You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | পশ্চিমবঙ্গের নকল মুজিবুরের তালি-মারা মন্ত্রিসভা হচ্ছে | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

পশ্চিমবঙ্গের নকল মুজিবুরের তালি-মারা মন্ত্রিসভা হচ্ছে
(দর্পণের পর্যবেক্ষক)

বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের নকল মুজিবুর কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পায়ে ধরে দেড়হাতি গামছা দিয়ে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন। মবলগ পাঁচ জনের দলনেতা যদি মুখ্যমন্ত্রী হবার বায়না ধরে, তাহলে সেই দেড়হাতি গামছা দিয়ে সামনে ঢাকতে গেলে পেছন উদোম, পেছন ঢাকতে গেলে সামনে খােলা এই করুণ দৃশ্য দেখে কার মন না। বিগলিত হবে?
তবু আমাদের নকল মুজিবুর আকাশে গদা ঘােরাচ্ছেন। আধ ন্যাংটোর বাটপাড়ের ভয় কি? দু’কান কাটা গেলে লােক সমাগমে কে আর লজ্জা পায়?
‘আমি মুজিবুরের মতােই জিতব’ বলে খবরের কাগজের তৈরি এই বীরপুঙ্গবটী হাঁক ছেড়ে বাজার মাত করছিলেন। এবার মুখ্যমন্ত্রীর গদি পাবার লােভে তাঁর গুরু মশাইকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বরানগরে হাঁটু ভাঙা দ’ করেই লােকে তাকে ছেড়ে দেয়নি, সারা পশ্চিমবাংলার লােক অজস্র মিথ্যা কথার হাঁড়ি, গান্ধীবাদী ভেকধারী দ্রলােককে মাথায় ঘােল ঢেলে মােটে পাঁচজনের দল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্ব। তার চাই-ই। ইন্দিরা গান্ধীর দরবারে ধর্ণা দিয়ে অনেক ধুপকাঠি পােড়ানাের পর দেবির আদেশ হয়েছে।
নাহার আমাদের নকল মুজিবুরের কাছে গাে-হারা হেরেছেন। তিনি নাকি অবাঙালি, বাংলাদেশে নাকি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা যায় না। তবে হ্যা, ডেপুটি হতে পারেন।
নকল মুজিবুর কিন্তু তার প্রধান সহকারীকে মন্ত্রিসভায় নিতে পারবেন না বলে কসম খেয়েছেন। সি পি আই বলে দিয়েছে তারা ধাড়ার ধাষ্ঠামাে আর সইবে না। এতােদিনের দুষ্কর্ম সুকর্মের সঙ্গী। আহা! তাকেও ছেড়ে দিতে হলাে গদির লােভে।
বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে সরকার গড়তে দেয়নি, তাকে ও তার দলকে বে-আইনি করে দিয়েছে।
কিন্তু আমাদের নকল মুজিবরকে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার দুশ আশি জনের মধ্যে পাঁচজনের হেঁড়া দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ডেকে মুখ্যমন্ত্রী হবার সুযােগ দিয়েছে। যা তারা সর্ববৃহৎ দলের নেতা জ্যোতি বসুকে দেয়নি। দেখুন না গণতন্ত্রের কী মহান দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান কাউন্সিলপন্থী কনভেনশনপন্থী কোয়ায়েমপন্থী (কাইয়ুম) তিন মুসলিম লীগকেই ধরাশায়ী করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করেছেন। আর আমাদের নকল মুজিবুর বাইশ বছর পর সেই মুসলিম লীগকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে এনে নতুনভাবে দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে পুনরুজ্জীবন করার মহান ব্রত গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর কেন্দ্রীয় সরকারের দখলদার ফৌজের সঙ্গে লড়াই করার জন্যে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে সামরিক বুটের তলায় খুঁড়িয়ে দেবার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে অকুতােভয় সংগ্রাম চালাচ্ছেন। আর আমাদের নকল মুজিবুর কেন্দ্রীয় সরকারের দখলদার বাহিনী সি আর পি ও মিলিটারিকে এপার বাংলার জনগণকে গুঁড়িয়ে দেবার কাজে সােল্লাসে আহ্বান জানাচ্ছেন।
