সাতটা বেজে ভাের ছটা পর্যন্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুপুরে একটা দুটোর পর থেকেই রাস্তাঘাটে আর লােকজন চলাচল করে না এখন, দোকানপাট যা খােলা তার শতকরা নিরানব্বই ভাগ অবাঙালিদের। তাও দুপুর বেলা সব বন্ধ। বিকেল পাঁচটার পর তাে রাস্তা একেবারে ফাঁকা। কচিৎ দু’একটা প্রাইভেট গাড়ি দেখা যায়।
৫ই এপ্রিল, সােমবার
দুপুর একটাখানেক হবে। যাচ্ছিলাম এক বন্ধুর বাসায়। ও গণ্ডগােলের আগেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে। প্রায় ওর বাসার সামনে এসে গেছি। হঠাৎ আমার রিকশার পেছনে প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় সবাই ছােটাছুটি করছে। আমার বিকশাওয়ালা মাঝপথে রিকশা দাঁড় করিয়ে কোথায় হাওয়া
৪৫
হয়ে গেল। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন দু চারজন তারাও দাঁড় করিয়ে ভাবছেন কী করা যায়। চারদিকে হইচই। তাকিয়ে দেখি কোথাও মিলিটারী নেই। ব্যাপারটা কী? আসলে কিছুই না। টয়ােটা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন এক ভদ্রলােক। তাঁর গাড়ির চাকা ফেঁসে গেছে। ঐ শব্দেই লােকজনের কী অবস্থা। এই হচ্ছে ঢাকার লােকের অবস্থা এখন। কোন আওয়াজ হলেই সবাই চমকে উঠে।
বিকেলে এক বন্ধু এসে উপস্থিত। ও থাকে ধানমন্ডির কাছে ঝিকাতলায়। বললাে, “যেভাবে মিলিটারী গাড়ি আর তাদের সাথে অবাঙালিরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে সাহস হয় না আর ওখানে থাকতে। তােদের এখানে আসবাে ঠিক করেছি।” বিকেলের দিকেও স্ত্রী ও চার বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে আমার এখানে আসলাে। বিদেশে গেছিলাে একবার। সাথে ফ্রিজ, রেডিওগ্রাম আরাে অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলাে। সব রেখেই চলে এসেছে। বললাে, চাকরি থাকলে বিদেশে আবার যেতে পারবাে। লুঠ হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, আবার কিনতে পারবাে।
৬ই এপ্রিল, মঙ্গলবার
সকাল এগারােটা বাজে। যাচ্ছিলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে। শহীদ মিনারের সামনাসামনি আসতেই দেখি বিরাটাকার একটি মিলিটারী ক্রেন শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি উঁচু মিনার গুলাে ভেঙে খুঁড়িয়ে দিচ্ছে। শহীদ বরকত, সালাম , জব্বার ও রফিক। চারজনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে চারটি উঁচু মিনার তৈরি করা হয়েছিল। ক্রেন দিয়ে ওগুলাে তারা ভাঙছে। আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশ পনেরােজন সৈন্য। শহীদ মিনার তারা ভেঙেছে ও দেয়ালের গায়ে আরবী, উর্দু ও বাংলায় লিখে দিয়েছে এটা মসজিদ। পরে শুনেছি এতে জুম্মার নামাজ পড়ানাে হয়েছে। অবশ্য কোন বাঙালি মুসলমান এই নামাজে যােগ দেননি।
৭ই এপ্রিল, বুধবার
আমি এখন রাত কাটাই অফিসে। বেশ ভালােই জমে আচ্ছা আমাদের। পাকিস্তান অবজারভার আর পূর্ব দেশ দুই অফিস মিলিয়ে জনা দশ পনেরাে আমরা থাকি। নির্ধারিত দিনগুলাে অত্যাচার আর নিপীড়নের শত বাধা ডিঙিয়ে চলে আসে। সাব্যস্ত হলাে চৈত্রের শেষ দিনে রাত বারােটায় আমরা পয়লা বৈশাখ পালন করবাে। গান বাজনা হবে না। খিচুড়ী আর ভুনাগােসত- এই মেনু, সবাই চাঁদা দিলাম তিন টাকা করে। রাত বারােটার সময় অফিসের সবাই মিলে গাইব ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি।
