বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের শেষ সংবাদ
বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য বাহিনী বিপর্যস্ত ও পলায়মান
(দর্পণের রাজনৈতিক সংবাদদাতা)
পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চল ঘুরে এবং বিভিন্ন ওয়াকিবহাল মহলের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে এই কথা পরিষ্কার যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী অথবা বাংলাদেশ মুজিব বাহিনী অবিলম্বে পাকিস্তানি আগ্রাসী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সম্মুখ সমরে নামছে না।
মুক্তি বাহিনীর তরফ থেকে এক প্রভাবশালী কমান্ডার আমাকে বলেছেন যে, এখন ওদের বিভিন্ন এলাকায় সমস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে যুদ্ধে লিপ্ত করে দেয়ার শক্তি আছে, কিন্তু সেই কার্যক্রমে তারা এখনই নিযুক্ত হওয়ার কথা চিন্তা করছে না দুটি কারণে : (এক) এই ধরনের সরাসরি যুদ্ধের ফলে মনােবল বিধ্বস্ত পাকিস্তানি বাহিনী আরও বেশি সাধারণ নাগরিক হত্যায় নেমে পড়বে এবং (দুই) পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন অংশে যে মতভেদ ও ভাঙন দেখা যাচ্ছে ব্যাপক যুদ্ধের কৌশল সেই ভাঙনের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণের অনুকূল নয়।
সম্প্রতি চৌগাছায় যে ট্যাঙ্ক যুদ্ধ হয়ে গেল সেই ব্যাপারে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকা এবং যশাের শাখার মধ্যে খবরাখবর বিনিময়ের কিছু গােপন সংবাদ সংগ্রহ করেছে। এই সংবাদ অনুযায়ী, ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের একাংশ অবিলম্বে ব্যাপক যুদ্ধের আদেশ দিয়েছিল এবং বলেছিল যে, প্রয়ােজন বােধে পাকিস্তান বাহিনী পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে।
কিন্তু এই আদেশ নিচু স্তরের সেনানায়করা অবান্তর বলে মনে করে এবং এদের ধারণা যে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের মুক্তি বাহিনীর প্রতি সক্রিয় সমর্থন সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নেই।
রংপুর থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত পায় পাঁচশ মাইল জুড়ে মুক্তিবাহিনীর নতুন তৎপরতায় পাকিস্তানি আগ্রাসী বাহিনীর নাজেহাল অবস্থা, বেশির ভাগ অঞ্চলেই পাকিস্তানি সৈন্যেরা মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের মুখে সবকিছু ছেড়ে পলায়নে তৎপর।
রংপুর জেলায় বুড়িগঙ্গা এবং তৎসংলগ্ন প্রায় আড়াই হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিরাট এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের ও মুক্তি বাহিনীর নতুন হেড কোয়ার্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি এক সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই নতুন প্রশাসন কেন্দ্রে পতাকা উত্তোলন করে এসেছেন।
অনুরূপভাবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেব এই সপ্তাহে গেছেন সাতক্ষীরা সফরে। সাতক্ষীরা শহর বাদে, সমগ্র অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা সংগঠনের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বর্তমান সফর।
সরকার এবং মুক্তি বাহিনীর তরফ থেকে দর্পণকে জানানাে হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার এখন বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠায় এবং বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার কাজে বেশি করে মনােনিবেশ করবে।
সরকারি এই কর্মনীতির সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম সংযুক্ত। অর্থাৎ এই সমস্ত ঘাঁটি এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন এলাকার ক্রম-সম্প্রসারণই মুক্তি বাহিনীর এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
অবশ্য সারা বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনী গেরিলা ও কমান্ডােদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। তাদের লক্ষ্য হবে পাকিস্তানি আগ্রাসী বাহিনীকে সমস্ত অঞ্চলে বিপর্যস্ত করা এবং সৈন্যবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করা।
মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে এক ঊর্ধ্বতন কমান্ডার দর্পণের সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, এখনই যশাের ক্যান্টনমেন্টের সমস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা ও ঢাকা যশাের রােড ধ্বংস করা মুক্তি বাহিনীর পক্ষে মােটেই শক্ত নয়। কিন্তু এই কৌশল এখনই মুক্তি বাহিনী নিচ্ছে না, কারণ ঢাকা যশাের রােড বিধ্বস্ত হলে ওদের আর পালানাের পথ থাকবে না, ওরা মরিয়া হয়ে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কাজে নেমে পড়বে।
ইতিমধ্যে ঢাকা যশাের রােড ধরে সৈন্য বাহিনীর পরিবারবর্গ যারা এতদিন যশাের ক্যান্টনমেন্টে বাস করছিল তারা পালাতে শুরু করেছে। এই পলায়মান পরিবারবর্গের ওপর মুক্তি বাহিনী কোনাে আক্রমণই করবে না।
অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর সাধারণ সৈন্যরা যখন এই রাস্তা ধরে পালাতে শুরু করবে তখনও মুক্তিবাহিনী ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনাে হামলা চালাবে না।
মুক্তি বাহিনীর ধারণা যে, পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর সম্ভারে যুদ্ধাস্ত্রের কোনাে অভাব নেই, তাদের যা অভাব তা হলাে মনােবল। আর এই অভাব পূরণ করার ক্ষমতা পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নেই।
সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়ালি খাঁর (খান) নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ বেআইনি ঘােষণা করেছে। এই পার্টি পাঞ্জাব বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ প্রভাবশালী। সামরিক কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠছে।
এই সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতারা সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। তাঁরা জানেন যে, পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর একটি শক্তিশালী অংশ গঠিত হয়েছে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের নিয়ে। এই আন্দোলন অবশ্যই এই সমস্ত অঞ্চল থেকে নেয়া সৈন্যবাহিনীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবে। এই প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং তার বহু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।
সূত্র: দর্পণ
০৩.১২.১৯৭১