You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.03 | ইয়াহিয়ার বেসামাল অবস্থা | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার বেসামাল অবস্থা
(দর্পণের পর্যবেক্ষক)

পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা (খান) স্কচ হুইস্কি নামক পানীয়ের বিশেষ অনুরক্ত। এ কোনাে ভারতীয় দেশপ্রেমজনিত অলীক কল্পনা নয়, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য।
পানদোষ দোষ নয়, অধিকমাত্রায় ঘটলে বড়জোর পাগলামী বলা চলে যার প্রকাশ ঘটে অসংলগ্ন বাক্যে। যেমন গত সপ্তাহে ইসলামাবাদে চীনা দূতাবাসের ভােজসভায় খাঁ সাহেব ঘােষণা করে বসলেন যে, আগামী দশ দিনের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বিরাট যুদ্ধ শুরু হবে যার পরিচালনা করবেন তিনি নিজে রাজধানী থেকে বহুদূরে রণক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে। যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা অবশ্য ইয়াহিয়ার একার নয়। সুদূর ফরাসি দেশে সত্তরােত্তর বৃদ্ধ আঁদ্রে মালরােও তাে চেয়েছেন একখানি ট্যাঙ্ক যাতে চেপে তিনি মদদ দিতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধাদের। তফাত এই যে, যে স্থলে মালরাে মানবিকতাবােধে উদ্দীপ্ত ইয়াহিয়া সেইখানে নিজ নাদিরশাহী বংশ গৌরবে মত্ত হয়ে পরিকল্পনা করছেন আরও মৃত্যুর আরও ধ্বংসের। যে সমস্যা একান্তভাবেই তার নিজের সৃষ্ট তার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দোষারােপ করে তিনি আজ ঘােষণা করতে চাইছেন জেহাদ। এর ফলাফল যে কী মারাত্মক হতে পারে চৌগাছা ও অন্যত্র অভিজ্ঞতা বােধ হয় এখনও তাঁকে তা শেখাতে পারেনি।
তবে খাঁ সাহেব যে সর্বদা একই কথা বলেন তা নয়। উপরিল্লিখিত ভােজসভার কিছুদিন আগে তিনি নিজ রাজধানীতে বসেই জনৈক সাংবাদিকের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাতুলতা মাত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে মনে হয় তিনি বুঝেছেন যে, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে’, ‘কাফেরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করতে হবে’ এই ধরনের হুঙ্কারের মাধ্যমেই একমাত্র নিজ দেশবাসীসহ বিশ্বের কিছু শক্তিকে অন্তত মূল সমস্যা সম্পর্কে বিস্মৃত করে দিতে পারা যাবে এবং অনেকাংশে তিনি তা পেরেছেন। ইঙ্গ মার্কিন সংবাদপত্রগুলাের দিল্লীস্থ সংবাদদাতাদের প্রতিবেদন। দিনের পর দিন নিজ নিজ সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ইন্ডিয়ান আর্মি ডিজগাইজড অ্যাজ গেরিলা ইনডেভ ইস্ট বেঙ্গল’ (মুক্তিযােদ্ধার ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যদল পূর্ব বাংলা আক্রমণ করছে) এই ধরনের শিরােনামা নিয়ে উপছে পড়ছে। (প্রসঙ্গত আশ্চর্য লাগে ভারত সরকারের ভগবান বুদ্ধসুলভ আচরণ। এসব সাংবাদিকরা এই ধরনের মিথ্যা প্রচারান্তেও ঘুরে বেড়াতে পারছে দেশের যত্রতত্র)। অপরদিকে পাকিস্তান রেডিও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে নিয়ে বলছে এগুলাে ঘটেছে ভারতীয় সৈন্যদের হাতে।
ইয়াহিয়া এখানে একটা বড় ভুল করেছেন। সর্ব ব্যাপারে ভারতকে দোষারােপ করা প্রােপাগান্ডা হিসেবে কিছুটা কার্যকরী হলেও তার নিজের ভবিষ্যত রক্ষায় কতখানি কার্যকরী হবে? তিনি এখনও মুক্তিবাহিনীর সামরিক সাংগঠনিক পটুতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকাটাই শ্রেয় মনে করেন তবে এই তরফে যে বিরাট আঘাত আসবে তাকে রােখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের উদ্দেশ্য যদি মুক্তি বাহিনীর দ্বারা সাধিত হয় তবে কী প্রয়ােজন তার যুদ্ধে যাওয়ার? খাঁ সাহেব যদি এখনও বাস্তবের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ছায়ার সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকেন তবে তার ইন্তেকাল আসন্ন।
আন্তর্জাতিক সমর্থন ইয়াহিয়া কতখানি পারেন তাও অনিশ্চিত। নিজ স্বার্থ বশতই কোনাে বৃহৎ রাষ্ট্র চাইবে অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে নিজ ভাগ্যকে জড়াতে। মার্কিনীরা আজও বেড়ার উপর বসে ওজন দেখে চলেছে। দাঁড়িপাল্লার যে দিকটা ভারি সেই দিকেই সময় মতন টুক করে নেমে পড়বে। আর চীন? খাঁ সাহেব যতই কেন পিকিংয়ের সমর্থন নিয়ে আস্ফালন করুন শরণার্থীদের জন্য কম্বল পাঠানােতেই চীনের চিন্তাধারার পরিবর্তন ধরা পড়েছে। তা ছাড়া চীন বরাবর বলে এসেছে যে ভারত যদি পাকিস্তানকে আক্রমণ করে তাহলে সে খা সাহেবের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ব্যাপারে তাে পাকিস্তানকে সমর্থন সূচক কিছু বলছে না। বরঞ্চ ইদানিং শােনা যাচ্ছে যে, চীন সরকার বাংলাদেশের সগ্রাম যে জনগণের সগ্রাম তা একটু একটু করে মানতে শুরু করেছেন এবং এই সংগ্রাম সার্থক হলে চীনও নিজস্বার্থ বশত স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করে থাকতে পারবে না— অবশ্য সেই সঙ্গে পাকিস্তানকেও সে সমর্থন জানাতে পারে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে।

সূত্র: দর্পণ
০৩.১২.১৯৭১