একটা কথা অবশ্য বলা দরকার। সেটা এই: এদিন রাতে সরকারীভাবে জানানাে হয়েছে যে অন্যান্যবারের মতাে বাংলাদেশের জন্যে এবার পয়লা বৈশাখে কোন ছুটি থাকবে না। খবরটা আসার পর মন খারাপ হয়ে গেছিল সবার।
৮ই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার
প্রেস ক্লাবের দুজন বেয়ারা ফিরে এসেছে। ক্লাব চালু হলাে আজ থেকে। কেবল চা পাওয়া যাচ্ছে। ক্লাব খুলেছে। এটাই সবার জন্যে বড়াে খবর। সকাল এগারােটার দিকে ক্লাবে গেলাম। দেখি দুতিনজন বসে আছেন। দেখে বড়াে ভালাে লাগলাে। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছাে। উত্তর দিলেন বন্ধু—এখনাে বেঁচে আছি। কেমন আছছা।” জিজ্ঞাসা করলে ঢাকার শতকরা নিরানব্বইজন এই একই উত্তর দেন। কিছুক্ষণ পর আসলেন ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এনায়েতুল্লা খান। এর মধ্যে দু’একবার তাঁকে দেখেছি রাস্তায়। গাড়িতে যাচ্ছিলেন। চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের অর্ডার দিলেন। ধোয়া ছেড়ে বললেন তােপের মুখ থেকে ফিরে এসেছি। দিন পাঁচ ছয় আগে মিলিটারী তাকে ও তার স্ত্রীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছিল। ঘটনাটা তার বয়ানেতেই শােনা যাক” রাত তখন এগারােটা হবে। আমার স্ত্রী আমাকে ফিসফিস করে বলল, বােধহয় মিলিটারী আসছে। আমি বললাম আরে কিছু না, মিলিটারী কেন আসবে এখানে। বলে আমি আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী খানিক পরে আবার ফিসফিস করে বলল নিশ্চয়ই মিলিটারী আসছে। এবার থাকতে পারলাম না বিছানায়। উঠে লাইট জ্বালিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে যা দেখলাম তাতে আমার গা শিউরে উঠলাে। দেখি প্রায় জন তিরিশেক মিলিটারী আমার লনে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির দিকে এগুচ্ছে।
৪৬
একটু পরেই দরজার কড়া নড়ে উঠলাে। আমার স্ত্রী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। যিনি ঘরে ঢুকলেন তিনি বেশ উচ্চপদস্থ অফিসার। ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন হলিডের সম্পাদক কোথায়। আমার স্ত্রী বললেন আমি হলিডের সম্পাদক। এনায়েতুল্লাহ খান কোথায়? আমি পাশেই ছিলাম বললাম আমিই সেই ব্যক্তি। তারা আমাকে নিয়ে গেলাে পাশের ছােট কামরায়। হাত পা বেঁধে মাটিতে ফেলে জিজ্ঞাসা করলাে— বললা তাজুদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, খােন্দকার মােশতাক এরা কোথায়? আমি বললাম ওরা কোথায় তা বলা তাে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের লােক হিসেবে তাদের সাথে আমার আলাপ পরিচয় আছে, তবে এখন তারা কোথায় আছে তা আমি কী করে বলি।
ইতিমধ্যে একজন লেফটেনেন্ট এসে আমার পায়ে একটা লাথি মারলাে। আর বলল তােমরা দুজনেই চটপট তৈরি হয়ে নাও। তােমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে আরাে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ছিলাে তাদের একটি আস্তানা। আমাদের দুজনকে পৃথক পৃথক ভাবে একজন কর্নেল অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, পরে তিনি ক্ষমা চাইলেন এজন্যে যে রাতের বেলায় তারা আমাদের দ্রিার ব্যাঘাত করেছেন। আসার আগে অবশ্য কফি খাওয়ালেন এবং গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন।” ঘটনা শুনে উপস্থিত সবাই স্বীকার করলেন যে সত্যিই তিনি তােপের মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন।