ভণ্ডামি গান্ধীবাদীদের বৈশিষ্ট্য বলে যারা মনে করেন, তারা এতে আশ্চর্য হবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অত ধৈর্যশীল নাও হতে পারেন। তবু দেড়হাতি গামছা মার্কা মন্ত্রিসভায় অসংখ্য তালি মারতে হয়েছে। মেদিনীপুরের ছটি থানা ভবিষ্যতে ঝাড়খণ্ড প্রদেশ গঠিত হলে ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার, মুসলিম লীগকে কৃষি, শিল্পবাণিজ্য, এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিজ দপ্তর ছাড়াও আরাে দু-চারটি দপ্তর ছেড়ে দেবার অঙ্গীকার, সবেধন নীলমণি এস এস পি সদস্য কাশীকান্ত মৈত্রকে খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তর দিয়ে চালের দর বাড়াবার বন্দোবস্ত করার অঙ্গীকার, সুশীল ধাড়াকে মন্ত্রী না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সি পি আইকে খুশি করার অঙ্গীকার, গাইবাছুর আর চরকাধারিণীকে একত্র মেলাবার অঙ্গীকার, পি এস পি ভগ্নাংশকেও তৈলপ্রদানের আশ্বাস–এতগুলাে তালিমারার পরও আমাদের নকল মুজিবুর ফরওয়ার্ড ব্লককে ওপর তাপ্পি দিয়েছেন ছয় মাসের মধ্যে আবার নির্বাচন করা হবে!
নব কংগ্রেসের রথীমহারথীরা যার হাতে হুঁকো রেখে তামাক খাবেন, সেই নকল মুজিবুরের এতে কোনাে লজ্জা নেই। সি পি এমকে পেটাবার জন্যে তার হাত নিসপিস করছে।
কিন্তু তাতেও ঝামেলা। বিধানসভার অধিবেশন ডাকলে কী যে হবে কে জানে? গুরু প্রফুল্ল ঘােষ না হয় করুণাময় ঈশ্বরের অপার করুণায় বেঁচে গিয়েছিলেন। নকল মুজিবুর কী করে তা সামলাবেন? তবে হ্যা, ইয়াহিয়া খানের আওয়ামী লীগকে বে-আইনি করার মতাে সি পি এমকে বে-আইনি করে দিয়ে, তার সব এম এল একে গ্রেপ্তার করে শূন্য বিধান সভা চালালে কেমন হয়?
ভালােই হয়। আমাদের অপূর্ব সংবিধানের গাই বাছুর গােয়ালিনী মার্কা গণতন্ত্র যে কেমন চিজ, খােলা চোখে লােকে তা দেখবার সুযােগ পায়।
আর কনিষ্ঠ ভ্রাতা দামুর নেতৃত্বে গাই বাছুর মার্কা ক্যুনিস্ট পার্টিকে আদি কংগ্রেসের পায়ের তলায় ঠেসে দেওয়া যায়। যেমন তিনি বরানগরে দিয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়াশীল প্রফুল্ল সেনের পদতলে শ্রীবিশ্বনাথ মুখুজ্যেকে বেমানান লাগবে না। তার দলের ও রকম অভ্যাস হয়ে গেছে সাতষট্টি সালে জনসংঘ, স্বতন্ত্র দলের সঙ্গে ঘর করে। এখানেও একটি জনসংঘ আছে, একটি এস এস পি ও দুটি আদি কংগ্রেস রয়েছে নৈবেদ্যর মাছি হিসেবে।
আর ফরওয়ার্ড ব্লক? এ দলে তাে কর্মী নেই, শুধু নেতা। সৈন্য নেই খালি জেনারেল! এতগুলাে জেনারেল পাঁচ বছর ধরে বেকার বসে থাকবেন, তাতাে হতে পারে না! সুতরাং তাদেরও আশ্বাস চাই, ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে।
নব কংগ্রেসের তরুণ নেতারাও অধীর। বেলা যে যায়। এবার যদি মন্ত্রী না হতে পারি, আর তাে সময় পাওয়া যাবে না। একটা নব বাংলা কংগ্রেস করলে কেমন হয়? ঝিকিমিকি চিন্তা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে।
পিটার জামুয়েলি একদা স্পেক্টেটর পত্রিকায় লিখেছিলেন, যতরকম ভণ্ডামি আছে তার মধ্যে ভণ্ডের শাস্ত্ৰবাক্য আওড়ানােটা একদম অসহ্য।
আমাদের নকল মুজিবুরও বাংলাদেশের মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছেন।
অপমানের আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে তাকে মুখ্যমন্ত্রীর শিরােপা দিয়েছিলেন সাতষট্টি, ঊনসত্তর সালে যে বাংলাদেশের মানুষ আজ তাদের কামড়ে দেবার সারমেয় বৃত্তি তিনি অবলম্বন করছেন। আবার তাকে আস্তাকুঁড়েই ফিরে যেতে দেখলে কে আর অবাক হবে?

সূত্র: দর্পণ
০২.০৪.১৯৭১