You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.23 | ঢাকার অবস্থা সায়গনের থেকে খারাপ- গেরিলা যুদ্ধ ব্যাপক হচ্ছে | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকার অবস্থা সায়গনের থেকে খারাপ
গেরিলা যুদ্ধ ব্যাপক হচ্ছে
(দর্পণের রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

মার্কিন দেশ থেকে এক জাদরেল বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক উইলিয়াম গ্রিফিথ, গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে কলকাতায় এসেছিলেন।
ঢাকায় যা দেখেছেন সেই সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আলােচনা করেন। তাঁর অভিমত : (এক) পূর্ববঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ উত্তরােত্তর ব্যাপক হচ্ছে, আর ঢাকার অবস্থা দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গনের থেকেও খারাপ; (দুই) পূর্ববঙ্গে এখন থেকে নভেম্বরের শেষে আমন ধান না ওঠা পর্যন্ত সাত লক্ষ টন খাদ্যের ঘাটতি।
অধ্যাপক গ্রিফিথ বলেন যে, বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রচুর খাদ্য সম্ভার চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে জাহাজে এসে আটকে পড়েছে। স্থলপথে রেলে কিম্বা লরিতে এই খাদ্য দেশের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, কারণ রেল লাইন গেরিলা বাহিনী অনেকাংশে উপড়ে ফেলেছে। আর রাস্তার অবস্থাও খারাপ কারণ পুল, কালভার্ট সবই একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
একমাত্র নদীপথে ছােট ছােট জাহাজে এই খাদ্য দেশের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু নদীর দু’পাশ থেকে জাহাজের ওপর কামানের গােলা পড়ে। জাহাজ যেতে পারে না।
মুক্তি বাহিনীর এক সেনাপতির সঙ্গে দর্পণের এ ব্যাপারে আলােচনা হয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গে খাদ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। গেরিলা বাহিনী খাদ্য চলাচলে অবশ্যই কোনাে বাধা দেবে না। কিন্তু মুশকিল হলাে, মার্কিনী খাদ্য সরবরাহের নামে জঙ্গিশাহী অস্ত্র পাচার করে। তাই তথাকথিত খাদ্যবাহী জাহাজ আর লরির ওপর গেরিলা আক্রমণ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
অধ্যাপক গ্রিফিথ বলেন যে, মার্কিন রাষ্ট্র সম্প্রতি বিশ লক্ষ ডলার সাহায্য দিয়েছে পাকিস্তান সরকারকে। এই টাকা দিয়ে অন্যান্য দেশের কাছ থেকে নদীতে যাতায়াতের অনুকূল ছােট ছােট জাহাজ
ভাড়া করার জন্য। কিন্তু জাহাজ এলেই বা কী হবে? খাদ্য আনা নেয়ার বিশেষ কোনাে সুবিধে হবে বলে মনে হয় না।
তাই গ্রিফিথের মতে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। আর তাছাড়া যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তাতে পূর্ববঙ্গের অনেকাংশে এখন বন্যা। তার ওপর আবার সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে ঝড়ের আশঙ্কা থাকেই। এর ফলে দুর্ভিক্ষ আরও তীব্রতর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
দুর্ভিক্ষ হলে ভারতে উদ্বাস্তুর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। হয়ত কয়েক মাসে এই সংখ্যা দেড় কোটিতে পরিণত হতে পারে।
আমেরিকার এই বুদ্ধিজীবী ওখানকার প্রভাবশালী মহলের বিশেষ আস্থাভাজন। তাকে বিশেষ উদ্দেশে ঢাকায় পাঠানাে হয়েছিল। তিনি এখানে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন।
ক্ষমতান্ধ সামরিক নেতারা ওকে সাফ কথা বলে দিয়েছে যে, এ ধরনের সমাধান অসম্ভব। কারণ বাঙালিরা স্বাধীনতা ছাড়া কোনাে সমাধানেই রাজি নয়। আর তাছাড়া এখন সমাধানের কথা সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলার অর্থ হলাে বশ্যতা স্বীকার করা।
সমর নেতারা অধ্যাপককে বলেন, আলােচনা করার অর্থ মনের দিক থেকে নিজের অণ্ডকোষ বাদ দিয়ে খােজা হওয়ার সামিল।’
গেরিলা যুদ্ধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যের মনােবল খুব শক্ত বলে মনে হয় না। বহু। সৈন্য সরকারি ভবন পাহারা দিতে আর রাস্তাঘাটে টহল দিতে ব্যস্ত। সৈন্যরা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন।
গেরিলারা এখন হাজারে হাজারে প্রচারপত্র বিলি করে, এমনকি ঢাকা শহরেও। কোনাে আক্রমণের আগে এরা সময় ঘােষণা করে নাগরিকদের সাবধান করে দেয়। ঘােষিত সময়ে এই আক্রমণ শুরু হয়। সামরিক বাহিনীর এই আক্রমণ বন্ধ করার ক্ষমতা নেই।
ঢাকা শহরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাড়ির সামনে, থানার বাইরে এমনকি ইন্টার কন্টিনেন্টাল হােটেলের সামনেও সৈন্য মােতায়েন। শহরের জীবন যাত্রায় অস্বাভাবিক ভাব।
কিছুদিন আগে অধ্যাপক সায়গন গিয়েছিলেন। সেখানে কিন্তু সৈন্যদের মধ্যে এই ত্রাসের ভাব লক্ষ করেন নি। সেখানে কেবলমাত্র প্রেসিডেন্টের বাড়ির সামনে সৈন্য মােতায়েন করা আছে।

সূত্র: দর্পণ
২৩.০৮.১৯৭১