৯ই এপ্রিল, শুক্রবার
সকালে উঠতেই প্ল্যান করেছিলাম ইকবাল হল, জগন্নাথ হল ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে আসবাে। জগন্নাথ হলে যে কী পরিমাণ গােলাগুলি চলেছে তা বাইরে থেকে দেখলেই বােঝা যায়। বিরাট বিরাট গর্ত দেয়ালে। এখানে ওখানে দরজা জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে আছে। ভেতরেও জিনিসপত্র সব ওলটপালট হয়ে আছে। ইকবাল হলেও একই অবস্থা। এখানে অবশ্য গােলাগুলি আরাে বেশি হয়েছে। কারণ মিলিটারী মনে করেছিল ছাত্ররা পাল্টা গুলি চালাবে। বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে শিক্ষকরা কেউ নেই। ড: জি সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড: মনিরুজ্জামান সহ প্রায় চৌদ্দজন সহকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর কোন সাহসে তারা কোয়ার্টারে ফিরে আসবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যুগ শেষ হয়ে গেছে অন্য আরেকজনের মৃত্যুর সাথে সাথে। তিনি হচ্ছেন সবার প্রিয় মধুদা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনের মালিক। তার বাবা ছিলেন এর মালিক। বাবা বুড়াে হয়ে যাবার পর ভার নিলেন তিনি। মধুদার সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউ এবং এক মেয়ে। মিলিটারী অবশ্য ভালাে কাজ করেছে কাউকে জীবিত রাখেনি। মধুদার মৃত্যু সংবাদ দিলাম কয়েকদিন আগে এক বন্ধুকে। সে বললে, “তুমি পাগল নাকি। মধুদা কী করেছে, মিলিটারী মধুদাকে মারবে কেন?” কথাটা সে বিশ্বাস করলাে না এবং যে মধুদার ও তার পরিবারের সবার মৃতদেহ পাঁচ ছয়দিন ধরে কেউ ছোঁয়নি।
১০ই এপ্রিল, শনিবার
ঢাকা শহর ছেড়ে লােকজন কেবল চলেই যাচ্ছে। চারদিকে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। অফিস আদালতে শতকরা দশ পনেরাে ভাগ লােক যাচ্ছেন, সরকারী বাস চলছে, তাও তিনটে চারটে পর্যন্ত। ইতিমধ্যে অবশ্য কারফিউ মেয়াদ শিথিল করে রাত নটা থেকে ভাের পাঁচটা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি নেই। রেডিওতে সরকার বলছেন অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বিপনি কেন্দ্রে ক্রেতার ভিড় ভেড়েছে অনেক। কলকারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে সবই মিথ্যা। বারাে তেরাে লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে তিন চার লাখ লােক শহরে বাস করছে। আজকে ই পি আই ডি সি অফিসে গেছিলাম। এক বন্ধু ওখানে উঁচু পােস্টে কাজ করে। জিজ্ঞাসা করলাম, তােদের ওখানে অ্যাটেনডেন্স কী রকম। ও বললে শতকরা পঁচিশভাগ হতে পারে। সবাই অফিসে গিয়ে চা খায় আর কোন রেডিও বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলছে বা কোথায় মিলিটারী লুঠ করলাে বা আগুন লাগালাে ও নিয়ে আলাপ করে। একটা ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যাচ্ছে না।
১১ই এপ্রিল, রবিবার
লােকজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখলাম। পাকিস্তান রেডিও কেউ শােনে না। আকাশ বাণী ভয়েস অব আমেরিকা বি বি সি এগুলােই সবাই শােনে। কারাে কারাে বাসায় নাকি ছেলে মেয়েরা চার্ট তৈরি করে
