সােমবারের বিমান যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ
(দর্পণের রণাঙ্গণ সংবাদদাতা)
বিমান যুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক গত সােমবার (বাইশে নভেম্বর) ঘটে গেল পশ্চিম বাংলার আকাশে। কলকাতা থেকে মাত্র চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে বয়ড়া সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি। বেলা তখন তিনটে, শীতের আকাশে এক খণ্ড মেঘও নেই।
প্রথমে কিছু শিশুরা লক্ষ করেছিল দূরে বাংলাদেশের দিকে কয়েকখানা পাকিস্তানি বিমান; মনে হয় যেন ভারতের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে থাকে যত বিমানগুলাে কাছাকাছি এসে পড়ে। সর্বসমেত চারখানা বিমান।
খুব বেশি উঁচুতে ওরা ছিল না, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। যারা জানে তারা বলল, ‘পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর স্যাবার জঙ্গিবিমান। সংখ্যায় চারটি। কী কাণ্ড একেবারে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে এল যে! কী করতে চায় ওরা?
সীমান্ত এলাকা বরাবর লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের শিবির। লােকেরা জটলা করে দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপার কী দেখতে। কিছুদিন থেকেই ওদের মনে হয়েছে আবহাওয়া উত্তপ্ত। ওদেরই ক্যাম্প থেকে অনেক তরুণের দল চলে গেছে মুক্তি বাহিনীতে যুদ্ধ করতে। খবরও নিত্য এসে পৌছুচ্ছে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক আগ্রাসী বাহিনীর নাজেহাল হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে। ওদের সকলেরই মুখে এক কথা : ‘শেষে কি পাকিস্তান পাকভারত যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে না কি?’
চারটি পাক জঙ্গি বিমানের উপস্থিতি তাই ওদের মনে আশঙ্কা জাগায়। ওরা এত নিচু দিয়েই বা যায় কেন? ‘বােধ হয় ছবি তুলতে এসেছে’ কেউ কেউ বলে।
হঠাৎ কামানের গর্জন, পর পর অনেক আওয়াজ। আর সারা আকাশ ভরে যায় ছােট ছােট ধোয়ার কুণ্ডলীতে। ভারতীয় বিমান বিধ্বংস কামানের গােলা।
বিদ্রি প্রহরায় নিযুক্ত এই কামানের দল সারা সীমান্ত এলাকা জুড়ে পাহারা দিয়ে চলেছে গত কয়েকমাস ধরে। আর সদাজাগ্রত হয়ে বসে আছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
কামানের গােলার সঙ্গে সঙ্গে চারটি ভারতীয় জঙ্গি বিমান হঠাৎ আকাশে হাজির হয়। পাকিস্তানিরা গােলা ছুঁড়তে শুরু করে তাদের বিমান থেকে ভারতীয় বিমান লক্ষ করে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে মরণপণ প্রত্যুত্তর।
নিচে দাঁড়াল হাজার হাজার উৎসুক জনতা বিমান যুদ্ধের পরিণতির কথা চিন্তা না করেই সমস্ত লক্ষ করছে। হঠাৎ গােলার আঘাতে ঘায়েল হলাে একটি পাকিস্তানি বিমান। সশব্দে ফেটে গেল বিমানটি আর আগুনের ডেলা নিচে পড়তে লাগল।এই অবস্থায় আরও তিনটি পাক জঙ্গি বিমান কেমন যেন ভীত মনে হলাে। ওরা পালাতে চেষ্টা করল। অনেক কায়দা করল ওরা, কখনও ওপরে উঠছে সােজা খাড়াই হয়ে, আবার ল্যাঠা মাছের মতাে মাথা নিচু করে নেমে আসে।
পেছনে তাড়া করা ভারতীয় বিমানের দল ছাড়ার পাত্র নয়। সমানে গুলি করে চলেছে।
হঠাৎ দুটো পাকিস্তানি বিমানে আগুন ধরে গেল তার বিমান দুইটি থেকে দু’জন পাইলট লাফিয়ে পড়ল মহাশূন্যে। কিছু পরে তাদের প্যারাসুটের ছাতা খুলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভারতীয় কামান নীরব হয়ে গেল। বােধ হয় পাকিস্তানি বৈমানিকরা আহত হতে পারে এই আশঙ্কায়। ভারতীয় বিমানেরাও গােলা ছােড়া ইতিমধ্যে বন্ধ করেছে। এই ফাঁকে একটি পাকিস্তানি বিমান দ্রুত পালিয়ে বাঁচল।