৪৭
নিয়েছে। যখন আকাশ বাণীর খবর কখন ভয়েস অব আমেরিকা বা বি বি সির সংবাদ সব ডাটা লেখা আছে। এছাড়া স্বাধীন বাংলা রেডিও শােনার ব্যাপারেও জনগণের প্রচুর আগ্রহ লক্ষ্য করলাম।
১২ই এপ্রিল সােমবার
“খ” এলাকার সামরিক প্রশাসক লে: জেনারেল টিক্কা খান আজ প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে শপথ নিলেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব বি এ সিদ্দিকী। বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সময় তিনি টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই অপমানের শােধ এখন বন্দুক দেখিয়ে টিক্কা খান নিচ্ছেন। বেলা প্রায় একটা বাজে। যাচ্ছিলাম জিন্নাহ অ্যাভিনুর দিকে। দেখি সে এক এলাহি ব্যাপার। গভর্ণর ভবনের সামনে থেকে বায়তুল মােকাররাম মসজিদ পর্যন্ত কয়েকশাে মিলিটারী মেশিনগান নিয়ে মাটিতে উবু হয়ে আছে। খবর পেলাম নতুন গভর্ণর জুম্মার নামাজ আদায় করবেন। গিয়ে দেখি মসজিদের সিঁড়িতেও মেশিনগান পেতে শুয়ে আছে মিলিটারী। দুপুর বেলায় রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হল যে, শপথ অনুষ্ঠানের পর নতুন গভর্ণর জনগণের সাথে অতি সহজ ও অন্তরঙ্গ পরিবেশে জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন। এ খবর শুনে কে একজন আছাড় দিয়ে তার রেডিও ভেঙে ফেলেছেন বলে এক খবর পাওয়া গেছে।
১৩ই এপ্রিল, মঙ্গলবার
বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা কেবল বেড়েই চলেছে। অবাঙালিদের পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন। সরকারের দালালগােষ্ঠী গঠন করেছে শান্তি কমিটি। এতে রয়েছে খাজা খায়রুদ্দীন, কাউন্সিল মুসলিম লীগের শফিকুল ইসলাম, জামাতে ইসলামের গােলাম আজম পি ডি পির মাহমুদ আলী অ্যাডভােকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ। আজ এই কমিটির উদ্যোগে বাঙালি ও অবাঙালিদের এক যৌথ শান্তি মিছিল বের করা হবে। বায়তুল মােকাররম থেকে বেশ বড় মিছিল হয়েছিল, ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এতে বাঙালিরা যােগদান করেনি, উপরে উল্লেখিত নেতৃবর্গ ছাড়া আমি বাঙালির চেহারাও দেখতে পাইনি। ফেস্টুন, ব্যানার ও স্লোগানের ভাষা ছিল উর্দু।
১৪ই এপ্রিল, বুধবার
আজকে একটা সিনেমা দেখতে গেছিলাম। দুটি শাে করে প্রতিদিন চলছে। বেলা একটা থেকে তিনটা ও সাড়ে তিনটা থেকে ছটা সিনেমা হলে বাংলাভাষা কানে আসলাে মাত্র দুএকবার। বাকী সবের ভাষা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। ছবিও সব উর্দু আর পাঞ্জাবী।
১৫ই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার
শহরে কদিন ধরে জোর গুজব কিছু একটা হবে। কিন্তু কী হবে বা কারা করবে কেউ বলতে পারে না। আজ সারা রাত তাস পিটিয়েছি। না কোথাও কিছু হয়নি। কেবল রাতের বেলায় মিলিটারী গাড়ির আওয়াজ ও মাঝে মধ্যে দুএকটা গুলির আওয়াজ। আমার এক বন্ধু ভলােই বলেছিল আজকাল বাজারে স্লিপিং পিল ট্যাংকুলাইজার ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে না। একটা গুলির আওয়াজ ব্যস ঘুম আসতে আর একটু দেরী হয় না। ইদানীং নাকি সে বেশ ঘুমুচ্ছে।
১৬ই এপ্রিল, শুক্রবার
আমাকে আজকে নদীর ওপাশে জিঞ্জিরায় পাঠানাে হয়েছিল। দেখে এসে কী অবস্থা চলছে তা রিপাের্ট করতে হবে। এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে গেছিলাম। দেখে আসলাম। কয়েকশ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে আছে। ভাঙা চোরা ঘর বাড়ি ও ভয়াবহুল জনগণ। বাজারে কেনাকাটা কিছু কিছু হচ্ছে, কিন্তু সবার মধ্যেই অনাবশ্যক তাড়াহুড়াে। এখানে প্রায় কয়েক হাজার লােক প্রাণ হারায় সেনাবাহিনীর হাতে।
রিপাের্টে লিখতে হলাে জিঞ্জিরায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, লােকজনের মুখে কোন আতঙ্কের চিহ্ন নেই। বাজারে নানাবিধ পণ্যের প্রচুর সমারােহ ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা কথা বলে রাখা
৪৮
দরকার—এ রিপোের্টও ছাপানাে যায় না। সরকারী সীল মােহর লাগে। তাতে লেখা থাকে সেন্সরড। ইচ্ছামতাে তারা রিপাের্ট বদলান। ঢাকার সব কাগজে এখন স্টাফ রিপাের্টারের খবর এভাবেই বেরুচ্ছে। বাকী সব তাে এজেন্সি আর ওদেরই পাঠাননা খবর।
সন্ধ্যায় অফিসে গিয়ে শুনি কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির তিনজন সদস্যকে কে বা কারা গুলী করে মেরেছে। এর মধ্যে পি ডি পি অ্যাডভােকেট শফিকুর রহমান রয়েছেন। অনেকে হত্যাকারীদের অভিনন্দন জানালেন।
১৭ই এপ্রিল, শনিবার
কারফিউর সময় আরাে শিথিল করে রাত সাড়ে দশটা থেকে ভাের পাঁচটায় কমিয়ে আনা হয়েছে। এতেও অবস্থার কোন উন্নতি নেই। দোকানপাট তিনটার মধ্যে সব বন্ধ, গাড়ি ঘােড়া চলাচলও থাকে না। কেবল যাদের নিজেদের গাড়ি আছে তারা এক আধটু এদিক ওদিক যান, তাও সন্ধ্যে সাতটার পর রাস্তাঘাট জনশূন্য। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি কদাচিৎ দেখা যায়। মােট কথা এতটুকু ঝুঁকি নিতে কেউ রাজী না, সবাই যেন পাথরের মূর্তির মতাে ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছে।
১৮ই এপ্রিল, রবিবার
অফিসে এসে দেখি একটা লোেক হাউ মাউ করে কাঁদছে। কী ব্যাপার। কোথায় নির্জন জায়গায় পেয়ে এক দল মিলিটারী তাকে একটা গাড়িতে তুলে নেয়। এবং রক্ত নিয়ে একেবারে সাদা করে ছেড়ে দিয়েছে। এখন লােকটা কাঁদছে, তার ধারণা সে মরে যাবে। কিছুদিন আগে আমরা গুজব শুনতে পাচ্ছিলাম যে, মিলিটারী ধরে ধরে রক্ত নিচ্ছে। খুব একটা আমল দেইনি কথাটার। এখন দেখছি সত্যি। এর মানে হচ্ছে আহতের সংখ্যা ওদেরও কম নয়। মিলিটারী হাসপাতালের রক্তে কুলােচ্ছে না।
১৯শে এপ্রিল, সােমবার
অফিস যাইনি আজ। বাসায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এভাবে জীবনযাপন করার চাইতে মুক্তিসংগ্রামে যদি এতটুকু সাহায্য করতে পারি তা অনেক ভালাে। অন্তত চিরদিনের জন্য নিজের বিবেকের কাছে ধিকৃত হবাে । মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম যে কয়েকদিনের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে।
২০শে এপ্রিল, মঙ্গলবার
আজ শুনলাম, মিলিটারী এখন শহরের উপকণ্ঠে নির্জন এলাকায় ঘরে ঘরে ঢুকে মা বােনদের ইজ্জতের উপর হামলা করছে। এ ধরনের অনেকগুলাে ঘটনা সামরিক আইন প্রশাসকের গােচরীভূত করা হয়েছে বলেও শােনা গেল।
২৫শে এপ্রিল, রবিবার
কাল রাত অফিসে কাটিয়েছি। সকাল আটটায় বাস। ঢাকা কুমিল্লা বাস চলছে এখন। সকালে উঠেই তৈরি হয়েই নিলাম। রাতেই ব্যাগ নিয়ে এসেছিলাম। অফিসের দুজন জানতাে আমি যাচ্ছি। তারা বিদায় জানালেন।
দেশ
২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