পাকিস্তানি দুই বৈমানিক নিরাপদেই স্থলে পৌছুল। ওদের নাম ফ্লাইং লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহদী কুরেশী এবং ফ্লাইং অফিসার খলিল আহমদ।
ওরা ধরা পড়ল ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর হাতে। কাছাকাছি কোনাে ভিড়ে এগুতে পারল না। ভিড়ের হাতে পড়লে ওদের আর নিস্তার ছিল না।
পারভেজের কপালে সামান্য আঘাত লেগেছিল আর খলিলের বিশেষ কিছুই হয়নি। ওদের কলকাতায় আনা হয়েছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হেফাজতে।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে মুজিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পাক বাহিনী অনেক দিন থেকেই ট্যাঙ্ক ও বিমান আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এবার মুজিব বাহিনী দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাক বাহিনীর অবস্থা সঙ্গীন। মনে হয় পাক বিমানের অবস্থা বুঝতে এসেছিল আর ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। যে শিক্ষা পেয়েছে তাতে ওদের সম্বিত ফিরে আসার কথা।
চারটি বিমানের তিনটে পনের মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল। যুদ্ধে এ এক প্রায় অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রতিহিংসায় পাক বিমান বাহিনী ঢাকা ও আশেপাশের শহরাঞ্চলে বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে। সাধারণ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় এই আক্রমণ। শােনা যায় হাজার হাজার লােক মরছে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ওদের একমাত্র বন্দর ‘চালনা’ অকেজো হয়ে পড়েছে মুক্তি বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে।
গত রবিবার একটি গ্রিক মালবাহী জাহাজ আসছিল চালনা বন্দরের দিকে, বােধ হয় কাঁচা পাট বােঝাই করতে। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে জাহাজ ডুবে যায় আর বন্দরের কাছাকাছি নদীগর্ভে আটকে যায়। ঐ জাহাজ না ওঠানাে পর্যন্ত আর নদীতে জাহাজ চলাচলের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থাও সঙ্গীন। মােট চৌদ্দটির জেটির মধ্যে বারটি অকেজো হয়ে গেছে। পুড়ে আছে মাত্র দুটি। ঐ বন্দর বেশি দিন চালানাে যাবে না।
পশ্চিমাঞ্চলে মরণপণ সংগ্রাম চলছে যশােহর আর খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায়। পাকিস্তানিরা ট্যাঙ্ক এবং আরও নানা ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বেপরােয়া ব্যবহার করে চলেছে। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ শুধু অব্যাহতই নয়, দিনের পর দিন আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুক্তি বাহিনীর খবরে প্রকাশ যে, কমপক্ষে তেরটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক যশােরের চৌগাছা অঞ্চলে ঘায়েল হয়েছে। ওরা বিধ্বস্ত ট্যাঙ্ক ছেড়ে পালিয়েছে।
খুলনার সাতক্ষীরা মহকুমা শহর এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে। কামানের অবিশ্রান্ত গােলাবর্ষণের শব্দ এখন সমস্ত পশ্চিম সীমানা জুড়ে শােনা যাচ্ছে। ও পাশ থেকে ছিটকে আসা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গেল পাক বাহিনী সবখানেই নাস্তানাবুদ।
সূত্র: দর্পণ
২৬.১১.১৯৭১